Prabandho – Katota Chini Bangladesh

কতটা চিনি বাংলাদেশকে?
(শুভজ্যোতি ঘোষ)

পশ্চিমবঙ্গে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা আমার প্রজন্মের এমন অনেককেই জানি, যাদের বাংলাদেশের সঙ্গে সত্যিকারের পরিচয় কাজের সূত্রে বিলেত-আমেরিকার তীরে এসে ভেড়ার পর। 
চল্লিশ বা পঞ্চাশের সীমান্তবর্তী এই পশ্চিমবঙ্গীয়রা লন্ডনের ব্রিক লিনে বা নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে কাঁকরোল, কাঁঠালের বিচি বা ফ্রোজেন পাঙ্গাস মাছ কিনতে গিয়েই সম্ভবত তাদের জীবনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে আবিষ্কার করেছেন। এবং বাংলাদেশী বন্ধুদের বাড়িতে ভূরিভোজের আমন্ত্রণ পেয়েই প্রথম জেনেছেন ওটা ঠিক নেমন্তন্ন নয়, বিশুদ্ধ ‘দাওয়াত’। বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাদের বাবুসোনা নয়, একলপ্তে ‘পিচ্চি’ বলে ডাকাটাই সেখানে দস্তুর।
স্টিরিওটাইপিংয়ের আশঙ্কা নিয়েও বলতে পারি এই সব ছোট ছোট ন্যুয়ান্সেস, বিরিয়ানি আর বুরহানির সঙ্গে নির্ভেজাল বাঙালি গল্পগাছার সূত্র ধরেই ঘরের পাশে বিদেশকে তাদের একটু একটু করে চিনতে শুরু করা। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণ সংখ্যক বাঙালি যে পাশের ভূখন্ডটায় থাকেন, তাদের দেখার চোখ ও ভাবার মনটা যে কিঞ্চিৎ আলাদা আমাদের সেই উপলব্ধি কিন্তু তখন থেকেই। কিন্তু কলকাতায় থাকার সময় কেন চিনতে পারিনি, সেই প্রশ্নটা থেকে যায় বই কী!
আসলে আমার কেমন দৃঢ় বিশ্বাস, দেশভাগের পরবর্তী সাত দশকে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) মধ্যে যেভাবে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে – একই ভাষায় কথা বলা দুটো ভৌগোলিক ভূখন্ডের মধ্যে এমন দূরত্বের আর কোনও নজির সারা দুনিয়াতে নেই। কমিউনিস্ট যুগেও বার্লিন এর চেয়ে অনেক বেশি কোলন-বন-মিউনিখের খবর রাখত, এমন কী আজ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া উত্তরের অনেক বেশি খুঁটিনাটির সন্ধান রাখে।
আসলে পাকিস্তান আমলে তো বটেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেও দুই বাংলার যাত্রাপথ একেবারেই ভিন্ন খাতে বয়েছে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অজস্র বঞ্চনার মধ্যে নিজের অস্তিত্ত্বের লড়াই চালিয়ে গেছে, আর শূন্য থেকে শুরু করেও বাংলাদেশ লড়েছে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার যুদ্ধ।
আবার হাজারটা ভালমন্দ নিয়েও পশ্চিম যখন গণতন্ত্রের চর্চায় ব্যস্ত, পূর্বপ্রান্তে কিন্তু জেনারেলদেরই দাপট। রিফিউজি কলোনি বা জুট মিলের ট্রেড ইউনিয়ন থেকে একদিকে যখন বামপন্থীদের উত্থান, তখন অন্য দিকে কমিউনিস্টরা রাজনীতির মূল স্রোত থেকে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছেন। আবার ভারতে যখন উদার অর্থনীতির জন্য অবারিত দ্বার, বাংলাদেশ তখনও প্রায় সামন্ততান্ত্রিক শাসনে – সমাজজীবনে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নেই বললেই চলে। এ যেন এক ভাষা, অথচ দুই পৃথিবী।
ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আশির দশকে বা নব্বইয়ের গোড়াতেও আমরা যখন কলেজ-ইউনিভার্সিটি দাপিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজা-উজির মারছি, আমাদের তখন বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সমসাময়িক বাংলাদেশে কারা তখন ভাল লেখালেখি করছেন বা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে সেখানে কী ধরনের নিরীক্ষা চলছে।
আনন্দবাজার পূজাবার্ষিকীর সুবাদে হুমায়ুন আহমেদ বা ‘নির্বাচিত কলামে’র দৌলতে তসলিমা নাসরিনের নাম তখন সবে একটু-আধটু কানে আসতে শুরু করেছে –আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক দেরি। পশ্চিমবঙ্গ তখনও জর্জদা কিংবা সুচিত্রা-কণিকাতেই মজে, ছায়ানট আন্দোলনকে ঘিরে ওয়াহিদুল হক বা সনজিদা খাতুনরা বাংলাদেশে যে কী উথালপাথাল ঘটিয়ে দিচ্ছেন তার কোনও ঢেউই এপারে এসে পৌঁছয় না। রাজ্জাক নামধারী এক নায়করাজ যে সে দেশে উত্তমকুমারের মর্যাদায় পূজিত, তারই বা খবর ক’জন রাখত?
বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয়ের সবচেয়ে জোরদার সূত্রটা ছিল বি-টিভির কিছু জনপ্রিয় নাটক বা সিরিয়াল। সেই বিবর্ণ দূরদর্শনের যুগে অ্যান্টেনার বুস্টার নাড়াচাড়া করে পশ্চিমবঙ্গীয়রা সাদা-কালো পর্দায় ‘বহুব্রীহি’ বা ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মতো বিদেশি টেলিনাটক হামলে পড়ে দেখতেন, সম্পর্ক বলতে এটুকুই! কিন্তু পাশের দেশটা সম্পর্কে তাদের কোনও স্বচ্ছ ধারণাই ছিল না বললে বোধহয় এতটুকু ভুল বলা হবে না।
অথচ পরে সমবয়সী বাংলাদেশী বন্ধুদের কাছে শুনেছি, তারা কিন্তু স্কুল-কলেজেই সুনীল-শীর্ষেন্দু গোগ্রাসে গিলেছেন – এমন কী অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে কিংবা সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা পর্যন্ত বাদ যায়নি। হতে পারে সেগুলো ছিল শস্তা কাগজে ছাপা পাইরেটেড এডিশন, কিন্তু সীমান্তের ওপারে পৌঁছত ঠিকই। আর আকাশবাণীতে অনুরোধের আসরে কান পেতে হেমন্ত-সতীনাথকে শোনা তো ছিল প্রিয় অভ্যেস, কেউ কেউ এমনও বলেছেন আমিন সায়ানির ‘বিনাকা গীতমালা’য় ঝুমরি তিলাইয়ার পাশাপাশি না কি ফরমায়েশ যেত বাংলাদেশের ঝালোকাঠি থেকেও!
সোজা কথায়, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ, এমন কী বলিউড বা দিল্লির রাজনীতিও তাদের কাছে অচেনা মুলুক ছিল না মোটেই । অথচ আমরা, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ঘুণাক্ষরেও জানতাম না বেনাপোলের ওপারে গিয়ে যশোর রোডের কী গতি হল! জানার চেষ্টাও করিনি, হয়তো উপায়ও ছিল না।
সে আমলে কলকাতায় কোনও বেসরকারি বাংলা চ্যানেলও ছিল না, তাদের রিয়েলিটি শো-র জন্য ঢাকা বা চট্টগ্রামে গিয়ে অডিশন নেওয়ারও তাই প্রশ্ন ছিল না। কলকাতায় বাংলা সাংবাদিকতার স্তম্ভ, আনন্দবাজার বা যুগান্তরে বাংলাদেশের খবর ঠাঁই পেত সাতের পাতার কোণার দিকে – যদি ফাঁকফোকর মেলে তবেই। আজ কলকাতার বিভিন্ন খবরের কাগজে আলাদা ‘বাংলাদেশ পেজ’ও একেবারেই হালের সংযোজন।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াও অনেক পরের কথা, কাজেই খেলার পাতাতেও তখন কোথায় আজকের ‘টাইগার’রা? তবে ঢাকার আবাহনী ক্রীড়াচক্র বা মহামেডান মাঝেমধ্যে কলকাতায় খেলতে আসত, আশির দশকে বাংলাদেশী তারকা মুন্নাও বেশ কিছুদিন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে চুটিয়ে খেলে গেছেন – ফলে এটুকু শুধু জানতাম ওপারেও ফুটবল চর্চাটা জমিয়েই হচ্ছে। কিন্তু সেই প্রাক-ইন্টারনেট বা প্রাক-স্মার্টফোন যুগে বাংলাদেশ যে পশ্চিমবঙ্গর কাছে ঠিক কতটা দূরের গ্রহ ছিল, আজকের প্রজন্মের কাছে তা কল্পনারও অতীত।
বাহাত্তর সালের গোড়ার দিকে এক নবীন রাষ্ট্রের জনক এবং স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কলকাতায় এসে যে বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন তা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গীয়দের সেই উদ্দীপনা আর উন্মাদনা স্তিমিত হতেও বেশি সময় লাগেনি, ইতিহাস কিন্তু তারও সাক্ষ্য দেবে।
তার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে – বহু শরণার্থীর না-ফেরা, গঙ্গার বুকে ফারাক্কা বাঁধ, ঢাকায় ক্ষমতার ক্রমিক পালাবদল, স্বৈরশাসন ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের পদধ্বনি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বাস্তবতা এটাই – এই ফ্যাক্টরগুলোই ক্রমশ একটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দেওয়াল তৈরি করেছিল দুই পড়শীর মধ্যে, যা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে একটা সময় বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গের কাছে প্রায় অচেনা করে তোলে। আর আমরা সেই দুর্ভাগা প্রজন্মেরই সন্তান।
অথচ আমাদের বাপ-জ্যাঠারা এই মুলুক থেকেই ইতিহাসের এক অভিশপ্ত পর্বে রাতারাতি ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী। যে জমিজিরেত হারিয়ে সর্বস্বান্ত, তাও আজ বাংলাদেশের গর্ভেই। পরবর্তী প্রজন্মেও পার্টিশন নিয়ে ঋত্বিক ঘটক-সুলভ বিষাদমাখা নস্ট্যালজিয়া থাকবে তা অবশ্য আশা করা যায় না, কিন্তু সেই বাংলাদেশ নিয়ে তাদের চরম উদাসীনতা আর অনাগ্রহেরও ব্যাখ্যা মেলা কিন্তু কঠিন। আমি অন্তত বিস্তর ভেবে এই উত্তরই পেয়েছি – নানা কারণে একটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের কাছে বড় বেশি অপরিচিত, অজানা হয়ে উঠেছিল।
সেই অপরিচয়ের বেড়াটা ভাঙতে বড্ড সময় লাগছে, এখনও অনেকটা বাকিও আছে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গ অনেকদিন ধরে অল্পস্বল্প শুনে এসেছে, বাংলাদেশ না কি ইসলামী মৌলবাদের আঁতুরঘর এবং তাদের ঘরের পাশে একটা টাইম বোমা। আমরা খুব একটা গা করিনি, কিন্তু বছরকয়েক আগে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবি জঙ্গীদের ডেরায় বিস্ফোরণের পর সহসা বোঝা গেল বাংলাদেশী জঙ্গীদের জাল এ রাজ্যেও কতটা বিছিয়েছে। কলকাতা যেন ঘুম ভেঙে হঠাৎ আবিষ্কার করল, বাংলাদেশে মৌলবাদের শিকড় কতটা গভীরে।
এই তো বছরতিনেক আগে গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলার পর এপার বাংলা শিউড়ে উঠে বলল, ‘ও মাই গড, এবার ঢাকাতেও!’
আজও অনেক কলকাতাবাসী বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেন ‘শেখ হাশিনা’। হাসিনা-র নামে ‘স’-এর উচ্চারণ যে ইংরেজি S -এর মতো, সেটুকুও তারা কখনও খেয়াল করেননি বা কেউ তাদের শুধরেও দেয়নি। এই অচেতন অবজ্ঞায় বাংলাদেশীরা কেউ কষ্ট পেয়েছেন, কেউ বা শুধু মুখ টিপে হেসেছেন।
আবার তারাই যখন কলকাতার এসপ্ল্যানেডে এসে বিলবোর্ড বা দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজি বা হিন্দির বাড়াবাড়ি দেখে আক্ষেপ করেছেন, তাদের বোঝাতে পারিনি পশ্চিমবঙ্গকে একটা বিরাট দেশের অংশ হয়ে বাঁচতে হয় – বাংলা নিয়ে অত বিলাসিতা করা তার সাজে না। একুশের আবেগে ঋদ্ধ ঢাকা মাতৃভাষায় নিজেদেরকে যেমন খুশি সাজাতে পারে, কিন্তু কলকাতার ছেলেদের চাকরি খুঁজতে জয়পুর-ব্যাঙ্গালোর-দিল্লিতেও যে পাড়ি দিতে হয়। হিন্দি তাদের ভাত না-পরুক, রুটি তো জোগায়!
প্রায় এক যুগ আগে বাংলাদেশের মুহাম্মদ ইউনুস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন, দুনিয়ার কোটি কোটি বাঙালির সঙ্গে উদ্বেলিত হয়েছিল কলকাতাও। কিন্তু ইউনুস-স্তুতিতে ভেসে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ কখনও জানার চেষ্টা করেনি, তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণের কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরেও কী পরিমাণ ধুন্ধুমার বিতর্ক আছে। ড: ইউনুসের স্বীকৃতিতে বাঙালি হিসেবে গর্বিত হওয়ার হক নিশ্চয় কলকাতারও আছে, কিন্তু তার ‘ক্ষুদ্র ঋণে’র সুদের হার নিয়ে সে দেশের মানুষজন কী বলছেন সেটাও কিন্তু জানা জরুরি ছিল। অথচ ওই যে, সেই অপরিচয়ের বেড়া তা জানতে দেয়নি।
এমন দৃষ্টান্ত আরও অজস্র দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লেখার বহর বাড়িয়ে লাভ নেই।
মান্না দে-র আইকনিক গানে কফি হাউসে আড্ডা মারা সাংবাদিক মঈদুল রাতারাতি ঢাকায় পাড়ি দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুরাও আর তার খবর রাখার গরজ দেখায়নি, অথবা রাখতে পারেনি।
আজকের যুগ হলে মঈদুলের সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা চ্যাট, কিংবা তার চোখ দিয়ে তার দেশকে চেনাটা কোনও সমস্যাই হত না। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায়অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে বেশিটা সময় প্রতিবেশী বাঙালিরা তাদের ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারেননি, বাস্তবতা এটাই।
*******************************************************************************
পুনঃশ্চ : সাংবাদিকের চোখে এই লেখা। পরবর্তী সংখ্যাতে লেখক আরো তথ্য নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করবেন।
লেখক পেশায় সাংবাদিক, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের হয়ে দিল্লিতে কর্মরত। সাংবাদিকতা শুরু কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়। বিবিসির কাজের সূত্রে এক যুগেরও বেশি সময় লন্ডনে কাটিয়ে এখন আবার স্বদেশে থিতু। আশি ও নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে বেড়ে ওঠা এক যুবকের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছেন তিনি।

(সমাপ্ত)

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *