তথাগতর পায়ের কাছে
সুপর্ণা চ্যাটার্জী ঘোষাল

“আজু কাম বাটা ফারকিনু ঢিলো হুঞ্ছা।” এক চামচ স্যুপ তুলে মুখে ভরে কুমারী। সুরেশের চোখের দিকে না তাকিয়েই বোঝে, সুরেশ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
“কেন? কাজ থেকে ফিরতে দেরি কেন হবে?” এর উত্তর যদিও সুরেশের অজানা নয়। তবু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারে না। বোবা রাগটা আবার ঘাড় বেয়ে মাথায় চেপে বসছে।
“হোটেল থেকে বেরিয়ে একবার হাসপাতাল যাব। তাসি পনি সাথ মা জাঞ্ছা। অন্ধকার হওয়ার আগেই ফিরে আসব।”
“না, তাসি সঙ্গে যাক বা না যাক…,” সুরেশের গলার স্বর কিছুটা রুক্ষ। কপালের বলিরেখাকে লম্বালম্বি ছেদ করে ভ্রুকুটিরেখা ফুটে ওঠে। “বললাম না, কাল সকালে গুরুদোংমারের ট্রিপ আছে। আজ আর কোথাও বের হব না। একবার সবজি মান্ডি যাব, চামলিং দাজুর কিছু মাল এনে দিতে হবে, তারপর সোজা বাড়ি। ঘরমা ফরকিয়েরো তিমিলাই হেরনু চাহাঞ্ছো।”
কুমারী খাওয়া থামিয়ে সুরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। অন্য দিন তো কই বাড়ি ফিরে কুমারীকে দেখার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে ওঠে না সুরেশ! ছোট দু’কামরার ঘর। একটা বেডরুম, অন্যটা এই খাওয়া-বসা-রান্না ইত্যাদি। সেই ঘরে একটা লাল প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবিল। এটাই তাদের বর্তমান যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ বছর কয়েক আগে, যখন বউ হয়ে প্রথম এই বাড়িতে পা রাখল কুমারী, তখন তো তুমুল আদরের সময় এই টেবিলের উপরে বসিয়েই তার রূপ-রস-নির্যাসের স্বাদ নিত সুরেশ। তখন টেবিলটা নতুন ছিল, পাহাড়ি গোলাপের মতো টকটকে লাল। এখন, ঘষা খেতে খেতে তাদের সম্পর্কের মতো এর উজ্জ্বলতাও কমে এসেছে।
এই মুহূর্তে, টেবিলের দুই প্রান্তে মুখোমুখি বসে আছে দুই যুযুধান পক্ষ। কুমারী আর সুরেশ। বংশগত নেপালি ছাঁচের সরু চোখ আরও সরু হয়ে পরস্পরকে এইবার ফালা-ফালা করে ফেলবে। চোখ নয়, নেপালি কুকরি; বরফের মতোই তীক্ষ্ণ, হিমশীতল। দুজনের সামনে চিনেমাটির ফুলকারি তোলা বাটিতে ধোঁয়া ওঠা থেনথুক। নুডলস আর মাংসের টুকরো ওইটুকু বাটিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ভাসছে। যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় মেঘের দল ভেসে বেড়ায়। পাশের একটা প্লেটে চারটে খাপসি রাখা। বেণীর মতো পাকানো খাপসি। গতকাল কেলসাঙ্গের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে এগুলো দিয়ে গিয়েছিল। কুমারীর আচমকা মনে হয়, প্রথম যে তিব্বতি মানুষ তিনটে ময়দার লেচি হাতে নিয়ে, খাপসিগুলোকে বিনুনির মতো আকার দিয়েছিল, সে বুঝি নিজের মনের টানাপোড়েন অবস্থাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়ে!
সুরেশ ছাঙের গ্লাস তুলে নিয়ে ঠোঁটে ঠেকায়। বিতৃষ্ণায় ওর মুখ বেঁকে গেল। আজ যেন ছাঙেও সেই স্বাদ নেই। বাইরে ঝলমলে রোদ, গুরাস গাছের ঝোপে তিনটে পেন্টেড লেডি প্রজাপতি কী পুলকে ওড়াউড়ি করছে! কুমারীর হাতে লাগানো এই গুরাস গাছটা। সাদা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলে ভরা গাছটা ঠিক যেন একটা ফুলদানি। সুরেশ কেন যে এই আনন্দযজ্ঞের অংশীদার হয়ে পারছে না। স্যাঁতসেঁতে বর্ষার রাস্তার মতো হতাশার মেঘটা জড়িয়ে ধরেই আছে।
“উপেন্দ্র ত তিম্রো পনি সাথি হো। ইনফ্যাক্ট, উপেন্দ্র আগে তোমার বন্ধু, তারপর…”
কুমারী কথা শেষ করে না। কথায় কথা বাড়বে। কাজে পৌঁছাতেও দেরি হবে। যে কথা কোথাও নিয়ে যায় না, তা বাড়িয়ে লাভই বা কই! এই বয়সে এসেও সুরেশ যদি বন্ধুত্বের মর্ম না বোঝে, কুমারীর কিচ্ছু করার নেই। এদিকে হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে তাড়াতাড়ি না পৌঁছালে তাসি কাউন্টার ছাড়তে পারবে না।
তাসিকে দেখলে মায়া লাগে। উপেন্দ্রর এই অবস্থার ফলে তাসির মানসিক অবস্থা এমনিতেই টালমাটাল। ওদের বছর তিনেকের বাচ্চাটাও, উপেন্দ্রকে দিন কয়েক ধরে দেখতে না পেয়ে খালি, ‘বুবা, বুবা’ বলে কান্নাকাটি করছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবারের বাটি ঠেলে সরিয়ে, খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল কুমারী। ডিভাইন ওয়াইন রঙের লিপস্টিকটা ঠোঁটে বুলিয়ে নিল। তারপর, সস্তার হাত ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, দরজার বাইরে পা রাখে।
“উ মেরো কোহি পনি হয় না! কেউ হয় না ও আমার!” সুরেশ চিৎকার করে উঠল। গাড়ির আওয়াজ, শীত-পোশাকের দোকান-পাট, টুরিস্টদের আনাগোনা— সব মিলিয়ে নেপালি বসতিতে সারাদিন হট্টগোল লেগেই আছে। সুরেশের কথার ঢেউ কুমারীকে স্পর্শ করে না।
২
সুরেশের স্করপিওটা বসতির মোড়ের মাথায়, চামলিংদের গ্যারাজে রাখা থাকে। পাহাড়ি পথের বাঁকে কাঁকড়াবিছের মতোই হাওয়া কেটে এগিয়ে চলে সেই স্করপিও। গাড়িটার উপর সুরেশের বেশ অপত্য স্নেহ কাজ করে। আজ সবজি মন্ডি থেকে ফিরে গাড়িটাকে ধুয়ে-মুছে রেডি করে নেবে। কাল ভোর ভোর রওনা।
মঙ্গন অবধি কোনও সমস্যা নেই। আরামসে চালিয়ে যাও। টুরিস্টদের বায়নাক্কা সামলে দু-একটা ফলস দেখিয়ে দিলেই হল। সমস্যা হয় আরও উঁচুতে। যেখানে রাস্তায় বরফ জমে থাকে। বেলা বাড়লে সেই সব পাহাড়ি রাস্তায় বিপদও বাড়ে। বরফ একবার গলতে শুরু করলে রাস্তা পিছল হয়ে যাবে। যে ড্রাইভার আগে রওনা দিতে পারবে, তার সুবিধা সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় যত গাড়ি চলাচল বাড়বে, বরফ মসৃণ হয়ে যাবে। তখন চাকা স্কিড করে খুব। সে রিস্ক সুরেশ নেয় না কোনোদিন। উপেন্দ্রও নিত না। বেশ সাবধানী ড্রাইভার উপেন্দ্র।
ইউনিয়ন থেকে ড্রাইভারদের চালানোর ধরন অনুযায়ী কাস্টমার জুটিয়ে দেওয়ার অলিখিত একটা নিয়ম আছে। যাদের রক্তের জোশ স্টিয়ারিঙে ফুটে ওঠে, অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরাদের নিয়ে যায় তারাই। সুরেশ, উপেন্দ্র, কেলসাঙ্গ, চামলিং দাজু— এরা ফ্যামিলি নিয়ে যায় উপরে। গ্যাংটক থেকে জুলুক, এক রাতের আশ্রয়; পরের দিন সিল্করুটের হেয়ার পিন রাস্তা পেরিয়ে ছাঙ্গুলেক, বাবামন্দির দেখিয়ে ব্যাক টু গ্যাংটক। সুরেশ আর উপেন্দ্র আরও উঁচুতে যায়। লাচুন, লাচেন হয়ে ইয়ুমথাং ভ্যালি আর গুরুদোংমারের ট্রিপ মারে। এসব রাস্তায় সাবধান না হলে নিজেরই ক্ষতি। কিন্তু, সেদিন যে উপেন্দ্রর উপর কী ভর করেছিল কে জানে!
ভাবতে ভাবতেই চামলিংদের গ্যারাজের কাছে পৌঁছে যায় সুরেশ। গাড়িটা বের করবে, এমন সময় দেখতে পেল মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাপা সিগারেট টানছে। সুরেশের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হেসে হাতছানি দেয়। মাংসের দোকানের মুখোমুখি থাপার ছোট্ট দোকান। দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটানো টিভি। টিভির সামনে দুটো মুখোমুখি কাঠের বেঞ্চ। একদিকে তাকের উপর থরে থরে সাজানো বুড়ো সাধু, সিগনেচার, ইমপিরিয়াল ব্লু’র বোতল। রক্সিও রাখা থাকে। সে-সবও চেখে দেখতে চায় কোনও টুরিস্ট। থুকপা, মোমো, নুডলস পাওয়া যায় গরমাগরম। চাইলে তাক থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের মদও। রাত হলে দোকানের সরঞ্জাম গুটিয়ে এটাই তাদের বসার ঘর। থাপার বউ রান্নাবান্না সামলায়, ক্যাশে বসে থাপা। থাপার বড় ছেলে দার্জিলিং-এ, হোটেল ‘মাউন্টেন ভিউ’য়ের ম্যানেজার। খুব ভাল ছেলে, দায়িত্ববান। বেগড়বাঁই করে শুধু এই ছোটটা। রামি। সে চায় রিয়্যালিটি শো’গুলোতে অংশ নিয়ে মুম্বই যাবে। গিটার বাজিয়ে গান গাইবে। থাপাদের বাড়িতে এই নিয়ে ঝুট-ঝামেলা লেগেই আছে। থাপার ইচ্ছা বছর দুয়েক পরে রামিকেও নামচি বা শিলিগুড়ি পাঠিয়ে দেয়। আপাতত রামি একটা পিতলের ধুনোদানিতে শুকপা জ্বালিয়ে দোকানের ভিতরে সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। কানে গাবদামতো হেডফোন। গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে অল্প অল্প। সুরেশের দিকে তাকিয়ে রামি এক-গাল হাসল। শুকপার সুগন্ধ সুরেশের নাকে এসে ধাক্কা দেয়। সে হাত তুলে রামিকে ইশারা করে, কী গান! রামি বাইরে আসে। দোকানের বাইরে একটা বাঁশ পোঁতা, তার মাথায় একটা আংটা মতো। ধুনুচির হাতলটা আংটার মধ্যে ঝুলিয়ে দিতে দিতেই সে কান থেকে হেডফোন নামায়, “অরিজিৎ সিং!” রামির সোনালি হাইলাইট করা চুলগুলোয় রোদ্দুর এসে পড়ছে। পাকা ভুট্টার মতো ঝলমলে চুলে একবার আঙুল চালিয়ে নিল রামি। “তোমাকে লিঙ্ক পাঠিয়ে দেব। নিউ রিলিজ।” তারপর বাবার দিকে ফেরে। “মেরো কাম শেষ বয়ো, ম আঁউদেছু!” উত্তরের অপেক্ষা না করেই, কালো পিচ রাস্তা ধরে রামি নিচের দিকে নামতে শুরু করে। সামনের বাঁকে অদৃশ্য না হওয়া অবধি রামির দিকে তাকিয়ে থাকে থাপা। তার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল, দু’আঙুলের টোকায় সিগারেটের টুকরোটা ছুড়ে দেয়। ঝোপের পাশে পাহাড়ি হোটেলের আবর্জনার স্তূপ। সেটার বুকে গিয়ে টুকরোটার পড়ল।
“ছেলে তো লায়েক হয়ে যাচ্ছে থাপা!” “হুঁহ! এ ছেলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতে পারলে আর কিছু চায় না। এখন নিশ্চয়ই বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে স্কুলের পিছনে গিয়ে বসবে গিটারের আড্ডায়।” সুরেশ হাসে, “আরে, দু’দিন পরে তো কাজে নামবেই, এখন একটু হাতে-পায়ে ফুর্তি করতে দাও!” “পা বলায় মনে পড়ল, উপেন্দ্রর মনে হয় পা’দুটো কেটে বাদ দিতে হবে।” এতক্ষণ ধরে লেগে থাকা বিরক্তিটা সরে গিয়ে থাপার মুখে যন্ত্রণায় ছাপ ফুটে ওঠে। রামির কথা ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সুরেশ। ইলেকট্রিকের পোলে একটা নীল রঙের কলচৌডি পাখি পিড়িং পিড়িং করে লাফাচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়েছিল ও। রামির সঙ্গে পাখিটার কী আশ্চর্য মিল। “কী?” সুরেশ থাপার দিকে চোখ ফেরায়। “উপেন্দ্র! হাসপাতালমা ভেট গরনু জানু ভয়না? ও, কেনই বা হাসপাতালে দেখা করতে যাবি, তোর তো আবার পুরনো রাগ…।” সুরেশ উত্তর দিল না। “উপেন্দ্র ভাল নেই সুরেশ। পারলে দেখা করে আসিস। আমরা পাহাড়ি লোক, পা’দুটো না থাকলে আমরা বেঁচে থেকেও মরা। মরেকো মাঞ্ছে মাথি রিস না রাখনু।” আলোচনা অস্বস্তিকর দিকে এগোচ্ছে। সুরেশ উশখুশ করে উঠল, উইন্ডচিটারের কুঁচকে যাওয়া হাতাটা প্রাণপণে সোজা করতে করতে হুড়মুড়িয়ে বলে, “এলাম থাপা দাজু, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” পাখিটা উড়ে গিয়েছে, এদিক সেদিক তাকিয়েও আর পাখিটাকে খুঁজে পেল না সুরেশ। শুধু থাপার কথাগুলো কানে বাজতে থাকে— মরা মানুষের উপর রাগ পুষে রাখিস না!
৩
হোটেল লিও ইন্টারন্যাশনালের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে লাল মার্কেটের দিকে, গাড়িটা সেদিকেই ঘুরিয়ে নেয় সুরেশ। আর কিছুটা নিচের দিকে এগোলেই নামগিয়াল হাই স্কুলের চত্বর। এত বড় স্কুল বিল্ডিং ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে আছে। এগারো সালে যখন এখানে প্রবল ভূমিকম্প হল, তখনই স্কুল বিল্ডিংটা লম্বালম্বি ফেটে দু’ভাগ হয়ে যায়। সামনে খানিকটা খোলা মাঠ। পাহাড়ের উপর যতটুকু সমতল থাকলেই মাঠ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়, ততটাই সিমেন্ট বাঁধানো প্রাঙ্গন। খাদের কিনারা বরাবর লোহার রেলিং। রেলিং-এর ওপাশে একটা বাতাবি লেবুর গাছ। মাঠের একপাশে, বিল্ডিং-এর পিছনে, একটা ধুপি গাছ। তার তলায়, ফুট পাঁচেক লম্বা একটা কৃত্রিম সেতু মতো বানানো। রামি আর তার বন্ধুবান্ধবরা এখানেই বসে গিটার বাজায়, আড্ডা মারে। নির্জন স্কুল বিল্ডিং-এর সামনে এসে সুরেশ গাড়ি কিছুটা স্লো করে দিল। বড় বড় কার্টুন আঁকা স্কুলের দেওয়ালে। সিম্বার হাসি-হাসি মুখে শ্যাওলা পড়ে গিয়েছে। জেরিকে ধাওয়া করতে যাওয়া টমের হাতের মাঝ বরাবর ফাটল। তবু টমের মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন মাত্র নেই। স্কুলের সামনের দিকে একপাশে টাইগার লিলির ঝোপ। একটা ঝামুড়-ঝুমুড় সাদা লোমওয়ালা কুকুর সেই ঝোপের মধ্যে ঢুকে ব্যাঙ তাড়াতে ব্যস্ত। লিলির ঝোপের সামনে স্কুলের একটা ছোট্ট রেপ্লিকা। কেউ সেখানে আগের দিন প্রদীপ জ্বেলে রেখে গিয়েছিল। বাসি প্রদীপটা কুকুরের পায়ে লেগেই নিশ্চয়ই উল্টেছে।
রামিদের দেখে সুরেশ হর্ন মারে। রামি মাথা নামিয়ে গিটার বাজাচ্ছিল, আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকায়। দোকানের রামি আর এই রামির মধ্যে কত পার্থক্য। রামির মুখটা এখন এক পশলা বৃষ্টির পরে দেখতে পাওয়া পাহাড়-চূড়ার মতো। রামি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রামির বন্ধুরাও সুরেশের চেনা, মাঝেমধ্যে ওদের আড্ডায় সামিল হতে সুরেশের ভালই লাগে। একটা চটি-জুতোর দোকানের সামনে গাড়িটা রেখে, সিঁড়ি দিয়ে স্কুল চত্বরে নেমে আসে সুরেশ। “আজ বেশিক্ষণ বসব না,” ফুঁ দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ধুপির শুকনো পাতা উড়িয়ে, সুরেশ বসে পড়ল। “থামলি কেন, বাজা?” রামি আবার গাইতে শুরু করে, “ইন সাঁসোঁ কা দেখো তুম পাগলপন কে, আয়ে নহি ইনহে চ্যায়েন…” সুরেশের বুকে কেউ যেন ধাক্কা মারল। একই স্কুল কম্পাউন্ড, একই ধুপি গাছের তলা। শুধু সুরেশের গায়ে এখন স্কুলের ইউনিফর্ম নেই। পাহাড়ের গা বেয়ে সময় গড়িয়ে গিয়েছে কয়েক বছর। সামনের মাঠে উপেন্দ্র ফুটবল পেটাচ্ছে না। স্কুলের শার্ট আর স্কার্ট পরে কুমারী দাঁড়িয়ে নেই উপেন্দ্রর অপেক্ষায়। প্রিয় বন্ধুর প্রেমিকার উপর কবে থেকে যেন একটু একটু করে ভাল-লাগা তৈরি হচ্ছিল, তা সুরেশ নিজেও বোঝেনি। উপেন্দ্র সারাদিন ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকে। এদিকে স্কুলে বা স্কুলের বাইরেও কুমারীকে সঙ্গ দেয় সুরেশ। একদিন টিফিন-টাইমে ক্লাস টেনের ছেলেমেয়েরা বসে অন্তাক্ষরী খেলছিল। সুরেশ সেদিন এই গানটাকেই বেছে নেয়। গাইতে গাইতে একবারও কুমারীর চোখ থেকে চোখ সরায়নি। কুমারীর চোখের দৃষ্টি বিস্ময় থেকে যেভাবে লজ্জায় বদলে গিয়েছিল, তা সুরেশ আজও ভুলতে পারে না। তারপর কীভাবে যেন দুজনে কাছাকাছি চলে আসে। আগামীর সুখস্বপ্নে দুজনেই বিভোর— এম জি মার্গে ক্যাফে খুলবে, আস্তে আস্তে পুরো সিকিমে তাদের ব্রাঞ্চ ছড়িয়ে যাবে।
কিন্তু এদিকে, সুরেশ-উপেন্দ্রর সেই ছোট্টবেলার বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটে গেল। বিপদ যে ওঁৎ পেতে সুরেশের অপেক্ষায় বসে থাকবে, তা সে কল্পনাও করেনি। ভাবা উচিত ছিল যদিও। উপেন্দ্র শোধ নিয়েছিল অন্যদিকে। নইলে হেডস্যারের ড্রয়ারে অফিস-আলমারির যে চাবি থাকে, তা সুরেশের ব্যাগে কেন পাওয়া যাবে! সুরেশের শত উপরোধ-অনুরোধ, কান্নাকাটি সত্ত্বেও বোর্ড এক্সামের আগেই তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হল। একজন চোরকে স্কুলে রাখতে রাজি ছিল না কর্তৃপক্ষ। সুরেশের পড়াশোনায় পূর্ণচ্ছেদ সেখানেই। ওর বুবা গাড়ির বিজনেসে জুটিয়ে দিলেন। পিছনে পড়ে থাকল গিটার, স্কুল, ধুপি গাছের তলার আড্ডা। এদিকে, উপেন্দ্রর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কানে তোলেনি কেউ। অন্য দিকে, স্কুলের ফুটবল টিমের চ্যাম্পিয়নকে ঘিরে কত গুজবই রটে, সে সবে কান দিতে নেই! যতই হোক, ফুটবল টুর্নামেন্টের গোল্ডেন ট্রোফিটা বছর বছর তার জন্যেই স্কুলে আসছে। সেই উপেন্দ্রর পা’দুটো বাদ দিতে হবে— সুরেশ খাদের দিকে তাকায়। অনেক দূর থেকে একটা ধূসর মেঘের চাদর এসে ঢেকে দিচ্ছে নিচে ঝুলনের মতো সাজানো ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি-ঘর, সায়েন্স পার্কের উলটানো বাটির মতো সবুজ ডোমটা।
৪
মঙ্গন পৌঁছাতে পৌঁছাতেই দুপুর কাবার। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে এদিকে। সুরেশ হিসাব করে, লাচেন পৌঁছাতে অন্ধকার হয়ে যাবে। ওর গাড়িতে একটা হানিমুন কাপল। গাড়ি দাঁড় করাতে না করাতেই হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল। এই ঠাণ্ডাতেও স্বল্পবসনা হয়ে, পাহাড়ের কিনারায় গিয়ে রিলস বানাচ্ছে। দুজনের খুনসুটি দেখতে দেখতে গাড়িটা চেনা দোকানের সামনে দাঁড় করার সুরেশ। প্রায় সব গাড়িই এখানে এসে কিছুক্ষণ থামে। কফি-ম্যাগি খায়, একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পথচলা শুরু। লাসান তামাং আর তার বুড়ি মায়ের ঝাড়া হাত-পা সংসার। দোকানের দায়িত্ব লাসানের কাঁধেই। বুড়ি হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে না। দোকানের বাইরে ছাতার তলায় চেয়ার টেবিল পাতা। এই বৃষ্টিতেও একদল টুরিস্ট সেখানেই বসে আছে। লাসান একটা ট্রে’তে চায়ের কাপ সাজিয়ে এনে তাদের সামনে রাখে। সুরেশকে দেখতে পেয়েছে লাসান, হেসে মাথা নাড়ায়। সুরেশ দোকানের ভিতর ঢুকে একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে বসে পড়ল। “ম্যাগি করে দিই?” আধভেজা স্যাঁতসেঁতে লম্বা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে লাসান ভিতরে ঢুকল। “পার্টি আসুক, তারপর। রক্সি ছ কে?” কাঠের গেলাসে রক্সি ঢেলে সুরেশের দিকে এগিয়ে দিল লাসান, তারপর আবার এক কেটলি চা বানাতে শুরু করে।
“কো সুরেশ হো?” সুরেশের গলা পেয়ে লাসানের মা হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঘরের ভিতর থেকে দোকানে আসে। লোলচর্ম বৃদ্ধার শরীরটা চেয়ারের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়েছে। “শরীর কস্তো ছ?” সুরেশ উঠে গিয়ে হুইলচেয়ারটা আর একটু ঠেলে নিজের চেয়ারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। “তুই কি গুরুদোংমার যাবি?” সুরেশ ঘাড় হেলায়। “মেরো এউটা কাম গরদিঞ্ছৌ, বাবু?” “কী করতে হবে?” সুরেশ রক্সি শেষ করে হাতের চেটোয় মুখটা মুছে, বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। “শরীরের এই হাল, আর দুদিন পরে তথাগতের চরণে আশ্রয় নেব। এই গোলাপটা গুরুদোংমারে দিয়ে আসবি? আসলে, কালকের দিনেই লাসানের বাবার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, গুরুদোংমারে। ঠিক এইরকমই একটা গোলাপ সে আমাকে দিয়েছিল।” একটানা কথা বলতে বলতে বুড়ির গলা বুঝে আসে। সুরেশ এতক্ষণে খেয়াল করল, বুড়ির হাতে একটা টাটকা লাল গোলাপ। “উফ! মা, আবার শুরু করলে?” চা বানাতে বানাতেই লাসান গলা তোলে। “তোর বুবা হয়, লাসান!” বৃদ্ধার ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ। “আর লোকটা শেষ জীবনে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেটা মনে থাকে না, না?” লাসান খেঁকিয়ে উঠল। বুড়ি বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। টিনের চালের উপর ধারাপাতের শব্দে, বুড়ির কথা ভাল করে শুনতে পায় না সুরেশ; শুধু কানে এল, “ভালটুকু মনে রাখ…” চায়ের কেটলি নামিয়ে রেখে, লাসান তার মাকে আবার ভিতরের ঘরে নিয়ে যায়।
সুরেশের ভিতরটা কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করেছে। রক্সির প্রভাব কি না সে জানে না। তবে এটুকু জানে, মঙ্গনের পরে মোবাইলের টাওয়ার আর ভাল পাওয়া যাবে না। কুমারীকে এক্ষুনি একটা ফোন করতে হবে। বলতে হবে, উপেন্দ্র সাদা গুরাস ফুল ভালবাসে। এই ট্রিপটা থেকে ফিরে এসেই ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবে সুরেশ। সঙ্গে নিয়ে যাবে বাড়িতে ফুটে থাকা সাদা গুরাস।
ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে বিশাল বড় সানদ্রুপ্সের গুরু পদ্মসম্ভবের বাঁধানো ছবি। তার পায়ের কাছে একটা কুড়ি টাকার নোট পানের খিলির মতো মুড়ে রেখে, আর একটা ম্যাঙ্গো জুসের বোতল অর্পণ করে কুমারী প্রণাম করছিল। মোবাইলটা তখনই বেজে ওঠে। স্ক্রিন জুড়ে তাসির ছবি। কুমারীর ভ্রূ কুঁচকে যায়। তাসি এখন হাসপাতালে আছে। আজ উপেন্দ্রর অপারেশন। ওটিতে ঢোকানোর সময় হয়ে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। গতকাল রাত থেকেই উপেন্দ্রর শরীর ভাল যাচ্ছে না। তাসি আগেই ফোনে জানিয়েছে, ওর নাকি পালস নেমে যাচ্ছে দ্রুত। প্রণামের দিকে আর মন দিতে পারল না কুমারী। ফোনে রিং হয়েই যাচ্ছে। ফোনটা কেটে যাওয়ার আগেই রিসিভ করতে হবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন