রাজশ্রী বসু অধিকারী
অনেকক্ষণ থেকে মোবাইলটা একঘেয়ে সুরে ডেকে যাচ্ছে। ভল্যুম কম করা থাকলেও থেকে থেকেই বেজে যাওয়া আওয়াজটা অস্বস্তিকর। পরমা কীবোর্ড থেকে আঙুল সরিয়ে হাতে নেয় ছোট্ট দামী যন্ত্রটা। তুলে ধরে চোখের সামনে। জানাই ছিল কার ফোন হতে পারে এই অসময়ে। তবুও আরেকবার জানতে চেয়ে তাকিয়ে থাকে। এই চাওয়াটা ঠিক চাওয়া নয়। যেন অনেক অনেক চাওয়া এবং না পাওয়ার স্তর পেরিয়ে চোখ এসে পৌঁছেছে না চাওয়ার অভিমুখে। এই নাম পরমা আর দেখতে চায়না মোবাইলের পাতায়, গাছের পাতায়, খাতার পাতায়, চোখের পাতায় অথবা বুকের পাতায়। তবু তাকিয়ে থাকলে স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নাম দেখতেই হয়। শিক্ষিত মানুষের এ এক ভারী জ্বালা। কিছুতেই একমূহূর্তে হয়ে ওঠা যায় না অক্ষরজ্ঞানহীন। পরমাও দেখে নেয় কে ওকে ডাকাডাকি করছে।
অরিত্রজিত ফোন করেছে। রাত দুটো কুড়ি বাজে। অরিত্রজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করছে পরমা সান্যালকে। করেছে নয়, করেই যাচ্ছে। করেই যাচ্ছে। পরমার শুকনো খড়ি খড়ি সরু ঠোঁটদুটো একটুখানি বেঁকে যায়। এটা হাসি নাকি অনেক পুরোনো রেগে ওঠা কান্না সেটা যে মানুষ বলতে পারত এই সময় সে এখানে নেই। অনেক দূরে। আরও যার বলার কথা ছিল, বোঝার কথা ছিল, সেও বোঝেনি কখনও। পরমা সেই বাঁকানো ঠোঁটে নিশ্চুপ তাকায় সামনের দেওয়ালঘড়িটার দিকে। তারপর বন্ধ করে দেয় কলটা। চোখ বুজে বসে থাকে কিছুক্ষণ। পাশে রাখা জলের গ্লাসে চুমুক দেয়। আবার ফিরে যায় নিজের কাজে।
কাল একটা অনুষ্ঠানে তাকে নতুন উপন্যাসের খসড়া পাঠ করতে হবে। তার ওপর আলোচনা সভা। সেই সভার বক্তব্য অনুযায়ী শেষ করতে হবে উপন্যাস। সেই উপন্যাসের ওপর চিত্রনাট্য তৈরী করবে নামী দামী একটি গ্রুপ। সেই গ্রুপের সঙ্গেও দফায় দফায় বসতে হবে পরমাকে। সব ফাইনাল হয়ে গেলে তৈরী হবে একটি নতুন ওয়েব সিরিজ। শুধু এই পর্যন্ত হলে একরকম ছিল। পুরো ব্যাপারটার গুরুত্ব বেড়ে গেছে যখন প্রোডাকশন কোম্পানীর মালিক অনিন্দ্য বলে রেখেছে, “পরমাদি, আমাদের ওটিটি প্লাটফর্মের এই চার নম্বর কাজ। এটাতে আমরা ফার্ষ্ট প্রাইজটা চাই। সেই আশা নিয়েই আপনার কছে এসেছি।” আগে এসব কম্পিটিশন ছিল না। কিন্তু এখন বেশ কয়েকটা বড় বড় কোম্পানী অনেক ঢাকডোল পিটিয়ে কোটি টাকা খরচ করে ওটিটি সিরিজগুলোর মধ্যে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন শুরু করেছে। এটাও একটা নতুন রকম ব্যবসা। পরমার লেখার গুরুত্বটা এখানেই অনেকটা বেড়ে গেল। বাড়ল কাজের চাপও।
অনিন্দ্য প্রচুর টাকা দিয়ে এগ্রিমেন্ট তো করেইছে, সেইসঙ্গে রেখে গেছে কাতর অনুরোধ উপরোধের বন্যা। পরমা এইখানটাতেই আটকে গেছে। কারোর অনুরোধ অবহেলা করতে ওর আজও এতখানি বয়সে এসেও কষ্ট হয়। ফলস্বরূপ যত কষ্ট সব ওর নিজের কাঁধে চেপে যায়।
নিজের আর সব লেখাপত্র ছেড়ে, অন্যান্য সমস্ত পাবলিশারদের কাজ ফেলে রেখে ক’দিন ধরে পড়ে আছে এই ওটিটির লেখা নিয়ে। আগে এটা শেষ করবে তারপর অন্য কিছু।
পরমা আবার লেখায় মন দেয়। কিন্তু দু’চার শব্দের বেশী এগোয়না। টং টং করে সমানে অরিত্রর মেসেজ ঢুকছে। কী এত লিখছে ও এতরাত্রে? ঘুম নেই ওর চোখে? দু’সেকেন্ড ভাবে পরমা। তারপর অলস আঙ্গুলে খুলেই ফেলে হোয়াটস অ্যাপের নির্দিষ্ট প্রোফাইল।
“কেন আমার ফোন ধরছো না তুমি? কেন? কেন? কেন? আমি ঘুমোতে পারছি না। তোমার ভয়েস না পেলে আজ আর ঘুম আসবেনা, কেন বুঝতে পারছো না? তুমি চাওনা আমি ভাল থাকি সুস্থ থাকি?”
“আজ সন্ধ্যা থেকেই মন তোমাকে চাইছে। খুব খুব গল্প করতে ইচ্ছে করছে, সেই
অনেকদিন আগের একটা সন্ধ্যার মত। একবার যাবে সেই জায়গাটায় যেখানে আমরা কাটিয়েছি কত সুন্দর মূহূর্ত?”
একটা দুটো তিনটে চারটে… মেসেজের পর মেসেজ, ঢুকেই যাচ্ছে একের পর এক। চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে একটু মুছে নেয় পরমা। আনমনে তাকিয়ে থাকে সামনে দুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের দিকে। কার মেসেজ এগুলো? অরিত্রজিত নামের সেই মানুষটার! কী আশ্চর্য! ও পারে নাকি এরকম মেসেজ করতে! কবে শিখল! জীবন ওকে কবে হাতে ধরে শিখিয়ে দিল এমন করে নিজের কথা বলতে! পরমা মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু সময় চুপ করে বসে থাকে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় ওর, না এই প্রথম তা তো নয়, আরও একবার ঠিক এরকমই হয়েছিল। সে বহুদিন আগে একবার পাল্টে গিয়েছিল। এইরকমই একটার পর একটা মেসেজ করে যেতো। আর বোকার মত পরমা সেই মেসেজগুলো বিশ্বাসও করে ফেলত। কিন্তু তারপর তো একসময় ওর নিজের কাছেই সেই বোকামিগুলো সব আকাশে ছুঁড়ে দেওয়া ফানুসের পোড়া খোল হয়ে ফিরে এল একটা একটা করে। আর একটু একটু করে প্রাণবন্ত চঞ্চল চিরযৌবনা মেয়েটা বুড়ো হয়ে গেল। ওর না প্রতিজ্ঞা ছিল এ জীবনে কখনো বুড়ো হবে না! সেই প্রতিজ্ঞাটা ছিঁড়ে ছড়িয়ে গেল আকাশময়। সেই ছেঁড়া প্রতিজ্ঞার ফাঁক দিয়ে পরমার চুলগুলো সাদা মেঘের মত ভেসে ভেসে ভাঙ্গা ভেলায় চেপে উড়ে এল এইদিনটার দিকে।
পরমা মোবাইলের পর্দায় তাকাব না তাকাব না করেও চোখ মেলে দেয়। ওদিকে এখনো টাইপিং দেখিয়েই যাচ্ছে। নাহ আজ নিজেও ঘুমোবে না ওকেও ঘুমোতে দেবে না। লিখব না লিখব না ভেবেও একটা লাইন রিপ্লাই লিখেই ফেলে, “ঠিক আছে। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। সকালে উঠতে হবে। এবার ঘুমোও। গুডনাইট।”
ওদিকে কী প্রতিক্রিয়া হল তা আর জানার ইচ্ছে নেই। রিপ্লাইটা সেন্ড করে দিয়েই মোবাইল বন্ধ করে দেয় ও। সুইচড অফ। প্রায় সময়েই ইচ্ছে হয় চিরদিনের মত এই মোবাইলটা সুইচড অফ করে রাখে। কিন্তু আজকের যুগে আর সেটা সম্ভব না! একটা নিঃশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে উঠে পড়ে। আজ আর কাজ হবে না। শুয়ে পড়াই ভাল। সকাল হতে না হতেই দিনটা ঝাঁপিয়ে পড়বে একগাদা কাজ নিয়ে।
ঢকঢক করে প্রায় হাফ বোতল জল শেষ করে শুয়ে পড়ে পরমা। মাথার কাছে ঝুলতে থাকা বেড সুইচ এর দিকে তাকিয়ে থাকে। গুটিয়ে রাখা তারটা নেওয়া হল না। আবার উঠতে হবে। পরমা কপাল কুঁচকে উঠেই পড়ে। আর মাটিতে পা রাখতে গিয়েই হঠাৎ টাল হারিয়ে উল্টে পড়ে খাটের একদম সামনে। বাঁ হাত দিয়ে শরীরের ভর সামলাতে চেষ্টা করে। পারে না। মাঝখান থেকে কব্জীটা ভয়ঙ্কর ব্যাথা করে ওঠে। ডান হাঁটু আর বাঁ হাত একসাথে মনে করিয়ে দেয় পরমা তোমার বয়স বাষট্টি। বোধহয় গলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কিছু কাতর শব্দ। পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে অনুপমা।
“এ কী? পড়লে কী করে এত রাত্রে? ইশশ… ওঠো ওঠো …দেখি আমার হাতদুটো শক্ত করে ধর…”
“তুই এত রাত পর্যন্ত ঘুমাসনি কেন অনু? তোর না কাল সকালেই আউটডোর আছে? চোখের তলায় কালি নিয়ে যাবি শ্যুটিং করতে?” বসে বসেই পরমা বকুনি দেওয়ার চেষ্টা করে।
কিন্তু সাতাশ বছরের গার্জেনটির ঝঙ্কারের কাছে সেই বকুনি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
“তুমি উঠবে? কি করতে গেছিলে এত রাত্রে? শোওনি কেন? ডাক্তার বারবার বলছে তাড়াতাড়ি করে শুয়ে সকালে লেখালিখি করতে, একটা কথাও কানে যায় তোমার? দেখি এসো এদিকে …হাতটা দাও, মুভ লাগাব। পায়ের কোনখানটা গেল? বাঁ পা তো আগেই সেরে বসে আছো …এবার ডান পা …দেখি দেখি নাইটী তোল …উফফফ … মনেই থাকে না যে বয়স হয়েছে, উনি আর খুকীটি নেই …”
অবিশ্রান্ত বকরবকর করতে করতে অনুপমা পরমাকে টেনে তুলে বসায় খাটের ধারে। হাতে পায়ে মুভ ম্যাসাজ করতে থাকে। পরমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “হ্যাঁ, আমার বয়স হয়েছে আর তুই আমার ঠানদি হয়েছিস। সেই থেকে বকুনি দিয়েই যাচ্ছিস। দে, বেডসুইচটা নামিয়ে দে। এটাই যত নষ্টের গোড়া।”
“ইশশ এই সুইচটা নিতে গিয়েই পড়লে? আশ্চর্য! এ তো হাত বাড়িয়েই নেওয়া যায়। তুমি নামতে গেলে কেন? মন কোথায় থাকে তোমার? আমাকেও তো ডাকতে পারতে একবার!”
অনুপমা সুইচ হাতের কাছে দিয়ে পরমাকে ঠেলে শোওয়ায়। গায়ে ঢাকা দিতেও ভোলে না। এইসব ছোট ছোট ভালবাসার বড্ড লোভ পরমার। চুপ করে সবটুকু চেটেপুটে নিয়ে চোখ বুজে বলে,
“এতরাত অবধি জেগে ছিলি কেন? কিংশুকের সাথে চ্যাট চলছিল? কবে আসবে কিছু বলল?”
একটু আগের কথার ফুলঝুড়িটা থেমে যায় মূহূর্তে। একটু সময় চুপ থেকে অনুপমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে, “কিংশুক আর কখনও আসবে না মনিমা। ভেরী সরি, তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না।”
অনুপমা চলে গেছে পাশের ঘরে। হয়তো পাশের ঘর থেকে কোন এক ছায়াঘেরা বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর মন। হয়তো ওর শরীরের আনাচে কানাচে আধোফোটা ফুলগুলো সব কান্নার উৎসবে মালা হয়ে সাজবে আজ রাতেই। শুধু সেই মালার পরিপাটী সজ্জা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকবে না কোন শ্রান্ত পথিক। কেউ দরজায় এসে ডাক দিয়ে বলবে না, আমার তৃষিত কন্ঠ একটু ভিজিয়ে দেবে? কী হল মেয়েটার! ওইটুকু কথা থেকে কিছুই তো বোঝা গেল না। ও কি আরেকবার ডেকে নেবে অনুপমাকে? জানতে চাইবে এসব কথার মানে কী? কিংশুক ছেলেটা তো এ বাড়ীর হাফ মেম্বার হয়েই আছে দু’বছর আগে থেকে। শুধু অনুষ্ঠানটুকু বাকী। তাহলে! কী এমন ঘটল যে আর কখনও আসবে না সে? নাহ, শরীরের কষ্ট ছাপিয়ে মাথার মধ্যেটা কীরকম করে উঠতে থাকে। এমন সব সমস্যা যার কোনও উত্তর নেই সামনে। পরমা সুইচ টিপে অন্ধকার করে দেয় ঘর। অনুপমার কথা ভাবতে গিয়ে কখন ওর চিন্তার সুতোগুলো পথ হারিয়ে এতাল বেতাল ঘুরে বেড়ায় জট পাকিয়ে। নিকষ কালো পর্দা ভেদ করে ওর বন্ধ চোখের পাতার তলায় ভেসে ভেসে উঠতে থাকে সুইচড অফ মোবাইলের স্ক্রীন। সেখানে অজস্র না লেখা মেসেজের ব্যস্ত আনাগোনা।
পা আর হাত সমানতালেই ব্যথা হতে শুরু করেছে। কোলবালিশটা আঁকড়ে ধরে আস্তে আস্তে পাশ ফেরে পরমা। প্রতিদিনের মত ঘুমের আগে আরও একবার ভাবে, নাহ, সেই গল্পটা এবার লিখে ফেলতেই হবে। কালই শুরু করব। কাজ ফেলে রাখা ভাল নয়। বয়স বাষট্টি হল। খুব বেশী সময় আর নেই হাতে। মনে মনে আরও একবার ঝালিয়ে নেয় অজস্রবার দেখা সেই অসহ প্রোফাইল পিকচার, আরও একবার ছুঁয়ে যায় বাষট্টি থেকে ছাব্বিশে ফিরিয়ে নেওয়া সেই আগ্নেয়গিরির লাভা, জমাট বরফের মত ঘুম এসে যতক্ষণ না মৃত্যুর দেশে নিয়ে যাচ্ছে, আরো ক’বার মন বেঁধে নেয় কপালের বলিরেখা দিয়ে।
অভিদীপ, ও আমার অভিদীপ, অভি, অভি, শুনতে পাচ্ছ? শুনতে কি পাচ্ছ? এত যে ডাকছি তোমায়! একটুও সাড়া দিলে না কেন? ঘুমিয়ে পড়লে আমার কাছে একবারও না এসে? কেন? কেনওও? আমি যদি কাল থেকে তোমায় একবারের জন্যও না ডাকি? আর যদি তোমায় একটুও ভাল না বাসি? পারবে তো সহ্য করতে? কিচ্ছু হবে না তোমার? একটুও কষ্ট হবে না? বল?
যন্ত্রের মত আঙুলগুলো মোবাইলের ওপর বুলিয়ে যাচ্ছিল রিক্তা। নিজেও জানে না কি লিখছে কেন লিখছে। শুধু ওর বুকের তলা থেকে একরাশ কষ্টের সুতো মাকড়শার জাল বুনে বুনে ওকে ঘিরে ফেলেছে। সেই জাল থেকে মেসেজগুলো বেরিয়ে এসে মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে ভেসে ভেসে উঠছে। রিক্তার নিজের হাতের ওপর নিজেরই কোন কন্ট্রোল নেই আর। দেওয়াল ঘড়ি দু’বার ডাক দিয়ে যায়। পাশ থেকে মঞ্জরী ঘুমন্ত গলায় বলে ওঠে, “ওরে বাবারে, দু’টো তো বাজল, এখনও ঘুমোবি না? লাইট অফ কর …”
“আমার ঘুম আসছেনা মঞ্জী…” রিক্তার ফিসফিস করে বলা কথাটা জাগিয়ে তোলে মঞ্জরীকে। উঠে বসে কপাল কুঁচকে। ঢকঢক করে জল খায়। ধীরে সুস্থে নেমে বাথরুমে যায়। তারপর ঘুরে এসে জানলার পর্দাটা টেনে সরিয়ে দেয়। সেখান দিয়ে এসে ঢুকে পড়া শেষরাত্রের করুণ চাঁদের চালধোয়া রঙ জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ঠেলা মেরে মেরে রিক্তাকে নিজের দিকে ফেরায়।
“জেগেই তো আছিস আমি জানি, এইটুকুর মধ্যে ঘুম আসেনি তোর। সারারাত আসবেও না বোধহয়। ওঠ …, চল কফি খাই। খাবি?”
“উউউহ… ঠেলিস না, আমি ঘুমোচ্ছি …” বালিশে মুখ গুঁজে বলে রিক্তা।
“যত ঢপ! এইমাত্র ঘুম আসছিল না, আর এক্ষুনি কাঁদা হয়ে গেল। এইসব ভেল্কির জন্যই তোর এত দুর্গতি। ওঠ ওঠ, আমি কফি করছি। তারপর নতুন সিডিটা চাপাব, ব্লু দেখব চল…”
চড়াং করে উঠে বসে রিক্তা। বালিশ ছুঁড়ে দেয় মাটিতে। দু’চোখে লাল ছোপ, নিঃশ্বাসে ঘনঘটা,
“না, ওসব বাজে বাজে ফিল্ম দেখতে আমার একটুও ভাল লাগে না। তোর ইচ্ছে হয় তুই দেখ …”
“নেকু পুষু আমার, দেখতে ভাল লাগে না! করতে? করতে তো খুউব ভাল লাগে …বল!”
“মঞ্জী! …রাতদুপুরে আমাকে রাগাস না বলছি …” এবার গায়ের চাদরটা গোল্লা পাকিয়ে ছোঁড়ে রিক্তা। দু’কাপ কফি নিয়ে ধীরে সুস্থে এসে বসে মঞ্জরী। একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে চুমুক দেয় নিজেরটায়।
“এই তোর জন্যই আমার কোন ডায়েটিং ফ্রুটফুল হয়না” গোঁজমুখে নিজের কাপ ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলে রিক্তা।
মঞ্জরী হাসে, “শোন, আমার ওপর রাগ করে কোন লাভ নেই। এতক্ষণ ঘুমোসনি মানে সারারাত তুই ঘুমোবি না ভাল করেই জানি আমি। কফিটা খেয়ে এবার নিজের কাজ করতে শুরু কর। তারপর কাল বেলা বাড়লে ঘুমিয়ে নিস। আর, একটা কথা কখনও ভুলিস না, একটা বড় কাজের জন্য এখানে এসেছিস তুই। ওই একটা মানুষের জন্য নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করা তোকে মানায় না। ও ছাড়াও তোর একটা গোল আছে …”
রিক্তা এবার আর রাগে না। চুপচাপ নিজের কফিটা শেষ করে। তারপর উঠে পড়ে খাট থেকে। জানলা দিয়ে ভোরের আগের পবিত্রতম বাতাসের সবটুকু টেনে নেয় ফুসফুস ভরে। ড্রয়্যার থেকে নিজের ডায়েরী আর পেন বের করতে করতে একটাই কথা বলে, “তুই না থাকলে ভেসে যেতাম। আমার পায়ের নীচে মাটি যখন ঝুরঝুর করছে, যখন আমার শেকড় টলোমলো ভেসে যেতে চায় প্রবল স্রোতের টানে, সেই সেই সময়গুলো একমাত্র তুই আমাকে …”
“ব্যস ব্যস …আর দরকার নেই। একটু পরেই এই সব কথারা দৌড়ে পালাবে হয়তো, একবার শুধু শ্রীমানের মুখটা দেখার অপেক্ষা …। সত্যি কী যে পেয়েছিস তুই ওই কালো কোলো ষন্ডামার্কা লোকটার মধ্যে … , কী দিয়ে যে তোকে এমন জাদু করল…”
রিক্তা চেয়ার টেনে বসতে বসতে হাসে, “মোটেই তোমার ওকে এরকম লাগে না, বরং আমার চেয়েও বেশী পছন্দ তোমার। আমাকে এসব ভাট দিতে এসো না … তাও যদি আমি না জানতাম …”
“হ্যাঁ …দেখতে অবশ্য বেশ। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ওর চোখটা, বল? কিরকম যেন সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী। ফিগারটা তো একেবারে ফিদাআআআ…কাটারি…” মঞ্জীরা চোখ নাক আঙুলের এক বিকট মুদ্রা ফুটিয়ে তোলে। আর ভোর চারটের সময় বিকট শব্দ করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে রিক্তা।
“উফফ …ওরে বাবারে …প্লীজ মঞ্জী এসব উতপটাং শব্দ আমদানি করিস না …ওরে বাবা… ফিদাকাটারি আবার কী…”
“আহা, মারকাটারি হতে পারলে ফিদাকাটারি হবে নাই বা কেন? যাক গে বাবা, ফিগার নিয়ে কিছু বলছিনা আর। ওটা তোমার প্রেরোগেটীভ …”
“আরে বাবা, তুই বল না, কে বারণ করেছে …তোর তো ওকে খুব ভাল লাগে বলেছিলি…”
“হ্যা, লেগেছিল। কিন্তু তুই তো আগেই আমার লাইন ব্লক করে ফেলেছিস দেখলাম। আর সেও তো তোর দিকেই জান মন প্রান দিয়ে তাকাচ্ছে শুধু। আমি আর কেন হাড্ডি হই! সরেই এলাম।”
“এভাবে ভালবাসা অন অফ করা যায় বুঝি?”
“ভালবাসা হলে যায় না। আমার না ঠিক ভালবাসা পর্যন্ত হয়নি বুঝলি? ওটা একটা ক্রাশ ছিল। তা সে তো তোর কল্যাণে এখনও দেখতে পাব বা পাচ্ছি। ওটুকুই আমার পক্ষে বেশ। কিন্তু তোকে আমি বলে দিচ্ছি তুই কিন্তু নিজের ক্ষতি করছিস। ওকে এত বেশী প্রশ্রয় দিস না। তোর যে একটা আলাদা ভ্যালু আছে সেটা ওকে রিয়ালাইজ করতে দে। ও কিন্তু তোকে টেকন ফর গ্রান্টেড করছে। এটা খুব খারাপ।”
রিক্তা নিজের ডায়েরী বের করে সাদা পাতায় আকিঁবুকি কাটছিল। জানলার বাইরে থেকে একটা আলোর টুকরো কেমন পর্দার ফাঁক দিয়ে দিয়ে চুপিসারে এসে বসেছে রিক্তার গালে কপালে। কালচে নীল আকাশে দুলতে থাকা বাতাসের পর্দায় লেগে সেই আলোর টুকরো হেসে হেসে খেলা করে রিক্তার গাল থেকে জানলার গ্রীল, গ্রীল থেকে দেওয়াল বেয়ে উঠতে থাকা কলমীলতার ঝাড়, রঙ্গনফুলের গুচ্ছ, বুকে নুড়িপাথর বিছিয়ে শুয়ে থাকা করুণ রাগিনীর চলন ভরা পথ জুড়ে।
“আমি কতবার ভেবেছি নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাব ওর জীবন থেকে। চলে যাব অনেক দূরে কোথাও। কিন্তু পারি না। কী ভীষণ টানে যে ও আমাকে ধরে রাখে, শত চেষ্টাতেও কোথাও যেতে পারি না আমি। ওর দেওয়া সব আঘাত আমি পর্যন্ত এসে কেমন ফুল ফুল হয়ে যায়। সব কাঁটা মাঝপথে কেমন উধাও হয়ে যায় আমাকে ভালবাসার ঝর্নায় ভিজিয়ে। ওর চোখের দিকে তাকালে, ওর কথা ভাবলে আমি সব ভুলে যাই, সঅঅঅব…। আমি আর একজন আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ থাকতে পারি না। নিজের কাজ, অ্যাম্বিশন, সব ভুলে যাই। মনে হয় আমার শরীরটাই শুধু আলাদা। আমার আত্মা একটাই। আমার সেই দ্রবীভূত আত্মার নাম অভি, আমার অভিদীপ, অভিদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।”
রিক্তা জানে না কখন ও লিখতে আরম্ভ করেছে। কেমন ঘোরের মধ্যে ওর ডায়েরির পাতা ভরে উঠতে থাকে। মঞ্জরীর বলে যাওয়া কথাগুলোর উত্তর ওর মনের মধ্যে গুনগুন করে ফেরে। অনেকসময় মঞ্জরীর কান পর্যন্তও পৌঁছোয় না সেই উত্তর। শুধু সারাদিনের চব্বিশ ঘন্টা রিক্তার মন প্রাণ জুড়ে থাকে সেইসব অন্তহীন কথামালা, যা আসলে অভিদীপের সঙ্গেই ক্রমাগত বলে যাওয়া কথার স্রোত। কোনও একজায়গায় এসে মঞ্জরীর প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে অভিদীপকে না বলতে পারা কথারা সমুদ্রের ঢেউ হয়ে মিশে যায় রিক্তার বুকের ভেতর।
অস্থির হাতের ধাক্কা পড়ে দরজায়। পামেলা ঘন ঘন হাতের চাপড়ে ভরিয়ে তোলে মাঝরাত্রের নিস্তব্ধতা।
“দীপ…দীপ… কী করছ এতক্ষণ বাথরুমে! খোল, দরজা খোল… কী হল আমি সেই থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? সাড়া দিচ্ছ না কেন? বাইরে থেকে লাগিয়ে দেব আমি দরজা … দেখবে? দেখবে তুমি? খোল বলছি এক্ষুনি…”
হালকা সবুজ আলোয় মোহময় ঘর, তাতে শাটিনের সাদা রাতপোষাক আর অবিন্যস্ত চুলের পামেলাকে অশান্তিময় কোন দ্বীপের অতৃপ্ত প্রেতিনীর মত দেখতে লাগছ । বাথরুমের দরজা খুলে অভিদীপ বেড়িয়ে আসা মাত্রই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গায়ের ওপর, “কেন? এতক্ষণ আমার ডাকে কোনও সাড়া দিচ্ছিলে না কেন? কি করছিলে তুমি বাথরুমে?”
যেন গায়ে কোন অনভিপ্রেত পোকামাকড়ের ছোঁয়া লেগেছে এভাবে বাঁ হাত দিয়ে পামেলাকে নিজের থেকে টেনে সরিয়ে এক পা এগিয়ে টেবিল থেকে জলের বোতলটা হাতে নেয় অভিদীপ। দু ঢোক জল গলায় ঢেলে বলে, “রাতের বেলা বাথরুমে কী করে মানুষ? বোকা বোকা প্রশ্ন যত!”
আবারও ঝাঁপিয়ে আসে পামেলা, “একদম মিথ্যে কথা বলবে না। আমি জানি তুমি বাথরুমে গিয়ে চ্যাট করছিলে। কোন মাগীটার সঙ্গে বল? বল কোন মাগীটাকে মাঝরাত্রে দরকার তোমার বাথরুমে দাঁড়িয়ে মাষ্টার্বেশানের জন্য? দেখি, দেখি তোমার পাঞ্জাবীর পকেট …আমি জানি মোবাইল নিয়ে ঢুকেছিলে তুমি …দাও আমাকে মোবাইল, আমি দেখব …”
অভিদীপের পাঞ্জাবীর পকেট লক্ষ্য করে টান দেয় পামেলা। অভিদীপ এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় ওকে। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে খাটের কোনায় গিয়ে পড়ে পামেলা। ককিয়ে ওঠে শব্দ করে।
“হ্যাঁ এবার চেঁচিয়ে লোক জড় কর। ছিঃ, নোংরা কথা বলার একটা সীমা থাকে মানুষের। তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। ঘেন্না …” নীচু গম্ভীর গলায় কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় অভিদীপ। ইচ্ছে হচ্ছে এই মূহূর্তে এই ঘরটা থেকে বেড়িয়ে যায়। কিন্তু পাশের ঘরে তোতোন আছে। ছেলেটার সামনেই আইসিএসসই পরীক্ষা। রাতে ভাল ঘুম না হলে সকালে পড়তে পারবে না। অভিদীপ চোখের সামনে না থাকলে বা ঘরের বাইরে গেলেই পামেলা চীৎকার চেঁচামেচি করে এমন নাটক করবে যে তোতোন কেন সারা পাড়াও জেগে যাবে। তার চেয়ে এই ঘরের মধ্যেই যত খুশী নাটক হোক। ছেলের চিন্তা ওরও আছে। অভিদীপ জানে ছেলের কানে পৌঁছোয় এমন উঁচুতে উঠবে না ওর গলার আওয়াজ। আগে আগে বহুবার প্রমাণ পেয়েছে। এই অসম্ভব নোংরা কথা বলা, সন্দেহবাতিক মহিলা তার ছেলের সামনে একেবারে আদর্শ চেহারা ধরে রাখে কী অবলীলায়। যাক, অন্তত এইটুকুর জন্যেই ওর শত অত্যাচার সহ্য করেও এই ঘরেই থাকতে হবে।
সিগারেটে টান দিতে দিতে একটা কথা মনে করে মৃদু হাসি খেলে যায় ওর ঠোঁটে। পামেলা ওর পালস চেনে। খুব মিথ্যে কথাও বলেনি। সত্যিই ও রিক্তার মেসেজগুলো পড়ছিল। মেয়েটা একটার পর একটা মেসেজ করে গেছে, একটারও রিপ্লাই দেওয়া হয়নি। দেবে কী করে! সারাক্ষণ সামনে পামেলা বসে। পকেটে রাখা অফসাউন্ড মোবাইলের ঘন ঘন ভাইব্রেশন টের পেয়ে অভিদীপ বুঝেছে যে ঢুকছে জলস্রোতের মত মেসেজ। উত্তর দেওয়া তো দূর, পড়তেও পারেনি। আসলে দোষটা ওরই। বাড়ীতে আসার আগে আজ রিক্তাকে জানানোই হয়নি। ও জানে টালিগঞ্জেই আছে অভিদীপ। আজ যে মধ্যমগ্রাম থাকছে তা জানলে কোন মেসেজই আসত না। যেদিন যেদিন বাড়ী আসে এরকমই বন্দোবস্ত। কিন্তু আজ কাজে এত ফেঁসে গেল যে বলা হয়নি। অবশ্য রিক্তার নাইন্টী পার্সেন্ট মেসেজের রিপ্লাই ও করে না ইচ্ছে করেই। যত চুপ করে থাকে মেয়েটা যেন ভালবাসায় পাগল হয়ে উঠতে থাকে। ছটফট করে ওঠে সদ্য কিশোরীর মত। একটার পর একটা অভিযোগ অনুযোগ মনখারাপ মেশানো সেই মেসেজগুলো কোন সুরেলা স্বপ্নের মত, কোন নেশালু পানীয়ের মত ভরে দেয় অভিদীপের একলা রাতগুলো। বলা যায় এটা ওর একটা খেলা। রিক্তা যত কষ্ট পায় কাঁদে ছটফট করে অভিদীপের ততই বাঁচতে ইচ্ছে করে, নিজের ঘরের এই নোংরা দুর্গন্ধ পরিবেশের অনেক ওপরে উঠে নির্মল বাতাসে ভেসে ভেসে ওর আত্মাটা অনেকটা সজীব হয়ে ফিরে আসে সাতচল্লিশ বছরের পুরনো এই খাঁচাটায়।
কিন্তু এমন তো না যে অভিদীপ কেবলই রিক্তাকে কষ্ট দিতেই ভালবাসে! কখনও কখনও ওর নিজস্ব হিসাবমতো ওকে ভালবাসাও দেয় বৈকি। একফোঁটা বা দুফোঁটা ভালবাসার জল পেলেই তো ওই মেয়েটা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। সেইটুকুও অভিদীপ খরচ করে অনেক কৃপণ হাতে। ইচ্ছে করে, ওর একবুক ইচ্ছে করে ভালবাসার সুনামিতে রিক্তাকে নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ভেসে যেতে। কিন্তু তা হয় না। আজও পর্যন্ত হয়নি তা। কারন অভিদীপের ভয় আছে। বেহিসাবী পেয়ে গিয়ে রিক্তাও যদি হয়ে যায় আরেকটা পামেলা? যদি ওর সব সুন্দর ভালবাসার ফুলগুলোয় পোকা ধরে গিয়ে গাছটাই মরে যায়? ওইটুকুই তো মাত্র নিজের আছে এই পৃথিবীতে। ওই হঠাৎ পাওয়া ঐশ্বর্য্য রিক্তা। ওই জায়গাটা ধ্বংস হয়ে গেলে আর অভিদীপ বাঁচবে কোন ভরসায়! হ্যাঁ অনেক ভয় আছে অভিদীপের। সেই ভয় এই পৃথিবীতে আর কাউকে দেখানো জানানো যায় না নিজেকে ছাড়া। তাই খুব সংযমী হয়ে খুব খুব কঠিন হয়ে অত্যন্ত কৃপণ হয়ে একটু একটু করে উপভোগ করতে চায় অভিদীপ, জিভ দিয়ে এমনকি নিজেরও অজান্তে চেটে চেটে নিতে চায় জীবনের স্বাদ। তাই পামেলা ঘুমিয়েছে জেনে পা টিপে টিপে গিয়েছিল বাথরুমে। মেসেজগুলো পড়তে পড়তে এমনকি মাষ্টার্বেশানের চেয়েও অনেক বেশী শারীরিক উত্তেজনাকে দমন করে সবেমাত্র একটা রিপ্লাই দিতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়েই শুরু হল দরজা ধাক্কানো।
সিগারেটে শেষটান দিয়ে আবারও হাসে অভিদীপ। নাহ, সত্যিই পামেলা ওর পালস জানে। জানে কখন কী করতে পারে ও। এতবছরের বিয়ের একটা আলাদা মূল্য থেকেই যায়। সেটাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে বিছানার দিকে ফেরে ও। পামেলা খাটে পা ঝুলিয়ে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে দুলে দুলে কান্নার মত গলায় অনেককিছু বলে যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে মায়া হয় অভিদীপের। নাহ, ওরও তো শান্তি নেই কোন। সারাক্ষণ মনের মধ্যে শুধু অশান্তি। বেচারা!
পামেলার পাশে বসে ওর ঘাড়ে হাত ছোঁয়ায় ও, “আচ্ছা, শোন পম, এই যে তুমি সেই থেকে মাগীগুলো মাগীগুলো করে যাচ্ছ …এত নোংরা ভাষা বলে কী আনন্দ পাও? মেয়েগুলো করেও তো বলা যায় …”
ছিটকে উঠে অভিদীপের হাত সরিয়ে দেয় পামেলা, “না যায় না। তুমি ভদ্রলোক সেজে মাগীবাজি করে যাবে, আর আমাকে সহ্য করতে হবে? বউ এর গায়ে হাত দিতে ইচ্ছে করে না আর বাথরুমে গিয়ে মাষ্টার্বেশান করবে অন্য মাগীর ছবি দেখে!”
অভিদীপ একটু আগেও মায়া করছিল পামেলাকে দেখে। এখন এই কথাগুলো শুনে আবারও মায়াই হয় ওর। রাগ হয় না। রাগের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। পামেলার হাত ধরে হালকা টান দেয়, “এসো শোবে এসো। জেগে থাকলে শরীর খারাপ করবে।”
এতক্ষণ অনর্গল বাজে বাজে কথা বলে যেতে থাকা পামেলা এবার চুপ করে এসে শুয়ে পড়ে অভিদীপের বাড়িয়ে রাখা ডান হাতখানার ওপর মাথা রেখে। কী বলা যাবে এই মানুষকে! এত নোংরা কথা যে বলে যায় যখন তখন তার কোনও চিহ্ন এই মূহূর্তে আর পাওয়াই যাবে না। সেকেন্ডে সব ভ্যানিস কিন্তু বাতাসে সেই দুর্গন্ধের রেশ তো লেগেই থাকে। ঘরের কোনায় কোনায় পুঞ্জীভূত হয় পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। আবার এই একপাশে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকা মানুষটাকে দেখলে মায়াও তো হয়! একে তো হাতের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায় না।
অভিদীপের বুক ঠেলে একটা ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। পামেলার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ও বলে, “পম, তুমি কি জানো না যে মাষ্টার্বেশান করার জন্য কারো ছবি দরকার হয় না! কেন শুধু শুধু নোংরা কথাগুলো বলে নিজে কষ্ট পাও আমাকেও কষ্ট দাও! আমরা আরেকটু ভাল থাকতে পারি না? আমি তো চেষ্টা করছি। তুমিও একটু হেল্প কর প্লিজ!”
পামেলা অভিদীপকে আঁকড়ে ধরে শুনছিল ওর কথা। এবার ওর শ্বাস গাঢ় হয়। বুকের ওঠাপড়া দ্রুততর হয়। আরও অনেকটা এগিয়ে আসে অভিদীপের দিকে। বেশ বোঝা যায় নিজেকে উজাড় করতে চাইছে ওর শরীর। ঝড়ের মত বয়ে যেতে থাকে অভিদীপের চোখে ঠোঁটে গলায় বুকে উষ্ণ চুম্বন স্রোত। পড়ে থাকা পুরুষ শরীর নিঃসাড়। সেদিকে খেয়াল ছিল না বুঝি কামোন্মত্ত নারীর। ক্ষিপ্রহাতে সে খুলে ফেলে পাজামার দড়ি। তারপর নিস্তেজ পুরুষাঙ্গের স্পর্শে শিউরে উঠে একরাশ অপমানের চাদরে ঢেকে নেয় নিজের উপযাচিকা শরীর। খাটের একধারে সরে গিয়ে কান্না বিকৃত গলায় বলে ওঠে, “আমি জানি তুমি আমাকে চাও না চাও না, আর কোনওদিন নেবে না তুমি আমাকে …কী লাভ …কী লাভ এভাবে একসাথে থেকে! চলে যাও, চলে যাও তুমি…আর কখনও এসো না।”
এরপরে আর সত্যি শুয়ে থাকা যায় না। পাজামার দড়ি বেঁধে নিয়ে উঠে আসে অভিদীপ। মনে মনে কথা বলে। যে কথা শুধু ওর মনই শুনতে পায়। হ্যাঁ তুমি ঠিকই জান পামেলা। তোমাকে দেখে আর শরীর জাগে না আমার। তোমার শত আকুল ছোঁয়াতেও আমি উত্থিত হইনা। আমি নিরুপায়। এই শরীর যা একদিন তোমাকেই দিয়েছিলাম, সময়ের পলি পড়ে পড়ে সেখানে অনেক বিতৃষ্ণার চড়া পড়ে গেছে। মনকে বুঝিয়ে নিয়ে কর্তব্য করানো যায়। শরীরকে জোর করে জাগানো যায় না। যা আমি পারি না তা করব কী করে! তোমার স্পর্শে আমার শরীরে ভর করে একশ’ বছরের পুরুষত্বহীনতা। একথা আমি যতই অস্বীকার করি তুমি বুঝে নাও নির্ভুলভাবে। এই শরীর আর তো আমার নয়। এই শরীরের অধিকার এখন অনেক দূরের সেই এক কাজল কালো চোখের মেয়ের যে আমাকে সারাক্ষণ বিনা স্পর্শেই বেঁধে রাখে, যাকে হাজার অবহেলা অবজ্ঞা দেখালেও সে সব তুচ্ছ করে সে এসে ঘুমের মধ্যেই আমায় ভরে দিয়ে যায় সঞ্জিবনীসুধায়, যার শেকড় চাড়িয়ে গেছে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আমার এই অনুভূতি যদি অন্যায় হয় তবে শত অন্যায় আমি স্বীকার করি। কিন্তু সেই অন্যায় থেকে বিরত থাকব এমন কোন উপায় আজ আর আমার নেই। আমাকে ক্ষমা কোর পম। অভিদীপ ধীর পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে থাকে ছাদের দিকে। এই শেষ রাত্রির অন্ধকারমাখা পৃথিবীটা ওর জীবনের জন্য পার্ফেক্ট একেবারে। একবার আকাশটা দেখবে। কেমন মায়াবী অন্ধকারেও জেগে আছে বহুদূরের মাটীর দিকে তাকিয়ে। কখনো তো আকাশ মাটির মিলন হবে। তখন একাকার হয়ে যাবে সৃষ্টি।
অভিদীপ নিশ্চিন্তমনে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখে। ও জানে এখন আর পামেলা চিৎকার করবে না, গালিগালাজ করবে না। এখন শুধু শুয়ে শুয়ে কাঁদবে ও। প্রতিবারই তাই কাঁদে। অভিদীপকে আঁচড়ে কামড়ে ছিন্ন করেও যতই জাগাতে পারে না, ততই ওর কান্না এসে ভাসিয়ে দেয় বাজারের সবথেকে দামী খাটের ওপর পাতা তারও চেয়ে দামী বিছানা। রাতের কান্নার স্রোত আবার দ্বিগুনভাবে গালিগালাজ অশান্তি ঝগড়া হয়ে ফিরে আসে দিনের আলোয়। মাসে দু’দিন অথবা চারদিন এই একই গল্প। বাকীটা তো অভিদীপের টালিগঞ্জের ফোর্সড ব্যাচেলর লাইফ। এটাই ওদের দাম্পত্যের ইতিহাস।
তবু এই সংসারও টিকে আছে একটাই মাত্র সরু সুতোয়। সেটা হল মায়া। ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে পামেলার কান্নাভরা মুখটা মনে করে আবারও বুকের ভেতর সেই মায়ার প্রস্রবণ টের পায় ও। আবারও মনে মনে হাত বুলিয়ে দেয় কাঁদতে থাকা পামেলার অবিন্যস্ত চুলে ভরা মাথাটায়। সেই সঙ্গে ঠিক করে নেয় একটা জোরালো যুক্তিসঙ্গত মিথ্যা, যা হয়তো ওর ফাটলে ভরা ভাঙতে বসা সংসারে সিমেন্ট আস্তরনের কাজ করবে। ভেবে নেয়, পামেলাকে বলবে, না পম আমি আর সুস্থ স্বাভাবিক নেই, আমায় ডক্টর কনসাল্ট করতে হবে, দেখো আমি আর পারি না আগের মত।
হয়তো পামেলা মেনে নেবে এই যুক্তি। হয়তো কিছুদিন শান্ত থাকবে ও।
মনে মনে একটা নতুন হাতিয়ার তৈরী করে এবার একটু শান্তি পায় অভিদীপও। হয়তো আরও কিছুদিনের জন্য ওর সংসারটা বেঁচেই গেল। না, এই পৃথিবীর কোন কারণের জন্যই সংসার হারাতে রাজী নয় ও। এখানে বড় মায়া। বড়ই মায়া এমনকি এই ফাটা চটা পলেস্তারাখসা সংসারেও। অভিদীপ কিছুতেই ভাঙতে দেবে না একে। যেভাবেই হোক ধরে রাখবে দু’হাতে।
রিক্তা টেবিলে ল্যাপটপের পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। মঞ্জরী স্নান সেরে ঘরে এসে ওকে দেখে ডাকতেই যাচ্ছিল। রোজ ভোর ভোর স্নান করা ওর অভ্যাস। সেসময়টা রিক্তা রোজই ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু আজকের মত এমনভাবে টেবিলে মাথা ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে না, তিন চারটে বালিশ নিয়ে বিছানাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই অনেক রাত অবধি জেগে জেগে লেখার পর শেষরাত্রে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়া রিক্তার এলোমেলো চুলে ভরা ঘুমন্ত ছেলেমানুষ মুখটা দেখেই মঞ্জরীর দিন শুরু হয়। তারপর স্নান করে এসে চা তৈরী করে ডেকে তোলে রিক্তাকে। কিন্তু আজকের শুরুটাই অন্যরকম হয়ে গেল। কাল একফোঁটা ঘুমোয়নি দু’জনেই। এখন টেবিলে ভর দিয়ে ঘুমোচ্ছে রিক্তা। ওর মুখ চাপা পড়ে আছে ঢেউ খেলানো চুলের তলায়। নির্ঘাত গায়ে ব্যাথা হবে এরপর। কিন্তু ডাকতে গিয়েও ডাকে না মঞ্জরী। থাক, এভাবেই একটু ঘুমিয়ে নিক না হয়। ডাকলেই জেগে যাবে। চা-টা না হয় কিছু পরেই করবে। মঞ্জরী একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে বন্ধুকে। তারপর বারান্দায় চলে যায় ভেজা তোয়ালে হাতে।
মঞ্জরীর সঙ্গে রিক্তার প্রথম দেখা হওয়াটা সেই ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভে। তারপর সেভেনে উঠে ছাড়াছাড়ি। আবার এই অনেকটা জীবন পার করে প্রখর লড়াইয়ের ময়দানে শহর কলকাতায় পিজি হোষ্টেলে। এখানে দুজনেই ছিল পেয়িং গেষ্ট হয়ে, একই বাড়ীর ওপরে নীচে। একদিন মুখোমুখি হয়েই গেল ডাইনিং হলে। ছোটবেলার বন্ধুত্বের উষ্ণতা একমূহূর্তে দুই বন্ধুকে ঢেকে ফেলেছিল হাজার স্মৃতির চাদরে। সেখান থেকে আলাদা একটা ছোট্ট রেন্টেড ফ্ল্যাটে উঠে আসতে দেরী হয়নি। মঞ্জরী কিছুদিন থেকেই ভাবছিল শিফট করার কথা। কিন্তু একা অ্যাফোর্ড করা কিছুটা মুশকিল তো ছিলই। তাই আর এগোয়নি। এখন রিক্তা জুড়ে যাওয়ায় অসুবিধা রইল না। লেখার জগতে বেশ নাম করে গেছে রিক্তা মুখার্জী। বছরখানেক ধরেই মোটামুটি ভাল টাকাপয়সা আসছে হাতে। তাছাড়া রিক্তা যেন বেঁচে গিয়েছিল মঞ্জরীকে পেয়ে। ও শুধু নিজের লেখার মধ্যেই ডুবে থাকতে চায়। নিত্যদিনের জীবনের মোটা দাগের প্রয়োজন অপ্রয়োজন ওকে ছোঁয়ও না খুব একটা, অথচ সেগুলো থেকে সবসময় মুখ ফিরিয়েও থাকা চলে না। এখন যেন ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে মঞ্জরীর গার্জিয়ানশীপে মঞ্জরীর কন্ট্রোলে নিজেকে এনে ফেলতে পেরে রিক্তা বেঁচে গেছে। শুধু টাকাটা ফেলে দিয়েই ও নিশ্চিন্ত। বাকী যা কিছু সব মঞ্জরীর দায়িত্ব। বারান্দায় দড়িতে হাতের তোয়ালেটা মেলে দিয়ে ঘরে এসে দাঁড়ায় মঞ্জরী। মোবাইল ঘড়িতে প্রায় আটটা। নাহ, অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। এবার চা না খেলে বাকী রুটিন একদম ঘেঁটে যাবে। রিক্তার থাই এর ওপরে গুটিয়ে থাকা নাইটিটা টেনে নামিয়ে চট করে পাশের ছোট্ট কিচেনে ঢুকে পড়ে ও। পাঁচ সাত মিনিট পর ট্রে হাতে এসে খাটে বসে পা ঝুলিয়ে।
“এই মেয়েটা, ক’টা বাজে খেয়াল আছে? ওঠ এবার, উঠে পড়। চা খেয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নে। আজ তোর ইন্টারভিউ আছে দূরদর্শনে। ভাল করে শ্যাম্পু কর, আমি হেয়ার ড্রাই করে কার্ল করে দেব। তারপর আমাকে বেরোতে হবে।”
“উমমম… আমি শ্যাম্পু করব নাআআআ…” মঞ্জরীর নাইটির কোনা ধরে টেনে চোখ বুজে বলে যায় রিক্তা। সাতসকালে স্নান করাটা ওর কাছে একটা পানিশমেন্ট। আর মঞ্জরীর এটাতেই বড্ড আপত্তি। রোজ এই নিয়ে একটা হুল্লোড় লেগে থাকে ওদের। তাতে কোনওদিন রিক্তা জেতে কোনওদিন মঞ্জরী।
“শোন। আমার টবে দুটো হলুদ জবা ফুটেছে …দ্যাখ কী সুন্দর! তুই তো বলেছিলি বাঁচবেই না গাছটা।”
“হ্যাঁ সায়ন দিয়েছে, ওই গাছকে তো বাঁচতেই হবে। এত যত্ন আদর লিটার লিটার জল আর গোবর ঢেলেছিস …বেচারী ভয়েই মরবে না।” রিক্তা পুরোপুরি ঘুম থেকে উঠে বসেছে। কোলের ওপর কোলবালিশ নিয়ে বসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মুখ ভেংচে বলে।
“ওই বাচ্চা ছেলেটাকে টানলি তো সকাল সকাল, এবার শ্যাম্পু তোকে করতেই হবে।” মঞ্জরী ওদের টেম্পোরারী ফোল্ডিং আলমারী থেকে শাড়ী বের করতে করতে বলে। রিক্তা সামনের প্রজাপতি ওয়াল হ্যাঙ্গিংটার দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমনভাবে বলে ওঠে, “আচ্ছা মঞ্জী অভিদীপ আমার একটাও মেসেজের রিপ্লাই কেন দেয় না বলতো! একটা অন্তত হ্যাঁ বা না তো বলতে পারে, আমার চিন্তা হয় এটা বোঝে না? কেন বলতো এমন করে!”
“অনেকবার বলেছি উত্তরটা… আর পারব না…”
“প্লিজ আরেকবার বল…”
“কারণ ও তোকে বহুদিন থেকেই টেকন ফর গ্রান্টেড করে রেখেছে, অন্য মেয়ে হলে ওর মুখ দেখত না, নাম করত না। তোর তো আরও বেশী করেই দূরে থাকা উচিত। এত নামডাক করেছিস, এত লোক তোকে নিয়ে মাতামাতি করছে, কোথায় অহংকারে মটমট করবি, পাঁচদিন পাঁচটা ছেলের সঙ্গে ডেট করবি তা না, এই একটা ছেলের পেছনে পড়ে আছিস…, অসহ্য …একদম আমাকে বলবি না এসব…” রিক্তার দিকে পেছন ফিরে শাড়ী ব্লাউজ হাতে নিয়ে বিরক্তিমাখা গলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছিল মঞ্জরী। এবার এদিকে ফিরে দেখে রিক্তা একটাও কথা না বলে খাট থেকে উঠে চলে যাচ্ছে বাথরুমের দিকে। ওর পা ঘষটানো মাথাটা নিচু করে চলে যাওয়া দেখে মূহূর্তে মঞ্জরীর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ইসস, সকাল সকাল বেশী রুড হয়ে পড়লাম। কোনও দরকার ছিল না এই কথাগুলো বলার। তার প্রধান কারণ হল, যাই বল আর যাই বোঝাও রিক্তার মাথায় কিছুই থাকবে না। অভিদীপকে নিয়ে আবারও ও শূন্যে স্বপ্ন বুনে যাবে। যাবেই। একবার পাঁচমিনিটের জন্য অভিদীপ এসে দাঁড়াক ওর সামনে, ও ভুলে যাবে গত দশদিনের ক্রমাগত খারাপ ব্যবহার। একথা বহুবার প্রমাণ হয়ে গেছে। মঞ্জরী কিছুতেই রিক্তার এই স্বভাবটা মানতে পারে না। কোনও যুক্তি দিয়েই ওকে রিক্তা কনভিন্স করতে পারেনি। একথা ঠিক যে প্রথমদিন অভিদীপকে দেখে মঞ্জরীরও ভাল লেগেছিল। সেই ভাললাগার রেশ এখনও রয়েই গেছে। কিন্তু মঞ্জরী জানে কোথায় থামতে হয়। প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে বুড়োবয়সের ক্রাশ নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করতে রুচি হয়নি ওর। তাই নিজেকে একপাশে নিয়ে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। এখন এটা ওর আর রিক্তার একটা হাসাহাসির টপিক। কিন্তু মঞ্জরী অনেক ভেবে দেখেছে, যেভাবে রিক্তা আকুল হয়ে থাকে অভিদীপের জন্য, বুক পেতে সহ্য করে ওর ছুঁড়ে দেওয়া সব নিষ্ঠুর আঘাত, সেভাবে শুধু মঞ্জরী কেন পৃথিবীর কোন মেয়েই বোধহয় কাউকে ভালবাসতে পারবে না। পুরো ব্যাপারটা ভাবলে অভিদীপের ওপর এক অসম্ভব রাগে মাথাটা তেতে থাকে ওর। আবার কখনও কখনও রিক্তাকে দেখলে এমনও হয় যে অপার বিস্ময়ে ওকে দেখতেই থাকে মঞ্জরী। এমন ভাবেও মানুষ কাউকে ভালবাসতে পারে বুঝি আজকের এই ইঁট কাঠ পাথরের স্বার্থপর পৃথিবীতে! একবারও নিজের কথা না ভেবে, কী পেলাম কতটুকু পেলাম সেই হিসেবের ধারেকাছে না গিয়েও শুধু ভালবাসার জন্যই ভালবাসতে পারে মানুষ! কই মঞ্জরী তো কাউকে এভাবে ভালবাসতে পারল না কোনদিন! পারবেও না! সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু নিজের অস্তিত্ব? না, রিক্তা যা পারে মঞ্জরী তা পারবে না কোনওদিন। মনের তলায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য রিক্তার জন্য একটা আশ্চর্য সম্ভ্রম রয়েছে ওর মধ্যে। কিন্তু তার খবর কেউ জানে না। মঞ্জরীও যতক্ষণ সজ্ঞানে থাকে ওর মনের মধ্যে জমে থাকা রাগটাই প্রকাশ পায় বারবার। সেই প্রকাশ কখনও রিক্তাকেও আঘাত করে। আর সেই আহত চোখ বা সেই আহত হেঁটে যাওয়া মঞ্জরীকেও ভেঙে দিতে চায়। একটু আগের রাগটা যত ফিকে হতে থাকে ততই মনখারাপ হয়ে যায় রিক্তাকে কঠিন কথা বলার জন্য।
ঠিক এখন যেমন হচ্ছে। ওই যে ও ধীরে ধীরে মাথা নীচু করে হেঁটে বাথরুমে ঢুকে গেল, কী যেন একটা ধাক্কা দিয়ে গেল মঞ্জরীর রাগে গনগন মনটায়। শাড়ীটা কোনমতে পরা হয়েছিল, প্লীট হয়নি। এখন কাঁধের ওপর আঁচলটা ছড়িয়ে বসে পড়ে মঞ্জরী। মনটা বিক্ষিপ্ত লাগছে। এভাবে ব্রেকফাস্ট বানাতে যেতেও ইচ্ছে করছে না। খাওয়ার মন তো ভ্যানিস। নিজেকে প্রাণপনে ধমকায় ও। ইশশ… আজ মেয়েটার ইন্টারভিউ। বাতায়ন প্রকাশনা থেকে গতবার বেরোনো রিক্তার ‘অনন্ত আমি’ উপন্যাস এবারের শারদ পুরস্কার পেয়েছে যেটা একটা বিশাল সম্মান। দূরদর্শনে এই উপন্যাস এবং পুরস্কার নিয়েই ইন্টারভিউ নেওয়া হবে রিক্তার। এমন একটা বিশেষ দিনের শুরুতেই রিক্তার মনটা খারাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য নিজেকেই ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে মঞ্জরীর। নিজের সমস্ত কাজকর্ম ভুলে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে ও।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল কে জানে! পাশে পড়ে থাকা রিক্তার মোবাইলটা বাজতে দেখে তাকায়। অভিদীপের গভীর চোখদুটো ভেসে উঠেছে। মঞ্জরীর এতক্ষনের রাগ গিয়ে পড়ে ওই ফোনটার ওপরে। কারও প্রাইভেসিতে হাত দেওয়া উচিত নয় এই জ্ঞানটাও থাকে না মূহূর্তের জন্য। রিসিভ করে কলটা। কঠিন গলায় ছুঁড়ে দেয় শব্দগুলো, “মেয়েটাকে আর কত কষ্ট দিলে আপনার শান্তি হবে? ও বেঁচে আছে এটা সহ্য হচ্ছে না? একদম শেষ করে ফেলতে চান বুঝি?”
“কী মুশকিল, আমি… আমি… আপনি মঞ্জরী বলছেন তো? রিক্তা কোথায়?”
“সেটা জেনে আপনি কী করবেন? বেঁচে আছে কিনা তাই জানার জন্য এক সপ্তাহ পরে ফোন করেছেন?”
“দেখুন, আমি আপনাকে এক্সপ্ল্যানেশন দেওয়ার অবস্থায় নেই। ওকে ফোনটা দিন।”
“আমি চাই না ও এখন আপনার সঙ্গে কথা বলুক। ভাবছি ফোনটা দেব না ওকে” ক্ষুদ্ধ গলায় বলে মঞ্জরী। অভিদীপ সামলে নিয়েছে নিজেকে। মঞ্জরীর হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা লাগলেও গলায় ফোটে না সেই ভাব। ভারী গম্ভীর গলায় বলে, “আমি জানি আপনি কতটা কনসার্ন রাখেন ওর ব্যপারে। কিন্তু আপনার কথার জবাব এভাবে তো দেওয়া যাবে না। আমি একদিন দেখা করতে চাই। আসুন তিনজনে কোথাও বসি, তারপর আলোচনা করা যাবে।”
“দেখা? আপনি বসবেন আমাদের সঙ্গে? কবে? কখন? সেই সময় আছে আপনার? শুনুন অভিদীপ আমি রিক্তা নই, যে আপনার দেওয়া সময়ের অপেক্ষায় হাঁ করে তাকিয়ে থাকব, তাকিয়েই থাকব।”
অভিদীপ হেসে ফেলে, “আমার দোষ আছে মানছি, কিন্তু আপনি তো একদম কোমর বেঁধে রেখেছেন দেখছি সকাল থেকে…, বন্ধুর জন্য এতখানি ভালবাসা কিন্তু দেখা যায় না। রিক্তা খুব লাকি…”
“এই শুনুন, আমি এসব ফ্ল্যাটারিতে একটুও মুভড হই না। ওই যে এসে গেছে, দিচ্ছি …”
“এই কে রে? কার সঙ্গে এত বকরবকর করছিস?” বলতে বলতে রিক্তা স্নান করে এসে দাঁড়ায়। মঞ্জরীর বাড়ানো হাত থেকে মোবাইলটা কানে চেপে স্থির হয়ে যায় দু’মূহূর্ত। মঞ্জরী তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“না গো, আজ তো আমার ইন্টারভিউ আছে। তোমাকে বলেছিলাম। হয়তো ভুলে গেছ…”
“ইভনিং এ? জানি না, টাইম পাব কিনা আগে থেকে বলব কী করে? কখন ওদের শেষ হবে …, না গো জানি না।”
“আচ্ছা…, দেখছি। ঠিক আছে, জানিয়ে দেব। মেসেজ করব, দেখে নিও …”
ফোন রেখে মঞ্জরীর দিকে তাকায় রিক্তা। মঞ্জরী পুরোটা শুনছিল দাঁড়িয়ে। এবার ওর ঠোঁট বেঁকে যায়, “ব্যস! ভালই এগোচ্ছিলি। কিন্তু পারলি না তো! শেষ পর্যন্ত আবার সেই জানিয়ে দেব, মেসেজ করব …, কেন? কেন শুনি? ওকে কখনও তো ইগনোর কর। করে দেখ না হয়তো পাল্টাবে একটু। কেন বুঝতে চাস না সাপ্লাই অঢেল থাকলে ডিমান্ড থাকে না? পড়িসনি ইকনমিক্স?” মঞ্জরীর গলায় মুখে চোখে বিরক্তি আর হতাশা মিলে মিশে গেছে।
“ছাড় না। ও তো বার বার বলছে একবার মীট করতে চায়। তোকেও তো নিয়ে যেতে বলল। কী করে না বলি বল তো! ওর তো খারাপ লাগবে! জানিস তো ওকে কোনও ব্যাপারেই না বলতে পারি না আমি! হাজার চেষ্টা করলেও তো শেষ পর্যন্ত পারি না…। শুনলি তো কতবার বললাম…”
“মর, ডুবে মর, গলায় দড়ি দিয়ে মর। কেউ পারবে না তোকে পাল্টাতে। উফফ…, ফালতু আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে…” গজর গজর করতে করতে মঞ্জরী চলে যায় ঘর ছেড়ে।
স্টুডিওর বাইরে কফিশপটায় ব্যস্ত পায়ে এসে ঢোকে রিক্তা। ওর ইন্টারভিউ শুরু হতে ঘন্টা খানেক বাকি আছে। এই সময়টা প্রোগ্রামটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অভিদীপ এতবার করে বলল যে ও নিজের কাজ শিকেয় তুলে টাইম বের করেছে। সন্ধ্যের পর মিটটা হলেই ভাল হত। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঠিকও হয়েছিল। বেরোনোর সময় মঞ্জরীকে বলেও এসেছে যে ফিরতে রাত হবে। ও লাঞ্চ করেই ফিরবে। প্রোগ্রামের পর চট করে একটু বিশেষ লুক নিয়ে নেবে বলে ব্যাগে স্পেশাল একটা চেঞ্জও এনেছে। কিন্তু দুম করে মাঝরাস্তায় মেসেজ এসে গেল। অভিদীপ জানিয়েছে এই কফিশপটায় ও আসছে কিছুক্ষণের জন্য। রিক্তা যেন এখানেই দুপুরবেলায় ওয়েট করে। সন্ধ্যায় ওর অসুবিধে এসে গেছে। এইরকমই করে ও। যখন তখন নিজের ইচ্ছেমত নিজের সুবিধেমতো সময় ভেনু সব চেঞ্জ করে জাষ্ট একটা মেসেজে জানিয়ে দেয় রিক্তাকে। একবারও জিজ্ঞেস করে না রিক্তার পক্ষে কোন সমস্যা আছে কিনা। আর রিক্তা কয়েক কোটিবার আসব না আসব না করেও না এসে পারে না। এই যেমন আজ হল। আজ রিক্তার জীবনে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। ওর লেখা নিয়ে ওকে ইন্টারভিউ করবে একটা চ্যানেল। খুব কম কথা নয় সেটা। সেই ইন্টারভিউ এর সময় তারিখ সব ঠিক হয়ে আছে বহু আগে থেকে। বেশ কয়েকবার অভিদীপকে সে কথা ও বলেওছে। তবু আজ এই সময়টাই অভিদীপের সময় হল দেখা করার জন্য। আর এখন নিজের কাজ কার্টেল করে সবাইকে হাজারটা মিথ্যে কথা বলে রিক্তা এসে কফিশপে বসে আছে। অথচ সময়ের পনেরো মিনিট পরেও অভিদীপের দেখা নেই।
একটা ব্ল্যাক কফি নিয়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইল কানে তোলে রিক্তা, “হ্যাঁ রাকেশ, ভাই আমি চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আসছি। আর বোলো না, খুব জ্যামে ফেঁসে গেছি গো।”
ইশশ, এইসব বাহানা দিতে এত খারাপ লাগে ওর। কিন্তু অভিদীপের সঙ্গে প্রোগ্রাম মানেই অজস্র সমস্যা, যার সবটাই একা ওকে ফেস করতে হয়। তাও যদি পনেরো মিনিট কোয়ালিটি টাইম পাওয়া যেত! যেটুকু সময় ও বসবে তার নাইন্টি পার্সেন্ট টাইম অসংখ্য ফোনে কথা বলে যাবে। জীবনে একটাও ফোন ও ছেড়ে দিতে পারে না রিক্তার জন্য।
কালো কফিটা এমনিতেই তেতো। আরো যেন বিস্বাদ তেতো লাগছে। একা একাই নিজের করুণ অবস্থাটা ভেবে হেসে ফেলে রিক্তা। নিজের জন্য মায়া হয় ওর। এখন যদি স্টুডিও ছেড়ে রেকর্ডিং ছেড়ে ওকে এখানে এভাবে একা সময় নষ্ট করতে দেখত মঞ্জরী তাহলে নির্ঘাত খুন করে ফেলত রাগে। মঞ্জরী কথাগুলো যে বলে, একটাও তো ভুল বলে না। আচ্ছা, আমি কেন এখানে বসে আছি? আমার তো এখন স্টুডিওতে থাকার কথা। আজ আমার ইন্টারভিউ। ওখানে সবাই আমার জন্য ওয়েট করছে। ওরা আমায় ভালবাসে, সম্মান করে। ওদের কাছে আমার নামটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে কেন আমি এমন একজনের জন্য বসে আছি যে হয়তো আমাকে তার প্রায়োরিটি লিষ্টের সত্তর নম্বরেও রাখে না। কেন আমি আসি বার বার? কেন ও ডাকলে আমি না করতে পারি না? কেন ওর গলায় একবার নিজের নামটা শুনলেই পৃথিবী ভুলে যাই আমি? আমার জন্য আজ পর্যন্ত কী ছেড়েছে ও? কতটুকু ছেড়েছে? কিছু না, একটুও না। তাহলে আমি শুধু একাই পাগল হয়ে কেন নিজেকে শেষ করব? রিক্তা মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজেকে দেখতে দেখতে অজস্র প্রশ্ন করে যেতে থাকে নিরুচ্চারে। প্রশ্ন ওর। উত্তরও ওরই। সেই উত্তরগুলো সব সাগরের গভীরে মিশে থাকা নুনের পাহাড়ের মত। ওর বুকেই জন্ম, বুকের ভেতরেই প্রতিমূহূর্তে গলে গলে শেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু সমুদ্রের জলে মিশে থাকা লবন জলকেও কখনও চেনা যায়, দেখা যায় চোখে লবনের বিন্দু, যদি তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিস্রুত করানো যায়। এই বিশেষ প্রক্রিয়া রিক্তা কী কখনও অবলম্বন করেনি? করেছে। অনেক সময়েই করেছে। নিজের মনের সমস্ত স্বপ্ন আশা আকাঙ্খাকে চাবুকের আঘাত মেরে মেরে শক্তি সঞ্চয় করতে চেষ্টা করেছে। নিজেকে পাখী-পড়া করে শিখিয়েছে, কারও হাতে এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নাম ভালবাসা নয়। এ হল আত্মঅবমাননা। এখান থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে অনেক দূরে বের করে নিতে হবে ওকে। অভিদীপ ওকে হয়তো সামান্য ভালবাসে। ভালবাসার চেয়েও অভিদীপ ওর খেলার সাথী হিসেবেই রিক্তাকে সর্বক্ষণ সঙ্গী করতে চায়। যেন ছোট ছেলের অনেক খেলনার মধ্যে কোন একটা স্পেশাল পুতুল নিয়ে গর্ব, ওইটা আমার আছে, ওটা আর কারোর নেই।
কিন্তু রিক্তা মানুষ। ও আরও কিছুটা বেশী চায়। সেটা এখানে কোনদিন পাবে না। তাই আজ আর নয়। আজ নয়, কাল নয়, পরশুও নয়। এবার চলে যাবে ও। অভিদীপের জন্য এই শেষ তিরিশ মিনিটের অপেক্ষাটুকুই রইল কালের গর্ভে। আর না। আর কোনওদিন না। কফির বিল মিটিয়ে উঠে পড়ে রিক্তা। পা বাড়ায় কাচের স্যুয়িং ডোর ঠেলে বাইরে। ভাগ্যটা ভাল ছিল। ভাল না খারাপ কে বলতে পারে! সামনে দিয়ে একটা ফাঁকা হলুদ ট্যাক্সি যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে থামায় ও। উঠে বসে শাড়ীর আঁচল গুছিয়ে। স্টুডিওর দিকে এগিয়ে যায় কিছুটা। আর তখনই ফোনটা বাজতে থাকে। অভিদীপ। রিসিভ করে কিছুমাত্র বলার আগেই কানের মধ্যে ঢুকে পড়ে একগাদা বিরক্তি মেশানো শব্দ, “কোথায় তুমি? আরে বাবা কত প্রবলেম করে এসময়টা আসতে পেরেছি। এখনও এসে পৌঁছাওনি? হরিবল! এক্ষুনি আমার একটা মিটিং আছে…। কতক্ষণ ওয়েট করতে হবে আমায়?”
রিক্তার ঠোঁটে একটু ভেজা হাসি ছুঁয়ে যায়।
“একটুও ওয়েট করতে হবে না তোমায়। আজ আমি আসতে পারব না। তুমি চলে যাও।”
“মানে? তুমি জানো কত দিক ম্যানেজ করে তবে আসতে পেরেছি? নিশ্চয়ই তোমার ওই মঞ্জরী তোমায় গাইড করছে?”
“কেন ওকে টানছো? তুমি আয়না দেখতে ভুলে গেছ। যাক, আমি এসব আলোচনা করতে চাই না।”
“শোন রিক্তা, কাল আমি তোমার মেসেজগুলোর রিপ্লাই দিতে পারিনি, তার কিছু কারণ ছিল নিশ্চয়ই। তোমাকেও কিছু ব্যাপার বুঝতে হবে। আমি অনেকবার …”
“থাক অভি। আমি কোন ব্যাখ্যা চাইনি তোমার কাছে। আমি প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করে চলে এলাম কারণ আর থাকা সম্ভব ছিল না। আজ আমার ইন্টারভিউ। তুমি জানতে সে কথা। তোমার কাছে শুধুমাত্র তোমার কাজটাই ইম্পর্ট্যান্ট। কিছুই না বলে টাইম অ্যান্ড ভেনু চেঞ্জ করে দিলে। শুধু একটা কথাই আমি বুঝি না, কেন আমাকে তবুও ধরে রাখবে তুমি! এই যে যৎসামান্য যোগাযোগ এটুকু না থাকলে মনে হয় আমাদের দুজনেরই উপকার।”
“তুমি এসেছিলে?”
“আমি বোধহয় আরও অনেকগুলো কথা বললাম …। যাকগে ছাড়ছি আমি।” ফোন কেটে দেয় রিক্তা। স্টুডিওর গেটে ঢুকছে ট্যাক্সি। জোর করে মরে থাকা মনটায় জল ছেটাতে চেষ্টা করে ও। চট করে ঠোঁটে বুলিয়ে নেয় লাল লিপষ্টিক। এতটুকু মনখারাপের গুঁড়োও লেগে থাকা চলবে না কোথাও। সে রাইটার। আ রাইটার রাইটস হার ওন ফেট হারসেলফ।
অনেক রাত্রে ফ্ল্যাটে ফিরে হাতের ব্যাগটা খাটের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে ক্লান্ত পায়ে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল রিক্তা। মঞ্জরী এখনও আসেনি। ওর তো মঞ্জরীর চেয়েও দেরীতে আসার কথা ছিল। ও হয়তো সেজন্যই দেরী করছে। আজ স্টুডিওতে ওরা সবাই খুশী। দুর্দান্ত বলেছে রিক্তাদি। প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ রাকেশ কিছুতেই ছাড়ল না সন্ধ্যে রাত্তিরেই ডিনার না করিয়ে। ওদের চাপাচাপিতে রিক্তাকেও কিছুটা খেতেই হল। ও প্রাণমন দিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছে, আড্ডা দিয়েছে, ছবিতে পোজ দিয়েছে, এমনকি খেয়েওছে। সবই করেছে একটা যন্ত্র। এমন সেই যন্ত্র যাকে কেউ চিনতে পারে না। অদ্ভুত এক প্রাণের প্রস্রবণ তাকে ঘিরে থাকে। চারদিকে সবুজ সবুজ সবুজ, সেই শ্যামলিমার অপার ছায়ায় ছুঁয়ে থাকা সমুদ্রের জল। রিক্তা মানেই অনেক আকাশ অনেক বাতাস, অনেক জল অনেক সবুজ। যে কোনও মানুষ যে কোন অবস্থায় ওর সংস্পর্শে আসুক, নিজেকে উজ্জীবিত করে ফিরে যায় আপন পৃথিবীর গতিপথে। কিন্তু যা কিছু যান্ত্রিক, যা কিছু কঠিন, তার একটাও ছায়া পড়ে না বাইরে। সেই নিষ্পেষন শুধু ভেতরে ভেতরে রিক্তাকেই নিঃস্ব রক্তাক্ত করে যায়। সবার সঙ্গে কাজ কথা আড্ডা আর খাওয়া দাওয়ার মাঝে থেকে থেকেই ওর মনের তলায় বেজে উঠেছে মৃত্যুর চেয়েও শীতল সেই বাজনা। সেই বাজনা নিষ্কাশিত হয় এক সজারুর পিঠের মত কঠিন যন্ত্র থেকে। যার নাম হৃদয়ের সভাঘর। যেখানে এক নিষ্ঠুর পদতলে মুছে যায় সব স্বপ্নের আলপনা।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল রিক্তা। নাহ আর না। অনেক হয়েছে নিজেকে খুন করে করে হোলি খেলার তাড়না। চোখে পটি বেঁধে খুনের উৎসবে যোগ দিয়ে ফেরা। এবার সামনে যেতে হবে। ওই যে সামনে অগনিত মুখ। কোন একটি নয়, সমস্ত মুখ একসাথে বুকে ভরে নিতে হবে। সব ভার পাথরের মত সঙ্গে নিয়ে নিজেকে ধুয়ে নিতে হবে এ জীবনের মত। আর নয় এই ঝরাপাতার আড়ালে নিজেকে লুকোনো। মোবাইল বাজছিল। অভিদীপ। এই সময়ে ফোন করেছে মানে আজ ও বাড়ীতে নেই। আর, হয়তো এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে হয়েছে যে রিক্তাকে আরও এক সেকেন্ড সময় দেওয়া উচিত। নাহ। এই মনে হওয়াকে আর সম্মান করবে না রিক্তা। অসম্মানের পাঁক মাখিয়ে দেবে বাকী জীবন ধরে, যেমন ওকে প্রতিমূহূর্তে দিয়েছে অভিদীপ এই এতগুলো বছর ধরে। মুখের সামনে মোবাইলটা তুলে ধরে দু’মিনিট বেজে যেতে দেয়। অপলক তাকিয়ে দেখে স্ক্রীনের বুকে বসানো মুখটা। তারপর মুছে দেয় সেই মুখ। অন্ধকার নেমে আসে মোবাইলের বুক জুড়ে।
কখন পেছনে এসেছিল মঞ্জরী তা রিক্তা জানতেই পারেনি।
চমকে তাকায় যখন মঞ্জরী ওর কাঁধে হাত দিয়ে অবাক গলায় বলে ওঠে, “কলটা কেটে দিলি? তুই? পারলি শেষ পর্যন্ত?”
“হ্যাঁ। পারতেই হত। তুই তো জানিস। আমিই শুধু জানতাম না তাই অনেকটা দেরী হয়ে গেল।” কাজল ধোয়া জলকে নেমে আসতে বারন করে মঞ্জরীকে বারান্দায় রেখে রিক্তা ঘরে ঢুকে যায়।
বেলা কত কে জানে। পরমা ঘুম ভাঙা চোখে পাশ ফিরতে গিয়ে আ-আ-আ করে চেঁচিয়ে ওঠে। সর্বনাশ! ডান পা তো নড়ানো যাচ্ছে না। কাল রাত্রেও তো বোঝা যায়নি যে এতটা ব্যথা লেগেছে। নিজের শরীর ছেড়ে পরমার এবার চিন্তা হতে শুরু করে অনিন্দ্যর জন্য। এই ব্যথা নিয়ে ওদের কাজটা শেষ করবে কী করে পরমা! হে ভগবান! এটাও আজই হতে হল! ছেলেটাকে কথা দিয়ে রাখতে পারবে না! অসম্ভব ব্যথা নিয়ে কোনমতে উঠে বসে পরমা। অনুপমাকে ডাকতে গিয়েও থেমে যায়। মেয়েটা কাল রাত্রে হয়তো ভাল করে ঘুমোয়নি। ওর বলে যাওয়া শেষ কথাটা মনে পড়ে যায়। কী হয়েছে কিংশুকের সঙ্গে কে জানে। এই ক’দিন ওদের খবরটাও নেওয়া হয়নি ভাল করে। সত্যি, পরমা যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। যে ওকে চোখের মনির মত করে আগলে থাকে তার মনের খবরটাই ও রাখতে পারছে না। যা অবস্থা তাতে খাট থেকে নেমে অনুপমার ঘরেও যাওয়া যাবে না। একটা মেসেজ বরং করে রাখা যাক। ও জেগে থাকলে চলে আসবে।
মোবাইলে হাত দিয়ে পরমা দেখতে পায় সেটা সুইচড অফ। কাল রাত্রে ও নিজেই করেছে। অরিত্রজিতের মেসেজের বন্যা ঢুকছিল। সেটা আটকাবার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখন ফোন খোলার সঙ্গে সঙ্গে টুংটাং করে আবারও ঢুকতে থাকে বিবিধজনের কাছ থেকে বিবিধ সমাচার। আজ ওর জন্মদিন? সবাই এত এত হ্যাপী বার্থডে মেসেজ করেছে! একা একাই হেসে ফেলে পরমা। কত বয়স হল যেন ওর? এখন আর কিছুই মনে থাকে না। মনে রাখতে ইচ্ছেও করে না। কার জন্মদিন কিসের জন্মদিন কেনই বা এই বৃথা জন্ম! ও না জন্মালে কারও তো কোন ক্ষতি হত না। পৃথিবী ঠিকই চলত তার আপন ঘূর্ণমান বৃদ্ধা শরীর নিয়ে। তার কোন ক্লান্তিতে কেউ তাকে মাপ করত না, করবেও না। পরমাও একদিন শান্তির ঘুম দুই চোখে বিছিয়ে শুয়ে পড়বে। কিন্তু পৃথিবীর চলার শেষ নেই শত ক্লান্তিতেও।
একটাও জন্মদিনের মেসেজ খুলে পড়ে না পরমা। উত্তর দেয় না একটাও মেসেজের। শুধু অনুপমাকে লিখতে যায়, “গুডমর্নিং, ঘুম থেকে উঠেছিস অনু? এঘরে আয়…”
কিন্তু সেন্ট করার আগেই চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির অনুপমা।
“গুউউউড মর্নিং বেবী… উঠে পড়েছো? বাহ…, যাও মুখ ধুয়ে এসো …”
“তোকেই মেসেজ করছিলাম তো…”
“মেসেজ করছিলে? কেন? ওঘরে গেলেই হত। এসো এসো চা খাব।”
“আমি তো উঠতেই পারছি না” পরমা অপ্রতিভ হাসে।
“উঠতে পারছো না? সে কী? কী হল আবার? দেখি দেখি…” অনুপমা ছুটে আসে। অসাবধানে ওর হাত পরমার পায়ে লেগে গেলে আরও একবার ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে পরমা।
“এ কী? এতটা লাগছে? কাল রাত্রে তো ছিল না! তাহলে ইন্টার্নাল ফ্র্যাকচার হয়েছে কিছু। উফফ … কী ঝঞ্ঝাট বাধালে বলতো! বলেছি বয়স হয়েছে, এবার একটু সাবধানে চলাফেরা করবে। একটা কথা শোন না তুমি আমার …” পরমার পা থেকে নাইটি সরিয়ে দেখতে দেখতে একটানা বকুনি দিয়ে যায় অনুপমা। পরমা ওর হাত ধরে টেনে থামায়। গম্ভীর গলায় ডাকে, “অনু, কী হয়েছে তোর? সত্যি কথা বলবি।”
থেমে যায় অনুপমা। থতিয়ে বলে, “বা রে আমার আবার কী হবে! হল তো তোমার। পায়ে লাগিয়ে বসে আছো …”
“সারা রাত একটুও ঘুমোসনি। কেন? কী হয়েছে?”
“কে বলল ঘুমোইনি? বাহ!”
“কাউকে বলতে হয় না। তোর মুখটা একবার আয়নায় দেখে আয়। না বলতে চাস বলিস না। তবে আমার কাছে বলাটাই ভাল ছিল। কোন গুড অ্যাডভাইস দিতেও তো পারি!”
অনুপমা কড়িতকর্মা মেয়ে। চটপট চা ঢেলে ফেলেছে। এগিয়ে ধরে বলে, “তোমার জীবনটাই আমার কাছে একটা বিশাল অ্যাডভাইস মনিমা। তোমাকে না বলার কিছু নেই আমার। কিংশুকের বিয়ে হচ্ছে এক মারাঠী মেয়ের সঙ্গে, ওরই কলিগ।”
খুব নির্লিপ্ত স্বর অনুপমার। ধীরে ধীরে একমনে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে পরমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে, “সে কী? ও তো তোকেই ভালবাসে। তুইও। এতদিনের সম্পর্ক তোদের! তাহলে? এটা কী করে সম্ভব?”
“তুমিও তো সেই ভদ্রলোককে ভালবাসতে, তিনিও তোমাকে পাগলের মত চাইতেন। তুমি সারাজীবন একাই থেকে গেলে। তবু তার কাছে আর গেলে না। কেন মনিমা?”
“আহ, আমার সঙ্গে তুলনা টানিস না। ও ম্যারেড ছিল আগে থেকেই। তাছাড়া আমি কাউকে দোটানায় ফেলতে চাইনি, তাই সরে এসেছি। কিন্তু কিংশুক তো তা নয়।”
“বিয়ে করার জন্য কী শুধু ভালবাসা আর আনম্যারেড হওয়াটাই যথেষ্ট? তা নিশ্চয়ই বলবে না তুমি। আরো অনেক বিষয়েই দোটানায় পড়ে মানুষ। আমিও কিংশুককে দোটানায় ফেলতে চাই না। আমি আমার অ্যাক্টিং তো ছাড়তে পারব না। যাকগে ছাড়ো। দেখি এবার অর্থো কোথায় পাই এই সাতসকালে। বড্ড ঝামেলায় ফেলে দিয়েছো…”
যেন বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা এমন কিছুই ব্যাপার নয় এইভাবে চায়ের শেষটুকু আরাম করে মুখে নেয় অনুপমা। তারপর হেলে দুলে মোবাইলে ডাক্তার খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে যায় ঘরের বাইরে। ওর দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরমা। পায়ের ব্যথাটা টের পাচ্ছে না আর। তার বদলে মন জুড়ে অজস্র বছর আগের কাঁটাছেঁড়া শুরু হয়েছে ।
অরিত্রজিত তারপরে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছিল। বহু বহুবার অন্তরঙ্গ হতে চেয়ে নানারকমভাবে যোগাযোগ করেছিল। এমনকি মিত্রাকে দিয়ে পর্যন্ত চেষ্টা করেছে বারবার। ওর আগ্রহ দেখে, ওকে কষ্ট পেতে দেখে এমনকি মিত্রাও পরমাকে বলেছে এতটা কঠিন হয়ে না থাকতে। কিন্তু পরমা কাউকেই বোঝাতে পারবে না এটা শুধুই একটা অধিকারের লড়াই ছিল না। এটা ছিল মনের ভেতর থেকে সমস্তরকম আশা আকাঙ্খা অধিকারবোধ চলে যেতে দেখার একটা অসহায় মুহূর্ত। এই মুহূর্তের সমস্ত অন্ধকার তার সবটুকু হতাশা নিয়ে গ্রাস করে ফেলেছিল পরমাকে। একটা ঢেউয়ে এতটাই দূরে এনে ফেলেছিল পরমাকে যেখান থেকে কোনভাবেই আর অরিত্রজিতের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না ওর। আর সেই ঢেউটা তো পরমার অবিমিশ্র ভালবাসার সাগরে তুলেছিল অরিত্রজিত নিজেই। ও পরমাকে, পরমার নিঃশর্ত ভালবাসাকে টেকন ফর গ্রান্টেড করেছিল। সেই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেটাই পরমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কাউকে বোঝানো যাবে না এসব। অনুপমা তো বাচ্চা মেয়ে! পরমা নিজেই কি আজ পর্যন্ত বুঝেছে নির্ভুলভাবে? আর এই বোঝা না বোঝার দোলায় দুলেই তো জীবনটা কেটে গেল।
পরমা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিশ্চল হয়ে বসে থাকেন। মাথার মধ্যে ঘাই মারতে থাকে অনিন্দ্যর মুখটা। এই একটু পরেই ওর ফোন এল বলে। লেখাটা নিয়ে খুবই উত্তেজিত আছে সে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা পড়তেই হবে। সেখানে পরমা এখনও শেষই করতে পারল না। অনর্থক এই পায়ের ব্যথাটা অসময়ে এসে ওকে কাবু করে দিল। পরমা ভেবে পায় না কি করে হাতের কাজটা শেষ করবে। বালিশের ওপর পা ছড়িয়ে বসে থাকে সামনের সাদা দেওয়ালে তাকিয়ে। অনুপমা খুব ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়। কানে ফোন। বোধহয় অর্থোপেডিক ডাক্তারের খোঁজে মাথা খারাপ করছে মেয়েটা। ওকে দেখে পরমার খারাপ লাগা আরো বেড়ে যায়। কাল রাত্রে লেখাটা এমন একটা টার্নিং পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে এক্ষুনি বাকীটা লিখে ফেলা খুব জরুরি। নাহলে টিউনিংটা হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ল্যাপটপটা এই বিছানা থেকে অনেকটা দূরে রয়েছে। কাউকে হাতের কাছে এনে দিতে হবে। অনু নিশ্চয়ই ডাক্তার আসার আগে ওকে কিছুই করতে দেবে না। করুণ চোখে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকে পরমা।
অনুপমা একগাল হেসে ঘরে ঢোকে কথা বলতে বলতে, “হুঁঃ, পাব না মানে? আমার নামও অনুপমা। দরকার হলে সারা কলকাতা এধার ওধার করে ফেলব ডাক্তারের জন্য …”
“কী হলটা কী? কাকে পেলি? কোন ডাক্তার?”
“ওই তো রিকভারি ডায়গনষ্টিক সেন্টারের একটা ছেলে আছে না? মলয়?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, যেদিন ইকো করাতে নিয়ে গেলি, তোকে হাঁ করে করে দেখছিল। সবাইকে বাদ দিয়ে আমারটাই আগে করে দিল লাইন ব্রেক করে। রুলব্রেকিং আমি একদম পছন্দ করি না।”
অনুপমা হিহি করে হেসে মেঝের ওপর একচক্কর পাক খেয়ে নিয়ে বলে, “আজকেও রুলব্রেক করে একজন জুনিয়র ডক্টর, এক্সরে মেশিন অ্যান্ড টেকনিশিয়ান নিয়ে এখুনি আসছে কী করব বল? ও ফ্রী অফ কস্ট দেখে যাবে, বিনিময়ে কিছুই দেবে না তা তো হয় না!”
“ছিঃ এটা তো অন্যায়। কেন বেচারাকে নাচাচ্ছিস? এর চেয়ে বেশী তো এগোবি না…”
“কে বলেছে এগোব না? এগোতেও তো পারি! আমি তো এখন ফাঁকা আছি। দেখতে কিন্তু দারুণ ছেলেটা। কিন্তু বড্ড যেন গোবেচারা টাইপ। আমি একটা ফোন করতেই যেন ধন্য হয়ে গেল। এরকম ধন্য ধন্য ছেলেরা টাইম টু টাইম খুব কাজে দেয় কিন্তু তার থেকে বেশী? উউউউ হুউউউ…”
অনুপমার রকম সকম দেখে পরমা হেসে ফেলে, “ওমা! এই না বললি এগোতেও পারিস!”
“হ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ…। ওই যে বললাম দারুণ দেখতে …। কিন্তু ভয়েসটা ভাল না … আর, বেশ ক্যাবলা টাইপ…”
“হয়েছে হয়েছে, আর অত মানুষের নিন্দে করতে হবে না। এগিয়ে দেখ এলো কিনা।”
পরমার পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঠিক করে বসিয়ে দিয়ে অনুপমা হেসে নেচে আবার বাইরে চলে যায়। আর পরমা ভাবতে বসে, অরিত্রজিত কেমন ছিল দেখতে? সেই কত কত যুগ আগের কথা যেন? এখনই বা কেমন হয়েছে সে?
চোখ বুজে খাটের বাজুতে মাথা হেলিয়ে এক দীর্ঘদেহী শ্যামবর্ণ সুগঠিত চেহারার যুবককে এগিয়ে আসতে দেখে পরমা। সেই যুবকের শরীর ছায়া দিয়ে তৈরী। ছায়া ছায়া সুগঠিত অবয়ব দৃপ্ত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে দরজা জানলা করিডোর গেট, গেটের পাশে দুলতে থাকা মাধবীলতার ঝাড়, দেওয়াল ধরে বেড়ে ওঠা অপরাজিতার গুচ্ছ, পর্দার ফাঁক দিয়ে মেঝের ওপর ঢুকে পড়া দামাল রোদের আলপনা সব কিছুর মধ্যে দিয়ে। এগিয়ে আসতে আসতে কখন সেই ছায়া শরীর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যেতে থাকে বদ্ধ ঘরের ঘেরাটোপে। পরমার বাড়ানো হাতের সীমানায় ধরা দেয় না সেই দুরন্ত দামাল যুবক হাতের স্পর্শ। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পরমা মনে করতে পারে না কেমন দেখতে ছিল অরিত্রজিতকে।
হোয়াটসঅ্যাপ ডিপিতে একটা সাদা ফুলের ছবি শুধু। যা থেকে কোনওভাবে ধারনা করা যায় না বার্ধক্যে উপনীত অরিত্রজিতের বর্তমান চেহারা। সারাদিনে রাতে অজস্র মেসেজ করে যায় সে অথচ নিজের চেহারা কোনওদিন দেখায়নি।
কি আশ্চর্য! আমি কি এই অবান্তর কথা ভেবে সময় কাটাব এখন? আমি কি অরিত্রজিতকে দেখতে চাই? কেমন চেহারা হয়েছে ওর তা জেনে আমার কী হবে আর? নিজেকে নিজেই ধমকায় পরমা। তারপর নড়াচড়া করে আবার চেষ্টা করতে থাকে নিচে নামার। ল্যাপটপটা কোনওভাবে কাছে আনা দরকার। অলস মস্তিষ্ক জন্ম দেয় যত উদ্ভট চিন্তার। নিজের ওপরেই বিরক্ত হয় পরমা।
“আরে আরে কী করছ তুমি? বিপদ আরও বাড়াবে? কী? কী লাগবে তোমার?” পেছনে দু’জন সুন্দর মত ছেলে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ঝনঝন করে চেঁচিয়ে ওঠে অনুপমা। পরমা তাকিয়ে থাকে। একজন তো সেই মলয় ছেলেটি। আর একজন নিশ্চয়ই তবে জুনিয়র ডাক্তার। এখন এদের হাতেই নিজেকে ছাড়তে হবে। কিচ্ছু না বলে বালিশে হেলান দিয়ে পা-টা লম্বা করে দেয় ও। ভাবনা ভুল নয়।
মলয় ছেলেটি হেসে হেসে বলে, “এই যে আমাদের সেন্টারে নতুন জয়েন করেছেন ডক্টর মৌলিক। অনুপমাদেবী ফোন করামাত্রই ওনাকে নিয়ে আমি চলে এলাম।” মলয়ের গদগদ মুখে কথা বলা আর অনুপমাদেবী সম্বোধন শুনে পরমার হাসি পেয়ে যায়। অতিকষ্টে গম্ভীর হয়ে ডাক্তারের কথামত পা-টা এগিয়ে দেয় সে। ডাক্তার ছেলেটি বেশ। অতি যত্ন করে দেখে প্রেস্ক্রিপশন লিখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন মলয়ের মুখটা দেখার মত হয়েছিল। যেন এত তাড়াতাড়ি কেন পেশেন্ট দেখা হয়ে গেল! বারবার সে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, “দেখুন, ভালমত দেখে দিয়েছেন তো? কেউ যেন আমাদের নিন্দে না করতে পারে।” আর প্রতিবারই কেউ বলার সঙ্গে সঙ্গে গলন্ত চোখে তাকাচ্ছিল অনুপমার দিকে। ওরা বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। পরমা অনুপমার এনে দেওয়া ল্যাপটপ বুকে জড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে ছাদ দেখছিল। আর সেই সঙ্গে লিখে চলেছিল ওর নিজস্ব উপন্যাসখানা, যা কিনা সারাক্ষণ লেখা হতে থাকে নিজের বুকের ভেতরে। যা ছাপা হয় না, হবেও না কখনো। যার লেখক পাঠক সব একমাত্র ও নিজে।
অনু তাকাবে তোমার মত ছেলের দিকে? হু! কক্ষনো না। ওই পাজী মেয়ে তোমায় ক’দিন নাচিয়ে ছেড়ে দেবে। জানো না তো! কী ডেঞ্জারাস মেয়ে! পরমা জানে। জানে কারন একদিন বয়স থেকে অনুপমা তার হাতেই মানুষ। মিত্রা শুধু জন্মই দিয়েছিল অনুপমাকে। পরমার প্রানের বন্ধু মিত্রা যে একটা সময় মায়ের মত আগলে রেখেছিল ওকে। ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মত উড়ে যেতে গিয়েও জীবনের কঠিন ডালে নিজেকে আটকে রেখেছিল পরমা, সে তো শুধু পাশে মিত্রা থাকার জন্যই। আজকের এই পরমা তখন কোথায়? সে তো বোধহয় জন্মায়ইনি তখনও। দিনে দিনে একটু একটু করে আলো দিয়ে জল দিয়ে বীজ থেকে চারাগাছ তৈরি করার মতো করে মিত্রাই বাঁচিয়ে তুলেছে তাকে। নাহলে তো এক উদাসীন মানুষের ভালবাসাহীনতা পরমাকে অসময়ে থামিয়েই দিয়েছিল পথের পাশে। ওর হাত ছেড়ে দিয়ে যেদিন চলে গেল অরিত্রজিত, পরমার জীবন্ত শরীরের ভেতরে দীর্ঘস্থায়ী বাসা বেঁধেছিল মৃত্যুর ঘুনপোকা। মিত্রাই সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে টেনে তুলে এনেছে ওকে। সমবয়সী বন্ধু হয়েও মায়ের মত ঘিরে ছিল ওর দুঃস্বপ্নের অন্ধকার দিন রাতগুলো। বহু পরিশ্রমে যত্নে এক নতুন পরমাকে তৈরি করে তুলেছে যে ওই চলে যাওয়া অরিত্রজিতের স্পর্শ ভুলে এগিয়ে এল এতদূর। কিন্তু তারপর নিজের জীবন শুরু করতে না করতেই একদিনের বাচ্চাটাকে পরমার হাতে তুলে দিয়ে মিত্রা নিজে চলে গিয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
কী অদ্ভুত সেই চলে যাওয়া! ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয় পরমার। যেদিন অনুপমা জন্মালো, মিত্রার স্বামী নিশান্ত ছুটে গিয়েছিল বাইপাসের সেই নামী দামী নার্সিংহোমে। মিত্রার বেডের পাশে বসে তার হাত ধরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল সে। সেইসময় আগুন ধরে যায় ছ’তলার সেই ওয়ার্ডে। সে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বহু চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি বারোজন মানুষকে, তার মধ্যে রোগী এবং পরিজন দুইই ছিল। ছিল অর্ধদগ্ধ শরীরে হাতে হাত ধরা মিত্রা এবং নিশান্তের মৃতশরীর। সে দৃশ্য পরমাকে বেঁচে থাকতে দিত না যদি না একদিন বয়সের অনুপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরত সে। অনুপমা জানে এসব কথা। পরমাই তার এই পৃথিবীর একমাত্র আপনজন। নিজের বাবা মায়ের জন্য ওর আলাদা কোন অনুভূতি আছে বলে পরমার জানা নেই। মাঝে মাঝে এটাও মনে হয় এই জেনারেশান বোধহয় অনেক বেশী প্র্যাকটিক্যাল। অকারণ আবেগের দাস নয় এরা। না, অনুপমাকে কখনও সেই অদেখা বাবা মায়ের জন্য উদাস হতে দেখেনি পরমা। শুধু দু’চোখ ভরে যেটা দেখে যায় ও, তা হল পরমার জন্য ওর অসম্ভব ভালবাসা, উদ্বেগ। অনুপমা যখন ওর মনিমার জন্য অস্থির হয়, দুশ্চিন্তা করে, জড়িয়ে ধরে আদর করে তখন একবারও মনে হয় না ও তার নিজের মেয়ে নয়। না, নিজের শরীর থেকে সৃষ্টি না হলেও সেজন্য সন্তানহীনতার কোন আক্ষেপে ভোগে না পরমা। বরং সারা মনপ্রাণ দিয়ে ও উপভোগ করে অনুপমার সঙ্গে এই অপূর্ব বন্ধন। তাই ওর জন্য চিন্তাও হয় সারাক্ষণ।
এই যেমন এখন মনটা কেমন অশান্তিতে ভরে আছে মেয়ের রকমসকম দেখে। কিংশুকের সঙ্গে ওর একটা সেটলমেন্ট এবার হয়ে যাবে বলেই জানা ছিল এতদিন। অনু রাইজিং অ্যাকট্রেস হিসেবে বেশ নাম করেছে। অনেকগুলো টিভি সিরিয়ালের পর এবার তিন চারটে ছবির কাজও করা হয়ে গেল। মানুষজন ওকে ভালই চেনে এখন। কিংশুক ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধু। ওকেই বিয়ে করবে বলে ডিক্লেয়ার করেছে বছর দুই আগে। আজ সকাল থেকেই উলটো গাইছে। কিংশুকের নাকি অন্য কারোর সাথে এনগেজমেন্টও হয়ে গেছে। পরমা অবাক হতেও পারছে না আর। এ কী? ভালবাসা কী এতটাই সহজলভ্য? যখন ইচ্ছে হল বাঁধা পড়লাম আবার যখন ইচ্ছে ভেঙে দিলাম? কাটে না? রক্ত বের হয় না? জীবন ছিঁড়ে খুঁড়ে যায় না? ভোলা যায় নাকি ভালবাসার মানুষের চোখ? তার ছোঁয়া? তাহলে পরমার উপন্যাসে রিক্তা কেন সুইসাইড করতে গিয়েছিল? সে তো নিজের আত্মসম্মান শেষপর্যন্ত বিকিয়ে দিতে পারেনি অভিদীপের কাছে। নিজেই সরে এসেছিল। তবুও কেন একসময় তার মনে হল একা একা এই জীবনটা ভীষণ ভারী? কেন সে সেই ভার নামিয়ে দিতে চেয়েছিল অজানা ভবিষ্যতের কাছে? কেন একমাত্র আশ্রয় হিসেবে মৃত্যুকেই বেছে নিতে চেয়েছিল? পরমা তো এ পর্যন্ত যতটুকু লিখেছে, এক কঠোর বাস্তবের কথাই লিখেছে। তাহলে কি ওর লেখাটা কিছুই হয়নি? শুধুই সেন্টিমেন্টের বদ্ধ পুকুরে ওর নায়িকাকে ঘুরিয়ে মারল নাকি এতদিন? সেখানে জীবনবোধ নেই? বাস্তবতা নেই? কই অনুপমাকে দেখে তো একটুও মনে হচ্ছে না ওর পৃথিবীর কোথাও এতটুকুও চিড় খেয়েছে কিংশুককে হারানোর সম্ভাবনায়! তাহলে কি এটাই ঠিক? রিক্তা ছিল এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মূর্খ? নাকি অনুপমা অভিনয় করছে! ও এতই ভাল অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে যে নিজের হাতে মানুষ করেও পরমা তাকে চিনতেই পারছে না!
ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বসে থাকাই সার হয়। পরমার মাথাটা ক্রমশ ভার হয়ে উঠতে থাকে। অজস্র উত্তর না মেলা প্রশ্নেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাথার আনাচে কানাচে। পায়ের ব্যথার অনুভূতি কমে গিয়ে এবার যেন মাথাতেই একটা অস্বস্তি শুরু হয়েছে। অনিন্দ্যকে দেওয়া কথা রাখতেই হবে, লেখাটা যেভাবেই হোক আজ কালের মধ্যে শেষ করতেই হবে এই চিন্তাটাও আর তেমন দাঁড়াচ্ছে না। সবকথার জট মিলে মিশে গিয়ে একটাই প্রশ্ন বড় হতে হতে দেওয়াল ছাপিয়ে জানলা দরজা ছাপিয়ে আকাশে ঝুলে আছে। ভালবাসা কত বড়? ভালবাসার মানুষকে ছাড়া জীবন কি সত্যিই শেষ হয়ে যায়? নাকি ভালবাসা একটা তাৎক্ষনিক অনুভূতি মাত্র? ভালবাসা ভুলে গিয়ে, ভালবাসার মানুষকে ভুলে গিয়ে, সেই মানুষের দেওয়া ব্যথা যন্ত্রনা সব মুছে ফেলে খুব সহজেই আবার সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব? তাহলে রিক্তা কেন পারল না অভিদীপকে ভুলতে? কেন সে অতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন এতখানি বয়সে, বার্ধক্যের দরজায় এসেও পরমা পারে না অরিত্রজিতের একটাও মেসেজের জবাব দিতে? কোন অভিমান এসে তাকে থামিয়ে দেয়? এবার জীবন শেষ হতে চলল। সেই মানুষটা যত ভুল করেছে তার শতগুণ খেসারতও তো দিয়েছে! নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছে। সেই কতবছর ধরে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরমার দরজায়। তবে কেন আজও পর্যন্ত পরমা তাকে ক্ষমা করতে পারল না? ভালবাসা কি এতই অভিমানী? এতই তার আত্মধ্বংসী বিস্তৃতি? জীবনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়? তাহলে অনুপমা কী করে এত সহজ স্বাভাবিক থাকতে পারছে? নাকি সবটাই তার অভিনয়? নিজের হাতে তৈরি মেয়েকেও পরমা চিনতে পারছে না কেন?
রিক্তা শুয়েছিল। ঘুম ছিল না চোখের পাতায়। ঘুমের চেষ্টা ছিল। সাতদিন পর নার্সিং হোম থেকে ওকে ফিরিয়ে এনেছে মঞ্জরী আর সায়ন। অক্লান্ত সেবায় জীবনের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে চলেছে ওরা। রিক্তাকে না বলেই অভিদীপকে খবর দিয়েছিল মঞ্জরী। যখন অভিদীপ ওর বিছানার সামনে এসে দাঁড়ালো, রিক্তা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। একবারও চোখ মেলে তাকায়নি। বহু ডাকাডাকিতেও ওকে ফেরানো যায়নি অভিদীপের দিকে। শুধু বাড়ীতেই নয়, অভিদীপ নার্সিংহোমেও গিয়েছে প্রায় রোজই। তখন মঞ্জরী ভেবেছিল বাড়ীতে গিয়ে হয়তো অভিদীপকে দেখলে ওদের মধ্যেকার এই জমাট বরফটা কেটে যাবে। কিন্তু সেটাও হল না। অনেকবার ডাকাডাকি করে নিরাশ মুখে দাঁড়িয়েছিল অভিদীপ। মঞ্জরীর মায়া লাগে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
“রিক্তা, এদিকে একবার তাকা না। কেন এমন করছিস! দেখ তো একবার …”
“ছেড়ে দিন, ওকে আর ডিষ্টার্ব করব না আমি। আমার জন্যই এই দিনটা এসেছে। আপনার বন্ধু যদি মাপ করে আমায় তাহলে খবর দেবেন, আমি আসব।” গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে বেরিয়ে গিয়েছিল অভিদীপ। আর, ও চলে গিয়েছে সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার পরেই মঞ্জরীর দিকে ফিরে চোখ খুলে তাকিয়েছিল রিক্তা।
“কী রে! কেন ওর সঙ্গে কথা বললি না? সাতদিন ধরে আসাযাওয়া করছে ছেলেটা …”
“ওকে আসতে বারণ করে দিস। আমার আর প্রয়োজন নেই ওকে। মরতে চেষ্টা করেছিলাম। যখন মরতেও দিলি না, তখন একাই বাঁচব বাকী জীবনটা। কোনও অভিদীপ ব্যানার্জীকে আর দরকার নেই আমার।” থেমে থেমে নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে কথাগুলো বলেছিল রিক্তা ।
সত্যিই সেটা বোধহয় ওর নতুন জন্ম ছিল। তারপর থেকে এক নতুন রিক্তাকেই দেখেছে মঞ্জরী। নিজের কাজেও মন বসাতে পারছিল না মঞ্জরী। সদ্য সদ্য সায়নের সঙ্গে রেজিষ্ট্রী সেরে নিয়েছে, এবার সংসার শুরু করার কথা ভাববে এমনটাই ঠিক ছিল। কিন্তু রিক্তা এমন কান্ড করে বসল যে ওদের দুজনের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এখন একটাই লক্ষ্য সামনে, যে করেই হোক রিক্তাকে স্বাভাবিক করে তোলা। সারাক্ষণ মঞ্জরীর মনে এই একটাই চিন্তা। সেদিনও অফিস থেকে ফিরে ও দু’কাপ কফি বানিয়ে এসে বসেছিল রিক্তার বিছানার ধারে। মেয়েটা হাসপাতাল থেকে ফিরে অবধি যেন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। শুধু সামনের দেওয়ালে তাকিয়ে থাকে। খেতে বললে খায়, ঘুমোতে বললে ঘুমোয়। বাদবাকি সারাক্ষণ শুধু চুপ করে শুয়ে থাকে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।
মঞ্জরী ওকে তুলে বসিয়ে হাতে কফির কাপ ধরিয়ে বলে, “জানিস আজ কে এসেছিল আমাদের অফিসে? পূর্নিমাদি, সেই যে যিনি দশ বছর আগে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হতে গিয়ে ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে ফিরে এলেন, যাকে নিয়ে কাগজে অনেক লেখালিখি হয়েছিল, তোর মনে আছে? আমি তখন ইলেভেনে পড়ি…”
মঞ্জরীর এত কথার উত্তরে রিক্তা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি অনেক দেরীতে বুঝেছি। অভি কোনদিনই আমাকে ভালবাসেনি। ভালবাসলে মানুষ তার জন্য সব করতে পারে, অনেক কিছু করতে পারে। অভি কোনওদিন আমার জন্য দশ মিনিট সময়ও দেয়নি। ও যা করেছে সব নিজের ইচ্ছায় করেছে। তাহলে আমি কেন ওকে বেঁধে রাখব? না, আর আমি ওকে পেছন থেকে টেনে রাখব না। আমাদের রাস্তা আলাদা। ভালবাসা জোর করে পাওয়া যায় না।”
নিজের মনে বলে যাচ্ছিল রিক্তা। মঞ্জরী স্তব্ধ হয়ে ওর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। প্রথমে ওকে থামিয়ে দিতে গিয়েও কী ভেবে চুপ করে যায়। নাহ, বলুক। যা ওর মনে আছে বের করে দিক। এই অভিমানের পাহাড় বুকে নিয়ে নইলে ও কোনওদিন স্বাভাবিক হতে পারবে না।
রিক্তার কথার সূত্র ধরেই ওকে সমর্থন করেছিল মঞ্জরী, “হ্যাঁ, একদম ঠিক বলছিস তুই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। ভালবাসা ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে সেখানে। তুই আর এভাবে সময় নষ্ট করিস না। এবারে উঠে পড়। অনেক কাজ পড়ে আছে তোর। অনেক লেখা বাকী আছে।”
রিক্তা শুনেছিল মঞ্জরীর কথা। আর শুয়ে থাকেনি সে। উঠে দাঁড়িয়ে জীবনের স্বাভাবিক স্রোতে একটু একটু করে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং সফল হওয়ার দিকে এগিয়েও গিয়েছে। আবার রিক্তা শুরু করেছিল লেখালিখি, বরং আগের চেয়েও অনেক বেশী করে নিজেকে যেন ঢেলে দিয়েছিল ওর ছোট্ট ল্যাপটপের মধ্যে। একের পর এক বই বেরোনোর পালা চলছিল তখন। সভা সমিতি ইন্টারভিউ, আরো কত কী। মঞ্জরী আর সায়ন খুশী হয়েছিল। ওরা নিজেদের জীবনে থামিয়ে রাখা পর্বটা শুরু করতে আবার নতুন প্ল্যান নিয়েছিল। এবারে রিক্তা শত হাতে বন্ধুর সংসার গুছিয়ে দিতে নেমেছে। ওরা চেয়েছিল রিক্তাও ওদের সঙ্গেই থাকুক এক ফ্ল্যাটে। রিক্তা মানেনি। নতুন কাপলের মধ্যে ঢোকা নিয়ে কিছু রসিকতা করে সরে এসেছিল আলাদা বাসায়। কিন্তু সারাক্ষণ জুড়ে ছিল মঞ্জরীর সমস্ত ভালমন্দের সঙ্গে।
সেই প্রথম প্রথম প্রায় একটা বছর সবচেয়ে সুখের সময় ছিল ওদের জীবনে। হাসি খুশী উচ্ছল রিক্তাকে দেখে মঞ্জরীর মাঝে মাঝে ভ্রম জেগেছে। এটা কি সেই রিক্তা যে অতগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল! সবটাই ওর অভিনয় নয় তো! মঞ্জরী আর সায়ন যাতে ভাল থাকে সেজন্য ও নিজের সবটা জ্বালায় মলম বুলিয়ে চলেছে! কিন্তু পরক্ষণেই অফিস ফেরতা রিক্তার হাত ভর্তি জিনিসপত্রের প্যাকেট নিয়ে ঢোকা চেহারা দেখে মনের ভেতরের সন্দেহটা মুছে গেছে। মঞ্জরী কিছুদিন বাদেই মা হবে। রিক্তা ভাবী মা আর বাচ্চার জন্য গাদা গাদা জিনিসপত্র কিনে ওদের ফ্ল্যাট ভর্তি করে ফেলেছে। ওরা বারণ করলে চোখ পাকিয়ে শাসন করেছে। ওকে দেখে যে কেউ ভাববে মঞ্জরীর নয়, এটা ওরই সংসার, ও নিজেই মা হতে চলেছে কিছুদিন বাদে। জীবন এতটাই উজ্জ্বলতার কাজল বুলিয়ে দিয়েছিল ওর চোখে।
তারপর এল সেই সাঙ্ঘাতিক দিন। সবকিছু শেষ হয়ে গেল কয়েক ঘন্টায়। রিক্তা একটা ঝড়ের দিন রাত পেরিয়ে কোলে একদিনের শিশু নিয়ে এসে উঠল তার নিজের ফ্ল্যাটে। বিধ্বংসী আগুন কেড়ে নিয়েছে দুটো তরতাজা প্রান। বহুতল হাসপাতালে আগুন লেগে অভাবনীয়ভাবে চলে গেল মঞ্জরী আর সায়ন। শুধু ওরাই গেল না, সেইসঙ্গে চলে গেল রিক্তার নতুন করে বেঁচে ওঠার চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টা ছিল তার নিজের জন্য। এখনও রিক্তা বেঁচে রইল। সেটা তার স্বপ্নকন্যার জন্য যাকে মঞ্জরী আর সায়ন তার জন্য আজীবনের দায়িত্ব আর উপহার হিসেবে রেখে গেছে।
অনেকগুলো বছর চলে গেল এক এক করে। চোখের বাড়ন্ত পাওয়ার আর চুলের পালটে যাওয়া রঙ নিয়ে রিক্তা নতুন ভাবে পৃথিবীকে আবিষ্কার করেছে এতবছর ধরে। একদিনের শিশুকে বুকে চেপে ধরে পৌঁছে দিয়েছে জীবনের সোনালী রঙ মাখা রাস্তায়। সেদিনের বাচ্চাটা আজ সফল সুন্দর একজন মানুষ যার উচ্ছল আনন্দ ভরা মুখ দেখে রিক্তার নিজেকেই সফল বলে মনে হয়। মনে মনে সারাক্ষণ মঞ্জরীকে বলে চলে রিক্তা, দেখ মঞ্জী, তোর মেয়েকে আমার সবটুকু দিয়ে মানুষ করেছি। বড্ড সুন্দর হয়েছে রে মেয়েটা। আমার সবটা দিয়ে ওকে ঘিরে রেখেছি।
এতকিছুর মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল অভিদীপ নামটা। হারিয়ে গিয়েছিল অভিদীপের দেওয়া যন্ত্রণা, কষ্ট, শূন্যতা। রিক্তা নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিল, চিরদিনের মত ভুলে গিয়েছে সে অভিদীপকে। অভিদীপ আর পামেলার মধ্যে সে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চায়নি। চায়নি ক্রমাগত আশা আর আশাভঙ্গের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হতে। নিঃশব্দে নিজেকে নিয়ে সরে এসেছে। কিন্তু সেই সব সরে আসার গল্পগুলো হঠাৎ করেই যেন ভেতরের লুকিয়ে রাখা বিশাল গর্ত নিয়ে সামনে এসে হাজির হচ্ছে। রাতের পর রাত ঘুম আসে না রিক্তার। যখন তখন সামনে এসে দাঁড়ায় সেই দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারার নিষ্ঠুরতম মূর্তি। তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে দেখেছে রিক্তা, সেই মূর্তি কী অনায়াসে দেওয়াল ভেদ করে রাত্রির নিকষ অন্ধকারে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার বাড়িয়ে দেওয়া দুই হাতের কোথাও এতটুকু লেগে থাকে না তো এত বছরের প্রবঞ্চনার ছাপ। সেই হাতদুটো ভালবাসার ধারাস্রোতে কী অদ্ভুত উষ্ণ! রিক্তা যত নিজের মুখ বুক চোখ ঢেকে রাখে, যত সেই মূর্তির থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় অনেক দূরের গাঢ় অন্ধকারে, ততই যেন সেই অদ্ভুত চোখদুটো ওর বুকের অনেক ভেতরে কোথাও ছুরিবিদ্ধ করে তুলে আনে বিপরীত ইচ্ছার বন্যা। এতখানি বয়সে এ কোন রোগে ধরল রিক্তাকে! নিজেকে কিভাবে শুশ্রূষা দেবে সে! আর তো মঞ্জরী নেই পাশে, যে ওকে বুঝবে, মায়ের মত করে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকবে এই টালমাটাল সময়ে। অনেক সফলতার পথ পার করে, প্রথিতযশা একজন মানুষ হয়েও নিজের এই নিভৃত অক্ষমতার ভার নিয়ে হতাশ হয়ে বসে থাকে রিক্তা। অপেক্ষা করে আবার কোন মিরাকলের। এই যে এতদিন পর আবার অভিদীপের জন্য ওর পাগল হয়ে ওঠা, এ তো বাস্তব চিন্তার কাছে অবিশ্বাস্য হাস্যকর এক ঘটনা। কিন্তু ঘটনা যখন ঘটছে, তার কোন সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। এবং ওকে নিজে নিজেই সেই রাস্তাটা খুঁজে পেতে হবে। আজকাল নিজের হাজার কাজ, লেখালিখি, বাইরের জগত, মেয়েকে নিয়ে ওর ছোট্ট সংসার, সবকিছুর মধ্যে থেকেও যেন ও ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সব করছে অথচ ওরই ভেতর থেকে অন্য একটা রিক্তা যেন কোথায় কোথায় দৌড়ে মরছে একবার অভিদীপকে দেখার জন্য, তার হাতদুটো একটিবার ছোঁয়ার জন্য। এই খোঁজ বাইরে থেকে দেখা যায় না। রাত্রিদিন এই খোঁজ শুধু রিক্তাকেই ভেতরে ভেতরে দীর্ন করে, নিঃস্ব করে। বাস্তবের মহিলাটি প্রখর রোদে আয়নায় তাকিয়ে মাথা নেড়ে নিজেকেই বলে, এ হল একটা অসুখ। এই অসুখের কিছু কঠিন ওষুধ চাই। কোথাও নিশ্চয়ই আছে সেই ওষুধ। সেই ওষুধ ওকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে।
পিঠে বালিশ নিয়ে এলিয়ে বসেছিল পরমা। চোখদুটো বোজা। কোলের ওপর খোলা ল্যাপটপ। অনেকক্ষণ লিখেছে। লেখাটা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। রিক্তাকে একটা মনোমতো জায়গায় না আনতে পারলে এই গল্প শেষ করা সম্ভব নয়। এমনিতে লিখতে বসে কিছুই আগে ভেবে নেয় না পরমা। ওর চরিত্ররা সব নিজের মত করেই ওঠে বসে এগোয় থামে। কিন্তু এই লেখাটার বেলায় বার বার যেন চরিত্রগুলো থমকে যাচ্ছে। যেন কোথায় যাবে তারা, কী করবে, কী ভাববে তার কোন স্থিরতা নেই। আর পরমাও যেন পারছে না নিজের ইচ্ছামত তাদের জীবনরেখা তৈরি করতে। যেন ওদের রয়েছে নিজস্ব কিছু গতিপথ যা ওদের স্রষ্টা হয়েও পরমা ধরতে পারছে না। অথচ সেই পূর্ব নির্দিষ্ট ঠিকানা না জেনে না বুঝে পরমা ওদের নিয়ে এগোতেও পারছে না। বসে বসে ঘাড় নিচু করে লেখা। এভাবে অভ্যাস নেই। হয় টেবিলে বসে নয়তো শুয়ে উপুড় হয়ে লেখে ও। এখন ঘাড়টা বেশ টনটন করছে। ডাক্তার দেখে যাওয়ার পর ওষুধ জল খাবার সবকিছু দিয়ে অনুপমা বেরিয়েছে। আজ ও নিজের কাজে গেল না। নিশ্চয়ই মনিমার শরীর খারাপের অজুহাতে ফোন করে দিয়েছে যাবে না বলে। একটা দিন শ্যুট বন্ধ মানে প্রোডিউসারের বহু টাকার লোকসান। মনে মনে অপরাধবোধ হয় পরমার। সে তো অনেকবার বলেছিল ওকে স্টুডিও চলে যেতে। কাকে কাকে সব ফোন করল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কোনও কথা শোনে না এই মেয়েটা। যা নিজে ভাল বুঝবে তাই করবে। পরমার কিছু হলে ওর মাথার ঠিক থাকে না। ওর কাজের ক্ষতি হল ভেবে খারাপ লাগছে। আবার এমন উতলা কেউ ছুঁয়ে আছে সর্বক্ষণ জেনে ভালও লাগে। এভাবে ওকে আঁকড়ে ধরার মত একজনকে যে দিয়ে গেছে বুকের কাছে সেজন্য মাঝে মাঝেই মিত্রার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফেলে পরমা। মিত্রার মেয়ে মিত্রার মত করেই ওকে দু’হাতে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে ভুলে যায় যে অনুপমা ওর শরীর থেকে সৃষ্টি হয়নি।
চোখ বুজে বসে থেকে থেকে ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যবর্তী এক অবস্থায় ভেসে যাচ্ছিল পরমা। আজকাল বয়স যত বাড়ছে, মন যেন ঘুমিয়ে থাকতেই চাইছে সারাক্ষণ। জাগতে চায় না ও। এত কিছু পেয়েছে সারাজীবন, এত নামডাক, এমন স্বপ্নের মত সন্তানসুখ, তবু যেন জেগে থাকলেই অদ্ভুত একটা ফাঁকা মাঠ এসে বুকের মধ্যেটা ছেয়ে ফেলতে চায়। নাকি ওই মাঠটা ওর বুকের মধ্যে আছেই! সামান্যতম সুযোগ পেলেই সেই ঘাপটি মেরে বসে থাকা ফাঁকা মাঠটা ওকে গিলে খেয়ে নিতে চায়! কেন কে জানে! যা কিছু শূন্যতা যা কিছু অসম্পূর্ণতা সব তো সেই কবে মিত্রার চিতার আগুনের সাথে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মিত্রার মেয়েকে কোলে নিয়ে যেদিন এই ফ্ল্যাটে এসে ঢুকল সেদিনই তো জীবন খুঁজে পেয়েছিল নতুন দিশা। এক নতুন আঙ্গিকে শুরু হল সবটা। তাহলে কেন এই শূন্যতা! কেন এই ফাঁকা মাঠ বারবার এসে হাজির হয় সামনে! কেন হাতছানি দিয়ে ডাকে পরমাকে!
কী যে ওষুধ খাইয়ে গেল মেয়েটা! পায়ের ব্যথাটা কমেছে কিছুটা কিন্তু মনে হচ্ছে শরীরের নিচে পা নয় যেন ভারী লোহার মত কোন অংশ ওকে ছুঁয়ে আছে। পাশ ফিরতে চেয়েও পারে না পরমা। একইভাবে এতক্ষণ থেকে বাকী শরীরটাও এবার অবশ ঠেকছে। ঘুমটাও যেন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে বার বার। তবুও ও জোর করেই নিজেকে সেই আধোঘুম আধোচেতনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে চায়।
এভাবে কতক্ষণ ছিল কে জানে। কপালে একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় পুরোপুরি জেগে গিয়ে তাকায় পরমা। তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে। একটা শান্ত সমাহিত মুখ ওর চোখের খুব কাছে ঝুঁকে আছে। কতদিন, কতবছর, কতযুগ যেন এই মুখটাকে দেখেনি পরমা! অরিত্রজিত! ওই জ্বলজ্বলে চোখদুটো কি সত্যি ওর দিকে তাকিয়ে আছে? ও কী করে এল এত কাছে? ওই চোখদুটো তো কতদিন আগে ছেড়ে চলে গিয়েছিল পরমাকে। নাকি পরমাই নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছে ওই চোখদুটোকে! আবার কী করে তবে ওই আলো আলো চোখদুটো এরকম করে ডাকছে ওকে! যে নদী একবার বয়ে যায় সেও বুঝি আবার কখনও ফিরে আসে উৎসমুখে! এই মূহূর্ত কি সত্যি নাকি স্বপ্ন!
আবার বুঝি পুরোপুরি ঘুম এসে গেল। ঘুমের মধ্যে হেসে হেসে নিজের শেষ না হওয়া গল্পটার একটা সুন্দর সমাপ্তি খুঁজে পেয়ে যায় পরমা। এই তো এবার ওই শেষ না হওয়া উপন্যাসটা ও শেষ করে ফেলতে পারবে।
অনুপমা বেশীদূর যায়নি। বাড়ীর কাছের মলটা থেকে কয়েকটা দরকারি জিনিস নিয়েই চট করে চলে এসেছে। আগে তো চলাফেরায় বাধা ছিল না কোনও। আজকাল পথে বের হলে কেউ কেউ চিনে ফেলে। আজও একই চিত্র। বেশ কয়েকজন অচেনা মানুষের সঙ্গে হাসি বিনিময় করে তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ীর দিকে এগোচ্ছিল ও। কিন্তু থেমে যায় ভারী গলার স্বর শুনে। পাশের গাড়ী থেকে বয়স্ক একজন মানুষ জানলায় হাত রেখে বলেন,
“তুমি তো অনুপমা! আমায় একবার তোমার বাড়ী নিয়ে চল।”
এত অবাক জীবনে বারবার হওয়া যায় না। তিন সেকেন্ড চুপ করে থেকে তীব্রস্বরে অচেনা একজন মানুষের কাছে বেজে উঠেছিল ও, “এতবছর দেরী করলেন আপনি? কেন?”
সামনের জানলার সৌম্য শান্ত মানুষটি সামান্য হাসি মেখে বলেছিলেন, “তুমি চিনলে কী করে আমাকে?”
“যেমন করে আপনি আমাকে চিনেছেন …”
“বাহ… মিত্রার মেয়ে মিত্রার মতই হয়েছে” অনুচ্চ উক্তি ছিল কেঁপে ওঠা ঠোঁটদুটোয়।
“সরি, আমি শুনতে পেলাম না…”
কিচ্ছু না বলে নিজের গাড়ী থেকে নেমে এসে অনুপমার গাড়ীতে উঠেছিলেন মানুষটি।
অনুপমা একটাও কথা না বলে স্টার্ট দেয় গাড়ী। মনিমা তাকে কক্ষনও কিছু লুকোয়নি। তাই অনেকবার শুনে শুনে তার প্রায় সমস্তটাই জানা। বহুবার তার নিজেরও মনে হয়েছে কেন এই দুটো মানুষ এত ভালবাসা সত্বেও এভাবে একা একা থেকে গেল সারাজীবন। কার কী লাভ হল এই দূরে থাকায়! কখনও মনে হয়েছে নিজেই গিয়ে ধরে আনবে এই মানুষটাকে। আবার কখনও ভেবেছে মনিমাই ঠিক। যে এতবছরে একবার আসতে পর্যন্ত পারে না সে ভালবাসতেই জানে না। যে শুধু মুখের কথায় চলে যায় জীবন থেকে, তার যাওয়াই ভাল। অভিমান যে কী সাঙ্ঘাতিক হতে পারে, তা যে একটা মানুষের সবকিছু পালটে দিয়ে খরস্রোতা নদীর ও গতিপথ পালটে দিতে পারে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তো মনিমা।
এতদিন উনি আসেননি। আজ কেন এলেন? কোথা থেকেই বা এলেন? মনের মধ্যে প্রশ্ন ঝলকায় ওর। গল্প শুনে, ছবি দেখে, চিনতে কোন অসুবিধাই হয়নি। আর এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষকে না বলা যায় না। তাই মুখ বুজে গাড়ী স্টার্ট দিয়েই ফেলে। বাড়ীর সামনে এসে গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক নামেন। বেশ আত্মস্থ পা রাখেন সিঁড়িতে। অনুপমার জোরে জোরে বলতে ইচ্ছে করে কেন দু’খানা জীবন এভাবে নষ্ট করলেন ইনি। কিন্তু সেকথা মুখে বলা তো দূর একটাও শব্দ বের হয় না ওর মুখ দিয়ে। কাল থেকে এই প্রথম হটাৎ কিংশুকের জন্য ওর ভীষণ মনকেমন করতে শুরু করে। নিজেকেই অবাক হয়ে দেখে ও। কি আশ্চর্য! কাল কিছুই হল না, অথচ এই মানুষটাকে দেখার পর থেকেই কিংশুককে এত মিস করছে কেন ও!
যেন ওঁর নিজেরই ফ্ল্যাট, যেন রোজ এইখানে এইভাবে উনি যাতায়াত করেন, এইরকম ভঙ্গীতে ডোরবেলে হাত ছুঁইয়ে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উনি বলেন, “কী জানতে চাইছিলে? দেরী করলাম কেন? সেটা আমারও প্রশ্ন। উত্তর খুঁজছি বহুদিন ধরে। বেটার লেট দ্যান নেভার, তাই না?”
ঘরে ঢুকতে ঢুকতেও সলজ্জ হেসে বলেন, “তবে যেটা কেউ জানে না, আমি বরাবর ওর খুব কাছে কাছেই থেকেছি, আই মিন এপাড়া ওপাড়া। আই ইউজড টু কালেক্ট হার এভরি ইনফর্মেশান… আই মিন যাকে তোমরা এখন স্টকিং বল। অ্যান্ড আই ফলোড হার ইন অল প্রোগ্র্যামস…”
অনুপমা চোখ বড় বড় করে শুনছিল। কী অদ্ভুত ভালবাসা এদের, কী অসম্ভব অভিমান আর ধ্বংসের ইতিহাস দুটো জীবনকে ঘিরে! কী নিদারুণ ভালবাসা! মনিমাকেও তো দেখল ছোট থেকে! মুখে নামটাও উচ্চারণ করে না কিন্তু প্রতি জন্মদিনে উপোস করে পুজো পাঠাতে ভোলে না।
বলব না বলব না করেও বলেই ফেলে অনুপমা, “আর পামেলা আন্টি?”
ঘাড় নাড়েন সৌম্য মানুষটি। তার কপালের প্রশান্তি ভেদ করে জেগে ওঠে তিনটি গভীর বিগত সময়চিহ্ন। খানিক চুপ করে থেকে দু’দিকে মাথা নাড়েন তিনি, “সে নেই। চলে গিয়েছে এক পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে। আমি তো তাকে কিছুই দিতে পারিনি। আমার কোন অভিযোগ নেই। ছেলেও তার নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত।”
চমকে ওঠে অনুপমা, “সে কী? তাহলে এতদিন আপনি এলেন না কেন? এতবছর ধরে?”
ম্রিয়মান হাসি খেলে যায় নদীবাঁধের প্রান্ত দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষটির উদাসীন ঠোঁটে, “সেজন্যই আর আসা হল না। যদি পামেলা চলে না যেত তাহলে হয়তো কোনওদিন আমি বাঁধন কাটিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু ও চলে যাওয়ার পরে এলে আমার আসাটাকেই ছোট করে দেখা হত, ধরে নেওয়া হত যেহেতু ও নেই তাই আমি এলাম। এতে আমি বা তোমার মনিমা দুজনেরই অসম্মান। তাই সারাজীবন ধরে ও ভাবল আমিই আবার আসব, আর আমি ভাবলাম ও আর একবার ডেকে নিক।”
আর কিছু বলার থাকে না অনুপমার। শুধু একটাই দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর ভেতর থেকে, একটাই মাত্র জীবন, কত কত তুচ্ছ কারণে শেষ করে দেয় মানুষ! এই হটাৎ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে আরো একবার কিংশুকের সম্বন্ধে গভীর চিন্তার বিষয়টা বুকের মধ্যে রেখে দেয় গুছিয়ে। একটু চেষ্টা করলে হয়তো এতদিনের সম্পর্কটা বাঁচানো যাবে।
পায়ে পায়ে পরমার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় দু’জনে। পরমার মুখ এদিকেই ফেরানো। বুকের কাছে ল্যাপটপটা আলগোছে ধরা। হয়তো লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকতে যাচ্ছিল অনুপমা। ওকে বারণ করে অরিত্রজিত। দু’জনে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কেমন একগুচ্ছ শুকনো রজনীগন্ধার মত পবিত্র লাগছে পরমাকে। বয়স পারেনি ওর নিজস্ব লাবণ্য কেড়ে নিতে। ভারী স্নিগ্ধ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠছে ঠোঁটের প্রান্তে।
অরিত্রজিত একবার পরমার কপালে হাত রাখে। তারপর নিজের মনে বলে যায়, “ডেকো না ওকে। ও আমার স্বপ্ন দেখছে। হ্যাঁ আমি জানি, ও আমারই স্বপ্ন দেখছে। যতক্ষণ ও না জাগবে, আমি অপেক্ষা করছি।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভীষণ ভালো লাগলো। উপন্যাসটা।কে বলে মেয়েদের বন্ধুত্ব হয় না!