আমি দুর্গা দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি
(জয়া চৌধুরী)
আশ্বিনের শারদপ্রাতে… ব্লা ব্লা যা বলে এসব লেখা শুরু করতে হয় তা দিয়ে শুরু করলাম না। আসলে হয়েছে কী আমরা যারা কলকাতায় থাকি তাঁদের পক্ষে আশ্বিন কার্ত্তিক চোত বোশেখ সেরম কিছু ফারাক পড়ে না। বোশেখ বললে রবি ঠাকুর এবং তজ্জনিত চেনা দশটা কবিতা আবৃত্তি এবং তিরিশটা গান বুঝি। আশ্বিন বললেও ওই খবরের কাগজ বা পুজাবার্ষিকীতে শিউলি ফুল, কাশ ফুলের ছবি ও খানিক হাহুতাশ… এই সম্বল। হাহুতাশ কেন? সেকথা কী আর বলতে! সে আপনারাও বোঝেন। “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…”। এই আগের মোহতে আজকাল দেখি লোডশেডিংও প্রিয় হয়ে গেছে। মাইরি বলছি লোডশেডিং যখন প্রিয় হয়ে ওঠে স্মৃতিচারণে বুঝতে পারি কলিকালের ভারা পূর্ণ হল। হ্যাঁ, লোডশেডিং উপলক্ষ্যে আমারও কিছু ভাল ভাল ফাঁকি মারবার স্মৃতি নেই তা নয়। আমপচা গরমে ঠিক সন্ধ্যেবেলা সাতটা ফাতটা হবে সবে দুবোন পড়তে বসতাম (ভাই তখন ছোট্ট) ঠিক তক্ষুনি কারেন্ট চলে যেত। উফফ সে যে কী রিলিফ! ঘন্টা দুই প্রায় সে আরাম। তার মধ্যে বিকেলে ইস্কুল ফেরত লাইব্রেরী থেকে আনা স্বপনকুমারের বইটা হ্যারিকেনের আলোয় চটপট ফিনিশ করা, (ওই যে –“কোথা হইতে কী হইয়া গেল, দীপকের হাতে পিস্তল দেখা গেল”-র স্বপনকুমারের ডিটেকটিভ গল্পের বইয়ের কথা বলছি।), অন্তাক্ষরী খেলা ইত্যাদি হেবি মজায় কাটত। অবশ্য লোডশেডিং খুব দীর্ঘায়িত হলে তখন ঝগড়া ঝাঁটি হবার চান্স দেখা দিত- তুই চোট্টামি করেছিস, ‘স’ দিয়ে বললাম তুই ‘সখী কখনও আসে নি বুঝি আগে…” দিয়ে শুরু করলি কেন? ওটা তো ‘র’ দিয়ে শুরু রোদন ভরা… ইত্যাদি। কিন্তু খারাপটা? পরীক্ষার আগে দরদর করে ঘামতে ঘামতে অঙ্ক করছি, লসাগু যদি বা ম্যানেজ করতাম, গসাগু নির্ঘাত চোদ্দবার কাটাকুটি আর পাখার ডান্ডির মার…কিংবা রাত দুটোর সময় সবে মৈত্রেয়ীর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মির্চাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব বলে বই মুড়ে চোখ বুঝেছি অমনি ফ্যান বন্ধ। উফফ এর পরেও লোকে লোডশেডিং নিয়ে আদিখ্যেতা করে!
আর আশ্বিন যদি বলেন আপনারা তাহলে বাপু এখন কলকাতায় আশ্বিন মাসে এসি ১৮ তে ঘুরিয়ে আমরা ঘরে বসে নেটফ্লিক্স দেখতে পছন্দ করি। বাইরে কাশফুল না হোক টবে টুকটাক শিউলি ফুল ফুটল কিনা সেসব দেখার আগ্রহও কমেই গেছে বলা যায়। আসলে বয়সটাও তো অষ্টাদশী নেই আর। সে আপনি পুজোর প্যান্ডেলে যদি ঘুরতে চান তাহলে বেশি বয়সী নয় কম বয়সের ছেলেমেয়েদেরই দেখবেন। খুব নির্দিষ্ট করে বললে যুব জনতাকেই দেখবেন। সিংহী পার্কে অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দেখেছি যা সে সমীক্ষা ভিত্তিক এই প্রজ্ঞালব্ধ হয়েছে আমার। চাদ্দিকে শুধু ইয়ং জেনারেশন! হিসেব করে দেখি আমরা তার মানে নিজেদের জেনারেশনে বেবি বুমের সৃষ্টি করেছিলাম। সেসব বেবিরাই তো আজকের তরুণ সমাজ। মুশকিল হল আমরা ততটা বুড়ো হই নি তবু। কী যে করা! উভয় সংকট। নিজেরা সেই কলেজ লেভেলের মন নিয়ে চলছি, যৌবনের মধ্য গগন সদ্য অতিক্রান্ত করেছি, এখনও স্টিল জ্বাজ্জল্যমান সে যৌবন। দুম করে সে কলোচ্ছ্বাস ইয়ং জেনারেশন হাইজ্যাক করতে চাইলে ভাল লাগে কারো? ফ্রাস্ট্রু খেয়ে ওদের নিন্দে করা শুরু করে দিই। আসলে তো ভালই লাগে আজো প্রথম কাউকে ভাল লাগা, অমুকদা তমুকদির লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা হওয়া সবই পুজোর ভীড়ে প্যান্ডেল হপিং এর অজুহাতে। তবে সত্যি বলতে কী আগের মত বাধাও তো নেই মেলামেশায়। নৈকট্য হলে যা হয় আগ্রহ হারিয়ে যায়। তবুও এর ফাঁকেই সৎ কোন দৃষ্টি বিনিময় স্নিগ্ধ কোন হাসি বুকে টান ধরায়।
কথা বলতে বলতে হঠাত একটা জিনিষ মনে পড়ল। আমার কাজ হল স্প্যানিশ – বাংলা অনুবাদ করা। সারাক্ষণ একটা মন থাকে ইওরোপ, লাতিন আমেরিকার খপ্পরে আর অন্য মন থাকে মাছ ভাত মিষ্টি আত্মীয়ভাব কুচুটেপনা পরনিন্দা পরচর্চার কলকাতায়। সারাক্ষণই শাফল করছি শাটল ককের মত। এই মুহূর্তেও একটি উপন্যাসে ব্যস্ত আর্জেন্টিনার সমসময়ের এক বিশিষ্ট সাহিত্যিকের। সেখানে হঠাৎ পড়লাম “সেপ্টেম্বরের সকালে দারুণ গরমে ঘেমে ভিজে ঘুম ভেঙে গেল ফাদার উলাদিসলাও গুতিয়েররেসের…”। হাত থেমে গেল কম্পিউটারের কী বোর্ডের ওপর। সেপ্টেম্বরে এত গরম! কিছু পরে দেখি লেখিকা লিখছেন “সেবার ডিসেম্বরের ভয়ংকর গরমের মধ্যেই লা পেরিচোনা চলে গেলেন অনন্ত আকাশে…”। কলকাতার আমরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর কি ডিসেম্বর বললে মনের মধ্যেই হালকা হিম হিম ভেজা ভেজা ভাব অনুভব করি। বাস্তবে অবিশ্য ততটাও নয়… সে যাই হোক। আর ইনি কিনা পরিষ্কার মে মাসের আম পচা গরমের কথা লিখছেন ডিসেম্বর মাস ঘিরে! খেয়াল করে দেখি ওহ হ্যাঁ তো, দেশটি যে আর্জেন্টিনা। সেটি দক্ষিণ গোলার্ধে পড়ে ভৌগোলিক এলাকা অনুসারে। মনে মনে হিসেব করলাম তার মানে আমাদের দুর্গাপুজো যেমন সেপ্টেম্বর অক্টোবরে পড়ে ওদের ক্রিসমাসও তো পড়ে ডিসেম্বরে! মানে ওরা গরম কালে বড়দিন উদযাপন করে! ভাবতেই কেমন ঘেমে উঠলাম। ক্রিসমাস মানেই তো লাল টুপি, প্লাম বসানো কেক আর অজস্র পিকনিক যেখানে সোয়েটার, কমলালেবু, পাঁঠার মাংস, আর অন্ত্যাক্ষরী। আমরা এক আধবার পুজোয় বৃষ্টি পড়লে কত ইনিয়ে বিনিয়েই না কাঁদি! এরা যে আজন্মকাল পোড়া গরমে বড়দিন উদযাপন করেন! তারপর ব্যাপারটার ভাল দিক ভাবতে চেষ্টা করলাম। আমাদের কলকাতায় যেমন বড়দিন মানেই বাড়িতে বানানো অসাধারণ ফ্রুট কেক কিংবা নির্ভেজাল ওয়াইন বানান বোব্যারাকের বুড়ি আন্টিরা, আর্জেন্টিনায় সেরকম কিছু ডেলিকেসি তারা খান কী না! ঘেঁটেঘুটে এখনও নতুন কিছু তেমন পাই নি, ওই টার্কির রোস্ট আর রেড ওয়াইন সম্বল। অবিশ্যি ফল খান তারা। গ্রীষ্মকাল বলে রসালো ফলের প্রাচুর্য তখন। ইস্পেশাল খাবার বলতে সেসময় তারা খায় আলু মেয়োনিজ ও সিদ্ধ ডিম দিয়ে জাঁকালো করে বানানো এনসালাদা মানে স্যালাড এক রকমের যার নাম “এল ভিতেল তোনে”, লেটুস পাতা, ঠাণ্ডা শুয়োরের মাংস “খামোন সেররানো”, নানা ধরনের সালসা মানে সস, জমানো পুডিং, আইসক্রীম, বিশেষ করে প্রচুর রসালো ফল, পানীয় হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ফলের রস। অনেক আর্জেন্টিনাবাসী তখন বাগানেও উদযাপন করে থাকেন ক্রিসমাস। এখানে কিছুটা মুসলিমদের রমজানের ইদের সময় রোজা চলাকালীন সন্ধ্যের ইফতারে নিয়ম করে ফল খাওয়ার মিলে চোখ পড়ে যায়। আমাদের দুর্গাপুজোয় ফল খাওয়া ওই সপ্তমী অষ্টমী নবমীর অঞ্জলির প্রসাদের থালাতেই সীমাবদ্ধ। ও হ্যাঁ আর্জেন্টিনায় অবশ্য বাড়িগুলো লাল সাদা রঙের কাগজ ফানুস ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। হু হু বাবা, আমাদের কলকাতায় যত নিন্দে মন্দ করো না কেন বাপু দুর্গাপুজোর জাঁক, আভিজাত্য ও শৈল্পিক উৎকর্ষ অতুলনীয় মানে আন-প্যারালাল বটে। শুধুমাত্র চারদিনের উৎসবকে কেন্দ্র করে যে আগ্রহ, শিল্প সুষমা, উৎকর্ষ দেখা যায় তা সত্যিই অবাক করায়। কলকাতা থেকে দূরে নেটে বসে সেসব দেখলে খুব ভাল লাগে। আমার অবশ্য বদ স্বভাব। ভীড় দেখলেই মূর্ছা যাই। সুতরাং কলকাতায় বসেও টিভিতেই মা দুগগাকে নমো করি চারদিন। শুধু বিজয়ার দিন নিজে মন্ডপে গিয়ে মাকে আদর করে আসি। হ্যাঁ চারদিনই পুজো মানি। এখন কলকাতায় মহালয়া থেকে কালিপুজো পর্যন্ত দুর্গাপুজোর নামে যে অশ্লীল ধরণের পেশি প্রদর্শন চলে তাকে নিন্দা করি। প্রবল নিন্দা। প্রবাসী বাঙালিরা যে চারদিনের পুজো ছুটির দিন দেখে দুদিনে সম্পন্ন করেন তাকেই বরং দুহাতে স্বাগত জানাই। অধিক সব নিন্দনীয় যে। জীবন বদলে গেছে সব অর্থেই। তাই অল্পে গভীরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। ঢাক অবশ্য তারা মিস করেন। মানে কিনে সিডিতে বাজালেও আমাদের সিংহী পার্কে যখন জনা ছয় সাত ঢাকী পালক লাগানো ঢাক কাঁধে ঝুলিয়ে গোল করে দাঁড়িয়ে আরতির সময় বাজনা বাজায় তারই জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকি বছরভর। তুলনাহীন সে বাদ্য। এক পুজো থেকে অন্য পুজোয় মায়ের আসার জন্য সে কারণেই তো এত প্রতীক্ষা এত সব আয়োজন।
এই অস্থির কুটিল সশঙ্ক সময়ে নির্ভয় করো মাগো, নির্বাসনা দাও, সকলের কল্যাণ করো মা, পৃথিবীতে শান্তি দাও মাগো ।
প্রসীদ মাতর্বিনয়েন যাচে, নিত্যং ভব স্নেহবতী সুতেষু।
প্রেমৈকবিন্দুং চিরদগ্ধচিত্তে, বিষিঞ্চ চিত্তং কুরু নঃ সুশান্তম।।
জননীং সারদাং দেবীং রামকৃষ্ণং জগদগুরুম্।
পাদপদ্মে তয়োঃ শ্রিত্বা প্রণমামি মুহুর্মুহুঃ।।