চা খাবেন?
-খায়রুল আনাম
আমার এক পোপেচার বন্ধু আছেন। অধ্যাপক সাহেবকে আমি বন্ধু বলি। তিনি হোরে, নোরে, শংকরে- সবাইকে বলে বেড়ান, “উনি আমার বড় ভাই”। ফর্মুলাটাকে ঠিক মেলাতে পারি না। যাই হোক, আমাদের এই ভাই-বন্ধু বা বন্ধু-ভাই সম্পর্কটা এতদিনে বেশ একটা স্টেবল পজিশানে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই আমাদের ফোনালাপ, দেখাসাক্ষাত, কথাবার্তা হয়। বিশেষ করে শুক্রবার, জুম্মার নামাজের জামায়াতে। মসজিদের লাগোয়া না হলেও আমাদের বাড়ি সেখান থেকে মাত্র তিন মিনিটের ড্রাইভ। তাই আমাদের বাঙ্গালী ট্রাডিশনটা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। জুম্মার নামাজের পর বাড়ি ফেরার পথে ওনাকে আমাদের বাড়ি হয়ে এক কাপ চা খেয়ে যাবার জন্য স্ট্যান্ডিং অনুরোধ করে রাখি। উনিও উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতো নামাজের পরে আমাদের বাড়িতে আসেন। আসার পথে মসজিদেই বিক্রী হওয়া কোন একটা স্ন্যাক নিয়ে আসেন।
এত উৎসাহ, মমতা নিয়ে যে বাড়িতে আসে, তাকে আপ্যায়ন করতে এক মিনিট কালও বিলম্ব করা কি উচিৎ? বিশেষ করে ‘বড়ভাই’ এর মাখনের প্রলেপটা যখন আমার চামড়ার উপর লাগিয়ে দিয়েছে। তাই ঘরে ঢুকেই ওনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলি, ‘ রহমান সাহেব, আজকে কোন চা-টা খাবেন ?”
“ঐ একটা হলেই হলো”।
“তা বললে কি হয়? কোনটা আজকে পচ্ছন্দ ঠিক করে বলুন। আমি এক এক করে নাম বলে যাচ্ছি।কোন কোম্পানী ও তার কোন ব্র্যান্ড? প্যাকেট টী না লুজ টী? দুধ সমেত না শুধু রঙ চা? চিনি চাই, না চিনি ছাড়া? সাদা চিনি না ব্রাউন সুগার? না কি স্প্লেনডা, ইকুয়্যাল, বা সুইট এন্ড লো? নাকি ট্রুভিয়া বা স্টেভিয়া? বাড়িতে মধুও আছে, আগাভে ন্যাচারাল সুয়েটেনারও আছে। দুধ নিলে, কি দুধ নেবেন? হোল মিল্ক আছে, ২% মিল্ক ফ্যাট ওয়ালা দুধ আছে, হাফ এন্ড হাফও আছে। আমার দুই আত্মীয় দু’রকম দুধ ব্যবহার করে। একজন সুইটেন্ড কন্ডেনস্ড মিল্ক ও অন্যজন দুধের বদলে কফিমেট ব্যবহার করে। আমি সব গুলোই বাড়ীতে রাখি। কোন ফুলে কোন দেবতা সন্তুষ্ট হয় আগে থেকে তো বলা যায় না। তবে আমি নিজে ক্যানের মধ্যের ‘এভাপোরেটেড মিল্ক’ ব্যবহার করি। ক্যানগুলোর মধ্যে কোনোটায় রেগুলার, কোনটায় ২%, কোনটায় নন-ফ্যাট দুধ থাকে। কারনেশান নামে একটা কোম্পানি ওগুলো বানায়।এগুলো এক এক সময়, এক একটা পরিমাণমতো নিয়ে চা’তে মেশাই। এখন বলুন, কোনটা এবং তার সঙ্গে কি কি চাই?”
“বললাম তো একটা হলেই হলো।‘
“আবার সেই একই কথা বললে চলবে?ব্ল্যাকটীনা গ্রীন টী সেটা তো বলতে হবে। শূনুন, আমার অনেক রকমের ব্ল্যাক টী আছে। লিপটন, ব্রুকবন্ড, তাজমহল, ওয়াঘ বাকরী, কাজী ব্রাদার্স, আর্ল গ্রে, বিগেলো, টেটলি, টোয়াইনিং, তাজো, হাইসন, ফারলিভস, গেশয়েন্ডনার, মারিয়েজ ফ্রেরেস কোম্পানীর দার্জিলিং, আসাম, সিলেট, শ্রীলংকা, ইয়োগী, লিচি, রুইবস, ও’সুলিভান, ইন্ডিয়ান চায়, কাভা ইত্যাদি হাজার রকমের অ্যারোমা, ফ্লেভার ও টেস্টের চা আছে। কোনটা লাগবে? নাকি ব্ল্যাকটীর বদলে গ্রীন টী লাগবে? আজকাল বিগেলো, লিপটন, ব্রুকবন্ড, টেটলীর মতো বেশিরভাগ কোম্পানীই গ্রীন টী বানায়। এদের অনেকেই আবার হোয়াইট টীও বানায়”।
“আপনি একটা কাজ করুন। আমাকে বেশ লম্বা একটা কাপে ‘বিগেলো’ কোম্পানীর গ্রীন টীই দিন। দুধ চিনি ছাড়া। ওর মধ্যে লেবুর, মানে লাইমের যে ছিটে ফোঁটা নির্য্যাস ও ফ্লেভার দেওয়া থাকে, তাতেই বেশ মজা পাওয়া যায়। আর কিছু লাগে না। গ্রীন টী’র অনেক গুণ, জানেন বোধ হয়”।
“ জানি, তা আপনি হঠাৎ গ্রীন টীর দিকে ঝুঁকলেন কেন? দুধ না, চিনিও না। আপনি কি আসলে চা খাবেন না ওষুধ খাবেন”?
“আরে স্যার, চায়ের আদিতেই তো ছিল গ্রীন টী, যেটা চাইনীজরা আবিষ্কার করেছিল। তার অনেক অনেক পরে ব্রিটিশরা এর সন্ধান পায়, বিশেষ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। তারাই একসময় এটা ভারতে নিয়ে যায়, বিভিন্ন পাহাড়ী, ঘন বৃষ্টিপাতওয়ালা এলাকায় চাষ করা শুরু করে এবং এই ব্যবসায়দারুণ লাভ করে”।
“ বলেন কি? কি রকম?”
“ শুনুন, পৃথিবীতে যত পানীয় আছে তাদের মধ্যে ব্যবহারের দিক থেকে চায়ের অবস্থান হলো এখন দ্বিতীয়। স্বাস্থ্যের দিক থেকে চায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আজকাল সেলেব্রিটিদের দিয়ে তো নানা ধরনের চা ও তাদের উপকারিতার কথা বলে বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে রাখছে, যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ওজন, হার্ট ডিজিজ ও ব্লাড প্রেশার কমানো। কোন কোন খাবার প্রস্তুতকারক গ্রীন টী ওয়াফল, আর্ল গ্রে জিলাটো ইত্যাদি বানাচ্ছে। ‘ওপরা উইনফ্রে’ তো ‘ওপরা চায়ে টি লাটে’ নামে একধরণের চায়ের মিশ্রণ ‘স্টারবাক্স’ কফি স্টোর-এর মাধ্যমে বিক্রী করছে।
একসময় চা শুধু একটা পানীয়ই ছিল না। ওষুধ, মুদ্রা ও বাণিজ্যের নানা স্তরেও তা ব্যবহৃত হতো। চায়ের উৎপত্তি নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। ‘আরলিং হো’ ও ‘ভিক্টর মায়ার’-এর গবেষণা অনুযায়ী, সেটা শুরু হয়েছিল প্রায় ৪০০০ বছর আগে,প্রাচীন চীনে ।বিশ্বাস করা না গেলেও এবং বাস্তবে প্রমাণিত না হলেও, ঘটনাটি নাকি সত্যি। চেন ন্যাং একদিন এক গাছের নীচে বসে খাবার জলটা ঈষৎ গরম করে নিচ্ছিলেন। সেই সময় গাছ থেকে একটি পাতা ঝরে ঐ জলের পাত্রের মধ্যে পড়ে। পাতাটা না ফেলে কৌতুহল বশে তিনি পাতার নির্য্যাস ওয়ালা সেই গরম জল পান করেন। স্বাদটি তাঁর বেশ পচ্ছন্দ হয়। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় সবুজ চা।
ক্রমশ স্বাদওয়ালা এই পানীয়ের ব্যবহার সারা চীনে বেশ পপুলার হয়ে যায়। তখন চা-কে তারা রপ্তানী ব্যবসায়ের সামগ্রী হিসেবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করে। প্রথম দিকে চায়ের ট্রেড করতে চীনারা চা পাতা বান্ডিল বান্ডিল করে রাশিয়ায় পাঠায়। কিন্তু সে সময়রাশিয়ানদের চায়ের প্রতি কোন আকর্ষণ দেখা যায় নি। ১৫০০ সালে সিল্ক রুট দিয়ে চীন,পারস্য ওইসলামিক বিশ্বে চা রপ্তানি করার চেষ্টা করে। প্রথমে ফারসিরা চা যে মানুষ কেন খায় তা ভেবে কোন কূল কিনারা পায় নি। কিন্তু কিছুদিন ব্যবহার করার পর স্বাস্থ্যের দিক থেকে এর উপকারিতা তারা বুঝে ফেলে। এভাবেই ঐ এলাকায় চা পপুলার হয়ে ওঠে। এরপর ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চায়ের ব্যবসায়ে নেমে পড়ে। তারা ইন্ডিয়া ও শ্রীলংকার বিভিন্ন অঞ্চলে চা উৎপাদনও শুরু করে এবং এর উপর গবেষণা ও প্রসেসিং করে তারা ব্ল্যাক টি বানায়। এটি ভারত উপমহাদেশে ভীষণ পপুলার হয়।
চা বলতে আগে সবাই ব্ল্যাক টী-ই বুঝতো। এর সঙ্গে দুধ ও চিনি মিশিয়ে একে আরো সুস্বাদু বানানো হতো। বিলেত ও পাশ্চাত্তে অবশ্য র’ টি বা রঙ চা-ই বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। আজকাল আবার গ্রীন টি, হোয়াইট টি ও বিভিন্ন হারবাল টী বেশ পপুলার হচ্ছে। স্বাদ বা খেয়ে মজা পাবার চেয়ে বরং স্বাস্থ্যের উপকারিতার দিকেই তাদের নজরদারীবেশি”।
“ঠিক আছে ভাই, চা খাওয়াতে গিয়ে অনেক জ্ঞানলাভ হলো। এই যে আপনার বড় কাপে র’ ‘বিগেলো গ্রীন টী। খেয়ে আপনি দীর্ঘজীবি হোন আর আমি হাফ এন্ড হাফ দুধ আর দু’চামস চিনি মিশিয়ে ব্ল্যাক টী খেয়ে দিনে দিনে শরীরের বারোটা বাজাই আর আপনার আগে স্বর্গলাভ করি। নাকি নরক?” (শিকাগো )