স্বস্তি

স্বস্তি
অদিতি ভট্টাচার্য
ন’টার সময় বাস ছাড়বে হোটেলের সামনে থেকে, গত কাল রাতেই বলে দেওয়া হয়েছিল। সকালে খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়ে যখন বাসের সামনে এলাম, তখনও ন’টা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি, বাসে লোক প্রায় নেই বললেই চলে। শুভাশিসবাবু দেখলাম ব্যস্ত হয়ে দৌড়োদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গের ছেলেটাকে খালি হোটেলের ভেতরে পাঠাচ্ছেন, বোধহয় তাড়া দিয়ে সবাইকে বার করতে।
আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বললেন, “ঘর ঠিক ছিল তো? কোন অসুবিধে হয়নি তো? আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে পারব আশা করছি। চল্লিশজন লোককে একসঙ্গে নিয়ে বেরোনো, বুঝতেই তো পারছেন, একটু আধটু দেরি হবেই, তার মধ্যে আবার বয়স্ক মানুষও তো আছেন ক’জন।”
আমি হেসে “না না ঠিক আছে, ন’টা মানে কি আর ন’টা হয় কখনও” বলে বাসে উঠে পড়লাম। লেকের দিকে জানলার ধারের একটা সিট দখল করলাম। আমার ঠিক সামনের সিটে দুজন বসে আছেন। একজন ভদ্রমহিলা, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ হবে আর একটি অল্প বয়সী মেয়ে। চিনি না, আমার সঙ্গে এখনও কারোরই আলাপ হয়নি। মল্লিকাদি দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন।
এক পর্যটন দলের সঙ্গে নৈনিতাল, রানিক্ষেত, আলমোড়া, চৌকরি, মুন্সিয়ারি ইত্যাদি বেড়াব বলে ভিড়ে পড়েছি। তবে হাওড়া স্টেশন থেকে পুরো নৈনিতাল অবধি এঁদের সঙ্গে আসা হয়নি। দিল্লিতে একটা কাজ ছিল, সেটা সেরে দিল্লি থেকে ট্রেনে গতকাল সন্ধ্যেয় লালকুঁয়া এসে পৌঁছেছি। সেখান থেকে নিয়ে এসে নৈনিতালের এই লেকের ধারের হোটেলে অবশ্য এঁরাই তুলেছেন। এঁরা নিজেরা বোধহয় তার ঘন্টা দুয়েক আগে সদলবলে হাওড়া থেকে কাঠগোদাম হয়ে এখানে এসেছেন। এ দলের সঙ্গে আগেও দু’বার ঘুরেছি, অভিজ্ঞতা ভালোই, তাই আবার এদের সঙ্গেই ভ্রমণের সিদ্ধান্ত। তবে সে দু’বার সহযাত্রীরা সবাই ছিলেন মহিলা। বিভিন্ন বয়সের শুধু মহিলাদের জন্যেও এই পর্যটন সংস্থার নানান জায়গার ভ্রমণ সূচী আছে। সেসব দলের দায়িত্ব নিয়ে সাধারণত মল্লিকাদি যান, সাহায্যকারী হিসেবে থাকেন শুভাশিসবাবু। খুবই করিৎকর্মা মানুষ দুজনেই। এবারেও সেরকম যাওয়াই স্থির ছিল, কিন্তু কিছু দিন আগে সংস্থার তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে ইচ্ছুক ভ্রমণার্থীদের সংখ্যা এত বেশী যে এবার এই ট্যুরটি অন্তত আর শুধু মহিলাদের জন্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
“প্রায় একই সময়ে দু তিনদিনের আগে পরে দু’টো ট্যুর হচ্ছে। আরেকটাতে অনেক লোক। সত্তর আশীজন তো বটেই, তার বেশীও হতে পারে। কয়েকজনকে বেছে নিয়ে ছোটো আরেকটা গ্রুপ করা হচ্ছে, সেটাতেই আপনাকে নিয়ে যাব। চিন্তা করবেন না, কোনও অসুবিধে হবে না,” ফোন করে মল্লিকাদি নিজেই বলেছিলেন।
আমার কোনওই অসুবিধে নেই, শুধু মাত্র এই কারণে ট্যুর বাতিল করার তো প্রশ্নই নেই।
“কী কাণ্ড তুমিও আছ!”
পাহাড় ঘেরা টলটলে নীল জলের লেকে সূর্যের আলোর খেলা দেখতে ব্যস্ত ছিলাম, কথাটা শুনে একটু চমকে উঠলাম।
প্রশ্নকর্ত্রী ধপ করে আমার পাশেই বসে পড়ে হাঁফাতে লাগলেন। তবে সে কারণে কিন্তু তাঁর কথা বলার বিরাম নেই, “ছেলে, বৌ জোর করে ঢুকিয়ে দিল, তোমার কাকুকে তো জানোই, বাড়ি থেকে নড়তে চায় না, এক রাত্তির আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে হলে তার গায়ে জ্বর আসে, এত দূরে সে যে বেড়াতে আসবে না বলাই বাহুল্য! এমন কুঁড়ে আর ঘরকুনো মানুষ বাপের জন্মে দেখিনি! শুধু বাড়ি আর অফিস এই করেই জীবন কাটিয়েছে। এখন শুধু ওই বাড়িই। ছেলে বলল, ‘তুমি কেন ঘুরবে না মা, তুমি যাও,’ তাই আসা। তা তখন জানতাম শুধু মহিলারা আছে, ব্যাটাছেলেরা থাকবে না, পরে জানলাম তা নয়। তাতে অবশ্য অসুবিধে নেই, বিদেশ বিভুঁই, ক’টা ব্যাটাছেলে থাকা ভালো। ওই যে সামনে দেখছ না একটি অল্প বয়স্ক ছেলে আর তার বৌ বসে আছে, ওই ছেলেটির মার সঙ্গে আমি একটা ঘর পেয়েছি। জিজ্ঞেস করেই দিয়েছে অবশ্যি, ইচ্ছে করলে একা একটা ঘরও পেতাম। বিদেশ বিভুঁই, একা থাকা পোষাবে না আমার। তবে ব্যবস্থা ভালোই। হবে না? কত টাকা নিচ্ছে! তুমি কি একাই? ট্রেনে তো তোমাকে দেখলাম না?” একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে তবে তিনি থামলেন।
অলকা কাকীমা। এক সময়ে আমাদের পাড়ায় থাকতেন, বহু কাল আর নেইও। তবে এক শহরে থাকলে যা হয়, মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়েই যায়। আমাদের পাড়ার দু-একজনের সঙ্গে ওঁর বেশ সখ্য আছে, তাই যাতায়াতও আছে। আমি কিন্তু প্রমাদ গণলাম। ইনি সর্বক্ষণ আমার পাশে থাকলে বেড়ানোর মজাই মাটি। অন্তত আমার। কারণ আমি বেড়াতে এসে বেড়াতেই ভালোবাসি, সাংসারিক গল্পগাছা আর পরচর্চা নয়। অথচ এ দুটো বিষয়ই অলকা কাকীমার সবচেয়ে পছন্দের।
“হ্যাঁ এ যাত্রা একাই। মাঝে মধ্যে তো এরকম বেরোই আমি। দিল্লিতে একটা কাজে এসেছিলাম, সেখান থেকে কাল সন্ধ্যেয় এসেছি,” সংক্ষেপে সারলাম আমি।
“আছ ভালোই। আমাদের মতো সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন গেল না! ওই ছেলেটির বৌ চাকরি করে, ছেলেটির মাও করতেন। ইস্কুলে। দশটা কথা বললে যদি একটির উত্তর দেন! মুখ বন্ধ করে কী করে যে থাকেন বুঝি না! আমি তো বাবা পারি না। তুমি কি একাই একটা ঘরে আছ?”
“হ্যাঁ। আমি সেরকমই বলে নিয়েছি।”
বাস ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। নৈনিতালের সব দ্রষ্টব্য আজ আমরা ঘুরে দেখব। আমার সামনের সিটের মেয়েটি দেখলাম সিট থেকে উঠল, মাথার ওপরের বাঙ্ক থেকে একটা ছোটো ব্যাগ নামাল। তখনই লক্ষ্য করলাম মেয়েটার হাতের পাতাদুটোয় পুড়ে যাওয়ার বীভৎস ক্ষত। বাঙ্ক থেকে ব্যাগটা নামাতে সোয়েটারের হাতা দুটোও একটু উঠে গেছিল, পোড়ার চিহ্ন সেখানেও। অলকা কাকীমার চোখ গোলগোল হয়ে উঠল। স্থূলকায় চেহারা, একটুতেই হাঁফিয়ে যান, তাও হাঁচোড় পাচোঁড় করে সিট থেকে উঠলেন এবং অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে ঝুঁকে পড়ে সামনের সিটের যে দুজন বসে আছেন তাঁদের দেখলেন। আমার অনুমান মেয়েটিকেই। মুখ তো তখন দেখতে পাননি ঠিক করে, তাই এই প্রচেষ্টা।
“কিছু বলছেন?” সামনে সিটের ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
“না না কিছু নয়,” অলকাকাকীমা আর বসার কোনও চেষ্টাই করলেন না। বললেন, “দেখি ওই দিকে যাই, জানলার ধার পেলে ভালো।”
আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
নয়নাদেবীর মন্দিরের সামনে বাস থামল। মন্দির চত্বরের বাইরে বড়ো পার্কিং প্লেস। বাস দাঁড়াল সেখানেই। বাস থেকে একে একে নেমে সবাই মন্দিরে ঢুকল। কথিত আছে সতীর চোখ পড়েছিল এখানে, তাই সতীর একান্ন পীঠের একটি এটিও। কিন্তু তা হলেও বেশ ছিমছাম, ছোট্ট সুন্দর মন্দির, পুজো দেওয়ার জন্যে কোনওরকম জোর জবরদস্তি নেই দেখে ভালো লাগল। যাঁদের ইচ্ছে তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ পথের দু ধারের দোকান থেকে ডালা কিনে নিয়ে গেলেন। আমি ছোট্ট মন্দিরে ছোট্ট দেবী প্রতিমাকে দর্শন করে একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে দাঁড়ালাম, জলের ধারে। রেলিং দিয়ে ঘেরা মন্দির চত্বরটি, যেন লেকের ওপরেই। অক্টোবরের সকালের রোদ যেন গায়েই লাগছে না, সবাই সোয়েটার, শালে নিজেদের আবৃত করে রেখেছেন। দেখলাম এক আমি ছাড়া সবাই পুজো দিলেন। আমার ভূমিকা এখানে শুধু ছবি তোলার আর দেখে যাওয়ার। প্রকৃতি, মানুষ – সবই। নিজের মনে, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। এখানেই প্রথম ভালোভাবে দেখলাম আমার সহযাত্রীদের, যাদের সঙ্গে দিন পনেরো ঘুরে বেড়ানোর সূচী। লক্ষ্য করলাম একলা বেরিয়ে পড়েছি আমি আর অলকা কাকীমাই। বাকিরা কারোর না কারোর সঙ্গে এসেছেন। যেমন অলকা কাকীমা যে ভদ্রমহিলার সঙ্গে থাকছেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর পুত্র, পুত্রবধূ আর পাঁচ ছ’বছরের নাতনি আছে। আরো একটি দম্পতি দেখলাম, বয়স্ক, বুঝলাম স্বামী স্ত্রীতে বেরিয়ে পড়েছেন। এছাড়া আছেন আমার সামনের সিটের ওই ভদ্রমহিলা এবং তাঁর সঙ্গের মেয়েটি। দলের বাকি ত্রিশজন এসেছেন শুনলাম পুরুলিয়া থেকে। প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পূর্ব পরিচিত। যেহেতু তাঁরাই দলে ভারি, তাই বাকিদের সঙ্গে আলাপ করার তেমন আগ্রহ তাঁদের নেই। পুজো দেওয়ার জন্যে প্রায় সকলেই উপোস করে ছিলেন। মল্লিকাদি তাঁদের আবার পার্কিং লটে নিয়ে গেলেন, ওখানেই জলখাবারের ব্যবস্থা।
“আধ ঘন্টা পরে বাস ছাড়ব, চলে আসবেন ঠিক। তবে আরো এক কাপ চা যদি চান তাহলে আগে আসবেন কিন্তু,” আমাকে বলে চলে গেলেন মল্লিকাদি।
এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না, কিন্তু লেক ছেড়ে নড়তেও ইচ্ছে করছে না।
“ম্যাডাম দেখলাম পুজোও দিলেন না, খেতেও গেলেন না, ব্যাপার কী?”
ফিরে তাকালাম। প্রশ্নকর্তা হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে। সেই বয়স্ক ভদ্রলোক, সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও আছেন।
বললাম,“না ওদিকে তেমন উৎসাহ নেই, যতটা প্রকৃতির শোভা দেখায়। আর জলখাবার? সে খেয়েই বেরিয়েছি। মল্লিকাদি জানেন, তাই জলখাবার সকালে হোটেলের ঘরেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আপনারা খেলেন না?”
“আমাদেরও ওই একই ব্যাপার,” এবার ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন, “খালি পেটে থাকতে পারি না, সকাল থেকেই তো ওষুধ খাওয়া শুরু। খেয়ে এসেছি। পুজো বলতে পঞ্চাশটা টাকা দিলাম বাক্সে, বড়ো ভালো লাগল এখানে এসে, তাই না?”
“ঠিক বলেছেন, নৈনিতাল খুব সুন্দর, আর কোথাও না ঘুরে লেকের সামনে বসেও বোধহয় কাটিয়ে দেওয়া যায়।”
ভদ্রলোক বোধহয় কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, হল না। রাজু চা নিয়ে এসেছে। শুভাশিসবাবু ক’কাপ চা দিয়ে এখানেই পাঠিয়ে দিয়েছেন।
“না ব্যবস্থা দেখছি বেশ ভালো। মনটা চা চা করছিল, চা এসে গেল,” গরম চায়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে বললেন ভদ্রলোক।
নাম পরিচয় জানতেও দেরি হল না। সুরঞ্জন বসু আর মীরা বসু।
আমার সামনের সিটের ভদ্রমহিলা দেখলাম ধীর পায়ে আবার মন্দিরে এসে একটা সিঁড়িতে বসলেন। দেখে মনে হল যেন নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে আছেন ভেতরের মূর্তির দিকে, সে দৃষ্টিতে যেন আকুতিও আছে। মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়ে।
“ইনি এসে আবার এখানে বসলেন? চা খেয়ে তো আবার বাসে ওঠার কথা,” মীরা বললেন।
“সবাই কেনাকাটা করতে ব্যস্ত। তোমরা তো এখানেই দাঁড়িয়ে রইলে, ওদিকে গেলেই না, ভুটিয়ারা চমৎকার সব জিনিস বিক্রি করছে। সবাই ওদিকেই গেছে। ম্যানেজার ভদ্রলোকও গেলেন তাগাদা দিতে।”
অলকা কাকীমা। হাঁফাতে হাঁফাতে যথাসাধ্য দ্রুত আসার চেষ্টা করছেন।
“আপনি কেনাকাটা করবেন না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“করব না কেন? নিশ্চয়ই করব, দরদাম করলে সস্তায় পাওয়া যাবে যখন। কিন্তু তোমাকে একটা দরকারি খবর দেওয়ার ছিল। তাই আবার দৌড়তে দৌড়তে এলাম। এদিকে একটু এসো তো,” অলকা কাকীমা স্থান, কাল, পাত্র বিচার করেন না। আগেও দেখেছি। কারোর সম্পর্কে কোনও খবর সংগ্রহ করতে পারলে, সেটা যদি মুখরোচক হয় তো কথাই নেই, সেটা ততক্ষণাৎ পরিচিতদের না শোনাতে পারলে নিশ্চিন্ত বোধ করেন না। এখানে পরিচিত বলতে একা আমিই, তাই আমাকে শুনিয়েই কর্তব্য পালন করবেন।
“কী হল?” আমি অস্বস্তিতে, কিঞ্চিৎ বিরক্তও।
“আগে শোনো, তারপর বোলো কী হল,” উত্তেজনায় অলকা কাকীমার কন্ঠস্বর বিকৃত, “ওই যে ওই মহিলা, তোমার সামনের সিটে বসেছিলেন, যার সঙ্গে একটা মেয়ে আছে না, হাতদুটো পোড়া, সেই মহিলার কথা বলছি……”
“কিন্তু আমি শুনে কী করব? ওঁরাও বেড়াতে এসেছেন আমাদের মতোই,” আমি ওঁকে থামাতে চাইলাম।
কিন্তু বৃথা আমার চেষ্টা, অলকা কাকীমাকে থামানো অত সহজ নয়, “আগে শোনো কী বলছি, তারপর বোলো শুনে কী করব। তোমাকে চিনি, তাই বলা আমার কর্তব্য, জনে জনে তো আর বলতে যাচ্ছি না। ওই মহিলা, মন্দিরের সিঁড়িতে অমন করে বসে আছে দেখে ভেবে বোসো না খুব ভক্তিমতী। ও মহিলার জন্ম কোথায় জানো? জেলে! মানে জেলের ভেতরে। বুঝলে? ওর মাকে খুনের দায়ে পুলিশে ধরেছিল, ও তখন পেটে, জেলেই হয়েছে।”
সুন্দর ঝকঝকে সকাল, সোনালি নরম রোদ চারপাশে ছড়িয়ে, এক পাশে পাহাড়ের কোলে লেক, সামনে নয়নাদেবীর মন্দির – এ পরিবেশে অলকা কাকীমার কথাটা কীরকম বেখাপ্পা শোনাল। একটু থতমতও খেলাম। সামনেই মন্দিরের সিঁড়িতে যে ভদ্রমহিলা বসে আছেন তাঁকে দেখে আর পাঁচজন ওই বয়সের সাধারণ মহিলার মতোই মনে হয়, বরং সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, সেটা সাধরণের চেয়ে বোধহয় একটু বেশীই এবং বয়স তাকে খুব একটা কাবুও করতে পারেনি।
আমার বিস্মিত চোখজোড়া ভদ্রমহিলা থেকে ঘুরে এসে অলকা কাকীমার মুখের ওপর স্থির হল, বললাম, “এত সব কথা জানলেন কী করে? কে বলল আপনাকে?”
“একটা বিয়ে বাড়িতে দেখেছিলাম একে, সঙ্গে ওই মেয়েটাও ছিল। হাতদুটো যা! একবার দেখলেই আর ভোলা যায় না! কবে সেটা? এই তো শ্রাবণের শেষের দিকে। যার মেয়ের বিয়েতে দেখেছিলাম, তাকেই ফোন করলাম। আমার খুব পরিচিত, সবই বলল। তা যা বলছি শোনো, সাবধানে থেকো বাবা, বিদেশ বিভুঁইয়ে একা বেড়াচ্ছো, মা খুনী, মেয়েও যে নয় তা……”
কথা শেষ হল না, মল্লিকাদি এসেছেন ডাকতে, “চলুন চলুন সব। বাস ছাড়বে।”
আর কথা এগোল না। আমরা মল্লিকাদির পেছন পেছন চললাম। মন্দিরের সিঁড়ি থেকে ওই ভদ্রমহিলাও উঠে এসেছেন। সবার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে আর “পারি না বাবা, এত হাঁটাহাঁটি!” করতে করতে অলকা কাকীমা।
বাসের কাছে এসে দেখলাম শুভাশিসবাবু প্রাণপণে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে কেনাকাটার আরো সময় পাওয়া যাবে। ফেরার পথে তো আবার নৈনিতালে আসতে হবে, পুরো আধবেলা সময় থাকবে শুধু কেনাকাটার জন্যেই। সে যুক্তিতে যে সকলে খুব প্রসন্ন তা নয়। তবে মানতে হল, কারণ সবে তো বেড়ানো শুরু।
অলকা কাকীমা আর আমার পাশে বসেননি দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। নাহলে আরো কত কী খবর দিতেন কে জানে! উনি পুরুলিয়ার ত্রিশজনের দলে ভিড়ে গেছেন। ওখানেই ওঁর ভালো লাগার কথা, কারণ নানান বয়সের মানুষ মিলে হাসি গল্পে, হৈ হল্লায় ওঁরাই বাস মাতিয়ে রাখছেন। নৈনিতাল সুন্দর শহর, তার দ্রষ্টব্য দেখানোর আয়োজনও সুন্দর করেই করেছে আমাদের পর্যটন সংস্থা, তবুও যখনই ওই ভদ্রমহিলার দিকে নজর গেছে, মনে হয়েছে এঁর জন্ম হাজতে! কাকে হত্যা করেছিলেন এঁর মা? কেনই বা? মনের ভেতর কৌতূহল জন্মেছে, আবার নিজেই তাকে শাসন করে দমিয়েছি তাকে। অলকা কাকীমাই যে সঠিক বলছেন তারই বা নিশ্চয়তা কী?
ভদ্রমহিলার নাম নমিতা সিংহ। আলাপ হল হঠাৎ। পথে বাসের মধ্যেই ভদ্রমহিলা হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছিলেন। গা গুলোচ্ছিল। অস্বাভাবিক কিছু নয়, পাহাড়ি পথে এরকম অনেকেরই হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে তো এনেছিলেন, কিন্তু বেরোবার সময়ে মেয়েটি তা ব্যাগে রাখতে ভুলে গেছে, সে ওষুধ পড়ে আছে হোটেলের ঘরেই। ওঁদের ঠিক পেছনের সিটেই আমি বসেছিলাম, ওষুধও ছিল আমার কাছে, দেরি না করে দিলাম। ভদ্রমহিলার অস্বস্তির নিরসন হল, ধন্যবাদ দিলেন হাসিমুখে, আলাপও করলেন। মেয়েটি ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী, নাম কাকলি।
“আমার মেয়ের মতোই বলতে পারো। সব সময় আমার সঙ্গেই আছে,” বললেন নমিতা।
এরপরও টুকটাক কথা হয়েছে। কাকলি এই প্রথম নিজের শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও এসেছে। যা দেখে তাতেই সে মুদ্ধ, বিস্মিত। আর সে সব নমিতাকে না বলেও শান্তি পায় না। তাই দু তিন মিনিট অন্তর অন্তর তার উচ্ছ্বসিত স্বরে “ও জেঠি দেখো কী সুন্দর!” “পাহাড় এরকম হয় বুঝি!” “জলটা কীরকম দেখো!” ইত্যাদি কানে আসছিল।
ঘুরতে ঘুরতে দিনের শেষে আবিষ্কার করলাম যেটুকু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে আমার এ ক’ঘন্টায় তা সুরঞ্জন, মীরা আর নমিতার সঙ্গেই। নমিতার ওই চাঞ্চল্যকর অতীত জেনেও।
হোটেলের সামনে নামতে না নামতেই অলকা কাকীমার হাতে আবার ধরা পড়লাম। প্রথমে উচ্চকন্ঠে জানালেন তিনি এবার থেকে ওই পুরুলিয়ার দলের এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গেই থাকবেন, “অত মুখ বুঝে থাকা আমার সয় না বাপু! দীপক ছেলেটিও বেশ, মাসীমা মাসীমা করে সব সময় খোঁজখবর নিচ্ছে, ওরই পিসির সঙ্গে থাকব। মা, বাবা আছে, নিজে বিয়ে করেছে, নিজের সংসার আছে, তাও পিসির প্রতি কর্তব্য ভোলেনি, সঙ্গে করে এনেছে তো।”
তারপর গলা নামিয়ে বললেন, “খুব তো কথা-টথা বলছ ওই মহিলার সঙ্গে। সাবধানে থেকো। পরে বোলো না কাকীমা কিছু বলেননি।”
অলকা কাকীমার কথাও শেষ হল আর নমিতাও কাকলিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার মুখে যেন হাসির আভাস। আমার বিড়ম্বনার একশেষ।
পরের দিন সকাল সকালই বেরিয়ে যাওয়া, গন্তব্য রানিক্ষেত। রানিক্ষতের ঝুলাদেবীর মন্দিরেও দেখলাম নমিতা ওইভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তন্ময়তা দেখে মনে হল যেন কিছুর উত্তর খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস। জানি না সফল হলেন কি না। সুরঞ্জন আর মীরাও যেন অন্যমনস্ক।
রানিক্ষেতের হোটেলে আমার, নমিতা-কাকলি আর সুরঞ্জন মীরার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল দোতলায় পাশাপাশি তিনটি ঘরে। একতলায় বাকি সবাই। সন্ধ্যেবেলায় সামনে টানা বারান্দায় এসে বসেছিলাম। নীচ থেকে নানার কন্ঠস্বরের নানান আওয়াজ ভেসে আসছে। একজন একটি জনপ্রিয় হিন্দি গান গাইছে। সুরের শুদ্ধতা যে রক্ষিত হচ্ছে সে কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। লক্ষ্য করলাম মীরাও বসে আছেন, একা। বিষণ্ণ মুখে। দেখে কীরকম মন খারাপ লাগল, নিজেকে আটকাতে পারলাম না, কাছে গিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে না তো?”
নিজের জগতে ছিলেন, আমার উপস্থিতি লক্ষ্য করেননি, তাই চমকে উঠে বললেন, “ওহ তুমি! কখন এলে?”
“এই তো। আপনাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে……”
চোখদুটো কি জলে টলটল করে উঠল? নাকি আমারই চোখের ভুল? বারান্দায় আলো অপ্রতুল।
“না কিছু হয়নি।”
কন্ঠস্বরও গতকালের মতো নয়।
“সবাই তো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত, হাসি মজায় মেতে আছে, তাই স্বাভাবিক অবশ্য, বেড়াতে এসে। তবে এ মেয়ের চোখে পড়েছে দেখছি।”
সুরঞ্জন কখন ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এসেছেন বুঝিনি। চেয়ারটা টেনে নিয়ে বললেন, “আজ আমাদের একমাত্র ছেলের মৃত্যুদিন। এক মাত্র সন্তানের। আর্মিতে ছিল। দশ বছর আগে চলে গেছে, কাশ্মীরের ওদিকে পোস্টিং ছিল, ওদিকের অবস্থা তো জানোই। এদিনটায় বাড়িতে থাকতে চাই না, বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু অবস্থা দেখি কিছুই পালটায় না, এত বছর হয়ে গেছে তাও।”
বিনা আয়াসে যেভাবে কথাক’টা বলে গেলেন সুরঞ্জন, আমার মুখে আর কথা জোগাল না। বুঝলাম ভেতরের রক্তক্ষরণকে ভেতরেই রাখার ক্ষমতা এঁদের আছে।
“কী ভাবছ, কীরকম মা বাবা এরা, নিজের মুখে বলে দিল, না কেঁদেকেটে, আটকাল না একটুও!” মীরা বললেন।
মনে হল কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে নিজের অগোচরেই কোনও ক্ষোভ উন্মোচন করলেন।
“উলটো মনে হল,” আমি বললাম, “যেরকম বাবা মা সেরকম সন্তানই তো হবে। এরকম মনের জোর তো আপনাদেরই হবে।”
“লোকে তা বোঝে না,” মীরা ম্লান হাসলেন, “একমাত্র ছেলে চলে গেছে আমাদের কেঁদে কেটে বিছানা নেওয়া উচিত ছিল। এই সবার মত। তা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এটা ওটা করছি।”
টা সহযোগে চা এসে এসে গেছে। শুভাশিসবাবুদের এসব দিকে খুব খেয়াল। সময়ের এতটুকু নড়চড় হয় না। তারপর শীতের জায়গা, বারবার চা, কফিতে তাই কারুরই আপত্তি নেই। রাজু আমারটাও মীরাদের সঙ্গেই রেখে গেল, তারপর একটু ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের ট্রেতে তখনো দু কাপ চা। বুঝলাম নমিতাদের।
“কী হল? কিছু বলবে?” আমিই জিজ্ঞেস করলাম।
“ওনাদের ডাকতে পারলাম না। ওই আপনার পাশের ঘরের মাসীমাকে,” রাজু কোনোরকমে বলল।
“কেন? ডাকতে পারলে না কেন?” আমি অবাক, এ আবার কী কথা!
“আপনারা আসবেন? নাহলে আমি দিদিকে ডেকে আনছি।”
“কী হয়েছে কী? খুলে বলছ না কেন?” সুরঞ্জন এবার ধমকেই উঠলেন।
“আসেন না আমার সঙ্গে,” রাজুর গলায়কাতর মিনতি।
“কী ব্যাপার বোলো তো, চলো গিয়ে দেখি,” সুরঞ্জন উঠে পড়েছেন। সঙ্গে আমরাও।
না, ডাকতে আমরাও পারলাম না। ঘরের দরজা বন্ধ আর দরজার ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। হালকা, কিন্তু স্পষ্ট কান্নারই আওয়াজ। কাকলির। নমিতা মনে হল সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কাকলিকে তো একটু আগে নীচে যেতে দেখলাম, এর মধ্যে কী হল?
“তুমি চাপা দিয়ে চা রেখে যাও, আমরা দেখছি,” বললেন মীরা।
রাজু সব রেখে দিয়ে চলে গেল, মনে হল বাঁচল।
সুরঞ্জন সরে এলেন, মীরা বেল টিপলেন।
নমিতা খুললেন দরজা।
“চা দিয়ে গেছে। দোতলায় তো আমরা এইক’জনই, আসুন না একসঙ্গে বসে খাই। ক’দিন তো একসঙ্গেই থাকতে হবে,” একেবারে স্বাভাবিক গলায় বললেন মীরা।
নমিতা এ অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। বারান্দায় এলেন। একটু পরে কাকলিও এল, যদিও সে স্বাভাবিক নয়।
“তুমি টিভি দেখো গে যাও, আমাদের মহিলা মহলের গল্পে ব্যাঘাত ঘটিও না,” মীরা সুরঞ্জনকে বললেন।
মুখে ছদ্ম দুঃখের ছাপ ফেলে সুরঞ্জন উঠে গেলেন। হেসে ফেললেন নমিতা, অল্প হলেও সে হাসির ছোঁয়াচ লাগল কাকলির থমথমে মুখেও। আমি দেখছিলাম মীরা আর সুরঞ্জনকে। কত কষ্ট, কত ব্যথা চেপে রেখে এ অভিনয়?
কাকলি নীচে গেছিল, সেখানে কিছু শোনেনি তো? অলকা কাকীমা মুখে যতই বলুন “আমি তো আর জনে জনে বলতে যাচ্ছি না,” ওঁর যা স্বভাব তাতে উলটোটা করাই স্বাভাবিক। বিশেষত দীপক এবং তার পিসিমার সঙ্গে ওঁর যখন এত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে।
কাকলি খুব আড়ষ্ট, হাতদুটো গায়ের চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে বসে আছে, বার করে চায়ের কাপটা তুলতেও যেন রাজ্যের সংকোচ।
“খাও খাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো” বলে বলে মীরাই শেষ পর্যন্ত খাওয়ালেন।
“একসঙ্গে আছি, একসঙ্গে ঘুরছি, আলাপ বলতে এই আপনাদের সঙ্গেই হয়েছে, তাই কোনও অসুবিধে হলে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন, কোনও দ্বিধা করবেন না। দুটো দিন একটু অন্যরকম কাটানো, রোজকার থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়ের থেকে বেরোনর জন্যে আসা। চিন্তা ভাবনা, দুঃখ কষ্ট তো রইলই। এ ক’টা দিন সে সব ভুলে থাকার চেষ্টা, এই আর কী,” দু একটা এদিক ওদিক কথার পরই মীরা বললেন, কথার শেষে দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওঁর, কথার সুরেও ছিল বেদনার ছোঁয়া।
সেটুকু বোধহয় নমিতাও নজর করেছিলেন, তাই হয়তো স্বল্প পরিচয়ের সংকোচ কাটিয়ে, মনের দ্বিধা কাটিয়ে সব বলতে পেরেছিলেন।
“দেখেই আসি না একবার, ছাদ অন্ধকার তো কী হয়েছে, টর্চ আছে তো,” পুরুলিয়া দলের কয়েকজন কলকল করতে করতে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।
তবে উঠে যাওয়ার আগে কয়েক মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল, গভীর মনোযোগে আমাদের নিরীক্ষণ করল এবং নিজেদের মধ্যে ফিসিফিস করে কিছু বলল। নমিতা স্থির দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন আর কাকলি বসে থাকতেই পারল না। উঠে ঘরে চলে গেল।
“কী যে বলি, কত বুঝিয়েছি মেয়েটাকে, কিন্তু বুঝতেই চায় না,” বললেন নমিতা, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এ দলে বেড়াতে এসেছেন একজনের সঙ্গে তোমার আগে থেকেই আলাপ আছে, তাই না?”
উনি অলকা কাকীমার কথা বলছেন, মাথা নাড়ে হ্যাঁ বললাম। এও মনে হল যে আমার অনুমান নির্ভুল। একে তো কাকলির হাতদুটোর ওই অবস্থা, তাই নিয়েই বেচারা সংকুচিত হয়ে থাকে, আমরাও তো খুব সভ্য ভদ্র, এরকম কিছু দেখলে হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকাই উচিত মনে করি, তার ওপর নমিতার জন্ম সম্পর্কিত তথ্য, নীচে নিশ্চয়ই আলোচনা পুরো দমে চলছে।
“জানি উনি তোমাকে কী বলেছেন। ছোটো থেকেই দেখি যেখানেই যাই না কেন এ খবরটা ঠিক আমার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে। শুধু একবারই কয়েক দিন পরে এসেছিল, আমার বিয়ের সময়,” নমিতা বললেন, “লোকে অবাক হয়ে শুনবে, আলোচনা করবে – এ আর আশ্চর্যের কী? কার আর হয় এরকম?”
সেই হিমেল সন্ধ্যেতে, বারান্দার ম্লান আলোতে বসে সামনের হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গকে সাক্ষী রেখে নমিতা সহজ কথায় শুনিয়েছিলেন নিজের জীবন কাহিনি, কাকলিরও। একে ওপরের ভরসার স্থল হয়ে ওঠার গল্পও।
নমিতার মার বিয়ে হয়েছিল উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়িতে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর, ননদ নিয়ে এক বৃহৎ পরিবারে। ছোটো ননদ নমিতার মার প্রায় সমবয়সীই ছিলেন এবং এই বৌদিটির প্রতি অত্যধিক অসূয়াপরায়ণ। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও তিনি নমিতার মার ওপর দোষারোপ করতেন এবং নিজের মার কাছে লাগাতেন। শ্বশুর শাশুড়িও এই পুত্রবধূটির ওপর যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ তার বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্ব তালাশটা এঁদের মর্যাদা অনুপাতে করা হত না। অন্তত এঁরা তাই মনে করতেন। ফলে মানসিক নির্যাতনের কমতি ছিল না। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ সেই ননদটি মারা গেলেন। অস্বাভাবিক মৃত্যু। বিষাক্ত কিছু খেয়েছিলেন। জানা গেল বিষ তাঁর খাবারে মিশ্রিত ছিল, খাবারের থালা আবার নমিতার মা নিজে হাতে তাঁর ঘরে দিয়ে এসেছিলেন। শাশুড়ি সারা পাড়া উচ্চকিত করে জানালেন এ কাজ নিঃসন্দেহে নমিতার মারই, ননদকে সে সহ্য করতে পারত না, নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে খুন করেছে। শ্বশুরেরও তাইই মত। নমিতার মা সে সময় অন্তঃসত্ত্বা, যে কোনও সময়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে, এমনই অবস্থা। না, এ অবস্থাতেও তাঁকে বাপের বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাই অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন, সে সন্ধ্যেতেই নমিতার মার স্থান হল হাজতে। নমিতার বাবা নাকি একাধারে ছোটো বোনের মৃত্যু, স্ত্রীর ওপর হত্যার আরোপ – এ দুয়ের আঘাতে এতই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলেন যে কিছু করে উঠতে পারেননি।
পরের দিন ভোর রাতে হাজতেই নমিতার জন্ম। পরে অবশ্য নমিতার মা বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন। যা করার ওঁর বাবা, ভাইরাই করেছিলেন। ওঁর ননদ মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না, এর আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন, প্রতিবেশীরাই আদালতে সে কথা বলেছিলেন। বিষাক্ত কীটনাশকও তিনিই সংগ্রহ করেছিলেন, সে সাক্ষীও ছিল। পক্ষান্তরে নমিতার মা শুধু থালাটা নিয়ে গেছিলেন, খাবার বেড়ে দিয়েছিলেন ওঁর শাশুড়ি। আদালত নমিতার মাকে সম্পূর্ণ নিরাপরাধ প্রমাণ করলেও সংসার ছাড় দিল না। বৌদির নিষ্ঠুর ব্যবহারই যে তাঁর ছোটো মেয়ের আত্মহত্যার কারণ এ কথা ওঁর শাশুড়ি সব সময় বলতেন। অভিযোগ আরও ছিল, পরপর তিন মেয়ের জন্ম দেওয়া। নমিতার মা এসব শুনেই দিন কাটিয়েছেন। উনিশ বছর হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গেল নমিতার। অবশ্যই জন্মস্থানের কথা গোপন করে। তবে বিয়ের পর কী করে যেন সবাই জানতে পেরেছে, তখন তাঁদের আফসোসের অন্ত ছিল না। ছাড়েননি অসিতও, নমিতার স্বামী। কোনও কারণে মতান্তর হলেই এ কথা উঠে আসত। জেলেখানায় যার জন্ম সে তো এরকম হবেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
চলছিল এরকম করেই। এক ছেলে নমিতার, রূপক। সমস্যা চরম আকারে দেখা দিল তার বিয়ের পর। পুত্রবধূ সোহিনীও এ খবর জানত। নমিতার তাতে কিছু অসুবিধে ছিল না, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন একদিন নাতি নাতনির মুখেও শুনতে হবে। সমস্যা হল কাকলিকে নিয়ে। কাকলি অনেক দিন নমিতার কাছে কাজ করছে। যে বেচারার জীবনও কিছু সুখের নয়। তার বাপ মা উত্তরবঙ্গের কোন গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একেবারেই হুট করে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। কাকলির বয়স তখন মেরেকেটে পনেরো। কোনো দাবি দাওয়া নেই ছেলের, এত সহজে একটা মেয়ে পার করা যাচ্ছে – এ সুযোগ কেউ ছাড়ে কখনো? বছর খানেকও ঘর করেনি লোকটার সঙ্গে কাকলি, যে তাকে ভুলিয়েভালিয়ে রেখে এল এক নরকে। কাকলির কপাল ভালো বলতে হবে। সে সময়ে খুব ধর পাকড় হচ্ছিল, পাচার হওয়া অনেক মেয়েকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, কাকলিও ছিল তার মধ্যে। কাকলির বাড়ির লোক কাকলিকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেনি, নিজেদের ঘরেই একটু ঠাঁই দিয়েছিল। ওর স্বামীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি বলা বাহুল্য। দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়। লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করতে শুরু করেছিল কাকলি। এক বাড়িতে ভাতের গরম ফ্যান পড়ে গেছিল দুটো হাতের ওপর। সে ঘটনার চিহ্ন স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে কাকলির দুটো হাতে।
সোহিনীকে ওই হাতেই একটা ছোট্ট উপহার দিতে এসেছিল কাকলি, সোহিনীর বিয়ের পর। ঘেন্নায় চোখমুখ কুঁচকে গেছিল সোহিনীর। উপহার সে নেয়নি, নমিতার অনুরোধ সত্ত্বেও। সেই শুরু অশান্তির। কাকলিকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে হবে।
কিছু দিনের মধ্যেই অসিত গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। কাকলি এক বাড়ি কাজ ছেড়ে নমিতার সঙ্গে সব সামলেছে। টাকা পয়সার দিকে নমিতাও কার্পণ্য করেননি ঠিকই, কিন্তু কাকলি যা করেছে তা খুব কম লোকই করে। সোহিনী তো একগোছা ফুল আর গেট ওয়েল সুন লেখা একখানা কার্ড দিয়েই দায় সেরেছিল। এক বাড়িতে থেকেও। কোথাও যাওয়ার না থাকলে সে দোতলায় নিজের ঘর থেকে একতলায় পদার্পণও করত না। অসিত সে যাত্রা আর সুস্থ হননি, এ দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছিলেন। অশান্তি আরও বাড়ল তারপর। কাকলিকে দেখলেই নাকি সোহিনী অসুস্থ বোধ করে। কাকলির পূর্ব ইতিহাসও সে তখন জেনে গেছে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। একে পাচার হওয়া মেয়ে, তার ওপর হাতদুটো অমন বীভৎসভাবে পোড়া – কাকলিকে কাজে রাখা চলবে না কিছুতেই। নমিতা শুধু মাত্র এই কারণে ওকে বরখাস্ত করতে পারেননি, ওর উপকার ভুলতে পারেননি। কাকলি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল, নমিতাই আটকেছেন। রূপক আর সোহিনী যখন স্পষ্ট জানিয়েছে কাকলি কাজ করলে তারা এ বাড়িতে থাকবে না, নমিতা তখনও অনড়। মনে হয়েছে আজ কাকলিকে নিয়ে এরকম করছে কাল আরেকটা কিছু নিয়ে করবে না তো? কাকলি কাজ না করলেও কি ওরা এ বাড়িতে থাকত? সম্পর্কের তিক্ততা কি শুধু কাকলির জন্যেই? অন্য কোনও কারণ নেই? রূপকরা চলে গেল, নমিতার সঙ্গে সম্পর্কও ত্যাগ করল বলতে গেলে। লোকে ছিছিক্কার করল নমিতাকেই। কেউ করে এ কাজ! ওই জেলখানায় জন্ম বলেই বোধহয়! কাকলি অন্যান্য সব বাড়ির কাজ ছেড়ে রাত দিন ওঁর কাছেই থাকতে শুরু করল। নমিতাকে কুটোটি নাড়তে দেয় না, অসুস্থ হলে সেবা যত্নের কমতি হয় না। ওই পোড়া হাতেই সব সামলায়।
“কিছু দিন থেকে যেন হাঁফিয়ে উঠেছিলাম, তাই বেড়াতে আসা। অনেক দিন কোথাও যাওয়াও হয়নি। তাই কি আসতে চায়? বলে ‘আমাকে নিয়ে যাবে তুমি জেঠি? পয়সা খরচ করে?’ কত বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। মাঝে মাঝে বুঝে পাই না ভুল করলাম না ঠিক। একমাত্র ছেলে, ছেলের বৌ, তারা যদি অন্যায় জেদও করে, না মেনে নিয়ে কি ঠিক করলাম?” নমিতার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মীরার মুখের ওপরেই।
মীরা উত্তর দিলেন না, পালটা প্রশ্ন করলেন, “কাকলিকে নাহয় ছাড়িয়ে দিলেন কিন্তু তারা যদি কোনও দিন আপনার সঙ্গেই থাকতে অস্বীকার করত আপনার জন্মস্থানের কথা তুলে? একমাত্র ছেলে, ছেলের বৌ ঠিকই কিন্তু তারা কি কোনওদিন খুব কাছের ছিল আপনার?”
“না। একেবারেই না। বুঝেই উঠতে পারলাম না তাদের। তাদের চোখে আমার মা দাগী আসামী, তাঁর মেয়ে বলে আমিও। সোহিনী তো কোনওদিনই সহজ হতে পারেনি, ছেলেও যেন কেমন দূরের হয়ে যাচ্ছিল। তুমি কী বলো? তুমি তো আমাদের থেকে অনেকটাই ছোটো,” নমিতা এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি অন্য কথা ভাবছি,” বললাম আমি, “এদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছি, বাকি ক’টা দিন এদের সঙ্গেই ঘুরতে হবে। ওই একত্রিশজন কী করল, কী বলল তা নিয়ে কেন আমরা মাথা ঘামাব? করুক ওরা ফিসফাস, আমরা গ্রাহ্যই করব না। দেখুক ওরা, ওদের দৃষ্টির উত্তরে আমরা ফিরিয়ে দেব উপেক্ষা। কাকলিকে বলুন, না হলে আমিই বোঝাব।”
নমিতা বোধহয় এরকম সমর্থন আশা করেননি, দুজন এরকম স্বল্প পরিচিতের কাছ থেকে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন, মনের গহনে ভাবের খেলার কারুকার্য শুধু ফুটে উঠছিল মুখে, চোখদুটোতে, তারপর বললেন, “এই প্রথম কেউ এরকম করে বলল। এসে ভুল করিনি দেখছি।”
“এই বেলা বরং বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বরগুলো নিয়ে রাখা ভালো। ফিরে গিয়েও যোগাযোগ থাকবে তাহলে,” মীরা বললেন।
আমাদের বেড়ানো বোধহয় এরপর থেকেই ঠিক শুরু হল। সারাদিন ঘোরাঘুরিতে কারোর উৎসাহের কমতি নজরে আসেনি, আনন্দ ছিল ভরপুর। খাওয়ার পর কাকলি হাজির তার আমলকি শুকনো আর জোয়ান নিয়ে। সন্ধ্যের পর চায়ের সঙ্গে আলুভাজাও কাকলিই জোগায়। সে নাকি ঝিরিঝিরি করে আলু কুটে ভেজে রাখে কৌটোয় শক্ত করে মুখ বন্ধ করে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে এসব।
সেসব খেয়ে তো সুরঞ্জন মুগ্ধ, “এরকম করে আমলকি শুকিয়ে রাখতেন আমার মা। কত খুঁজে খুঁজে ভালো আমলকি নিয়ে এলাম, সে আমাদের রজনীদেবীর হাতে পড়ে যা হল! এমন নুন মাখিয়েছে যে মুখে দেওয়া যায় না! সব ফেলা গেল। ফিরতে দাও, আলু আর আমলকি নিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে।”
আলমোড়া, চৌকরি, মুন্সিয়ারি হয়ে আবার যখন নৈনিতালে ফিরে এলাম আনন্দের এই রেশ রয়ে গেল তখনও। শাল, সোয়েটারের দরদাম নমিতা, কাকলি কেউই করতে পারছেন না, মীরা হাজির মুশকিল আসান হয়ে। দেখেশুনে কাকলির জন্যে সোয়েটার কেনা হল। সে সোয়েটার পরে আমার ক্যামেরার সামনে কাকলি হাসি হাসি মুখে পোজ দিল। সে হাসি ছিল সূর্যের আলোর মতোই উজ্জ্বল। দিনের শেষে হোটেলে ফিরে বারান্দায় বসে গল্প করেছি। আমাদের হাসি, গল্পে আকর্ষিত হয়ে মাঝে মাঝে মল্লিকাদিও চলে এসেছেন। সুরঞ্জন নিজের মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসে বলেছেন, “এখনও সেলফি তোলাটা ঠিক রপ্ত করতে পারলাম না, দেখিয়ে দাও তো।”
বাকি একত্রিশজনের যত কৌতূহল তখন আমাদের পাঁচজনকে ঘিরে।
“এবার থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ঠিক করলে আমাদের বোলো। তুমি যেদিকে যাবে আমরা তোমার পেছন পেছন যাব, বুঝলে?” সুরঞ্জন বলেছেন আমাকে, মীরা, নমিতা সায় দিয়েছেন।
“দিদি থাকলে আমারও সুন্দর সুন্দর ছবি উঠবে,” বলেছে কাকলি।
অলকা কাকীমা অবশ্য তাঁর কর্তব্য পালনে ত্রুটি রাখেননি, একদিন বলেছিলেন, “এত করে সাবধান করলাম, শুনলে না, সেই ওই মহিলার সঙ্গেই লেগে রইলে!”
আমি উত্তর দিইনি, হেসেছি শুধু, উনি যা বোঝার বুঝে গেছেন।
আবার নয়নাদেবীর মন্দির। নমিতা আবার পুজো দিলেন, তবে এবার আর আকুল হয়ে সিঁড়িতে বসে রইলেন না। আমি সে কথা বলাতে বললেন, “উত্তর পেয়ে গেছি তো, তোমরা এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলে যে।”
ওদিকে তখন মীরা কাকলিকে বলছেন, “এসব খাইয়ে খাইয়ে ক’দিনে যা অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছ! ফিরে গিয়ে ঠিকঠাক সাপ্লাই না দিলে আমিই তাগাদা দেব। এসব ব্যাপারে আমাদের আবার একেবারেই লাজলজ্জা নেই কিনা!”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “স্বস্তি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *