হুইলচেয়ারে মৎস্যকন্যা

হুইলচেয়ারে মৎস্যকন্যা
জয়ন্ত দে

আনন্দী নির্বিকার।
মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেও কোনও মানুষ এমন শান্ত থাকতে পারে! যেন কিচ্ছু হয়নি। আমরা ওকে নিয়ে যেমন নদীর চরে গিয়েছিলাম হইহই করতে করতে, আমরা হইহই করতে করতে ফিরব। এমনটাই সবাই জানত। কিন্তু আমরা ফিরছিলাম, সবাই কেমন শান্ত। নিস্তরঙ্গ। যেন ভীষণ কোনও ঝড়ে আমাদের প্রিয় গাছগুলোর মাথা ভেঙে উড়ে গেছে, বড় বড় ডালগুলো ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। কেউ কোনওদিন আমাদের এমন দেখেনি। পারলে কেউ কেউ চলে যাওয়ার জন্য পা ভারী করছিল। পিছিয়ে পড়ছিল ইচ্ছে করে। পিছিয়ে পড়তে পড়তে এক সময় সে পিছন থেকে হারিয়ে যাবে।
আনন্দীর হুইল চেয়ার ঠেলছিলাম আমি। সারাটা পথ আমিই ঠেলে নিয়ে এলাম। আর কারও হাত দেওয়ার সাহস নেই। আরও কারও ওপর আমার ভরসাও নেই। আসতে আসতে এই আসার পথটুকুতে পিন্টু ছাড়া এক এক করে সবাই চলে গেল।
হীরক বলল, ‘আমার একটু কাজ আছে— ঠাম্মার জন্য বাতের ওষুধ নিয়ে যাব।’ সোনাই বলল, ‘আমিও যাব, মা বলেছে—কুন্তীকাকিদের বাড়ি থেকে সেলাইয়ের বইটা নিয়ে যেতে।’
হীরক আর সোনাই চলে গেল।
গোগোল বলল, ‘ভাই আমি যাই— অঙ্কের মাস্টার আসবে।’
পিন্টু শুধু আমার পাশে পাশে। বেশ অনেকটা হেঁটে এল। দু একবার ফিসফিস করল, ‘আমাকে একটু দে না, আমি ঠেলতে পারব রে। আমি খুব আস্তে আস্তে ঠেলব।’
হুইলচেয়ার ঠেলা খুব কিছু কঠিন কাজ না। খুব বেশি গায়ের জোরই লাগে না। একবার গড়িয়ে দিলে সে এগোতে চায়, গড় গড় করে সামনের দিকে চলে যেতে চায়। তখন তাকে ধরে এগিয়ে দিতে হয়। অত বড় বড় চাকা। যেতে তো চাইবেই। আস্তে ঠেললে হুইলচেয়ার যাবে না। আটকে যাবে। মাঝ রাস্তায় থমকে থাকবে। বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। সন্ধের আগে আগেই আমরা বাড়ি ফিরব। মিসেস রাও, জগদম্বা নিশ্চয়ই আমাদের ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে।
আনন্দী বলল, ‘নদীর চরটা দারুণ। আরও একদিন যাব, আরও একদিন, তোমাদের মতো যদি রোজ রোজ যেতে পারতাম—’
আমি হ্যাঁ না বলার আগেই আনন্দী বলল, ‘আমি নদীর জলে হাতছানি দেখেছি—স্পষ্ট! আমাকে পরিষ্কার ডাকছিল জানো। ইশ নেমে পড়লেই হত।’
আমি আনন্দীর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু ওর কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম। নেমে পড়তাম মানে? কুসুম নদীর জলে—
আনন্দী বলল, ‘কুসুম নদীর জল! আহা! কতখানি জল হবে, আমার পায়ের পাতা ভিজবে, গোড়ালি ডুববে, না কি হাঁটুজল, কোমর পর্যন্ত—?’
পিন্টু বলল, ‘তারও চেয়ে বেশি!’
‘কত বেশি, আমার নাভি পর্যন্ত, বুক অবধি?’
পিন্টু বলল, ‘তার থেকেও বেশি মনে হয়—।’
‘তবে কত খানি? আমার চিবুক স্পর্শ করবে, আমার ঠোঁট নাক চোখ, মাথার চুল ভাসাবে—!’
পিন্টু কিছু বলল অথবা বলল না। কতগুলো শব্দ, হয়তো শ্বাস নেওয়ার।
আনন্দী সে শ্বাস উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এক মানুষ জল, দু মানুষ জল, একটা তাল গাছ কিংবা কুসুম পাহাড়ের ছোট্ট যে মাথাটা — তার মতো গভীর জল! উঃ কী আনন্দই না হত। আমি ডুব দিয়ে কুসুম পাহাড়ের শিকড় বাকড় দেখে আসতাম।’
আমি ছটফট করছিলাম, আজ আর একটু হলে মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারত। হুইলচেয়ার সুদ্ধু তুমি জলে পড়তে। হীরক ঠিক করেনি, অত জোরে কেউ হুইলচেয়ার ঠেলে—। নদীর চরের উতরায়ে তোমার হুইলচেয়ার হাওয়ার শক্তি পেয়েছিল। হীরকের সাধ্য কী যে তাকে রোকে? সে তো নদীর জলের দিকে যাবেই—। হীরকের হাত ছাড়িয়ে হুইলচেয়ার উড়ছিল আনন্দীকে নিয়ে।
আনন্দী হাসল, বলল, ‘হঠাৎ যেন আমি একটা ডানা পেয়েছিলাম—ডানা। মনে হচ্ছিল উড়ে যাচ্ছি হাওয়ায় হাওয়ায়, ভেসে যাচ্ছি হাওয়ায় হাওয়ায়— হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে—আমি জলে ভাসব—।’
জলের কথায় আমার বুকের ভেতর কাঁপছিল। জগদম্বা বলেছিল—তুমি বেবিকে ছাড়বে না।
হীরক কিন্তু আমার হাত থেকে আনন্দীকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল, আমি আটকাতে পারিনি। অথচ কুসুম নদীর চরে তাকে আমিই বেড়াতে নিয়ে এসেছিলাম। মিসেস রাও আমার ভরসায় তার আদরের কন্যা আনন্দীকে ছেড়েছিল, নয়তো ওর সঙ্গে জগদম্বা আসত। তার হাত থেকে কেউ পারত না আনন্দীকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতে, আনন্দীর হুইলচেয়ার হাওয়ায় ভাসাতে, জলের বিপদে।
মিসেস রাওদের বাড়ির বিশাল লোহার গেটের কাছে জগদম্বা দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে খিলখিল করে হাসছিল আনন্দী। ওর একমুখ আলো। আনন্দী বলল, ‘খরগোশ দেখেছি নদীর চরে, নদীর জল নীল, কুসুম পাহাড় সবুজ, আমি হাওয়ায় উড়েছি— এই আমার হুইলচেয়ারকে ওরা দুটো ডানা বেঁধে দিয়েছিল—।’
‘ডানা!’
‘হ্যাঁ পরির। জলে ভাসলে মাছের!’ আনন্দী হাসতে হাসতে জগদম্বার সঙ্গে কথামালায় বাড়ির ভেতর চলে গেল।
আনন্দীরা চলে গেলে আমি আর পিন্টু সাদা মাঠে এসে চুপ করে দাঁড়ালাম। মাথার ওপর নক্ষত্ররা জ্বলে উঠছে। পিন্টু ফিসফিস করেছিল— ‘যদি জলে পড়ে যেত আজ?’
আমি বললাম, ‘না’।
যা বললাম না, তা হল—আমি ছিলাম আনন্দী জলে পড়বে কেন?
পিন্টু বলল, ‘ও ডুবে যেত!’
আনন্দী নিশ্চয়ই সাঁতার জানে না। যে হাঁটতে পারে না, সে কি সাঁতার জানবে? জানে না নিশ্চয়ই। পিন্টুর কথায় তবু আমি না তাকিয়ে বললাম, ‘আনন্দী সাঁতার জানে।’
‘সাঁতার জানে? কী আশ্চর্য!’
‘এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?’
‘কেন?’ পিন্টু ভ্রু কুঁচকে অবাক গলায় বলল।
‘মাছ কি হাঁটতে জানে— কিন্তু মাছ তো সাঁতার জানে।’
পিন্টু অদ্ভুত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমাদের আকাশটা এখন গা ধুয়ে এসে মণিমুক্তে সাজছে। বেশ কিছুক্ষণ আগে বিকেল গড়িয়ে গেছে। সন্ধেও হয়ে গেল ঝুপ করে। যেন আনন্দী বাড়ি ঢোকার জন্য অপেক্ষায় দিনটা আলো ফুটিয়ে রেখেছিল। আনন্দী বাড়ি ঢুকতেই আলো নিভিয়ে দিল।
পিন্টু বলল, ‘আনন্দী হাঁটতে পারে না, অথচ সাঁতার জানে, মাছের মতো, ও তাহলে মৎস্যকন্যা না রে!’
আমি পিন্টুর দিকে তাকালাম।
পিন্টু বলল, ‘আনন্দীর গা থেকে খুব সুন্দর একটা গন্ধ বের হয়, তুই পেয়েছিস কখনও?’
আমি ঘাড় নাড়লাম। ‘পেয়েছি। অনেকবার পেয়েছি। সবাই পায়— যে ওর কাছে যেতে পারে, সেই পায়—’
পিন্টু বলল, ‘একদিন তোদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। ওদের গেটের সামনে দেখলাম জগদম্বা আর আনন্দী। আনন্দী আমাকে ডাকল। তারপর আমাকে একটা পাখির পালক দিল। বলল, ডোডো পাখির পালক!’
‘ডোডো পাখির পালক— আমাকেও দিয়েছে ও!’
‘কী জানিস, সেদিন আমি ওর গা থেকে আশ্চর্য একটা গন্ধ পেয়েছিলাম। ওই গন্ধ ফুলেরও না, ফলেরও না। তারপর আজও সেই গন্ধটা আমি বার বার পাচ্ছিলাম। গন্ধটা পেতে পেতে আমি খুঁজছিলাম— কোন ফুলের? না কি অন্য কিছুর? বুঝতে পারিনি? তুই জানিস গন্ধটা কীসের?’
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘কেন জানব না, জানি?’
‘জানিস?’
‘হ্যাঁ, ও মৎস্যকন্যা! মানুষের রূপ ধরে আছে।’
‘আর গন্ধটা?’
‘গভীর সমুদ্রের!’
আমার কথায় পিন্টু চুপ করে থাকল। বলল, ‘তুই সমুদ্র দেখেছিস, আমি কোনওদিন সমুদ্র দেখিনি। তবে ছবিতে দেখেছি, টিভিতে, সিনেমাতেও দেখেছি—কী প্রবল তার গর্জন! আর আনন্দী কত শান্ত!’
আমি বললাম, ‘ও জলভ্রষ্টা হয়ে মাটির পৃথিবীতে এসেছে! সমুদ্রের জল দূষিত —তাই ও জলভ্রষ্টা! জলভ্রষ্টা আনন্দী তাই মাটির পৃথিবীতে! অথচ ও মাটিতে পা রাখবে না!’
‘তবে কি ও জলে পা রাখবে?’
‘জলে ভেসে যাবে—জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে!’
‘কবে?’
‘আমি জানি কবে— তবে সে কথা বলা বারণ। বললেই ও আর ফিরতে পারবে না, মাটিতেই শিকড় ছড়িয়ে আটকে যাবে।’
পিন্টু আমার হাত চেপে ধরল, বলল, ‘ভাই বলিস না, মৎস্যকন্যা সমুদ্রে চলে যাক, এখানে ওর খুব কষ্ট—হাঁটতে পারছে না, সারাদিন হুইলচেয়ারে—।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “হুইলচেয়ারে মৎস্যকন্যা

  1. অন্য রকম সুন্দর গল্প। গল্পের নামকরণ সার্থক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *