আবু জাফর খান
দ্বীপের নাম নান-মাডল। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে মাইক্রোনেশিয়ার পনফেই দ্বীপের পাশে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ। স্থানীয়রা বলেন ‘ভূতুড়ে দ্বীপ’! আশপাশে তেমন কোনও সভ্যতার চিহ্নও নেই। এই দ্বীপ সম্পর্কে শোনা যায়, ওখানে একরাত থাকলে নাকি মৃত্যু অনিবার্য! রাত হলে নাকি চেহারাই পালেটে যায় প্রাচীন এই দ্বীপের। দ্বীপটি এতই প্রত্যন্ত যে, কারও পক্ষে যাওয়াই প্রায় অসম্ভব।
পনফেই দ্বীপের বাসিন্দারা এই দ্বীপের ধারে কাছে যেতে চান না। তাঁদের দাবি, ওই দ্বীপে ভূত আছে। রাতের অন্ধকারে নাকি আলোকোজ্জ্বল অদ্ভুত সব বস্তু ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন তাঁরা। রহস্যময় এই দ্বীপ অস্ট্রেলিয়া থেকে ১৬০০ মাইল দূরে এবং লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ২৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত।
পাঁচ পাগলাটে অণুজীব বিজ্ঞানী ভন লিউয়েন, লুই সিয়াচক, সারগেই উইনুগ, মার্টিন জারিঙ্ক এবং মঙ্গলা নার্লিকার। এঁদের বয়সের বিপুল তারতম্য। মঙ্গলা নার্লিকার সবচেয়ে ছোট। বয়স কম হলেও তিনি একটা জিনিয়াস। তাঁর ট্যালেন্ট সম্পর্কে ভুলক্রমেও কারও কোনও সন্দেহ নেই। বয়সে তারতম্য থাকলেও দীর্ঘদিন অণুজীব গবেষণার বিভিন্ন শাখায় একসঙ্গে কাজ করতে করতে এঁদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়। এঁরা অণুজীবের বিভিন্ন শাখায় এক একটি নক্ষত্র। আবিষ্কারের নেশায় নিরন্তর মগ্ন থাকা বিজ্ঞানী।
ভন লিউয়েন ভাইরোলজস্টি, লুই সিয়াচক মাইকোলজীস্ট, সারগেই উইনুগ প্যারাসাইটোলজীস্ট, মার্টিন জারিঙ্ক ইমিউনোলজীস্ট এবং মঙ্গলা নার্লিকার ব্যাকটেরিওলজীস্ট।
দীর্ঘদিন ধরে এঁদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে এমনকিছু আবিষ্কারের নেশা, যা গোটা বিশ্বকে চমকে দিতে পারে। কিন্তু তার জন্য দরকার লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন দূরের কোনও নির্জন গবেষণাগার। তেমন ল্যাব পৃথিবীতে কোথায়? তবু এই জিনিয়াস পাগলাটে বিজ্ঞানীর দল দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তাঁরা তাঁদের আয়ের অংশ থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত একটি গবেষণাগার।
হঠাৎ করেই একদিন পাঁচ বিজ্ঞানী উধাও হয়ে যান। তাঁদের আত্মীয়স্বজন, স্ব স্ব রাষ্ট্র হন্যে হয়ে খুঁজেও কোনও সন্ধান পায় না। কেউই বুঝতে পারে না, এভাবে একসঙ্গে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ বিজ্ঞানী কীভাবে নিখোঁজ হলেন! কেউ কেউ বলেন, এলিয়েন তাঁদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। রহস্যের কোনও কিনারা পাওয়া যায় না।
বিংশ শতকের গোড়ার কথা। পাঁচ বিজ্ঞানীর মাথায় ঢোকে এমন এক ভাইরাস তৈরি করবে, যেটি গোটা মানব জাতিকে এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। তাঁরা পরিকল্পনা করেন, ভাইরাস রেপ্লিকেশনের আগে আবিষ্কার করতে হবে ভ্যাকসিন। যাতে তাঁরা বেঁচে থাকতে পারেন। সভ্যতা ধ্বংস হবে। ধ্বংস হবে মানব জাতি। বেঁচে থাকবেন শুধু তাঁরা পাঁচ জন। গোটা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়ে উঠবেন তাঁরা। তাঁরাই হবেন এই গ্রহের নিয়ন্তা।
ল্যাব লুইভনাজ, নান-মাডল।
পাঁচ বিজ্ঞানী দিনরাত গবেষণার কাজে আত্মমগ্ন। তাঁদের সংগ্রহে ছিল কিছু অ্যানশিয়েন্ট ভাইরাসের ডিএনএ এবং আরএনএ। যে ভাইরাসগুলো সুপ্ত অবস্থায় হাজার হাজার বছর পৃথিবীতে বিরাজমান ছিল। তাঁরা সেগুলোকে ভিরুলেন্ট করে তোলার কাজে নিমগ্ন। মানে মারাত্মক বিষাক্ত ভাইরাসে পরিণত করার কাজে।
তাঁরা প্রথমেই ভাইরাসটির সিরিজ জেনম সিকুয়েন্সিং এর মাধ্যমে প্রতিষেধক আবিষ্কারে হাত দেন। প্রতিষেধক আবিষ্কারও করে ফেলেন।
যে রাতে তাঁরা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, সেই রাতে মহাসাগরের তীরে হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন। ভাইরাস তৈরি, প্রতিষেধক তৈরি। এখন শুধু ভাইরাসটির ভিরুলেন্সি বাড়াতে হবে।
তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন জেনম মিউটেশনের কাজে। মিউটেশন করাতে করাতে ভাইরাসটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান, যখন সেটি প্রতি মিনিটে একবার মিউটেশনে সক্ষম হয়ে ওঠে। এমন ভাইরাস পৃথিবীতে আগে ছিলও না, ভবিষ্যতে আসবে বলেও তাঁরা মনে করেন না। আণবিক বোমার চেয়েও সহস্রগুণ শক্তিশালী এক ভাইরাস।
ভাইরাসটির বৈশিষ্ট: এরা বাতাসে ভেসে বেড়াতে সক্ষম। এটি শ্বাসনালী দিয়ে প্রবেশ করে ইমিউন সিস্টেম বিশেষ করে টি-সেল ধ্বংস করে দেবে। তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত ভাইটাল অর্গান ড্যামেজ করে দেবে। প্রবেশের চার ঘণ্টার মধ্যেই মানুষের মৃত্যু ঘটবে। এটির ভিরুলেন্সি এই পর্যয়ের যে, এটি থেকে কেউই নিস্তার পাবে না। এটির অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, এটি কেবল মানুষকেই আক্রমণ করবে। অন্য কোনও প্রাণীকে নয়। সংক্রমিত হবে মানুষ থেকে মানুষে। এটি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, গোটা পৃথিবীতে মহামারী রূপ ধারণ করতে মাত্র এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
ভাইরাসটির নাম দেয়া হয়: অঅও-২০।
ভ্যকসিনের নাম: অঅঠ-৫
পাঁচ পাগল বিজ্ঞানী প্রস্তুত। এবার পরিকল্পনা কোথা থেকে শুরু করবেন সেই নিয়ে রাতে গোলটেবিল আলোচনায় বসেন। আলোচনা চলছিল। হঠাৎ ভন লিউয়েন অসুস্থ বোধ করেন। অন্য চারজন শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। দ্রুত পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টস পরে নেন। কারণ, তাঁরা জানেন যেভাবে হোক ভন লিউয়েন সংক্রমিত হয়েছেন।
ক্রমাগত রক্তবমি করতে করতে মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে লিউয়েন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আতঙ্কিত সবাই। সকলেই মৃতের কাছে যেতে শঙ্কা বোধ করেন। কারণ তাঁরা জানেন, এই ভাইরাস মৃতের শরীরে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকে। স্পর্শ করলে তিনিও নিশ্চিত আক্রান্ত হবেন। কোনও প্রটেকশনই তাকে রক্ষা করতে পারবে না। শুধুমাত্র ভ্যাকসিন একজন মানুষকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু ভন লিউয়েন ভ্যাকসিনেটেড হওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত হয়েছেন! চারজনের কপালে চিন্তার রেখা!
মঙ্গলা নার্লিকার তাঁর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তিনি ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। জানেন, আজ রাতে তাঁর ঘুম হবে না।
অগত্যা নিশ্ছিদ্র প্রটেকশন নিয়ে অপর তিনজন একটা দীর্ঘ বাঁশ জাতীয় লাঠির সাহায্যে কোনওমতে ঠেলে ঠেলে লাশটি প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলে ভাসিয়ে দিলেন। তাঁরা জানেন, কাজটি ঠিক হলো না। কারণ এই মৃতের শরীর হয়ে উঠতে পারে মহামারী সূচনার ভয়ানক আধার। যদিও তাঁদের পরিকল্পনা মহামারী সৃষ্টির, তবুও তাঁরা তিনজন কেমন এক বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন।
তিন দিন পর।
চিকিৎসা শাস্ত্রের বাঘা ব্যক্তিরা ছুটে আসেন। কিন্তু তাঁরা হতভম্ব। তাঁরাও আকান্ত হতে থাকেন। শীতের ঝরা পাতাদের মতো মানুষ মরতে থাকে! ঝরে পড়তে থাকে দল বেঁধে। ঝড়ের বেগে গোটা আমেরিকায় অজ্ঞাত মহামারি রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষকে সমাধিস্থ করার মতো জায়গা নেই। মানুষও নেই! ঘরে, রাজপথে, উদ্যানে, সরণিতে মৃতের স্তূপ! মাত্র দিন দশেকের মধ্যে গোটা আমেরিকা বিরল জনপদে পরিণত হয়।
নান-মাডল দ্বীপ।
চার বিজ্ঞানী যেন মূক ও বধির। কারও সঙ্গে কারোর কথা নেই। মেঘ-থমথমে মুখ। তাঁরা ক্রমে বিষণ্ণতায় ডুবতে থাকেন। যেটি করার মানসে তাঁদের এই নির্জন নিভৃত বাস, এই গবেষণা, তা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। তবুও তাঁরা বিষাদিত। মঙ্গলা নার্লিকার রীতিমতো যুদ্ধংদেহী। কথায় কথায় তিনজনের দিকে তেড়ে যান।
অনেকটা গৃহবন্দির মতো তাঁরা দিনযাপন করতে থাকেন। বেরোন না বললেই চলে। মাথার ভেতর ভাবনার মহাসমুদ্র অনবরত পাক খায়। কী করলেন তাঁরা! কেন করলেন! তাঁরা তো খুনি! একটি দেশ মনুষ্যহীন করে দিলেন! এরকম চাননি হয়তো! না, ভন লিউয়েন চেয়েছিলেন! যাঁর হাড়গোড় এখন প্রশান্ত মহাসাগরের ১৪ হাজার ফুট জলের গভীরে পড়ে আছে।
ফাইফি পারপেল স্যান্ড বিচ, ক্যালিপোর্নিয়া।
চার পাগল বিজ্ঞানী এই মুহূর্তে বিধ্বস্ত। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁদের নিজেদের কাছেই নিজেদের ঘোর অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে। বিচে কেউ নেই! সুনসান, নির্জন! অথচ সূর্যাস্তের সময় এখানে ঠাসাঠাসি ভিড় থাকত। কেউ কেউ বিরক্ত হলেও সেটিই ছিল স্বাভাবিক। মানুষের গ্রহে মানুষ না থাকলে কী মূল্য তবে সেই গ্রহের!
ভুল! একদমই ভুল! ভয়ঙ্কর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল!
মানুষ না থাকলে পৃথিবীর কী মানে তবে! তাঁদেরই বা কীসের মূল্য! এই অহিতকর আবিষ্কার, সব অর্থহীন! মানুষ ছাড়া মানুষের বাঁচার কোনও মানে থাকতে পারে না।
তাঁরা গভীর থেকে গভীরতর বিভ্রম, ক্লান্তি আর অবসাদে নুয়ে পড়ে। একসময় ঘোরতর পাগলামিতে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে যেটিকে বলে ‘স্কিট্সোফ্রেনিয়া’!
জাঁদরেল চার বিজ্ঞানী এখন পথে পথে ঘোরেন, আর বলেন, ‘ভুল, ভুল’!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন