rannaghor-bangalir-adi

বাঙালির আদি খাবার

আল মারুফ রাসেল


বাঙালির রসুইঘর এখন যেসব শাক-সব্জি, তরকারি আর ফলে ভরপুর তার অধিকাংশই বিশ্বায়নের ফল। হবে না-ই বা কেন, খোদ বাঙালি জাতিটাই যে বিশ্বায়নের কারণে তৈরি। আদিতে সেই ভেড্ডা (অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্রিক) জাতির সঙ্গে প্রাক বৈদিক আর্য রক্তের মিশ্রণ, পরবর্তীতে বৈদিক আর্যদের মিশ্রণ- এরপর রাজা-উজিরে কত কত উত্থান-পতন, মুসলিম আগমণ, ইউরোপীয় বণিকদের রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা- সব মিলিয়েই ত বাঙালি জাতি তৈরি। সে সব বিতর্কে না গিয়ে বরং ধরে নিই বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষদের যে অবিভক্ত ভূ-খণ্ড, সেখানে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যারা বাস করছে, তারাই বাঙালি, বাঙালির আদিপুরুষ। আর সেই ভূ-খণ্ডের আদ্যিকালের খাবার নিয়েই এই লেখা।

প্রত্নপ্রমাণ এই এলাকার ইতিহাসকে প্রস্তরযুগে টেনে নিয়ে যায়। আসাম, মূর্শিদাবাদ, হুগলি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, লালমাই ও সীতাকুণ্ডে পাওয়া প্রস্তর হাতিয়ার সে সাক্ষীই দেয়। প্রাগৈতিহাস ও ইতিহাসের আদি যুগের বেশ কিছু প্রত্নস্থল থেকে বেশ কিছু প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা নেওয়া যেতে পারে আগেকার দিনের মানুষের খাদ্যাভ্যাস। জীবাশ্ম কাঠ, প্রাণীর হাঁড় দিয়ে তৈরি এসব হাতিয়ারের ব্যবহার আমাদের এখানে আদিকালের মানুষের অধিবাসের কেবল প্রমাণ দেয় না, একইসঙ্গে এই এলাকার বিস্তৃত অরণ্যে যে তারা পশু শিকার করে খেত তারও স্বাক্ষ্য দেয়। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী তাম্রপ্রস্তর যুগে এই এলাকায় প্রথম বসতি ছিল, এবং এই বঙ্গ এলাকা ছিল অরণ্যসঙ্কুল। এমনকী এই মধ্যযুগের মুসলিম শাসনামলেও বাংলার খুব বেশি এলাকায় মানুষের বিচরণ ছিল না। ইতিহাসবিদরা বলছেন, হরিণের মাংসের প্রতি লোভ সে আমলেও নাকি ছিল। আর এই সেদিনও, উনবিংশ শতকের শেষের দিকে সুন্দরবনের শেষ গণ্ডারটিও উদরস্থ করেছিল সাতক্ষীরা এলাকার সাধারণ মানুষ। আর মাঝখানে আরও কত কত প্রাণী যে শিকার হত, তার ইয়ত্তা নেই।

বাঙালির ইতিহাস চর্চার ইতিহাস খুব বেশিদিন আগের নয়। আর ইতিহাস যখন লেখা হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাগৈতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ ছিল অপ্রতুল, বৈদিক সাহিত্য (যথেষ্ট সম্মান নিয়েই বলছি) মুখে মুখে প্রচলিত ছিল আর তা লেখা হয়েছিল ঐতিহাসিক যুগে, ফলে ভুল-ত্রুটি যে নেই তা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলা কঠিন। তাই প্রাক-ইতিহাসের যুগ, বাংলার ইতিহাসের আদি যুগের খাবার সম্পর্কে জানতে আগেকার সাহিত্য যেমন ধারণা দেয়, তেমনি প্রয়োজন তার প্রমাণেরও- অর্থাৎ প্রত্নসামগ্রী আর প্রত্নস্থলের। এখানে প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভারতে গত ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে কাজ হলেও বাংলাদেশে কিছুদিন আগে শুরু হয়েছে। প্রত্নস্থল থেকে পাওয়া শুকিয়ে যাওয়া খাদ্য শস্য বা তার অবশিষ্ট সে সময়কার খাবার সম্পর্কে খানিক ধারণা দিতে পারে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় পাওয়া কিছু খাদ্যশস্যে আলোকপাত করা জরুরি, যেগুলো রাখালদাস বা নীহার রঞ্জন বা রমেশচন্দ্রের ইতিহাস লেখার বহু পরে পাওয়া গিয়েছে।
গাঙ্গেয় ভূমিতে খ্রি.পূ. ২৫০০ থেকে ২০০ অব্দ অবধি পাওয়া কিছু উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে বেশ কিছু প্রত্নস্থান মিলিয়ে গত চার দশকে। ধান, বার্লি, দুই ধরনের গম, আঙুল বাজরা, জোয়ার, কডো, বাজরা, মটরশুটি, মশুর, খেসারি, চানা, মুগ ডাল, ঘোড়া ডাল, তিসি, কুসুম ফুলের বীজ, তিল, কালো শর্ষে, ভাং, ধুঁদুল বীজ, বিউলির ডাল, পেঁয়াজের বীজ, কালোজিরা, হরিতকী ফল ও বীজ, বহেড়া ফল ও বীজ, আমলকি ফল ও বীজ, বরই বীজ, কুল বরই বীজ, বীজ, ক্যাপার বীজ, গুরগুরের দানা ও বীজ, উরি ধান, ঘাস বীজ, দু’রকমের ছোলা বীজ, মুথা, মেছুয়া শাকের বীজ, মোরগঝুটির বীজ, বিছুটি গাছের বীজ, মাকড়জালি বীজ, মাকড়সা হুড়হুড়ি বীজ, মন্তা দানা, গুল্ম পারিজাতের দানা, দাঁড়ি ঘাসের দানা, বুরাসামা ঘাসের দানা, পোস্ত দানা, ওট বীজ, শিমুল বীজ, বট বীজ সহ আরো অনেক গাছের নমুনা পাওয়া গিয়েছে।
প্রমাণ মিলেছে বেশ ক’রকম ধান রীতিমত চাষ করা হত। আরও রয়েছে বার্লি, গম, আখ, বামন গম, কাওন, ঝাড় ভুট্টা, মুক্তা বাজরা, জোয়ার, কডো, মসুর ডাল, মটরশুটি, ছোলা, চানা, ঘোড়ার ডাল, মুগ ডাল, মাসকালাই ডাল, অড়হর ডাল, বরবটি, শিম, মেথি, তিল, রাই শর্ষে, শন, কুসুম ফুল, তুলা, পেঁয়াজ, রেড়ি ,ফলসা। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে এগুলো গঙ্গা অববাহিকায় চাষ হয়ে চলেছে খ্রিঃপূঃ ২০০০ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন গঙ্গা অববাহিকা বলতে বিশাল একটা এলাকা বোঝায়, কেবলমাত্র বাংলায় কি ধরনের চাষবাস হত, বা খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার জন্যই এই প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ্যার এই আলোচনা।
উয়ারি বটেশ্বর, যেটাকে বলা হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগেকার সভ্যতার নিদর্শন, সেখানে পোড়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে ধান ও ধানের তুষ, চাল, বার্লি, বজরা, কাওন, কডো, মাকরা, বুনো ঘাসবীজ, মুগ ডাল, মাসকলাই, জংলি শিম, শিম, মটরশুটি, মশুরের ডাল, তিল, কালো শর্ষে আর নারকেলের ছোবড়া। আবার এরপর সপ্তম-অষ্টম শতকের বিক্রমপুর বিহার থেকে উয়ারি বটেশ্বরের মত প্রায় একই জিনিস মিলেছে।
এরপর আসা যাক ঐতিহাসিক কিছু সূত্রে আলোকসম্পাত করতে। বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদেরা বারবার টেনে এনেছেন বাংলার কৃষিভিত্তিক আদি সভ্যতার কথা। বাংলা শব্দের উৎপত্তিতেই নাকি জড়িয়ে আছে কৃষিভিত্তিক এক সভ্যতা বা অঞ্চলের ইতিহাস- এমনটাই ভাবেন ইতিহাসবেত্তারা। বঙ্গ নামের জনপদের সঙ্গে ভাটি এলাকার পানি বা জল আটকানোর আলের ব্যবহারে বঙ্গাল নামের উৎপত্তি। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে তাই উল্লেখ করেছেন ‘ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান্য যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নেই। ভাত ভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর (এখন যাদের ভেড্ডা বলা হচ্ছে) সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান।’ সম্প্রতি উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে আবিষ্কৃত জ্যাপোনিকা জাতের ধান, যা থেকে আঠালো ভাত হয়, তা স্বাক্ষ্য দিচ্ছে দূর প্রাচ্যের সঙ্গেও আমাদের ওঠা-বসা ছিল আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগেও। তাই খাবারের আদি ইতিহাসে প্রাচ্য দেশগুলোর প্রভাবটাও দেখতে হবে আমাদের। পাঁচ হাজার বছর আগে নাকি এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রথম প্রথাগত উপায়ে ধান চাষ শুরু হয় বলে মতামত দিয়েছেন গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইয়ে।
ইতিহাসের আরও যা বই আছে, স্বাক্ষ্য দেয় ভাত ছাড়াও একটি খাবারের প্রাচুর্য ছিল এই এলাকায়, সেটা হল মাছ। বাংলায় নদী, খাল, দীঘি, পুকুর আর অন্যান্য প্লাবনভূমিতে মাছের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য মাছকে আমিষের তালিকার বাইরে রাখতে গৌড়ীয় ব্রাক্ষ্মণরা বাধ্য হয়েছিলেন একটা সময়ে। বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম খাবারের প্যাটার্ন তাই মাছে-ভাতে। যতই আধুনিকতা আসুক, বাঙালির জীবনে মাছ-ভাত চিরন্তন সত্য, ধ্রুব।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাঙালির খাদ্য বিষয়ক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন যে ‘বাঙালিরা চিরকাল মৎস্যভোজী’। নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন, ‘বারিবহুল, নদনদী-খালবিলবহুল প্রশান্ত সভ্যতাপ্রভাবিত এবং আদি অস্ট্রোলীয় মূল বাংলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। চীন, জাপান, ব্রক্ষ্মদেশ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের আহার্য তালিকার দিকে তাকাইলেই বুঝা যায়, বাঙলাদেশ এই হিসাবে কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। এই তালিকায় ভাত ও মাছই প্রধান খাদ্যবস্তু। ’
তবে একটু আগেই উল্লেখ করেছি, বাঙালির এই মৎস্যপ্রীতিকে শুরুতে আর্য সভ্যতা-সংস্কৃতির মানুষগুলো ঠিক মেনে নিতে পারেনি। বাংলার অন্যতম স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব প্রচুর যুক্তি-তর্ক দেখিয়ে বাঙালির মাছ খাওয়াকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বাংলার আরেক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্য বিষ্ণুপুরাণের ছ’টি শ্লোক থেকে দেখিয়েছেন, বিশেষ কিছু তিথি আর পর্ব মেনে চললে মাছ খেতে বারণ নেই। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে রুই, পুটি, শোল এবং সাদা ও আঁশযুক্ত অন্যান্য মাছ ব্রাক্ষ্মণদের খেতে বাঁধা নেই বলে উল্লেখ রয়েছে। জীমূতবাহন ইলিশ মাছের তেলের বহুল ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তেল-চর্বির বর্ণনায়। তবে যেসব মাছ কাদায় ও গর্তে বাস করে, যাদের মুখ ও মাথা সাপের মত, আর যেসব মাছের আঁশ নেই, সেগুলো ব্রাক্ষ্মণদের জাতচ্যুত করতে যথেষ্ট ছিল। শুটকি মাছ আর মাছ পচিয়ে খাওয়াও ব্রাক্ষ্মণদের বারণ ছিল, যদিও টীকাসর্বস্ব বইয়ে লেখক সর্বানন্দ বলেছেন বঙ্গাল দেশের মানুষদের বিশেষ প্রিয় ছিল এই সব খাবার।
প্রাচীন বাঙালির (খুব বেশি প্রাচীনও নয়) মৎস্যপ্রীতির পরিচয় মেলে পাহাড়পুর, ময়নামতির টেরাকোটায়। নীহাররঞ্জন রায় বেশ ক’টি টেরাকোটার উল্লেখ করেছেন যাতে মাছ কাটা ও ঝুড়িতে বোঝাই মাছ হাতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অঙ্কিত রয়েছে। প্রাকৃত বাঙালির খাবারের তার প্রাকৃতপৈঙ্গল বইয়ের থেকে দেয়া উদ্ধৃতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যার চলিত বাংলা- যে নারী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নালিতা বা পাট শাক পরিবেশন করতে পারেন, তাঁর স্বামী যে যথার্থই পুণ্যবান সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
বেদে প্রায় ২৫০ রকমের প্রাণীজ আমিষের উল্লেখ প্রমাণ করে যে আগেকার মানুষের মাংসে বিশেষ অরুচি ছিল না। এর মধ্যে আবার প্রায় ৫০টি পূজার নৈবেদ্য হিসেবে চিহ্নিত করা। ঋগ্বেদে ঘোড়া, ষাঁড়, মহিষ, ভেড়া ও ছাগলের নাম পাই উৎসর্গের প্রাণীর তালিকায়। আবার বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যেত বাজারে- গরু, ভেড়া, শুকর, হরিণ, মুরগি, কুমির ও কচ্ছপের উল্লেখ করা যেতে পারে। বুদ্ধযান ধর্মসূত্র থেকে জানা যায় গণ্ডারের মাংস দিয়ে তৈরি হত শ্রাদ্ধের খাবার। জাতক থেকে পাওয়া যায় কবুতর, তিতির, বানর, হাতি ভক্ষণযোগ্য। বৃহৎ সংহিতায় যোগ হয় সরীসৃপ ও গবাদিপশু। বিষ্ণুপুরাণে পাওয়া যায় শ্রাদ্ধে মাংস খাওয়ানো সমাজে সম্মানজনক ব্যাপার ছিল। খরগোশ, শূকর, ছাগল, হরিণ, পাহাড়ি ছাগল, মহিষ, গয়াল, ভেড়া ছিল এই তালিকায়। গৃহ সূত্রে বলা হয়েছে, ভেড়ার মাংস বলদায়ক, তিতিরের মাংস পবিত্রতা, মাছ ভদ্র স্বভাব আর ভাত ও ঘি গৌরবের। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ৭০০ গ্রাম (২০ পাল) সারঙ্গ মাংস (চিত্রল হরিণ), এক কুদুবা (২৫০ গ্রাম) তেল, এক কুদুবার দুই তৃতীয়াংশ দই, এক পাল লবণ আর এক পালের এক পঞ্চমাংশ মসলা (মসলার বিবরণ নেই) দিয়ে এক রান্নার বিবরণ পাই। সুগন্ধি চালের সঙ্গে খাওয়া হত এই পদ। চড়ক সংহিতায় আরও অনেক মাংসের সঙ্গে উল্লেখ পাওয়া যায় কুমির, কচ্ছপ, শেয়াল আর সজারুর মাংস।
পঞ্চম শতকে নিরামিশাষী আন্দোলনটা জোরদার হয়, ফা হিয়েন আর হিউয়েন সাংয়ের মত পরিব্রাজকেরা অবশ্য তাতে বৌদ্ধ প্রভাবটাই বেশি খুঁজে পেয়েছিলেন। পরে আল বিরুণী আরও গভীরভাবে এই নিরামিশাষী সংস্কৃতি নিয়ে বিবরণ দেন। তিনি বলেন, এই নিয়ম কেবলমাত্র ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষাকারী বর্ণ ব্রাক্ষ্মণদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। আর এই নিয়মে কয়েকটি প্রাণীর নাম নেয়া হয়, যেগুলো তাদের জন্য নিষিদ্ধ- গরু, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, উট, হাতি, গৃহপালিত পাখি, টিয়া, কাক, রাতচরা পাখি, ডিম আর মদ। মদ শুদ্রদের জন্য শিথিল হলেও, তারা মদ বিক্রি করতে পারত না, মাংসের মতই। আল বিরুণী হঠাৎ করে গোমাংস বন্ধ করার কারণও দেখিয়েছেন। তার মত সমর্থন করে বেদের ভাষ্যও। গোমাংস গলধ:করণের পর সেটা হজম করার জন্য পান খাওয়ার প্রয়োজন পড়ত। আবার দূর্বল পরিপাকতন্ত্রে এই খাবার ঠিকঠাক হজমও হত না, ফলে নির্ধারিত কাজ সময়মত সম্পন্ন হত না। আবার অর্থনৈতিক কারণও ঠিক উপেক্ষা করার মত নয়। গরু একাধারে মালবাহী, কৃষিক্ষেত্রে কর্মঠ আবার গৃহস্থ ঘরে দুধের যোগানদাত্রী, গোবর প্রয়োজন মাটির ঘরের রক্ষণাবেক্ষণে। তাই গরুর মাংসের চেয়ে জীবিত গরু অর্থনৈতিকভাবে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। বাংলায় তথা গোটা ভারতবর্ষে শাক-সব্জির প্রাচুর্যও আরেকটি কারণ হতে পারে- বাংলার মানুষের নিরামিশাষী হওয়ার ক্ষেত্রে। মিষ্টির ব্যাপারে বাঙালির পাতে কেবল পায়েসের চল ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। ছানার মিষ্টি কিছুই ছিল না। তবে চিনির পুতুলসহ অন্যান্য ময়দার মিষ্টি (মিষ্টান্ন ও গজা) আদিকাল থেকেই প্রচলিত। আর নানা পদের ও নামের মাদকের বর্ণনা সংস্কৃত সাহিত্য ঘাটলেই মেলে।
তবে বাঙালি যখন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু হল, খাবারের ব্যাপারেও একটু খেয়ালি হল, ঐতিহ্যের দিকে ঘুরে তাকাল, তখন সব কিছুরই গোধূলিবেলা। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে বিস্মৃতিতে। নিজের কি ছিল, আর কি কি চাপিয়ে দেয়া হল পশ্চিমা সংস্কৃতির বদৌলতে. তা আলাদা করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব।
বাঙালির প্রথম রেসিপির বই পাক রাজেশ্বর। বইয়ের প্রকাশকাল ১৮৩৮। এরপর ব্যঞ্জন রত্নাকর, ১৮৫৮ সালে। অর্থাৎ বাঙালির রান্নাঘরে রীতিমত ঝড়-ঝঞ্জা, পরিবর্তন-পরিবর্ধন, উপকরণ গ্রহণ-বর্জন, অনেক কিছুই হয়ে গিয়েছে। তাই বাঙালির ইতিহাসের মধ্যযুগে রচিত কাব্যগুলো ছাড়া অতীত রোমন্থনের আর কোনও সুযোগ নেই।
প্রাচীন বাংলায় ধর্ম ও বর্ণ বৈষম্য, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যাপারটাও জড়িত ছিল দৈনন্দিন খাবারের বেলায়। পলি পড়ে এ ভূমি কেবল ধান জাতীয় শস্যের পরিকল্পিত চাষের এলাকায় পরিণত করেছিল এ ভূমিকে, তা নয়- শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাঙলা দেশের ইতিহাস (আদি পর্ব) ’ বইয়ে আখের থেকে উৎপাদিত চিনি ও গুড়ের রপ্তানির কথা জানা যায়। সরিষার চাষের পাশাপাশি ফলবান বৃক্ষেরও রীতিমত চাষ হত বলে জানা যায় এই বই থেকে। নারিকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল, ডালিম, কলা, লেবু, ডুমুর ইত্যাদি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আর ছিল বুনো লতাগুল্মেরও প্রাচুর্য। সেখান থেকেই সুস্বাদু পাতা বাছাই করে রান্না হত শাক। শুভদীপ বোয়াল তার এক লেখায় চর্যার বর্ণনার একটি বিশেষ দিক তুলে ধরেছেন অন্ত্যজ মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যে, সম্ভবত তারা ‘ওয়ান পট মিল’ এ অভ্যস্ত ছিল। কারণ ভাতের হাঁড়ির নানা প্রকরণ সে সময়ে ছিল, তবে কড়াইয়ের বর্ণনা কোথাও মেলে না।
এবারের গল্প এখানেই থামাই। মধ্যযুগের গল্প হবে না হয় অন্য কোনও সময়ে। তবে শেষ করার আগে, বয়োবৃদ্ধদের একটা কথা বলি- হয়ত তার প্রমাণ মিলবে ভেড্ডাদের সঙ্গে সম্পর্কিত এখনকার আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাসের দিকে তাকালেও। বয়োবৃদ্ধরা কথায় কথায় এখনো বলেন, ‘ফেনা ভাত আর কচু ঘেচু খাইয়াই ত তোর বাপ-দাদা আর তাগোও বাপ-দাদা বড় হইসে’। শিকার কালের পর এইসব টিউবার জাতীয় খাবার, মানে কচু-ঘেচু (মান কচু, মুখি কচু, কচুর লতি, শাক, ওল কচু ইত্যাদি) সঙ্গে ফেনা ভাত বা বুনো চালের ভাত যে আমাদের আদি খাবার ছিল, তাতে মনে হয় কোনও সন্দেহ রাখা আর উচিত নয়!
তথ্যসূত্র: কে টি আচায়া, ১৯৯৪ ইন্ডিয়ান ফুড: আ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন, অক্সফোর্ড
ইউনিভার্সিটি প্রেস।
মিজানুর রহমান, ২০১৯, উয়ারী-বটেশ্বর অ্যান্ড বিক্রমপুর, সাক্সেসফুল কেস স্টাডিজ ইন আর্কিওবোটানি, বাংলাদেশ, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর প্রিহিস্টোরিক অ্যান্ড কোয়াটারনারি স্টাডিজ।
লিন্ডা সিভেটেলো, ২০১১, ক্যুইজিন অ্যান্ড কালচার: আ হিস্ট্রি অফ ফুড অ্যান্ড পিপল, জন উইলি অ্যান্ড সন্স
কলিন টেলর সেন, ২০১৫, ফিস্টস অ্যান্ড ফাস্টস: আ হিস্ট্রি অফ ফুডস ইন ইন্ডিয়া, রিয়্যাকশন বুকস
জন পি অ্যালোক, ২০০৬, ফুড ইন দ্য এনসিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড, গ্রিনউড পাবলিশিং গ্রুপ
গোলাম মুরশিদ, ২০০৫, হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি, প্রথমা
এলিজাবেথ এ ক্ল্যারিক, ২০১০, ইনসাইড অ্যানসিয়েন্ট কিচেনস, ইউনিভার্সিটি প্রেস অফ কলোরাডো
অনিল কে পোখারিয়া, ২০১৬, নিওলিথিক টু আর্লি হিস্টোরিক (২৫০০বিসি-২০০এডি) প্ল্যান্ট ইউজ: দ্য আর্কিওবোটানি অফ গঙ্গা প্লেইন, ইন্ডিয়া, কোয়াটার্নারি ইন্টারন্যাশনাল
কে এস সরস্বত, ১৯৯২, আর্কিওবোটানিক্যাল রিমেইনস ইন এনসিয়েন্ট কালচারাল অ্যান্ড সোশিও-ইকোনমিক্যাল ডায়নামিকস অফ দ্য ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট, প্যালেওবোটানিস্ট।
রুবি ঘোষ, ২০০৬, প্ল্যান্ট রিমেইনস ফ্রম অ্যান আর্কিওলজিক্যাল সাইট এজ ইন্ডিকেটরস অফ ভেজিটেশন অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল প্র্যাক্টিস বিটুইন ৩৩২০ অ্যান্ড ২০৮০ ইয়ার বিপি ইন গাঞ্জেটিক ওয়েস্ট বেঙ্গল, ইন্ডিয়া, জার্নাল অফ ইন্টেগ্রেটিভ প্ল্যান্ট কায়োলিজি।
ডরিয়ান কিউ ফুলার, ২০০৯, সিরামিকস, সিডস অ্যান্ড কালিনারি চেঞ্জ ইন প্রিহিস্টোরিক ইন্ডিয়া, রিসার্চ
মনিকা এল স্মিথ, ২০০৬, দ্য আর্কিওলজি অফ ফুড প্রেজেন্স, আমেরিকান অ্যানথ্রোপলজিস্ট
নীহাররঞ্জন রায়, ১৩৫৬ (বঙ্গাব্দ), বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), দে’জ পাবলিশিং
রমেশচন্দ্র মজুমদার, ১৩৫৫ (বঙ্গাব্দ), বাংলাদেশের ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং
এবং ইন্টারনেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *