novel-nona-jol-2-of-5

নোনা জল
অনিন্দিতা গোস্বামী

দশ

বাজছে ম্যান্ডোলিন, বাজছে ড্রাম, ফ্লুট আর কাঠের পাটাতনের ওপর চামড়ার বুটের বাদ্যি। কাচের মদিরা পাত্র উপছে উঠছে উত্তাল সমুদ্রের মতোই। ফের একটা নীলের পেটি ভর্তি ব্রিটিশ জাহাজ লুঠ করেছে ক্যাপ্টেন ফিলিপ্পে। তাই এই উল্লাস উৎসব। জিপসি সুন্দরীর লাস্যে মায়াবী হয়ে উঠেছে জাহাজের ডেক। উপর-নীচ আজ সব নীল। ব্রিটিশরা তাদের জাতশত্রু। জাতশত্রুকে কব্জা করার মজাই আলাদা। তাদের কাছ থেকে ব্যবসা শিখে এখন তাদের ওপরেই খবরদারি চলাতে চায় বেজন্মাগুলো। তারা পর্তুগিজ, জলের নেশা তাদের জন্মগত। না হলে লুঠ করবার জন্য ল্যান্ড কি কিছু কম আছে? তবু ঝড়ঝঞ্জা উপেক্ষা করে বার বার জলে নামে কেন তারা? দেশটাকে চেনাল কে? পথটাকে চেনাল কারা? চুরুটে নতুন করে তামাক ঠুসলেন ফিলিপ্পে। ধক্‌ ধক্‌ করে জল কেটে এগোচ্ছে তাদের বাণিজ্য তরী।

উত্তাল সমুদ্রের বুকে নারীসঙ্গের স্বাদ যেন পাগল করে দেয় পর্তুগিজ রক্ত। নেশা মাথায় চড়লে তিনি হাত ধরে টান দিলেন নৃত্যরতা জিপসি সুন্দরীকে। রুপোর মালা পরাবেন আজ তিনি সুন্দরীর গলায়। চিনের থেকে রুপো ভর্তি জাহাজ আসবে তার হাতের মুঠোয়। চারটে বন্দুকে কী করতে পারেন তা আজ দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি ইংরেজদের এবার। তিনি রুপোর বদলে এক জাহাজ অস্ত্র কিনবেন আর এক জাহাজ অস্ত্রের বদলে একটা গোটা দেশ। ক্ষমতা দখল করতে পারলে কে দস্যু আর কে রাজা! সুন্দরীকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন আড়ালে। নেশায় বুঁদ হয়ে তখন তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ঝিমোচ্ছে। সমুদ্রের বুকে তখন শুধু ভারী জাহাজের স্পন্দন।

গভর্নর লর্ড ক্যানিংয়ের মস্ত বড় টেবিলের ওপর খোলা আরও মস্ত মস্ত দুটো মানচিত্র। তার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন ভারপ্রাপ্ত সুদক্ষ প্রশাসক জে পি গ্রান্ট আর ক্যানিং নিজে। দু’জনেরই মুখে চিন্তার ছাপ, ভুরু কুঁচকানো। লন্ডনের লিডেন হল স্ট্রিটের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে এসেছে কড়া ভাষায় লেখা চিঠি। তাতে ভর্ৎসনা করা হয়েছে উভয়কেই। ভারত মহাসাগরের ওপর থেকে নীল ভর্তি বাণিজ্যতরী জলদস্যুদের দ্বারা লুঠ হওয়ায় প্রভূত ক্ষতি হয়েছে কোম্পানির। দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা সামলে এই ক্ষতিপূরণ কোম্পানির কাছে এই মুহূর্তে খুবই সমস্যার। বিশেষ করে এটা তো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা তাদের বাণিজ্যপথ, এই পথের সুরক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ভাবে ভাবনাচিন্তা করা উচিত। নিরর্থক অর্থের ক্ষতিসাধন মহারানি বরদাস্ত করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

টোপো মানচিত্রের বৈশিষ্ট্য এই যে তা পনেরো ডিগ্রি অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের ব্যবধানে অঙ্কন করা হয়। তাই কোনো অঞ্চলের সামগ্রিক বিষয় খুব সহজেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লর্ড ক্যানিং বললেন, কী ভাবছেন মি গ্রান্ট, বিষয়টা কি নতুন করে ভাবনাচিন্তা করা যায়?

ঘাড় নাড়লেন স্যার জন পিটার গ্রান্ট, হুম্‌, যায়। কিন্তু অভিজ্ঞতাই ভাবনাকে থমকে দিচ্ছে। কেউ তো দায়িত্ব নিতে রাজিই হবে না।

ক্যানিং বললেন, রাজি হবে না বলে তো কোনো কথা নেই, অর্ডার মানে অর্ডার। মিলিটারি শাসনে পসিবিলিটিস্‌ বলে কোনো কথা নেই। আর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তো মানুষ ভয় পায় না, শিক্ষা নেয়। আপনি পোড় খাওয়া মানুষ অফিসার, আপনাকে আমি নতুন করে কী বলব? পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের অবস্থা আর এখনকার অবস্থা তো এক নয়। এখন আমরা অনেকটা গুছিয়ে নিতে পেরেছি। শুধু ট্রেডিং–এ তো নয়, রাজনীতিতে ইস্ট ইন্ডিজ-এ আমরা এখন একটা শক্তিশালী ক্ষমতা। আর বাণিজ্যে তো আমরা এখন মনোপলি করছি, কোথায় ফ্রেঞ্চ কিম্বা পর্তুগিজরা? তারপরেও যদি হার্মাদদের কন্ট্রোল করতে না পারি আমরা, তবে তো সেটা সত্যি লজ্জার আমাদের কাছে।

অফিসার বললেন, কে হার্মাদ মহামান্য? পর্তুগিজ অথরিটির সাপোর্ট না থাকলে ওদের এত বাড়বাড়ন্ত হতে পারে?

মহামান্য ক্যানিং বললেন, মাঝসমুদ্রে ওদের সাপোর্ট দিতে নিশ্চয়ই কেউ আসেনি, আপনাদের পেট্রোলিং থাকলে নিশ্চয়ই এটা ঘটতে পারত না।

চিন্তান্বিত ভাবে ঘাড় নেড়ে অফিসার বললেন, এসেছে, মাঝসমুদ্রে সাহায্য করতেই ওদের কেউ এসেছে, আমরা সেটা জানতে পারছি না।

—তবে জানার চেষ্টা করুন।

—হুম্‌। আর ওই যে বললেন না স্যার পেট্রোলিং, মাঝসমুদ্রে ঘাঁটি না গেড়ে পেট্রোলিং করাটা খুব সমস্যার, ল্যান্ড থেকে দূরত্বটা একবার চিন্তা করেছেন স্যার?

—তা ঘাঁটি গাড়ুন। নাভাল বেস তৈরি করুন ওখানে। আমি তো এই কথাটাই এতক্ষণ ধরে বলতে চাইছি আপনাকে।

অফিসার ঝুঁকে পড়লেন মানচিত্রের ওপরে। বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগরের দিকে পরপর নেমে যাওয়া দ্বীপের মালায়। বললেন ক্রান্তীয় বৃষ্টি-অরণ্য অঞ্চল। গভীর জঙ্গলে ঢাকা এসব এলাকা। তার ওপরে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ঠেসমূল আর শ্বাসমূলে মাটির ওপরে চলাই অসম্ভব। কোনো কিছু তৈরি করতে গেলে আগে শোর অঞ্চল দরকার। সেরকম উপকূল তো এখানে নেই স্যার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ক্যানিং, কোম্পানির অফিসারের দিকে। বললেন, অ্যাট এনি কস্ট উই নিড আ নাভাল বেস অন বে অব বেঙ্গল। আপনি একটা প্রোজেক্ট জমা দিন আমার কাছে অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। অ্যাপ্রক্সিমেটলি আপনার কত খরচ এবং কত লোকের প্রয়োজন। দেন আই উইল টেক্‌ দ্য নেসেসরি অ্যাক্‌শনস, ওকে অফিসর, ইউ গো এন্ড স্টার্ট ইয়োর ওয়ার্ক। আই থিঙ্ক উই উইল মিট ভেরি সুন। খুব শিগগিরি আমরা বসতে পারব আশা করি। অফিসারের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন লর্ড ক্যানিং, হাত ঝাঁকিয়ে বিদায় নিলেন অফিসার। তাঁর চলা দেখে মনে হলো গোটা উপমহাদেশীয় ভূখণ্ডটাই চেপে বসেছে তার মাথার ওপর।

ফিলিপ্পের বাণিজ্যতরী এসে নোঙর করল জঙ্গলে ঘেরা একটা ছোট্ট দ্বীপে, যেখানে অপেক্ষা করছিলেন একজন দেশীয় অফিসার, রবার্ট। এই রবার্ট অবশ্য তাঁর সত্যিকারের নাম নয়। ছদ্মনাম। এরকম কত অফিসার আছে যারা ছদ্মনামে চোরাই ব্যবসা চালান। তাদের সহযোগিতা না পেলে কি ফিলিপ্পের মতো কী যেন বলে, জলদস্যুদের, চলত! হাতবদল হয়ে গেল নীলের পেটি। বদলে ফিলিপ্পে পেল জাহাজের জ্বালানি, রসদ, খাদ্য, পানীয় আর রৌপ্যমুদ্রা। অফিসার রবার্টের জাহাজ এখন রওনা দেবে চিটাগাং বন্দরের দিকে আর ফিলিপ্পে ফের ভেসে পড়বেন জলে। উত্তাল ঢেউয়ের তালে তালে হাজার পাল তুলে নাচবে তাঁর জলপরী। তিনি ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে দূরবিন চোখে দিয়ে খুঁজবেন লালমুখো বাঁদরগুলোকে। আর হাল ধরে থাকবে তাঁর ভাই জুনিয়র ফিলিপ্পে। লাল ড্রাগনদের দিন শেষ, তুমি জেনে রাখো ইংরাজ, জলে তোমাদের রাজ চলবে না। ওহ্‌ কত সাধ করে আবার প্রথম জাহাজের নাম দেওয়া হয়েছিল লাল ড্রাগন। এখন ফের আবার নীল তিমি জলে দাপাবে।

দীর্ঘদিন জলে ভাসার জন্য জাহাজের যেমন জ্বালানি দরকার, তেমনি জ্বালানি দরকার মানুষেরও। চারদিকে জল শুধু জল দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে যায় তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। তাদের চাঙ্গা করতে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয় ফিলিপ্পেকে। তাই তিনি মাটি ছাড়ার সময় তালবাদ্যি নৃত্যগীতের জিপসি দলকে জাহাজে তুলতে ভোলেন না। চোখ থেকে দূরবিন নামিয়ে হাততালি দিয়ে জিপসি দলকে ডেকে ডাকলেন ফিলিপ্পে। কানাঘুষো তাঁর কানে আসছে, ইংরাজরা নাকি এই অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে চাইছে। চেষ্টা করেই দেখুক না, ধনে প্রাণে সব মারা যাবে। হার্মাদ কী দেখেছে তারা, জানে না তো এই জঙ্গলে কারা আছে। ভাবছে নোনা জল পেরিয়ে এই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ কিছু আসতে পারে না। অতএব জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে। হাঃ হাঃ, বাঘের থেকেও সাংঘাতিক জিনিস আছে এখানে। মানুষখেকো মানুষ। কম মানুষ কি তাদেরই মারা গিয়েছে! এখন না হয় ঘুরতে ঘুরতে তারা জেনে গিয়েছে কোন দ্বীপে তারা থাকে আর কোন দ্বীপে তারা নেই। দ্বীপে তো আর বণিকেরা থাকে না। কিন্তু জলে ঘুরে ঘুরে বনজঙ্গল ঘেঁটে সেসব জানা তো বড় সহজ কথা না। ওসব আতুপুতু আলুভাতেগুলো দিয়ে ওসব সম্ভব হবে না। নোনা হাওয়াতেই ওগুলোর গায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে।

পর্তুগিজ সাহেবের ডাকে হইহুল্লোড় করতে করতে ডেকের ওপর উঠে এলো নাচগানের দল। আয়ে ও ও ও ও বলে ফিলিপ্পের পিঠের ওপর আঙ্গুল দিয়ে হিলি বিলি কেটে দিল নৃত্যসুন্দরী। ও ও ও করে সমবেত উল্লাস প্রকাশ করল জাহাজের কুলি শ্রমিকরা। চাঁটি পড়ল ড্রামে। রৌপ্যমুদ্রা প্রাপ্তির আনন্দে গান ধরল সুন্দরী।

—আ মিনা সাই ভেলহিনহা

ইস্টা টোডা রোটিনহা

ডি আনডার আ বেইলার।

ঘাঘরার কুঁচিতে তরঙ্গ তুলে ফিলিপ্পেকে ঘিরে নাচছিল সুন্দরী। সর্দারের হাতে লাল মদিরার পান পাত্র তুলে দিয়ে সে ফের ধরল,

আগোরা টেনহ্‌ উমা নোভা

ফেইটিনহা না মোডা

পি রা এউ ইস্ট্রিয়ার।

মানে কিনা আমার পুরনো পোশাকটিও ভালো ছিল কিন্তু নতুন পোশাকটি খুবই আধুনিক ও সুন্দর। আসলে আমার মা আমায় যখন বিয়ে দিয়েছিল, আমি ছিলাম সুপ্ত, এখন আমার আগ্নেয়গিরি আগুন উৎপাদনে সক্ষম।

ফিলিপ্পের হাত থেকে মদিরা পাত্র নিয়ে গেল একজন ভাঁড়। সুন্দরী নাচের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ফিলিপ্পের দিকে। সন্ধ্যে ঘন হয়ে আসছিল একটু একটু করে। চাঁদ উঠছিল দিগন্তবিস্তৃত খোলা আকাশের গায়ে। পায়ের তালে তালে ঘন হয়ে আসছিল দুটো শরীর রুপোলি জ্যোৎস্নায়। সিক্ত জিহ্বা দিয়ে নর্তকী যখন মুছে নিচ্ছিল ফিলিপ্পের ঠোঁটের কষ থেকে গড়িয়ে আসা অবশিষ্ট মদিরা, ফিলিপ্পের চোখ থেকে মুছে যাচ্ছিল তার গুলিতে গড়িয়ে পড়া ইংরেজ নাবিকের রক্ত। ফিলিপ্পে সুন্দরীর খোলা চুলের মধ্যে দু’হাতের আঙুল চালিয়ে খামচে ধরে তার ওষ্ঠ অধরে তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দিতে দিতে বলল, নীল তিমি। নীল তিমি।

সুন্দরী সামান্য ঠেলায় ফিলিপ্পেকে সোজা করে ধরে বলল, উঁহু, তিমি নয়, হাঙর। শার্ক।


এগারো

আজ ওদের কচ্ছপ ভক্ষণ উৎসব। ঝিল্লি উৎসব। সুরমাইয়ের ঋতু দর্শনের বৎসরকাল সম্পূর্ণ হয়েছে গত অমাবস্যা তিথিতে। ঘোর অন্ধকারে উৎসব সম্পন্ন করার সমস্যাহেতু পূর্ণচন্দ্রের তিথি নির্ধারিত হয়েছে উৎসবের জন্য। ছেলেদের হাতের নীচের খোঁদলে সুপুরি গাছের নরম আঁশের মতো রোম গজালেও উৎসব হয়, তবে মেয়েদের ঝিল্লি উৎসবের মেজাজই আলাদা। তিন দিন ধরে চলে সে উৎসব। নাচ গান খানা পিনা।

গতবার যখন ঝোপেঝাড়ে টিপক ফুটল, ওহ্, কী গরমের দিন। সারা শরীরে যেন জ্বালাপোড়া করে। দুপুরের দিকে খাঁড়ির মুখে জলে পা ডুবিয়ে একটা পাথরের ওপর বসে ছিল সুরমাই। হঠাৎ টের পেল সুরসুর করে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তার শরীরের ভেতরে। সে ঘাড় নিচু করে দেখল সরু রক্তের ধারা গড়িয়ে নেমে আসছে পাথর বেয়ে। সে জানে, সে বুঝল ফুল ফুটেছে। ঝিল্লি বড় পবিত্র জিনিস মেয়েদের জীবনে। সে দূরে নীল জলের দিকে তাকিয়ে বলল লুক দেখতে পাচ্ছিস, আমার জীবনের সকল রং কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে তোরই দিকে।

রোজ দুপুরে নির্জন খাঁড়ির কাছে এই জায়গাটায় এসে বসে থাকে সুরমাই। দূরে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় সাগরের বুকেই কোথাও একটা স্থির হয়ে আছে লুক। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে নামে জলের ধারা, ঠোঁটের কোনায় সেই ধারা এসে ঠেকলে সুরমাই টের পায় তার স্বাদও ওই সাগরের জলের মতোই। সাহেবদের কাছে থেকে কী করে যেন তার দিদি কতগুলো সাহেবদের ভাষা শিখেছে, একদিন সাগরের জল মুখে নিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে তাকে বলেছিল, সল্টি, সল্টি, নোনা।

সে উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে পাতার ঝালর খুলে পাথরের ওপর রেখে এক পা, দু’পা করে গিয়ে দাঁড়াল কোমর পর্যন্ত জলে। অঙ্গ মার্জনা করে করল স্নান, জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, লুক আমি বড় হচ্ছি! এক লজ্জার ঘূর্ণি যেন পাক খেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল গভীর সমুদ্রের দিকে। সে জল ছেড়ে উঠে আসার সময় আঁজলা ভরে জল এনে ধুয়ে দিল পাথরের ওপর লেপটে থাকা রক্তের দাগ।

নাওয়ের দলবল কাল সন্ধেয় বেরিয়েছিল কচ্ছপ শিকারে। সুরমাইটা পয়মন্ত মেয়ে। এত বড় বড় দুটো কচ্ছপ সাধারণত একদিনে ভাগ্যে জোটে না। হা হা হা হা, আকাশ ফাটিয়ে হাসছিল নাও। দারুণ রগড় লাগে তার ঠিক এই সময়টায়। কোকবিগুলোর দুই চোখে তীক্ষ্ণ তীরের ফলা বিঁধিয়ে দিলেই ওগুলো কানা হয়ে যায়। বুড়ো দাদুগুলোর মতো ঘাড় নাড়ে আর পালাতে পারে না। নিশ্চিন্তে নিয়ে এসে ফেলে রাখো বালির ভেতরে, তারপর ফের পাকড়াও করতে যাও আর একটাকে।

শিকার একধরনের খেলা। যারা জানে তারা জানে। মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। জঙ্গল চলে গেলেও মানুষের প্রবৃত্তি ধ্বংস হয় না, শুধু পরিমার্জিত হয় কেবল। নামু বলল, নাও, সুরমাইয়ের গায়ের তেল এবার ফেটে বেরবে। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে থেকে ফনা তুলল সুরমাই, দরকার নাই। আঃ আঃ আঃ, কেন মারলে তোমরা কোকবিটাকে অমন করে! ওকে আমি চিনি, ও বার বার আসে এইখানে। ওকে দেখে ধমকে উঠল নাও। —এই, তুই কোথায় ছিলি রে? আকা বেয়া ডে শিকার দেখে ভ্যাকভ্যাকাচ্ছিস? বড্ড ন্যাকা হয়েছ তুমি না?

নাওয়ের বকুনি খেয়ে তার মনখারাপ একটু কমল। এটা তার সেই প্রিয় জায়গা। তার সবসময় দল বেঁধে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু ক’দিন ধরে তো তাকে ঘিরে চলবে উৎসব, হইহট্টগোল, তাই উৎসব শুরু হবার আগে টুক করে সে পালিয়ে এসেছিল এখানে, বসে ছিল সেই পাথরটার ওপর। শিকারির দলকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি সে ঝোপের মধ্যে সিঁধিয়ে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসেছিল। তারই জন্য তো আজ তারা শিকারে এসেছে, চোখে জল নিয়েই সে ফিক করে হেসে ফেলল নাওয়ের দিকে তাকিয়ে, তারপর জিভ ভেঙিয়ে বালির ওপর দিয়ে দিল ছুট। এই মিষ্টি মেয়েটাকে ভালোবাসে দলের সকলেই। যেন একটা ছোট্ট প্রজাপতি, নরম সরম আর নিরীহ।

পাড় ছেড়ে জঙ্গলের উতরাই ধরে ঘরের দিকে ফিরছিল সুরমাই। কাল থেকে তিন সূর্যোদয় কী কষ্ট যে সইতে হবে তার, তবু তার মনে মনে আনন্দ হচ্ছে বেশ। কাল সে একটা নতুন নাম পাবে। নতুন নাম পাবার পরে পুরনো নামকে কি ভুলে যায় লোকে? পা দিয়ে বালি ঠেলতে ঠেলতে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল সে। বৃষ্টির জল বালির ওপর দিয়ে নদী কেটে গিয়ে পড়েছে সাগরে। শুষ্ক সেই শীর্ণ নদীখাতের পাশে সুরমাই দেখল পড়ে রয়েছে মস্ত বড় কমলা রঙের কেতকী গাছের ফুল। তার দিদি তাকে বলেছে, সাহেবদের দেশে নাকি ঠিক এরকম দেখতে একটা ফল আছে তার নাম পাইনাপেল, আনারস। উবু হয়ে বসল সুরমাই। দেখল নানা রকম শঙ্খের খোল পিঠে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট শঙ্খ কাঁকড়ার দল ওই ফুলের গায়ে উঠছে নামছে ঢুকছে বেরচ্ছে, যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সাগরের মাঝখানে ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো আকাশে ধাক্কা খেয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে তেরচা হয়ে এসে পড়েছে ওই ফুলের গায়ে। সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ওই দিকে, তারপর ধীরে ধীরে উঠে হাঁটতে লাগল বনের পথ ধরে।


বারো

লিচো খুব দ্রুত পায়ে প্রবালপোকা পাড়ের দিকে হাঁটছিল। নাও সেটা লক্ষ করল। এমনিতেই ভোরবেলা চুনো মাছ ধরাটরার প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কেউ ওদিকটায় যায় না, পাথুরে এবড়ো খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে হাঁটার সময় না রক্তারক্তি হয়। তাছাড়া আজ বেলা পড়তেই শুরু হয়েছে সুরমাইয়ের অরকুবির অনুষ্ঠান, সাদা কাদা, মানে টোলোডু নিয়ে থুতু দিয়ে গুলে গুলে ওর সারা গায়ে মাখিয়ে পাতা আর কাটি দিয়ে নকশা কাটা হবে। কোমরে পরানো হবে দু’ থাকে হলুদ পাতার ঝালর। হাতে গলায় পরানো হবে কড়ির মালা। সব মেয়েরা ঘিরে ধরে সুর করে গাইবে আর সাজাবে তাকে। এ সময় তো লিচোর সেখানে থাকার কথা। তবে এই অবেলায় লিচো কোথায় যায়? শুধু আজ না, বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ করছে নাও, লিচোর হাবভাব কেমন বেমানান ঠেকছে। প্রথমটায় সে অত আমল দেয়নি। কিন্তু আজ তো তার পিছু না নিলেই নয়, ওই মেয়ের দ্বীপে বিপদ ডেকে আনতে দু’দণ্ডরও বেশি সময় লাগবে না।

কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে তাই রক্ষে, এসময় জঙ্গলে হাঁটলে বেশি শব্দ হয় না। শুয়োরের চর্বি মাখানো টান টান ধনুকের ছিলার গায়ে একবার হাত বোলাল নাও। আগত বিপদের আশঙ্কায় চতুষ্পদের মতো যেন রোম খাড়া হল তার। লিচো গিয়ে দাঁড়াল উঁচু পাথরের ওপরে। ওর চোখ দূরে সাগরের দিকে। পাথরের আড়াল নিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে রইল নাও। তার ইচ্ছে করছিল তীরের তীক্ষ্ণ ফলায় কোকবির চোখের মতো লিচোর চোখের মণিদুটো বিঁধিয়ে ফেলতে। কিন্তু অনেকক্ষণ ওঁত পেতে থেকেও নাও কিছুই দেখতে পেল না। লিচোও নেমে এল পাথরের ওপর থেকে।

মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকল লিচো। লিচোর আজ মন ভালো নেই। সুরমাই আজ রানি। সবাই আজ সুরমাইকে নিয়েই ব্যস্ত। পাগল ভূতটা আজ এল না কেন? ভূতটা বুড়ো, কিন্তু খুব ভালো। কী সুন্দর সুন্দর গল্প শোনায় ওদের ভাষায়, হাত পা নেড়ে নেড়ে। লিচো ঠিক বুঝে যায়। সব একটা দাড়িওয়ালা ভগবানের গল্প। সেই ভগবানের নাম জেসাস। কত নতুন নতুন শব্দ শেখায় তাকে, গড, অলমাইটি, ওয়াটার, বোট, শিপ, সি, ট্রি, ফ্রুট, বানানা, আবার তার সঙ্গে কাতুকুতুও খেলে। বার বার লিচোকে বলে, সবাইকে যেন সে গডের কথা বলে। বাব্বা, জানে না তো এদের, ওসব কথা বলতে গেলে এরা লিচোকেই চ্যাংদোলা করে সাগরের জলে ছুড়ে ফেলে দেবে। ভূতের গায়ের গন্ধটা লিচোর খুব ভালো লাগে, আর হাসিটা কেমন যেন বাচ্চা ছেলের মতো।

ঘরের মধ্যে একটা চাটাইয়ের ওপরে হাত পা সামনের দিকে ছড়িয়ে বসে আছে সুরমাই। পাশে একটা ছোট্ট পাটাতনের ওপর কাঠের পাত্রে রাখা জল, সেটা ঘিরে গোল করে বসে আছে দলের সব মহিলারা। লিচো এসে চুপচাপ বসে গেল তাদের মধ্যে। সবাই এখন অপেক্ষা করছে প্রার্থনা শুরুর জন্যে। বাইরে আগুনের ভাপে সেদ্ধ হচ্ছে মস্ত মস্ত কচ্ছপ। একটা বড় পাতার ওপরে তুলে এনে রাখা হল কয়েক টুকরো কচ্ছপের মাংস আর মসৃণ ও তীক্ষ্ণ করে চাঁছা লম্বা লম্বা দুটো কাঠি।

এখুনি কাঠিতে বিঁধিয়ে দু’টুকরো মাংস সুরমাইয়ের মুখে দেবে তার কাকা, তারপর শুরু করবে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে প্রার্থনা আর কান্না। সুরমাই বলল, তারা সুলুটকোয়া! মানে ও কাকা! এই কাকা ডাকটাই সুরমাইয়ের শেষ কথা। এরপর তিন দিন ধরে সে আর কোনো কথা বলবে না। হাত-পা ছড়িয়ে একভাবে বসে থাকবে চাটাইয়ের ওপরে। তাকে জাগিয়ে রাখতে দিন রাত তাকে ঘিরে চলবে খানা পিনা নাচ আর গান। এই তিন দিন তিন রাত চুপ করে থাকতে থাকতে সে জ্ঞানী হবে। তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে, সে বুদ্ধিমতী হবে, সে বড় হবে। বিচক্ষণ হবে।

হে আমার পূর্বপুরুষগণ এ মাংস আমি তোমাদের উৎসর্গ করছি বলে প্রার্থনা সেরে কাঠিতে করে মাংসের টুকরো সুরমাইয়ের মুখে তুলে দিয়েই কান্না শুরু করল তার কাকা, ও আমার পূর্বপুরুষগণ, আজ এই আনন্দের দিনে তোমরা নেই গো, তোমরা নেই। অমনি উপস্থিত সকলে কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল। ও মাহে ও মিনি ও আমার প্রিয় মানুষেরা তোমরা আজ কেন নেই গো, কেন নেই। কাঁদতে কাঁদতে যখন হাঁপিয়ে গেল সকলে, তখন সকলকে কলা আর মাংস খেতে দেওয়া হল। ঘরের মধ্যে এনে রাখা হল বাটির মতো বিরাট কচ্ছপের খোলের মধ্যে দগ্ধ হওয়া গরম মাংস আর সকলে গোল হয়ে বসে দুই হাত দিয়ে তুলে মহা আনন্দে খেতে লাগল সেই মাংস।

খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সকলে মিলে শুরু করল নাচ। ওলে লে লে ওলে লে লে সামনে খানিক ঝুঁকে হাতে তালি দিয়ে পশ্চাদ্দেশ আন্দোলিত করে ঘুরে ঘুরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগল সুরমাইয়ের ঋতুমতী হবার জন্য।

লিচোর না ভালো লাগছিল নাচতে, না ভালো লাগছিল গাইতে। সে বাইরে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল একটা গাছের নীচে। বাইরেও চাঁদের আলোর নীচে গোল হয়ে নাচছিল আর একটা দল। সে দলে পুরুষই বেশি। নাও লিচোকে লক্ষ করে এসে হাত ধরে টান দিল নাচের জন্য। লিচো এক ঝটকায় সরিয়ে দিল নাওকে। নাওয়ের চোয়াল শক্ত হল, চোখ জ্বলতে লাগল ধক্‌ ধক্‌ করে।

গনগনে আগুনে সুসিদ্ধ চর্বি সহ নরম তুলতুলে মাংসের টুকরো তখন গলে যাচ্ছিল কারও কারও জিভের ওপরে। এরা নুন কী জিনিস জানে না, তেল কী জিনিস জানে না, ঝাল, মশলা কিচ্ছু না। তবু কী তৃপ্তি এদের খাওয়ায়।

তক্কে তক্কে ছিল নাও। ধরবেই সে লিচোকে। লিচোর গলায় আজ সে দেখেছে চকচকে সাদা লোহার মতো একটা জিনিস। লাওরা ওকে বশ করেছে। ওই পথ দিয়ে ঢোকার রাস্তা খুঁজছে। খাল কেটে কুমির আনছে লিচো।

এরপর জঙ্গল কেটে সাফ করে দেবে ওরা, তখন তারা খাবে কী? থাকবে কোথায়? আকাচাপান তাদের বলে, হয়ত কোনো দানো সাগর পাড়ি দেবার সময় পিপে করে তাদের ভাসিয়ে দিয়েছিল জলে, আর তারা ভাসতে ভাসতে এই জঙ্গলে এসে ঠেকেছে। সেই থেকে জঙ্গলেই তাদের ঘরবাস, জঙ্গলই তাদের আহারদাতা। এত দেখেও কি চোখ ফোটেনি লিচোর! তবু ও তাকিয়ে থাকে লাও বোটের দিকে!

উৎসবের ঘোরে এখন মহল্লায় সবাই আনমনা। এই সময় লিচো যা খুশি করে ফেলতে পারে। তাই নাও লিচোকে চোখ ছাড়া করছে না। সুরমাইয়ের নতুন নাম হয়েছে জাইরে। এই জাইরে নামটা তার মাত্র কিছু দিন থাকবে। তেমন লিচোর নাম ছিল লিপে। এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে সুরমাই, তার হাত দুটো ধরে পাশে বসে থাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে লিচোকে। কিন্তু সূর্য ঢলতেই উসখুস করে উঠল লিচোর মন। সে অন্য একটি মেয়েকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে টুক্‌ করে পালিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল পাথরের ওপরে। পিছন থেকে শিসের শব্দ শুনে চমকে তাকাল সে। দেখল যেখানে সমুদ্রের জল পাহাড়ের গা কেটেছে খিলানের মতো করে, তার আড়ালে জমা জলের ওপরে টলটল করে দুলছে একটা ছোট্ট ডুঙ্গি। বুকটা আনন্দে চলকে উঠল গলার কাছে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না তার বুড়ো ভূতটাকে। অথচ শব্দ করে ডাকার সাহসও পেল না। সে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে খুঁজতে লাগল ভূতকে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন চেপে ধরল তার চোখ। ওরে বাবা রে, বলে সে সবে দৌড়তে যাবে, চোখ ছেড়ে হাত চেপে ধরল বুড়ো ভূত। হো হো করে হেসে উঠে বলল, কেমন ভয় দেখালাম?

বুড়ো ভূতের মুখ চেপে ধরল লিচো, বলল পাহাড়ের কান আছে, শব্দ ছড়িয়ে যায় অনেক দূর। আস্তে। বলে দুজনে হাত ধরাধরি করে নেমে গেল পাহাড়ের নীচে রাখা ডিঙ্গির ওপরে।

বুড়ো ভূত বলল, আজ তোমাকে একটা গান শেখাব। আমাদের গির্জার গান। গান বলতেই লাফিয়ে উঠল লিচো, ডুঙ্গি দুলে উঠল এদিক ওদিক, লিচো বলল আমি জানি তো ওলে লে লে।

ভূত বলল, না না ওরকম না, এ হলো প্রার্থনা, গডকে বলতে হয় আমাকে রক্ষা করো। নিল ডাউন হও, হাঁটু মুড়ে বসো।

হাঁটু মুড়ে বসতে গিয়ে সামনে টাল খেয়ে গেল লিচো। লিচোকে ধরে খাড়া করে দিল ভূত। উদ্যত ঢেউয়ের মতো স্থির হয়ে আছে লিচোর উন্মুক্ত দুটো স্তন। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মসৃণ, আশ্চর্য সুন্দর। দুজনে মুখোমুখি বসেছে ওরা।

প্রার্থনা শুরু করলেন সেই ঈশ্বর পুরুষ। জ্যোর্তিময় সূর্যের আলোকে উজ্জ্বল হয়ে ছিল তার মুখমণ্ডল, দুহাতের আঙুল মুড়ে হাত ঠেকানো কপালের ওপরে। লিচো অনুকরণ করার চেষ্টা করছিল ওঁকে। লিচোর বুকের ভেতরে এসে স্পর্শ করছিল যেন এক আনন্দের বিভা। চোখের পলকে ছুটে এসে বিঁধে গেল এক তীক্ষ্ণ তীর মানুষটার সাদা জোব্বা ভেদ করে একেবারে বুকের ভিতরে। আঃ বলারও অবকাশ পেল না যেন মানুষটি। লাল রক্তে ভিজে উঠল তার শুভ্র পোশাক। লুটিয়ে পড়লেন মানুষটি তার ছোট্ট ডিঙ্গির ওপরেই। আ আ আ আ পাগলের মতো উঠে গিয়ে এ মাথা ও মাথা ছুটোছুটি করতে লাগল লিচো। কে! কে করলি এমন? নাঃ কাউকে দেখতে পেল না লিচো। এমন কি ভিজে বালিতে কারও পদচিহ্নও না। তার মানে অনেক দূর থেকে ছুটে এসেছে এ তীর। এমন লক্ষ্যভেদ, এ নাও ছাড়া আর কারও কাজ নয়। নাও, তুই এটা ভালো করলি না, এর শোধ একদিন আমি তুলবই তুলব, জলে ভেজা রক্তবর্ণ চোখে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করল লিচো। তারপর ডুঙ্গিটাকে ঠেলে আস্তে করে ভাসিয়ে দিল জলের অন্দরে। সে আর একটু জলে নামল, আরও একটু ঠেলে দিল ডুঙ্গিটা, আরও একটু, আরও একটু।

তখন জোয়ারের জল বাড়ছিল সাগরে। ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় মিলিয়ে গেল ছোট্ট ডিঙি নৌকা। লিচো বিড়বিড় করে বার বার একটাই কথা বলতে লাগল যা সে এতক্ষণে শিখতে পেরেছে, হোয়াট আ ফ্রেন্ড উই হ্যাভ ইন জেসাস, হোয়াট আ ফ্রেন্ড উই হ্যাভ ইন জেসাস, তার গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল, নোনা জল।

পরদিন সকালে মায়ের সঙ্গে সাগরে গিয়ে স্নান সারল সুরমাই। এই তিন দিনের পরিধেয় হলুদ পাতার কোমরবন্ধনী বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হল গাছের ডালে, যতক্ষণ না তা আপনাআপনি পচে খসে মাটিতে পড়ে যায়। ঘরে ফিরে সকলের সঙ্গে গল্প করতে করতে পেট পুরে মাংস আর কলা খেল সে। তারপর ক্লান্তিতে নেতিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল চাটাইয়ের ওপরে। উৎসব শেষ হল।


তেরো

জেটির ওপর থেকে ডাক্তারের উদ্দেশে শেষবারের মতো হাত নাড়লেন অফিসার স্যার জে পি গ্রান্ট। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে তাঁর। চোখের সামনে ফুটে উঠছে যেন কিছুদিন ধরে পর পর ঘটে চলা চিত্রপট।

মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা, গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের নিজস্ব কক্ষের দরজা ঠেলে স্যালুট ঠুকে ভেতরে ঢুকলেন তিনি, ইয়েস স্যার। সামনের চেয়ার দেখিয়ে লর্ড ক্যানিং বললেন, বসুন অফিসার। সিট ডাউন প্লিজ। আপনার প্রোজেক্ট কদ্দুর? পেপারস এনেছেন? ইয়েস স্যার, বলে মোড়ানো কাগজের রোলটা তিনি এগিয়ে দিলেন গভর্নরের দিকে। তারপর বললেন, মাপ করবেন স্যার। আলোচনা শুরুর পূর্বে একটা কথা একটু বলে নিতে পারি কি? বড়লাট বললেন, সিওর। নিশ্চয়ই পারেন। অফিসার বললেন, খবর শুনেছেন?

মুচকি হেসে লর্ড ক্যানিং বললেন, কী? বঙ্গোপসাগরে ঝোড়ো হাওয়া, আকাশে কালো মেঘ?

অফিসার সন্দিগ্ধ চোখে বললেন, না মানে স্যার…

ক্যানিং বললেন, প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপ থেকে চিঠি এসেছে, আমি তো মিশনারিদের আগেই বলেছি বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে গেলে যা হয় আর কী।

অফিসার আমতা আমতা করে বললেন, সেটা কথা না স্যার, কথা হলো বুনো লোকগুলো কী ডেঞ্জারাস! সাংঘাতিক।

লর্ড ক্যানিং বললেন, আপনি জলের একটা সামান্য ম্যাসাকার নিয়ে এত চিন্তিত কেন অফিসার, যখন হোল সাব কন্টিনেন্টের অবস্থা হরিবল, মিজারেবল। মহারানি ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত যার পর নাই অসন্তুষ্ট। কোম্পানি শাসনই বুঝি আর থাকবে না। আমি তো সবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব। কিন্তু এতদিন নেটিভদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কেন টের পায়নি ইউরোপিয়ান অফিসাররা? বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের নাভাল বেসের পরিকল্পনা শুরু হয়েও কেন থমকে গেল! আমি আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করতে চাই না। দেখি আপনি কী ভাবনা চিন্তা করেছেন এ ক’দিনে, বলে তিনি মোড়ানো কাগজটা খুলে ছড়িয়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। কাগজের ওপর ঝুঁকে এলেন অফিসার, আঙুল দিয়ে চিহ্নিত করলেন একটা বিন্দুকে, বললেন এই হচ্ছে চ্যাথাম দ্বীপ, এটা কিন্তু স্যার অন্যতম বড় দ্বীপ, এইখানে ব্লেয়ার সাহেব প্রথম একবার কলোনি সেটেলমেন্ট তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন সেই ১৭৯৬ সালে। আপনি জানেন স্যার মহামারী ম্যালেরিয়ায় তখন প্রায় অর্ধেক লোকই মারা যায়, প্রাণভয়ে পরিকল্পনা বাতিল করে ব্লেয়ার সাহেব পালিয়ে আসেন। যে ক’জন বেঁচে ছিলেন তাদের পেনাংয়ে প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপে চালান করা হয়।

—ওহ্! বলে বিরক্তিসূচক শব্দ করে ক্যানিং সাহেব বললেন, জানা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে অযথা সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন আছে কি অফিসার?

খাড়া হয়ে অফিসার বললেন, নো স্যার।

গভর্নর বললেন, প্লিজ কাম টু দ্য পয়েন্ট অফিসার।

—ইয়েস স্যার, চ্যাথামের মেন প্রবলেম ছিল স্যার স্কারসিটি অব ওয়াটার। জলের অভাব, এ ব্যাপারে আমি একজন সার্ভেয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি, এই দ্বীপটা দেখুন মোটামুটি ১১ ডিগ্রি উত্তর ৯২০ পূর্ব, এখানে এই সমস্যা নেই। বঙ্গোপসাগরের ওপর এই যে ছোট্ট দ্বীপটা এটাই মনে হয় প্রাথমিক কাজকম্মো শুরু করার জন্য অধিক উপযোগী হবে। তারপর ধীরে ধীরে আশেপাশের দ্বীপগুলোতে প্রয়োজন হলে এবং সম্ভব হলে বাড়ানো যাবে বাসস্থান। তবে স্যার টু হট আর হিউমিড ওয়েদার। ভীষণ গরম, আর ভেজা নোনা বাতাস। তাছাড়া আপনাকে তো আগেই বলেছি, খুব শক্ত কাঠের গাছে ছাওয়া ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে প্রচুর শ্রমিক দরকার। নেটিভরা তো বেশির ভাগই স্থলযুদ্ধে ব্যস্ত। চারিদিকে তো বিদ্রোহ আর বিদ্রোহ। স্থল সামলে জল সামলানো কি সহজ হবে স্যার?

গভর্নর লর্ড ক্যানিং বললেন, সেটাই তো আমাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা। অসংখ্য প্রিজনার। এত সংখ্যক কয়েদির স্থান সংকুলান হবার মতো কারাগার আমাদের কই অফিসার! বহু মানুষকে জাস্ট স্থানের অভাবে গুলি করে মেরে দিতে হচ্ছে। মেরে দিলে এমনিতে কিছু না, লস্‌ অব ম্যান পাওয়ার। সস্তা কিম্বা ফ্রি মানব শক্তি যে কতখানি প্রয়োজন একটা সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গোপসাগরের জল হয়তো দু দশ হাজার মানুষের লাশে বুজে যাবে না, কিন্তু দু দশ হাজার মানুষ একটা কারখানা দাঁড় করিয়ে দিতে পারে সহজেই। মানুষ মারা আমাদের কাজ নয়, মানুষ মারতে আমরা এখানে আসিওনি। ব্যবসা করতে এসেছি। সেটা কীভাবে কত লাভজনক ভাবে করা যায় সেটাই আমাদের দেখা উচিত। তবে হ্যাঁ, বৃহত্তর স্বার্থে কিছু ম্যান লস হতেই পারে। সেটা কোনো ব্যাপার না। তবে ক্ষতি মানে ক্ষতি, তাতেও কিন্তু সমাজে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অফিসার গভর্নরের কথার গতি কিছুটা আঁচ করে বললেন, সেক্ষেত্রে…

—হ্যাঁ, আমাদের এই অসংখ্য কয়েদিদের কাছে লাগানো উচিত।

অফিসার বললেন, ইয়েস স্যার, এটা একটা খুব ভালো প্রস্তাব। কিন্তু কাজ পরিচালনার জন্য কিছু ইউরোপীয় অফিসারদেরও তো প্রয়োজন।

গভর্নর বললেন, ইয়েস, সে তো প্রয়োজন বটেই। সেটুকু স্যাক্রিফাইস তো করতেই হবে। একটা রাজত্ব পরিচালনা করব অথচ নিজেরা কোনো যুদ্ধে নামব না তা কি হয়। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের কথা ভাবুন তো। তবে আপনি জানেন কি— কোনো আত্মত্যাগই কিন্তু বিফলে যায় না, ইতিহাসে কোথাও না কোথাও সেই নাম থেকেই যাবে।

অফিসার বললেন, ইয়েস স্যার। তাঁর মুখে এসে গিয়েছিল, হ্যাঁ মহামান্য, ইতিহাসে নাম থাকে শুধু নেতাদের, রাজাদের, মহামান্যদের। আমজনতার নয়, তারা মাস। জনগণ। কিন্তু গিলে নিলেন, কারণ তিনিও যে প্রায় আমজনতাই। এই কথা গভর্নর জেনারেলের সামনে তাঁর মতো ক্ষুদ্র অফিসারের ঠোট ফস্কে নির্গত হলেই ইতিহাস কেন, বর্তমান থেকেও তাঁর নাম মুছে যেতে দেরি হবে না।

লর্ড ক্যানিং বললেন, তাহলে অফিসার, কাজ শুরু করুন। প্রথমে একটা দপ্তর গঠন করুন, কারা আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলুন। ঠিক আছে, আপনার প্রস্তাবই থাক। প্রথমে কাজটা ছোট করে শুরু করুন তারপর ধীরে ধীরে এগোনো যাবে। আমি আশা করছি ওই দ্বীপ ভবিষ্যতে মানুষের আর্কষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াবে। তার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে থাকবে কোম্পানির গরিমাও।

—ইয়েস স্যার, আমি আমার কাজ শুরু করছি, বলে উঠে পড়লেন অফিসার। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন এতদিন কলকাতায় থাকতে থাকতে বাংলাটা তিনি ভালোই শিখেছেন, সামান্য একটা উপসর্গের তফাত, সু আর কু, কোম্পানি শাসন এই উপমহাদেশের জনগণের জন্য যা যা করছে তার ভালো খারাপ দু’দিকেরই তুল্য মূল্য বিচার করে কোন উপসর্গ তাদের মুকুটে যোগ হবে তা কালই বিচার করবে। তবে কোনো কাজই বুঝি নিরবচ্ছিন্ন ভালো হয় না, তার ভালো খারাপ দু’দিকই থাকে।

কাজে কিন্তু গাফিলতি করলেন না গ্রান্ট। সব দিক দেখে শুনে সুষ্ঠুভাবে কাজটি যাতে শুরু হয় তার ব্যবস্থা করলেন। প্রথমেই একটা কমিটি গঠন করা হল। যার সদস্য সভাপতি হিসাবে মনোনীত করা হল ইনস্পেকটর জেনারেল অব প্রিজন, এফ জে মোয়াটকে। এছাড়া কমিটিতে রইলেন, জে আর প্লেফেয়ার এবং লেফ্‌টেন্যান্ট জে এ হেথকোট। কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হল বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সবচেয়ে উপযোগী একটা জায়গা নির্বাচন করতে। আলোচনার মাধ্যমে সম্ভাব্য কয়েকটি জায়গা নির্দেশ করা হল কমিটির কাছে। দেখতে বলা হল সেটা যেন একটা স্বাভাবিক পোতাশ্রয় হয়। জল ও কাঠের প্রাচুর্য থাকে। কয়েদিদের জন্য একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে। চাষবাসের উপযোগী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিছু জায়গা থাকে। এবং প্রয়োজন হলে সেখানে যেন একটা মস্ত বড় কারাগার তৈরি করা সম্ভব হয়। সেখান থেকে কয়েদিরা যেন কোনো ভাবেই সাঁতরে কোনো দিকে পালাতে না পারে। এই পরিদর্শন অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করতে রাজি হলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। ক্যাপ্টেন ক্যাম্পবেলের তত্ত্বাবধানে কলকাতা থেকে বার্মা হয়ে নৌবাহিনীর বাষ্পচালিত ছোট্ট যুদ্ধ জাহাজ রওনা হল আন্দামানের উদ্দেশে। বার্মার কমিশনারের নির্দেশে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর যারা জঙ্গলে চলাফেরায় অভ্যস্ত এমন কিছু কর্মী কয়েদিও গার্ড হিসাবে সঙ্গী হলেন সেই অভিযানের।

কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করল। তারা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে রুটল্যান্ড ও সিঙ্কু দ্বীপকে প্রাথমিক ভাবে বসতি স্থাপনের উপযোগী জায়গা হিসাবে চিহ্নিত করলেন। যদিও জায়গা দুটো চ্যাথামের থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কিন্তু উত্তরের উপকূলগুলো এত ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আবৃত যে তা নিরাপদ ভাবে জাহাজ ভিড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী নয়। অতএব দূরত্বের কথাটায় গুরুত্ব না দিয়ে কিছুটা দক্ষিণেই বসতি স্থাপন করা শ্রেয় বলে উল্লেখ করলেন তাঁরা।

কমিটির রিপোর্ট পছন্দ হল গভর্নরের। শুরু হল দায়িত্বভার অর্পণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্রিটিশ অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র এবং সুপারিনটেনডেন্টের খোঁজ। দ্বীপান্তর যে তাদেরও ঘটবে একথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন কঠিনতর কাজের ভার অর্পণের জন্য তাই চাই খুব যোগ্য দুটো হাত।


চোদ্দ

বিকেলের শেষ আলো এসে পড়েছিল ডাক্তারের সবুজ রেক্সিনে মোড়া চওড়া টেবিলের ওপরে। সেখানে ঝুঁকে পড়ে ডাক্তার চিঠি লিখছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে।

ডিয়ার, তুমি জানতে চেয়েছ এখানকার জেলগুলির পরিবেশ কী? হা হা, তুমি তো স্বর্গের বাসিন্দা, মর্তের পরী। একবার নিজে এসো না ভারতে। এও একটা দেশ। এসে দেখে যাও এখানে মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে। তুমি এখানকার কারাগারের অবস্থা জানতে চেয়েছ? তার আগে এসে দেখো সৈন্যদের অবস্থা, সেনা ছাউনির অবস্থা, এমনকি সাধারণ মানুষের অবস্থাও।

যুদ্ধ মানেই নরক, তুমি সেবার আলো জ্বালিয়ে তাকে স্বর্গ করে তুলবে কী ভাবে? আর এই যুদ্ধ তো কোনোদিন থামবে না। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের, এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের। মানুষের মনে যতদিন ক্ষমতা উপভোগের ইচ্ছা থাকবে ততদিন সে অন্যের উপর দখল নেবার চেষ্টা করবে। ফলে রক্ত, ফলে মৃত্যু, ফলে অর্থনাশ।

জানো তো এখানে হিন্দু মন্দিরে ক্যান্ডেলের মতো যে মাটির ল্যাম্প জ্বালায়, পুজো শেষে প্রিস্ট সেই ল্যাম্পের শিখার ওপর হাত দিয়ে তাপ নিয়ে সব ভক্তের বুকে ছুঁইয়ে দেন। তুমি এসো তোমার বাতির হিরণ্ময় শিখার ওই তাপ আমার বুকে একটু ছুঁইয়ে দিয়ে যাও। নইলে আমি ধীরে ধীরে মনুষ্যেতর জীবে পরিণত হচ্ছি। তোমাকে যখন চিঠি লিখি সে আমি অন্য আমি, কিন্তু ওই নরকের দরজায় গিয়ে যখন দাঁড়াই তখন যেন আমার মধ্যে একটা দানব এসে ঢুকে পড়ে। আমি ক্ষেপে উঠি। ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধে মেতে পড়ি। শুশ্রূষা কি শুধু আর্তেরই হয়। আর তাও যদি বলো, তুমি তো জানো উন্মত্ত মানুষও এক প্রকার আর্তই। তারাও মনের দিক থেকে অসম্ভব অসহায়। জীবনে হাত ধরে থাকার মতো লোক তারা পায়নি বলেই ঝোড়ো হাওয়ায় তাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।

তুমি এসো, তুমি এসো, তুমি এসো। তোমার আতিথ্যের জন্য আমি আর আমার স্ত্রী চার হাত বাড়িয়ে রেখেছি এখানে। সারা ভারতের সমস্ত আর্ত মানুষও হয়তো হাত বাড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে তোমার শীতল করতল স্পর্শ পাবার।

শুভেচ্ছান্তে জেমস।

কলম বন্ধ করে টেবিলের ওপর কনুইয়ে ভর রেখে দুহাতের পাতায় থুতনি ঠেকিয়ে জানালা দিয়ে সোজা বাইরে তাকিয়ে রইলেন জেমস। অগ্নি, লাইট। আনমনে বুকের ওপর একটা ক্রস আঁকলেন তিনি। মনে পড়ে গেল কলেজ জীবনের কথা। হিপোক্রেটিক ওথের কথা। মানুষ কি সত্যিই পারে শপথ অনুযায়ী চলতে? তিনি পেরেছেন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প। কারণ তিনি মানুষ না, তিনি দেবী। মা মেরি তাঁর শরীরে প্রবেশ করেছেন নতুন করে। না হলে সে পারে কী করে?

কই, জেমস তো পারে না। তার ভিতরের পোকাটাকে কিছুতেই তো সে মারতে পারে না। এত দয়া কোথা থেকে সংগ্রহ করেন ওই মহিলা। তার তো সেনা ছাউনির পার্শ্ববর্তী অস্থায়ী নোংরা হাসপাতালগুলোতে চক্কর কাটতে কাটতে উগরে আসতে চায় বমি, ঘায়ের ওপর ভিনভিন করা মাছির দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করে না। শুধুমাত্র দম বন্ধ করে চাকরি আর অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত তাকে কাজ করে যেতে হয়। ফলে সে হয়ে ওঠে রুক্ষ, তিরিক্ষি আর বদমেজাজি। অস্ত্রোপচারের ছুরি, কাঁচিগুলো নেটিভদের শরীরে স্পর্শ করলেই অস্ত্রের মতো শানিয়ে উঠতে চায়। ইচ্ছে করে আরও একটু খুঁচিয়ে ঘা করে দিতে ওই কালো চামড়ায়। এই নিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভিন্ন আধিকারিক ও প্রশাসনের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে একাধিকবার বচসা হয়েছে সেনাবাহিনীর সার্জেন ডাক্তার জেমস প্যাট্টিসন ওয়াকারের। কোম্পানির সেনা স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো তাগিদ নেই অথচ ওই সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ফরমান জারি হচ্ছে এই করো আর সেই করো। কোম্পানি নেটিভ সেপাহি নিয়োগ করে সেনাবাহিনী তৈরি করেছে ইংল্যান্ডের নিজস্ব সেনাবাহিনীর দ্বিগুণ। আর বাহা, কী বুদ্ধি এদের, দেশের লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে বলছে নিজের লোকদের সঙ্গে লড়ো। ফলে যা হবার তাই হয়েছে।

ওই যে নেটিভ প্রজারা কী যেন একটা কথা বলে না, জুতো মেরে গরু দান, নাকি গরু মেরে জুতো দান এ যেন অনেকটা সেরকম। এখন হঠাৎ তাদের কয়েদিদের, সেপাহিদের শরীর-স্বাস্থ্য ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির চিন্তা মাথায় ঢুকেছে, হাইজিন, স্যানিটেশন, ওহ সব গাল ভরা শব্দ প্রয়োগ করে কমিটি গঠন হচ্ছে। এখানকার অফিসাররা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে গুছিয়ে গুছিয়ে নিজেদের তৈরি করা রিপোর্ট পাঠাচ্ছে ইংল্যান্ডে আর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মুহুর্মুহু কৈফিয়ত তলব। আরে বাবা, কটা ইউরোপিয়ান আর বেঁচে আছে? নেটিভ সেপাহিরা তো মেরে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছে। গোরা সিপাহিদের সংখ্যা তো নগণ্য, হাতে গোনা যায়। কীভাবে হত্যা করে ওরা সিভিলিয়ানদের। জল তলানিতে এসে ঠেকেছে। এদেশে ব্রিটিশদের নিরাপত্তা কোথায়? যেভাবে জেল ভেঙে ওরা দাগী আসামীদের মুক্ত করে দিচ্ছে, যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র, তাতে খুব শিগগিরি পাততাড়ি গুটোতে হল বলে কোম্পানিকে। যেদিন ওরা জন হুইলারকে গুলি করে মেরে দিল সেদিনও টনক নড়ল না ব্রিটিশ প্রশাসনের। হুইলার তো ছিলেন সাধারণ নাগরিক। তিনি কাঠের ব্যবসা করতে এদেশে এসেছিলেন। বার্মা আর নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া জুড়ে ছিল তাঁর ব্যবসা। ডক্টর ওয়াকারের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্য। হুইলার একবার বার্মা থেকে ফেরার সময় কঠিন জ্বর বাধিয়ে এসেছিলেন। তখন চিকিৎসায় তাঁকে সুস্থ করে তুলেছিলেন ওয়াকার। বন্ধুত্বের সূচনা সেই থেকেই। প্রশাসনের নির্লিপ্তি অসহিষ্ণু করে তুলেছিল ওয়াকারকে। জে পি গ্রান্টের সঙ্গে একবার বিস্তর তর্ক হয়েছিল তাঁর। ডঃ ওয়াকার চিৎকার করে বলেছিলেন, শুশ্রূষা দেওয়া তো দূর অস্ত এখুনি কয়েদিদের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত, নাহলে মুষ্টিমেয় যে কজন ইউরোপীয় এখনও ইন্ডিয়া তে বসবাস করছেন তারা কেউই আর বেঁচে থাকতে পারবেন না। কাদের শুশ্রূষা দিতে চাইছেন কোম্পানি? যারা নিজের ভালোই বোঝে না? যে দেশে এখনও দাস কেনাবেচা চলে? যেদেশে মেয়েদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলেও লোকে তার প্রতিবাদ করে না বরং ঢাক, ঢোল নানারকম বাদ্যযন্ত্র পিটিয়ে তাকে উৎসবে পরিণত করে? কে শিক্ষা দেবে ওদের? যারা ওই আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরে ফেলার প্রতিবাদ করতে গেছেন তাঁরাই দেশীয় জনগণের টার্গেট হয়ে গিয়েছেন। যে দেশে সম্পূর্ণ অধার্মিক কাজকর্ম হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে?

জে পি গ্রান্ট মুগ্ধ হয়েছিলেন তর্কপ্রিয় তরুণ ডাক্তারকে দেখে। ভর্ৎসনার বদলে পিঠ চাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ঘর থেকে। ওয়াকার তখন ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি কী সমন নির্দেশ হয়ে আসবে তারই টেবিলে।

ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আবারডিন মেডিসিন স্কুল থেকে মেডিক্যালের ডিগ্রি করে ইন্ডিয়ান আর্মির ডাক্তার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন ওয়াকার রোগী পরিষেবার ব্রত নিয়ে। কিন্তু নরক গুলজার করতে করতে সেই সেবার ব্রত কোথায় যেন স্তিমিত হয়ে গেল। থরে থরে ইউরোপীয় সিপাহির মৃতদেহ থেকে গুলি বার করতে করতে তাঁকে গ্রাস করল ভয়। আত্মবিনাশের ভয়। আর এই ভয় ধীরে ধীরে তাঁকে ভয়ঙ্কর করে তুলল, ডাক্তারি ছেড়ে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সুযোগও করে দিলেন মিস্টার জে পি গ্রান্টই। যদিও ওয়াকার প্রথমটায় ভেবেছিলেন এ বোধ হয় সেদিনের তর্কের ফল, তাই খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া হাঁকিয়ে তিনি ছুটেছিলেন মিস্টার গ্রান্টের অফিসে। মনে মনে তৈরিও হয়ে গিয়েছিলেন গ্রান্টের সঙ্গে এক হাত বোঝপড়ার। কিন্তু গ্রান্ট কথায়, যুক্তিতে দামি দার্জিলিং চায়ে বশীভূত করে ফেললেন ওয়াকারকে, ওয়াকার রাগের বদলে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। রাজা হবার স্বপ্ন।

কথোপকথনটা শুরু হয়েছিল এই ভাবে। মিস্টার গ্রান্ট বললেন, আসুন আসুন, আমাদের তরুণ সেনাপতি কর্নেল ডাক্তার জেমস্‌ ওয়াকার। সিট ডাউন প্লিজ। আজ আপনার জন্য একটা দারুণ সুখবর আছে, ঠিক যে জন্য আপনাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি।

ডঃ ওয়াকার তেরিয়া হয়ে বললেন, বুঝেছি, সাস্‌পেন্ড করবেন তো? বলবেন তো, আমি নেটিভদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করি। ডাক্তারের কাছে সমস্ত রোগীই সমান হওয়া উচিত।

মৃদু মৃদু হাসছিলেন জে পি গ্রান্ট, বললেন আপনার এই অ্যাংরি ইমেজটাই আমাকে মুগ্ধ করে। আর ঠিক এই জন্যই আমার আপনার কথা মনে এসেছে।

ওয়াকার বললেন, ঠিক কী কথা মহামান্য এবার আমাকে বলবেন তা আমি সরাসরি জানতে পারি কী? আমি দুঃখিত, আমার খুব অল্পেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।

সোনালি রঙের দার্জিলিং চায়ের দিকে হাত দেখিয়ে জে পি গ্রান্ট বললেন, প্লিজ, কথা শুরুর আগে আপনি চা গ্রহণ করুন। অ্যাণ্ড সিট উইথ রিল্যাক্স। আরাম করে বসুন।

ওয়াকার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন এই মুহূর্তে আফিংয়ের পরেই চা রপ্তানিতে কোম্পানি সবচেয়ে বেশি লাভ করছে বোধ করি। এই রকম অসামান্য সুবাস, এই ফ্লেভারটা কিছুতেই অন্য কোনো ক্লাইমেটে আসবে না। একই উষ্ণতা, একই জলবায়ু, সব একই রকম রাখা তো সম্ভব না।

গ্রান্ট বললেন, সেই। তবে এখনও পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাতে বৈদেশিক বাণিজ্য খুব মার খাচ্ছে। একটা জাহাজ লুট হওয়া মানে কোম্পানির একটা বড়সড় ধাক্কা।

কিছু না বলে ঘাড় নাড়লেন ওয়াকার, ঠিক। জে পি গ্রান্ট যেন রাস্তা পেয়ে গেলেন। কথার গতি এগিয়ে নিয়ে যাবার বললেন, সেই জন্যই একটি বিশেষ ব্যবস্থার কথা চিন্তা ভাবনা করছেন কোম্পানি অফিসাররা। এখন দেখা যাক সেটা কতখানি ফলপ্রসূ হয়। তবে সেটা সম্পূর্ণই নির্ভর করছে আপনার ওপরে।

—আমার ওপরে? চমকে উঠলেন ওয়াকার। বললেন ডাক্তারের কাজ রোগীর শুশ্রূষা করা, নৌকা সামলানো তো নয়। বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক থাকতে পারে আমি তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মহামান্য বোধ হয় ভুল লোককে ডেকে ফেলেছেন এই বিষয়ে আলোচনার জন্য।

গ্রান্ট বললেন, উঁহু। ভুল নয়, একেবারে সঠিক লোক। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। আমি ঠিক জানি কোন মানুষকে দিয়ে কোন কাজ হবে। আশা করি চা পানে তৃপ্ত হয়েছেন। আপনি এবার মূল কথায় আসা যাক।

জেমস্‌ বললেন, হুম্‌, আমি তো সেই প্রতীক্ষাই করছি।

গ্রান্টের প্রস্তাব শুনে লাফিয়ে উঠলেন ওয়াকার, ইম্‌পসিবল।

গ্রান্ট খুব শান্ত ভাবে বললেন, আর্মিতে তো ডিসওবে করা যায় না অর্ডার, তাছাড়া এটা তো আপনার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি কর্নেল। আপনি সমগ্র একটা দ্বীপের রাজা, ভাবুন তো একবার! ক্ষমতা ভালোবাসেন না আপনি? কত ক্ষমতা চান? উপভোগ করুন। সুপ্রিম অথরিটিই আপনি। কেউ আপনার কাজের ওপর ছড়ি ঘোরাতে আসবে না।

দাঁতে দাঁত ঘষলেন ওয়াকার, বুঝলেন গ্রান্টের সঙ্গে সেদিনের তর্কের ফল এই পানিশমেন্ট ট্রান্সফার, এখন বেটা রাজা বানানোর গল্প শোনাচ্ছে। তাচ্ছিল্য ভরে হেসে বললেন, মেরে ফেলার ইচ্ছা থাকলে সরাসরি ডেকে শ্যুট করলেই পারতেন স্বয়ং গভর্নর ক্যানিং। এই কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার কী দরকার ছিল? আপনি তো আমায় রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন, এক বছরের রাজা। গ্রান্ট বললেন, কিন্তু সেই রূপকথাটাই যদি সত্যি করে ফেলতে পারেন ইতিহাসের পাতায় আপনার নাম উঠে যাবে। কোম্পানি আপনার বিলাসব্যসনের কোনো খামতি রাখবে না কর্নেল। আপনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্তর পিছনে দুটো বড় কারণ আছে কর্নেল। আপনার মতো তরুণ বলিষ্ঠ প্রশাসক যেমন সমস্ত পরিকল্পনাটি গুছিয়ে তুলতে পারবে তেমনি স্থানীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত কোনো চিন্তাও আর থাকবে না।

খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে গোঁজ হয়ে বসে থেকে ওয়াকার বললেন, ইয়েস স্যার। আপনি প্রস্তুতি শুরু করুন। আশা করি আপনাদের প্রদেয় কাজটা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে পারব।

—গুড! উঠে দাঁড়ালেন মি গ্রান্ট, করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন ওয়াকারের দিকে। ওয়াকার শিথিল হাতটা গ্রান্টের হাতে স্পর্শ করে ঘুরে দাঁড়ালেন, বললেন, চলি স্যার। যাত্রা শুরুর দিন বন্দরে অপনাকে দেখতে পেলে খুশি হব।

মাথা ঝাঁকালেন গ্রান্ট, সিওর।

গ্রান্টের অফিস থেকে বেরিয়ে ওয়াকার সরাসরি গেলেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। যাবার আগে কিছু কাগজপত্র তিনি গুছিয়ে নিতে চান দ্রুত। দেখাও করে নিতে চান তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে, যাতে এখানে তাঁর জালটা তিনি ছড়িয়ে রেখে যেতে পারেন। প্রয়োজন হলে যাঁরা তাঁকে মূল ভূখণ্ডের খবরাখবর জানাবেন। দোতলার বারান্দা ধরে গটগট করে হাঁটছিলেন ওয়াকার, ভাবছিলেন, গ্রান্ট তাকে রাজা বানাতে চায়! বেশ তিনি রাজাই হবেন। হয়ে উঠবেন রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা। হু নোজ হি আন্ডারস্ট্যান্ডস ক্যালিগুলা! বলে বুটসুদ্ধ পা তুলে বারান্দার ওপরেই একবার নেচে নিতে ইচ্ছে করল ওয়াকারের।

লর্ড ক্যানিংয়ের তত্ত্বাবধানে মিস্টার জে পি গ্রান্টের তৎপরতায় সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। মানচিত্রের নির্দিষ্ট স্থানের ওপর পড়ে গেল গোল চিহ্ন। অভাবনীয় এই সিদ্ধান্তে উৎফুল্ল লর্ড ক্যানিং যাত্রার পূর্ব সন্ধ্যায় নিজ বাসভবনে আয়োজন করলেন পান ভোজনের। পিয়ানোর তরঙ্গে নৃত্যে মশগুল হলেন সস্ত্রীক কোম্পানির তাবৎ অফিসার।

ওয়াকারও কিছুক্ষণ হাজিরা দিয়ে গেলেন ওই সভায়। মদিরাপাত্র শূন্যে উঠিয়ে বললেন, প্রসারিত হচ্ছে কোম্পানির হাত, বন্ধুগণ অতএব, উল্লাস। সমবেত অভ্যাগত হুল্লোড় করে উঠে বললেন, চিয়ার্স।


পনেরো

জেলে জেলে বার্তা গেল রটে। সমুদ্র লঙ্ঘন করতে হবে এবার তাদের, পাড়ি দিতে হবে কালাপানি। নাড়ির টান ছিঁড়তে হবে এবার তাদের। জাত ধর্ম সংস্কৃতি সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে বৃন্তচ্যুত ফলের মতো দেশ মাটি ভূমি ছেড়ে। সেখানে ঘন জঙ্গল, বুনো জন্তু আর চারিদিকে ভয়াল সমুদ্র। পালাবার পথ নেই কোনো, পথ নেই যোগাযোগেরও। খুব শিগগিরি কয়েদিদের শুরু হবে দ্বীপচালান। কারাগারগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বিদ্রোহী সিপাহিদের ব্রিটিশ সরকার পাঠাতে চাইছে বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের ঘন জঙ্গলে। এতে স্থান সংকুলানের সমস্যাও মিটবে আবার মূল ভূখণ্ডে ইংরেজ জনসাধারণ অধিক নিরাপদও বোধ করবেন। পুনরায় বিদ্রোহ ছড়ানোর আশঙ্কাও কমবে।

সিপাহিদের মধ্যে শুরু হল গুঞ্জন, কয়েদিদের ইজ্জত ধর্মের আছেটা আর কী। তারা তো না জেনে গরু আর শুয়োরের চর্বির তৈরি এনফিল্ড বন্দুকের টোটা দাঁতে কেটেছে, ম্লেচ্ছদের স্পর্শ করেছে। তাছাড়া কারাগারগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট খুপরির মধ্যে ঠেসে ঠেসে যেভাবে কয়েদিদের ভরা হচ্ছে তাতে দম বন্ধ হয়েই কত জন মারা যাচ্ছে। খোলা মলমূত্র, মাছি থেকে কলেরা ছড়াচ্ছে, নরক দর্শন তো তাদের হয়েই গিয়েছে, তাতেও ব্রিটিশ কোম্পানির মন ভরল না, এখন দ্বীপান্তরে পাঠাতে চাইছে।

অনেকেই বিশ্বাস করলেন না কথাটা। অনেকে ভাবলেন এই অজুহাতে একবার যদি জেলের বাইরে যাওয়া যায় তবে পালানোর একটা সুযোগ পাওয়া যাবে। কোনো না কোনো একটা উপায় হবে নিশ্চয়ই। ইংল্যান্ড থেকে জনকল্যাণ দপ্তরের কিছু লোক এসে একদিন কয়েদিদের বুঝিয়ে গেলেন কোম্পানি একটা নতুন দেশ গড়তে চাইছে, তাতে কয়েদিদের সহায়তা দরকার, তাদের ব্যবহারে যদি সন্তুষ্ট হতে পারে কোম্পানি তবে খুব শিগগিরি তাদের মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনা হবে এবং সাজাও মকুব করা হবে।

কিন্তু সাজা মকুবের প্রতিশ্রুতিও কয়েদিদের উৎসাহিত করতে পারল না কালাপানি পেরনোয়। কোম্পানির অফিসারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ঠিক হল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের চোখে কালো কাপড়ের ফেট্টি বেঁধে না জানিয়ে তোলা হবে জাহাজে। নির্দিষ্ট দিনে জাহাজ প্রস্তুত হল বন্দরের ঘাটে। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা চিকিৎসাবিদ্যার প্রতিষ্ঠান আবেরডিন মেডিসিন স্কুল থেকে পাশ করে বেরনো একজন প্রতিশ্রুতিমান ডাক্তার সার্জেন ডক্টর জেমস প্যাট্টিসন ওয়াকার হাতে চেন ঘোরাতে ঘোরাতে অ্যানিম্যাল ট্রেনারের মতো কিছু ইউরোপিয়ান অফিসার সহ কয়েদিদের সঙ্গে উঠে পড়লেন জাহাজে। মনে মনে ভাবলেন, দ্বীপান্তর ঘটল তারও। মৃত্যু অনিবার্য। তবু প্রাণপণ সে ভয় কাটাতে ডেকের শেষ প্রান্তে অভিযাত্রীর মতো পাটাতনের ওপর পা তুলে দাঁড়ালেন তিনি। চোখে দূরবিন লাগিয়ে দেখবার চেষ্টা করলেন ত্রিসীমানায় নীল জল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় কিনা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামনে কিছুই দেখতে পেলেন না, এমনকি পিছন থেকেও ধীরে ধীরে মুছে গেল স্থলভাগের প্রান্তটুকু, তিনি এক অবিমিশ্র অবসাদে ফিরে এসে শুয়ে পড়লেন নিজের কেবিনে। হাতে পায়ে শিকল-বাঁধা কয়েদিরা বসে বসে ঝিমোচ্ছিল জন্তুর মতো। তরঙ্গবিক্ষুদ্ধ সমুদ্র শান্ত হয়ে আসছিল। জাহাজের স্তিমিত দুলুনিতে টের পাওয়া যাচ্ছিল জলের গভীরতা বাড়ছে।

জলে জন্ম ডাঙায় বাস, জলে দিলেই সর্বনাশ। জন্মের পরে ভূমিষ্ঠ হবার আগে পর্যন্ত, দশমাস দশ দিন মাতৃগর্ভের জলের থলিই যে মানবশিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় সেই মানুষই ঢেউয়ের অস্থির ঝাপটে নোনা বাতাসে অস্থির হয়ে উঠছিল। একজন এর মধ্যে বমি করতেও শুরু করে দিল। কিন্তু বহুদূর সমুদ্রপথ অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা ওয়াকারের আছে। তাই শারীরিক ভাবে জাহাজের দুলুনি তাঁকে কাবু করতে পারছিল না, তবে একটা অপমান তাঁকে যেন ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তার ইচ্ছে করছিল জাহাজটাকে উল্টে কয়েদিগুলোকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে লন্ডভন্ড কিছু একটা করে ফেলতে। অথচ তার সঙ্গে যে আরও দুজন ডাক্তার ও চারজন ইউরোপীয় অফিসার এসেছেন তাঁরা কত সুন্দর ভাবে ডেকের ওপরে তাসের আসর বসিয়েছেন। একজন সুন্দরী নর্তকীর অভাব বোধ করে হা হুতাশ করছেন আর সুরাপাত্র উপুড় করে দিচ্ছেন গলায়। তাদেরও নিশ্চয়ই অস্থির লাগছে, অসহায় লাগছে, তবু তো তাঁরা অসহিষ্ণু হচ্ছেন না। তবে কেনই বা তাঁর ক্ষোভের উপশম হচ্ছে না, কেন বিতৃষ্ণা উগরে দিতে ইচ্ছে করছে সার্ভে কমিটির ওপর। মরবার আর জায়গা পেল না এরা। হেল মানে রিয়েল হেল! ওহো, হেল বলা যাবে না। হিন্দু ধর্মমতে বলতে হবে জলতলে স্বয়ং নারায়ণ যোগনিদ্রায় মগ্ন। বাষ্পের ধাক্কায় যদি একবার বাসুকি নাগের ঘুম ভাঙে তবে দুলে উঠবে পৃথিবী, ফুলে উঠবে সমুদ্র, এই ছোট্ট নৌকাটাই ওলটপালট খেয়ে তলিয়ে যাবে কোথায় তার খোঁজও পাওয়া যাবে না। গুলি খেয়ে মরার থেকে সলিলসমাধি শ্রেয়। আগুনে পুড়লে বিদেহী আত্মা বড় কষ্টে থাকে, তার থেকে জল অনেক আরামের।

তবে, সার্ভে টিমের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই ওয়াকারের। সার্ভে টিমে যদি তাঁকে রাখা হত তবে সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের একটা সুযোগ পেতেন তিনি। বাঃ, জায়গাটায় থাকবেন তিনি, আর সার্ভে টিম গঠন করার সময় জড়ো করা হল যত বিদ্যেদিগ্‌গজদের।

সঙ্গী ডাক্তাররা ওয়াকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন, যাঁরা থাকবেন তাঁদের পরিদর্শক দলে নেওয়া অবশ্যই উচিত ছিল। ওয়াকার সঙ্গী ডাক্তারের পিঠে হাত চাপড়ে বললেন, আরে বোঝো না, আমরা হলাম গিয়ে ওই ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো।

হা হা করে হেসে সঙ্গী ডাক্তার বললেন, তুমি তো বেশ ভালো বাংলা শিখেছ ডাক্তার, কুলো মানে কী?

ওয়াকার বললেন, অ্যান ইনডিজেনাস ইকুইপমেন্ট ফর ডাস্টিং পালসেস।

সঙ্গী ডাক্তার বললেন ওয়াও, কুলো, ডাস্টিং ফর ধুলো।

—রিডিকুলাস! বলে মজাদার ভাবে একটা ধমক দিলেন ওয়াকার তাঁর সঙ্গী ডাক্তারটিকে। বললেন, আর ইউ ক্রেজি? এই পরিবেশেও তোমার হাসি আসছে? ডাক্তারটি বললেন, এই ব্যাপারটা আমি নেটিভদের কাছ থেকে শিখেছি। দে ওয়্যার অলওয়েজ সিঙ্গিং আ সং। ইভন হোয়েন দে প্যারেড টু হ্যাঙ।

হাসলেন ওয়াকার, প্রেম, স্বদেশ প্রেম। দু’সপ্তাহের মধ্যে ওসব ভুলিয়ে ছাড়ব আমি। তবে কমিটির শর্তগুলো দেখলে আমার গা জ্বালা করছে। আমাকে মিঃ গ্রান্ট বলেছিলেন এখানে আমার কাজের ওপর কেউ খবরদারি করবে না। এর পরেও যদি কেউ কিছু বলতে আসে, আমি পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশে ফিরে যাব। অনেক হয়েছে, আর না। একটা বাঘের খাঁচায় আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এখন বাঘগুলোকে আমি যদি ঠিকমতো দমন করতে না পারি ওই বাঘগুলোই আমার মাংস ছিঁড়ে খাবে। অতএব টিট ফর ট্যাট।

সঙ্গী ডাক্তারটা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েছিল, কিন্তু আমরা ডাক্তার, সহানুভূতিই আমাদের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত। ক্রূর চোখে ওয়াকার একবার মাপলেন ছেলেটিকে, তারপর বললেন, নিশ্চয়ই। সেবাই ধর্ম, কিন্তু আমি এখানে পরিষেবা দিতে এসেছি। নাও আই অ্যাম দ্য কিং অব ডেভিলস আইল্যান্ড। সো ইউ অলসো ওবে মাই অর্ডার। আন্ডারস্ট্যান্ড? বলে অনেকটা যাত্রার ঢঙে হা হা করে হাসলেন ওয়াকার।

সন্ধ্যে নামছিল। নীল জল ক্রমশ কালো হয়ে উঠছিল। এক বৃহৎ ঢেউ এসে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ল জাহাজের গায়ে। প্রকৃতির গর্জনে যেন টাল খেয়ে গেল যন্ত্রদানব। শঙ্কিত হয়ে ওয়াকার বললেন, হোয়াট হ্যাপেন্ড? ভূমিকম্প নয় তো? ইট ইজ অ্যান আর্থকোয়েক প্রোন এরিয়া। সমুদ্রের নীচে ঘটা ভূমিকম্প কিন্তু সাংঘাতিক। বলতে বলতে ওয়াকার দৌড়লেন ক্যাপ্টেনের কেবিনের দিকে। পাশ থেকে শিকলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে বসে ঝিমোতে ঝিমোতে এক কয়েদি উত্তর দিলে, ভগবান বিষ্ণুর ঘুম ভাঙছে সাহেব। সাগর ভগবানের বিশ্রাম আবাস। আপনি তার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন।

নাঃ, তেমন বিশেষ কিছু ঘটল না। কোম্পানির নৌবাহিনীর পথপ্রদর্শক বাষ্পচালিত ছোট্ট জাহাজ সেমিরামিস। ১৮৫৭ সালের ১০ মার্চ এসে ভিড়ল ভিগলিপুরের কর্নওয়ালিস বন্দরে। ব্লেয়ার সাহেবের নামে কোম্পানির পরিদর্শকমণ্ডলী যে বন্দরের নামকরণ করার প্রস্তাব করেছেন পোর্ট ব্লেয়ার।

দুশো জন কয়েদি গুটিকয় ইউরোপীয় সহ কর্নেল ডাক্তার জেমস প্যাট্টিসন ওয়াকার, প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট অব পেনাল সেটেলমেন্ট, পা রাখলেন আন্দামানের মাটিতে। অন্য দিকে লাহোর থেকে আর-একটি কয়েদি বোঝাই জাহাজ এসে থামল পোর্ট ব্লেয়ারে।


ষোলো

লু বইছে তখন উত্তর ভারত জুড়ে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু তখন কলকাতাতেই এসে পৌঁছয়নি, দিল্লি তো অনেক দূর। শুধু উত্তর ভারত কেন সমগ্র ভারতই তখন যেন উত্তপ্ত। সৌররশ্মি কিরণ দিচ্ছে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপরে। সে আগুন সয়ে গেছে ভারতবাসীর। তারা সহনশীল। কিন্তু কাহিল হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ ফৌজ। তাদের বর্ণহীন ত্বকে অসহনীয় হয়ে উঠেছে সে উত্তাপ। তার ওপর দীর্ঘ পথ চলা অথবা অশ্বারোহণ। স্বাস্থ্য ভাঙছিল জেনারেল আনসানের। তাই পঞ্জাব পৌঁছানোর পর কমান্ডার ইন চিফ অব বেঙ্গল আর্মি, কয়েকজন অফিসার ও সামান্য কিছু ফৌজ নিয়ে সিমলার দিকে যাত্রা করলেন, উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য উদ্ধার।

ওই বরফগলা বিয়াস, ওই পাইনের ঝোপ, সেনা ছাউনির বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি উপভোগ করতেন ওই মনোরম পরিবেশ। চামড়ার ওপর লাল হয়ে ওঠা ফোস্কাগুলো কমে আসছিল ঠান্ডায়। দেশের কথা মনে পড়ত। মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়ে দুলকি চালে বৈকালিক ভ্রমণের সময় ভাবতেন, তাঁরা কী বোকা, বাণিজ্য করছে কোম্পানি, ফায়দা লুঠছে তাঁর দেশ, অথচ মরছেন তাঁরা। সৈন্যরা। মাঝে মাঝে নেটিভদের জন্যও মন খারাপ করত তাঁর। না না, এটা ঠিক নয়। এটা আগে কখনও হত না, সম্প্রতি শুরু হয়েছে। কত দরিদ্র একটা দেশ। কত অশিক্ষা— হুলিগানিজম ছাড়া কিছুই বোঝে না। অ্যাকচুয়ালি রেজাল্ট অব পুয়োর মনার্কি অ্যান্ড ডিসইন্টিগ্রেশন। সুশাসনের জন্য একটা ইন্টিগ্রিটি দরকার।

আম্বালার ডিস্ট্রিক্ট অফিসার টি ভি ফোরসিথ তখন নিজের কার্যালয়ে বসে পাটিয়ালার মহারাজের কাছে পাঠানোর জন্য একটা চিঠি টাইপ করছিলেন। এই সব গোপন চিঠি তিনি নিজে টাইপ করেন। ডিকটেশন দেন না। লিখলেন, মহামান্য, আম্বালার সুরক্ষা হেতু এই পত্র আপনাকে প্রেরণ। মহারাজ যদি দয়া করে একদিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন অথবা মহারাজ চাইলে ফোরসিথ নিজেও যেতে পারেন তাঁর কাছে। কোনো দূত মারফত এ খবর আদান প্রদানে তিনি আগ্রহী নন। এমনকি সংক্ষিপ্ত বার্তা প্রেরণেও নন। একটি দীর্ঘ আলোচনা আবশ্যক। হিন্দুস্থানের অবস্থা অগ্নিগর্ভ। তাকে সুশাসনের অধীনে আনবার জন্য মহারাজের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের সহায়তা কোম্পানির খুবই প্রয়োজন। আগামী দিনে বিদ্রোহ দমনের নীতি নির্ধারণ খুবই জরুরি।

এই পর্যন্ত লিখে বাঁ হাতে থুতনি চেপে ধরে ফোরসিথ ভাবছিলেন ঠিক কাকে দিয়ে প্রেরণ করা যায় এই চিঠি। খুবই বিশ্বাসযোগ্য কোনো ঘোড়সওয়ার প্রয়োজন। ঠিক সেই সময়, টক্‌, টক্‌, টক্‌, টক্‌, টক্‌টক্‌। শব্দ শুনে ঘাড় উঠিয়ে তাকালেন ফোরসিথ, সামনে রাখা টেলিগ্রাফ যন্ত্রের দিকে। বার্তা এসেছে। সচকিত হয়ে উঠে গেলেন সরু হয়ে নেমে আসা কাগজের কাছে, ঝুঁকে পড়লেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে, ডট আর লাইনে ধাঁধা লাগছে তাঁর, মাথা সামান্য ঘুরছে, যেভাবে চারদিকে ম্যালেরিয়া, কলেরা ছড়াচ্ছে, এদেশে শরীর ঠিক রাখাই দায়। ধুর, নিজের ভাবনাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন তিনি, অনেকক্ষণ ধরে টাইপ করছিলেন বলে হয়তো চোখটা ঝাপসা লাগছিল, তুলে নিলেন লম্বা কাগজটা, তারপর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। কর্মজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আজ সেই সময় আগত। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজগুলো করে যেতে হবে এক এক করে। সবার আগে পাটিয়ালার মহারাজের কাছে চিঠিটা পাঠিয়ে দেওয়া যাক। যে-সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে অযথা দেরি করার কোনো মানে হয় না। তবে পরের ধাপে এগোতে সুবিধা হয়। তিনি লম্বা কাগজের টুকরোটাকে ফাইলের নীচে চাপা দিয়ে রেখে জরুরি তলব পাঠালেন অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধানকে।

এই মুহূর্তে আম্বালায় কোনো বড় অফিসার নেই। সবাই প্রায় ছুটি কাটাতে গেছেন সিমলায়। এই অসহনীয় গরমের হাত থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি নিয়ে। ফোরসিথের বয়স অল্প। তিনি অত অল্পেতে কাবু হন না। রাতে একটু হালকা মদিরা, মারিয়েটের সঙ্গে সামান্য নাচ, তাঁকে চাঙ্গা করে দেয় পরের দিনের জন্য। তাই এই মুহূর্তে আম্বালায় তিনিই দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বময়কর্তা। অতএব তিনি কাজগুলো পর পর সাজাতে লাগলেন মাথার মধ্যে।

তিনি একই বয়ানে কতকগুলো চিঠি টাইপ করলেন। বিদ্রোহী সেপাহিরা দিল্লি পৌঁছেছে। দিল্লি দখল করে তারা পঞ্জাবের উদ্দেশে রওনা হবে। দিল্লি থেকে আম্বালার মধ্যে একটাও ইউরোপিয়ান রেজিমেন্ট স্টেশন নেই, অতএব বিদ্রোহ দমনের জন্য যা কিছু কর্মকাণ্ড আম্বালা থেকেই সংগঠিত করতে হবে। এমনকি ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের সংরক্ষণের দায়িত্বও নিতে হবে আম্বালাকেই। এই মুহূর্তে প্রত্যেক সিনিয়ার অফিসারের আম্বালায় উপস্থিত হওয়াটা একান্ত জরুরি।

তারপর একটুও সময় নষ্ট না করে দূত মারফত সেই চিঠির একটা পাঠালেন লাহোরে পঞ্জাব অথরিটির কাছে। আর একটা পাঠালেন সিমলায় অ্যানসানের কাছে। বয়ান সামান্য অদলবদল করে তিনি আর একটা চিঠি পাঠালেন জি সি বারেন, কমিশনার অব আম্বালার কাছে, তাছাড়া আম্বালার অন্য দুটো মিলিটারি ডিভিশনের কাছে। এছাড়া তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ইউরোপিয়ান সিপাহি দিয়ে আম্বালার সিপাহি স্টেশন ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করলেন। যাতে আম্বালার সিপাহি ছাউনিতে কোনো অশান্তি না ছড়ায়। সিপাহিদের মনোরঞ্জনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করলেন তিনি যাতে বিদ্রোহের আঁচ এসে লাগতে না পারে তাঁর সেনা ছাউনিতে।

রাতের অন্ধকারে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলেন ফোরসিথ। মহারাজা নরেন্দ্র সিং তখন অপেক্ষা করছিলেন জেসোমিনিতে তাঁর অস্থায়ী গোপন ডেরায়। ঘোড়ার খুরের শব্দে বাইরে এসে দাঁড়ালেন পাটিয়ালার মহারাজ। বুকে হাত দিয়ে বাও করে মহারাজাকে অভিবাদন জানালেন ফোরসিথ। মহারাজাও এগিয়ে দিলেন হাত। উষ্ণ আহ্বানে স্বাগত জানালেন ফোরসিথকে। পানীয়ের সুবন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন মহারাজ। লাল মদিরায় চুমুক দিয়ে আলোচনা শুরু হল।

চমৎকার লাগে এই মানুষটিকে ফোরসিথের। মুক্তমনা। রুচিশীল এবং রসিক। ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসলেন ফোরসিথ, এই বয়সেই সাত-সাত জন রানি, বাচ্চা। করমর্দনের সময়ই তিনি টের পেয়েছেন মহারাজের কমনীয়তা, না না, রমণীয়তা। ইংল্যান্ড দেখার খুব শখ মহারাজের। ফোরসিথ কথা দিয়েছেন মহারাজকে, বিদ্রোহ সামলে ওঠার পরই তিনি মহারাজের ইংল্যান্ড ভ্রমণের ব্যবস্থা করবেন।

বন্দোবস্ত সব পাকা হয়ে গেল। জেসোমিনি একেবারে আম্বালার সীমান্তে একটা ছোট্ট গ্রাম। এখানে কিছু সেনা মোতায়েন করে রাখবেন মহারাজা। যাতে প্রয়োজন হলেই তারা কোম্পানির সাহায্যে লাগতে পারে। এছাড়া কিছু খচ্চর, হাতি আর উট তিনি কালকা পর্যন্ত পাঠাচ্ছেন যাতে যে সব ব্রিটিশ অফিসার দলবল নিয়ে ছুটি কাটাতে পাহাড়ে গিয়েছেন তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমতলে নেমে আসতে পারেন।

ফোরসিথ বললেন, মহারাজ আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই।

মহারাজ বললেন, নো নো, নো নিড টু মেনশন। বাট আফটার সাপ্রেসিং দ্য রিভোল্ট আমাকে ভুলে যাবেন না যেন।

ফোরসিথ বললেন, না, না, নো মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, আই উইল টেল টু মাই হায়ার অথরিটি আবাউট ইয়োর কোঅপারেশন। এভরি কোম্পানি অফিসার ইজ প্লিজড্‌ উইদ ইয়োর কর্ডিয়াল অ্যাসিস্টেন্স।

মহারাজা নরেন্দ্র বললেন, আমার বন্দুক সহ তেরো হাজার সৈন্য জেসোমিলি থেকে মার্চ করবে থানেশ্বর পর্যন্ত, এছাড়া কারনাল থেকে ফিলোর পর্যন্ত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পাহারা দেবার ব্যবস্থাও করব আমি।

মিস্টার ফোরসিথ খুব জোরে মহারাজের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আজ তবে উঠি মহারাজ। রাত্রি আপনার শুভ হোক।

মহারাজ বললেন, হুম্‌, শুভরাত্রি। চিন্তা করবেন না, পথে আমার সৈন্য আপনাকে এগিয়ে দেবে আপনার ছাউনি পর্যন্ত। আপনি আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। আপনাকে সুরক্ষিত অবস্থায় আপনার আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার।

ফোরসিথ বললেন, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না।

মহারাজ বললেন, প্রয়োজনের প্রশ্ন নয় অফিসার, আতিথেয়তা আমার ধর্মে একটি আবশ্যিক কর্তব্য।

অন্ধকারে ঘোড়া হাঁকালেন ফোরসিথ, দু’পাশে বর্শা হাতে ঘোড়া ছোটালেন মহারাজের দুজন রক্ষী।


ক্লিক করুন পরের পাতায়
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *