short-story-vuter-rani

ভূতের রানি দিলো ধড়
সুমন ভট্টাচার্য


প্রেতরীতিসম্মত সতর্কীকরণ: অনূর্ধ্ব অষ্টাদশ ভূত পেত্নীদেরও পড়া নিষেধ। গর্‌র্‌র্‌র্‌

তোমরা কখনও কী কেহ ভূত বা পেত্নী হইয়াছ? বালাই ষাট, না হইলে হইয়াও কাজ নাই। তবে আমি কয়েকজনকে জানি যাঁহারা অমন হইয়াছিলেন। আসুন, আমরা তাঁহাদের কথা শুনি।

মাসতিনেকে সময়টা খুব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে সুখবিলাসের। মুখস্থ ছাড়া আর কি! দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার এলেই কেউ যেন মুখে একটা বেদম টান দিয়ে নিয়ে আসে সেই বেদম খাড়াইওলা নেই-দেয়াল পাঁচিলের কাছটায়। তড়াক করে লাফিয়ে, নাকি লাফটাফ নয়, নেই বঁড়শিতে গাঁথা মাছের মতন তারও মুড়োটা, উঠে যায় সেই পাঁচিলের ওপর।

পাঁচিলের ওধারে যিনি মাসদুয়েকই হয়েছে যে আবিষ্কার করেছেন, ওই মুখটি মুখিয়ে থাকে তাঁরই দিকে, তাঁর নাম অধরা। তিনি ওই চূড়ৈল মহল্লায় জমা পড়েছেন মাস পাঁচেক। ব্যাপারটা এমনই, যে জমাদারনি চুন্‌চুন্‌দিদিও খেয়াল করলো যে অধরা ওই পাঁচিলের কাছে গিয়েই থানা গেড়ে বসে এবং সেই ভাসমান বা গড়গড়ায়মান মুণ্ডুর দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।

এই ভৌতলোকের বিজ্ঞান, কে কতটা জানেন, জানা নেই। তবে কতককতক বলে না দিলেও নয়। যাঁরা জানেন, তাঁরা তো জানেনই। অপঘাতে মৃত এবং পারলৌকিক ক্রিয়া যাদের অসমাপ্ত-অসম্পূর্ণ বা অঘটিত, তাঁদেরই এনে রাখা হয় প্রেতলোকে। তারও কয়েকটি অন্তর্বর্তী বিভাগ আছে। অত কিছু বলবার জায়গা এটা নয়, আপাতত এইটুকু জানলেই চলবে, সুখবিলাস ধর নামা এক নীরোগ-নিরীহ-নিরাপদ এবং খুব একটা নিরামিষ নয় যুবাপুরুষ সহসা এক দুর্ঘটনায় ধড় ও মুণ্ড আলাদা হয়ে গেলে, ওই প্রেতলোকের বর্তমান বাসিন্দা। মর্ত্যলোকে তাঁর বন্ধুজন কেবলমাত্র মুণ্ডখানির সৎকার করতে চাইলে, ধড়বিযুক্ত সুখবিলাসের মুখে মুখাগ্নিও করতে চায়নি কেউ। আর অধরা তালুকদার নাম্নী তরুণীও ধড়-মুণ্ড একত্র থাকলেও এমনভাবে পিষ্ট হয়েছিলেন যে- থাক সে যন্ত্রণার কথা, অর্থাৎ মৃত্যুর সময়কার পরিস্থিতিতে তিনি অধরাই থাকলেন। এবং তাঁরও স্থান প্রেতলোকে। তবে তাঁর জানানামহল অর্থাৎ চূড়ৈলমহল্লায়। ওদের পারলৌকিক স্থিতির বিধান অপ্রদত্ত। ফলে, স্বর্গ না নরক, তার নির্ধারণ না হওয়ায়, এদের এমন আলাদাই করে রাখা হয়। পুরুষবিভাগ, অর্থাৎ পিরেতমোকামে তেমন পাহারা নেই, কারণ এখানে মুখ্যত দুই প্রকারের বাসিন্দা। একপক্ষ প্রেতিনী উদাসীন। সম্ভবত জীবিতকালেই চারপাশের নারীকুলে পরীর মায়ায় পেত্নীস্থিতিতে এখন… একটু আরামে-বিশ্রামে। আর অপরপক্ষ অভিজ্ঞতার ভাবে অথবা অভাবেও অত্যুৎসাহী। যাদের বিশেষ দক্ষতা আছে, এখনও ইহজগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন এবং ভূত হওয়ার পর ভূতপূর্বপরিচিতাদের দিকে ধাওয়াটাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সেই চূড়ৈল মহল্লায় কড়াকড়ি খুব। তার হেড জমাদারনি চুনচুন মানুষটি কিঞ্চিৎ মিছরির মতন। প্রয়োজনে ছুরিকারূপিনী হলেও ছুঁড়িদের প্রতি সুমিষ্ট এবং সামান্য লেহনে বিগলিত হওয়ার প্রবণতা রাখেন। অন্তত তাই বলেন পেত্নীরা। তা চুনচুন-ই অধরাকে বললেন, যা না একটু কথা বলে আয় না। তারপর দেখি কতদূর কী করা যায়! অতএব অধরাই সুখবিলাসের সঙ্গে আলাপে প্রবৃত্ত হয়ে, ঠেকে গেলেন। না নামে নয়। পদবিতে। সুখবিলাস তাঁর ধর পদবি বলতে বলতেই কেঁদেই ফেললেন একটু ফোঁৎ ফোঁৎ করে। আর অপরপক্ষ ভরসা দিলেন যে তিনিও অধরা। র- আর ড় এর তফাৎ নিয়ে খুব বেশী ভাবিত হলেন না কেউই।

তৃতীয় দিনে পাঁচিলের ওপর উঠে, অধরা গল্পে মাততে চাইলেন সুখবিলাসের সঙ্গে। চতুর্থদিনে পরম আগ্রহে আশ্লেষের অনুরাগে যেতে গিয়েই বুঝলেন, এ যেন একটি, বেড়ালের পশম গোলা নিয়ে খেলা! আর তাতে বেচারা সুখবিলাসের ধড়টি না থাকায়, দুজনের কারোরই সুখ বা বিলাস সবই অধরাই থাকলো, এক্কেবারে।

ধড়ছাড়া তো, মোটামুটি গুটি দশ পনেরো থাকেই, আর পাশের শাখা পিরেতমোকামে কবন্ধও থাকেই। কখনো কখনো তাদের নিজেদের বেশ একটা আপোষরফা বন্দোবস্তে, চিরস্থায়ী না হলেও ক্ষণস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কারবারও যে চলে না, তা নয়। কিন্তু সেদিন অধরার কোলে ধরা দিয়েও সুখবিলাস ডুবে গেলেন অসুখের চরমে। হাতও নেই, যে সুতরাং থাকার মধ্যে যে সবেধন নীলমণি কপাল, চাপড়াতে পারলেন না তা-ও। বসে না শুয়ে, তা জানা নেই। অধরার কোলে সেই কথাই বললেন, ‘আমার এমন বরাত, তুমি আমার কাছে ধরা দিয়েও অধরাই থাকলে। আর আমি একটু কপাল চাপড়াতেও পারবো না! এমনই কপালের লেখা!’ আরেকটি তরুণী প্রেতিনী এবং চুনচুন – প্রেতিনীস্বভাববশতঃ কাছাকাছিই ছিল, তাদের প্রণয়লীলা দেখতে। বলে উঠলো, ‘কিন্তু পাঁচিলে কপাল ঠুকতে পারেন, যাকে মাথা কোটা বলে তা-’

একথায় অধরা বিরক্ত হলেন, ‘তা না হয় পারলো- তাতে ওর একটা শরীর পেতে সুবিধে হবে কিছু?’

– তাহ’লে তুইই যা, মাথা কুটতে থাক্‌, তা’তে যদি কিছু হয়।
চুনচুনের এই কথায় অধরা বিস্মিত, ‘মানে? আমি মাথা কুটলে—’
– ‘মাছের নয়, তোমার নিজের, আর তা আমাদের দুপুরের পাতে মুড়িঘণ্ট হতে নয়, আমাদের সেকশান ইনচার্জ, চূড়ৈল মহলের বিবিসাহেবার কাছে, যা না, একবার –’

অতএব, সুখবিলাসকে আরেকটু একতরফা আদর করে নিজমহলে পাঠিয়ে, ‘তুমি চিন্তা ক’রো না, দেখছি কিছু করা যায় না কি-না’ বলে মোটামুটি : যদি হও বেউলা সতী মুখে দিব ধড়ের গতি – এমন এক প্রতিজ্ঞা করে অধরা সঙ্গে সঙ্গেই চুনচুনকে নিয়ে চলে গেলেন ভূতেদের রানির মহলে।

প্রেতিনীদের রানির ক্ষমতাও খুব বেশি নয়। তবে হালে প্রেতিনীদের ক্ষমতায়ন বিষয়ে অনেকটা সচেতনতা দেখা দিয়েছে। রানি সব শুনে, কতক ভাবলেন, তারপর তাঁর আপ্তসহায়িকাকে বললেন, ‘হ্যাঁরে, ওই টেংরিখোলার বাড়িঘরে যে ছোকরা পাহারা দেয়, তার আবার তোর দিকে একটু নজর আছে না?’

– ‘আজ্ঞে রানিমা, তা কতক কতক আছে বটে—’

– ‘তবে তুই ওই ছোকরা ভূতকে ওখানে সেঁধোবার ব্যবস্থা কর – খবর পেয়েছি ওখানে বেশ কটা অমন মুণ্ডু কাটা, কবন্ধ, কবন্ধ যাকে বলে তা মজুত আছে।’

– ‘কিন্তু তার তো হিসেব করা – স্টক রেজিস্টার –’

– ‘ছোঃ! কিচ্ছু খবর রাখিস না- ওই লাশগুদামের চৌকিদার আর ওইখানকার ছোকরা ভূত দুটোই ফাঁকিবাজের আঁটি। কিচ্ছু করেনি। তায় আজই ঝামেলা আছে কয়েকটা লাশ পাচার হবে, বুঝতে পারিস?’

অধরা ভূতের রানির পায়ে মাথা রেখে পেন্নাম করবেন, ঠিক তখন তিনি বললেন, ‘শোন এবার এই সমস্ত প্রেতলোকের প্রেসিডেন্ট পোস্টের যে ইলেকশন হবে সেখানে পেত্নি-শাঁখচুন্নি-ডাকিনী সকলেরই প্রেসিডেন্ট হওয়ার অধিকার থাকছে, এই প্রথম। তা আমার জন্য তোরা তো আছিসই, আর ওই যে যার জন্য বললি, কী যেন লাশ – কী যেন সুখের লাশ – ’

– ‘সুখের লাশ নয় ম্যাডাম-’

– ‘অ্যাই ম্যাডাম না- হার হাইনেস- হার হাইনেস বলা রপ্ত কর- তা ওই ছোকরাকেও বলিস ধড়টা পেয়ে গেলে পর, যেন ক্যাম্পেন করে আমার হয়ে, এখন যা।’

চুনচুনের দৌত্যে পিরেতমোকামের সর্দার ঘুনঘুন সুখবিলাসকে দেখা করতে বললো অধরার সঙ্গে। আর অধরা হদিশ দিলেন সেই ধড়-কে ধড়পাকড় করে আনবার ঘাঁতঘোঁতের।

পুরুষমানুষের যেমন প্রেতেরও তেমনি, শরীর আনবার সময় সুখবিলাস আবদার করলেন ‘উঁ, তুমি আমার সঙ্গে চলো, ধড়টা পেয়েই আমি তোমার কাছেই ধরা দেবো, আর তুমি আমার অধরা – না-না তুমি অধরাই থাকবে। কিন্তু আমার ধড়ে, আমার ধরায় ধরা দিয়ে-’

– ‘হুঁ, আমার এই অধরা নামটাই জানো অপয়া, তাইতো জ্যান্ত অবস্থায় আমার জানো কোনো ইয়ে জোটেনি – উঁ-’

এইসব কথার তালে তালে সুখবিলাস অধরাকে নিয়ে, বা অধরা দেবী কালিকার করতলে ধৃত পুংমুণ্ডটির মতো অথবা বিলাসিনী নারীদের হাতে দোলানো মহার্ঘ্য বটুয়ার মতো করে দোলাতে দোলাতে সুখবিলাসকে নিয়ে রওনা হলেন মড়িঘরে। মড়িঘরের এজেন্ট ভূত চার-পাঁচটা লাশ দেখিয়ে বললেন, ‘ওদের থেকে বেছে বুছে পছন্দ করে নাও হে- নিয়ে সটকে পড়ো। আমায় আর জ্বালিও না-’

নরজন্মে মানুষের নিজদেহ নির্বাচনের উপায় থাকে না। অন্তত এখনও নেই। আর পরজন্ম যদি প্রেতলোক হয়, সেখানে এই অধিকার পেয়ে সুখবিলাস বুঝলেন নিজের শরীর নিজে বাছবার বিলাসিতা এবার তাঁর চোখের, এবং অধরারও হাতের মুঠোয়। তার মত সুখ কোথাও কি আছে? এবং আপনার কথা ভুলিয়া যাওয়াও সোজা, সুখবিলাস বললেন ‘কোন চেহারাটা তোমার পছন্দ, সেইটাই নেবো। পুরুষের শরীর তার যথার্থ সমঝদার তো নারীরা, থুড়ি প্রেতিনীরাই! অন্যদিনক্ষণ হলে একথায় একটা বিতর্ক বা কলহকলা গড়ে উঠতেই পারতো, তবে অধরা কোনো দোকানে গিয়ে সুখবিলাসের জন্য আউটফিট পছন্দ করার চোখ নিয়ে লাশগুলিকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনটি লাশ বেশ পছন্দ হ’ল অধরার, সুতরাং সুখবিলাসেরও।

এবার ওই তিনটির মধ্যে কোনটি নেবেন, তা নিয়ে যখন তাঁরা দ্বিধান্বিত। তখনই ভূতের রানির নির্দেশ এলো, শিগগিরি চলে এসো। লাশপাচাড়িদের দল আসছে। তিনটে ধড় নিয়েই চলে আয় – পরে নিদান বিধান দেওয়া যাবে ‘খনে।’

সুতরাং সুখবিলাস দ্রুত একটা ধড়ে মুণ্ডু ফিট করে, দুটো ধড়, চাদরের মতো কাঁধে ফেলে নবপ্রাপ্ত বাহুতে অধরাকে ধরে পরম সুখবিলাসে রওনা হলেন প্রেতলোকে। তাঁরা একটু গানও ধরলেন।

ভূতের রানি দিলো ধড়।
জবর জবর তিন ধড়।
যেমন খুশি শুইতে পারি
এক নম্বর
ধা ধা ধিনতা নাচতে পারি
দুই নম্বর
দুম দাম ধ্রাম ধ্রাম পিটতে পারি
তিন নম্বর

সুখবিলাস ধর এক্ষণে ধড়প্রাপ্ত। কিন্তু সুখের যে অসীমতা এবং রবীন্দ্রনাথ কথিত বিলাসের ফাঁদ, এবার আচ্ছন্ন করলো তাঁদের। ব্যাপারটার মূলে প্রচ্ছনভাবে অধরাই। সুখবিলাস অধরাকে জাপটে ধরে বলছিলেন, ‘এত সুখ আর পাইনি আগে, বিলাসটাও তো এখন জানে ধড় পেয়েছি, তাই তো ধরি, নামের সার্থকতা প্রমাণ করি-’

– ‘ও তোমার নামের সার্থকতায় আমার অধরা নামটা যে ভন্ডুল হ’ল, তার বেলা-’

প্রেমে পড়লে কারো কারো মাথা খোলে, সুখবিলাস বললেন, ‘কেন- ওই আমার দুটো ধড়, তারা তো তোমায় ধরতে পারছে না, তাদের কাছে তো তুমি অধরাই থাকছ, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ট, দুই ধড়-এর কাছে তুমি অধরা–’

অধরা খুবই খুশি হয়ে সুখবিলাসকে একটু আ ছি ছি ছি করে বললেন, ‘তা’লে ওদুটোও তুমিই রাখছ তো- ফেরত টেরত-’

– ‘না, না খোদ রানির হুকুম- তাই কখনো পারি-’

তাঁরা তো যে যার আস্তানায় পৌঁছলেন। সুখবিলাস বললেন বটে, কিন্তু কোন খেলা যে খেলবো কখন – এই ভাবনাটা মাথাচাড়া দিলো, কোন ধড় যে ধরবো কখন – সুখবিলাসের সুখে দাগ ধরলো একটু। তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলেন না তাঁরা। দুজনের বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ার পর প্রেতপুরোহিতের মধ্যস্থতায় বিবাহপর্ব এলে কোন শরীরটি বরবেশরূপে গৃহীত হবে এবং সেইটিই বা সেইটিইকেই পাকাপাকিভাবে রাখতে হবে কিনা, এ প্রশ্ন এলে পুরোহিত প্রেতগীতা থেকে নজির দিলেন : অঙ্গানি বিকল্পানি যথা বিহায়, ইত্যাদি ইত্যাদি, বিকল্প রক্ষা করে অঙ্গগুলিকে ত্যাগ ট্যাগ করা যায়- অবশ্য ট্যাগ-টা ইংরেজি শব্দ।

এই নির্দেশনায় সকলেই খুব খুশি হলেন। ভূতের রানির খুবই জয়জয়কার। তাঁর প্রেতিনী প্রীতিভাবাপন্নে, সুখবিলাস দুই নম্বর ধড়টিকে ধারণ করে এসে বেশ কতক নাচও দেখালেন। তবে সেই বিবাহব্যস্ততার উৎসবরাতগুলি ইহলোকে খুবই কষ্টে কেটেছিল ওঝাদের।

প্রেত-রাক্ষস-দানব-যক্ষ-খোক্কস-অসুর – যে পর্যায়েরই হোক না কেন, প্রত্যেকেরই বিবাহের পরবর্তী পর্যায় একই রকম। সুখবিলাস অধরার দাম্পত্যেও ছিল চমৎকার। বিশেষত, সুখবিলাস প্রেত হওয়ার পর তেমন কোনো দায়িত্ব বা পোর্টফোলিও কিছুই পাননি। উপরন্তু তাঁর নির্বাচিত প্রথম ধড়টি ছিল বেশ নোদোল-গোঁদল, গ্যাদাগোদা – ট্যাবাটোবা অত্যন্ত আরাম এবং শয্যাগ্রহণপ্রিয়। তা এতে অসুবিধা তেমন ছিল না কারোই। কিন্তু কর্তব্যগ্রহণের দিন এলে বিবাহরাত্রের সেই নৃত্যকলা স্মরণে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হ’ল কয়েকটি পরিবারে গিয়ে একটু নেচে আসতে হবে। অর্থাৎ ভূতের নেত্য দেখিয়ে ভয় পাওয়াতে হবে জানে দেশজ মানুষজন বিলিতে মতে গন্‌ হয়, অর্থাৎ পটল তোলে! অবশ্য সংস্কৃতমতেও গণ অর্থাৎ পিশাচে পরিণত হতে পারে। এসবই আসন্ন প্রেতলোক নির্বাচনে দ্রুত ভোটারসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য। আর এই আদেশে সমর্থন ছিল ভূতের রানির। তিনি হিসেব করছিলেন সুখবিলাসের নৃত্যদর্শনে যারা প্রেত হবে, তাদেরকে তিনি তাঁর দলেই টান্তে পারবেন। অসুবিধাও কিছু ছিল না। এবং সুখবিলাসও কবির কথায়, নাচিছে সুখধর নবীন প্রেত, তালেতে সব গৃহ কাঁপে, হস্তপদে খেলে হাজার তাল, ভয়েতে মরে লোক দাপে। সুতরাং সুখবিলাসের কীর্তি তখন উচ্চপ্রশংসিত। ইহলোকে সহসা বেশ উচ্চ মৃত্যুহার, প্রেতলোকে প্রতিদিন হিসেবের বাইরে আমদানি। বিশেষ করে সুখবিলাস এই জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে একটি ট্রুপ খুলবার প্রস্তাব দিলো – যেখানে অপঘাত মৃত্যুর পরিসংখ্যান ছুঁয়ে যাবে অথবা ভেঙে দেবে সর্বকালের রেকর্ড। একক প্রদর্শনীর বদলে দলবদ্ধভাবে নৃত্য প্রদর্শন করলে পিশাচ-পিশাচিনীর পদতালভারেও ভেঙে যেতে পারে দুর্বল বা পুরাতন সেতু, ভেজালগাঁথা বহুতল বাড়ি – আর গণমৃত্যুর ব্যাপারে ওঝা সোসাইটির কোনো দাওয়াই এখনো নেই। কারণ এই পদ্ধতিই সম্পূর্ণ নতুন। এবং এই অসামান্য উদ্ভাবনার জন্য সুখবিলাসকে একটি প্রেতরত্নসম্মান দেওয়ার প্রস্তাবও উঠলো ঘরোয়া আসরে। এবং এই পর্বে যা হয়, সুখবিলাসের অনুরাগিণী প্রেতিনীকুলও বিকশিত হলেন। অধরাও তাঁর যাবতীয় মাধুরী পরিহার করে প্রথমে অভিমানিনী এবং অতঃপর ধারণ করলেন কলহকামিনী রূপ।

কিন্তু ব্যাপারটা ঘুরে গেল অন্য জায়গায়। নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রেতলোকে যে নির্বাচক নথি প্রচলিত ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছায়াভাষপত্রক, যেখানে প্রত্যেকের মুন্ডুর বিবরণ-নখের ছাপ-দাঁতের সংখ্যা-দেহের আয়তন-বিশিষ্টতা-উচ্চতা-বৈশিষ্ট্য সবই নথিবদ্ধ থাকে। যে অঙ্গগ্রহণ করে বিয়ে হয়েছিল, সেই নথিটিই সংরক্ষিত ছায়াভাষে। কিন্তু সাধারণ গার্হস্থ্যে প্রথম প্রথম অধরা তা পছন্দ করলেও, দ্বিপ্রহরে দাম্পত্যকালে তাঁর খুব পছন্দ এই তৃতীয় ধড়টিই। আর কর্মক্ষেত্রে তাঁর দ্বিতীয় ধড়েরই আদরকদর।

ইহলোকে যেমন পরলোকেও মূল নিয়ম একই – সুখবিলাসের নৃত্যভীতি প্রদর্শন পদ্ধতিতে সফলতা আসবার পরে, সে কাজে আর দরকার নেই তাঁকে।

কিন্তু ওদিকে, সুখবিলাস তাঁদের ঘরে ফিরেছেন, খুবই দুঃখিত মুখ, বাড়ি ফিরে, দুই নম্বর শরীরটা খুলে এক নম্বর শরীরটায় মুণ্ডু বসাচ্ছেন, এমন সময় অধরা এক হ্যাঁচকা টানে টেনে নিলেন সেই আরামের এক নম্বর। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেন সুখবিলাস ‘উঃ- উঃ- ক্‌ – কী – হ’ল?’

– ‘এইটা গলিয়ে তোমায় ঘুমোতে দেব না।’ অধরার মুখ যেন ক্রমশ, বিকাশ ভট্টাচার্যের ছবি থেকে, গণেশ পাইনের ছবিতে যোগেন চৌধুরীর খাবড়া খাবড়া কারুকাজ নিয়ে দেখা দিতে থাকে, ‘হ্যাঁ – অ্যাতক্ষণ তো ওই গেছো পেত্নী-মেছো পত্নী, এঁচো পেত্নীগুলোর সঙ্গে খুব মজামোচ্ছব করে এলে – কিচ্ছু বলি না ব’লে বড্ড বেড়েছ – ওই পেঁচোগোপিনীদের সঙ্গে কেষ্টলীলা ক’রে ঘরে এসে ওই নাদুসনুদুস ধড়টি ধরে ঘুমুবে – অ্যাঁ’

– ‘সারারাত্তির, নাচাকোঁদা করে, জানো, আজ একটা বহুতল বাড়িতে আমার ট্রুপ নিয়ে, তাদের ছাদে নেচেকুঁদে, একসঙ্গে পঞ্চান্নটাকে – একদম –এবার একটু আরাম-’

– ‘বেশ তো, এখন ওই দ্যাখো, এই তিন নম্বরটা নাও – উঁ উঁ – এইটায় তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে –’

– ‘না না ওসব চালাকি চলবে না’

– অগত্যা সুখবিলাস তিননম্বর ধড়টা মুণ্ডুতে আঁটাতেই, কেমন চমক লাগলো, মাথায়। সটান অধরাকে পাকড়ে ধরে মেঝেতেই গড়িয়ে গেলেন তাঁরা।

কিন্তু অধরা আর্তনাদ করলেন আর চললো সেই আর্তনাদের ক্রমশ বর্ধিত শব্দভার। সুখবিলাস বুঝতে পারলেন যে শরীরটি তাঁর মুণ্ডুর নির্দেশে চলছে না। আর অধরার কণ্ঠেও যে সশব্দতা, সুখ এবং বিলাসের জাতক নয় একেবারেই। অর্থাৎ শরীরটি প্রহার করছে অধরাকে। সুখবিলাস বুঝলেন, মুণ্ডু আর ধড়ের সংযোগরেখায় একটা ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু বোঝাবে কে? সুখবিলাস অধরাকে ছেড়ে উঠতে চাইলেও, তাঁর সেই ধড় ছাড়তে চাইছে না! অবশেষে অধরাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করলেন না ধড়টারই ইচ্ছে ফুরোলো, তায় বুঝলেন না সুখবিলাস। শুধু অনেক কষ্টে, মাথার জোরে মুন্ডু ছাড়িয়ে নিরীহ গোবেচারা ভূতদের মতো পরে নিলেন এক নম্বরী ধড়টি।

তা’তে সমস্যা মিটলো না কিছু। অধরার কাছে গিয়ে বসা মাত্র, ‘তুমি আবার এসেছ? এতক্ষণ মারধোর ক’রে আশা মেটেনি?’

– ‘তুমি বুঝতে পারছ না অধরা –’

– ‘খুব বুঝতে পারছি। যাতে আর তোমাকে এরকম না ডাকি – আর তুমি তোমার ওই নেচোদলের ঘেঁচো ছুঁড়িদের সঙ্গে সবরকম ফষ্টিনষ্টি চালাতে পারো, তাই আমায় আজ অমন কল্লে, আমি এখুনি রানির কাছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ করবো-’

– ‘শোনো- শোনো’

কিন্তু অধরা শুনলেন না, এবং নালিশ করলেন রানির কাছে। রানি ঠেলে দিলেন খোদ প্রেসিডেন্টের দরবারেই। ভূতসমাজে এই দাম্পত্যসমস্যা নিয়ে যে গোলমাল হয় না, তা নয়। কিন্তু যেহেতু, ভূত-পেত্নী উভয়পক্ষই আত্মরক্ষা আর আক্রমণে অত্যন্ত পারদর্শী। সুতরাং এমনিই মিটে যায়। কিন্তু এ ব্যাপারটা মিটলো না। প্রেতাচার-বিচারসভায় উঠলো ঘটনাটা। অপরাধ এবং প্রেতিনীঘটিত অপরাধ। ফলে তা চলে গেছে নরকেও। আগে এই দপ্তর দেখতেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু তাঁর নামে ম্যালপ্র্যাকটিস্‌-এর অভিযোগ আসে যে, তিনি খুব ডাহা-অপরাধীদের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে, অনেক চিত্রই গোপন করতেন, অর্থাৎ এভিডেন্স ট্যাম্পার করতেন। এখন সেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন চিত্রপ্রকাশ ঘোষ। এটা তাঁর সপ্তম মামলা। চিত্রপ্রকাশ সব শুনে বললেন, ‘সুখবিলাসকে বলা হয়েছিল একটা ধড় নিতে। সেখানে তিনি তিনটি ধড় আত্মসাৎ করলেন। এটা বেআইনি। সে অতি অন্যায় লোভ করেছিল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। মৃত্যুই এর দণ্ড।’

সুখবিলাসের উকিল লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘কিন্তু হুজুর, সে তো নিজের সিদ্ধান্তে তিনটে ধড় নেয়নি। এবং বিবাহকালে তাকে এ বিষয়ে অধিকারও দেওয়া হয়েছে, অঙ্গানি বিকল্পানি যথেচ্ছ বিহায়’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আর হুজুর প্রেতের মৃত্যু কেমন করে হবে? বিশেষ করে এর তো ফাইনাল অ্যালটমেন্ট, মানে নরকভোগও হয়নি!’

চিত্রপ্রকাশ বললেন, ‘পুনর্জন্মই এর দণ্ড, অর্থাৎ প্রেতলোকে থাকা ওর চলবে না। কিন্তু এই অবস্থায় আর যা যা করেছে – তার খতিয়ান দেখাতে হবে।’

– ‘আজ্ঞে হুজুর, এই সুখবিলাস ধর, প্রেতলোকে গিয়ে তার যে দায়িত্ব, তা অতি দক্ষতায় সুসম্পন্ন করেছে। বিবাহ পরবর্তী তিনমাসে, প্রেতলোকে সে প্রায় সাতশোজনকে এনেছে। এটা সর্বকালের রেকর্ড।’

– ‘হ্যাঁ তা বলা হয়েছে বটে। তবে কোন পদ্ধতিতে?’

– ‘আজ্ঞে তার দুই নম্বর ধড় ছিল এক নাচিয়ের, সুতরাং সেই শরীরে সে মর্ত্যলোকে প্রেতনৃত্য পরিবেশন করে, একক এবং যূথবদ্ধ প্রেত দিয়ে –’

– ‘থামুন। ছায়াভাষপত্রকে – তার তথ্য পরিবেশন করুন।’

বিবাহকালে, ছায়াভাষপত্র তৈরির সময় তার একনম্বর শরীরের বিবরণ আছে। চিত্রপ্রকাশ মাথা নাড়লেন। ‘সুখবিলাস যে ধড় যোগে মর্ত্যে গিয়েছে এবং ভীতি প্রদর্শন করেছে, সেই ধড়টিতো স্বীকৃত নয়। সুতরাং তার নিয়ে আসা সেই প্রেতদলও বেআইনি।’

অধরা চুপ করে শুনছিলেন। এবার ‘হুজুর, একটা কথা বলতে পারি?’

– ‘বলুন’

– ‘ইনি, আমার স্বামী, আমার অভিযোগ সপ্তাহখানেক আগে তিন নম্বর শরীর নিয়ে আমাকে- মানে আমাদের – ইয়ের আমার –’

– ‘ই এ মানে? ইরোটিক অ্যাকটিভিটি –’

– ‘হ্যাঁ হুজুর, তাই, মানে আমি কনজুগাল লাইফের কথা-’

– ‘না- আপনি – তথ্য বলছে, একই সঙ্গে আপনি, আপনার স্বামীর মুন্ডুর পরিচয় নিয়ে তিনটি প্রেতকে দাম্পত্যে ব্যবহার করেছেন।

সুখবিলাস ধরের মুন্ডু আর ধড়ের ডি এন এ ম্যাচ করেনি। যে শরীরে তিনি বিবাহ করেছিলেন – এখন যে শরীরে আছেন – তার সঙ্গে ডি এন এ ম্যাচিং হয়ে যেত! আর ডকুমেন্ট অনুযায়ী – সাক্ষ্য অনুযায়ী, মড়িঘরের এজেন্ট বলছে, আপনিই সুখবিলাসকে তিনটি কবন্ধই আত্মসাৎ করতে বলেছিলেন – সুতরাং মুন্ডুর সুযোগ নিয়ে, একই সঙ্গে তিনজন প্রেতের সঙ্গে আপনি সহবাস করেছে, এই পলিগ্যামাস অ্যাটিচুডের জন্য আপনিও ব্যভিচারিণী ই এ-’

এবার উকিল বললেন, ‘তার মানে হুজুর- ইয়ে বললে তো হবে না –’

– ‘আপনি অভিজ্ঞ উকিল – দশবছর ওকালতি করছেন, ই এ- এক্সট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ার অর্থাৎ অ্যাডালটারেশন – এও বিশেষ দণ্ডনীয় –’

অধরা আবার বলে উঠলেন, ‘কিন্তু আমি তো পেত্নীরানি মানে প্রেতিনীপ্রজল্পিকা রাজ্ঞী, তাঁর নির্দেশেই, ওকে তিনটি ধড়ই নিতে বলি – আপনি ওই মড়িঘরের কর্তাকে জিজ্ঞেস করুন।’

মড়িঘরের এজেন্ট ফুচুলাল দুয়ারি বললেন ‘হ্যাঁ হুজুর, রানির আদেশ পেয়েই আমি তিনটে লাশ ওদের দিয়ে দিই।’

চিত্রপ্রকাশ মাথা নাড়লেন। তারপর প্রেতান্তবৃত্তান্ত, এক্সোরসিজম, ম্যালকলেন্ট অর্ডার অ্যান্ড ডিসঅর্ডার, ইত্যাদি বই খুলে দেখে পড়ে বললেন – ‘প্রেতিনীপ্রজল্পিকা রাষ্ণীর এই আদেশ করবার অধিকার নেই। তাঁকে এই বিচারসভায় আসতে আদেশ করা হচ্ছে।’ তিনি কতক মাথা চুলকে, কানে খড়কে দিয়ে, নাকে নস্যিমাখা পালকে সুড়সুড়ি খেয়ে, তিনবার হেঁচে বললেন, ‘এ অতি জটিল অপরাধ। এক, প্রেতদাম্পত্য বীভৎসতা, দুই, প্রেতায়ত অবস্থায় অবৈধ শরীরে কাজ করে প্রেত আনয়ন। সুতরাং তারাও অবৈধ প্রেত – এদের পুনঃপ্রেরণের বিধান দেখতে হবে, তিন অধরার গোপন ব্যভিচার এবং চার বিভাগীয় অধিকর্ত্রী প্রেতপ্রজল্পিকার নিজস্ব এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে আদেশ – আমি আজকের সভা মুলতুবি রাখছি। সুখবিলাসের তিনটি ধড়ই বাজেয়াপ্ত করা হোক। আপাতত জামিনে মুক্ত।’

সুখবিলাস জামিনে খালাস পেয়ে আর তাঁদের ঘরে গেলেন না। এখন বেশ কদিন মুণ্ড অবতারে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন – ওই তো, ওই তো আপনার ঘরের জানালায়, যান না – ডেকে জিজ্ঞেস করতেই পারেন। মামলার হালচাল।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *