মোজাফ্ফর হোসেন
চিনি না, দরজায় টোকা পড়ল, খুলে দিলাম। ছিদ্রটা কদিন থেকে নষ্ট, ময়লা জমেছে, ভেতর থেকে ঠিকমতো বোঝা যায় না। নীলু বারবার করে বলে গেল, কেউ এলে না বুঝে দুম করে খোলার দরকার নেই। পাশের ফ্ল্যাটেও সেদিন দিনেদুপুরে ডাকাতি হয়ে গেল। খোলার পর নীলুর কথা মনে পড়ে হাসি পেল। লোকটা আর যাই হোক ডাকাত হবে না। দরজাটা আলগা হতেই খুব চেনা মানুষের মতোই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লেন। আমার লেখার ঘরের বারান্দার চেয়ারে বসে বললেন, “পানি দাও। অল্প ঠান্ডা। গরম চা আধাঘণ্টা রেখে দিলে যেমন হয়।” চায়ের তুলনাটা দেয়াতে বুঝতে সুবিধা হলো। আমি এক কাপ চা দু ঘণ্টা ধরে খাই। বলে দিতে পারব কত মিনিটে কতটুকু ঠান্ডা হয়। লোকটা আমাকে জানে সম্ভবত। হয়ত আমাদের পরিচিত কেউ হবে। লেখালেখি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে মাঝে লেখালেখির বছরগুলোতে চেনা লোকগুলো খালি দূরে সরে গেছে। লোকটি তাদেরই একজন হবে ভেবে আর পরিচয় জানতে চাইনি।
আমি পানি দিয়ে চা নিয়ে আসি। চুলায় পানি চাপানোই ছিলাম। লোকটির বয়স আমার চেয়ে বেশি হবে। ভাই না চাচা নাকি মামা বলব ঠিক করতে না পেরে ভাববাচ্যে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”
“খুব কঠিন একটা প্রশ্ন।” বলে লোকটা পানিটা দামি হুইস্কির মতো করে হিসাব করে পান করা শুরু করলেন।
আমি নিজে প্রতিদিন কতশত প্রশ্ন সিগারেটের ধোঁয়ার মতো ভাসিয়ে দিই! তাই কোনও প্রশ্নের উত্তর আমাকে কোনোদিনই তাড়া করে না। এই কারণে নীলুকে কোনও প্রশ্ন করলে অভিমান করে বলে, “তুমি আমার কোন উত্তরটা মন দিয়ে শুনেছ?” নীলুর এটা পাল্টা প্রশ্ন কিনা, আমার কিছু বলা উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতে নীলু উঠে যায় ওর কাজে।
লোকটিও সম্ভবত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবেন না। পানির অর্ধেকটা শেষ করে রেখে দেন। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট অফার করা ঠিক হবে কিনা ভাবি একবার। অনেক ধূমপায়ী বুকপকেটে সিগারেটের প্যাকেট রাখে। ভদ্রলোক পকেটবিহীন সাদাকালো চেক শার্ট পরে আছেন। ফুলহাতা। প্যান্টের পকেটে থাকাটা বেশি স্বাভাবিক। যারা তুখোড় স্মোকার তাদের পকেটে আবার অধিকাংশ সময় কোনো সিগারেট থাকে না। লোকটির শরীর থেকে সিগারেটের গন্ধ আসে কিনা বোঝার চেষ্টা করি, বারান্দায় এত বেশি ধূমপান করি যে নীলু এখানে দাঁড়ালে ওর শরীর থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসে। কিন্তু কি আজব ব্যাপার, আমি টানি বেনসন লাইট, ওর শরীর থেকে যে স্মেল আসে সেটা গোল্ডলিফের। একবার আমি সন্দেহ থেকে নীলু যে-দুজন সহকর্মীর সঙ্গে মেশে তাদের সিগারেট পরীক্ষা করেছিলাম। একজন অধূমপায়ী, অন্যজন আমারই মতো বেনসন লাইট-ভক্ত। এরপর অনেকদিন ভুলে গিয়েছিলাম বিষয়টা। নীলুই একদিন বলল, ও যে পারফিউম ব্যবহার করে তার সঙ্গে মিশে গন্ধটা বদলে যায়। আমি কি নীলুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম? নাকি ও নিজে থেকেই বলেছিল? সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে প্রশ্নটাও ভাসিয়ে দিই। লোকটি একবার তাকান আমার দিকে। যে সিগারেট টানে, তাকে সেটা অফার করা সৌজন্যতা, তবে অধূমপায়ীকে অফার করলে অভদ্রও ভাবতে পারে। আমি না চাইলেও আমাকে এখন এর যে কোনও একটি অবস্থা বেছে নিতে হবে। জীবন এভাবেই কখনও কোনও প্রশ্নে নীরবতার মধ্যেও একটা উত্তর খুঁজে নেয়। আমি সবসময় দ্বিতীয়টা পছন্দ করি, অর্থাৎ উত্তরের ভারটা নিজের উপর নিই না। এক্ষেত্রেও সেটা করব কিনা ভাবতে ভাবতে একটা সিগারেট ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিই। ভদ্রলোক দেখলেন না। না দেখার অভ্যাসটা আমারও আছে। প্রায়ই নীলু সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি চিৎকার দিয়ে ওকে ডাকি। টেবিলে চা ভর্তি কাপ রেখে আরও একটা বানিয়ে আনি। নীলু এও বলেছে, আমি নাকি সিগারেট টানতে টানতেই সেটাতে ফের লাইটার ঠুকি।
লোকটি চায়ের কাপটা হাতে নেন কিন্তু মুখে তোলেন না। আর যাই হোক চোর কিংবা ডাকাত হওয়ার কথা না। আমি এখন তাকে বসিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে অন্য কাজ থাকলে সেরে নিতে পারি। আপনি কি দুপুরে খেয়ে যাবেন? জিজ্ঞাসা করি। কথাটা বলার পর মনে হয়, প্রশ্ন না করে বাক্যের শেষে একটা ‘কিন্তু’ বসালে ভালো হতো। একটা ’কিন্তু’! ‘কিন্তু’—কত ব্যবহৃত আবার কত অচেনা একটা শব্দ! সবচেয়ে সরল, সবচেয়ে জটিল। কিন্তু! আমার জীবনটা? কিন্তু। একটাই কিন্তু। নীলুকে যেদিন প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি কি থাকছ আমার সঙ্গে?” ও কত অনায়াসেই না বলে দিলো, আছি। এরপর সে একটা মৃদু নিঃশ্বাসের মতো ‘কিন্তু’ বলে বেরিয়ে গেল। আমি যে উপন্যাসটা মাঝপথে থামিয়ে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি সেটার শেষ শব্দও ‘কিন্তু’। এই একটা শব্দ আমার লেখার ইচ্ছাকে চিরকালের মতো থামিয়ে দিয়েছে। অথচ শুরু করেছিলাম এই শব্দটা দিয়েই। “কিন্তু আমি হত্যার টেবিল থেকে উঠে এলাম রক্তাক্ত চাকু হাতে, কাউকে আঘাত না করেই।” আমার প্রথম উপন্যাসের ওপেনিং।
“কোথায় যাব?” লোকটি প্রশ্ন করে। কোনও শব্দের ভেতর ঢুকে পড়লে আমার আর বের হওয়ার কথা মনে থাকে না। লোকটিকে যে এভাবে বসিয়ে রেখে আমি বেকার ভাবনার মধ্যে চলে যাচ্ছি সেটা বুঝতে পেরে খারাপ লাগে। ভদ্রলোক এই প্রশ্ন কেন করল আমি মনে করতে পারি না। আমি কি কোনো প্রশ্ন করেছিলাম? সিগারেটের শেষ টানটা দিই। দরজা খোলার শব্দ হয়। নীলু ফিরেছে। দরজা খোলা রেখেছি বলে নিশ্চয় ও বকা শুরু করবে। ভেবেছিলাম একদিন বলি, ওর ভেতরে আসতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যই খুলে রাখি। কিন্তু আমি নিজেই নিশ্চিত হতে পারি না কেন খুলে রাখি। আর কোনও কথা নিশ্চিত না হয়ে বলে দিলে নীলু ধরে ফেলে। ও আমাকে যত ভালো করে পড়তে পারে, পৃথিবীর কোনো উপন্যাসই আমি এত ভালো করে পড়তে পারিনি। নিজেকে এতটা তরল ভেবে মাঝে মধ্যে বিরক্ত হলেও ওর এই ক্ষমতার সুবিধাও নিয়েছি। একদিন যেমন বললাম, “কাল থেকে চাকরিতে যোগ দেব। একা ঘরে বসে থাকা ঠিক হবে না।” নীলু বলল, “এটা তোমার মনের কথা না।” আমি দ্বিধায় ছিলাম। ওর কথায় নিশ্চিত হলাম। সেই থেকে নিয়ম করে অফিস করার ঝামেলা চুকিয়ে ঘরে বসে আছি। সবসময় ভেবেছি কাজ না থাকলে জয়েসের মতো একটা উপন্যাস লিখতে পারতাম। কাজ ছাড়ার পর শুধু একটা শব্দই যোগ করতে পেরেছি অসমাপ্ত উপন্যাসে—‘কিন্তু’।
নীলু কিছু বলে না। শোবার ঘরের দিকে চলে যায়। আমি লোকটির পাশে বসি, বলি, নীলু ফিরেছে। লোকটি বেখেয়ালে পিঁপড়ের ঘরে ফেরা মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই মিছিলের দিকে তাকিয়ে আমি ‘গার্মেন্টস’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। জীবনে একবারই গার্মেন্টস ছুটি হওয়ার পর শ্রমিকদের ঘরে ফেরার দৃশ্য দেখি। তাও ছাত্রজীবনে। গল্পটি পড়ে এক সমালোচক লিখেছিলেন, এই দৃশ্য নিয়ে আমি নাকি বিস্তর গবেষণা করেছি। অথচ গবেষণা করে জীবনে একটাই উপন্যাস লিখেছি, ‘মাছরাঙার ঠোঁট’। ছোটবেলায় বাড়ির সামনের পুকুরের একপাশের দেয়াল ছিল মধুর চাকের মতো গর্ত গর্ত। আমি দিনের পর দিন বসে থেকে ওদের জীবনের সুখদুঃখ ভাগাভাগি করেছি। এরপর একদিন দেয়ালটা পাকা করে দেওয়া হলো। মাছরাঙা পুকুরের মাছ খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে বলে অনেকে মনে করতে পারেন; কিন্তু না। পুকুরে ভোর রাতে কোলের মেয়েকে রেখে মুতাপাগলি গোসল করতে নেমেছিল। এরপর সে উঠে দেখে মেয়েটি নেই। সে মাছরাঙার গর্তে তখন হামলা করে। বোবা পাগলির আচরণে মানুষ ধরে নেয় কাজটি মাছরাঙাদের। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রথমে ওদের মারা হয়। এরপর কেরোসিন ঢেলে গর্তে গর্তে আগুন দেওয়া হয়। চোখের সামনে শতশত মাছরাঙা উড়ে যেতে দেখি আগুনঠোঁটে। ছেলেদের সাথে আমিও সেদিন গর্তে হাত ঢুকিয়ে সিদ্ধ ডিম বের করে খেয়েছিলাম। একটা পোড়া বাচ্চা নিয়ে মুতাপাগলি সেই যে হারিয়ে গেল মাছরাঙার পথ ধরে, আর ওদের ফিরে আসতে দেখিনি। গল্পটি লেখার আগে আমি মাছরাঙা নিয়ে পড়াশুনা করি, ডিসকভারির ডকুমেন্টারি দেখি, ড্রাইভার ইকবাল পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে কোথা থেকে যেন একটি মাছরাঙা ধরে এনে দেয় খাঁচায়। পাখিটির মৃত্যুর শেষদৃশ্য পর্যন্ত আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। আর সেই গল্প যখন প্রকাশিত হলো, লোকজন বলে কিনা, মাছরাঙা নিয়ে আমার কিছু পড়াশুনা করা উচিত ছিল!
নীলু বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার প্রায় সকল আত্মীয় পরিচিত মানুষ ওর চেনা। নিশ্চয় লোকটাকে ও চিনতে পারবে। ভাই বলবে না মামা, কিংবা অন্য কিছু? ভাই না বলে দাদাও বলতে পারে, নীলুর দাদা ডাকার অভ্যাস আছে। ওর বড়ভাইকে ওরা দাদা বলে ডাকত। ভাইকে দাদা ডাকে হিন্দুরা, ছোটবেলায় এ নিয়ে অনেক হাসাহাসি করেছি আমরা। নীলুরা তাদের ভাইকে দাদা ডাকে—বাবা মা বেঁচে থাকলে এই কারণে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হত না। প্রথম রাতে নীলুকে এই কথা বলে আমরা দুজনেই হেসেছি। যতই হাসাহাসি করি না কেন ওর দাদাকে দাদা বলে আমি ডাকতে পারিনি। এই অক্ষমতা আমার আছে জেনে নীলু বলেছিল, “তুমি লেখক কিন্তু শিল্পী না।” ওকে বোঝাতে পারিনি, কিংবা চাইওনি, ওর দাদাকে আমি দাদাই ডাকতে চেয়েছি সবসময়, আর তাতে যে আমার বাবা মায়ের চেহারা ভেসে উঠেছে সামনে, সেই মুহূর্তটি উপভোগ করেছি। একটা শব্দ অন্তত ছিল অতীতের সাঁকো হয়ে। শুধু এই কারণে ওকে বিয়ে করে আমি সুখ পেয়েছি। আর কোনওভাবে নীলু আমাকে এতটা সুখ দিতে পারেনি। নীলুকে কি কোনওদিন বলেছি সেটা? না, বলিনি, বললে ও ভাবত আমি শিল্পী হওয়ার বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছি। আজ অবশ্য বলা যায়। কিন্তু নীলু লোকটিকে দেখেও কিছু বলে না। না দেখার মতো করে চোখটা ভাসিয়ে নেয় উপর উপর। ভদ্রলোকও নীলুর উপস্থিতিকে পাত্তা দেন না। আমাকেই শেষ পর্যন্ত বলতে হয়। নীলুকে বলি, “আসো, পরিচয় করিয়ে দিই।” কিন্তু লোকটির পরিচয় তো জানি না। একজন অচেনা লোককে ভেতরে বসিয়ে চা পানি খাওয়াচ্ছি জানলে নীলু ছেড়ে কথা বলবে? বুদ্ধি করে লোকটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলি, “নীলু, আমার স্ত্রী।” লোকটি আমার কথা শোনেন, নীলুরও না শোনার কারণ নেই। কিন্তু ওরা নিজেদের ভেতর কোনও কথা না বলে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি বিরক্ত হই। আমাকে রীতিমতো অপমান করা হচ্ছে। ভদ্রলোককে বলি, “আমার স্ত্রী। আপনি ওকে চেনেন?”
লোকটি মৃদু হেসে বলে, “হুম। দুর্ঘটনার দিন ছিলাম।”
“কিসের দুর্ঘটনা? কোন দুর্ঘটনা?”
“আত্মহত্যার দিন।” বলে ভদ্রলোক মুখটা এমন করে বন্ধ করেন যেন পৃথিবীতে এটাই তার শেষ কথা।
নীলু আত্মহত্যা করেছে? আমি প্রশ্নটা করতে গিয়ে নীলু পাশে আছে ভেবে চেপে যাই। নীলুর দিকে ফিরে তাকাই। ওকে খুব নিশ্চিন্ত মনে হয়। বলি, “সকালে এসেছেন। তুমি চলে যাওয়ার পর। তুমি কি চিনতে পারছ না?”
নীলুকে বিরক্ত মনে হয়। বলে, “যে উপন্যাস আর কোনওদিনই শেষ করবে না, তাকে কেন মাথা থেকে নামাচ্ছ না?”
“না, ভদ্রলোক সত্যিই এসেছেন নীলু। আমি তাকে পানি আর চা খেতে দিয়েছি। আমার উপন্যাসের সেই চরিত্র না। তাকে আমি আগের দিনই বলে দিয়েছি আর না আসতে। আর কখনোই আসবে না সে। বলেছি না, তার অপমানবোধ আছে!”
নীলু আর কিছু না বলে ধীর পায়ে ভেতরে চলে যায়। আমি পেছনে পেছনে বোঝাতে চেষ্টা করি। নীলু শোওয়ার ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ্নভাবে। এরপর রোজ যা করে আজও তাই করে। দেয়ালে ফুলের মালা পরিয়ে সেঁটে থাকা আমার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। নীলুকে বোঝাতে চেষ্টা করি, “আমি বেঁচে আছি নীলু।” আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। লোকটিকে ছুটে গিয়ে বলি, “নীলু বেঁচে আছে।” আবার নীলুর কাছে ছুটে আসি, বলি, “বারান্দায় সত্যি সত্যি একজন এসেছেন নীলু। লোকটি চা খেয়েছে। আমি দুটো সিগারেট শেষ করেছি তার পাশে বসে।”
নীলু এবার হাসতে হাসতে বলে, “তুমি সিগারেট খাও না। অধূমপায়ী। কিন্তু তুমি মাঝে মধ্যে আমার জন্য সিগারেট কিনে আনতে। গোল্ডলিপ।”
“কিন্তু লোকটি? লোকটিকে দেখো কিভাবে বারান্দায় পিঁপড়ের সারিবদ্ধ চলা দেখছেন। মনে আছে, আমি অনেক দিন ঝাঁকভাঙা পিঁপড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে গার্মেন্টস গল্পটি লিখি, ওই যে, যে-গল্পটি প্রসংশিত হয় খুব? তুমিই না একটা আলোচনা পেপার থেকে পড়ে শোনালে; ভুলে গেলে?”
“তুমি এখন যে গল্পগুলোর কথা বলো, যে গল্পগুলোর কথা তোমার মনে পড়ে, এর কোনওটিই তুমি লেখোনি।”
“গল্পগুলো কি মিথ্যা তবে, নীলু?”
“এখন আর কোনওকিছুই মিথ্যা না”— বলে নীলু বারান্দায় চলে যায়। লোকটির পাশে বসে। ওরা কথা বলা শুরু করে। আমি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিই। অনেকক্ষণ পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকি, মনে হয় বহু বছর আমি বাথরুমের বাইরে বের হইনি। জীবনটা সত্যি সত্যি কি একটা বাথরুমের ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার জানা নেই। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি নীলু আর কে যেন ড্রয়িংরুমের বারান্দায় বসে। ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
আফজাল ভাই এসেছেন উপন্যাসটা নিতে। “তুমি নাকি আজ আসতে বলেছ?” নীলু বলে।
“হ্যাঁ, আপনার কথামতো অ্যাডভান্স নিয়ে এসেছি। আপনি গোসলে, এই সুযোগে জেবা ভাবীর সঙ্গে গল্প করছি।”
জেবা? দেখি আফজাল ভাইয়ের পাশে জেবা বসা।
আমি টেবিলে প্রিন্ট করা পাণ্ডুলিপিটি আফজাল ভাইকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসি। তিনি নেড়েচেড়ে দেখেন। আমাকে পেনড্রাইভ দিয়ে বলেন, “সফট কপিটা দিয়ে দেন। পিডিএফ করা থাকলে সঙ্গে দিয়েন।”
আমি পেনড্রাইভ নিয়ে ভেতরে যাই। আফজাল ভাই বারান্দা থেকে জানতে চান, “নীলু নামের বানানটা কি ঈ-কার দিয়েই রাখবেন? আজকাল সব তো ই-কার হয়ে যাচ্ছে।”
জেবা হাসতে হাসতে বলে, “একবারও পিপীলিকা বানানটা ঠিক করে লিখতে পারিনি। কতবার মারও খেয়েছি। একে তো ঈ-কার ও ই-কারে গণ্ডগোল, তার ওপর পিঁপড়েতে চন্দ্রবিন্দু থাকলে পিপীলিকায় কেন থাকবে না?”
জেবার কথা ভাবতে ভাবতে আমি লক্ষ্য করি বাঁ পায়ের কাছ দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে পিঁপড়ের দল ঢুকে যাচ্ছে খাটের নিচে। ওদের সারি ভেঙে দিয়ে ছুটোছুটি দেখতে আমার অসম্ভব আনন্দ লাগে। আমার পা চলে যায় পিঁপড়ের সারিতে।
“যে উপন্যাস আর কোনওদিনই লিখবে না, সেটা খুলে বসে আছো যে?” পেছনে থেকে নীলা বলে। ও কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার তখন মনে পড়ে, নীলা আজ অফিসে যায়নি। ওর ঘরে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু আজকের দিনটা কোনও দিন সেটা আর মনে পড়ে না। নীলা কি আজ অফিসে যায়নি নাকি অন্যদিন? প্রশ্নটা মাথায় এদিক সেদিক করতে করতে বারান্দার দিকে উঠে যেতে গেলে নীলা অভিমানের সুরে বলে, “জেবা নামটা বদলে দাও। হোক অসমাপ্ত এবং মৃত, প্রাক্তন প্রেমিকার নাম ঘরে কোথাও থাকুক কোনও স্ত্রীই সেটা চাইবে না।”
“পেনড্রাইভটা ফর্মেট দিয়ে ফাইলটা সেন্ড করেন।” বারান্দা থেকে আফজাল ভাই আমাকে বলেন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন