ভালবাসার বাঘ বেরোল বনে!
পারমিতা ঘোষ মজুমদার

মানিক এক মনে সু এর ছবি দেখছিল মোবাইলে। সু ঠোঁট কুঁচকে, চোখ মটকে একটা বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। মানিক জানে বাইকটা রতনের। রতন সু এর প্রেমিক। সুকে রতনের সঙ্গে দেখলে রাগে মানিকের হাড় পিত্তি জ্বলে যায়, তবু মানিক পারে না সুকে এড়াতে, সু-এর ছবি উপেক্ষা করতে। মহাব্বাত! ইয়ে হ্যায় মহাব্বাত!
“কী রে? কাল থেকে তোকে বারবার ফোন করছি, টিউব-লাইট লাগানোর জন্য? ফোনে হু হু করছিস, কাজটা করার নাম নেই, তোর খুব তেল হয়েছে না?”
কেষ্টবাবুর চড়া ধমকে মানিকের সম্বিৎ ফেরে। সে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়।
“আমাকে তুই তোকারি করেন কেন? আমায় কি ইলেকটিরি মিস্ত্রি ভাবেন নাকি? জানেন আমি ইঞ্জিনিয়ার? স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করব বলে চাকরি ধরিনি? দ্যাখেন না আমি টাই পরে কাজে যাই?”
কেষ্ট বাবু হাসি চেপে বললেন “তা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আমার কাজটা কবে হবে বলবেন স্যার? ফোনে কাজ হচ্ছে না দেখেই তো সশরীরে চলে এলুম আপনার দোকানে?”
মানিকের উস্মা কিছু কমল ভদ্রলোকের কথায়। কালো চশমা পরে নিল চটপট। গলায় ঝোলানো মলিন টাই ঠিক করতে করতে বলল, “বিকেলে যাব। এখন ধ্রুব স্যারের বাড়িতে একটা জটিল কাজ আছে। সেটা সেরে যাব।”
“ধ্রুব? ধ্রুব মিত্তির? প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি?”
“না না, সে সব না। বড় অফিসার ছিলেন। আমাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখেন।”
“আর তুই আবার ও বাড়ির ঝিটাকে না দেখলে চোখে অন্ধকার দেখিস! সুষমা না কী যেন নাম? এখন ঢং করে নিজের নাম করেছে সু! তা ধ্রুবর বাড়ি লুঙ্গি তুলে দৌড়চ্ছিস কেন তা আর বুঝি না? সব বুঝি! মেয়েটার লটরপটর আছে রতনের সঙ্গে। তোকে তো পোঁছে না”
“কেষ্টবাবু আপনার মুখের ভাষা ঠিক করুন। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। তবেই শ্রদ্ধা পাবেন, বুঝলেন? আর আমি লুঙ্গি পরি না। লুঙ্গি ব্যাড।”
কেষ্টবাবু হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন “ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বেশ নীতি শিক্ষা শিখেছিস তো? তা তোর কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শুনি? কোন ব্যাচ?”
“ওই তো যাদবপুর! একজন স্যারের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ক্লাস এইটের অঙ্কের নম্বর দেখে ভর্তি করে দিলেন। এইট-এর পরে টাইফয়েড হল, পড়াশুনো বন্ধ। স্যারের বাড়ি যেতাম, ফ্যান বাল্ব সারাতে, মুখে মুখে যোগ বিয়োগ করতাম।”
“ও বাবা! ক্লাস এইটের পরেই যাদবপুর! ফাটিয়ে দিয়েছিস তো!”
মানিক আত্মবিশ্বাসী হাসি হেসে তার এক টেরে দোকান বন্ধ করল। লজঝড়ে সাইকেলে উঠে প্যাডেল ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে বলল “সি ইয়ু স্যার।”
মানিক একটি গুলবাজ ও ঠগ। পাড়ার সবাই সে কথা জানে। তবু মানিককে সবাই এক রকম ভালবাসে এ পাড়ায়।
দশ টাকার কাজ করে পনেরো টাকা নেওয়া অবধি ওর চুরি। আর নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার বলে পরিচয় দেওয়া। ক্লাস এইট ফেল, বাপ-মা মরা মানিকের ভিতর কছু একটা আছে, এ পাড়ার কেউ ওর উপর রাগ পুষে রাখতে পারে না। তার কারণ হয়ত ওর পারিবারিক ইতিহাস।
ছোট্ট মানিকের বাপ আর মা, ভাই আর দাদা এক দিনে বাড়িতে আগুন লেগে মরেছিল। অনাথ, অসহায়, হদ্দ গরীব মানিক হাঘরে ভিখিরি হয়ে হারিয়ে যেতে পারত, তা হতে দেয়নি এ পাড়ার ভদ্রলোকেরাই। মধ্যবিত্ত, হিংসুটে, স্বার্থপর মানুষজন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখিয়ে চাঁদা তুলে বানিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট একখানা ঘর। দেশ থেকে মানিকের ঠাকুমা এসে সে ঘরের হাল ধরেছিলেন। ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছিল সংসার সে বুড়ি আর মানিকের। ক্লাস এইট অবধি টেনেটুনে পড়েছিল সে ইশকুলে। তারপর এখানে ওখানে ফাই ফরমাস খেটে, হোঁচট খেতে খেতে ছোট্ট ইলেকটিরির দোকান। একে ওকে তাকে টুপি মেরে টু পাইস। গুল মেরে মেরে দিন গুজরান, টাই পরে কাজে যাওয়া আর সু এর প্রেমে হাবুডুবু।
সু-এর আসল নাম সুষমা। প্রাচীনপন্থী নাম না পাসান্দ বলে সে নিজেকে সু নামে পরিচয় দেয়। মা নেই, পাঁড় মাতাল, চোলাই খাওয়া বুড়ো বাপ আছে বস্তিতে। নানান সামাজিক মাধ্যমে সু-এর “পাতা” আছে। নানান ছবি, রিল দিয়ে দিয়ে বেশ একখানা ফ্যান ফলোইয়িং বানিয়ে ফেলেছে সু নিজের। রতনের সঙ্গে প্রেমের ছবিও সে দেয় সেখানে। মানিক ছাড়াও আরো অনেক ভক্ত সে সব ছবি দেখে রতনকে শাপ-শাপান্ত করে আর মনে মনে সুকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেয়।
সু বস্তিতে থাকে না। সে থাকে ধ্রুব মিত্রর বাড়িতে। ধ্রুবর বয়স ষাট পেরলেও, সে রেগুলার জিম করে আর দাবা খেলে মন ও শরীর, দুই-ই আয়ত্তে রেখেছে। স্ত্রী বিয়োগ হওয়ার পর, নিঃসন্তান ধ্রুব থাকে তার সাতানব্বই বছর বয়সী বাবা দ্বীপ নারায়ণের সঙ্গে। দ্বীপ নারায়ণের দেখভাল করার জন্য সুষমাকে রেখেছে ধ্রুব। সু এর সঙ্গে উঠতে বসতে ধ্রবর ঝামেলা লাগলেও ধ্রুব আর সু একে অপরকে জান সে জ্যাদা ভালবাসে।
দ্বীপ নারায়ণ চলচ্ছক্তিহীন আজ অনেকদিন। সারাদিন চোখ বন্ধ, কথা প্রায় বলেন না, বললেও কী বলেন বোঝা যায় না।
সু কেবল বলে “আমার বেবির সব কথা আমি বুঝি!”
সু গান গেয়ে গেয়ে দ্বীপকে খাওয়ায়, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়, বেড প্যান দেওয়া, স্নান করানো সব করে যেন কোলের শিশু। আর এসব দেখে মানিকের মাথা গরম হয়ে যায়!
আজ ধ্রুবর বাড়িতে পাম্পের স্টার্টার সারাতে এসে মানিক দেখল সু দ্বীপকে প্রায় কোলে নিয়ে বসে আপেল সেদ্ধ না কী যেন খাওয়াচ্ছে!
“বেবি, আমার সোনা বেবিটা, আরেক চামচ খেলেই একটা হামি দেব!” শুনে রাগে মানিকের নাক কাঁপতে লাগল।
“ঘাটের মড়া, মরবি কবে?” মনে মনে বলল সে।
দ্বীপের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে ঘামছিল। সুকে দেখলে তার ঘাম অবধারিত। বুক ধড়ফড়, গলা শুকিয়ে আসা, পেটের ভিতর গোৎলানো ভাব। আর ঘাম। সুকে একেবারে আয়েশা ঝুল্কার মত লাগছে! ওই হাসি, ওই চোখ…উফফফ!
“আরে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে! আসুন আসুন!”
ধ্রুবর কণ্ঠে মানিকের ঘোর ভাঙ্গে।
মানিক গলার টাই ঠিক করে ধ্রুবর দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেয়।
সু ঘাড় ঘুরিয়ে মানিককে দেখলেও একেবারেই পাত্তা দেয় না।
লোকটা ধ্রুবকাকাকে ঠকায় তবু ধ্রুবকাকা লোকটাকে অপার বিশ্বাস করে! ব্যাঙ্কে পাঠায় চেক দিয়ে। এমনকি সেদিন এটিএমের পিন বলে দিল! কার্ড দিয়ে বলল “ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, যান, টাকা তুলে আনুন দেখি। আপনি অঙ্কে ভালো, আপনি পারবেন এটিএমে টাকা তুলতে। সবাই পারে না!”
সু তো হেসে বাঁচে না! ও নাকি ইঞ্জিনিয়ার! ও নাকি অঙ্কে ভালো!
তবে এটিএম ব্যাপারটায় সু এর ভয় আছে। একবার কার্ড দিয়ে ধ্রুবকাকা তাকে পাঠিয়েছিল। কী সব ভুলভাল বোতাম টেপাতে, কার্ড গর্তের মধ্যে গায়েব হয়ে গেল! টাকাও বেরোল না!
সু কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু ধ্রুবকাকা অন্য রকম লোক। বকাবকি না করে হাসল। কিছুতেই রাগ করে না।
রতনকে একটা লাভ ইয়ু পাঠিয়ে সু দেখল মানিক বৈঠকখানায় বসে পা নাচিয়ে নাচিয়ে চা খাচ্ছে আর আড়ে আড়ে তাকে দেখছে। সু ওর পশ্চাৎদেশ একটু বেশি দুলিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল!
মানিক গরম চা কোঁত করে গিলে, জিভ পুড়িয়ে কাজে লেগে পড়ল। আর ধ্রুব সবটুকু দেখে হাসি চেপে হাতে ধরা ক্রসওয়ার্ডে মন দিল।
মানিকের কাজ শেষ। প্রাপ্যর চেয়ে বেশ কিছু বেশি দাবী করা মানিকের পারিশ্রমিক, বিনা প্রশ্নে মেটাচ্ছে ধ্রুব, এমন সময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সু তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে!
মানিক হতভম্ব। ধ্রুব অবিচলিত কণ্ঠে বলল “কী হল? ছবিতে লাইক পড়েনি বুঝি?”
সু মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কী সব বলছে। রতন ও বন্দনা নাম দুটি বোঝা গেল। বাকিটা ধোঁয়াটে!
“চামড়া তুলে নেব, মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব, বম্বে যাওয়া দ্যাখাচ্ছি, বন্দনা বোম্বাইওয়ালি, চোখ যদি না গেলে দিই!” এই সব শুনে মানিক যা বোঝার খানিক আন্দাজ করেছে। সে সু-এর দিকে দু-এক পা এগিয়ে পিঠে হাত রাখতেই সপাটে একখানা চড় খেল! জমি ধরে নিতে নিতে দেখল, ধ্রুব সুকে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়েছে।
সু খানিক শান্ত হলেও তার কান্না ও হেঁচকি থামছে না। তার মধ্যেও চলছে টানা গালাগালি রতনের উদ্দেশ্যে।
কথার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যা বোঝা গেল তা হল সু-এর আদরের প্রেমিক রতন কুমার পাশের পাড়ার বন্দনা নাম্নী যুবতীকে বগলদাবা করে বোম্বাই পাড়ি দিয়েছে!
বন্দনা এখন সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে “বন্দনা বম্বাইওয়ালি” পরিচয় দিয়ে রতনের সঙ্গে মাখো মাখো ছবি টাঙ্গিয়াছে!
ধ্রুব সুকে নিয়ে ব্যস্ত, সু ফের নতুন করে কান্না জুড়েছে, মানিক তার টাকা বুঝে নিয়ে খানিক খুশি হয়ে ধ্রুবর বাড়ি থেকে বিদায় নিল। চড় খেয়ে গাল লাল হয়ে আছে। কিন্তু মহাব্বাতের দোহাই! তার মন গুনগুন করে গান গাইছে! “মাঠ ফাঁকা রে পাগলা! ভগমান আছে। গড ও আছে! নাউ সু লাভ ইয়ু!”
প্রায় আস্ত একটি দুপুর খরচ হল ধ্রুবর সু এর মন শান্ত করতে।
বিকেলে ধ্রুব রোজই মৌসুমির বাড়ি যায় চা খেতে, আড্ডা মারতে।
আজ সুকে বাবার সঙ্গে একা রেখে বেরবে কিনা ভাবছিল ধ্রুব। সাড়ে পাঁচটায় বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, দিল যতই ভেঙ্গে থাকুক সু-এর, তার কাজে বা দায়িত্বে কোন গাফিলতি নেই। সে ঠিক সময়ে দ্বীপ নারায়ণকে গলায় বিব পরিয়ে, বেবি বেবি করে ছানা খাওয়াচ্ছে।
দ্বীপ নারায়ণ কী বুঝছেন কে জানে, তিনি আজ সমানে টানা ঘরঘর করে আওয়াজ করছেন গলায়।
ধ্রুব শুনল, সু বলছে “আমার দুক্কু শুধুই তুমি বোঝো দাদু, ওই হাড় হারামি, গু এর পুত রতনের খাল যদি না খিচে নিই আমার নাম সু নয়!”
দূর থেকে ধ্রুবর মনে হল, দ্বীপ যেন ক্ষীণ হাসলেন!
সু এর কণ্ঠ ফের শোনা গেল। সে বলছে “এবার আমার বেবি জল খাবে, হিসি কব্বে, ঘুমু কব্বে! আমার ছোত্ত বেবিতা! আমার গুলিপুলিতা!”
ধ্রুব আর দাঁড়াল না। মৌসুমির বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
মৌসুমি এক সময় ধ্রুবর সহকর্মী ছিল। পদে থাকার সময়ই বন্ধত্ব ছিল, এখন এক পাড়ার বাসিন্দা হয়ে বন্ধুত্ব আরো গাঢ় হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত দুই বন্ধু রোজ বিকেলে এক সঙ্গে আড্ডা দেয়। মৌসুমির জীবনে একবার ব্যর্থ প্রেম এসেছিল। বিয়ে করেনি মৌসুমি। ভালো চা সহযোগে আড্ডা দিতে ভালবাসে। আর ভালবাসে ধ্রুবর মুখে সু আর মানিকের না হয়ে ওঠা প্রেমের গল্প শুনতে।
ধ্রুব আজ তাঁকে জানাল এ কাহিনির নতুন উপস্থিত বাঁকের খবর।
মৌসুমি হেসে বলল “ঠাকুর তাহলে মানিকের দিকে মুখ তুলে চাইলেন!”
ধ্রুব বুঝতে পারেনি কথাটা।
মৌসুমি ভেঙ্গে না বলে বলল, “নেচার অ্যাবহরস ভ্যকুয়াম! তোমার বাড়িতে সানাই বাজল বলে!”
ধ্রুব হেসে ফেলে। বলে “সু কিন্তু ওকে দেখতে পারে না। চোর চোট্টা বলে!”
“চুরি টুরি সব সেরে যাবে, প্রেমটা হতে দাও না! মানিক নামেই শুধু মানিক না। ও ভালো ছেলে। অভাবে পড়ে টুকটাক সরায়। ভালবাসা পেলে ও লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে, দেখে নিও তুমি!”
দিন যায়। মানিকের অবস্থানের হয়ত একচুল পরিবর্তন হলেও হয়ে থাকতে পারে সু-এর চোখে। সু রতনের জন্য খিস্তির বন্যা আর বইয়ে দেয় না। চোখের জল ফেলে, মানিকের কাঁধে মাথা রেখে।
মানিক এটুকুতেই গলে বিষ্ঠা! তবে দ্বীপ বুড়োর মরণ সে আজো চায়। সু-এর মুখে ওই বুড়োর জন্য বেবি বেবি শুনলে রাগ হবে না মানিকের?
সু বাইক ভালবাসে। মানিকের বাইক কেনার টাকা নেই। সহজ উপায়ে সে এই মিস ম্যাচ এর সমধান করতে চায়। সে রোজ রাতে মন দিয়ে ধ্রুবর সই নকল করে। ধ্রুবর চেক বুক ওই বাড়িতে খোলা পড়ে থাকে। সই জাল করে টাকা তুলে নিলে কেউ সন্দেহ করবে না। ব্যাঙ্ক এর লোক তাকে ভালো মতন চেনে। আর ধ্রুবর টাকা পয়সার দিকে কোন খেয়াল নেই মানিক ভালোই জানে।
এ ছাড়াও উপায় আছে। এটিএম পিন। ধ্রুব মানিককে চরম বিশ্বাস করে ওই নম্বর দিয়ে রেখেছে। সু এর মনটা আরেকটু মানিকের দিকে ঢলে পড়লেই মানিক কাজ হাসিল করে ফেলবে।
মানিকের ভগমানের কাছে স্রেফ দুটো আর্জি। দ্বীপ মরুক। সু গলুক।
মন্ত্র পড়ার মতন মরুক-গলুক-মরুক-গলুক আওড়ায় আজকাল মানিক। মন্ত্রে একটুকুও কি কাজ হবে না? হে ভগমান!
সেদিন সু এর বাবার শরীরটা খারাপ। সু হুটোপুটি করে দ্বীপ বুড়োকে কী সব গিলিয়ে বস্তিতে চলে গেল। মানিক আড় চোখে দেখল বুড়ো মাড়ি দেখিয়ে সু-এর দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে! গা জ্বলে গেল মানিকের। সে বসে বসে ঠ্যাং নাচায়। ধ্রুব তাকে ডেকেছে, কী যেন জরুরি কথা আছে!
ধ্রুব খানিক বাদে নিজের ঘর থেকে বেরোল।
বাইরে যাওয়ার পোষাকে সে তৈরি।
“আমি মৌসুমির বাড়ি চা খেতে চললাম। মানিক তুমি থাক এ বাড়িতে। সু সাতটা নাগাদ ফিরবে, বুঝলে? একজন আসবেন। বাড়িতে কারুর থাকা দরকার। যিনি আসবেন, তাঁকে বসাবে, বুঝেছ? আমিও চলে আসব আজ তাড়াতাড়ি। তুমি ততক্ষন এখানে বসে টিভি দেখ, কেমন?”
মানিকের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে! ভগমান মুখ তুলে তবে কি চাইলেন?
গতকাল আশি হাজার টাকা তুলেছে ধ্রুব। মানিক ছিল সঙ্গে। এ বাড়ির রঙ আর কী সব মেরামতি হবে। ক্যাশে নেবে বলেছে কন্টাক্টর।
সে টাকা আলমারির কোন খোপে আছে মানিক জানে। আলমারির চাবি কোথায়, তাও মানিক জানে!
সই জাল করে বা এটিএম পিন দিয়ে যে কাজ করা হয়ে ওঠেনি এতদিন, সে কাজ যেন হেঁটে হেঁটে মানিকের কোলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে কোলে নাও গো!
সু গতকাল রাতে তাকে একখানা লাভ ইয়ু পাঠিয়েছে। এখন মানিক অপ্রতিরোধ্য!
ভালবাসা পেলে সে লন্ড ভণ্ড করে দিতে পারে এটা এরা কেউ জানে না!
ধ্রুব বেরিয়ে যায়। মানিক ধীরে সুস্থে ধ্রুবর আলমারি খুলে গুনে গুনে পঞ্চাশ হাজার টাকা সরিয়ে নেয়!
হাত কেঁপেছিল। বুক ধক ধক করেছিল। মনের ভিতর খানিক পাপ বোধও জেগেছিল।
কিন্তু সে সমস্ত বোধ, অনুভূতি, ভালবাসার বাঘের পেটের চলে গেল নিমেষে!
মানিক ধ্রুবর ড্রয়িং রুমে বসে জম্পেশ করে সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে এর পরের গল্প কীভাবে সাজাবে। ধ্রুবকে টুপি পরাতে হবে, সু কে ওর “বেবি”র থেকে দূরে সরাতে হবে। মানিকের ঠিক করে দেওয়া কন্টাক্টরকে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়াতে হবে যতদিন না মানিক সু জোড় শহর ছেড়ে ভাগল্ভা হচ্ছে। বাড়ির কাজ শুরু না হওয়া অবধি ও টাকার খোঁজ করবে না ধ্রুব!
মানিকের সুখ স্বপ্নে ধাক্কা লাগে। শব্দ। গোঁগোঁ, ওউঃ!
মানিক চেয়ার ছেড়ে ওঠে, দ্বীপ বুড়োর ঘর থেকে আসছে না শব্দটা?
ঘরে উঁকি মারে মানিক! এ কী? বুড়োর মুখে গ্যাঁজলা, চোখ উলটে গেছে, বুড়োটা টেসে যাবে নাকি?
ভগমান কী জোড়া বর দিলেন আজ?
পকেট থেকে ঝটিতে মোবাইল বার করে ধ্রুবর নম্বর ডায়াল করে সে। ফোন বেজে ওঠে ধ্রুবর ঘরে! তাড়াহুড়োতে ধ্রুব আজ ফোন ফেলে গেছে!
মানিকের ঘাম হচ্ছে। দ্বীপ নড়ছে চড়ছে না-মরে গেল মরে গেল ভাবতে ভাবতে মানিক দ্বীপের কাছে গিয়ে দেখে, দ্বীপের বুক খুব ক্ষীণ হলেও উঠেছে নামছে।
ঝপ করে মানিক দ্বীপকে কোলে তুলে নেয়। ফোন করে জামাইকে। জামাই এর অটো ডেকে মানিক তাতে দ্বীপকে নিয়ে ওঠে। বারংবার ফোন করতে থাকে সুকে। সু ফোন ধরে না!
পাঁচ মিনিটের মধ্যে জামাই-এর অটো পৌঁছয় লাইফ নার্সিং হোমে। বড়লোকদের জায়গা। দ্বীপকে কোলে নিয়ে অটো থেকে নেমে মানিক দেখে সামনে চাকা লাগান রুগী টানা গাড়ি! তাতে দ্বীপকে শুইয়ে ছুট ছুট ছুট! ঠিক যেমন সিনেমায় দেখায়!
চকচকে বাড়ির ভিতর লিপস্টিক মাখা ছুকরি-মানিকের হাত থেকে গাড়ি টেনে নেয় সে। জোটে আর দু এক দয়ালু চেহারার লোক!
মানিক হাফাচ্ছিল। মাথা ভোঁ ভোঁ।
কয়েক মিনিট কেটে যায়। দ্বীপ বাড়ির ভিতরে হাওয়া। জামাই আর মানিক বেকুব মুখে দাঁড়িয়ে।
এক মোটা সোটা মহিল এসে জানায়, দ্বীপের করনারি কী যেন! অপেরেশন করলে বাঁচবে। এক্ষুনি ভর্তি নিয়ে নেবে।
“আপনার কাছে কার্ড বা ক্যাশ আছে তো? হাজার পঞ্চাশ দিয়ে ভর্তি করুণ। বাকিটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আমাদের পরিষেবা, ডাক্তার, ব্যবস্থা, সব এ ক্লাস! আসুন এই এদিকে আসুন!”
মানিক মন্ত্রমুগ্ধের মতন চলে। ব্যাগ থেকে বার করে টাকার গোছ। ফর্মে নাম লেখে, সই করে। আর ঠিক তখনই আসে সু-এর ফোন!
সবটা বলতে পারে না সে। জামাইকে ফোন দিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে নরম চেয়ারে। এসির হাওয়ায় তার চোখে ঘুম নামতে থাকে।
যথা সময় দ্বীপ নারায়ণের অস্ত্রোপচার সাঙ্গ হয়। ডাক্তারবাবু জানান বুড়ো আরো বাঁচবে! আর তা সম্ভব হল মানিকের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য!
“আপনি হিরে-মানিক নন, হিরো- মানিক!” বলেন তিনি।
ততক্ষণে ধ্রুব এসেছে হাসপাতালে। এসেছে সু।
সব কাজ মিটিয়ে ওরা ধ্রুবর বাড়ি ফিরে আসে রাতের দিকে।
সু এখন মানিককে অন্য চোখে দেখছে। চা দেওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে গেছে মানিককে নাকি রনবীরের মতন দেখতে। কাপুর না সিং, কাপুর না সিং মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল মানিকের, ধ্রুব জানাল পুলিশ এসেছে মানিকের খোঁজে। বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে।
তাহলে ধ্রুব সব ধরে ফেলেছে? কখন দেখল কে জানে? নাকি হাসপাতাল থেকেই জেনেছে, মানিক দ্বীপকে ভর্তি করেছে? তাতেই সন্দেহ হয়েছে? যাক গে, যাক, মানিক ঠিক করল সে বাধা দেবে না। অপরাধ করেছে, সাজা তো পেতেই হবে।
সিঁড়ি দিয়ে মানিক বেশ শান্তভাবেই নামল।পিছনে পিছনে ধ্রুব ও সু।
তারাও শান্ত, অভিব্যক্তিহীন। মানিকের বুক একটু টনটন করছিল।
পাড়ার ভিতর দিয়ে তার কোমরে দড়ি দিয়ে পুলিশ নিয়ে যাবে, সু তাও চোখের জল ফেলছে না? পাষাণ! পাষাণ! একে তুই মন দিয়েছিস রে পাগল? মনে মনে বলে মানিক।
ধ্রুবই দরজা খোলে। সদরের বাইরে দাঁড়িয়ে ধ্রুবর আই-পি-এস বন্ধু সজল। এঁকে ধ্রুব পুলিশ বলেই ডাকে। মানিকের সঙ্গে এনার পরিচয়ও আছে। মাথাটা টালুমালু ছিল বলে মানিক প্রথমে বুঝতে পারেনি।
সজলের হাতে একটা চাবি আর দরজার ঠিক বাইরেই দাঁড় করানো একখানা ঝাঁ চককচকে মোটরবাইক!
ধ্রুব বাইকের চাবিটা সজলের হাত থেকে নিয়ে মানিকের হাতে দেয়।
“এই নাও! এটা তোমার। মাস দুয়েক আগে বুক করেছিলাম। আজ বিকেলবেলা দেওয়ার কথা ছিল। তাই তোমায় থাকতে বলেছিলাম। এদিকে আজই বাবা খেল দেখালেন, তাই নাটকীয় মুহূর্ত রচনা করা গেল না! ঠিক হ্যায়! জীবনে সব কিছু চিত্রনাট্য অনুযায়ী আর কবে হয়েছে?
মানিক হাউমাউ করে কাঁদছিল। “ক্ষমা ক্ষমা” বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে বোমা বোমা বেরোল মুখ দিয়ে!
সু হলুদের ছোপ লাগা দাঁত দেখিয়ে হেসে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলল “ও খুব ইমসনাল গো, কাকাবাবু!”
ধ্রুব হেসে বলল, “ভালবাসার বাঘ বেরলে অমন হয়! যা তোরা একটু ঘুরে আয়। আমি আর পুলিশ বরং এক হাত দাবা খেলে নিই ততক্ষণ!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন