Travel – Jatro Boye Kura Nodi

যত্র বয় কুরা নদী

(শাহাব আহমেদ)

বাকুতে ট্রেনে চড়ে বসি । চারজনের কুপে কিন্তু আমরা দুজন। ট্রেন চলছে আর বাইরের পৃথিবী পপলার গাছের তুলার মত উড়ে-ঘুরে যাচ্ছে পেছনে। গাছ-পালা, বন, নদী, মাঠ, ঘর সবার যেন পাখা গজিয়েছে। এবং সেই পাখায় ক্লান্তির ধীর ঝাপটায় নেমে আসে আঁধার, দূরের মাঠ থেকে কাছে, তারপরে ট্রেনের জানলা দিয়ে এসে বসে আমাদের পাশে। আমার মাথার তালুর পেছনের যেখানটাতে চুলহীন মসৃন, সেখানে হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ সন্ধ্যা প্রশ্ন করে, ‘কেমন আছো ?’
‘কেমন যে আছি কিভাবে বলি, ভালোই তো।’
প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি অভিযোগের জীবন। কত অভিযোগ করি, জীবনকে সুন্দর হতে শাসাই, নেপথ্যের খল-নায়িকাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে দেই, কিন্তু জীবন সুন্দর হয় না।মাকড়শার মত ঘনিয়ে আসা অন্ধকার ছড়া কেটে বলে:
‘বিজ্ঞেরা বর্জ্য-মতি
জীবন কদর্য অতি’
আমি প্রতি পদে পদে টের পাই। জীবন সুন্দর, কিন্তু কদর্যতার কালি মাখা ‘কৃষ্ণকলি’ সৌন্দর্য তার।
বিজ্ঞেরা তর্ক করার জন্যই বাঁচে, তাদের কলম চোখ ফুটো করে দেবার প্যান্থার নখর, দাঁত ভেঙে দেবার মৃন্ময় মুগুর। তারা আদার ব্যাপারি না ‘কাদার’ বেনিয়া বোঝা মুশকিল।

পাশে বসে প্রেমময়ী নারী কুশি কাঁটায় কিছু বুনছে স্থির ও শান্ত মুখে। তার দুই হাতের আঙুলের এনসেম্বলে যেন নাচছে বিশ্ব মহাবিশ্বের মায়ার ইন্দ্রজাল, তার দিকে তর্জনি দেখিয়ে বলি, ‘ওই যে দেখ শান্তি। তার নিবিষ্ট স্থির দুটো চোখে যে আলো সেই আলোতে আমি হাঁটি, আমার ঘর শীতে উষ্ণ, গ্রীষ্মে শীতল।’
বলতে বলতে আমার চোখে তন্দ্রা নেমে আসে। ট্রেনের চাকার তুক তুক, ধুক ধুক, অন্য কুপে থেকে ভেসে আসা কোন শিশুর কান্না, অন্যত্র কোন যুবতির হাসির কোমল টেম্বর ইত্যাদির হিপনোগগিক (hypnagogic) হ্যালুসিনেশনে দুলতে থাকি।
কিন্তু গতির রাত দীর্ঘায়িত হয় না।
ডকুমেন্ট চেক করার জন্য খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগায় আজারবাইজানের বর্ডার গার্ড। তারপরে আসে জর্জিয়ার ওরা। দুই তরফা নিরাপত্তা নিবন্ধন শেষ করতে করতে আঁধার উবে গিয়ে আলো খেলা করে।বাকুর চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যের পরে জানালার বাইরের জগতটাকে বেশ দরিদ্র মনে হয়। পাশের অব্যবহৃত রেল লাইনে জং ধরা বগি, ছোট ছোট আস্তর খসা বিল্ডিং, ঘর-বাড়ি, ঝোপ-ঝাড়, নদী, হলুদ ঘাসফুল, দৃষ্টিকটু দেয়াল লিখন ইত্যাদি অতিক্রম করে আমরা তিবিলিসি পৌঁছি। তিবিলিসি জর্জিয়ার রাজধানি।

জর্জিয়া প্রাচীন দেশ। খুব ছোট্ট পাহাড়ি দেশ। জর্জিয়ানরা হাসি খুশি আড্ডাবাজ। ফুর্তি তাদের জীবনের ওতপ্রোত অংশ। কথিত আছে, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করার পরে বিভিন্ন জাতিকে ডেকে পাঠান এবং প্রত্যেক জাতিকে একটুকরো করে জমি বন্টন করে দেন। সেই বন্টন অনুষ্ঠানে যাবার পথে সুন্দর একটি ছায়া সুনিবিড় স্থান দেখে, জর্জিয়ানরা বলে, দেখ দেখ কী সুন্দর স্থান, আসো আমরা একটা “বারান”* জবাই করে একটু নাচ গান করি। কেউ “বারান” ধরে আনে, কেউ আগুন জ্বেলে “শাসলিক”** বানায়, কেউ মদ ঢালে। খাওয়া-দাওয়া সেরে নাচে গানে মত্ত হয়ে তারা ঈশ্বরের বদান্যতার প্রশংসা করতে করতে তারই ডাকা অনুষ্ঠানে যেতে দেরি করে ফেলে। গিয়ে দেখে সবশেষ,সবাই যার যার মত জমি নিয়ে চলে গেছে। ঈশ্বর ব্রুম হাতে অনুষ্ঠান শেষের আবর্জনা পরিস্কার করছেন। প্রশ্ন করেন, “তোমরা কারা?” “আমরা গ্রুজিন।” “এমন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, দেরি করেছ কেন ?” “আসার পথে আমরা এত সুন্দর একটি স্থান দেখি যে, বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা-উৎসব করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেছে।” ঈশ্বর দেখেন আরে বাহ্ ! এমন ফুর্তিবাজ একটা জাতি সৃষ্টি তিনি করেছেন মনেও ছিল না। এরা ফুর্তি করতে গিয়ে সব হারাতেও রাজি। বলেন, “জমি তো আর নেই। সব দিয়ে দিয়েছি। রাশিয়ানরা এসেছিল সব শেষে, সবাইকে বিলিয়ে দেয়ার পরেও বেশ কিছু জমি ছিল হাতে। এত জমি দিয়ে আমি কী করবো, সব ওদের দিয়ে দিয়েছি।” “ঈশ্বর তাহলে আমরা যাবো কোথায় ? আমরা নাচবো কোথায় ? আর গান গাইবো কার জমিতে দাঁড়িয়ে ?” ঈশ্বর দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে মাথা চুলকান, শেষে বলেন, “আচ্ছা, আমি নিজের জন্য এক টুকরো জমি রেখেছিলাম। সামান্যের সামান্য, তোমাদের সেটুকুই দিয়ে দিচ্ছি।” তিনি নিজের জমিটুকু গ্রুজিনদের দিয়ে দেন। ফলে পৃথিবীতে তার থাকার কোন জায়গা থাকে না, তিনি আকাশে চলে যান। গ্রুজিনরা যদি সেদিন একা আনন্দ ফুর্তি না করে, সময়মত ঈশ্বরের দহলিজে আসতো, তবে ঈশ্বরকে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হতো না, পৃথিবীর বখাটে বদি ও বদমাশরা নিয়ন্ত্রণে থাকতো এবং আমরা সবাই আনন্দ ফুর্তি করে জীবন কাটাতে পারতাম। যাই হোক, এই হল সেই দেশ। আঙুরের চাষ এবং আঙুর থেকে “ভিনো” বা “দ্রাক্ষামোহন” তৈরির শিল্প তারা আবিস্কার করেছে কমপক্ষে ৮ হাজার বছর আছে। তারও বহু হাজার বছর আগে শিখেছিল “ধাতববিদ্যা” বা “মেটালের ব্যবহার” ও উন্নত কৃষিকাজ। সমৃদ্ধির সীমা পরিসীমা ছিল না। তাই শত্রু এসেছে বার বার এই দেশে। রক্তের জোয়ার বয়েছে কুরা নদী দিয়ে। ওরা জানতো যে জর্জিয়ার প্রাচুর্য তার জমি, তার মানুষ, তার ‘ভিনোগ্রাদনায়া লাজা’, তার গাম্ভীর্যের গির্জা সমূহ। ‘ভিনোগ্রাদ’ হল আঙুর, আর ‘ভিনোগ্রাদনায়া লাজা’ ঘন সবুজ পাতার আড়ালে সেই আঙুর লতার একে অন্যের সাথে জড়ানো পেঁচানো ভালোবাসা, প্রেম, মাখামাখি, চুম্বন ও উন্মন মনের রসায়ন। হ্যাঁ রসায়ন। ‘ভিনোগ্রাদনায়া লাজা’ জীবন্ত সত্তা, জর্জিয়ার জীয়ন কাঠি।ভিনো থেকে তৈরী যে সুরা, যাকে আমরা ‘মদ’ বলে অপমান করি, তা হল ‘ভিনো।’ পরদেশি আগ্রাসীরা জানতো যে, এই দেশ দখল করতে হলে, পদানত করতে হলে ‘ভিনোগ্রাদনায়া লাজা’ ধ্বংস করতে হবে। করতোও তাই। তারা মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হতো না, ‘মা জর্জিয়ার’ অন্তর-গহীনের যেখান থেকে আঙুর লতার উন্মেষ হতো, ঠিক সেখানে কোপ মারতো ওরা। ঝরতো আঙুরের লাল রক্ত আর লাল অশ্রু। তাই আক্রান্ত হয়ে পাহাড়ে পালিয়ে যাবার আগে মানুষ সাথে নিত তাদের শিশুসন্তান আর কিছু আঙুর লতা। লুন্ঠনকারীরা যখন তাদের অদৈব নৃত্য সমাপন করে, পিছনে মৃতের স্তুপ, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর, আত্মশ্লাঘার ধর্ষণগাঁথা রেখে চলে যেত, গৃহবিচ্যুত মানুষ পাহাড় থেকে নেমে এসে নতুন করে আঙুর বুনতো। আঙুরের লতায় বেড়ে উঠতো তাদের আবহমান জীবনের নতুন জীবনানন্দ। কত শতবার ঘটেছে এই দানব নৃত্য, এই মাটিতে। কেবল মাত্র তিবিলিসি শহরই নাকি ধ্বংস ও পুনর্গঠন দেখেছে ৪০ বার। জর্জিয়ার জমিতে ৫০টিরও বেশি উপজাতি বাস করতো। প্রাচীন কালে গড়ে উঠেছিল দুটো মৎসজীবী রাজ্য। পশ্চিমে কলখিদা বা কলখিস্।সুদূর গ্রিস থেকে জ্যাসন ও অ্যারগোনাটসরা এসেছিল গোল্ডেন ফ্লিসের জন্য। পরে এই অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাচ্যে গঠিত হয় ‘আইবেরিয়া’, যা সাসানিড ইরানের পুন: পুন: আক্রমণে ক্লান্ত হয়ে বাইজাইনটাইনের প্রটেকশন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। আমি কলখিদা ঘুরে দেখেছিলাম যৌবনে, রাজকন্যা মিডেয়ার দেশে। আমার “লেনিনগ্রাদ থেকে ককেশিয়া” ও “ককেশিয়ার দিনরাত্রি” সেইসব কাহিনিতে সমৃদ্ধ। এখন এসেছি আইবেরিয়ায়, কুরা নদীর উপকূল বেয়ে যাবো লের্মন্তভের চরিত্রদের সন্ধানে।প্রমেথিউসকে বেঁধে রাখা হয়েছিল যে কাজবেক পাহাড়ে, যাবো তারও পাদদেশে। —— *বারান – খাসি ** শাসলিক – আগুনে পুড়িয়ে তৈরি মাংস গ্রুজিন – জর্জিয়ান। ভিনোগ্রাদ -আঙুর ভিনোগ্রাদনায় লাজা – আঙুর লতার ঘনকুঞ্জ ভিনো – দ্রাক্ষামৃত

হোটেলে চেক-ইন করার সময় ২ টায় হলেও ক্যাফেতে বসে নাস্তা সারতে সারতে সকাল ১০ টার মধ্যেই আমরা রুম পেয়ে যাই। Kopala Rikhe হোটেল, ভাইব্র্যান্ট শহরের কাঁচুলির তলে। সামনেই কুরা নদী, জর্জিয়ান নাম মেতক্ভারি ( Mtkvari), খুব সহাস্য রূপসী নয়,যদিও বুকে তার সস্রোত যৌবন মধুময়। বুক মোচড়ানো আষাঢ়ের পদ্মার ঘোলাজলের মত জল তার, কিন্তু পদ্মার বিশাল-বিস্তীর্ণ দেহ তার নেই। তন্বী সে চঞ্চলা, এপ্রিল-মে মাসে ঋতুমতি হয়। দুপাশে বাঁধানো তীর,আর ব্যতিব্যস্ত শহর। বাম পাশে পাহাড়ে একটি গির্জা যার প্রায় সবটাই সংস্কারের জন্য ঢাকা এবং তার পাদদেশে অশ্বারোহী রাজা ভাখতাঙের মূর্তি। মূর্তির পায়ের কাছে কুরা নদীর দুই তীর সংযোগকারি নীচু ব্রিজ। কুরা নদীর জল থেকে একটি শৈলগিরি খাড়া উঠে গেছে উপরে। লুঙি পরে স্নানে নেমে আকাশের দিকে মাথা তুলে মগ্ন দাঁড়িয়ে থাকা বাউলের মত। এই পাহাড়ের বুকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি প্রাচীন দুর্গ ছিল সম্ভবত ৫ম শতাব্দী থেকে, মেতেখি দুর্গ। তার ভিতরে তৈরি করা হয় মেতেখি গির্জা এবং গির্জা সংলগ্ন বিশাল রাজপ্রাসাদ। বর্তমান গির্জাটি তৈরি করা হয় ১৩শ শতাব্দীতে। মঙ্গোলরা ফড়িংয়ের মেঘের মত গতিপথের সবকিছু ধ্বংস করে যেত। এই রাজপ্রাসাদও রক্ষা পায়নি, মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। রুগ্ন আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত গির্জাটি দাঁড়িয়েছিল কোনমতে। তিবিলিসির প্রায় প্রতিরাজাই এই মন্দির পুনর্নির্মাণ করেছে, কিন্তু ঘুরেফিরে এসেছে পার্সিয়ানরা, তুর্কিরা, আবার পার্সিয়ানরা। লুট-তরাজ ও সন্ত্রাসের পাশাপাশি খৃষ্টান গির্জাধ্বংসকরাও ছিল তাদের পবিত্র মিশনের অংশ। ১৮১৯ সাল থেকে জার রাশিয়ার অধীনে এই দুর্গটি জেলখানা হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। বিপ্লবের পরে এই জেলখানা নাকি বলশেভিক বধ্যভূমি হিসাবে কাজ করে, যার ভিতরে অবিরত ফায়ারিং স্কোয়াড কার্যকর ছিল। নিরন্তর গুলির শব্দে ভীত প্রতিবেশীরা নাকি এলাকা খালি করে চলে যায়। পরে দুর্গ ও দুর্গের দেয়াল ধ্বংস করে ফেলা হয়। জর্জিয়ার পার্টি নেতা ও সারা সোভিয়েত স্বর্গের দু:খ, লাভরেন্তিয়ি বেরিয়া তিবিলিসির নয়ন বুদ্বুদ এই গির্জাটিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু দিমিত্রিশে ভারনাদজে নামে একজন প্রমেথিউস পুত্র চিত্রকর বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। জর্জিয়ার জনগণকে আহ্বান করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়াতে। জনগণের দেশ হলেও সে সময়ে জনগণের কথা বলা বা প্রতিবাদ করার অধিকার ছিল না, তা ছিল ‘পবিত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’কে পায়ে দলনের মত। সেই চিত্রকরকে অতি শিঘ্রই দেশের শত্রু হিসাবে গ্রেফতার করে ফায়ারিং স্কোয়াডের রামধনু পথে বুদ্ধের নির্বানে পাঠানো হয়। কিন্তু একটি কাজ হয়, দ্বিপদী দানব পিছু হটে, গির্জা রক্ষা পায়। জাতির ৭০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী রক্ষার জন্য একজন মানুষের জীবনদান কিছুই নয়। বিপ্লব তো মানুষের জন্যই। মানুষ হত্যাও, মানুষের জন্যই।
এই দুর্গের কাহিনি এখানেই শেষ করে দেয়া যেত, কিন্তু একজন নারীর উপকথা উঁকি মারে এর ইঁটের ফাঁক থেকে। নাম তার সুশানিক। সে ছিল আর্মেনিয়ার কোন সেনাপ্রধানের কন্যা। তাকে বিয়ে দেয়া হয় জর্জিয়ার দক্ষিণাংশের ‘ত্সুরতাভি’ রাজ্যপ্রধান ভাস্কানের সাথে। তখন আইবেরিয়ার ( তিবিলিসি – রাজধানী) শাসক ছিলেন ভাখতাঙ -১ গর্গোসালি। সে ভাখতাঙের থেকে সিংহাসন কেড়ে নেবার লক্ষ্যে স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে পারস্যে পালিয়ে গিয়ে স্বধর্ম ত্যাগ করে জরাথুস্ত্রবাদে দীক্ষা নেয়। শাহ তার মেয়েকে বিয়ে দেয় স্বজাতির বিশ্বাসহন্তার সাথে। এরপরে পারস্যের সৈন্য নিয়ে সে তিবিলিসি ফিরে আসে। পথবিভ্রান্ত স্বামীকে সে ফুলের মালা হাতে বরণ করতে না গিয়ে সুশানিক প্রাসাদের ছোট্ট একটি কক্ষে লুকিয়ে অবিরত প্রার্থনায় লিপ্ত থাকে। বহু পিড়াপিড়ি করা সত্ত্বেও সে বের হয়ে আসতে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত তার পিতামাতাকে আনা হয় এবং তাদের অনুনয় বিনয়ে সে বাধ্য হয়ে বের হয়ে আসে। ভাস্কেন প্রাসাদে বহুলোকের দাওয়াত দিয়ে মহাভোজের আয়োজন করে। সর্বসমক্ষে সুশানিককে আদেশ দেয় স্বধর্ম ত্যাগ করে পারস্যের অগ্নিপ্রভুর পূজা করার। সুশানিক মাথা উঁচিয়ে অস্বীকার করে। তাকে হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে নির্যাতন করা হয়। তারপরে প্রাসাদের এক অন্ধকার কক্ষে নিক্ষেপ করা হয়। খৃষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসীরা গোপনে তাকে জল ও খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে ৬ বছর। এই ৬ বছরের মধ্যে ভাস্কেন আবারও তাকে বন্দীদশা থেকে বের করে এনে তার থেকে অগ্নি উপাসনা আদায় করার চেষ্টা করে। আবারও ব্যর্থ হয়, সে রাগে উন্মত্ত হয়ে উদ্ধত নারীকে চুল ধরে রাস্তায় টেনে আনে জনতার সামনে। তারপরে নিক্ষেপ করে অন্ধকূপে। আলো সেখানে প্রবেশ করেনা, কিন্তু আলো ছিল তার বিশ্বাসে, সেই বিশ্বাসের মই বেয়েই সে ধীরে ধীরে অপার্থিবে বিলীন হয়ে যায়। কেউ বলে ঘটনাটি ঘটে এই প্রাসাদে, কেউ বলে ঘটে ‘ত্সুরতাভি’তে এবং দশম শতকে তার দেহভস্ম নিয়ে আসা হয় মেতেখি গির্জায়। ৪৮২ সালে নাকি ভাখতাঙ ভাস্কেনকে বন্দি করে মৃত্যদণ্ড দেয়। ফলে পার্সিয়ানরা ৪৮৩ ও ৪৮৪ সালে আইবেরিয়া আক্রমণ করে। মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে ভাঙা যায়। মানুষকে কিনে ফেলা যায়, কাউকে অর্থ দিয়ে, কাউকে ফুল দিয়ে, কাউকে পুরস্কার ও পদবী দিয়ে, কিন্তু সবাইকে নয়। এখানেই হল সব নিপীড়কের পরাজয়ের চাবিকাঠি। তাকে পরিবর্তীকালে সাধ্বী ঘোষণা করা হয় এবং এই গির্জায় তার আইকন রয়েছে। দিমিত্রি শেভারনাদজেও সুশানিক, সম্পূর্ণ ভিন্নযুগ, ভিন্ন আদর্শের মোহান্তদের হাতে নিহত। মানুষের অধিকার দলনে সামন্ততন্ত ও সমাজতন্ত্র একে অন্যের চরিত্রে কোনই ভিন্নতা দেখাতে পারেনি। বুঝতেই পারেনি যে, শ্লোগানই সমাজতন্ত্র নয়, সমাজতন্ত্র ভিন্ন কিছু। মেতেখি পাহাড়ের পাদদেশে অশ্বারোহী রাজা ভাখতাঙ-১ গর্গোসালির মূর্তি। তার শাসনকাল ৪৪০ থেকে ৫০২ সাল পর্যন্ত। ৪৫৮ সালের দিকে তিনি তিবিলিসি শহরের পত্তন করেন। জর্জিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। বাইজানটাইন থেকে জর্জিয়ান চার্চের স্বায়ত্তশাসনের স্ট্যাটাস আদায় করেন। তিনি তাকিয়ে আছেন কুরা নদী পার হয়ে তিবিলিসের “ময়দান” বলে খ্যাত প্রাচীন হাটের দিকে। এখানে দেশ-বিদেশ ও চারিদিক থেকে আসত চাঁদসওদাগর ও শংখবণিকের দল। আসতো ক্রেতারা, দামা-দামি, বেচা-বিক্রি, বাঁশির প্যাঁপুঁ, ছাগলের ব্যাব্যা, মুর্গির কোঁকোঁ, ঘোড়ার চিঁহিই…গাধার জীবন-দর্শন, কোন আওয়াজ এখানে শোনা না যেত ! ময়দানের ইঁট বাঁধানো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত রাস্তার দুইদিকেই দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর সুন্দর ইমারত। তিবিলিসির জীবনপ্রবাহের রঙ বৈচিত্র্যের অপূ্র্ব অঙ্গন এই ময়দান। মূর্তির পায়ের কাছ দিয়ে কুরানদীর দুই তীর সংযোগ করেছে সুন্দর নীচু ব্রিজ, যার উপর দিয়ে কুরার স্রোতের মতই নিয়ত জনস্রোত। কেউ যাচ্ছে ডানে তো কেউ যাচ্ছে বামে। কেউ হাসছে, কেউ আইসক্রিম চাটছে, এবং কোন এক মেয়ের হাল্কা স্কার্ট উড়ে যেতে চাইছে কিন্তু কোন এক যুবক তার হাত ধরে আছে। মেয়েটির চোখে রোদ, ছেলেটির চোখে আকাঙ্ক্ষা। থৈ থৈ জীবন। রৈ রৈ শহর। সামান্যই দূরের পাহাড়ে, যেখানে কোমল পা ফেলে হাঁটে কিশোরী রোদ, আর তার কটিদেশে দাঁড়িয়ে আছে ‘মা জর্জিয়া’ মূর্তি ও প্রাচুর্যের মেখলার মত কয়েকটি গির্জা, আমরা সেখানে যাবার উদ্দেশ্যে ‘কেবল কারের’ ওয়াগনে চড়ে বসি। হোটেলের অদূরেই স্টেশন। আমাদের গাইড তামারা এক মধ্যবয়সী নারী। মা তার রুশ আর বাপ গ্রুজিন। সুন্দর রুশ বলে সে, বলে ইংরেজিও। কুরা নদীর উপর দিয়ে দড়ি টানা পথে চলছে ‘কেবল কার’ আর সেই উঁচু থেকে উন্মুক্ত হয়েছে প্রাচীন শহরে অসামান্য সৌন্দর্যের বিহঙ্গ বিস্ময় ! পাহাড়ের উপর থেকে তাকিয়ে আছে ১৩ শতাব্দীর সেইন্ট নিকোলাস চার্চ, যা ১৮০০ সালে আগুনে পুড়ে যায়, তা নতুন করে তৈরি করা হয় ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে।
পাহাড়ের নাম ম্তাত্সমিন্দা। নামি যেখানে সেটি একটি প্রাচীন দুর্গের দেয়ালের বাইরে। নাম তার ‘নারিকালা’, নারিকেলের মতই দুর্ভেদ্য ও দুর্জয়। এই দুর্গ কবে তৈরি করা হয়েছে তা অজ্ঞাত। তবে দেয়ালের বিভিন্ন স্তর থেকে বোঝা যায় একবারে তৈরি নয়। আগে সিমেন্ট ছিল না, দেয়ালে ইটের ফাঁকে ফাঁকে নাকি চুন আর ডিম ব্যবহার করা হতো স্থায়িত্বের জন্য। ৪র্থ শতাব্দীতে পার্শিয়ান শাসনামলে এর নাম ছিল ‘শুরিস ত্সিখে (Shuris tshikhe) বা ‘স্বতন্ত্র বা ঈর্ষনীয় দুর্গ।’ সিল্করোডের এই দুর্গ নাকি কেউ জয় করতে পারে নি। আরব উমাইয়া শাসনের সময় (৭ম-৮ম শতাব্দী), পরে ১১২২ সালে আরবদের হাত থেকে জর্জিয়া স্বাধীনকারী ডেভিড ( দি বিল্ডার ) এর শাসনামলে ( ১০৮৯-১১২৫ ) এবং আরো পরে মঙ্গোল শাসনের কালে ( ১১-১২ শতাব্দী ) এর সম্প্রসারণ করা হয়। মঙ্গোলরা নাম দেয় ‘নারিনকালা’ বা ‘ছোটদুর্গ’। ১৮২৭ সালের ভূমিকম্পের সময়ে ব্যাপক ক্ষতির সাথে যুক্ত হয়, ভিতরে সংরক্ষিত বারুদ স্তুপের বিস্ফোরন, যা দুর্গটিকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলে।


ম্তাত্সমিন্দা পাহাড়ের পেছনে আরও একটি পাহাড় আছে। দুই পাহাড়ের মাঝখানে গভীর গিরি খাত। নীচে তাকাতে ভয় শির শির করে। একটি ছোট নদী এবং পার্ক, হাঁটার রাস্তা, অনতি উচ্চ জল প্রপাত, যদিও শব্দ তার প্রচুর যা সেই উঁচুতে বসে শোনা যায়। তিবিলিসির বোটানিকাল গার্ডেনও সেখানে। আমরা দুর্গ থেকে পায়ে হেঁটে যাই ‘মা জর্জিয়া’ মূর্তির কাছে।
স্বদেশ সব জাতির জন্যই মা, জর্জিয়ানরা এর ব্যতিক্রম নয়। মা দাঁড়িয়ে আছে টান টান পিঠ, ঋজু ও আত্মবিশ্বাসী; পাহাড়ের চূড়ায়, নারিকালা দুর্গ থেকে একটু নীচুতে। ১৯৫৮ সালে এটি স্থাপিত হয় রাজধানী তিবিলিসির ১৫০০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। স্থপতি এলগুঝা আমাসুকেলি। প্রথমে কাঠের তৈরী হলেও, ১৯৬৩ সালে আপাদমস্তক অ্যালুমিনিয়ামে পরিবর্তন করা হয়।দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগে। কিন্তু বিশালত্ত্বের কারণে কাছ থেকে সম্পূর্ণ দেখা যায় না।
মায়ের ডানহাতে তলোয়ার, উদ্যত নয় বরং কটির একটু নীচে, শ্রোণী বরাবর আড়াআড়ি করে শরীরের সমকোণে ধরা। বামহাতে উঁচু ‘ভিনোর’ পেয়ালা। সে অতিথিকে বরণ করে মনোভাব বুঝে, যদি সে আসে বন্ধুর মত, মা তাকে বরণ করে জর্জিয়ান ‘দ্রাক্ষামৃতে’র পেয়ালা উঁচিয়ে, তার সন্তান, কবি তিতসিয়ান তাবিদজের মত। আর অতিথি যদি আসে যুদ্ধ ও মড়ক নিয়ে মা অনম্বর করে তার মাতঙ্গিনী রূপ। প্রতিহত করে তলোয়ার উঁচিয়ে।

কবি তিতসিয়ান তাবিদজের কথা অন্যত্র বলেছি। ইয়েসিনিন, মায়াকোভস্কি, প্যাস্টারনাক সহ এমন কোন রুশ কবি সাহিত্যিক ছিল না, যে তাঁর ও তার স্ত্রীর উষ্ণ আতিথ্য গ্রহণ করে নি। যৌবনে সে ছিল চালচুলোহীন কবি। প্রেমিকা ছিল তার কবিতার ভক্ত।
সে বলেছিল, বিয়ের রাতে তোমাকে নিয়ে যাবার গৃহ নেই আমার, বিয়ে করবে আমাকে?
গিরিখাতের মত প্রেম, তলাহীন, পরিণতির কিচ্ছু দেখা যায় না, তবু ঝাঁপ দেয় নারী।
ভালোবাসা বলে কথা, কারো আঙিনায় প্রেম বার বার আসে, কারো আসে একবার, আমৃত্যু।
মৃত্যু এগিয়ে এসে সব কিছু সহজ করে দেয়।
কবিতার ভক্ত, নগরপাল খবর পায় এই চাল-চুলোহীন বিয়ের, চাবি দিয়ে বলে, “যাও, তোমাদের জোনাকি সন্ধানের এই রাত হোক এই গৃহে। জানালায় চাঁদ উপুড় করে দিক প্রেমের অমৃত কুম্ভ।”
সেই গৃহে অতিথি ছিল জর্জিয়া ও রাশিয়ার সত্য সুন্দরের সাধকেরা।

“আমি কবিতার স্রষ্টা নই,
বরং গল্প সৃষ্টির মত আমাকেই জন্ম দেয় কবিতারা,
এবং জীবনের পথ তাদেরই পায়ে পায়ে হাঁটে।
কবিতা কী ?
অ্যাভালাঞ্চ। তুষার ধ্বস।
যা ফুঁ দিয়ে তোমাকে জীবন্ত কবর দিতে পারে
কবিতা তাই।”
(প্যাস্টারনাকের রুশ অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর আমার)
এই কবিতা লেখার দশ বছর পরে, তাঁরই প্রিয় জর্জিয়ার ভাষা, জল ও আবহাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা ইওসিফ জুগাশভিলির বিপ্লব-ছিনতাইকারী দানবেরা ইতিহাসের ক্রুরতম জল্লাদের মতই তাকে হত্যা করেছে ১৯৩৭ সালে।
“যা ফুঁ দিয়ে তোমাকে জীবন্ত কবর দিতে পারে,
কবিতা তাই।”

আমরা সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসি পাহাড় থেকে। বোটানিকাল গার্ডেনের গেটের পাশ কাটিয়ে যাই গিরিখাতের সমতলে। এই গিরিখাতের একটি নাম আছে, “ইনঝিরগিরিখাত।” একসময়ে এখানে নাকি প্রচুর “ইনঝির” মানে ফিগ্ বা ডুমুর ফলতো। মিষ্টি, কচকচে, সুস্বাদু একধরণের ডুমুর, বাংলায় বলে যজ্ঞডুমুর। তবে ফিগ্ জিনিসটির রুশী ব্যবহার খুব বেশি ঝাঁঝালো। যেমন তুমি কোন রূপসীর কাছে (সে হতে পারে তোমার প্রেমিকা ) ওষ্ঠচুম্বনের অতিরিক্ত কিছু চাইলে, এবং সে তার ডানহাতের প্রথমা ও মধ্যমার মধ্যে বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে তোমার দিকে উঁচিয়ে বললো, “ফিগ্তিবিয়ে।”
সর্বনাশ ! তুমি যা চাইছো তা তো পাবেই না, খুব বড়জোর একটা ফিগ পেতে পারো। আমি এই ফিগের যন্ত্রণা সয়ে সয়ে অঙ্গার হয়ে বুঝেছি যে, রাশিয়ান ফিগের চেয়ে বাংলার যজ্ঞডুমুর অনেক বেশি সুস্বাদু। অবশ্য কাছে পেলে।

নদী বইছে কুরার দিকে। ছোট পাহাড়ি নদী। যারা সমতলের মানুষ, তারা একে নদী কি, নালাও বলবে না। নালার সাথে নর্দমার এত নিবিড় মাখামাখি যে, এত সুন্দর এই প্রকৃত প্রবাহকে নালা বলতে গা ঘিনঘিন করে। রুশভাষায় ছোট্ট ধারা বা জলস্রোতকে স্নেহ করে বলা হয় ‘‘রুচেই।”
ইংরেজিতে ব্রুক বা স্ট্রিম।

 

এঁকেবেঁকে গেছে সে সর্পিল নমনীয়তায়। হাঁটার জন্য কাঠের সেতু তৈরি করা হয়েছে তার উপর দিয়ে। আমরা জলপ্রপাতের শাশ্বত সঙ্গীতের মঞ্চের কাছে যাই। আহা কী শব্দ ও সুন্দরের জলঝর্নায় অবগাহন !
ঝর ঝর ঝর ঝরেছেই নিরন্তর। নির্ঝর নির্মল।
একজন জর্জিয়ান দাঁড়িয়েছিল একটি চিল নিয়ে। কয়েকটি ‘লারি’র বিনিময়ে ছবি তুলতে দেয়।
ককেশিয়ার উন্মুক্ত আকাশের তরলতায় পাখা মেলে মহাজীবনের সাধন করেছে যে, সে অর্জন করেছে নতুন জীবন, মানুষের দাসত্ব। মানুষ শুধু নিজেই দাস নয়, দাস-মালিকও।
কত বছর বাঁচে চিল ? বছর তিরিশ ? অথচ কত কিছু দেখে সে উঁচু থেকে।
চিল কি হাসে কখনও, মানুষের দিকে তাকিয়ে ?
প্রশ্নটি করা হয়নি।

এখানেও পাখি গায়, বেশ গায় ! মেয়েরা নদীর মত বুকে তরঙ্গ তুলে হাঁটে এবং তাদের চোখে চিকচিক করে আলো, ভালোবাসা যায় না কিন্তু ভালোবাসার ইচ্ছা জাগে। ইচ্ছাই তো মানুষের বেঁচে থাকার শ্বাস-নিশ্বাস। নারী শাশ্বত সুন্দর, জর্জিয়ার আঙুরলতার মত নিরত্যয়। ! পুরানো শহরে যাই। সেখানে শত শত বছরের অনেক স্নানাগার বা “হামাম।” “শিরিনহামাম” খুবই প্রসিদ্ধ এর স্থাপত্য সৌন্দর্যর জন্য। হার্মদাদ, ইউনানিও আয়ুর্বেদ যতটা না করতে পারে, তার চেয়ে হাঁকডাক হৈচৈ করে বেশি। তেমনি সুনাম এই হামাম তিবিলিসের সালফার বাথের। যেন সর্বরোগের মহৌষধ। তিবিলিস নামটি এসেছে ‘তিবিলি’ শব্দ থেকে, যার অর্থ উষ্ণপ্রস্রবন, ভূগর্ভস্থ উষ্ণজলের নির্ঝরের জন্য বিখ্যাত ছিল পাহাড়ি এই স্থান, তাই রাজা ভাখতাঙ তার রাজধানী স্থাপন করেন এখানে। বারবার প্রতিবেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হতে ক্লান্ত হয়ে রুশ প্রোটেকশনের জন্য রাজা দ্বিতীয় ইরাক্লি “ক্যাথেরিন দি গ্রেটের” সাথে গিওর্গিয়েভ চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য হন। অর্থডক্স খৃষ্টান জর্জিয়াও একই ধর্মের শক্তিশালী রাশিয়ার এই মৈত্রি দুই মুসলমান নেকড়ে প্রতিবেশী, পারস্য ও তুরস্কের উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি করে। ক্ষিপ্ত পার্সিয়ান শাহ আগা মুহাম্মদ খান কাজার হুমকি দেয়, তার চিঠি পাবার সাথে সাথে চুক্তি ছিঁড়ে না ফেললে সে জর্জিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। জর্জিয়া হুমকি অগ্রাহ্য করে। সে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসে ৩৫ হাজারের সৈন্য বহর নিয়ে। রাজা দ্বিতীয় ইরাক্লির সৈন্যসংখ্যা মাত্র ৫ হাজার। কিন্ত যুদ্ধ করে তারা বীরের মত, শত্রুদের তিবিলিসিতে কোন মতেই ঢুকতে দেয়না। রাজা দ্বিতীয় ইরাক্লি নিজে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেন। অবরোধ চলতে থাকে। পারস্য, তুর্কি ও আরব বেনিয়াদের হামাম ব্যবসার নিকটেই ছিল দুর্গের পূর্ব ফটক। এরা এই দেশের জল,হাওয়া ও মাটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে, তাদের নারীরা এখানে সন্তানের জন্ম দেয়, শিশুরা চাঁদ ও তারার সাথে খেলে খেলে বড় হয়, তাদের স্বজনেরা এই মাটিতে সমাহিত। শুধু ধর্মের সাযুজ্যের কারণে তারা একরাতে দরজা খুলে দেয় আগ্রাসি দস্যুদের। তিবিলিসের পতন হয় এবং আগা মুহাম্মদ খান তার প্রতিজ্ঞা রাখে। সাত দিন সাত রাত চলে হত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠন। শাহ আগা মুহাম্মদ খানের একটা গোপন যন্ত্রণা ছিল। ছ’বছর বয়সে তাকে খোজা করে দেয়া হয়েছিল। এই মানসিক আঘাত তাকে হিংস্র ও নির্মম করে তোলে। ভাগ্যচক্রে পারস্যের সিংহাসনে বসে সে মানবজাতির উপরে প্রতিশোধ নেয়। ধ্বংসযজ্ঞের সাত দিনই তিবিলিসিতে সে হামামে কাটায়। যখন সে টের পায় যে, অন্য সবকিছুর নিরাময় হলেও, অণ্ডহীনতার কোন চিকিৎসা নেই – সে তখন রাগে ফেটে পড়ে। আদেশ দেয় সামনে যাকেই পাবে তাকেই হত্যা করতে। এইভাবে শৈশবে তার উপরে সংঘটিত পাশবতার প্রতিশোধ সে নিয়েছে মানুষ হত্যা করে। পুশকিন, গ্রিবায়েদেভ, লেরমন্তভ, ইয়েসিনিন এই সব হামামে স্নান করেছেন। সেই সময়ে সামাজিক মেলামেশার স্থান ছিল এই স্নানাগারগুলো। খাদ্যপানীয় সবকিছুর পরিবেশন হতো এখানে। মেয়েদের স্নানাগারে অভিজাত মহিলারা তাদের যুবতি মেয়েদের নিয়ে সারাদিন কাটাতো। গাল-গল্প, আড্ডা, পরচর্চা, বিত্ত-গহনার প্রদর্শনী ইত্যাদির এগুলো ছিল মাহেন্দ্র মন্দির। বিয়ের ঘটকালি করতো যে নারীরা, কুমারি মেয়েদের দেহের নিঁখুত বৈভব ও সার্বিক সৌন্দর্য দেখার ঈগলদৃষ্টির ও আনাগোনা ছিল এখানে।

এই হামামগুলোর কাছেই রয়েছে সারা জাহানের বিস্ময় তিবিলিসির জুম্মামসজিদ। এখানে শিয়া ও সুন্নিরা একসাথে নামাজ পড়ে, যা অদিব্য এই জগতে প্রায় অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য। প্রয়োজনে একজন শিয়া বা একজন সুন্নি সংক্ষিপ্ত লেজের বরাহের সাথে জুম্মা পড়বে কিন্তু একে অন্যের সাথে নয়। ১৭২৩ সালে অটোমানরা এই সুন্নি মসজিদের প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু ২০ বছর পরে শিয়া পার্সিয়ান
দখলদারেরা তা ধ্বংস করে দেয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এর পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হয়। একই সময়ে তৈরি করা হয় শিয়াদের স্থাপত্য সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন “নীলমসজিদ।” কিন্তু ১৯৫১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ঈশ্বর বিতাড়নের অংশ হিসাবে অর্থ খরচ করে নীলমসজিদ ধ্বংস করা হয়। ফলে শিয়াদের নামাজ পড়ার মসজিদ আর থাকে না এবং জুম্মা মসজিদ তাদের গ্রহণ করে। হাজার বছর ধরে একে অন্যের রক্তপায়ী এই দুই দল বিপরীতমুখী অদ্বয়বাদীকে এক করার কৃতিত্ব যে, ১৯৫১ সালের “প্রায়হালাকু” সম্প্রদায়ের, তা স্বীকার না করে উপায় নেই।

মে-জুন ২০১৯

1 thought on “Travel – Jatro Boye Kura Nodi

  1. ভ্রমণ কাহিনি যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে লেখক শাহাব আহমেদ তা প্রমাণকরে দিলেন। ভ্রমণ কাহিনি কেবল নয়নাভিরাম ছবি নয়, নয় কেবল ডাটাবেইজ- তা ইতিহাস, সে-যে পুরাণ, তারো অধিক জীবন, জীবনযাপন কথাটি না বললে পুরোটা বয়ান করা হয় না; সর্বোপরি ভ্রমণসাহিত্য খালি জীবন নয়- অন্যরকম অধিক- অনর্গল জীবন সৃষ্টি করার অভয়বাণী!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *