হিমি মিত্র রায়
গত এক বছর আমাদের অর্থাৎ মানুষ জাতির এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। ঘর বন্দী অবস্থায় মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, প্রিয়জনের জন্য চিন্তা, প্রচুর মানুষকে অকালে চলে যেতে দেখা, বদ্ধ পরিবেশ, খোলা হাওয়ার অভাব, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত দমবন্ধ অবস্থায় কেটেছে। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণী জগৎ পশুপাখিরা অবশ্য ভালো থেকেছে বেশ কিছুদিন। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে অনেকটা। ধুলো, ধোয়া পলিউশনের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলেছে খানিক। যেসব জায়গায় পাখির দল আসা বন্ধ করে দিয়েছিল সেখানে দল বেঁধে তাদের ফিরতে দেখা গেছে। সকালবেলায় পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙেছে অনেক রাত করে শুতে যাওয়া কর্পোরেট সেক্টরের কর্মীটির। খবরে দেখেছি বিভিন্ন দেশের রাস্তায় পশুপাখিদের অবাধ বিচরণ, তারা মেতে উঠেছে খেলায়। বলা যেতে পারে পরিবেশ অনেকটা হলেও ভারমুক্ত হয়েছে। কিন্তু এই মারণ রোগ আমাদেরকে ঘরে বসিয়ে রেখেছিল প্রায় এক বছর, ফলে প্রত্যেকেই আমরা কমবেশি স্বনির্ভর হওয়া শিখেছি করোনার কল্যানেই।
করোনা পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় অনেক স্বাভাবিক। মানুষ এখন মুক্ত বাতাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ছে এদিক সেদিক। আমরাও তাই খুঁজতে হঠাৎ একটি প্ল্যান বানিয়ে ফেলি। কথায় আছে না ‘উঠল বাই তো কটক যাই’! তেমনি আর কি। তাও আবার অনলি গার্লস ট্যুর। বিশুদ্ধ অক্সিজেন পেতে পাহাড়ের থেকে বেস্ট অপশন আর কীই হতে পারে! সবথেকে প্রথমে একটা কথা বলা উচিত ছিল যে আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে। অর্থাৎ পাহাড়-জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। চাইলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আসতে পারি যখন তখন। কিন্তু বিবাহসূত্রে যাযাবর জীবন যাপন হওয়ায় হয়তো দূরের জায়গা ঘুরে আসতে পেরেছি বহুবার, কিন্তু নিজের ঘরের কাছের পাহাড়কে শেষ দেখেছি ২০১৪ সালে। তারপর আর হয়ে ওঠেনি।
একটি ঘাসের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু দেখতেই এই ঝটিকা সফর। আসলে বড্ড বেশি করে পাহাড় দেখতে চাইছিলাম খুব কাছ থেকে। এক দিনের প্ল্যানিং চললাম কার্শিয়াং আর ডাওহিল দেখবো বলে। জলপাইগুড়ি থেকে প্রথমে চলে গেলাম বন্ধুর বাড়ি। বাড়ি নয়, ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, ওর ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে এক রাত থেকে পরদিন বেরিয়ে পড়লাম কার্শিয়াং। মেয়েকে প্রথম পাহাড় দেখাবো এটাও একটা অন্য ধরনের উত্তেজনা। খুব ছোটবেলায় ওকে নিয়ে দার্জিলিং আর তার ক’দিন পর রিষপ গিয়েছিলাম। তারপরে আর যাওয়া হয়নি।
শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং মোটে এক ঘন্টার রাস্তা। কিন্তু সোজা রাস্তা না হওয়ায় মনে হয় সময় টা একটু বেশি লাগে। শুকনা ছাড়াতেই আঁকাবাঁকা পথ শুরু হয়ে গেল। চোখের আরাম মনের শান্তি। কতদিন এদিকে আসিনি। প্রাণভরে চোখ বন্ধ করে জানলার থেকে মুখ বাড়িয়ে শ্বাস নিলাম বেশ কিছুক্ষণ। আমার মেয়ে ভাবছে এ যাত্রায় মা বোধহয় পাগলই হয়ে গেল! ভেজা পথ, সবুজ চা বাগান, চা পাতার গন্ধ, ঝাঁকে ঝাঁকে কমলালেবু, এসব কিছুর জন্যই তো বারবার আসতে ইচ্ছে করে! কিন্তু অনেক সময় কাছে থেকেও সব সময় হয়ে ওঠে না।
এই রাস্তা গুলো দিয়ে অন্য সময় এলে দেখা যায় স্কুল ফেরত ছোট ছোট কচিকাচাদের দল পিঠে ব্যাগ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। বড় সুন্দর দৃশ্য কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে এখন স্কুল বন্ধ হলে পাহাড়ের রাস্তায় এসে চিরপরিচিত নেপালি বাচ্চাগুলিকে দেখা গেল না। রাস্তার দুই ধার দিয়ে নাম না জানা ফুলের মেলা দেখতে দেখতে অবশেষে আমরা চলে এলাম কার্শিয়াং টুরিস্ট লজের সামনে। বেশিরভাগ পর্যটকরাই হল্ট করে। আমরাও দাঁড়ালাম। কতদিন পাহাড়ের মোমো খাইনি!
আরো বেশ কিছু গাড়ি পার্কিং করা ছিল। কার্শিয়াং শহরের এটা একটা অসুবিধে শহরের রাস্তায় সমতলের অন্য গাড়ি পার্কিং করার জায়গা নেই। শুধুমাত্র এখানকার গাড়ি নিলেই তবে রাস্তার দোকানপাটের সামনে দাঁড় করানো যাবে অথবা নয়। যদি আমি কোন হোটেল বুক করি তবে অবশ্য সেই হোটেলে পার্কিং করা যাবে, অথবা গাড়ি রাখার খুবই অসুবিধে।
শহর থেকে একটু দূরে এই ট্যুরিস্ট লজটি, তাই বাইরে গাড়ি জায়গামতো পার্কিং করে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। জানুয়ারি মাস, প্রচন্ড ঠান্ডা। কনকনে হাওয়া বইছে। ট্যুরিস্ট লজের উল্টোদিকে ফুলে ঝাঁকড়া গাছ, পাহাড়ে ঘেরা। আমরা ভেতরে ঢুকতেই হাসিমুখে নেপালি ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন। আমরা আমাদের পছন্দ মতো খাবার দাবার অর্ডার করে ফেললাম। ছিল চিকেন মোমো, মানচাও স্যুপ, সসেজ, স্যানডুয়িচ, সঙ্গে ধূমায়িত কফি কাপ। কিছুক্ষণ গল্প না করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম, কেন এতদিন আসিনি তা বারবার মনে হচ্ছিল।
পাহাড় সবসময়ই রহস্যের হাতছানি দেয়। গল্প লিখতে ভালবাসি তাই মাঝেমাঝেই চুপ হয়ে যাচ্ছিলাম। পাহাড়ের প্রতিটি খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে রয়েছে কত গল্প, কত রহস্য। কনকনে ঠান্ডায় এক চামচ স্যুপ টেনে নিয়ে তৃপ্তি হল। আশেপাশে অনেকেই নিচ থেকে এসেছেন। অনেকের পাহাড়ে অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। সবাই ওষুধের দোকান খুঁজছে। তাই জন্য বলে রাখা ভাল যাদের অভ্যাস নেই তারা অবশ্যই এভোমিন জাতীয় বমি বন্ধ করার ওষুধ খেয়ে আসবেন, নয়তো পাহাড়ে জার্নি করতে একটু অসুবিধে হবে। আমাদের অবশ্য কিছু হয়নি। প্রত্যেকেই পাহাড় দেখার আনন্দে শরীরের কথা বোধ হয় ভুলে গেছিলাম।
কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজ থেকেই সোজা চলে গেলাম ডাওহিল পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। অনেকেরই প্রথম শোনাতেই একটা কথাই মনে আসে, এটা নাকি হন্টেড প্লেস, বিভিন্ন ভূতের আগমন এ জায়গায়। বিশেষ করে ডাওহিল স্কুল নাকি নানান রকম ভূতের আখড়া। স্কন্ধকাটা কেউ নাকি অন্ধকার পথে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক। এই ডাওহিল স্কুল কিন্তু যথেষ্ট পরিচিত এবং ভালো স্কুল। অনেক ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেলে থেকে স্কুলে পড়াশোনা করে। ডাওহিল রাস্তায় ঢুকতেই যেন মনে হল ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। রাস্তাটির মধ্যে দুদিকে ঘন বন। বৃষ্টি হওয়ার পর যখন বৃষ্টি থেমে যায় তখনও এই বৃষ্টি কিন্তু থামে না। ভুতুড়ে মনে হলেও আসলে গায়ে গায়ে লেগে থাকা পাইন গাছের থেকে ক্রমাগত বৃষ্টির জল ঝরতে থাকে। সত্যিই এ জায়গাটার মধ্যে কেমন একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। আমরা স্কুলের সামনে দাঁড়ালাম। বাইরে থেকেই সবাই দেখছি, হঠাৎ মনে হল যেন একটা ছোট স্কটল্যান্ডএর সামনে আমরা এসে পৌঁছেছি। রূপকথার দেশের স্কুল যেন এই স্কুলটি, দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
১৮৭৯ সালের প্রথমের দিকে তখনকার বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর একটা সরকারি স্কুল চালু করতে চেয়ে ছিলেন। সরকারি চাকুরেদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য যারা মূলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির, যারা পাহাড়ের এই স্কুলে তাদের বাচ্চাদেরকে পাঠাতে পারবে। ডাওহিল স্কুল তার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। পাহাড়ের উপর অবস্থিত হিমালয়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্কুল অপূর্ব সুন্দর নৈসর্গিক আবহাওয়ার পরিবেশ এর মধ্যে অবস্থিত। চারিদিকে নানান ধরনের সবুজ, ছোট ছোট ওয়াটারফল ছড়িয়ে থাকা আর লাইট এ্যন্ড শেডের খেলা এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। ছেলেমেয়েদের জন্য একটা পারফেক্ট পড়াশোনার জায়গা এমন হলে খুবই ভালো হয়। চিৎকার, কোলাহল থেকে দূরে এক নিভৃত নির্জন পড়াশোনার পরিবেশ। সাধারণভাবে বলতে গেলে এটা জানা যায় যে একটা ছোট্ট মিষ্টি পাখির নাম ডাও। লোকাল মানুষ এই নামেই পাখিটিকে চেনে। এখানকার খুবই কমন পাখি। এ পাখির নাম অনুসারেই আর পাহাড় পরিবেষ্টিত হওয়ায় এর নাম হল ডাউহিল। এটি একটি রেসিডেন্সিয়াল স্কুল।
সম্পূর্ণ কার্শিয়াংএর এই ডাওহিল জায়গাটায় যেন রহস্যাবৃত। শোনা যায় নানান রকম ভূতুড়ে কাহিনী। যদিও এদের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। এরকম শোনা গেছে যে ফরেস্ট অফিস থেকে যাওয়ার রাস্তাটা নাকি ভয়ঙ্কর রকমের। কেউ কেউ মুণ্ডহীন কিশোর বয়সী ছেলেকে দেখেছে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতে, বা কোনো লাল চোখের কাউকে তাকাতে দেখেছে চতুর্দিকে। অথবা ধূসর পোশাকে একজন মহিলা। কিছুদূর গেলেই ভিক্টোরিয়া স্কুল, ১০০ বছরের পুরনো। সেখানেও নাকি এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছে। যখন স্কুল বন্ধ থাকে তখন নাকি ফিসফাস, পায়ের শব্দ ইত্যাদি ঘটনা রোজ রোজ ঘটে থাকে।
এসমস্ত ভুতুড়ে কান্ড কারখানা সবই লোকমুখে শোনা। এগুলো কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এভাবেই হয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও মানুষ এখানে যাচ্ছে এবং আমরাও গেছিলাম এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে।
ডাওহিল ও তার আশেপাশের পাইন বনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম মকাইবাড়ি টি এস্টেট। ঘুরে দেখলাম কিভাবে দার্জিলিং চা তৈরি হচ্ছে যা আমাদের প্রতিদিনের এনার্জি বুস্টার। যে কটি সুগন্ধি চা জগদ্বিখ্যাত তার মধ্যে অন্যতম। অনেকগুলি চা বাগান রয়েছে চারিদিকে ছড়ানো ছেটানো। চায়ের কথা যখন উঠলো তখন কার্শিয়াং এর মার্গারেট’স ডেকে না গেলেই নয়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই ক্যাফেটেরিয়ার চারিদিকে অতল নিতোল খাদ। কনকনে শীতল হাওয়া কাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সারা শরীর। কিন্তু এই ঠান্ডা উপভোগ করার মধ্যেও এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে চারিদিকে, কোনো গল্প আড্ডা কিচ্ছু না, নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে হয় কখনো কখনো যে, এই পরিবেশটা ঠিক তেমন। অনেক টুরিস্ট এসেছেন। তারা যে যার মত সময় কাটাতে ব্যস্ত আমরা বাইরে হাওয়ায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ভেতরে কাঁচের ঘরে এসে ঢুকলাম। চারপাশে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবুজ পাহাড় বিভিন্ন রকম চায়ের জন্য সুখ্যাতি আছে এই ক্যাফেটেরিয়ার আমরা দুই ধরনের চা অর্ডার করলাম। সেবিকার সাহায্য নিয়ে সঙ্গে অ্যাপেল ওয়ালনাট কেক এবং আমার মেয়ের জন্য হট চকলেট আর ব্রাউনি দিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ভ করা হল। বলাই বাহুল্য প্রত্যেকটি জিনিস হাতে গরম করে দেওয়া এবং অতি সুস্বাদু। আমরা প্রত্যেকেই দু-তিন কাপ করে চা খেয়ে নিলাম।
প্রত্যেকটা পাহাড়ের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, কার্শিয়াংএরও আছে অবশ্যই। আমাদের মত যারা রাতে থাকার প্ল্যান না করে পাহাড়ে ঘুরতে যেতে চায় অথবা পাহাড়ের অনেক উঁচুতে না গিয়ে তবুও পাহাড়কে অনুভব করতে চায় তাদের জন্য কার্শিয়াং ইজ বেস্ট। শিলিগুড়িতে হল্ট করে সকালে বেরিয়ে সারাদিন ঘুরে ফিরে খেয়েদেয়ে আবার শিলিগুড়িতে ব্যাক করে চলে আসা যায়। অথবা কার্শিয়াংএও প্রচুর হোটেল রয়েছে, আশেপাশে হোমস্টে আছে। আবার এমনটাও হতে পারে কার্শিয়াংএ এক রাত থেকে পরদিন সকালে দার্জিলিংএর জন্য বেরিয়ে পড়া, পাহাড়ের ধকলও হল না যাদের পাহাড়ে সমস্যা আছে গাড়ি জার্নিতে। অসংখ্য ছোট ছোট হোটেল রয়েছে, তাদের ওয়েবসাইট আছে, সেখান থেকে হোটেল বুকিং করা যায়। একদিনের ডে আউটিং কার্শিয়াং আমাদের মনে থাকবে বহুদিন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন