যত্র বয় কুরা নদী – ২
(শাহাব আহমেদ)
– ১ –
রুশ ভাষায় বিশাল বড় ও জাঁক-জমকপূর্ণ গির্জাকে বলা হয় ‘সাবোর’। আর ছোটখাটো একটু কম জাঁক-জমকপূ্র্ণ সাদামাটা যা, তাকে বলা হয় ‘খ্রাম’। খ্রামের বাংলা সম্ভবত ‘মন্দির’। ‘সাবোর’ সেক্ষেত্রে হয়তো হয় ‘মহা-মন্দির’। বাংলা ভাষায় অবশ্য এমন কোন শব্দ নেই, তবে ইংরেজিতে এর নাম ক্যাথেড্রাল। তিবিলিসের সেইন্ট ইলিয়া টিলার উপরে অবস্থিত সাবোর ‘স্মিন্দা সামেবা’ বা ‘ট্রিনিটি ক্যাথেড্রাল’ হচ্ছে জর্জিয়ার মূল ও সবচেয়ে উঁচু গির্জা। ১৫০০ বছরের স্বায়ত্ব শাসিত জর্জিয়ান চার্চ ও খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের ২০০০ বর্ষপূর্তি হিসাবে ১৯৯৫ সালে এর বিনির্মাণ শুরু হয়। এর ভিত্তিতে নাকি রাখা হয় জায়ন পাহাড় ও জর্দান নদীর তলা থেকে আনা পাথর, জেরুজালেমের মাটি এবং কয়েকটি সোনার মোহর। ১০০ মিটার উঁচু এবং এর চূড়ায় স্থাপিত ক্রুশটি ৭.৫ মিটার দীর্ঘ। ৫০০০ বর্গমিটার মেঝে নিয়ে তৈরি এই গির্জায় রয়েছে বেশ দামি দামি আইকন। জর্জিয়ার ৪৩২ জন সন্তের অবয়ব নিয়ে তৈরি “জর্জিয়ার আশা” নামের আইকনে ৩০ কিলো স্বর্ণ ও দামি পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। সোভিয়েত আমলে অর্থ ব্যয় করা হতো মন্দির ভাঙার জন্য, এখন করা হয় মন্দির গড়তে। দুই আমলই ভালো, দুই ভিন্ন গোত্রের মানুষের জন্য। এরা বলে ওরা খারাপ, ওরা বলে এরা মন্দ।ক্ষমতার পেন্ডুলাম, হোক সে মার্ক্সীয় বা অমার্ক্সীয়, ঘোরে নিজস্ব নিয়মে, নিজের অক্ষে। এবং ক্ষমতাসীন ‘চারুবাক’ সন্তরা সব আমলেই সুন্দর উচ্চারণে পড়ে ‘জনগনের অর্থে’র গাঁথা।
অথচ সে অর্থ জনগণ না পায় দেখতে, না পায় স্পর্শ করতে। এমন কি, কেন তা কোনো হাসপাতাল বা স্কুল গড়তে ব্যয় হয় না, বড় মন্যুমেন্ট বা মন্দির বা জেলখানা গড়তে ব্যয় হয়, সে প্রশ্নও তারা করতে পারে না।
তবে সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
এই ট্রিনিটি ক্যাথেড্রালেই এখন রক্ষিত আছে সাধ্বী নিনোর ক্রুশ, যা তিনি স্থাপন করেছিলেন ‘মেতস্খেতা’ পাহাড়ের চুড়ায়, যেখানে পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে ‘জ্ভারি চার্চ।’ জর্জিয়া অর্থডক্স খৃষ্টান দেশ। চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে ৩২৭ সালের দিকে সাধ্বী ‘নিনো’ খৃষ্টধর্ম নিয়ে এই দেশে আসেন। সময়ে এই আলোচনা হবে। জর্জিয়ারও আগে আর্মেনিয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে। জর্জিয়ার প্রায় ‘অর্ধ-মিলেনিয়া’ পরে, ৮৬২ সালে ‘কিয়েভ রুশ’ আর্মেনিয়া-জর্জিয়ার পথ ধরে খৃষ্টের অনুগামী হয়।
অর্থডক্স চার্চগুলোর একটি বড় বৈশিষ্ট হল এদের জাঁক-জমক, ডেকোরেশন ও গাম্ভীর্য। অর্থডক্স ‘সাবোর’ বা ‘খ্রামের’ মেঝেতে পা ফেলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। জর্জিয়ানরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি হাজার বছর ধরে তাদের দেশকে সাজিয়েছে এই সব অসামান্য সাবোর, খ্রাম, ও গির্জা দিয়ে। এবং প্রত্যেকেরই পেছনে কোন ইতিহাস, কোন উপকথা বা বিশ্বাস লুকিয়ে রয়েছে। মানুষকে জানতে হলে মানুষের মনোজগৎকে জানতে হয়। যদিও আধুনিক মানুষ খুব বেশি ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, তবু এই মনোজগৎকে উপেক্ষা করে সুখ ও শান্তির সন্ধান হবে মরুতে মায়ার মত।
কুরার তীরেই দাঁড়িয়ে আছে “জায়ন বা উসপেনিয়া সাবোর”। জেরুজালেমের পবিত্র ‘জায়ন’ পাহাড়ের নামে তৈরি।“স্মিন্দা সামেবা” সাবোর তৈরি হবার আগে ঐতিহাসিকভাবে এ-ই ছিল জর্জিয়ার মূল ক্যাথেড্রাল।
‘উসপেনিয়া’ শব্দটির অর্থ আমার জানা ছিল না। তামারাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হল। যীশুখৃষ্টের মা, যাকে ‘ঈশ্বরজননী’ বলা হয়ে থাকে, মহাপ্রয়াণে যান ২৮শে আগষ্ট। খৃষ্টধর্ম বিশ্বাসীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাঁর মহাপ্রয়াণকেই বলা হয় ‘উসপেনিয়া’। শব্দটির অর্থ ঘুম অথবা মৃত্যু।
ঈশ্বরজননী যেহেতু মৃত্যুর উর্ধ্বে, তাই তাঁর অদিব্য জগত থেকে দৈবে প্রকাশের প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয় ‘উসপেনিয়া’ শব্দের মাধ্যমে। মহাপ্রস্থানের আগে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যীশুর শিক্ষা প্রচারে নিবেদিত সমস্ত শিষ্য ও সন্তদের একত্র জড়ো করার। কিন্তু তারা তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন মহান বাণী নিয়ে। কিন্তু ধর্ম হল মনের মধ্যে মন্দির, সেখানে বহু অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে থাকে। দৈববলে নাকি এই সন্তেরা সবাই ঈশ্বরজননীর সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। কেবল সেইন্ট থমাস ( ধারণা করি তখনো তাঁকে ‘সেইন্ট’ উপাধি দেয়া হয় নি ) এসে পৌঁছাতে পারেন নি ।
যীশু নিজে স্বর্গ থেকে ফেরেশতাদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন মাতৃ শয্যায়। জননী একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে পুত্রকে আলিঙ্গন করেন এবং তার মধ্যদিয়েই তাঁর অপার্থিব জগতে উত্তরণ ঘটে। তাঁকে সমাহিত করা হয় একটি গুহার ভেতরে। বিশাল একটি পাথর দিয়ে গুহামুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। তিনদিন পরে ক্লান্ত খিন্ন থমাস এসে উপস্থিত হন। ঈশ্বরজননীকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অশ্রুসিক্ত অনুমতি চান তাঁর সমাধিতে গিয়ে শেষ বিদায় জানানোর। গুহামুখের পাথর সড়িয়ে তাঁর কবরে তাকিয়ে বিস্ময় বিহ্বলিত হয় সবাই।বসন পড়ে আছে, কিন্ত তিনি নেই। সেই থেকে উসপেনিয়া হয় অর্থডক্স ধর্মবিশ্বাসীদের জন্য স্মরণীয় ও উৎসবের দিন। রাশিয়া ও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের দেশগুলোতে বহু গির্জা রয়েছে ‘উসপেনস্কি সাবোর’ নামে।
ধারণা করা হয়, রাজা ভাখতাঙ-১ সর্বপ্রথম এই ‘সাবোর’ তৈরি করেন। পরে রাজা চতুর্থ ডেভিড ( দি বিল্ডার ) এর পুনর্নির্মাণ করেন ১২ শতাব্দীতে। বহু ইতিহাস, রক্ত, অশ্রু ও নিপীড়নের সাক্ষী এই ধর্মালয়। ১২২৬ সালে খোরেজম শাহ জালালউদ্দিন তিবিলিসি দখল করে সমস্ত গির্জা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং ‘জায়ন সাবোর’কে মসজিদে পরিণত করে। সে নাগরিকদের আদেশ দেয় ভূলুন্ঠিত পবিত্র আইকনের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার। যারা আদেশ অমান্য করে তাদের শিরোচ্ছেদ করে কুরা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তিবিলিসির ১ লক্ষ নাগরিক নাকি নিহত হয় এই পৈচাশিকতার ফলে। সে হয়তো এখন হুর গেলমান ও শরাব নিয়ে তুমুল ব্যস্ত আছে বেহেশতে। কিন্তু জর্জিয়া তার ধর্ম গ্রহণ করে নাই। অথচ ১২২১ সালে সিন্ধু নদীর তীরে চিঙ্গিজ খানের হাতে পরাজিত হয়ে, সেই তার হারেমের নারীদের সিন্ধুর জলে ডুবিয়ে হত্যা করে জীবন বাঁচিয়েছিল সিন্ধু নদী সাঁতরে। তারপরেও রক্তের পিপাসা তার কমে নাই, বরং আরও বেড়েছে।
ইতিহাস এমন গুনীজন নিয়ে সমৃদ্ধ।
১২৩৬ সালে এবং ১৫২২ সালে এই গির্জা আবারও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৬৬৪ সালের ভূমিকম্প এর বিপুল ক্ষতিসাধন করে। ১৭৯৫ সালে আগা মুহাম্মদ খানের দস্যুরা ভিতরের চিত্রকর্ম ও আইকনসমূহ ধ্বংস করে দেয়। এক ধর্মের দেবালয় অন্য ধর্মের অসুর নৃত্যের মঞ্চ হয়েছে সহস্র বছর এবং আজও খুব একটা পরিবর্তন হয় নি।
– ২ –
জর্জিয়ানদের হৃদমাঝারের আইকন, রানী তামার ও রুশ প্রিন্স ইউরির বিয়ে হয় এই চার্চে। এই বিয়ে সুখের ছিল না। অভিজাতদের চাপের মুখে তামারকে মত দিতে হয়েছিল কিন্তু ইউরিকে ভালোবাসতেন না তিনি। ইউরি ছিলেন মদ্যপ ও ‘মেধাহীন’ একজন মানুষ, যে মাতাল হয়ে স্ত্রীকে মারধোর করতেও নাকি ইতস্তত করত না। অথচ তামারের সামনে ছিল বিশাল কীর্তিময় জীবন। তার প্রয়োজন সহচর, প্রতি পদক্ষেপে বাধা নয়। তাঁকে অভিজাতদের বিষদাঁত উৎপাটন করতে হয়েছিল একে একে। তারপরে ইউরিকে উপঢৌকন দিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু ইউরি পারস্যের রাজদরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সরাসরি। জর্জিয়া ছিল পারস্যের শাহদের মৃগয়া ক্ষেত্র। যে কোন সুযোগ পেলেই তারা চলে আসতো যুদ্ধ নিয়ে। ইউরি পারস্যের সৈন্যদল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জর্জিয়ার ওপর। কিন্তু তামার সিংহিনী, নিজেই নেতৃত্ব দেন যুদ্ধে, হারিয়ে দেন প্রাক্তন স্বামীকে। তিনবছর পরে সেই নির্লজ্জ ফিরে আসে আবার, আবারও পরাজিত হবার জন্য। তামার এরপরে তার সেনাবাহিনীর বীর সেনাপতি ডেভিড সুসলানকে বিয়ে করেন এবং তার সাথে ২০ বছর সুখী জীবন- যাপন করেন। আরবদের তাড়িয়ে জর্জিয়ার মুক্তিসাধন করে রাজা চতুর্থ ডেভিড (দি বিল্ডার) যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন স্বদেশের পুননির্মাণের, তারই সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জিত হয় তাঁর প্রপৌত্রি তামারের শাসনামলে। জর্জিয়ার সেই স্বর্ণযুগে, কৃষ্ণসাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তির্ণ ছিল তার সীমানা। জেরুজালেমে সুলতান সালাদিন ছিলেন তার কূটনৈতিক মিত্র। মৃত্যুর পরে যাতে শত্রুরা তার সমাধিকে অপবিত্র করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে তার সমাধি গোপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবিকল একই রকমের ৯ টি কফিন তৈরি করে ৯ জায়গায় সমাধিস্ত করা হয়। যারা এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করে, কাজ শেষে তারা একে অন্যকে খঞ্জরবিদ্ধ করে মহীয়সি তামারের সমাধি কোথায় সেই গোপন তথ্য সাথে করে নিয়ে যায়। ভোটের ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, সুশাসন একজন শাসক বা নেতাকে বাঁচিয়ে রাখে জনগণের বুকের গহীনে। তবে শাসক বা নেতাদের এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্নমত, এবং তাও প্রায় চিরকালীন সত্য। এই একই ‘উসপেনিয়া’ সাবোরের সাথে জড়িত আছে আরও একটি দু:খজনক বিয়ের ইতিহাস। এখানেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন রুশ লেখক আলেক্সান্দার গ্রিবায়েদেভ তার ভালোবাসার পাত্রি নিনো চেভচাভাদজের সাথে। বিয়ের সময়ে তিনি যখন নিনোকে আংটি পরাতে যান, তাঁর হাত থেকে নাকি আংটিটি পড়ে গিয়েছিল। কুসংস্কারে বিশ্বাসী দন্তহীন বুড়ো মানুষেরা বলেছিল, “হায়, হায়, ওটা অশুভ লক্ষণ।” প্রকৃত ভালোবাসা কি ‘অশুভ লক্ষণ’ দেখে পালিয়ে যায়?গিয়েছে কখনও?
আমরা ‘উসপেনস্কি সাবোর’ অতিক্রম করে এগিয়ে যাই সামনের দিকে। আমাদের ডানদিকে পড়ে দেয়াল ঘেরা লম্বা লম্বা সাইপ্রেস গাছের আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতার শান্তির নীড়। জর্জিয়ান চার্চের ‘মহাপোপ’ যিনি, এটি তার বাসস্থান।যদিও ভ্যাটিকানের পোপের মত মহাক্ষমতাধর তিনি নন, কিন্তু অবস্থান তার সমান্তরালে।
যেতে যেতে পড়ে রিজো গাবরিয়াত্তির পুতুলের থিয়েটার, তিবিলিসির অন্যতম জনপ্রিয় স্থান, চোখে পড়ার মত সুন্দর, লম্বা একটি দালান যা ইচ্ছা করেই তৈরি করা হয়েছে একটু হেলানো অবস্থায়। প্রতি ঘন্টায় তার বারান্দায় কিছু পুতুলের চরিত্র বের হয়ে এসে শো দেখায়।
আমাদের আসার সাথে সাথেই সুন্দর শো শুরু হয় এবং ঘন্টা বাজিয়ে শেষ করা হয়।
রিজো গাবরিয়াত্তি বয়স্ক, এখনও জীবিত আছেন। তিনি হাসি ও আনন্দের মাধ্যমে মানুষকে সুখী করতে চান। তাঁর অতি পরিচিত বাক্য হল “শুধুমাত্র ঝাঁঝালো পেঁয়াজই হোক আপনাদের অশ্রুর কারণ।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা? ঝাঁঝালো পেঁয়াজ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, ধর্ম, আদর্শ ইত্যাদির তুলনায় মানুষের অশ্রুর সবচেয়ে তুচ্ছ কারণগুলোর একটি। কিন্তু তারপরেও মহৎ মানুষেরা থেমে থাকে না, তারা ফুল ফুটে ঝরে যায় বলে, ফুলগাছ লাগানো থেকে বিরত হয় না।
– ৩ –
পরের দিন আমরা যাই ছোট্ট তেলাভি শহরে। এক সময়ের কাখেতিয়ান জর্জিয়ার রাজধানি। শাহ আব্বাসের হাতে গ্রেমি শহরের পতন ও রাজপরিবারের অনেকের হত্যাকাণ্ডের পরে রাজধানি এখানে সরিয়ে আনা হয়। সোভিয়েত আমলের বহুল পরিচিত হাসির ছবি ‘মিমিনো’ র নায়ক মিমিনো এই তেলাভির ছেলে। সে একটি হেলিকপ্টার চালাতো এবং ছিল এখানকার গ্রামীন সহজিয়া জীবনের অংশ। একবার সে এক বৃদ্ধার পিড়াপিড়িতে তার গরুটির পেটে দড়ি বেঁধে হেলিকপ্টারের নীচে ঝুলিয়ে বেশ কয়েক মাইল দূরের অন্য গ্রামে দিয়ে এসেছিল। সে ছিল এক দারুন হাসির দৃশ্য। তারপরে সে মস্কো যায়, পাইলট হয়, এক শহুরে স্টুয়াডেসের প্রেমে পড়ে কিন্তু সে তাকে গোল চক্কর দেখায়। মিমিনো বিদেশে যায় পাইলট হিসাবে এবং সেখান থেকে সে তেলাভিতে ফোন করার বুকিং দেয়। টেলিফোন বুথের ডিসপেচার ভুল করে তাকে তেল- আবিবের সাথে সংযোগ করে দেয়। সেখানে ফোন ধরে জর্জিয়া থেকে অভিবাসি হয়ে যাওয়া এক ইহুদির সাথে। তাদের মাতৃভাষায় কথোপকথন এবং পিছনে ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য ইহুদির যে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তা নিয়ে এক অসামান্য ছবি এই মিমিনো। যা হোক মিমিনো’র চেয়েও বড় যা, তা হল, রাজা ২য় ইরাক্লির জন্ম শহর তেলাভি। আগা মুহাম্মদ খানের পৈচাশিকতা থেকে নিজের জনগণকে রক্ষা করতে না পেরে ভগ্ন হৃদয়ে সে তিবিলিসি ছেড়ে তেলাভি চলে এসেছিল এবং মৃত্যু পর্যন্ত আর তিবিলিসি ফিরে যায় নি। এখানে দেয়াল দিয়ে ঘেরা রয়েছে তার রাজ প্রাসাদ । খুবই সাদামাটা, মনেও হয় না রাজবাড়ি। পুরানো একটি গির্জা পাশে। বেশ কিছু প্রাচীন কবর। কালো পাঞ্জাবি পরা দুজন ধর্মযাজক গির্জার সামনে বসে কথা বলছে। গাছের ফাঁক গলিয়ে, তাদের কপালে এসে পড়েছে এক চিলতে সূর্যরশ্মি। রাজবাড়ি ও গির্জার পেছনে অনেক নীচুতে উন্মুক্ত হয়েছে আদিগন্ত উপত্যাকা, চক্রবালের সীমানা অতিক্রম করে। রাজবাড়ির সামনে অশ্বারোহী রাজা দ্বিতীয় ইরাক্লি’র বিশাল মনুমেন্ট, তার ডান হাতে ধরা উন্মুক্ত তলোয়ার। উদ্যত আক্রমনাত্মক তলোয়ার নয় বরং নিম্নমুখী। তার হাতল এমনভাবে তৈরি যে মনে হয় এটি একটি আগ্রাসনের অস্ত্র নয় বরং যীশুর শান্তির বাণী বহনকারী ক্রুশ। ঘোড়সওয়ার রাজা তাকিয়ে আছেন ৯০০ বছর বয়স্ক একটি অতি বৃদ্ধ গাছের দিকে, নাম তার ‘তেলাভির প্লাতান।’ অতি প্রাচীনকালে সারি সারি প্লাতান (Plane) গাছের একটি বীথি ছিল এখানে। বিশালাকৃতির এই গাছগুলো ছিল অতীব সুন্দর। তাদেরই মধ্যে একটি গাছ ছিল, সৌন্দর্য ও দৈর্ঘে সবাইকে অতিক্রম করে। তার মাথা ছুঁয়েছিল আকাশ। তার ছাতা দিয়েছিল শীতল ছায়া। কিন্তু সে বাড়ছিল তো বাড়ছিলই, যেন তার করপুটে বন্দি করতেই হবে আকাশের মেঘের পৈলব, তাকাতে হবে পৃথিবীর দিকে যেখান থেকে পাখিরা তাকায়। লোকজন ভাবতো এই গাছ আকাশ ও মাটির মধ্যে সংযোগকারী সেতু।সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতো, তার ছায়ায় কাণ্ডের কাছে বসে আলোচনা করতো জীবনের আশা-আনন্দ, ভালো-মন্দ, প্রেমানুভূতি ও হৃদয়হরণের গাথা। সে কিচ্ছু বলতো না, উপদেশ দিত না, কিন্তু জানতো সবার কথা, সবাইকে সে ভালোবাসতো। মানুষও ছিল সহজ সেইসব কালে, প্রায় বৃক্ষের মতই সহনশীল। যুগ ও শতাব্দী অতিক্রম হয়ে যায়, সময়ের দাঁত আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলে সবাইকে, বীথি উজাড় করে অন্য সব প্লাতানেরা মরে পচে বিলুপ্ত হয়ে যায়, যেমন যায় রাজা, রাজ্যপাট, শোষক, শোষিত, বিপ্লবী, কমরেড, কমিউনিস্ট, শুধু রয়ে যায় সবার প্রিয় গাছটি। কালের মহিরুহ, বিষণ্ণ একাকী। শহর গড়ে ওঠে তার চারিদিক ঘিরে, আসে নতুন মানুষেরা, নতুন ব্যথা ও বেদনা নিয়ে। সেই শতবর্ষ আগের মানুষ ও আজকের মানুষের ভিন্ন মন ও ভিন্ন মেজাজ হলেও, এবং তাদের ভালো -মন্দ বিচারগুলো ভিন্ন হলেও বেদনাগুলো রয়ে যায় একই। মানুষ ভালোবেসে কাঁদে, স্বামী ও সন্তানের জন্য কাঁদে। বেদনা, অপ্রাপ্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সেই একই। অনুভূতিগুলো একই সরকির মত ধারালো। তারপরেও মানুষ ভালোবাসে বৃদ্ধ এই বৃক্ষকে, যত্ন করে। তার সাথে কথা না বললে, নিজেদের সুখ দু:খের গল্প না বললে, যেন তাদের মন ভরে না, এই এত শতাব্দী পরেও। এমনকি যে শহর ছেড়ে চলে যায়, সেও অনুভব করে এই বৃক্ষের অনুপস্থিতি। এই এত ভালোবাসার প্রতিদানে নিজেরই অজান্তে সে পরিবর্তিত হয়ে যায় এক ইচ্ছাপূরনকারী কল্পতরুতে। তার কাণ্ড জড়িয়ে ধরে মানুষ যখন তীব্রভাবে, শুভ্র মন নিয়ে, কোন কিছু কামনা করলে তা নাকি অবশ্যই ফলে যায়। ৯০০ বছর বয়স তার, সে যে বিস্ময়ের বরপুত্র তাই কি প্রমাণ করে না, তার এই বেঁচে থাকায়। আমার যে খুব প্রিয় সে প্রশ্ন করে, “তুমি কী কামনা করেছ?” “বেঁচে থাকো বিশুদ্ধ প্লাতান, বেঁচে থাকো মানুষের জন্য।”– ৪ –
নিনোর পিতা আলেক্সান্দার চেভচাভাদজে ছিলেন শিক্ষিত, শিল্প-মনা, অভিজাত ও কবি। প্রভূত খ্যাতি ছিল তার। রুশ ও জর্জিয়ান অভিজাতদের এমন কেউ নেই যে, তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেনি। প্রাসাদসম বাড়ি, সুবিখ্যাত ইংলিশ গার্ডেন, ‘ভিনো’* ফ্যাক্টরি, সবই ছিল তার। ৮ হাজার বছর ধরে যে সম্পূর্ণ নিজস্ব ‘ভিনো বানানোর পদ্ধতি’ ছিল জর্জিয়ায়, তার বিপরীতে ইওরোপে ছিলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও সহজ পদ্ধতি। আলেক্সান্দার চেভচাভাদজে এই ইওরোপিয়ান পদ্ধতির প্রচলন করেন জর্জিয়ায়। ফলে জর্জিয়ার “আঙুর ও ওয়াইন” বিজ্ঞান এক ভিন্ন মাত্রা অর্জন করে। আলেক্সান্দার চেভচাভাদজের সাথে মস্কো থেকে আসা আলেক্সান্দার গ্রিবায়েদেভের নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি প্রথমবার যখন চেভচাভাদজের বাড়িতে আসেন তখন নিনোর বয়েস ছিল মাত্র ৬ বছর। নিনো নির্দ্ধিধায় এসে গ্রিবায়েদেভের কোলে বসে গল্প করা শুরু করে। গ্রিবায়েদেভ এক সময় ঠাট্টা করে বলেন, “তুমি এত সুন্দর ও চটপটে, তুমি যখন বড় হবে, আমি তোমাকে বিয়ে করবো।”– ৫ –
তিবিলিসির উঁচু পাহাড় মতাতস্মিন্দা’র চূড়ায় একটি অতি সুন্দর পার্ক রয়েছে। এই পাহাড়েরই স্কন্দে রয়েছে তিবিলিসি প্যানথিয়ন। শব্দটির বাংলা-মন্দির। মন্দির মানে একটি গির্জা রয়েছে সেখানে। কিন্তু এখানে সমাহিত আছেন জর্জিয়া ও রাশিয়ার কবি সাহিত্যিক শিল্পী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগন। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক আলেক্সান্দার গ্রিবায়েদেভ তাদের মধ্যে অন্যতম। বস্তুত ১৯২৯ সালে গ্রিবায়েদেভের মৃত্যুর শতবর্ষ উদযাপনের সময়ে এই প্যানথিয়ন উন্মুক্ত করা হয়। আমরা প্যানথিয়ন যাই দড়িটানা ওয়াগনে চড়ে। সরাসরি উপরে চলে গেলে ভাড়া ৩ লারি, নেমে আসতে ৩ লারি, কিন্ত আমরা প্রথমে যাবো প্যানথিয়নে, সুতরাং আরো ৩ লারি।( ১ ডলার= ২.৭ লারি)। নগদ চুরির প্রলুব্ধি থেকে কর্মচারীদের পবিত্র রাখার জন্য ক্যাশ পে করার কোন ব্যবস্থা নেই। ২ লারি দিয়ে কার্ড কিনতে হয়। সুতরাং ১১ লারির ধাক্কা। তবে ১ কার্ড দিয়ে সারা গ্রুপের অর্থ পে করা যায়। ৬ জন আমাদের গ্রুপে, ৫৬ লারি দিয়ে টিকেট কেটে আকাশ ওয়াগনে চড়ে বসি। এটি দড়ির উপরে ঝুলন্ত ‘ক্যাবল কার’ নয়। রেল বা ট্রাম লাইনের মত নীচ থেকে উঁচু পর্যন্ত রেল বসানো এবং শক্তিশালী ক্যাবল নীচ থেকে উপরে টেনে নিয়ে যায়। পাহাড়ের মাঝামাঝি প্রথম স্টেশন, প্যানথিয়ন থেকে বেশ উপরে। নামতে হয় অসংখ্য সিঁড়ি ভেঙে বাঁধানো পথ বেয়ে। যেতে যেতে যেন পথ আর শেষ হয় না, অক্সিজেন কম, শ্বাসকষ্ট হয়। অবশেষে থেমে থেমে, পাখির গানে মুগ্ধ ও চেরেওমুখা ফুলের গন্ধে মোহিত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্যানথিয়নে পৌঁছাই। কালো পাথরের গ্রিবায়েদেভের সমাধির উপরে ক্রুশ ধরে আনত হয়ে আছে কালো বসনের শোকার্ত এক নারী। “আমার প্রেম কী করে তোমার প্রেমের চেয়েও দীর্ঘতর হলো, প্রিয়তম ?” সেখানে খোদাই করা আছে প্রশ্ন । পাশেই শুয়ে আছে সে। তার কবরটিও কালো পাথরের, প্রায় একইধরণের, তবে সেখানে শোক প্রকাশ করার কেউ নেই। শতাব্দী পার হয়ে গেছে, অথচ ভালোবাসায় ধুকপুক করতো এই মানুষগুলোর হৃদয়, যেমন করে আমাদের। কষ্টে ও কান্নায় বুক ও চোখ উথলে উঠতো অথচ সব শান্ত হয়ে গেছে এখানে। কিচ্ছু নেই, একটি ফোঁপানির শব্দও শোনা যায় না আর।আমরা এর পরে যাই একটি সমাধি-প্রস্তরের কাছে। একটি আয়তাকার কালোপাথরের বামপাশে একটি লম্বা,সাদা পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরে বয়ামের মত দেহভস্ম রাখার একটি পাত্র।
একটি চাদর দিয়ে এমনভাবে আবৃত করা হয়েছে, দূর থেকে মনে হয় যেন অবনত মাথার কোনো নারী, যার সারা শরীর ও মাথা ঢাকা, শুধু মুখটি উন্মুক্ত । ইকাতেরিনা গেলাদজে, সংক্ষেপে যাকে ডাকা হতো ‘কেকে’ বলে।
স্ট্যালিনের মা। ১৯৩৭ সালের ৪ঠা জুন তার মৃত্যু হয়। স্ট্যালিন তখন মস্কোতে ব্যস্ত ছিলেন মার্শাল তুখাচেওভস্কিসহ আর্মির বিশাল সব হাতি গণ্ডার ও ম্যামথ শিকারে। তার পক্ষে মস্কো ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না, ডানহাত বেরিয়াকে পাঠিয়েছিলেন মায়ের সৎকার্য সম্পাদন করার জন্য।
মাতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল কুরা নদীর জলের মতই কিছুটা শীতল, কিছুটা ঘোলাটে।
দেখাও হতো খুব কদাচিৎ। নাদেঝদা আলুলুয়েভার আত্মহত্যার পরে দেখা সাক্ষাত প্রায় থেমেই গিয়েছিল। শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৩৫ সালে, তার অসুস্থতার সময় স্ট্যালিন এসেছিলেন।
“তুমি এখন কী কর?”
মা প্রশ্ন করেছিল। সম্ভবত পার্টি, পলিটব্যুরো, সেক্রেটারি, সভাপতি ইত্যাদি শব্দগুলো সে বুঝতে পারবে না, তাই তিনি বলেছিলেন, “তোমার জার-বাতিউসকা’র* কথা মনে আছে ? আমি এখন অনেকটা তার মত।”
“তুমি যদি জার না হয়ে ধর্মযাজক হতে..” মা আক্ষেপ করে বলেছিল।
এই মাকে যদি মাতৃভূমি কল্পনা করা হয়, আর তার আক্ষেপ মাতৃভূমির আক্ষেপ! জর্জিয়া এই জারের একটিও মন্যুমেন্ট রাখে নি, সোভিয়েত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত অন্য সবগুলো দেশের মতই, অথচ তিনি এখানে জন্মেছিলেন, গোর্কির ভাষায় ইতিহাসের এক বিশাল ‘ভেংচি’ হিসাবে।
( *জার-বাতিউসকা= জার-পিতা, রুশ কৃষকরা জারকে শুধু জার না বলে জার-পিতা বলে ডাকতো।)
প্যানথিয়নে সমাধি প্রস্তর অনেক, কিন্তু সবই জর্জিয়ান ভাষায় লেখা। বোঝার উপায় নেই কে কোথায় শুয়ে আছে। আমাদের সাথে গাইড নেই। ইতস্তত হাঁটাহাটি করি।দেখি এক মহিলা কবরখানা ঝাড়ু দিচ্ছে। তাকে অনুরোধ করি আমাদের একটু তথ্য দিতে বিভিন্ন সমাধি দেখিয়ে।
নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো একজন পুরুষের অপূর্ব সুন্দর মূর্তি -নুদার দুবাদজে, ব্যালের যাদুকর বলা হতো।
আরসেন দেলাশভিলি- জর্জিয়ার রবিনহুড
ইলিয়া চাভচাবিদজে- জর্জিয়ার জাতির জনকতুল্য।
বিশাল একটি আয়তাকার কবর, যেখানে শুয়ে আছে নব্বইয়ের দশকে নিহত স্বাধীন জর্জিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট গামসাহুরদিয়া।
দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ একজন কবির মূর্তি, গালাকতিওন তাবিদজে, স্ট্যালিনের নিপীড়নের সময়ে নিহত কবি তিতসিয়ান তাবিদজের আত্মীয়। মহিলা বোঝা গেল গালাকতিওন তাবিদজের কবিতার ভক্ত। সে আমাকে বোঝাতে চাইল, যে তার কবিতা এত সূক্ষ ও এত সুন্দর যে একেবারে বুকের গহীনে গিয়ে স্পর্শ করে। তার মত কবি জর্জিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। সবাই মনে করে যে, সে ছিল পাঁড় মাতাল, কিন্ত আসলে তা নয়, সে মাতালের ভান করে স্ট্যালিনের জহ্লাদদের হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিল।
কোন প্রফেশনাল গাইড নয়, কোনো সাহিত্যের শিক্ষক নয়, একজন সাধারণ মানুষ, কবরখানা ঝাড়ু দেয়, অথচ তার প্রিয় কবিকে সে কিভাবে বর্ণনা করছে। এখানেই হল কবি ও কবিতার শক্তি। মানুষের ভালোবাসা জবরদস্তি করে আদায় করতে হয় না।
আমি তিতসিয়ান তাবিদজের নাম শুনেছি কিন্তু গালাকতিওন তাবিদজের নাম আগে শুনিনি। এই শুনলাম এবং তার সমাধি দেখলাম। তিনি জর্জিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় লিরিকাল কবি। তিনি ওলগা অকুদঝাবা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। কিন্তু ওলগার ভাই ছিল জর্জিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি নেতা। তাকে অন্যান্য নেতার সাথে হত্যা করা হয় ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। পরিবারের উপরে নেমে আসে নিপীড়ন। স্ট্যালিনের নেতৃত্বের ব্যক্তিগত বা গোত্রগত হিসাব নিকাশ তখনও শেষ হয়ে যায়নি। নাৎসিরা আক্রমণ করে বসে। ফলে সেই দেশে উন্মুক্ত হয় সমান্তরাল দুই ফ্রন্ট। একদিকে নাৎসিরা যুদ্ক্ষেত্রে মানুষ মারছিল পিঁপড়ের মত, অন্যদিকে দুই জর্জিয়ান, স্ট্যালিন ও বেরিয়া বধ্যভূমিগুলোতে হত্যা করছিল পার্টি ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
গালাকতিওন তাবিদজে স্ট্যালিনের টেরর থেকে রক্ষা পান কিন্তু তার চোখের সামনে সংঘটিত নারকীয়তা ও তার প্রিয় বন্ধু কবি- সাহিত্যিকদের হত্যাকাণ্ডে তীব্রভাবে বিধ্বস্ত হতে দেখে এলকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। স্ট্যালিন-বেরিয়ার মৃত্যুর পরেও তার মানসিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের জানলা দিয়ে তিন তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি ১৯৫৯ সালের ১৭ই মার্চ। সোভিয়েত ইউনিয়নে কবিরা হয় আত্মহত্যা করতেন, নয় নিহত হতেন রাষ্ট্রের হাতে, এটাই ছিল নিয়ম।
আমরা প্যানথিয়ন দেখা শেষ করে আবার আকাশমুখী রেলে চড়ে বসি। বিশাল পার্ক পাহাড়ের চূড়ায়। ঘুরে ফিরে দেখার অনেক কিছু, শিশুদের সুন্দর সুন্দর রাইড। ঝর্না, গাছপালা, দৃষ্টিনন্দন দূরের দৃশ্য। সত্যিই সুন্দর শহর তিবিলিসি।
সেই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে দেখলাম। নীচে আদিগন্ত শহর, কুরা নদী এঁকে বেঁকে চলেছে তার বুক চিরে। কত কত গির্জা, ঘর-বাড়ি, ইমারত। ধীরে ধীরে বাতি জ্বলে উঠছে, তারপরে হঠাৎ দেখি এক আলো ঝলমলে শহর আমাদের নীচে। আমাদের উপরে আকাশে চাঁদ উঠেছে গোল চাকতির মত। পাখিরা নীড়ে ফিরছে হৈ হৈ করে।
আমাদেরও হোটেলে ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে।
ভালো লাগলো ভ্রমণ আখ্যানটি। ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, স্থাপত্য সহ বিবিধ বিষয়ের সুচারু বর্ণনে লেখাটি চমৎকার লাগলো।