travel-berano-cherano

বেড়ানো চেড়ানো
সাগরিকা রায়

Main Entrance

তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে পার হেড ২০০ টাকা ভাড়ায় টাটাসুমোতে উঠে বসেছি। উঠে তো বসেছি, কিন্তু নির্মল বাতাসের আকাঙ্ক্ষায় জোরে শ্বাস নিতে যাচ্ছি কি, অমনি সামনের সীটের দু’জন প্যাসেঞ্জার এমন হাঁচি-কাশির জলসা শুরু করে দিল যে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ব কিনা ভাবতে হচ্ছে। সেই যে চীন দেশ থেকে এসেছিল ভারত ভ্রমণে, না, হিউয়েন সাঙ বা ফা হিয়েনের কথা বলছি না, বলছি করোনা হিয়েনের কথা। হাঁচি কাশির আওয়াজ পেলেই মন ভোমরা সাবধান করে, “ওরে পেইলে যা, প্রাণ ভোমরাটারে বাঁচা, সে বুঝি খাঁচা ছাড়া হল!” চৈনিক পর্যটক হিন্দি সিরিয়ালের পিসির মত সেই যে এসেছে, যাওয়ার নামটি করছে না।

তো যাক, বিহারি প্যাসেঞ্জারের বড় বড় চোখ, আর কাস্তের মত নাক দেখে ভরসা হল, এঁদের চেনা চেনা লাগে। অনেকটা আমার মতই দেখতে। সুতরাং এঁরা চীনা নয়। চেনা অচেনার ফাঁদ কেটে ফের গাড়িতে উঠেছি। তখন ভাল করে তাকিয়ে দেখি আমার ঠিক পাশে একজন আমেরিকান নিপাট ভালমানুষের মত মুখ করে আলুর চিপস খাচ্ছে। আমার দৃষ্টি তাঁর ওপরে নিবদ্ধ দেখে ভাবল নেটিভের খিদে পেয়েছে। তখন চিপসের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে নাকি সুরে বলল, “টেক দ্য চিপস!”

আমি কিন্তু নিইনি। অত লোভী নই। কাষ্ঠ হেসে “নো, থ্যাংকস”, বলে সীটে হেলান দিতে যাচ্ছি, তখন মনে হল, মাকে ফোন করি। ড্রাইভার স্টিয়ারিং এ হাত রেখেছে, এখনই রওনা হব। তার আগে মাকে জানিয়ে দিই রওনা হচ্ছি। উনি আবার চিন্তা করতে ওস্তাদ। এর ওপর যদি জানতে পারেন, আমার একদিকে বিহার প্রদেশের সন্দেহজনক দুজন এবং অন্যপাশে সাদামুখো রয়েছে, তাহলে মা ভেবে সারা হবেন বঙ্গভাষী মহিলার জন্য।

যাচ্ছি কোথায়? এই দেখ, বলাই হয়নি। সিকিমের একটা নতুন মনাস্ট্রি হয়েছে, সেটা দেখতেই যাচ্ছি। গ্যাংটক থেকে অনেকটা নীচে সেই মনাস্ট্রি। সে সম্পর্কে বলব বাপু, আগে রওনা হতে দাও। সবেতেই তোমাদের বেশি তাড়াহুড়ো। একেই সম্ভবত করোনা নিরন্তর সঙ্গী হয়ে রয়েছে পাশে, তার ওপর তোমাদের ব্যস্ততা দেখে বাঁচি না !

গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্যবান সিকিমিজ মধ্যবয়সী ড্রাইভার খুশি খুশি মুখে গান চালিয়ে দিল। সে গানের শব্দ আমার কানে যেমন এসেছে, তেমনটাই বলছি। ভুল ধরো না। “গাড়ি ধিংতাং ঘিন্তাং ধিংতাং,হে গাড়ি,হো গাড়ি নৃত্যম নৃত্যম …”। সেই সঙ্গে বাস্তবের গাড়ির হর্ণ আর চাকার তুমুল সঙ্গত চলতে লাগল। এর মধ্যেই একটা ভয়ংকর ঘটনা দেখতে পেলাম। সামনের সীটের সেই দুজন হাঁচি-কাশির বাদ্যকরেরা মুখ নীচু করে গুজগুজ করে কী বলছে আর মাঝে মাঝে খেস খেস শব্দে হেসে উঠছে!

দেখে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত হিম শীতল স্রোত নেমে গেল! খুব সুবিধের তো লাগছে না এঁদের হাবভাব! কান খাঁড়া করেও একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি না! কে জানে, এবারেও গ্যাংটকে গন্ডগোল হবে কি না !

প্রধান নগরের পাশ কাটিয়ে সার্কিট হাউসের দিকে আলতো চেয়ে দেখতে দেখতেই সামনে মহানন্দা এসে পড়ল। বাঁদিকে আইনক্স চকচকে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, “আজ নয়, অন্যদিন আসব। ওয়েট করো।“ সে কী বুঝল জানি না। তাকে ছাড়িয়ে খানিকটা গিয়ে আমাদের গাড়ি সেবকে উঠে গিয়ে ট্যাংক ভরে তেল নিল। একজন বেঁটেখাটো লোক সেধে সেধে জল খাওয়াচ্ছে সব গাড়ির প্যাসেঞ্জার থেকে ড্রাইভারকে। আমি অবাক। এরপরেই কি মরুভূমি পড়বে নাকি পথে? জোর করছে জল খেতে! আমি জল খাব না বলাতে সে রুষ্ট হল। বলল, “জল না খেলে জীবন বাঁচে?”

জীবন আবার কে? আমার জল খাওয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? ভাবতে ভাবতেই দেখি মেইন রোডে উঠে এসেছি। আর,গাড়ি হু হু করে ছুটতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ছি। ড্রাইভার খুশি মুখে বলে উঠল, “অব এসি ওয়েদার চলেগা!”

ক্রমশ উপরে উঠছি। রাস্তার দু’ধারে শুকনো পাতার সমারোহ! দূরে দূরে লম্বা লম্বা পাইনের অবিচল শাসন। বেড়াতে বলতে আমার ভাল লাগে জঙ্গল। ডুয়ার্সের মানুষ বলে জলদাপাড়া, গোরুমারা. চাপড়ামারি প্রচুর গিয়েছি। জলদাপাড়ার বাঘগুলো আমাকে চিনে গিয়েছিল। দেখলে হাই তুলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতো। যেন, “ধ্যাত,সেই মোটা মহিলা ফের এয়েচে!” আর সেবকের বাঁদরগুলো? আমি কলা, রুটি দিলে হামলে নিত, পরক্ষণেই দাঁত খিঁচিয়ে ক’টা দাঁত আছে, দেখিয়ে দিত। এত অবজ্ঞা সহ্য হয় না। সে যাক গে! যার যা স্বভাব!

পাহাড় খারাপ লাগে এমন মোটেই নয়। এই যে, কেমন চমৎকার বেশ ঠান্ডা লাগছে এখন। হাত ব্যাগ থেকে স্কার্ফটা বের করে গলায় জড়িয়ে নিলাম। জানালার বাইরে কুয়াশা আর মেঘ রীতিমতো হুল্লোড় করছিল। অচেনা গাছ ,ঝরঝরে ভেজা ভেজা রাস্তা, অনেক দূরে গোল্লা পাকানো কুয়াশার তান্ডব দেখতে দেখতে লোকালয় ছাড়িয়ে এলাম। এখন এক ধারে অতলস্পর্শী খাদ। অন্য ধারে আকাশ ছুঁই ছুঁই পাহাড়। পাহাড়ি ছোটো ছোটো বেগুনি ফুল প্রিমুলা পাহাড়কে ঢেকে ফেলেছে প্রায়! তারই ফাঁক ফোকর থেকে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে হাস্যময় সিকিমিজ। পিঠে রাইশাকের ঝুড়ি। এই শাক শুকিয়ে গুন্ড্রুক নামের ঝোল রেঁধে ভারি সুখে ভাত খায় এঁরা, শুনেছি।
Monk

ক্রমেই এক রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। মরিস মেটারলিংকের “ব্লু বার্ড” উপন্যাসের তিলতিল, মিতিলদের মত। এখন কেবল মেঘ, কুয়াশা, ফুল, রঙ্গিন পাতার দুনিয়া সামনে। দেখছি, পাহাড়ের মাথায় পাইনের বন। পাহাড় কেটে রাস্তা হচ্ছে। সরল গাছের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি স্পিড কমিয়ে যাচ্ছে। ডাইনে, বাঁয়ে লম্বা লম্বা বাঁশের সঙ্গে মন্ত্রপূত রঙ্গিন কাপড় লাদেচু পতপত করে বাতাসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে মন্ত্রের শ্বাস, “বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি…।“

রাস্তা মাঝে মাঝে এত সংকীর্ণ যে বাঙালের বেপরোয়া মেজাজও ধড়ফড় করে উঠছে, “খাইছে! আইজ আমি শ্যাষ!”

গাড়ি সিকিমে ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় পড়ল ডিস্টিক্ট কোর্ট। মসৃণ ঢালু রাস্তায় গাড়ি হড় হড় করে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে পিছুটান না রেখেই। যেন জুলে ভার্নের জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে, পৃথিবীর গহ্বরে পৌঁছে যাব বলে নেমে যাচ্ছি। ড্রাইভারের নাম এতক্ষণে জেনে ফেলেছি। দোরজে ডুকপা। বেশ নাম। মনে রাখা সহজ। “দরজা দিয়ে ঢুকবা”।

দোরজের কাছ থেকে জেনে নিলাম রাস্তার দু’ধারের লম্বা লম্বা গাছগুলোর নাম। উত্তীস! পাহাড় জুড়ে গাছ আর গাছ! ফুল আর ফুল। পরীর পায়ের ছাপ সেই সব ফুলের পাঁপড়ির গায়ে। স্পষ্ট দেখেছি।

ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজছে। বেলা বারোটার ঘন্টা। তারই অনুরণন বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। খেয়াল হল, নামতে নামতে গাড়ি একটু একটু করে ওপরে উঠছে। প্রত্যন্ত এলাকা রে ভাই! কেউ কোত্থাও নেই। অনাবিষ্কৃত এলাকার মতো। স্যাঁতসেঁতে ,নির্জন! ফের গাড়ি নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে! রাস্তা গহন। রহস্যময়। অবশেষে সিকিমের নতুন মনাস্ট্রি রাংখায় পৌঁছে গিয়েছি।

গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখি, সার বেঁধে রয়েছে মণি। হাত দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে যাও। মনের ইচ্ছে প্রকাশ করো ঈশ্বরের পায়ে মণির মাধ্যমে। মুখে বল, “ওম মণিপদ্মে হুউম!”

নিঃসীম পাহাড় এখনও মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে রোদের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। ফুল, মেঘ, রোদ, আলো, বাতাস…আহা ! হমিন অস্ত ! স্বর্গ এখানেই।

মনাস্ট্রির ভিতরে ঢুকে দেখি, বিশাল জায়গা নিয়ে মনাস্ট্রি রয়েছে। বিরাট এলাকা জুড়ে উঠোন। চারপাশে তিনতলা বিল্ডিং। এক কণা বালি নেই কোথাও। দু’দিকেই চওড়া চওড়া সিঁড়ি রয়েছে। রঙ্গিন সিঁড়িতে কমলার আতিশয্য। সিঁড়ি সোজা তেতলার দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে রঙ্গচঙ্গে ওড়না বাতাসে মেলে দিয়ে।

মনাস্ট্রিটা নতুন। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে চিত্রিত হচ্ছে বুদ্ধের জীবঙ্কথা। এর সঙ্গে ড্রাগন রয়েছে। আর রয়েছে মেঘ,পাখি,সারস…। ছবি আঁকছে দুজন আর্টিস্ট। গ্যালসিন আর তামডিং। ওঁরা বুদ্ধের উত্তরীয়তে রঙ দিচ্ছে। দোতলায় উঠে সামনেই বিরাট ছাদ। সেখানে ফুলের সমারোহ। বিশাল হলঘরে ছোট ছোট বসার জায়গা। চাকা লাগানো কাঠের গাড়ির ওপরে অস্বাভাবিক বড় একখানা পেতলের বাঁশি। তাতে প্রচুর সাজ পরানো হয়েছে। মাঝে মাঝে প্রৌঢ় লামা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে গম্ভীর আওয়াজ তুলছেন। আধ অন্ধকার হলঘরে ছায়া ছায়া লামাদের দেখতে পাচ্ছি। খুব ব্যস্ততায় রয়েছেন তাঁরা।
Ranka

প্রশস্ত দরজার ফ্রেম পেতলের তৈরি। দরজার ঠিক মাঝখানে পেতলের ধূপদানি। হলঘরের দুটো পাশ ঘিরে শিক্ষার্থী লামারা সমস্বরে ত্রিপিটক পাঠ করছে। তাদের সামনে খোলা পুঁথি। আর ছোট বাটি করে রাখা আছে কাঁচা দুধ। কেন? জানি না। অবিরত বাজনা বেজে চলেছে ঝ্যাম ঝ্যাম ঝ্যামর ঝ্যাম! একটু এগিয়ে যেতেই বি-শা-ল সোনালি রঙ্গের বুদ্ধ ধ্যানমগ্ন! দু’পাশে দুটো ভয়াবহ মূর্তি। তাঁরাও আকারে প্রকারে বুদ্ধমূর্তির সমান।

দেওয়ালে দলাই লামার বাঁধানো ফোটোগ্রাফ। সমস্তটা ঘিরে রয়েছে ১০৫টি ঘিয়ের প্রদীপ। সর্বত্র রঙ্গচঙ্গে সবুজ, তুঁতে, কমলা সিলকের কাপড় ঝুলে আছে। মনাস্ট্রি জুড়েই এই রঙগুলোর প্রাচুর্য!

আমার আবার রহস্য খোঁজার অভ্যেস। মনাস্ট্রি ঘুরে দেখতে দেখতে একটা সরু, লম্বা, ঘোরপ্যাঁচওলা প্যাসেজ পেরিয়ে পিছনের দিকে চলে গিয়েছি। দুটো বাচ্চা ছেলে রাশিকৃত বালি ভরছিল বস্তায়। ওদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, ওরা কাছেই একটা গ্রামে থাকে। এই বালি নিয়ে যাবে পাহাড়ের আরও ওপরে। সেখানে নাকি আরেকটি মনাস্ট্রি হবে। নাম তার সেডা। রাংখা মনাস্ট্রির ওপরে রাংখা কলেজ আছে। কিছু তরুণ সিকিমিজকে দেখলাম কলেজের দিকে যাচ্ছে। ঘন খয়েরি পোশাক তাঁদের পরনে।

ছাড়ানো ছাদে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে টুলটুলে মুখ কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে দেখা হল। ভারি লাজুক। একজন নাম বলল, “লেব চু।“ ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সকালে চা-রুটি খেয়েছে। বারোটায় ভাত সবজি। “তিন বাজে চা “।

ফেরার সময় হল। মনাস্ট্রির বাইরে রাখা জুতোতে পা গলাতে গিয়ে লক্ষ্য করি, টিবেটান ভাষায় লেখা আছে, “TANGGALKAN KASUT”. নীচে ইংরেজিতে অনুবাদ করা, “নো শু’জ অ্যালাউড”।

এবারে ফের গাড়িতে উঠে বসেছি। রাস্তার ধারের রেস্তরায় ডিম ভাত, ট্রি টমোটোর সঙ্গে ডল্লে খর্সানি নামের বীভৎস ঝাল লংকার মিশেলের চাটনি খেয়ে নিলাম। ফেরার পালা। গ্যাংটক হয়ে সোজ্জা বাড়ি।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *