স্বাতী দে

দেখতে দেখতে আবারও ক্রিসমাস এসে গেল! বছরটা যেন চোখের পলকে কেটে গেল — কখন শুরু, কখন শেষ, কিছুই টের পেলাম না। জীবনের খাতায় কী জমল আর কী কী হারিয়ে গেল সে হিসেব না করে বছরের শেষে কয়েকটা দিন সব হৈ-হুল্লোড় থেকে বাইরে গিয়ে নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর এক অদম্য ইচ্ছে কিছুতেই দমন করতে না পেরে বেরিয়ে পড়লাম ব্যারিংটন কোস্ট-এর উদ্দেশে।
সিডনী থেকে উত্তরে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ধরে প্রায় তিন ঘন্টার পথ। সিডনী থেকে যাবার পথে বা-দিকে ইউক্যালিপটস পরিবেষ্টিত পাহাড়, আর ডান-দিকে প্রশান্ত মহাসাগর। মাঝখান দিয়ে চলেছে প্রশস্ত প্যাসিফিক হাইওয়ে। চারিদিকের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে তিন ঘণ্টা যে কিভাবে কেটে গেল সেটা বোঝার আগেই পৌঁছে গেলাম ব্যারিংটন কোস্ট-এর টানকারী শহরে।
অস্ট্রেলিয়ায় আছি সাতাশ বছর হয়ে গেল, কিন্তু এখানকার একটা জনপ্রিয় অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি আমার — ক্যারাভ্যান পার্কে থাকা! এখানে লোকেরা হলিডের সময় গাড়ি, ক্যারাভ্যান, নৌকা, সাইকেল, সার্ফিং বোর্ড, টেন্ট – সব কিছু সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত সমুদ্র বা লেকের ধারে, ক্যারাভ্যান পার্ক বা হলিডে পার্ক রয়েছে। সেখানে আগে থেকেই বুকিং করতে হয়। তারপর পার্কে পৌঁছে কয়েক দিনের জন্য সংসার গেঁড়ে বসে। সাথে খাবার-দাবারও নিয়ে যায় পর্যাপ্ত পরিমাণে। স্কুল হলিডের সময় এটা বেশি হয়। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মুক্ত আকাশের নিচে খোলামেলা পরিবেশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেশ সুন্দর সময় কাটায়। আর বড়রা কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি ভুলে দু’দন্ড স্বস্তি খোঁজে। আজকের ব্যস্ত শহুরে জীবনযাত্রায় যেটা প্রায় দুর্লভ হয়ে উঠেছে।
আমার অবশ্য ক্যারাভ্যান পার্কে থাকার একটুও ইচ্ছে ছিল না। তবে ক্রিসমাস হলিডের সময় আগে থেকে হোটেল বুক করা না থাকলে হঠাৎ করে আমার মত ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ করে হোটেল পাওয়া সম্ভব নয়। অনেক খুঁজেও কোথাও কোনো হোটেলে রুম পেলাম না। শেষ পর্যন্ত আমার বেটার হাফ একটা হলিডে হোমের সন্ধান দিল। এখানে ক্যারাভ্যান পার্কের পাশাপাশি হলিডে কটেজ আছে। কটেজ-এ হোটেলের মত সব সুবিধাই রয়েছে। তাই আর দেরি না করে সেখানেই একটা কটেজ বুক করা হল।
২৫ শে ডিসেম্বর সকালে উঠে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে নিলাম। সাথে কিছু খাবার-দাবার আর বরফ চাপা দেওয়া কোল্ড বিয়ার। ওয়েদার রিপোর্ট বলছে আগামী কয়েকদিন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীর আশেপাশে থাকবে। অতএব, দিনের বেশিরভাগ সময় কটেজের ছায়াতলে বসে কাটাতে হবে ভেবেই বেরিয়ে পড়লাম।
ব্যারিংটন কোস্ট-এর ফর্স্টার-টানকারী হলিডে পার্ক। ফর্স্টার আর টানকারী, পাশাপাশি দুটো শহর, মাঝে কূলঙ্গলুক নদী। আর শহর দুটোকে যুক্ত করেছে ফর্স্টার-টানকারী ব্রীজ। সাগর, উপসাগর, সমুদ্র সৈকত, লেক, সমুদ্রের ধারে বালিয়াড়ি, ন্যাশনাল পার্ক – কী নেই এখানে!
ফর্স্টার শহরের নামকরণ হয়েছিল নিউ সাউথ ওয়েলস এর প্রিমিয়ার, উইলিয়াম ফর্স্টার-এর নামে। আর ‘টানকারী’? সে এক অন্য গল্প! অস্ট্রেলিয়ার নেটিভ অ্যাবোরিজিনাল ভাষায় এর অর্থ হল ‘অঢেল মাছ’। ব্রিটিশ কলোনাইজেশনের আগে এখানকার স্থানীয় অ্যাবোরিজিনাল লোকেরা মাছ ধরেই এক রকম জীবিকা নির্বাহ করত। এখনও টুরিস্টরা এখানে মাছ ধরতে যায় ঠিকই, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা জীবিকা নয়, শুধুমাত্র আনন্দের জন্য। বিলাসবহুল নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে সারাদিন সেখানে কাটিয়ে বিকেলে সব মাছ আবার সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে ফাঁকা হাতে ফিরে আসে। আমার মত মাছ-ভাত খাওয়া তৃতীয় বিশ্বের এক বাঙালীর কাছে প্রথম প্রথম এটা শুধুমাত্র বিস্ময়ের ছিল না, বেশ পীড়াদায়ক ছিল বললেও বেশি বলা হবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্ময় মিশে গেছে অভ্যাসে, আর এখন এসব দেখলে বরং মজাই লাগে!
সিডনী থেকে আসার পথে রেস্ট এরিয়াতে বসে লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম, তাই হলিডে পার্কে পৌঁছে জিনিসপত্রগুলো কটেজ-এ রেখে চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বারান্দায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ল অহমাজ বে (Ohmas Bay)। হলিডে পার্কটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে। টুরিস্টদের বাজেট অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের থাকার ব্যবস্থা আছে। তার সাথে আছে সুইমিং পুল, ওয়াটার পার্ক, খেলার মাঠ, বোট র্যাম্প, মাছ ধরার ব্যবস্থা, কফি শপ আর রেস্তরাঁ। হলিডে পার্কটা ঘুরে দেখতেই প্রায় ঘণ্টা খানেক লেগে গেল। চারদিকে প্রচুর টুরিস্ট। সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছে ছুটি কাটাতে।
আগেই বলেছি, আমার ক্যারাভ্যান পার্কে থাকার কোনো অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। তাই একটু বেশি মনোযোগ দিয়েই সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। কেউ ক্যারাভ্যানের পাশে তাঁবু গেঁড়ে নিয়েছে, কেউ সেটাকে আরেকটু আরামদায়ক করতে চেয়ার-টেবিল, বারবাকিউ, এমনকি রাতে চাঁদের আলোতে বাইরে শুয়ে সিনেমা দেখার জন্য বড় প্রজেক্টর স্ক্রিন পর্যন্ত লাগিয়ে নিয়েছে! এত নিখুঁতভাবে সব সাজানো, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা সবাই এই যাযাবর জীবনযাত্রায় কতটা অভিজ্ঞ এবং অভ্যস্ত। আরেকটা ব্যাপার খুব চোখে পড়ল — প্রায় সবাই তাদের পোষ্য কুকুর বা বেড়াল নিয়ে এসেছে। কুকুরগুলো অবিরাম ছুটোছুটি করছে, খেলে বেড়াচ্ছে! হয়তো এই কারণেই অনেকে হোটেলের পরিবর্তে ক্যারাভ্যান পার্কে থাকতে বেশি পছন্দ করে। আমি যদিও কুকুর-প্রেমী নই, তবু সেই উচ্ছ্বাস দেখতে ভালোই লাগছিল।

অনেকের সাথে পরিচয় হল। একটি পরিবার এসেছে সুইটজারল্যান্ড থেকে, অস্ট্রেলিয়ার সামার উপভোগ করতে। ওদের একটি বছর পনেরোর ছেলে আছে। নাম লিয়াম। দেখলাম লিয়াম একটা ট্রাই-সাইকেল চালাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। আমি কিছুটা উত্সাহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার সাইকেলটা তো খুব সুন্দর। এটা কোথায় পেলে? এখানে তো এরকম সাইকেল বেশি দেখা যায় না। এটা কি সুইটজারল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছো?”
লিয়াম মিষ্টি হেঁসে বলল, “না না, এটা আমার গ্র্যান্ড ড্যাড-এর সাইকেল। উনি এখানেই থাকেন”।
আমি আরো বেশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে তোমার গ্র্যান্ড ড্যাড তোমার জন্যই এটা কিনেছেন?”
ছেলেটি বেশ হাসি-খুশি স্বভাবের। আবার এক গাল হেঁসে জবাব দিল, “একদম না। এটা আমার গ্র্যান্ড ড্যাড-এর সাইকেল। আশি বছর বয়সেও উনি এই সাইকেল চালিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়ান”।
আমি মুহূর্তেই কল্পনা করে নিলাম এক আশি বছরের যুবককে — শক্ত হাতে ট্রাই-সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরা, চোখে মুখে প্রাণোচ্ছলতা, জীবনের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা।
বিদায় নেওয়ার সময় লিয়াম হেসে বলল, “আপনি একবার চালাবেন সাইকেলটা? আমি তো এটা নিয়ে নাজেহাল হচ্ছি। জানি না গ্র্যান্ড ড্যাড এটা কী ভাবে ম্যানেজ করেন”।
আমি হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে লিয়ামের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। আমার মেরুদণ্ডের যেক’টা হাড় এখনো অক্ষত আছে, সেগুলোর মায়া এখনো ছাড়তে পারিনি!
এবার বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। প্রথমেই গেলাম টানকারী রক পুল। এখানে কূলঙ্গলুক নদী এসে প্রশান্ত মহাসাগরে মিশেছে। জায়গাটা ‘পিকচার পার্ফেক্ট’ বললেও হয়তো একটু কম বলা হবে। কূলঙ্গলুক নদীর ফিরোজা রঙের জল আর তার শান্ত ধীর গরিমাকে প্রশান্ত মহাসাগরের ব্যাপ্তি যেন কোনো ভাবেই ছোট করতে পারেনি। হয়তো বলা ভালো, নদী আর সমুদ্র দুজনেই দুজনের জায়গায় অসাধারণ, অনন্য।
এই রক পুল এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং টুরিস্টদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় সাঁতার কাটার জায়গা। স্কুবা ডাইভিং, জেট স্কি, এমনকি নিরিবিলি বসে থাকার জন্যও আদর্শ জায়গা। এছাড়াও এখানে রয়েছে ওয়াক ওয়ে, পিকনিক এরিয়া, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলার জন্য প্লে-গ্রাউন্ড। তার সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভাল রেস্তরাঁ। এখান থেকে ফর্স্টার-টানকারী ব্রীজ আর তার পরেই ফর্স্টার শহরটা দেখা যায়। মনে হলো, এখানে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিলেও কিছুতেই একঘেয়েমি আসবে না। আর তাই আমি ঠিক সেটাই করলাম!
রক পুলের পাশেই রয়েছে টানকারীর বিখ্যাত নাইন মাইল বীচ। নাম শুনলেই আন্দাজ করা যায়—এটা সত্যিই নয় মাইল দীর্ঘ এক বিস্তৃত সৈকত। আর এই বীচের আরেকটি বিশেষত্ব হল এটা ফোর হুইল ড্রাইভ-এর জন্য আদর্শ বীচ। অন্য যে কোনো গাড়ি নয়, এখানে বালির উপর একমাত্র ফোর হুইল ড্রাইভ চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। আগে থেকেই লোকাল কাউন্সিলের পারমিশন নিতে হয়। অনেকে এখানে এসে বালির উপর ফোর হুইল ড্রাইভ রেসিং করে। এবার কোনো রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে চলে এসেছি বলে কাউন্সিলের পারমিশন নিয়ে আসতে পারিনি। তাই এ যাত্রায় সমুদ্র সৈকতে ফোর হুইল ড্রাইভ-এর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলাম।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সূর্যাস্তের সময়টা যে কতটা মোহময় হতে পারে, তা এই জায়গায় না এলে বোঝা যেত না। দেখতে দেখতে সূর্য দিগন্ত রেখার নিচে নামতে শুরু করল। আকাশ, বাতাস, সমুদ্র সবকিছু যেন প্রকৃতির ক্যানভাস। তার উপর আলতো হাতে একে চলেছে কমলা, গোলাপী, বেগুনী আর লাল রঙের নকশা। আর এই রঙের ছটায় সমুদ্র যেন নিজের গর্জন ভুলে অনেকটাই শান্ত হয়ে গেছে। চারিদিকে যেন অপার শান্তি। শুধু একটা দল ছুট সীগাল শান্ত নদীর জলে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে!
এবার ফিরতে হবে। খিদেও পেয়েছে। আশেপাশে কোনো দোকান বা রেস্তরাঁ আজ খোলা নেই। ২৫ শে ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়াতে সব কিছু বন্ধ থাকে। তাই অগতির গতি, কটেজ-এ ফিরে নিজেদের আনা খাবার খেয়ে রাত কাটাতে হল।
আজকের সকালটা শুরু হলো অহমাজ বে-র শান্ত জলের ধারে এক নির্ভেজাল মর্নিং ওয়াক দিয়ে। সমুদ্রের মৃদু বাতাস, জলের ওপরে সূর্যের ঝিলিক—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নময় সকাল। এরপর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম টারীর উদ্দ্যেশে।

তবে সব থেকে বেশি অত্যাচারিত হয়েছিল এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা। বে-আইনী ভাবে এদের জমি দখল থেকে শুরু করে, নদীর জলে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা, ছেলেদের কুপিয়ে মারা, মেয়েদের উপর শারীরিক নিগ্রহ করা, কোনো কিছুই বাদ দেয়নি ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা। তবে আজকের প্রজন্ম অবশ্য সে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না।
পোর্ট ম্যাকোয়ারিতে বেশ কয়েকটি সুন্দর বীচ রয়েছে, তার মধ্যে টাউন বীচ এবং লাইট হাউস বীচ সাঁতার এবং সার্ফিং-এর জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে নৌকা করে তিমি আর ডলফিন দেখতে যাওয়া যায়। সাধারণত মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিমি দেখতে পাওয়া যায়। তবে সারা বছর ধরেই ডলফিন দেখা যায়। আমরা টাউন বীচ এবং লাইট হাউস বীচে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে গেলাম হেস্টিংস নদীর ধারে। এখানেও পর্যটন শিল্পকে উত্সাহিত করার জন্য রয়েছে নানা রকমের অ্যাক্টিভিটি। নৌকা বিহার, কায়াকিং – সব কিছুই রয়েছে। আমাদের হাতে খুব একটা বেশি সময় নেই। তাই এ যাত্রায় এসব না করে গিয়ে বসলাম একটি রেস্তরাঁতে। নদীর ধারে এই রেস্তরাঁ। ‘কোটি টাকার দৃশ্য’ হয়তো একেই বলে! এখানে সারাদিন বসে থাকা যায়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে লাঞ্চ সেরে আমরা বেরিয়ে এলাম।
পোর্ট ম্যাকোয়ারিতে একটি কোয়ালা হাসপাতালও রয়েছে। কোয়ালা অস্ট্রেলিয়ার নেটিভ অ্যানিম্যাল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টুরিস্ট অস্ট্রেলিয়াতে আসে কোয়ালা দেখার জন্য। কোয়ালা সাধারণত দিনের মধ্যে ১৮ থেকে ২২ ঘণ্টা ঘুমায়। কোয়ালা পৃথিবীর একমাত্র জন্তু যে এতক্ষণ সময় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। কোয়ালা ইউক্যালিপটস গাছের পাতা খায়। এই পাতায় পুষ্টি বলতে প্রায় কিছুই থাকে না। বরং এর মধ্যে এক রকম বিষাক্ত উপাদান থাকে যেটা হজম করতে কোয়ালাকে অনেকটা এনার্জি খরচ করতে হয়। তাই ঘুমিয়ে থাকলে এনার্জি কম খরচ হয়। আজকাল চারদিকে যে ভাবে গাছপালা কাটা হচ্ছে তাতে কোয়ালার বাসস্থান প্রায় অবলুপ্তির পথে। তার উপর আছে অস্ট্রেলিয়ার দাবানল। এই সব প্রতিকূলতার হাত থেকে এদের রক্ষা করার জন্য ১৯৭৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল এই কোয়ালা হাসপাতাল। এখানে আহত, অসুস্থ এবং অনাথ কোয়ালাদের যত্ন এবং পুনর্বাসন করা হয়ে থাকে। কোয়ালা আমার কাছে নতুন নয়। তবুও এখানে এসেছি একটি বিশেষ কারণে – আমার মত টুরিস্টদের অর্থ সাহায্যেই এই কোয়ালা হাসপাতাল এত বছর ধরে কোয়ালা কনসার্ভেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের এই সুন্দর কাজে কিছুটা সাহায্য করতে পেরে বেশ ভাল লাগলো। আমরা কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম।
ফেরার পথে বুরাওয়ান স্টেট ফরেস্ট-এ গেলাম এখানকার বিখ্যাত ওল্ড বটলবাট, রেড ব্লাড উড ট্রী দেখব বলে। গাছটির গুড়ির দিকটি দেখতে একটি বোতলের মত, আর সেই থেকেই এরকম নামকরণ। এটি পৃথিবীর মধ্যে এই প্রজাতির সব থেকে বড় গাছ। প্রায় দুশো বছরের পুরনো এই গাছটির গোড়ার চারপাশের পরিধি 16 মিটারের কিছু বেশি। স্থানীয় অ্যাবোরিজিনাল লোকেরা এই ফরেস্টের দেখাশোনা করে। এখানে হাঁটার জন্য ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি ওয়াক ওয়ে রয়েছে। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আশেপাশে বিভিন্ন রকম নেটিভ গাছপালা আর পশুপাখি দেখা যায়। এখানে পার্কে বারবাকিউ করার জায়গাও রয়েছে। অনেকেই দেখলাম পার্কে বসে রান্না করছে, গল্পগুজব করছে। খাবার খাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে। পাশেই আছে ক্যাম্পিং-এর জায়গা। সব মিলিয়ে একটি সুন্দর নিরিবিলি ছুটি কাটানোর জায়গা। আমরা ঘণ্টা খানেক থেকে ফিরে এলাম।
এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর বেশ খিদেও পেয়েছে। ফেরার পথে গেলাম আজকের বিশেষ আকর্ষণ থার্টি থ্রি ডিগ্রীস (Thirty Three Degrees) অয়েস্টার বার এবং রেস্টোরান্ট-এ। রেস্তরাঁর নামটি বেশ অদ্ভুত। তবে এর পিছনে একটি কারণ রয়েছে। থার্টি থ্রি ডিগ্রী নামটি রেস্তোরাঁর ভৌগলিক অবস্থানের, ৩৩ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে এসেছে। টানকারী শহরে ওয়ালিস লেকের ধারে এই আধুনিক অস্ট্রেলিয়ান রেস্তরাঁ স্থানীয় এবং বহিরাগতদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়। এই রেস্তরাঁ রক ওয়েস্টার-এর জন্য বিখ্যাত। এখানে স্থানীয় ওয়েস্টার ফার্ম থেকে জীবিত রক ওয়েস্টার এনে প্লেটের উপর শুধুমাত্র লবণ আর লেবু দিয়ে পরিবেশন করা হয়। ওয়েস্টার প্রেমীদের জন্য এই রেস্তরাঁ একটি বিশেষ আকর্ষণ। রেস্তরাঁর ডেকে বসে ওয়ালিস লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ডিনার করার অভিজ্ঞতা অনেক দিন মনে থাকবে।
দেখতে দেখতে কয়েকটি দিন কেটে গেল। এবার ফেরার পালা। তবে আমার বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া নেই। এখনও একটি বিশেষ জায়গায় যাওয়া হয়নি। তাই সকালে উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টানকারী থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে মাঙ্গো ব্রাশ, যা একসময় অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল ওয়ারিমি জনগণের বাসস্থান ছিল। এরা আজও এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রক্ষক। এই জায়গার সাথে স্থানীয় অ্যাবোরিজিনালদের হাজার বছরের সম্পর্ক।

মাঙ্গো ব্রাশ আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটি জায়গা। গত কয়েক বছরে আমি বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি। এটা আমার বেশ কয়েকটি ‘মন ভালো করা’ জায়গার মধ্যে একটি। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই সমুদ্র সৈকত পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এখনও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। এর পেছনে দুটো কারণ আছে, প্রথমত, এই জায়গাটি অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল লোকেরা দেখাশোনা করে। এরা জানে প্রকৃতির সাথে কী করে সহাবস্থান করতে হয়। এরা প্রকৃতি থেকে ঠিক ততটুকুই নেবে যতটুকু নিতান্ত প্রয়োজন। প্রকৃতিকে এরা ভগবানের মত পূজা করে, রক্ষা করে। আর দ্বিতীয়ত, এটাই আমার মনে হয় সব থেকে বড় কারণ, এখানকার সমুদ্র সৈকতে গিয়ে সময় কাটানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
কার পার্কে গাড়ি পার্ক করে দু-এক মিনিট হেঁটে সাধারণত যে কোনো বীচে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু মাঙ্গো ব্রাশ-এর বীচ ঠিক সে রকম নয়। কার পার্ক থেকে বীচের দূরত্ব অন্তত দেড় কিলোমিটার। এই দেড় কিলোমিটার পথ আবার যে-সে পথ নয়। সম্পূর্ণ বালিয়াড়ি। এখানে গেলে আমার দুবাইয়ের বালিয়াড়ির কথা মনে পড়ে যায়। মাঙ্গো ব্রাশ-এর সম্পূর্ণ এলাকাকে ভৌগলিক দিক থেকে বিচার করলে মোটামুটি তিনটে ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমে ফরেস্ট, তারপর বালিয়াড়ি, সবশেষে সমুদ্র সৈকত এবং সমুদ্র। এখানকার বালিয়াড়ি ‘স্টকটন বাইট স্যান্ড ডুনস’-এর একটি অংশ, যা দক্ষিণ গোলার্ধের বৃহত্তম চলমান উপকূলীয় বালিয়াড়ি। এই বিশাল চলমান বালিয়াড়ি, কোন কোন জায়গায় যার উচ্চতা ৩০ মিটারেরও বেশি, একটি ভূ-তাত্ত্বিক বিস্ময়।
ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে রাস্তা রয়েছে, ফলে ড্রাইভিং করতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বালিয়াড়িতে কোনো রাস্তা নেই। আর সব থেকে বড় সমস্যা হল এখানে কোনো দিক নির্দেশক সাইন পোস্ট নেই। প্রায় দেড় কিলোমিটার বালিয়াড়ি, মাঝে মাঝে ছোট টিলা, যে দিকে চোখ যায় শুধু বালি। দিগন্ত বিস্তৃত বালি আর মাথার উপর নীল আকাশ ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। বালিয়াড়ির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি ফেরার পথ নেই। এখানে আসার সময় বালির উপর যে পায়ের ছাপ পড়েছিল, হাওয়ার সাথে চলমান এই বালির রাশি সাথে সাথেই সেটা মুছে দিচ্ছিল। চারিদিকে সাদা বালি ছাড়া আর কিছু নেই। কোথায় কার পার্ক করেছি, কোন দিক দিয়ে এসেছি, বুঝে ওঠা সহজ নয়। আশেপাশে আমরা ছাড়া আর কোনো লোকজনও নেই। বেশ একটু ভয় ভয় করছিল। হঠাৎ করে ফোনের ম্যাপের কথা মনে পড়ল। ফোনের ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলাম সমুদ্র আরো অন্তত এক কিলোমিটার দূরে। তাই আর সময় নষ্ট না করে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
কিছুদূর হাঁটার পর চোখে পড়ল দূরে বালির টিলার উপর কয়েকটি ছেলে স্যান্ডবোর্ডিং করছে। এখানে অনেকগুলো উঁচু টিলা আছে বলে অ্যাডভের প্রেমী ছেলেমেয়েরা স্যান্ডবোর্ড নিয়ে টিলার উপর থেকে নিচে নামে। ওদের দেখতে দেখতে আরো কিছুটা পথ হেঁটে শেষ পর্যন্ত আমরা পৌঁছলাম জিমিস বীচ-এ। পুরো বীচ জনমানব শূন্য। সিডনীর বিখ্যাত বন্ডাই বীচ বা মারুব্রা বীচের একেবারে বিপরীত। আর সে জন্যই এই বীচ আমার এত ভাল লাগে। জন কোলাহলের বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেকে যেন সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে উপলব্ধি করা যায়। সম্পূর্ণ বীচ যেন আমার নিজের। কেউ নেই ভাগাভাগি করে নেবার। বীচের ধারে জমা হয়ে আছে নানা রঙের এবং আকারের ঝিনুক। যেহেতু এখানে লোক জনের ভিড় কম, তাই সব কিছুই যেন নিজের নিজের জায়গায় স্বমহিমায় বিদ্যমান। এদের বিরক্ত করার কেউ নেই।
এই বীচে সাঁতার কাটা একটু কষ্টকর। একদিকে যেমন সমুদ্রের ঢেউ খুব বেশি, অন্যদিকে, এখানে কোনো লাইফ গার্ড নেই। সহজ কথায় বললে, বিপদে পড়লে বাঁচানোর কেউ নেই। সমুদ্রের ধারে ভেজা বালির উপর কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত সৈকত হেঁটে বেড়ানোর জন্য আদর্শ। তবুও সব ভয় দূরে সরিয়ে রেখে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে নিলাম। তারপর সমুদ্রের ধারে বসে লাঞ্চ করাটাও ছিল সুন্দর অভিজ্ঞতা। সেই সময় আরো দুটো পরিবার এল, সাথে দুটো বাচ্চা মেয়ে। ওদের দেখে মনে হল ওরা এই নির্জন বীচে আমাদের দেখে যেন একটু আশ্বস্ত হল। বাচ্চা মেয়ে দুটো মা-এর হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে স্যান্ড কাসেল বানাতে শুরু করল।
ওদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা যখন ফিরে আসার জন্য তৈরি হচ্ছি ঠিক সেই সময় একজন ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। উনি গরমে ঘামছেন। আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের কাছে কি একটু জল হবে?”
এদেশে সাধারণত লোকেরা এভাবে কারো কাছে কিছু চায় না, খাবার জিনিস তো একেবারেই না। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “জল? কেন? জল দিয়ে আপনি কী করবেন?”
লোকটার সাদা মুখ একেবারে লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে বারবার ঢোক গিলছেন। তবুও অনেক কষ্টে বললেন, “আসলে আমি জলের বোতলটা গাড়িতে ফেলে এসেছি। বুঝতে পারিনি এখানে এই বালিয়াড়ির উপর দিয়ে হেঁটে আসাটা এতটা কষ্টকর হবে। এখন একটু জল না পেলে মনে হচ্ছে আর ফিরে যেতে পারবো না”।

আমি ব্যাগ থেকে আমার জলের বোতলটা বের করে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিতেই উনি এক নিঃশ্বাসে সম্পূর্ণ জল খেয়ে আমার দিকে একটু অপরাধীর মত তাকিয়ে বললেন, “আমি যে আপনার সম্পূর্ণ জল খেয়ে নিলাম, আপনারা কী করবেন?”
“কিছু হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের কাছে আরো জল আছে”, বলে ভদ্রলোককে একটু আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। যদিও সত্যি বলতে, আমাদের কাছে আর একটুও জল নেই। আমি এই জলটুকু বাঁচিয়ে রেখেছিলাম ফেরার পথে দরকার হবে বলে। কিন্তু না, আমার থেকে এই অজানা মানুষটির ওই জলটুকু এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল। আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোক সমুদ্রের ধার দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন।
এবার আমাদের ফেরার পালা। ফোন বের করে কার পার্ক-এর দিকটা দেখে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আজ তাপমাত্রা প্রায় ৩৫ ডিগ্রী। সমুদ্রের ধারে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, তাই গরমটা এতক্ষণ ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু ফেরার পথে আবার সেই বালিয়াড়ি। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ জুড়ে কোনো গাছপালা নেই। শুধুই বালি। সূর্যের দাবদাহ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। বালিও তেঁতে রয়েছে। সমুদ্রে সাঁতার কেটে শরীরও এখন বেশ ক্লান্ত। প্রায় আধ ঘণ্টা লাগলো কার পার্কে পৌঁছতে। ‘কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না’, আজকের দিনটাও ঠিক সেরকম। শরীরের ক্লান্তির থেকে অনেক বেশি মনের আনন্দ নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।
এবার রওনা দিতে হবে সিডনীর উদ্দেশে। কয়েকটা দিন দেখতে দেখতে কিভাবে কেটে গেল বোঝার আগেই গাড়ি চলতে শুরু করল।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন