মেঘনা রায়
হিমালয়ে আমি আমার ঈশ্বরকে খুঁজি। মানুষের রেখে যাওয়া কাহিনি খুঁজি। তাই শরীরকে কষ্ট দিয়ে, আরাম স্বাচ্ছন্দ্যকে সাময়িক বনবাসে পাঠিয়ে, নিজের বাচ্চা মেয়েকে পাহাড়ের মানে বুঝে ওঠার আগেই ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দিয়েছিলাম। হিমালয়ান পৌরুষের প্রতি সুতীব্র টান আর চওড়া ফেমিনিন নদীর প্রেমময় সিকোয়েন্সের খোঁজে প্রতিটা পাহাড় আমার কাছে নিখাদ এক এ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি। আজ আমি যে ট্রেকিং বৃত্তান্তের ঘুঁটি সাজাতে বসেছি আজকের দিনে জলভাত হয়ে গেলেও ২০০৫ সালের পরিপ্রেক্ষিতে তা একেবারেই সুখকর ছিল না। মদমহেশ্বর, বুড়া মদমহেশ্বর নিয়ে ছিল আমার উত্তরমুখী অভিযান।
১৬ দিনের ট্রিপের লাগেজাদি সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে অষ্টমীর দুপুরে বেরিয়ে পড়েছিলাম শিয়ালদা রাজধানী ধরতে। পরদিন নির্ধারিত সময়ে দিল্লি পৌঁছে বিকেলে জনশতাব্দী ধরার জন্য স্টেশনে জিরিয়ে নিলাম। ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে জনশতাব্দী এলো।
পরদিন সকালে আমরা হরিদ্বার থেকে ১৭৯ কিমি রাস্তা পাড়ি দিতে উখিমঠের উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। উখিমঠ পৌঁছে ভালো অপশন না পেয়ে ভারত সেবাশ্রমে উঠলাম। শেষ অক্টোবরের শীত আগ্রাসী থাবা বসাতে শুরু করেছে তখন। উখিমঠের ঐতিহ্যপূর্ণ গুরুত্ব হল শীতকালে দীপাবলীর পরে মদমহেশ্বরের শিব ডোলিযাত্রা করে উখিমঠের মন্দিরে এসে পূজিত হন। আবার অক্ষয় তৃতীয়ার পর স্বগৃহে ফিরে যান। উখিমঠ থেকে আমরা যাবতীয় রেশন, কেরোসিন জোগাড় করে দুটি জিপ নিয়ে ১৪ কিমি দূরে রাওলেঙ্খের দিকে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে যোগাসুতে আমাদের গাইড পোর্টার,৫ টি তাগড়াই ঘোড়া নিয়ে মিট করলো। তিনটি ঘোড়াতে আমাদের স্যাক এবং রেশন ইত্যাদি লোড করা হলে আমরা গাড়ি নিয়ে রাওলেঙ্খ চলে এলাম। খালি ২টি ঘোড়ায় মিকি ও মুমাই চেপে বসলো। বেলা বারোটা নাগাদ বহুদিনের কাঙ্খিত পথে যাত্রা শুরু করলাম। আজ ৬ কিমি দূরে রাশি গ্রামে হল্ট করবো। পাহাড়ি মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করেছি। ২০০৩ সালে পিন্ডারী গ্লেসিয়ার দিয়ে ট্রেকিং এর হাতে খড়ি। সেই অর্থে এটা দ্বিতীয় ট্রেক তাই একটু অভিজ্ঞ। মধুগঙ্গা নদীকে ডান হাতে রেখে ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করতে পাগল করা জঙ্গুলে গন্ধে শ্বাসবায়ু ভরে গেল। কতদিন হাঁটি না এমন মায়াবী পথে,বৃষ্টিতে ভিজি না, কেমন শহুরে মরচে ধরেছে মনে। আলগোছে শহুরে মনকে দূরে সরিয়ে রাখি।
পাহাড়ের রঙিন ঘরবাড়ি যেন ছোটবেলার ড্রইংখাতা হয়ে উঠেছে। বর্ষার পর পাহাড়ি ঝর্ণা প্রবল বেগবতী হয়ে পথ অবরোধ করলো। পোর্টাররা বড় পাথর ফেলে রাস্তা করে দিল কিন্তু ওপাশের মাটি প্রচন্ড ভঙ্গুর। একজন সঙ্গী ‘জয়ন্তী রক ক্লাইম্বিং কোর্স’ করেছে জানায়। কিন্তু বাহাদুরি দেখাতে হুড়মুড় করে প্রথমে গিয়েই ওপাশের দেয়ালে কোনোমতে আটকে গেল। কিঞ্চিৎ বেচাল হলে সোজা নদীগর্ভে। পোর্টাররা অতি দক্ষতায় তাকে উদ্ধার করে একটা পাথরে বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা ভীত। প্রত্যেকে কসরৎ করে বোল্ডারে পা রেখে ক্রস করলাম। মেয়ের কথা মনে পড়ায় ব্যাকুল হয়ে এপারে এসে দেখি একগাল হাসি মুখে মিকি ঘোড়ায় বসে। ঘোড়াওয়ালাকে চোস্ত হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলাম কোনো অবস্থাতেই যেন মেয়েদের ছেড়ে না যায়। পথ ভালো চড়াই। দিনের আলোয় রাশি গ্রামে পৌঁছাতে হবে। ছায়া সুনিবিড় জঙ্গলের পথে মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে এগোচ্ছি। ডানদিকে মধুগঙ্গা নদী খেয়ালি বাঁকে পথ খুঁজেছে। বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ আমরা আটপৌরে গ্রাম রাশিতে পৌঁছালাম।
ছোট্ট পাকা দোতলা বাড়ি হলো সেদিনের ঠিকানা। ঘর দুটো এত্তো ছোট যে, মাল ঢোকানো গেল না। বাইরেই রাখতে হল। ঘর জুড়ে বড় চৌকি পাতা। দরজা থেকে লম্ফ দিয়ে উঠতে হবে। যদি বৃষ্টি আসে তবেই কেলো।
বিকেলের চা শেষ করে রাশি মন্দিরের দিকে এগোলাম। শ্লেট পাথরের তৈরী কেমন একটা অগোছালো ভেজা ভাব মনকে শান্ত করে দিল। মন্দিরে বেশ কিছু পাহাড়ি শিশুর সঙ্গে আমাদের কন্যারাও মিশে গেল। ন্যাপস্যাক ঘেটে যত লজেন্স, টফি পাওয়া গেল মিকি আর মুমাই ওদের হাতে তুলে দিতে অনাবিল হাসিতে বাচ্চাগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
কোনো রকমে রাত কাটিয়ে ভোর পাঁচটায় উঠে সবাই তৈরি হয়ে রওনা দিলাম। পরদিন আমরা গোন্ডার এবং বানতোলি হয়ে ১৩ কিমি পথ হেঁটে নানু গ্রামে আশ্রয় নেব। শুরু করেছি পথ চলা। কিছুটা চড়াই পেরিয়ে হাল্কা উৎরাই দমের কষ্ট লাঘব করল। ঘন পাইনের বন শুরু হতেই সব কেমন পাল্টে গেল। কিছুক্ষণ পর এলো রূপসী ভীমসী ফলস। তার পাশে বসে আমরা মুড়ি মাখা আর ফল দিয়ে প্রাতরাশ সারলাম। ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী গমনের পর এক বাঁকের মাঝে পাইনের সারি ভেদ করে চৌখাম্বা উঁকি দিয়েই লুকিয়ে গেল। পাইনের ল্যান্ডস্কেপে বেতাজ বাদশার মতো উন্মোচিত হচ্ছে হিমালয়। এতো বিশাল মহিমাময় তার আবেদন চোখ ভারি হয়ে আসে। বারোটায় গোন্ডার গ্রামে পৌঁছে এক চট্টিতে সবার জন্য লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া হল। হেল্পার বেচারা তখন সবে এক ধামা আলু ছাড়াতে বসেছে। মালকিন এসে ঝটপট রামদানার রুটি আর তরকারি বানিয়ে দিলো।
গোন্ডারের পর থেকে দমফাটা চড়াই। একঘন্টা পর পথে পড়ল বানতোলি। যা মধুগঙ্গা আর সরস্বতী নদীর সঙ্গম। ভারি মিষ্টি জায়গা। নদী প্রচন্ড শব্দে নিশ্চুপ পাহাড়ি দুপুরকে খান খান করে বয়ে চলেছে। এই সেই বানতোলি, যেখানকার হিমালয়কে ভালোবেসে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পথক্লান্ত পথিকের জন্য একটি ঘর বানিয়েছিলেন। পাকা হলুদরঙা রামদানার ক্ষেত নদীর পাদদেশ থেকে পাহাড়ের গায়ে নক্সা এঁকেছে। মাঝেমধ্যে রঙিন ঘরবাড়ি যেন ঝুলনের সাজে পূর্ণ। সূর্য মধ্য গগনে। পা চালিয়ে নানু গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। ১৩ কিমি রাস্তা পার করে নানুতে ঢুকলাম বিকেলে। পাহাড়ের সানুদেশে দাঁড়িয়ে থাকা মাটির দোতলা বাড়িটি কতকটা যেন ওয়াচ- টাওয়ারের মতো। চতুর্দিক থেকে জঙ্গলময় হিমালয়ের অখ্যাত শৃঙ্গরাজি ঘিরে রেখেছে। বাড়ির মধ্যে কোনো ল্যাটরিন নেই। জলের অভাব। মেঠো পথের উল্টোদিকে টিন দেওয়া ছোট্ট ল্যাটরিন। রাতে একা বেরোনো বেশ চাপের। ডিনার করলাম লক্ষতারা খচিত আকাশের নীচে। জঙ্গল থেকে রকমারি রাত চরার ডাক কানে এল। সে এক দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। জানলাম ঐ জঙ্গলে ভাল্লুকেরও বসবাস আছে।
অর্ধ জাগরিত অবস্থায় রাত কাটিয়ে ভোরে রওনা দিলাম সোজা মদমহেশ্বরের উদ্দ্যেশ্যে। যা আরো কষ্টকর যাত্রা বাচ্চাদের জন্য। ঘোড়াওয়ালাকে বললাম, মেয়েকে সাপোর্ট দিয়ে বেঁধে দিতে যাতে ঘুমিয়ে পড়লেও পড়ে না যায়।
নানু থেকে পাকদণ্ডীর প্যাচ ধরে ট্রিলাইনের ওপরে চলে এলাম। বৃক্ষহীন ব্যাপক চড়াই পথ পরীক্ষা নিতে শুরু করেছে। একাগ্র মনে হেঁটে চলেছি ৬ কিমি রাস্তা, মনে হচ্ছে ফুরাবে না। অবশেষে শেষ চড়াই অতিক্রম করে মদমহেশ্বর মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। উচ্চতা ১১৭৪৫ ফিট। প্রচন্ড ঠান্ডা শনশনে হাওয়া পাঠিয়ে কাছে ডাকছে আমাদের। ব্যাকড্রপে একদিকে কেদারশৃঙ্গ অন্যদিকে অনন্য চৌখাম্বা দেখে বিস্মিত নির্বাক। দুহাত জড়ো করে মগ্ন হয়ে দেখলাম শৃঙ্গের ঝলসানো রূপ।
মন্দিরের গঠনশৈলী কেদারনাথের আদলে হলেও এই দেবস্থান নিতান্তই নিভৃতচারী। উপচে পড়া ভিড়, মন্দির ঘিরে উন্মাদনা, কৌশলী লাইনের মহড়া থেকে এই কেদার একেবারে ভিন্ন। আমরা মন্দির চত্বরে কাঠের তৈরী ধর্মশালায় উঠলাম। পরপর ঘর এবং মন্দিরমুখী বারান্দা, দুটি বাথরুম। বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেস হয়ে চাউল ডাল সব্জি ও শেষ পাতে আচার দিয়ে লাঞ্চ সেরে এবার একটু একা হয়ে ভ্যালির নিঃসঙ্গ বৃক্ষের তলায় শুয়ে পড়লাম। কুয়াশা ছাড়িয়ে আলতো মেঘের ছোপ লেপ্টে আছে। এই শ্বেত শুভ্রবলয়ে আমি হিমালয়কে দেখতে চাই গাছ গাছালির ফাঁকে, প্রথম সূর্যের আলোয় দিনের শেষে ক্লান্ত পথিকের বেশে অবচেতনে আমার কবিতাতে।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঘরে এসে জ্যাকেট চাপালাম। জুতো গলিয়ে গোধূলি লগ্নে বাইরে এসে দেখি প্রতিটা পাহাড়ে আগুণরঙা মানচিত্র। সূর্য পাটে গেলেও রেখে গেছে শেষ কিরণের কারিশমা। সামনে কোজাগরী পূর্ণিমা। তাই চাঁদের বিকিরণ বড় তীব্র। মনে হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কিণারায় আমরা গুটিকয়েক মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে স্থবির। আসন্ন রাত রহস্যময় অবগুণ্ঠিতা। মনে প্রকৃতির যে রূপরেখা আঁকা হল তা সারা জীবনের প্রাপ্তি। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শুরু হতে সম্বিত ফিরে পেয়ে আরতি দেখতে ছুটলাম।
পরদিন সকালে সাজো সাজো রব। আজ আমরা ২ কিমি হেঁটে বুড়া মদমহেশ্বর যাব। উচ্চতা ১৪,০০০ ফিট। এ পথে ঘোড়া যায় না। মেয়ের কাছে জানতে চাইলাম, “পারবি তো মিকি বুড়ি?” কি বুঝে মাথা কাত করলো। গাইড বলল “হাম ছোটি লেড়কী কো কান্ধেপে লে যায়েঙ্গে।” আপাতদৃষ্টিতে পথ দেখে মনে হলো এতটা রাস্তা এসেছি এটা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম আসলে বুড়া মদমহেশ্বরে যাবার নির্দিষ্ট রাস্তা নেই। যা ছিল তা ভেঙে একেবারে ঘোট পাকানো। তাই গাইড না থাকলে সমূহ বিপদ। আমরা ডানদিকের যে রিজ ধরে হাঁটছি তার মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে চৌখাম্বা ক্রমশ বৃহৎ হতে লাগলো। এ এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। একবারে শেষ দিকে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পাহাড় বাইতে হচ্ছে। প্রতিপদে বুঝতে পারছি অক্সিজেন খুব কম, তখন বাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছি। মেয়ে ততক্ষণে গাইডের কাঁধে। অবশেষে ভ্যালিতে পৌঁছে একেবারে স্বর্গীয় ঠিকানা। ডানদিকে হাতের নাগালে চৌখাম্বা মনে হচ্ছে ধরতে পারবো। এত কাছ থেকে চৌখাম্বা গাড়োয়ালের আর কোথাও থেকে দেখা যায় না। ১৪,০০০ ফিটে বৃষ্টির জলে তৈরি তিনটে ন্যাচারাল তাল আছে। সেই তালের জলে চৌখাম্বার প্রতিফলন মস্তিষ্ক মনের কোথায় যে গেঁথে গেল, সারা জীবনে ভুলবো না। কালো শ্লেট পাথরের তৈরী ছোট এক শিব মন্দির রয়েছে যা হয়তো মেষ পালকেরা তৈরি করেছে। খেজুর, কিসমিস দিয়ে পুজো দিলাম। কথিত আছে মদমহেশ্বরে এসে যদি বুড়া মদমহেশ্বরে না যাওয়া হয় তবে বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না। অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম। আস্তে আস্তে সূর্য প্রখর হতে শুরু করলে প্রণাম করে নামতে শুরু করি। একসময় পৌঁছেও যাই। ফিরে এসে মদমহেশ্বর মন্দিরে পুজোর আয়োজন করি। এই মন্দিরে মহাদেবের নাভি পাওয়া যায়। বাড়ি থেকে আনা নারকেল দিয়ে পুজো সেরে, সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করি। অপার শান্তিতে মন ভরে যায়।
দুপুরে মধ্যান্ন ভোজন সেরে তল্পিতল্পা গুছিয়ে মদমহেশ্বরকে বিদায় জানিয়ে ভারাক্রান্ত মনে নামতে শুরু করলাম। সমস্ত আকাশ বাতাস বৃক্ষ রাজিকে সাক্ষী রেখে ফিরে যাচ্ছি। আজকে যতটা সম্ভব নীচে নেমে যাব পুরো টিম। সমস্যা হল কোনো বুকিং নেই, ফলে গোন্ডারে গিয়ে কোথায় রাত কাটাবো তার নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই।
ঘোড়ার টিম আগে চলে গেল। পেছনে আমরা। চেনা জায়গাগুলো পার হচ্ছি, এ পথে আর জীবনে আসবো না। তাই গভীর বিষন্নতা ছুঁয়ে আছে। নামার সময় উৎরাই হওয়ায় অনেক সময় পা কন্ট্রোলে থাকছে না। আর্টিফিশিয়াল লিগামেন্ট লাগানো আমার ডান হাঁটু বিট্রে শুরু করল। হাতের স্টিক নিয়ে ব্যালেন্স রাখছি। একটা সময় মালুম হল সামনের দল বেশ আগে আর পেছনের দল অনেক পেছনে। ক্রমশ বিকেল হয়ে আসছে! একটা পাথরে বসে পড়লাম। মাথায় চিন্তা শুরু হয়েছে বাচ্চাগুলো ঘোড়াওলাদের কাছে। আমরা দেরি করলে ঠান্ডায় ওদের খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ঘড়িতে পাঁচটা, সাতটা পর্যন্ত হাঁটলে গোন্ডারে পৌঁছাতেও পারি। দুপুর একটা থেকে পাঁচ ঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে। বিপুল উৎসাহে শুরু করলাম পথচলা। এর পরে স্পিডে পা চালিয়েও তেমন সুবিধা করতে পারলাম না। সূর্য সেদিনের মতো ছুটি নিয়ে আকাশে রক্তকরবী ছড়িয়ে গেছে। শিরশিরে অন্ধকার নেমে আসছে শ্বাপদের মতো। ধূলো উড়িয়ে স্নিকারে ঠোক্কর খেতে খেতে গোন্ডারে পৌঁছোলাম সাতটার পর। টর্চের আলোয় নাম ধরে ডেকে মেয়েকে আর ঘোড়াওয়ালাদের পেলাম এক জায়গায়। পোর্টাররা ঘর খুঁজতে গেছে। একজন পোর্টার খবর দিলো ট্রেকারের গ্রুপ আসায় গোন্ডার একদম ভর্তি। হে ভগবান কী হবে! আমরা সেই লজে গেলাম যেখানে যাওয়ার সময় লাঞ্চ করেছিলাম। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে নীচে ওদের ঘরে গিয়ে চড়াও হলাম। অনেক রিকোয়েস্ট করায় ওরা একটা ঘর দেখাতে নিয়ে গেল অনেক নীচে সুরঙ্গে নামার মতো জায়গায়। আস্তাবলের ওপর একটা গুদাম ঘর। চৌকিতে দাঁড়ালে সিলিং-এ মাথা ঠেকবে। চৌকির তলার আবার আলু পেঁয়াজ রাখা। যাইহোক সবাইকে আসতে বললাম। পিছনেই প্রচন্ড শব্দে বয়ে যাচ্ছে বিরামহীন জলধারা। আকাশ কাচের মতো স্বচ্ছ। রূপোলী চাঁদ প্রকৃতিতে প্রহেলিকার মতো কুয়াশার জাল বুনে অনেক নীচে নেমে এসেছে। আমরা বিস্মিত হয়ে গেলাম এমন দৃশ্য দেখে। প্রায় সতেরো কিমি পথ হেঁটে এসেছি, সেইসব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিল ঐ মায়াবী দৃশ্য।
পরদিন নতুন ভোর। নতুন উদ্যম। ভোরের চাঁদ পিছু ছাড়েনি তখনও। সকালের প্রাতরাশ পর্ব মিটিয়ে হাঁটা শুরু করেছি রাওলেঙ্খের দিকে। মদমহেশ্বরের মেঠো পাকদণ্ডীর পথে সেদিন আমাদের শেষ হাঁটা। রাজকীয় পাহাড়, অকৃপণ প্রকৃতি, মেঠো পথ, সরল পাহাড়িয়া তোমরা সবাই ভালো থেকো বলে নামতে থাকলাম। নামতেই থাকলাম…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন