Prabandho – Pouranik Narir Naborupayan

পৌরাণিক নারীর নবরূপায়ণ : সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে

পূরবী বসু


কবি মনজুরে মওলা সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলমে’ লিখেছেন, “পুরাণ ব্যবহার করার স্বাধীনতা যেমন সব শিল্পীরই আছে, পুরাণ থেকে সরে আসার অধিকারও তেমনি সব শিল্পীর আছে। পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তাকে ঠিক তেমনি করে তুলে ধরার দায় শিল্পীর নেই। সত্যি বলতে কি, পুরাণে, বা, ইতিহাসে যা আছে, তা ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করলে শিল্প রচনার কোনও মানে থাকে না, যদি না, যা আছে, তার কোনও বদল না করেও শিল্পী তার মধ্যে নতুন জীবন সঞ্চার করতে পারেন, তাকে নতুন অর্থ দিতে পারেন, তাকে সমকালীন করে তুলতে পারেন। জীবনকে তিনি নিজের মতো করে যেভাবে দেখেন, সেভাবে তুলে ধরতে পারেন। উৎসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা অসম্ভব নয়, কিন্তু বিশ্বস্ত থেকে তাকে নতুন করে তোলা সহজ নয়।”

সাহিত্যে পুরাণকে নবরূপায়ণে পরিবেশন লেখকদের জন্যে একটি অতি পরিচিত, স্বীকৃত ও নন্দিত পদ্ধতি, যে রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে। তবে বাংলা সাহিত্যে এর প্রচলন আগে আরো বেশি ছিল, বর্তমান সময়ে পৌরাণিক চরিত্র বা বিষয়ের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। সংস্কৃতে লেখা শ্রুতিমধুর কাব্য ভাগবত পুরাণের প্রথম অনুবাদ হয় বাংলায়, করেন মালাধর বসু এবং এর বাংলা নামকরণ হয় ভাগবত। ১৪৭৩ সালে মালাধর ভাগবত পুরাণের বিষয়বস্তু অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা শুরু করেন। সেই কাব্য রচনা শেষ হয় ১৪৮০ সালে। এই কাব্যের আরেক নাম গোবিন্দমঙ্গল। বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের উদ্দীপ্ত করতে এই গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এই কাব্য চৈতন্যদেবের মতো ভক্ত ও দার্শনিকের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের আদলে নরনারীর প্রেম সংক্রান্ত কবিতা, সংগীত ও গল্প-উপন্যাস রচনার দ্বার খুলে দেয়। আজো সেই জোয়ারে ভাসছে বাংলা। শত সহস্র রূপে তার প্রকাশ, ব্যঞ্জনা ও অভিব্যক্তি।

পৌরাণিক যেসকল নারী চরিত্র বিভিন্ন পুরাণ-গ্রন্থে বর্ণিত রূপে বা প্রতীকি সংকেতে বাংলা সাহিত্যে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে , তারা হলো দ্রৌপদী, রাধা, সীতা, শকুন্তলা, দুর্গা (পার্বতী, উমা, সতী, কালী),  কুন্তি ও চিত্রাঙ্গদা। কবি  ও নাট্যকারের অসীম কল্পনায় এবং তাদের নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় পুরাণের মূল কাঠামো (কাহিনী ও চরিত্রসহ), অতি সহজেই ভেঙে পড়ে। মেদ-মাংসহীন সেই কাহিনীর মৌলিক কাঠামোতে তখন নিজের কল্পনা মিশিয়ে বিনির্মাণ করেন লেখক এমন সব চরিত্র ও কাহিনী, যা আবহমান কাল ধরে পাঠকের কাছে গৃহিত হয়, তাদের আন্দোলিত করে, দেশ-কাল-ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের হৃদয়কে দোলা দেয়। প্রাচীন কাহিনীর সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা এবং আধুনিক জীবনের বহু অনুষঙ্গ মিশিয়ে তৈরি করেন তারা নতুন এক সাহিত্য যার গ্রহণযোগ্যতা, নান্দনিকতা, ও নতুনত্বের আবেদন অনেক বেশি জোরালো ও স্থায়ী। এই নবরূপায়নের সময়, বেশীর ভাগ সময়েই আদিকালের পাত্রপাত্রীকে বর্তমান সময়ের নরনারীতে পরিণত করা হয়। নির্মলেন্দু গুণ যেমন আজকের সংসারকে সেকালের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। “সূচাগ্র সুখের কণা কেহ কারে সহজে দেবে না/ সংসার যুদ্ধের সুখ পায় স্বেচ্ছা পরাজিত সেনা”(‘কুরুক্ষেত্র’ কবিতা)।

পুরাণের এই ধরনের নব রূপায়ন বহু লেখক অনেককাল ধরেই করে আসছেন, যার বিস্তারিত বিবরণ বা তালিকা দেওয়া কঠিন। কিন্তু কেবল উদাহরণ টানার জন্যে এঁদের ভেতর মাত্র কয়েকজন লেখকের লেখা থেকে শুধু একটি বা কয়েকটি রচনার উদ্ধৃতি দেওয়া হোল নীচে :
মালাধর বসু (শ্রীকৃষ্ণবিজয় বা গোবিন্দমঙ্গল কাব্য), কালিদাস (অভিজ্ঞান শকুন্তলা; সংস্কৃতে কাব্য), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (শকুন্তলা ও সীতার বনবাস; কাব্য), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (কৃষ্ণচরিত্র; প্রবন্ধ, শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা; প্রবন্ধ), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (শর্মিষ্ঠা;  নাটক, মেঘনাথবধ কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কর্ণকুন্তি সংবাদ, চিত্রাঙ্গদা, নরকবাস, বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন, বাল্মিকী প্রতিভা; কাব্যগীতি), রাজশেখর বসু পরশুরাম ছদ্মনামে (হনুমানের স্বপ্ন, পুনর্মিলন, যযাতির জরা; রম্যরচনা), উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (ছোটদের মহাভারত, পুরাণের গল্প ১ ও ২;  শিশু সাহিত্য), মানিক বন্দোপাধ্যায় (দুঃশাসনীয়, রাঘব মালাকার; ছোটগল্প), বুদ্ধদেব বসু  (রাবণ, প্রথম পার্থ, মহাভারতের কথা, দময়ন্তী ও দ্রৌপদীর শাড়ি, শীতের প্রার্থনা বসন্তের উত্তর; কবিতা, তপস্বী ও তরঙ্গিনী; কাব্যনাটক ), বিষ্ণু দে (এবং লক্ষিন্দর, উত্তরাসংবাদ; কবিতা), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (রাধাকৃষ্ণ; উপন্যাস), গজেন্দ্র কুমার মিত্র (পাঞ্চজন্য; উপন্যাস), সুবোধ ঘোষ (ভারত প্রেমকথা; পৌরাণিক প্রেমাখ্যান), সমর সেন (উর্বশী, স্বর্গ হতে বিদায়; কবিতা), প্রতিভা বসু (মহাভারতের মহারণ্যে : মহাভারতের চরিত্র ও ঘটনার স্বতন্ত্র ও অভিনব ব্যাখ্যা; বিশেষ করে দ্রৌপদী চরিত্রটির প্রতি সম্মিলিত অবিচারের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন সম্মিলিত পুরুষদের কামনা-বাসনার সামগ্রী হয়ে দ্রৌপদী খেলার বলের মতো সারাজীবন এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরিত হয়ে তদের ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছেন), সমরেশ বসু কালকূট ছদ্মনামে (শাম্ব – সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত; উপন্যাস), সব্যসাচী (কৃষ্ণা; কবিতা), শরৎ কুমার মুখোপাধ্যায় (বেহুলার প্রতি অর্ফিউস; কবিতা), শঙ্খ ঘোষ (আরুনি উদ্দালক; কবিতা),  শওকত আলী (প্রদোষে প্রাকৃতজন; উপন্যাস, শুন হে লক্ষীন্দর; ছোটগল্প), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (এক যযাতি, ফিনিক্স; ছোটগল্প), আল মাহমুদ (কৃষ্ণকীর্তন; কবিতা), বিনয় মজুমদার (মহাদেবের জটা; কবিতা), পূর্ণেন্দু পত্রী (আমিই কচ, আমিই দেবযানী; কবিতা), সেলিনা হোসেন (নীল ময়ূরের যৌবন, কালকেতু ও ফুল্লরা; ইতিহাস ও লোকগাথাভিত্তিক উপন্যাস), সেলিম আল দীন (প্রাচ্য উপাখ্যান), নির্মলেন্দু গুণ (কুরুক্ষেত্র; কবিতা), ফরহাদ মজহার (শিবানী বন্দনা; ১, ২, গদ্য ও কবিতা), মুহম্মদ নূরুল হুদা (শুক্লা শকুন্তলা, অর্জুন অর্জুন; কবিতা), সাদ কামালী (অনূঢ়া আখ্যান, সুবলাদাসীর ধর্মযুদ্ধ; ছোটগল্প), শাহনাজ মুন্নী (রূপময়ীর ছয়টি হাত; ছোটগল্প),  বুলবুল চৌধুরী (টুকা কাহিনী; ছোটগল্প), নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী (সত্যান্বেষী; উপন্যাস), সেজান মাহমুদ (অগ্নিবালক; উপন্যাস), মাহবুব সাদিক (দ্রৌপদীর শাড়ি; ছোটগল্প), প্রশান্ত মৃধা (যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী; ছোটগল্প), নিয়াজ জামান (A Different Sita; ইংরেজিতে ছোটগল্প), পূরবী বসু (প্রতিমা পুরাণ, বারে বারে ফিরে ফিরে, যুথিষ্ঠিরের সহোদর, যুথিষ্ঠিরের বোন, লক্ষ্মীন্দরের বাসর; ছোটগল্প, লিটন তোমার অন্তহীন পাঞ্জাবী; কবিতা), আমিনুর রহমান (একাকী যাব না স্বর্গে; কবিতা), সেলিম আলদীন (প্রাচ্য), মোজাম্মেল বিশ্বাস (জেগে ওঠো লক্ষিন্দর; কবিতা), লক্ষ্মীপ্রসাদ (দ্রৌপদী; তেলুগুতে উপন্যাস, ২০১১ সালে সাহিত্য আকাদমী পুরস্কারপ্রাপ্ত), অনুরাগ আনন্দ (The legend of Amropali, ২০১২; ইংরেজিতে Historical  Novel), মার্গারিত ইউরসেনার (Kali Beheaded- ছোটগল্প; বেলজিয়ান)। বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি কিশোরগঞ্জের চন্দ্রাবতী (১৫৫০-১৬০০) পিতার উৎসাহে বাংলায় ‘রামায়ণ কথাঃ’ লেখেন। এ এক ভিন্ন ধরণের রামায়ণ। এটি মূল রামায়ণের অনুবাদ নয়। বরং নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এই রামায়ণে সীতার প্রতি অবিচার এবং তার মর্মবেদনা অত্যন্ত দরদের সঙ্গে পরিবেশিত হয়েছে। চন্দ্রাবতীর স্বহস্তে লিখিত রামায়ণের পান্ডুলিপিটি এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের মতোই বুদ্ধদেব বসু-ও পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে বিশেষ করে মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রকে নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। মূল কাহিনী ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করেছেন প্রাচ্যশাস্ত্রের অংশবিশেষ। পুরাণের অন্তর্নিহিত অর্থ বা ব্যঞ্জনাকে তিনি কখনো দার্শনিক অভিজ্ঞানে, কখনও রোমান্টিকতায় আবার কখনও নারীর অস্তিত্ব রক্ষার আবেদনে বা বিশেষ ঘোষণা কিংবা প্রত্যয়ে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। যেমন তাঁর ‘নতুন পাতা’ কাব্যগ্রন্থের ‘সমুদ্রস্নান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, “ফুটে উঠুক, কিছু ফুটে উঠুক তোমার আমার সংস্পর্শে, তোমার আর আমার মাঝখানে যেমন একদিন পৃথিবী ফুটে উঠেছিলো পদ্মের মতো বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে।” শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় সরাসরি প্রাচ্য পুরাণ খুব একটা ব্যবহার করেন নি। তবে বিধ্বস্ত নীলিমা গ্রন্থের ‘পুরাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- “আমাকে জড়ায় সত্য, অর্ধসত্য কিংবা প্রবচন, তবু জানি কিছুতে মজে না মন বাতিল পুরাণে।” এই কথার ভেতর দিয়ে তিনি পুরাণের অর্থহীনতা ও আজকের যুগে তার অচলতা, অসারতা ও অনুপযুক্ততা প্রকাশ করেছেন। তারপরেও, পুরাণ দ্বারা, বিশেষত পশ্চিমী পুরাণ দ্বারা তিনি যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে হয়।  কোন কোন কবিতায় তিনি প্রাচ্য পুরাণের নানা অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ, চরিত্র ও ঘটনাও অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে সীমিতভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে সেসব প্রধানত পৌরাণিক নাম বা শব্দ ব্যবহার। কাহিনী বা চরিত্রের বিস্তার বা পুনর্নির্মাণ নয়।  উদাহরণস্বরূপ,  দেখা যায় তাঁর কবিতার শরীরে গেঁথে আছে, ‘মায়ামারীচ’, ‘খাণ্ডবদাহন’, ‘জতুগৃহ’, ‘কালকূট’, ‘বাল্মিকী’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘শিখণ্ডী’ প্রভৃতি শব্দাবলী।

বছর সাতেক আগে (২০১২ সালে) প্রকাশিত অনুরাগ আনন্দের লেখা “The legend of Amrapali” একটি ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস। এখানে আম্রপালির নগরবধূ হয়ে ওঠার ভিন্ন কারণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সৃজনশীল লেখক তাঁর কল্পনা মিশিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন, আম্রপালির কৈশোরকাল থেকে এক প্রেমিক ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তার সৌন্দর্য্যে আত্মহারা হয়ে রাজ্যের রাজা যখন তার প্রেমে পড়লেন প্রবলভাবে, ঈর্ষান্বিত হয়ে একদিন তিনি আম্রপালির প্রেমিককে খুন করে ফেলেন। আম্রপালি কিন্তু তারপরেও রানী হতে অস্বীকৃতি জানায় রাজাকে। রাজা তারপর আম্রপালিকে শাস্তিস্বরূপ নগরবধূ বানিয়ে দেন যাতে রাজ্যময় সকলে তাকে ভোগ করতে পারে, যেহেতু একভাবে তাকে ভোগ করার অধিকার অর্জনে সে ব্যর্থ হয়েছিল।

কালীকে নবরূপায়ণে উপস্থাপিত করেছেন এক বিদেশি নারী গল্পকার। তিনি লেখেন, চরাচরের এমনই একটা ঘোর অন্ধকারে, পৃথিবীর এক বড় দুঃসময়ে শিবসহ সব দেবতা মিলে স্থির করেন কালীর আবির্ভাব মর্তে একান্তই জরুরি এই মুহূর্তে। সঙ্গে সঙ্গে দেবকুলের নির্ধারিত শর্তে মর্তে এসে হাজির হন কালী। কিন্তু কালীর ক্ষমতা, শক্তি ও বীরত্ব দেখে দেবতারা শঙ্কিত এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তারা কালীর গলা কেটে ব্যবচ্ছেদ করে দেন। পরে নিজেদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তারা ফের কালীর ধড় ও মস্তক একত্রে জোড়া লাগাতে মর্তে আবির্ভূত হন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় ঘটে যায় এক মহাবিপর্যয়। কালীর খন্ডিত মাথাটি যেখানে গিয়ে পড়েছিল সেখান থেকে মহানগরের সবচেয়ে বড় গণিকালয় খুব দূরে নয়। সেদিনই সন্ধ্যায় সেই গণিকালয়েও একটি গণিকাকন্যা খুন হয়। ওই পল্লীতে এ রকম মাঝে মধ্যে দু-একটা নারীর খুন হওয়ার ঘটনা খুব অসাধারণ বা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কোন খরিদ্দার, নাকি কোন ঈর্ষাকাতর গোপন প্রেমিক অথবা গণিকালয়ের স্বার্থান্বেষী কোন দালালের সঙ্গে অর্থ নিয়ে অবনিবনা হওয়ায় মেয়েটির ধড় থেকে গলা কেটে মস্তকটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য দায়ী, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মৃতদেহের দুটো টুকরোই অর্থাৎ মস্তক ও ধড় দুটোই টেনে এনে গণিকালয়ের লোক ফেলে দিয়েছিল নিকটবর্তী সেই মাঠে, যেখানে অনেক দূর থেকে বাতাসে উড়ে এসে পড়েছিল সেই অকুতোভয়, অসুরবিনাশিনী কালীর ধড় আর কাটা মুন্ডুটিও। স্বর্গ থেকে দেবতার চর এসে যখন দেখে সেখানে মাঠের ওপর পড়ে আছে পাশাপাশি দুটি মস্তক ও দুটি ধড়, সে তাড়াতাড়ি করে সঠিক মুন্ডটি বেছে নিয়ে ওটাকে জোড়া দিয়ে দেয় ভুলক্রমে পাশেই পড়ে থাকা গণিকার ধড়ের সঙ্গে। অতঃপর তাতে প্রাণ সঞ্চার করে স্বর্গের দেবতারা। সব কাজ শেষ হলে শিব দূর থেকে মন্ত্র পড়ে তাকে কালীতে রূপান্তরীতে করেন। কিন্তু কেউ তখনো জানে না যে, মুন্ডুটা কালীর হলেও শরীরটা একজন গণিকা কন্যার। ফলে রুদ্রময়ী কালী তার তরবারি দিয়ে দুর্জনকে একনাগারে বধ করে গেছেন সত্য, গলায় পরেছেন ব্যবচ্ছেদ করা দুর্জনের খন্ডিত মুন্ডুর মালা। নিহত বা আহত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে একটি করে মহাসুরের নতুন করে জন্ম রোধ করার উদ্দেশে কালী ক্রমাগত রক্ত চুষে নিতে থাকেন তার সদ্য বধ করা তাবৎ শিকার থেকে। কিন্ত এই যে বিশাল শক্তিধর, প্রচন্ড সাহসী, বীর কালী যে বিশ্বসংসারে সংশয় ও শঙ্কাবিহীন বলে পরিচিত, সে কিন্তু রাত হলেই অন্য এক নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তার দেহ, যা আসলে এক গণিকার দেহ, তাকে প্ররোচিত করতে থাকে গণিকালয়ের খুপরিতে ঢুকে যেতে এবং জানালার পাশে বসে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, নেচে-কুঁদে-গেয়ে খদ্দেরের মন ভোলাতে। তারপর রাতভর শরীর-শরীর খেলায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতে থাকে সে। দিনের কালীর ন্যায়পরায়ণতা ও প্রচন্ড দাপটে দুর্জন বধের আকাঙ্খা আর রাতের কালীর শরীর থেকে উৎসারিত অসীম ভোগের আকাঙ্ক্ষা মিলে যে দেবতার সৃষ্টি হয় সেই কালীই হয় মানুষের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন এবং চেনা দেবতা। কেননা সে শুধুই কল্যাণময়ী, শুধুই দুর্জনবধকারী, শুধুই সব ভালো এবং দেবতুল্য গুণের সমন্বয় নয়; সে কেবলই শক্তির প্রতীক নয়, তার মস্তিষ্ক যাই বলুক, তার শরীর লালায়িত হয়ে ওঠে পুরুষ সঙ্গলাভের জন্য। উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণী আকর্ষণীয় দেহবল্লভী নিয়ে তখন সে প্রকাশ করে তার ভোগের জন্য কাতরতা। বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন ছলাকলা তাকে মানবিক করে তোলে। ভালো ও মন্দের একত্র সহবাস, একই শরীরে ভক্তি ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা কালী দেবীকে আমাদের কাছের মানুষ বানিয়ে ফেলে। একজনের দেহ ও অন্যজনের মুন্ডু দিয়ে গড়া এই সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের কবন্ধ কালীকে আবিষ্কার করেছিলেন উপকথা নিয়ে গল্পরচনাকারী বিখ্যাত নারী-লেখক মারগারিত ইউরসেনার, বেলজিয়ামে যাঁর জন্ম এবং ফ্রান্স ও আমেরিকার যৌথ নাগরিক ছিলেন যিনি।

শুধু সাহিত্যে নয়, পুরাণের কথা ও লোকগাথা বহু মঞ্চায়িত অথবা রেকর্ডকৃত বাংলা নাটকেরও উপজীব্য। কাজী নজরুল ইসলাম লেটোর দলে পালা গান লিখতে গিয়ে এবং গ্রামোফোনে রেকর্ড করতে গিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করেন। এসবের অনেকগুলোরই আজ আর হদিশ পাও্য়া যায় না। তবে অন্যান্য রেকর্ডের মধ্যে তার লেটোর দলের জন্যে লেখা পালা গান ‘শকুনি বধ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উদ্ধার করা হয়েছে। তখনকার দিনের প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষের রচিত কিংবদন্তী কবি ও বচন রচয়িতা খনাকে নিয়ে রচিত ‘খনা’ বহুভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। নেপালের গোয়ালঘর থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর চর্যাপদ আবিষ্কারের কিছুকাল পর থেকে নারী-পুরুষের প্রেম ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে রচিত বিশেষ করে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে রচিত নাটক ক্রমাগত মঞ্চায়িত হতে থাকে, সাহিত্য ছেয়ে যায় রাধাকৃষ্ণের আদলে নরনারীর প্রেমে, সংগীতে। বিশেষ করে বোষ্টমীদের মুখে মুখে উপচে পড়ে রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব প্রেম। তবে আঠারোশ সালের আগে নারী চরিত্রেও মঞ্চে পুরুষরাই সাধারণত অভিনয় করতো। মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটকের মধ্য দিয়ে মূলত নারীদের মঞ্চে প্রবেশ। কেননা আধুনিকমনস্ক বিদেশী সংস্কৃতিত্র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশা ও সেখানকার নাটকের সঙ্গে পরিচিত মধুসূদন পুরুষকে দিয়ে নারী চরিত্রের মঞ্চায়নে অস্বীকৃতি জানালে বাধ্য হয়ে কলকাতার নাট্যশালায় তখন নারী চরিত্রে অভিনয় করতে উঠে আসেন বারবণিতা, বাইজী, বারাঙ্গনার মতো বাইরের মেয়েরা। ভদ্রঘরের কন্যা ও বধুরা তখনো মঞ্চে যাবার অধিকার বা সাহস পায়নি। সেই সময়ে নটী বিনোদনীই প্রথম বহু পৌরাণিক নারীর ভূমিকায় যেমন দ্রৌপদী, সীতা, রাধা, সাবিত্রী রূপে মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে তার অভিনয়কলায় সকলকে বিমোহিত করতেন।  এর অনেক পর যখন ভদ্র ঘরের মেয়ে-বধূরা মঞ্চ অভিনয়ে এগিয়ে এসেছেন, তখন শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয়ে করা ‘নাথবতী অনাথবথ’ নাটকে দ্রৌপদী ও তার পঞ্চ স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও মনোভাবের কথা নবরূপে রূপায়িত হয়েছে। মনসা ও চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে শম্ভু মিত্রের লেখা ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি  ঢাকা ও নিউ ইয়র্কে মঞ্চস্থ করেছেন রওশন আরা ও জামাল উদ্দীন হোসেন। কলকাতার নান্দীকার গোষ্ঠি সম্প্রতি যযাতির কন্যা মাধবীর জীবনালেখ্য নিয়ে রচিত ‘মাধবী’ নাটকটি মঞ্চায়িত করে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের পরিচালনায় গিরীশ মঞ্চে। মাধবীর মধ্য দিয়ে সমসাময়িক নারীদের মর্মবেদনা ও পুরুষ কতৃক নারীদের ওপর অন্যায্য ব্যবহারের চিত্র ফুটে ওঠে। কচ ও দেবযানীকে নিয়ে নব-রূপে রূপায়িত রবীন্দ্র-রচনার সঙ্গে মূল মহাভারতীয় উপাখ্যান মিশিয়ে নাটক তৈরি করেছেন অর্পিতা ঘোষ। কচ ও যযাতি, দু’জনের কাছেই প্রেমে প্রতিহত-লাঞ্ছিত দেবযানী যে ভাবে উপেক্ষিতা হয়ে রইলেন, তা নিয়েই অর্পিতা অভিনীত ও নির্দেশিত পঞ্চম বৈদিক-এর নতুন নাটক ‘এবং দেবযানী’ প্রদর্শিত হয়েছে ২০১১-এর রবীন্দ্রনাট্যোৎসবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য চিত্রাঙ্গদাকে নির্মাণ করে যেমন নারীবাদী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন, বিদায়-অভিশাপে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত দেবযানীর মুখে মহাভারতের অভিশাপ অক্ষুন্ন রাখলেও কচকে তিনি নবায়ন করে অনেক উদার ও মহৎ করে ফেলেন এইভাবে যে মহাভারতের কচের মতো রবীন্দনাথের কচ দেবযানীকে পালটা অভিশাপ দেয় না। উপরন্তু সে বিদায়কালে প্রেমিকাকে শুভকামনা জানায়, যেন সুখী হয় সে। মধুসূদন দত্তের  বীরাঙ্গনা কাব্য অবলম্বনে রচিত ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নাটক এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ হচ্ছে।  মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য মহাভারতের পটভূমিতে রচিত। যুদ্ধপ্রাক্কালে প্রেম-বন্ধনে বাঁধা নরনারীর কথোপকথনকে উপজীব্য করে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’।  এখানে আমরা দেখতে পাই, একাকিনী পত্নী বা প্রেমিকাদের প্রত্যেকে (১১ জন) তাঁদের নিজ নিজ পুরুষকে পত্র লিখছেন। এই নারীদের মধ্যে রয়েছেন শোকাতুরা শকুন্তলা, ঈর্ষান্বিতা দ্রৌপদী, পতির অমঙ্গল আশংকায় অস্থির দুঃশলা, এবং পুত্রশোকে কাতর, পতির ভীরুতার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনকারী জনা। ১১টি পত্র থেকে চারটির নাট্যরূপায়নই ‘কহে বীরাঙ্গনা।’ পৌরাণিক কাহিনী হলেও এতে উঠে এসেছে প্রাচ্যের চিরন্তন নারীর বিরহ, বেদনা, একাকীত্ব, হাহাকার। বাংলাদেশে এই নাটকটি পুরোপুরি মনিপুরী সম্প্রদায়ের শিল্পীদের নিয়ে মঞ্চায়িত। সুভাশীষ সিন্‌হার পরিচালনায় চারটি অঙ্কেই একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিন্‌হা। ওদিকে বিজন ভট্টাচার্য ‘জীয়নকন্যা’ নাটকে উলুপীর মিথকে ব্যবহার করেছেন। নাটকের শেষে দেখা গেল নাগকন্যা উলুপী আসলে স্বয়ং ভারতবর্ষ।  মধ্যযুগের লোকগীতি অবলম্বনে সমাজের দুই মেরু থেকে উঠে আসা মহুয়া ও নদের চাঁদের প্রেমকে ঘিরে আযিমুদ্দীন আহমদের লেখা ‘মহুয়া’ নাটক ষাটের দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চস্থ হয়েছে।

আধুনিক যুগে চলচ্চিত্রেও পুরাণ চরিত্রের  নবায়ন অথবা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।  রাধাকৃষ্ণ ও শিবপার্বতীসহ বহু দেবদেবী, লাইলীমজনু, এমনকি সরাসরি পূর্ণ রামায়ন, মহাভারতের কাহিনী নিয়ে অথবা  আম্রপালী (ভারতে এ পর্যন্ত হিন্দি ও বাংলায় অন্তত একটি করে ছায়াছবি এবং টেলিভিশনে একটি সিরিয়েল হয়েছে আম্রপালিকে নিয়ে), কি বাল্মীকির জীবন ও কর্ম নিয়ে অসংখ্য ছায়াছবি বানানো হয়েছে, হচ্ছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। এসব ছায়াছবির কাহিনী অনেক সময় সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে রচিত হয়।  অতি আধুনিক কালের কোন কোন সিনেমাতেও  তাই পুরাণ চরিত্রের  নবায়ন অথবা ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।  পাকিস্তানের বরেণ্য নারীবাদী পরিচালক সাবিহা সুমারের ছবি ‘খামোশ পানি’তে দেখি, দেশ বিভাগের সময়, এক শিখ-কন্যা পিতামাতার সঙ্গে ভারত চলে না গিয়ে এক মুসলমান যুবককে বিয়ে করে ধর্মান্তরী হয়ে পাকিস্তানে স্বামীর ভিটাতেই থেকে যায়।  ইতোমধ্যে তার স্বামী মারা যায়। একমাত্র পুত্র সাবালক হয়ে ওঠে।  সংসার চালাবার জন্যে এই নারী নিজের বাড়িতে প্রতিদিন পড়শী ছেলেমেয়েদের কোরাণ শরিফ পাঠ শেখান। এদিকে জন্মাবধি চারদিকে অরাজকতা, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও হানাহানি দেখে দেখে প্রচন্ড হতাশ হয়ে নারীটির তরুণ পুত্রটি ধীরে ধীরে খুব গোঁড়া মুসলমান ও জেহাদী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, বহু বছর পর অন্যান্য শিখদের সঙ্গে এক তীর্থভ্রমণে ভারত থেকে পাকিস্তানে আসা একদল শিখের সঙ্গে এই নারীটির ভাই-ও উপস্থিত হয় সেই অঞ্চলে।  সেই ভাই তার পরিচিত পুরনো জায়গার ফিরে এসে যখন নানান জনের কাছে তার বোনের খোঁজ নিয়ে অবশেষে তাকে আবিষ্কার করে, বোন জানায় এটাই তার ঘর, এটাই তার বাড়ি, এখানেই তার সংসার।  যদিও সে তখন বিধবা, কিন্তু একমাত্র পুত্র নিয়ে এটাই তার সংসার এখন। ভাইয়ের শত অনুরোধেও তার সঙ্গে অন্যান্য আত্মীয়দের কাছে ভারত ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সে। ইতোমধ্যে, ব্যাপারাটা জানাজানি হয়ে যায় চারদিকে। আর ওদিকে নারীটির অতীত পরিচয় ঐ অঞ্চলে প্রকাশিত হয়ে  যাবার পরে দেখা যায়, তার কাছে আর কোন ছেলেমেয়েই আসে না কোরান পাঠ শিখতে।  আর অন্যদিকে যে মোল্লা ও ধর্মান্ধ দলটির সঙ্গে এই নারীর একমাত্র পুত্রের নিত্য ওঠাবসা, তাদের তরফ থেকেও প্রচন্ড চাপ আসে ছেলেটির কাছে। বাধ্য হয়ে তখন তার নিজের পুত্র  মা’কে রাজপথে বেরিয়ে সর্বসম্মুখে ঘোষণা  করতে বলে, প্রমাণ করতে বলে যে তার মা সাচ্চা মুসলমান, এবং শিখ ধর্ম সে বহু আগে স্বেচ্ছায় এবং চিরতরে বিসর্জন দিয়েছে। তার মা তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে। পুত্রকে জানায় যে  তার নিজের জীবনযাপন  এবং এতোগুলো বছরের সমস্ত কর্মকান্ড দিয়ে সে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে বলে সে মনে করে। তবু পুত্র যখন নাছোড়বান্দা, তখন তার মা কুয়োর ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে এই অপমানের প্রতিবাদে। বহু বছর আগে দেশ বিভাগের সময় শ্লীলতাহানির আশঙ্কায় শত শত হিন্দু ও শিখ পিতামাতা দেশ ছেড়ে ভারত চলে যাবার আগে তাদের যুবতী কন্যাদের এই সকল কুয়োতে নিজের হাতে ডুবিয়ে খুন করে গেছেন। সেই সময় থেকেই ঐ কুয়ো নিয়ে বড় ভয় জন্মে এই নারীটির মনে। ছবিতে আগেই দেখানো হয়েছে, কক্ষনো নিজে কুয়োতে যেতো না সে জল তুলতে। যে বাচ্চা মেয়েটিকে রাখা হয়েছিল কুয়ো থেকে প্রতিদিন জল তুলে দেবার জন্যে, সেও গত ক’দিন ধরে আর আসে না  এই বাড়িতে, কোরান পাঠ শেখার ছোট্ট ছাত্রছাত্রীদের মতোই। ‘খামোশ পানি’র এই মা যেন আজকের যুগের নির্বাক প্রতিবাদহীন সেই রামের স্ত্রী  সীতা যে বার বার নিজের সতীত্ব প্রমাণ করার অপমান সইতে না পেরে আত্মহননের পথ-ই বেছে নেওয়া সাব্যস্ত করেন।

এছাড়া সম্প্রতি (২০১১ সালে) তানিম নূরের পরিচালিত ‘ফিরে এসো বেহুলা’ চলচ্চিত্রে বর্তমানকালে স্বামীর নিরাপত্তা ও নিজে বেঁচে থাকার জন্যে বেহুলার মতো এক নারীর অন্তহীন সংগ্রামের কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। এখানে প্রতীকি বেহুলা মনসা বা সাপ নয়, দূষিত সমাজ দ্বারা প্রতিনিয়ত উৎপীড়িত। মাত্র কিছুদিন আগে বিখ্যাত তেলেগু চলচ্চিত্র পরিচালক  মনিরত্নম বিশাল বিশাল তারকাদের নিয়ে ‘রাবণ’ নামে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ছায়াছবি তৈরি করেছেন যার সুটিং হয়েছে কেরালার দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশে।  এই ছবিতে অভিষেক বচ্চন হয়েছেন রাবণ, যে এই ছবির নায়ক, ঐশ্বরিয়া হয়েছেন সীতা আর দক্ষিণের বিক্রম হয়েছেন রাম, যার ভূমিকা কিছুটা ভিলেনের মতো। ছবিটা শুরু হয়েছে রাবনের সীতা-হরণের দৃশ্য থেকে। তবে এখানে বনবাসী সীতাকে নয়, ডুবন্ত নৌকা থেকে সীতাকে উদ্ধার করে রাবণ নিজ গৃহে নিয়ে যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে এক রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অতীত দৃশ্যে দেখানো হয় রামের সঙ্গে সীতার বিবাহিত জীবনের কিছু দৃশ্য। পরে রাম সীতার খোঁজ করলে রাবণ সীতাকে রামের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু রাম তার বাহিনী নিয়ে রাবণকে আক্রমণ করে এবং সীতার বাধা সত্বেও তাকে  খুন করে।  সীতা মৃত্যুপথযাত্রী রাবণের হাত ধরে কাঁদতে থাকে। এই ছবিতে গোবিন্দ অভিনয় করেন রামায়নের হনুমানের ভূমিকায়, যে রামকে রাবণের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে যায়, অর্থাৎ এই ছবিতে আধুনিক হনুমান গোবিন্দ পুলিশ ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলদেশে জহির রায়হান বেহুলা আখ্যান নিয়ে নির্মান করে গেছেন চলচ্চিত্র ‘বেহুলা।’ তবে কেবল বেহুলাতে নয়, পুরাণের এবং মঙ্গলকাব্যের (মনসামঙ্গল) ধারা অনুসরণ করে বরাবরই সাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে বাংলা ছায়াছবিতে। এখানে সাপ উপস্থিত হয় নির্দিষ্ট একটি ভূমিকা পালন করার জন্যে অথবা রূপক হিসেবে। ছায়াছবিতে তার আবির্ভাব ঘটে বিভিন্নরকম ভাবে–কখনও প্রতীকি অর্থে, কখনো চরিত্র হিসেবে এবং কখনও মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে। চলচ্চিত্র শিল্পে সাপ একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অনেক আগেই তা এসেছে পুরাণে, বিভিন্ন লোকগাথায় ও  মঙ্গলকাব্যে।

তবে মহাকাব্য মহাভারতের বিশাল প্রেক্ষাপট ও তার সার্বজনীনতা নিয়ে পৃথিবী তোলপাড় করা দীর্ঘ ও বিস্তৃত ছায়াছবি নির্মান করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক পিটার ব্রুক্স (Peter Brooks)। মহাভারতের ব্যাপকত্ব ও সার্বজনীন আবেদন বোঝাতে তিনি এই ছবিতে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন ধর্মের শিল্পী নিয়ে এসে ছবির চরিত্র নির্মান করেছিলেন। এছাড়া ভারতে ‘কলিযুগ’ এই নামেও মহাভারতের ওপর ভিত্তি করে একটি ছবি নির্মিত হয়েছে, যেটা মূল কাহিনী থেকে প্রক্ষিপ্ত।

প্রাচ্য পুরাণের কাহিনী, চরিত্র ও বিশেষ বিশেষ ঘটনা ভারত উপমহাদেশের চিত্রকলা, পটশিল্প, বাটিকশিল্প তথা তাবৎ শিল্পকলারই একটি বড় উপাদান।  চরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা পুরাণের যুগের হলেও কখনো কখনো সময়কে অতিক্রম করে বর্তমানের বাস্তবতায় পুরাণের কাহিনী রং তুলি দিয়ে বিনির্মাণ করেন শিল্পী।  কখনো আবার ঘটনা অথবা চরিত্র অক্ষত, অবিকৃত রেখেও শিল্পীর রং-এর আঁচড়ে তা ভিন্নতর রূপ নেয়, যেমন গোপালের ননী চুরি করা, সন্তান গণেশ কোলে শ্রী দুর্গা প্রভৃতি। এই ব্যাপারে সবচেয়ে যাঁরা অগ্রগণ্য তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়,  সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, মকবুল ফিদা হুসেন, গণেশ পাইন, বিজন চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া,  কুমোরের হাতে খড়, মাটি রঙ দিয়ে  বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি গড়া থেকে শুরু করে, লক্ষ্মীসরা তৈরি, পটুয়াদের হাতে অঙ্কিত বিভিন্ন পট, পোড়া মাটির নকসা, আজও বাংলার ঘরে ঘরে শোভা পায়। এছাড়া ভাস্কর্য্য-শিল্প নির্মাণে পুরাণ ও মহাকাব্যগুলোর চরিত্র একটি প্রধান বিষয় হিসেবে সর্বকালেই ভাস্করদের কাছে সমাদৃত।

এছাড়া প্রাচ্য মিথোলজির নানারকম অনুষঙ্গকে বিভিন্ন জনপ্রিয় মিডিয়ায়  বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন  প্রাচীন পুরাণের আখ্যান বা চরিত্রের সরাসরি প্রয়োগে বা তার ছায়ায় রচিত অত্যাধুনিক ব্যান্ড মিউজিকের কথা থেকে শুরু করে, আরো নানা ধরনের গান (বিশেষ করে ভক্তিগীতি, লোকগীতি), গাজন নাচ, গাজির পট, যাত্রা, বিভিন্ন পূজা-পার্বণ-ব্রত, পথনাটক আজো দারুণ জনপ্রিয় ও সচল বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, বাজারে, উঠানে, ঘরে, মঞ্চে সর্বত্র। প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী অমর পাল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিয়ে গানের কথা ও সুর বেঁধে রেকর্ড করেছেন,
“ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ গেল
শূণ্য হল রথী
চন্দ্র সুর্য্য অস্ত গেল
জোনাকী দেয় বাতি।”

এই উপমহাদেশের প্রেমের গানের (ধর্মীয়/লোকগীতি/আধুনিক) একটা প্রধান অংশ জুড়ে আছে রাধাকৃষের প্রেম। দ্বাদশ শতাব্দীতে জয়দেবের কাব্যনাটক ‘গীতগোবিন্দে’র আগে বাংলায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাহিনীর সন্ধান পাওয়া যায় না। এই কবিতায় কৃষ্ণের সঙ্গে অসংখ্য গোপীর বন্ধুত্বের কথা লেখা রয়েছে, তার ভেতর বিশেষ প্রিয় গোপীর নাম ছিল রাধা। জয়- দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত সংস্কৃত প্রধান হলেও এর ভিতরে কিছু বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। রাধাকৃষ্ণের অমর প্রেম কাহিনী এই গীতগোবিন্দের মাধ্যমে ভারতবর্ষে বিকাশ লাভ করেছে। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ যা বসন্তকুমার বিদ্যুতবল্লভ একটি গোয়াল ঘর থেকে উদ্ধার করেছেন। এই গ্রন্থটির ভাষাতাত্বিক মুল্য অনেক বেশি। কেননা, তখনকার সময়ে বাঙালীরা যে ভাষায় কথা বলত হুবহু সেই ভাষায় লেখা হয়েছে এই গ্রন্থটি। ফলে ভাষাতাত্বিক দিক দিয়ে এবং লোক ভাষার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে এই গ্রন্থটিকে সমাদরে গ্রহণ করা হয়।  বড়ু চন্ডিদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ যখন প্রকাশিত হয় রাধাকৃষ্ণের প্রেম নিয়ে চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে যায়। ফলে, দেখা যাচ্ছে, বঙ্গদেশে দ্বাদশ শতকের বাঙালি কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যেই ‘রাধা’ নামটি প্রথম উল্লেখিত হয়। জয়দেবের এই কাহিনীর পরেই বৈষ্ণব ধারার সূচনা হয় যা শ্রীচৈতন্য আরো পূর্ণ মাত্রায় জাগিয়ে তোলেন এবং এর প্রচার ও প্রসার ঘটান। এরপর থেকে রাধাকৃষ্ণের আবেদন আজো একই রকম রয়েছে বা আরো বেশি প্রবল হয়েছে। মমতাজের গলায় “আযান শুনে ঘুম ভাঙ্গিল/চোক্ষের পানি রাখতে নারি/শ্রীদাম রে, ওরে ভাই শ্রীদাম/কেমন আছে প্রাণেশ্বরী”-এর মতো গান আবহমান বাংলার যৌথ সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। এছাড়া, লৌকিক উপাখ্যান বা গাথা নিয়ে রামলীলা, কৃষ্ণলীলা, লক্ষিন্দর-বেহুলা পালা, লাইলী-মজনু, শিরীন-ফরহাদ ও জুলেখা-ইউসুফ-পালা, রাধাকৃষ্ণ-এর কীর্তন, গাজী কালু ও চম্পাবতী কন্যা নিয়ে গাজীর গান, সঙ্গীতসহ নৃত্য, পাঁচালী ও পুঁথিপাঠ এবং জলসা নিয়মিত পরিবেশিত হয়।

কয়েক বছর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেছিলেন সরস্বতীকে দেখলে তাঁর মনে কামভাব জাগে (এছাড়া সুনীলের কবিতাতেও আছে, বাল্যকালেই সরস্বতীর মূর্তিকে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন), অথবা কালী দেবীকে তিনি যখন ‘ন্যাংটো সাঁওতাল মাগী’ বলে আখ্যায়িত করেন, চারদিকে হইচই পড়ে যায়, কারো কারো ধর্ম-অনুভূতিতে প্রচন্ড আঘাতও লাগে। সুনীলের নামে কোর্টে কেস ওঠে, কিন্তু তাঁর জীবন সংশয় হয় না। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেনের মতো প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীর কল্পনা মিশিয়ে আঁকা দেশমাতৃকার অবয়বে বস্ত্রবিহীন সরস্বতীকে কিছুতেই সে দেশের হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারে না। শিল্পীর স্বাধীনতার ওপর কট্টর হিন্দুদের এই স্বৈরাচারী আক্রমণে সন্ত্রস্ত ও হতাশ রোমান্টিক শিল্পী ফিদা স্বেচ্ছা নির্বাসনে দুবাইতে জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়ে লন্ডনে ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সরস্বতী বা কালীকে নিয়ে সুনীলের এই ধরণের মন্তব্য অবশ্য তাঁকে যতই ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক বা প্রগতিশীল করে তোলে বলে তিনি মনে করুন না কেন, এর পেছনে নারী এবং উপজাতীয়দের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য ও অশ্রদ্ধাও যে ধরা পড়ে, সেটা তিনি হয়তো গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখেননি। লক্ষ্মীপ্রসাদকে তার উপন্যাস ‘দ্রৌপদী’র জন্যে ডানপন্থী হিন্দু রাজনৈতিক দল ক্ষুব্ধ হয়ে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় গালাগাল করেছে, কেননা এই উপন্যাসে লক্ষ্মীপ্রসাদ দ্রৌপদীর যৌনতা, স্বামী হিসেবে পঞ্চপান্ডবের মধ্যে তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, সর্বোপরি কর্ণের দিকে দ্রৌপদীর চোখ পড়ার মতো সব উল্লেখ রয়েছে। কট্টর হিন্দুদের কাছে মনে হয়েছে, যদিও এটি একটি উপন্যাস, তাহলেও সাহিত্য একাডেমী একে পুরস্কৃত করে হিন্দু ধর্মকে অপমান করেছে। এটি নাকি পর্নোগ্রাফির সমতুল্য। আর সেটা করা হয়েছে হিন্দুদের পূজনীয় নারী চরিত্র দ্রৌপদীকে নিয়ে। তারা এই গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করার অনুরোধ জানান সরকারের কাছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছেও লেখক ও তার পুস্তকের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়ে।  কিন্তু দৃঢ়চেতা লক্ষ্মীপ্রসাদ সটান এবং স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন নিজস্ব স্থানে–শক্ত মাটির ওপরে। এতটুকু সমঝোতা করার লক্ষণ দেখা যায়নি সেখানে। লেখকের কল্পনা ও তার লেখার স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করেন। সাহিত্য একাডেমী এই পুরস্কারটির নির্বাচনকালে ওই একাডেমীর প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধায়। সুনীলের আমলে এমন একখানি গ্রন্থ একাডেমী পুরস্কার পেলে অবাক হবার কিছু নেই। লেখকের কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতাকে আর যেই হোক অন্তত সুনীল গলা টিপে মারতে পারেন না বলেই আমাদের ধারণা। আসলে, সৃজনশীলতার গতি বন্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই – থাকা উচিত নয়। প্রাচ্য মিথোলজির ঘটনা ও চরিত্রগুলো আজকের লেখকদেরও প্রবলভাবে আন্দোলিত করছে।  তারা পুরাণের আখ্যানকে, চরিত্রকে, বিশেষ করে নারী চরিত্রকে নবায়ন করছেন। আর তাই  নবরূপে, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সমকালীন সমাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উপস্থাপিত হচ্ছে হাজার হাজার বছরের পুরাতন উপাখ্যানের অংশবিশেষ, এর বিভিন্ন অনুষঙ্গ, চরিত্র, চরিত্রের নাম ও অন্তর্নিহিত দর্শন, ঘটনার বাঁক, যার আবেদন সার্বজনীন, চিরন্তন। আর এ শুধু প্রাচ্যে নয় পাশ্চাত্য পুরাণের প্রতিও গভীর নজর ও আকর্ষণ সৃষ্টিশীল লেখকদের। তাঁরাও পুরাণের পরিচিত চরিত্র, অতিরঞ্জিত বা অলৌকিক সব ঘটনা কিংবা কর্মকান্ড সাঙ্কেতিক অর্থে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করে থাকেন, অথবা তাঁর সৃষ্টির স্বার্থে খুশিমতো পুনর্নির্মাণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *