travel-jibonto-itihaser-mukhomukhi

জীবন্ত ইতিহাসের মুখোমুখি
রাখী নাথ কর্মকার



এইমুহূর্তে আমাদের চারপাশে এক থমথমে যুদ্ধের আবহ। হৃৎপিন্ডের অলিন্দে অলিন্দে ঠিকরে ওঠা পিলে চমকানো গোলাগুলির আওয়াজ! দ্বীপান্তরের পলাতকা বিকেলের আলোয় যেন অন্য এক গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে। অবেলার ভারি বাতাসে দমবন্ধকরা বারুদের গন্ধ! এপ্রিলের তরুণ বসন্তের সুবাসও যার কাছে ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। মেপল, বার্চ, পপলারের নতুন পাতার সৌরভ ম্লান হয়ে গেছে যুদ্ধক্লান্ত আকাশের ধূসরতার কাছে। আলতাআঁচল আকাশের নিচে গোলাপী ফুলে উপচে পড়া ম্যাগনোলিয়ার ডালে একটা ব্লু জে পাখি, ব্যাটালিয়ন ড্রিলের আওয়াজে হঠাৎই ঘাবড়ে গিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকতে ডাকতে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল কোথায়!

বিস্মিত, ভীতসন্ত্রস্ত চোখে চেয়ে দেখি, সবুজ মাঠের এক কোণে ফায়ারিংএর আগে ক্যানন লোড করছে এক অনুগত সৈনিক! হালকা নীল প্যান্ট, ঘন নীল ওভারকোট। মাথায় তাঁর কেপি। কোমরে বেল্ট সেট। একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল … জনাকয় আহত সৈনিক তাঁবুর সামনে শুয়ে কাতরাচ্ছে, কেউ হয়ত কারোর বাবা, কিংবা ছেলে, হয়ত বা কাকা, ভাইপো কিংবা বন্ধু! আহা, একটা অদ্ভুত কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে উঠে এল আমার গলার কাছে! একটু দূরে দেখলাম ডাঁই করে রাখা চ্যালা কাঠের ঢিবির পাশে রিভারসাইড তাঁবুতে জেনারেলদের মিটিং চলছে। পাশেই প্যারাড গ্রাউন্ডে যুদ্ধের আগে…কর্নেল তাঁর ট্রুপকে অর্ডার দিচ্ছেন। দিগন্তবিস্তৃত পার্কের পশ্চিমপ্রান্তে কতগুলি ‘ডগ টেন্টে’র সামনে (শুনেছিলাম ইউনিয়ন সৈনিকরা মজা করে বলত – এমন ছোট্ট তাঁবুর মধ্যে কেবল একটি কুকুরই শুকনো অবস্থায় থাকতে পারে, সে কারণেই হয়ত এই নামকরণ!) ক্যাম্পফায়ারে বিশাল কেটলিতে জল ফুটছে। দূর থেকে ভেসে আসা চাপা আওয়াজে তাকিয়ে দেখলাম, স্বতন্ত্র পোশাকে কনফেডারেট আর্মির সেনা মার্চিংএ ব্যস্ত! শুনেছিলাম ইউনিয়ন সেনারা কনফেডারেটদের মজা করে ‘বাটারনাটস’ বলতেন, তাঁদের পোশাকের ঐ ‘ট্যান-গ্রে’ রঙের জন্যে! আমাদের সামনেই কাঠের টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে কয়েকজন সৈনিক। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল তাঁরা। কাঠের টেবিলে রাখা আছে তাঁদের ঠান্ডা রুটি আর মাংসের টুকরো, ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। আমাদের একটু চমকে দিয়ে হঠাৎই পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন চারপাঁচ জন জেনারেলের স্ত্রী, স্কার্টব্লাউজ পরিহিতা, হুপ স্কার্টের ঘেরে ঢেকে যাওয়া আতঙ্কের শীর্ণতা। মাথায় বনেট। পায়ে বাটন আপ জুতো। আর একটু এগিয়ে চোখে পড়ল এক মহিলা ভিভ্যান্ডিয়ের, ‘ব্যাটল ফিল্ড নার্স’কে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন – পরনে তাঁর ট্রাউজারের উপর হাঁটু দৈর্ঘ্যের স্কার্ট, টিউনিক, মাথায় টুপি। শুনেছিলাম সিভিল ওয়্যার ভিভ্যান্ডিয়েরদের কস্টিউম বিভিন্ন রেজিমেন্টে আলাদা হত, তবে সব পোশাকই হতে হত রেজিমেন্টের সঙ্গে থাকার, মার্চ করার পক্ষে উপযুক্ত। নার্সটি একমনে গৃহযুদ্ধের সময়কালীন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামগুলিকে একবিংশ শতাব্দীর ওষুধের সঙ্গে তুলনা করে দেখাচ্ছিলেন!

কী আশ্চর্য! কোন এক জাদুবলে যেন টাইম ট্রাভেল করে আমরা হঠাৎ এসে পৌঁছেছি উনবিংশ শতাব্দীর আমেরিকায়, গৃহযুদ্ধের সন্ধিক্ষণে! ব্যাটল অফ অ্যান্টিটাম! ইতিহাসের পাতা উল্টোলে দেখা যাবে, মেজর জেনারেল জর্জ ম্যাকক্লেলানের নেতৃত্বে আর্মি অফ দ্য পোটোম্যাক ১৮৬২ এর ১৭ই সেপ্টেম্বর, মেরিল্যান্ডের শার্পসবার্গে অ্যান্টিটাম ক্রিকের কাছে কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট ই লি’র বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক শক্তিশালী আক্রমণ চালিয়েছিল। কনফেডারেটরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়ার ফলে মেরিল্যান্ডে কনফেডারেটদের আক্রমণে সমাপ্তি ঘটেছিল, এটি ইউনিয়নের এক কৌশলগত জয় হিসাবেই ঘোষিত হয়েছিল। অ্যান্টিটামের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত এক দিনের লড়াই যার প্রায় ১২ ঘন্টার মধ্যে তেইশহাজারেরও বেশি হতাহতের (নিহত, আহত বা নিখোঁজ হিসাবে তালিকাভুক্ত পুরুষ) খবর পাওয়া গিয়েছিল।

ইতিমধ্যেই, ছেঁড়া ছেঁড়া শোণিতাভ মেঘে সন্ধের অন্ধকার জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আলো নিভে আসা জঙ্গলে সৈন্যেরা সব একে একে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। পড়ে আছে স্টেজে বিগত যুদ্ধের বিধ্বংসী স্মৃতি! কোন এক নিশাচর পাখি তার তীক্ষ্ণ, তীব্র চিৎকারে নাগরিক সভ্যতার অনিত্যতাকে চিরে খান খান করে দিয়ে যেন উড়ে গেল জঙ্গলের গভীরে! পাশের পার্কিং লট থেকে দেখি একটা একটা করে গাড়ি ঘড়ঘড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে বাড়িমুখো রওনা দিচ্ছে। হঠাৎই সেই শব্দে সচকিত হয়ে যেন বাস্তবে ফিরে আসি আমরা! হ্যাঁ, এইমুহূর্তে আমরা পেনসিলভ্যানিয়ার বেনসালেমে, নেশামিনি স্টেট পার্কে! অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যের সম্ভার নিয়ে প্রায় ৩৩০ একর বিস্তৃত পার্কটি নেশামিনি ক্রিক এবং ডেলাওয়্যার নদীর সঙ্গমে অবস্থিত। প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহান্তে (শনি, রবি) এখানে বার্ষিক ‘সিভিল ওয়্যার রিএন্যাক্টমেন্ট’ অনুষ্ঠিত হয়, এবছর ২৮তম পুনঃনির্মাণ! আমেরিকার পূর্ব উপকূলে গেটিসবার্গের পরেই ‘লার্জেস্ট সিভিল ওয়্যার রিএন্যাক্টমেন্ট’এর জন্যে বিখ্যাত এই নেশামিনি পার্ক! প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গায় গৃহযুদ্ধের পুনঃনির্মাণে অংশ নেন। নেশামিনি স্টেট পার্কের এই ইভেন্টটির পৃষ্ঠপোষক বেশ কিছু সংস্থা: পার্ক্স ক্যাসিনো; বেনসালেম হিস্টোরিকাল সোসাইটি; ২৮তম পেনসিলভেনিয়া হিস্টোরিকাল অ্যাসোশিয়েশন; ফার্স্ট ব্যাটালিয়ন অফ দ্য আর্মি অফ নর্দার্ন ভার্জিনিয়া; ডেলাওয়্যার ভ্যালি সিভিল ওয়্যার রাউন্ডটেবল…ইত্যাদি!

পার্কের এককোণে দেখি ‘নেশামিনি রিএন্যাক্টমেন্ট ইভেন্ট কমিটি’র চেয়ারম্যান মি.গিলসন ভিজিটরদের বলছেন, কীভাবে প্রতি গ্রীষ্মে একটি উপকমিটি রিএন্যাক্টমেন্টের জন্য যুদ্ধ নির্বাচন করে। সেপ্টেম্বরে সেটি প্রধান কমিটির অনুমোদন পায়। এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মানদণ্ড মেনে চলতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই রিএন্যাক্টমেন্টে ফিলাডেলফিয়া এবং আশেপাশের অঞ্চলের লোকাল ট্রুপদের জড়িত থাকতে হয়। ইভেন্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে – ব্যাটল রিএন্যাক্টমেন্ট, ক্যাম্প লাইফ দৃশ্য, মিলিটারি ও সিভিল লাইফ প্রদর্শন। তবে যুদ্ধটিকে অবশ্যই হতে হবে সময়োপযোগী। যুদ্ধকৌশল, ইউনিফর্ম, অস্ত্র, অনুষ্ঠান সমস্তই নির্বাচিত যুদ্ধের জন্য বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। প্রতিটি পুনঃনির্মাণের জন্যে গভীর গবেষণা এবং প্রস্তুতিরও প্রয়োজন! এইসব রিএন্যাক্টরদের সঙ্গে দর্শকদের পরিচিত হওয়ার সুযোগও থাকে, যেমন সাটলার এরিয়াতে (যারা সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, রসদ সরবরাহ বা বিক্রি করে এবং সেই ইউনিটের সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়) বিভিন্ন ঘরে বানানো খাবার যেমন ‘সার্সাপরিলা’, ইউনিফর্ম, ফটোগ্রাফ, টুপি, পিরিয়ড পোশাক থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধের পোশাক …এসব কেনারও সুযোগ রয়েছে!

শোনা যায়, ‘ব্যাটল রিএন্যাক্টমেন্ট’এর ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রোমানরা তাঁদের অ্যাম্পিথিয়েটারে বিভিন্ন বিখ্যাত যুদ্ধের পুনঃনির্মাণ করতেন। মধ্যযুগীয় ইউরোপ এবং সপ্তাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডেও যা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শুধুমাত্র বিনোদন নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রিয়জনদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্যে ‘শাম ব্যাটলের’,‘মক ব্যাটলে’র মাধ্যমে পরিবেশিত হত এই ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট। আমেরিকায় সিভিল ওয়্যারের সময়েও এই ধরনের রিএন্যাক্টমেন্ট প্রচলিত ছিল, এর মাধ্যমে গৃহযুদ্ধের ভেটেরানরা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত কমরেডদের স্মরণ করতেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরতেন। তবে আমেরিকায় আধুনিক রিএন্যাক্টমেন্টের সূচনা হয় ১৯৬১ সাল থেকে, সে বছর প্রথম সবচেয়ে বড় রিএন্যাক্টমেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিউ জর্জিয়ার এনসাইক্লোপিডিয়া রেকর্ড অনুসারে, গৃহযুদ্ধের পুনঃনির্মাণ আসলে আমেরিকান সেনাদের ফাঁকা গোলাবারুদ নিয়ে লড়াই করা ‘শাম ব্যাটলের’ সুপ্রাচীন ঐতিহ্যেরই অঙ্গ। সেই ‘প্র্যাক্টিস ব্যাটল’ই আজকের ‘সিভিল ওয়্যার রিএন্যাক্টমেন্ট’ ঐতিহ্যের পূর্বসূরী!

রাত আদরের পরাগ মেখে বাড়ি ফেরার সময় দেখি, কুড়িয়ে আনা অতীতটুকু অকাতরে বাষ্প হয়ে মিশে যেতে শুরু করেছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! পৃথিবীর বিস্তীর্ণ স্টেজে এইমুহূর্তে অতীত, বর্তমান সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *