রম্যাণী গোস্বামী
বছর আটেক আগে আমরা যখন প্রথমবার ঝালং রিভার ক্যাম্পে গিয়েছিলাম তখন ওই নামটা একেবারেই পরিচিত ছিল না ট্যুরিস্টদের মধ্যে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ। আমাদেরও সেই অর্থে কোনও প্ল্যানিং ছিল না বেড়ানোর। উত্তরবঙ্গে বর্ষায় আবার কীসের বেড়ানো? জোঁকে ধরবে না? একদিন সন্ধেবেলা দার্জিলিং চা, আলুর চপ-মুড়ি সহযোগে আড্ডা দিতে দিতে নিজের ফোনে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ (wbfdc.net) এর সাইটটা ঘাঁটছিল আমাদের বন্ধু দীপ। ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের চৌত্রিশখানা ‘নেচার রেসোর্ট’ এর উল্লেখ রয়েছে ওই সাইটে। হোমপেজে গেলেই বুকিংয়ের জন্য পছন্দসই ‘নেচার রিসোর্ট’টি বেছে নেওয়ার অপশন দেখায়। তারপর রুম ফাঁকা থাকলে পেমেন্ট ইত্যাদি সব অনলাইনে। সেখানেই দীপ হঠাৎ আবিস্কার করে বসল জায়গাটাকে। এর আগে ওদিকটায় কখনো ডে-ট্যুর করিনি এমনটাও নয়। নর্থবেঙ্গলে বিন্দু-ঝালং-প্যারেন তো বেশ জনপ্রিয় বেড়ানোর স্পট। জলঢাকার হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রজেক্টের কথা কে না জানে। কিন্তু অচেনা এক ঝোরার ধারে রাত কাটানো? সে তো বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার হবে!
দীপ উৎসাহ পেয়ে এদিক সেদিক থেকে বেশ কিছু ইনফো জোগাড় করে ফেলল আধঘণ্টার মধ্যে।
শিলিগুড়ি থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরত্বে কালিম্পং সাবডিভিশনে ইন্দো ভুটান বর্ডারের কাছে জলঢাকা নদীর ধারেই ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ ঝালং। স্থানীয় ঝালং খোলা বা ঝোরার গা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে এই রিভার ক্যাম্প। ঝোরার ধারে পরপর চমৎকার কাপড়ের সব টেন্ট। হ্যাঁ। সিমেন্টের উঁচু ভিতের উপরে তখন এক একটা বড় সাইজের তাবুই ছিল। এখন গেলে অবশ্য টেন্টগুলো আর পাওয়া যাবে না। মেইন্টেইনেন্সের বড্ড ঝামেলা। তাছাড়া বর্ষার জলে ভিজে ভিজে তাবুর কাপড় পচে যাওয়ার দরুন সমস্তটাই আমূল বদলে ফেলে এখন সেখানে এসি, নন-এসি সবধরনের কটেজই বসেছে। মোট কটেজের সংখ্যা পাঁচ। ব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো তবে কিনা সেই আগেকার মতো তাবুতে রাত কাটানোর রোমাঞ্চটা ওতে মিসিং। কিন্তু এটাও ঠিক যে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই দুঃখটা ভুলে যেতে হয় এক নিমেষেই।
ফিরে যাই যেখানে ছিলাম। অনলাইনে ঝটপট বুকিং সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রুটটা খুবই সহজ। ট্রেনে বা ফ্লাইটে এলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন অথবা বাগডোগরা থেকে গাড়িতে সেবক হয়ে ওদলাবাড়ি, মালবাজার পেরিয়ে চালসা। খুনিয়া মোড়ে পৌঁছে বেঁকে যেতে হবে চাপড়ামারির দিকে। বাঁ হাতে চাপড়ামারি অভয়ারণ্যের গেটটাকে রেখে কুমাই বিট অফিস এবং বনবস্তি পেরিয়ে খুনিয়া-ঝালং রোড ধরে সোজা গৈরিবাস। খুনিয়া মোড় থেকে ঝালং রিভার ক্যাম্পের দূরত্ব তেইশ কিলোমিটার। সরু পথ। দুপাশে চাপড়ামারি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। হঠাৎ সামনে হাতির পাল দেখলে গাড়ি ব্যাকে চালাতে হবে, ঘোরানোর কোনও অপশন নেই। ড্রাইভিং সিটে বসা অর্ক সেটা নিয়ে একটু টেনশনে। তখনই সুরশ্রী ওর কোলের উপরে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা আমাদের কুট্টুসটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে একটা বিটকেল প্রশ্ন করে বসল, এই, শোন, এই জায়গাটার নাম খুনিয়া কেন রে? এখানে কোনও সময় কোনও খুন টুন হয়েছিল নাকি?
নির্জন পথ। মেঘলা আকাশ। শিরশিরে বাতাস বইছে। পথের উপর চেপে আসা দুপাশের জঙ্গলে কেমন একটা ছমছমে ভাব। অর্ক ড্রাইভ করতে করতে ভুরু কুঁচকে কটমট করে তাকাল সুরশ্রীর দিকে। দীপ পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে অর্কর হয়ে নিজেই ঘাড় ঘুরিয়ে জবাবটা দিল, উম, খুন তো বটেই, তবে মনে হয় মানুষে করেনি সেটা, হাতিতে করেছে। শিওর। খুনি হাতি। বুঝলি? তাই জায়গাটার নাম হল খুনিয়া।
তর্কাতর্কির মধ্যেই দেখলাম রাস্তাটা এবার চড়াইয়ে উঠছে। পথে আসবার পথে পুঁচকে পুঁচকে ঝোরা পেয়েছি দুটো তিনটে। সবগুলোই জলে টইটম্বুর। বর্ষার সময় যে। পাহাড়ে ঘোর বৃষ্টি। এবার যাওয়ার সময় গৈরিবাস ভিউ পয়েন্টে নেমে আমার কন্যা রূপকথার ফেভারিট দুর্দান্ত চিকেন মোমো আর চা খেয়েছিলাম। ওখান থেকে নীচে জলঢাকা নদীর বিস্তৃত উপত্যকার শোভা অসাধারণ। নদীর ওপারে চাষের জমি, এপারে ছোট ছোট বাড়িঘর। পিছনে জেগে আছে ভুটান পাহাড়।
চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম ঝালংয়ে। ছবির মতো সুন্দর ঝালংয়ের সরকারি বাংলো। বাংলো ঘেঁষে বাঁ-দিকের রাস্তাটা চলে গেছে রিভার ক্যাম্পের দিকে। আরও মিনিট দুই গাড়িতে। তারপরেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। দূর থেকেই জলের গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল আমাদের। নেমে আমরা চমকে গেছি। এ কী দেখছি! এ যেন বিদেশী কোনও সিনেমার দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে এনে ফেলা হয়েছে!
চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম ঝালংয়ে। ছবির মতো সুন্দর ঝালংয়ের সরকারি বাংলো। বাংলো ঘেঁষে বাঁ-দিকের রাস্তাটা চলে গেছে রিভার ক্যাম্পের দিকে। আরও মিনিট দুই গাড়িতে। তারপরেই একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। দূর থেকেই জলের গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল আমাদের। নেমে আমরা চমকে গেছি। এ কী দেখছি! এ যেন বিদেশী কোনও সিনেমার দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে এনে ফেলা হয়েছে!
চোখের সামনেই বয়ে যাচ্ছে ঝালং ঝোরা। কিন্তু বর্ষায় তার যে এমন বিশালতা তা আমাদের ধারণাতে ছিল না। কচ্ছপের পিঠের মতোই বিরাটাকার কালচে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে সফেদ জলরাশি দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে সগর্জনে। পাহাড়ি ঝোরাটার ঘাড়ের কাছেই ঝুঁকে নিঃশ্বাস ফেলছে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। ওপাশের ঘন নীল ভুটান পাহাড়ের গায়েও লুটিয়ে পড়েছে মেঘ। সেই কালো আকাশ আর বৃষ্টিধোয়া নীল পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে ধাবমান দুধসাদা বিপুল জলরাশির দিকে তাকালে একই সঙ্গে বুকের ভিতরটা কেমন ছমছম করে ওঠে আবার পরমুহূর্তেই মনটা পাগলের মতো নেচে ওঠে আনন্দে। কী যেন হারিয়ে গেছিল জীবন থেকে। কী যেন ফিরে পেয়েছি! এরকম সব কনফিউজিং ভাবনা কোথা থেকে এসে পড়ে মাথার ভিতরে এলোমেলো ঘোরে।
সবাই লাগেজ টাগেজ নিয়ে নেমে দাঁড়িয়েছি সমতল জায়গাটায়। কুট্টুসকে সত্যিই আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। ও ছটফট করছে নতুন জায়গাটাকে সবার আগে আবিস্কার করবে বলে। তাকিয়ে দেখি ফুঁসতে থাকা ঝোরার উপরে আড়াআড়িভাবে তৈরি একটা কাঠের পুল। দেখে মনে হল বেশ পুরনো। কাঠের লগ দড়ি দিয়ে জুড়ে সেই পুল সোজা চলে যাচ্ছে রিভার ক্যাম্পের ভিতরে। চারপাশে জনমানুষের সাড়া নেই কোনওখানে। যেন অন্য একটা জগত।
প্রাথমিক ঘোর কেটে যাওয়ার পর যে যার রুকস্যাক, শুকনো খাবার দাবার ভর্তি বিগশপার, জলের বোতল ইত্যাদি নিয়ে টুকটুক করে হেঁটে ব্রিজ পেরলাম। কুট্টুসটা একেবারে সামনে লাফাতে লাফাতে চলেছে। ওর চরম আনন্দ হচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছি। একবার নীচে তাকিয়েই কেঁপে উঠলাম। আমাদের পায়ের তলায় প্রায় পা ছুঁয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে জল। ব্রিজের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন জলের উপরেই দাঁড়িয়ে আছি অদ্ভুত কোনও ক্ষমতায়। ইচ্ছে করছিল ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে থেকেই গোটা বেলাটা দিব্যি কাটিয়ে দিই। বসতে না পেলেও চলবে। এখন সেই ব্রিজ আর নেই। পরপর দু’বার হড়পা বানে কাঠের তৈরি ব্রিজ ভেসে যাওয়ার পর অনেক উঁচুতে শক্তপোক্ত কাঠ ও দড়ির এক ঝুলন্ত সেতু তৈরি হয়েছে। ব্রিজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এবারেও নীচের দিকে তাকিয়েছিলাম। সেই রোমাঞ্চ আজও অনুভব করলাম।
প্রপার্টির ভিতরে ঢুকেই বাগান পেরিয়ে দূরে একে একে তাবুগুলো চোখে পড়ল (এখন কটেজ)। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ডান হাতে বিরাট ডাইনিং হল। একসঙ্গে পনেরো কুড়িজন খেতে বসতে পারে। সেখানেই দেখা হল ক্যাম্পের কেয়ারটেকারের সঙ্গে। খুবই আন্তরিক মানুষটি। আমাদের পাশাপাশি দুটো তাবুর বুকিং ছিল। শুনলাম আমরা ছাড়া আর কোনও বুকিং নেই। আমাদের বাঁদিকের খাত বরাবর পাথরের পর পাথর টপকে গর্জন করতে করতে ছুটে যাচ্ছে ঝোরা। ঝোরার ওপাশে সবুজ টিলার বুকে ঝোপঝার, জঙ্গল। ঝোরার মূল স্রোতের দিকে তাকালে চোখে পড়বে নীল পাহাড়। এখন যেখানে বুনো হাতির মতো কৃষ্ণকায় মেঘেরা এসে লুটোপুটি খেলছে।
নিজেদের তাবুতে জিনিসপত্র নামিয়ে রেখেই আমরা ছুটলাম ঝোরার জলে পা ভেজাতে। সবচাইতে যেটা অভিনব লাগল সেটা হচ্ছে এখানে প্রত্যেকটা টেন্ট থেকেই (এখন কটেজগুলো থেকে) আলাদা আলাদা রাস্তা রয়েছে ঝোরার বুকে নামার জন্য। এক টেন্ট থেকে অন্য টেন্টে যাওয়ার রাস্তাগুলোও খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দুপাশে ফুলগাছ লাগানো, রাতের জন্য আলো সেট করা, সব মিলিয়ে এক দারুণ ব্যবস্থা। নেমে দেখি বড় বড় পাথরে এমন প্রাকৃতিক আড়াল তৈরি হয়েছে যে সবাই একই সময়ে ঝোরার ধারে বসে থাকলেও একদলের সঙ্গে পাশের দলের দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরিই হচ্ছে না। যেন প্রত্যেকের নিজের নিজের পার্সোনাল রিভারসাইড!
একে তো অন্য কোনও বুকিং নেই, তায় এমন প্রাইভেসি এখানে। এই সুযোগ কি ছাড়া যায়? অর্ক লাফিয়ে উঠল, আমরা এখন ঝোরায় স্নান করব। দীপও শুনে একপায়ে খাড়া, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, ক্যাম্পে এসে ঘরে থাকব নাকি?
এখন স্নান! আমি আর সুরশ্রী তো আকাশ থেকে পড়লাম! বাড়ি থেকে তো সকালে স্নান সেরেই বেরিয়েছি! ঘড়িতে প্রায় সাড়ে বারোটা। রোদ নেই, আবার বৃষ্টিও হচ্ছে না। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে পাহাড়ের দিক থেকে। কাকা’কে লাঞ্চের কথা বলে এসেছি। একটু সময় লাগবে। অগত্যা ওদের হুজুগে সায় দিয়ে এক পা এক পা করে নেমে পড়লাম জলে। উহ, কী ঠাণ্ডা জল। কুট্টুসকে এই প্রথম সাঁতার দিতে দেখলাম। আশ্চর্য! শিখল কবে? এই ঝাঁপিয়ে জলে নামছে, তারপর সাঁতার কাটতে কাটতে পাড়ে আসছে, বালিতে গা ঝেড়ে নিয়ে আবার জলে ঝাঁপ। এইরকম বারকয়েক করার পর বালির উপরের একটা বেঁটেমতো চ্যাপ্টা পাথরের শ্যাওলামাখা মখমলি গায়ে চার পা ছড়িয়ে হাই তুলে ঘুম।
ঝোরায় নামার একটু পরেই শরীর মনে যেন জলের নেশা লেগে যায়। মাঝামাঝি জায়গায় প্রচণ্ড স্রোত। হৈহৈ করে ছুটে যাচ্ছে জলরাশি। পাগল! ওদিকে গেলে কি আর রক্ষে আছে? টেনে নিয়ে চলে যাবে সোজা জলঢাকার বুকে। ঝালং ঝোরা তো জলঢাকাতে গিয়েই মিশেছে। আমরা তাই সজাগ। তীরের কাছে অল্প ঢেউয়ে যে যার মতো বালিতে বসে জলে অর্ধেক গা ডুবিয়ে রেখেছি। অর্ক আর দীপ চলে গেছে আরও খানিকটা গভীরে। নিরাপদ দূরত্বের আওতায়। ওরা চিত হয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে জলের বুকে।
আমাদের মাথার উপর বিরাট আকাশ। কান ফাটানো একটানা গর্জন জায়গাটাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বাইরের দুনিয়া থেকে। একটা লম্বাটে চ্যাটালো পাথর টপকে জল এসে পড়ছে ঝিরঝির। তার নীচেই কোমর অবধি স্থির জল। এখানে স্রোতের টান নেই। মসৃণ শীতল পাথুরে গায়ে ঠাণ্ডা পরিষ্কার জলস্রোত গড়িয়ে নামছে। ঠিক যেন ন্যাচারাল শাওয়ার। আমি সেই পাথরে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। দুই কাঁধ থেকে জল গড়িয়ে নেমে চলেছে অবিরাম ধারায়। মাঝে মাঝে স্রোতের দমকে অনেকটা জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে মাথা। পাথরের উপর জলের ভেঙে পড়ার নেশাজাগানো গম্ভীর একটানা শব্দ। আরামে দু’চোখ বুজে আসে আমার।
এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না। সময়ের হুঁশজ্ঞান ছিল না। নদীর শীতল স্রোত সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। অনেক পাওয়া-না পাওয়া, দুঃখ-ক্ষোভ, আনন্দ-বেদনা, ব্যস্ত জীবনের স্ট্রেস – সবই ভেসে গিয়েছিল জলের তোড়ে। কাকা’র হাঁকাহাঁকি এবং বকাবকির চোটে উঠতে হল জল ঠেলে। তাবুতে ফিরে মাথা টাথা মুছে শুকনো জামাকাপড় পরে রেলগাড়ির মতো লাইন করে পৌঁছে গেলাম ডাইনিংয়ে। খিদে পেয়েছিল জব্বর। রান্নাও হয়েছিল খাসা। কিন্তু দেখলাম সে নিয়ে কারোর মুখেই কোনও কথা নেই। ঝোরার দিকে মুখ রেখে বসেছি আমরা। আবিষ্ট সকলে। নিবিড় প্রকৃতির মাঝখানে এমন আদিম পরিবেশে কথারা হয়ত এভাবেই হারিয়ে যায়।
বিকেলে সূর্য অনেকটা নেমে এল। কখন যেন মেঘ কেটে গিয়ে ফর্সা হয়েছে আকাশ। চারটে চেয়ার বালিতে গেঁথে বসানো হয়েছে। গেঁথে, কেননা হাওয়ার দাপটে বারবার উল্টে যাচ্ছে ফাঁকা চেয়ার। কাকা’দা এসেছিল কার্বলিক অ্যাসিডের শিশি হাতে। সাপখোপ থাকা অসম্ভব নয়। আমাদের সঙ্গে পোষা কুকুর আছে। ভয় সেকারণেই। তাবুর চারদিকে সেই বস্তুটা ছড়ানো চলছে। আমি আর সুরশ্রী দুটো চেয়ার দখল করেছি। হুহু হাওয়ায় আমাদের চুল উড়ছে। সুরশ্রী গুনগুন করছিল।
কী মনে পড়াতে ওকে বললাম, সেই যে আসার পথে খুনিয়া মোড়ের নামকরণের কারণ খুঁজে পেয়েছি রে।
সুরশ্রী দারুণ উৎসাহে নড়েচড়ে বসল, বল শুনি।
আসলে ওই খুনিয়া কথাটা এসেছে ‘খুনিয়া’ অথবা ‘খেন’ নামের আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে। অসমীয়া ভাষায় ‘খুন’ বা ‘খেন’ একই কথা। এর মানে হল রাজা বা সুপিরিওর কেউ। জলপাইগুড়ির স্বনামধন্য লোক গবেষক বিমলেন্দু মজুমদার লিখেছেন যে এই ‘খেন’ উপজাতিদের নাম থেকেই গরুমারা বনবিভাগে গড়ে উঠেছিল ‘খুনিয়া বনবস্তি’। এখন ‘খেন’রা নিজেদের ‘সেন’ বলে পরিচয় দিলেও ওই খুনিয়া নামটা রয়েই গেছে।
কথায় কথায় আরও সন্ধে ঘনাল। চা-পকোড়া সমেত জমজমাট আড্ডার পর্ব মিটেছে। এখন ওই বালিতেই গাঁথা বার্বিকিউয়ের স্ট্যান্ডে ধিকিধিকি জ্বলছে কাঠকয়লার আগুন। কাবাব সেঁকা চলছে। অর্ক উঠে মাঝে মাঝে কাবাব সমেত শিকগুলো ঘুরিয়ে আসছে। একটু পরেই বিশাল এক চাঁদ উঠল আমাদের চোখের সামনে।
তাই তো! আজ যে পূর্ণিমা! মনেই ছিল না।
চাঁদ উঠতেই সম্পূর্ণ বদলে গেল জায়গাটা। কেমন এক রহস্যময়তা ছড়িয়ে পড়ল জ্যোৎস্নাভেজা চিকচিকে বালির বুকে। আঁধার যতই গাঢ় হয়, চাঁদের চেকনাই আরও বাড়ে। ঝোরার জলস্রোতের বুকে লম্বা স্তম্ভের আকারে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। দেখি ফটফটে সেই আলোর তলায় দিনের বেলার মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সফেদ জলরাশি। অলৌকিক ঝোরার বুকে জেগে আছে অতিকায় বাইসনের পিঠের মতো নিকষ কালো পাথরগুলো।
জল এখন আরও বেড়েছে। বার তিনেক আমাদের চেয়ারগুলো টেনে পিছিয়ে বসতে হয়েছে। দীপ পাথরের উপরে আধশোয়া। স্তব্ধ বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে আছি সামনে। যেন অন্য কোনও জগত থেকে কেউ অকৃপণ হাতে জলরাশির শরীরে বিলিয়ে দিচ্ছে বহুমূল্য রূপোর কণা। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে গলানো রূপোর কুচির মতো কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্তেরা। ঝোরার ওপারে টিলায় বাতাসে মাথা নাড়ছে গাছপালা। আমরা সম্মোহিতের মতো বসেই আছি বালুতটে। রাত গড়ায়।
ডিনার শেষ নটায়। তাবুর উষ্ণ গহ্বরে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসছে না। কেবলই শুনতে পাচ্ছি পাথরের গায়ে প্রবল বেগে জলের আছড়ে পড়ার গুমগুম আওয়াজ। অনেকটা যেন মেঘের ডাকের সঙ্গে ভ্রম হয়। অথবা হয়তো সত্যিই বৃষ্টির ঢল নেমেছে পাহাড়ের মাথায়। লাফিয়ে লাফিয়ে শীতল জল নামছে নীচে। তাবুর গায়ের চৌকো জানলা থেকে উঁকি দিয়ে চাঁদকে দেখার চেষ্টা করি আপ্রাণ। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে চরাচর। কিন্তু যাকে খুঁজছি, সে নেই। সেকী! কোথায় গেল আমাদের একা রেখে? কেঁপে উঠে মনে মনে উচ্চারণ করি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চাঁদ কবিতার অংশ –
কোনো এক ঘুমভাঙা রাতে
হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখেছি বাহিরে
ঝাউয়ের সারির পরে হিমঝরা অদ্ভুত আলোক, প্রান্তরের নদীটির বুকে
প্রেতে-পাওয়া হাসি নিয়ে ধীরে-ধীরে মরে গেল চাঁদ।
দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে গেল রাতটা। শিলিগুড়ির গতানুগতিক কর্মব্যস্ততার মাঝে ফেরার পালা। পরদিন ঠিক যখন গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসা হচ্ছে তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কুট্টুসটা হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই সামনে বসা আমার কোল থেকে ছিটকে চলে গেল পিছনের সিটে আর দুপা তুলে পিছনের কাচে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ অবধি সেই ঝালং ঝোরাকে দেখা যাচ্ছিল ও ওমনিভাবেই ছিল। নড়েনি। দীপ ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, মন খারাপ করিস না কুট্টুস। আমরা তোকে নিয়ে আবার আসব এখানে।
নাহ্, কুট্টুসের আর ঝালং ঝোরায় ফেরা হয়নি। ও এখন তারাদের দেশে আছে। হয়তো গলানো রূপোর রাতগুলোয় কোনও এক বন্ধু তারার পিঠে সওয়ার হয়ে ও ঠিক চলে যায় ওর প্রিয় জায়গাটিতে। ঝোরার ধারের সেই চ্যাটালো পাথরের উপরে চারটে পা থেবড়ে শুয়ে থাকে। আর টিলার বনের পাখিরা দল বেঁধে এসে ওকে গান শোনায়।
আট বছর পর যখন আবার গেলাম ঝালং রিভার ক্যাম্পে, তোকে খুব মিস করছিলাম রে কুট্টুস।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন