নিলুফা আক্তার
মা নাকি জন্মের আগেই মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিল ‘কৃষিকা’। স্কুলে যাবার আগ-পর্যন্ত নাম নিয়ে কোন উৎপাত হয়নি। স্কুলে যাবার পর থেকেই শুরু হলো উত্যক্তকরণ। সহপাঠীরা তাকে ‘কৃষকের বউ কৃষিকা’ বলে ক্ষ্যাপানো শুরু করে। এ নিয়ে কতদিন ‘কৃষিকা’ কান্নাভেজা চোখ, বিমর্ষ মুখ নিয়ে বাসায় ফিরেছে। উদ্বিগ্ন মা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেই, ব্যাগ, ফ্ল্যাক্স ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে বলতো, “মা আমার নাম পাল্টাও। ওরা সবাই আমাকে ‘কৃষকের বউ কৃষিকা’ বলে ক্ষ্যাপায়।” মা দুষ্টামি চোখের হাস্যেজ্জল মুখ নিয়ে বলতো, “দারুণ তো! এর চেয়ে খুশির আর কী আছে মা?” তারপর হাসি লুকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতো, “কৃষকের বউ হওয়া কী চাট্টিখানি কথা, এ্যাঁ!” পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক মুখ করে কান্নারত মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, “ওরা ফসল না ফলালে, আমরা যে না খেয়ে মরতাম মা।” ছোট্ট কৃষিকা কখনও কী বুঝে মৃদু হাসি মুখে চুপ করে থাকতো, কখনো ব্যাগ, ফ্ল্যাক্স ধপ করে ফ্লোরে ফেলে ধুপধাপ পায়ে ভেতরে চলে যেতো। মেয়ের বেণী বাঁধানো বাড়ন্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে মায়ের ভেতরটা অদ্ভুত মায়ায় আর্দ্র হয়ে ওঠে, আহা, মেয়েটাও ঐ পুঁই লতার মতই কেমন তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে। মনে মনে বলে, দেখতে দেখতেই মেট্রিক দিয়ে দিবে, তারপর ইন্টারমিডিয়েট এরপর তো মেয়েকে ছাড়তেই হবে। বয়সের মত মানুষকেও তো বেঁধে রাখা যায় না। নামের এই যন্ত্রণা মেয়েকে অনেক বছরই বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। ওর বিষণ্ণ মুখ দেখলে মাঝে মাঝে মায়ের মনে হতো, নামটা বদলে ফেললে কীই বা যায় আসে? তারপর নিজেই নিজেকে প্রতিউত্তর দিতো, অনেক কিছু যায় আসে। নাম দিয়েই তো অস্তিত্বের পরিচয়ের শুরু। বিসমিল্লায় গলদ করা যাবে না। ওর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। ওই দিনটার কথা মায়ের এখনও মনে আছে। শুরুর কথাটা পরে কৃষিকা নিজেই মাকে বলেছিল। স্কুলে বন্ধুদের ক্ষ্যাপানোর যন্ত্রণায় যখন কৃষিকা অস্থির হয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই তিক্ত সময়টাতে কৃষিকার এক গিক্ বন্ধু ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে ওর হাতে ধরিয়ে হাতটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, “ওই পাগল-ছাগলের কথায় বোকার মত এত ক্ষেপেছিস কেন বলতো? বাসায় গিয়ে বইটা পড়, মাথা এমনিতেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।” কিশোরী কৃষিকা সেদিন কী এক রোমাঞ্চকর উত্তেজনা নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। ওর মনে হচ্ছিল কোনও এক গোপন প্রেমিকের প্রেমপত্র নিয়ে সেই ঘরে ফিরছে। প্রহর গুনছে, কখন একান্তে পড়বে সেই চিঠি! আয়োজনটাও তেমনই ছিল। কাল-পরশু সাপ্তাহিক ছুটি। কৃষিকা শাওয়ার করে ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে বইটা বন্ধ রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কৃষ্ণাও আজ বাসায়, দ্রুত রান্না শেষ করে, মেয়ের রুমে উঁকি দিয়ে অবাক হয়ে যায়। পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো খাটের বাইরে ঝুলিয়ে সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের কাছে কী একটা বই দন্ডায়মান অবস্থায় রেখে গভীর মনোযোগে কৃষিকা পাঠে মগ্ন! এই বিরল দৃশ্য অবলোকন করে মা বিস্মিত হয়েও হয় না। মেয়ে তার অনেক পড়ুয়া। তবে ছোটবেলা থেকেই পড়ার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে ওর। এই সময়টা বাসায় থাকলে কৃষিকা সাধারণত মায়ের আশেপাশে ঘোরাঘুরি, খুনসুটি করে। মা কৌতূহল নিয়ে ভাবে, চঞ্চল মেয়েটার আজ আবার কী হলো? মেয়ের দিকে এক পা বাড়িয়ে ল্যান্ডফোনের কর্কশ শব্দে উল্টো পথ ধরে। তারপর গার্হস্থ্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কাজ করতে করতে ভাবে, কর্মজীবী নারীদের কোথাও ছাড় নেই, না ঘরে না বাইরে। যতই নারীবাদী বলে চিৎকার করুক না কেন নারীরা কী তাদের স্বভাবজাত অভ্যাস ছাড়তে পারে? পারে না। বেশির ভাগ ইতিহাস তো তাই-ই বলে। কৃষিকার কানের চতুর্দিকে চাকভাঙা উন্মক্ত মৌমাছির মত গুণ গুণ করতে থাকে, ‘কৃষিকা, কৃষকের বউ’, ‘কৃষকের বউ কৃষিকা’। বিছানায় এলানো দেহটা নিয়ে, স্কুলের দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠলে রাগে, বিতৃষ্ণায় বইটা হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে গিয়ে দ্বিগুণ আগ্রহে চোখের সামনে মেলে ধরে ‘নেমসেক’, ঝুম্পা লাহিড়ী, চমকলাগা আকর্ষণীয় নারী। লেখকের চেহারা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে মনে মনে বলে, উহ্ এই নামের জন্যই তো আমাকে এত জ্বালা পোহাতে হচ্ছে। দেখা যাক না, ওতে কী আছে? দুপুরে মা মেয়েকে ভাত খেতে ডাকছে অথচ মেয়ে ডুবে গেছে ‘নেমসেক’ এ। শেষ পৃষ্ঠায় এসে কৃষিকার চোখ শ্রান্তির ঘুমে ডুবে যায়। মা এসে দেখে মেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মেয়েকে আর ঘুম থেকে তোলে না। ক্ষুধার্ত মা, খেতে বসে, না খেয়েই উঠে যায়। ঘরটাতে দু’জন মানুষ, একা খায় কী করে!
বয়স চল্লিশ পার হয়নি দেহে ক্লান্তি জেকে বসেছে। তবে কী মানুষের দেহটাও মেশিনের মত। ক্লান্তি দূর করার জন্য, সচল হবার জন্য তারও অনুষঙ্গ চাই। তা না হলে মনও অচল হয়ে যায়। কৃষ্ণার মন কী তাহলে অচল আধুলির মত অবহেলায়, ঘরের অমনোযোগী কোন কিনারায় পড়ে আছে? নাকি নিজের রক্ত মাংসের দেহটাই আজ স্বেচ্ছায় নিজের কাছে উপেক্ষিত? মন কেন উচাটন দেয় না? মন তো পাথর নয়? মন তো জল, হাওয়া তবে স্তব্ধ হয়ে আছে কেন? আত্মপ্রশ্নবিদ্ধ ত্যক্ত কৃষ্ণা ভ্রু কুঞ্চিত করে মনে মনে বলে, বাঙালি নারীরা পুরুষশাসিত এই সমাজের বিচিত্র দায়ভাগ জেনে, না জেনে নিজের স্কন্ধে নিয়ে উপরে মহান অথচ ভেতরে ধুঁকে ধুঁকে মরে। এই স্ববিরোধিতা কেন রে বাবা? ওই একই কর্ম তো কৃষ্ণাও করছে? গোপনে জমে থাকা ময়লার মত শরীর, মনকে উপেক্ষা করে এ জীবন সে টানবে কেমন করে কে জানে? পুরানো ঢাউস সোফাটায় বসে বসে কখন চোখ লেগে গেছে বলতেইও পারে না। চারদিক সজাগ করে ধ্বনিত মাগরিবের আজানে কৃষিকার ঘুম ভাঙ্গে। ‘গোগোল’ মাথায় ঘুরছে। ‘গোগোল’ নাম নিয়ে আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভোগে নাই তা ঠিক না। কিন্তু ওই আজগুবি ক্রাইসিস মাথায় নিয়ে মাথা নষ্ট করেনি। বরং জীবনের আইডেন্টিটির খোঁজে পথে নামে। আর সে কী না বোকার মত ছাড়পোকাদের কামড় খাচ্ছে! ধ্যেৎ কী পাগল সে! কৃষিকা একা একা হাসে। মনে মনে বন্ধুটাকে ধন্যবাদ দেয়। এই বইটি ধরিয়ে না দিলে, সে হয়ত নামের অন্ধকারেই ডুবে থাকত। ও দিন খুব ভালো করে নেট ঘেটে দেখেছে, কৃষিকা নামের অর্থ লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে কঠিন শ্রম করে যে। সুতরাং ওর এত ভয় কেন? আর কৃষকের বউ হতে লজ্জা কীসের? মা তো ঠিকই বলেছে। বরং ওর বাপের মত পুরুষের স্ত্রী হওয়া যে-কোন নারীর জন্য লজ্জাকর, দুর্ভাগ্য। কৃষিকা বইটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়। মা মুচকি হেসে বলে, “শেষপর্যন্ত তাহলে মাথা ঠান্ডা হয়েছে।” ভাতের চিন্তা বাদ দিয়ে মা মেয়ে চা-ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে গোগোলকে নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে।
শীতের দেশে বন্ধুদের নিয়ে ককটেল পার্টির ফূর্তিতে মত্ত কৃষিকার ভেতরটা হঠাৎ ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে। স্বচ্ছ সোনালি টলমল পানিতে বিবর্ণ অতীত একটার পর একটা ফ্ল্যাশব্যাকের মত ঘুরপাক খেতে থাকে। বিরক্ত কৃষিকা দু’আঙ্গুলের নিটোল ব্যবধান থেকে গ্লাসটা নামিয়ে রাখে। কিন্তু অতীত যেন হৃদপিণ্ড অতিক্রম করে চোখে গেঁথে আছে। গোগোলের মত কৃষিকাও একসময় অস্তিত্বের খোঁজে ঘরের বাইরে পা রাখতে বাধ্য হয়। স্ত্রী, কিশোরী মেয়ের ভবিষ্যৎ, সংসার, সমাজ সব তুড়ি মেরে উকিল বাবা হাঁটুর বয়সী মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে, আইনী মারপ্যাঁচে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে কন্যা বয়সী মেয়ের সঙ্গে দিব্যি ঘরগেরস্থি চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মমতার ভেতর দিয়ে চলমান জীবন থেকে পালানোর জন্য কৃষিকা তখন মরিয়া। আদর্শ, আশ্রয় সবই তার মা। স্কুলে বন্ধুরা তখন হুমায়ুন আহমেদের স্লিম-ট্রিম রসালো উপন্যাসগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ক্লাসরুমে টিচার লেকচার দিচ্ছে আর কৃষিকারা মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর কিশোরীর প্রেমের উত্তেজনায় হাবুডুবু খাচ্ছে। ঘরে ফিরলে বেডরুমে স্বামী-স্ত্রীরূপী মা-বাবার অনবরত তর্ক-বিতর্ক, একসময় তুই তুকারে থেকে নোংরা ঝগড়াঝাটিতে পর্যবসিত। মেয়ের ঘরে ফেরা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। এই অসুস্থ পরিবেশেই কৃষিকার বেড়ে ওঠা। ওই ঝগড়ায় প্রথম প্রথম সে ভয় পেত, সেই ভয় তীব্র অশ্রদ্ধা হয়ে একসময় নির্বিকারবোধ তৈরি করে দেয়। একটা সময় হুমায়ুন আহমেদ কৃষিকাকেও মজিয়ে রাখতো। তারপর মধ্যবয়সী বাবার কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া, ছলাকলায় মাকে ডিভোর্স ওই মজাকে প্রচন্ড ঘৃণায় পরিণত করে। দরজার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে বাবার পরকীয়া কাহিনি শোনার পর থেকে ঘৃণার পাশাপাশি বাবাকে সে ভীষণ ভয় করতে শুরু করে। সঙ্গে যুক্ত হয় পুরুষদের প্রতি বিতৃষ্ণা ঘৃণা! সব পুরুষরাই ‘বাবা’ নামক পুরুষটার মতন, কচিদেহভোগী নাকি কে জানে? ছিঃ! তারপর মা-মেয়ের সামনে দিয়েই ‘বাবা’ নামক, ‘স্বামী’ নামক পুরুষটার বাক্সপেটরাসহ প্রস্থান। এরপর থেকে সেই পুরুষের নাম বাড়ির চৌহদ্দিতে কখনোই উচ্চারিত হয়নি।
কৃষিকার স্কিনটাইট জিন্স আর কাটা গলার গভীর খাদ ছাপিয়ে অবাধ্য স্তনগুলো যেন অবমুক্ত হতে মুখিয়ে আছে। বারের আলো-অন্ধকার কোণায় মদ্যপানরত মধ্যবয়সী, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সুবেশী বাঙালি এক পুরুষের লুব্ধ নষ্ট চোখ চেটেপুটে খেতে চায় ঐ পুষ্ট স্তনের যুগল মিনার। শিকার করতে চায় মধ্যবর্তী অন্ধকারের অমৃত সাধ। সোনালি পানীয়ের ওজনহীন স্বচ্ছ গ্লাস আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে কৃষিকা হঠাৎ বন্ধুমহল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কোনও কথা না বলে সোজা সেই মাঝবয়সী শিকারী পুরুষের পাশে বসে, চিয়ার্স বলে লোকটার মদের গ্লাসটায় মৃদু ঠোকর মারে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে এতক্ষণ যাকে সে দেখে চেখে সুখভোগ করছিল, সেই মেয়ে সামনে এসে শুধু দাঁড়ায়নি, মদের গ্লাসে চিয়ার্স করে, ভারী নিতম্ব সজোরে ঠেসে পাশে বসে গোপন ইশারায় প্রলুব্ধ করছে। মধ্যবয়সী লব্ধুক নীরব হামলার আশঙ্কায় অতি সতর্ক হয়ে যায়। এই ব্যবসায় ঘাগু মাল সে। নারী-নেশা তার দূষিত রক্ত মাংস মেদ মজ্জা শিরা উপশিরায় নিষিদ্ধ বিষক্রিয়ার মত সংক্রামিত। পুরানো খেলুড়ে সে, তবুও নড়েচড়ে বসে। কৃষিকা ব্যাধটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে চকচক নেশাতুর চোখ ঘুরিয়ে, কৌতুক হাসি নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে, “নষ্ট পুরুষ, মেয়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছো কতবার?” অশ্লীল প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে নির্বিকার কৃষিকা চকচকে চোখে মৃদু হাস্যমুখে তখনও তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। নষ্ট পুরুষের চোখের সীমানায় ভেসে উঠে, স্বামীর নৃশংস নির্যাতনে মৃত মেয়ের বিভৎস মুখ। আজ আর খেলা জমে না। শালি, হারামজাদি মজাটাই নষ্ট করে দিল। দ্রুত বার থেকে প্রস্থানরত লব্ধুক কৃষিকার ‘হেই মিস্টার’ সম্বোধনে হতভম্ব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। কৃষিকা শ্লথগতিতে এগিয়ে এসে ওয়ালেটটা পুরুষটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, পুরানো প্রেমিকার মত তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ কণ্ঠে বলে, “শালা নেমকহারাম বাঞ্চোত কোথাকার! কালো বাক্সবন্দি স্ত্রী-কন্যার ফটোদুটো ঘরে ফেরার পথে টেমস নদীতে ফেলে যাস কুত্তা।”
দূর থেকে বন্ধুরা ওর কার্যকলাপ দেখছিল কিন্তু বিস্মিত হয় না। হঠাৎ হঠাৎ ওর কী জানি হয়! এই ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়েছে। নির্বিকার কৃষিকা মদের গ্লাসে ঠোঁটের অগ্রভাগ ডুবিয়ে পুনরায় আড্ডায় মজে যায়। বিদেশি বন্ধুরা ওর নামের শেষ অক্ষর ছাটাই করে, ‘কৃষি’ নামে ডাকে। এখন ওর আর খারাপ লাগে না বরং মনে হয় এ নামে ডাকলে চারপাশটা দেশজ সুবাসে ভরে থাকে। স্মৃতির দুর্গন্ধও ওকে আক্রমণ করতে চায়, কিন্তু পারে না। এখন সে অতীতে পিঠ ঠেকিয়ে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে। তবুও মায়ের শরীরের গন্ধ, ঘামের গন্ধ ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়! উফ্ জননী আমার। কী করে এই ভীষণ মায়ার সুবাস দুর্গন্ধ হয়ে বিষাক্ত করে দিয়েছিল তরুণী কৃষিকার দেহমন! সেই দূষিত স্মৃতিই তো আজ তাকে পরবাসে ঠেলে দিয়েছে একাকী। আক্রোশে ক্ষোভে কৃষিকার দুই চোখে জ্বালা ধরে যায়। সবাই আলাপে-প্রলাপে মশগুল। কৃষিকা এদের সঙ্গে থেকেও নেই। নানা দেশ থেকে আসা ইউনিভার্সিটির বন্ধু সব। বিচিত্র সংস্কৃতির সম্মীলন অথচ কোথায় যেন গুম হয়ে গেছে প্রাণের মিলন। এ দোষ সে কাকে দেবে? পৃথিবী একটা ভূখন্ড সবাই এখানে মানুষ নামক নাগরিক, এই ভাবনাকে মেনে নেবার ক্ষমতা ক’জনের আছে? মানতে না পারার দোষও কী তাদের দেয়া যায়? স্বার্থের হীনমন্যতায় নিঃস্বার্থের আত্মহনন হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্র। বাহ্যিক সংবেদনশীল হলেও ভেতরে কোথায় যেন জমাট বরফ। বারের টিভি স্ক্রিনে স্বামীর হাতে স্ত্রীর নির্মম খুনের নিউজ ঘুরে ঘুরে আসছে। কৃষিকার দৃষ্টির সীমানায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেদিন দুপুরে কোন এক নর-নারীর শেষ মৃত্যুর অসমাপ্ত দৃশ্যখন্ড। ওই পুরুষটা কে ছিল? তাকে জন্ম দেয়া নষ্ট পুরুষ বাবা তো নয়! তবে কে ছিল সে? আর অবিন্যস্ত চুলের প্রায় বিবসনা নারীটা, কে ছিল সে? তারা তো এমন হতে পারে না। এমন হয় কেমন করে? না না কিছুতেই না। সে অন্য কেউ। হ্যাঁ অন্য কেউ। সেইদিনের অন্ধকার স্মৃতি রক্তচোষা নেশাখোর বাদুড়ের মত তার পেছন ছাড়ে না। কলেজের গভর্নিং বডির কোন এক সদস্যের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে একঘন্টা ক্লাসের পরই কলেজ ছুটি দিয়ে দেয়। কে জানত কৃষিকার জীবনেও অন্য এক মৃত্যু তখন অপেক্ষা করছিল! ওর বন্ধুরা অনেকেই বাসায় না গিয়ে বারোটার শোতে ছবি দেখতে চিত্রলেখা সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে। কৃষিকা ওই শোতে যোগ না দিয়ে সোজা বাসার পথে রওনা দেয়। মনে মনে ভাবে, চাকুরি আর বাসা একা সামাল দিতে দিতে ক্লান্ত মা তার। মায়ের জন্য মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে। এই বয়সে মা-টা তার একা হয়ে গেল। দমবন্ধ করা নিরানন্দ এক বাক্সে বন্দি হয়ে গেছে মায়ের জীবনটা। আজ সারাটা দিন মায়ের সঙ্গে কাটাবে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কী টের পেয়েছিল কী কঠিন নির্মম জীবনদৃশ্য তার জন্য তখন অপেক্ষা করছে যা সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানাবে! সেই দৃশ্যের অপেক্ষায় বন্ধুরা সদলবলে সিনেমা হলের আলো-আঁধারি কক্ষে উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে। কৃষিকা দ্রুত পায়ে কলেজ গেইট থেকে রিক্সা চড়ে সোজা নিঃসঙ্গ বাসার গেইটে এসে থামে। শব্দহীন শব্দে গেইটটা খুলে ভেতরে ঢুকে। মনে মনে ঠিক করে রাখে আজ মাকে সারপ্রাইজ দিবে। রাস্তা ঘেষে দাঁড়ানো কোমর সমান লোহার গেইট অতিক্রম করে গোলাকৃতি বারান্দায় ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়, সদর দরজাটা বন্ধ, অবাক হয় না। মা সাধারণত রুমে থাকলে ওটা বন্ধ করেই রাখে। কারণ সদর দরজা থেকে মায়ের রুমটা সরাসরি দেখা যায়। নষ্ট পুরুষ বাবাটা চলে যাবার পর মা আর কখনোই ওই রুমে শোয়নি। খাটটা তুলে ষ্টোর রুমে রেখে দিয়েছে। আবড়া-জাবড়া জিনিষপত্র দিয়ে রুমটা বিশৃঙ্খল করে রেখেছে। এখন যেন মায়ের গোপন যত যন্ত্রণা, আক্রোশ, ক্ষোভ ওই প্রাণহীন রুমের প্রতি।
দরজা বন্ধ সুতরাং মাকে সারপ্রাইজ দেয়া হলো না। আচ্ছা মা কি ঘুমোচ্ছে? এই অসময়ে তো মা কোনওদিন ঘুমায় না। গতকাল বলেছিল, ঘর গোছানোর জন্য আজ ব্যাঙ্ক থেকে ছুটি নিয়েছে। মার তো আবার ঘর গোছানোর বাতিক আছে। জীবনটা যখন থেকে অগোছালো হয়ে গেছে তখন থেকে মায়ের ঘর গোছানোর রোগ আরও বেড়ে গেছে। তার তো এখন ঘুমানোর কথা না। ধ্যেৎ তাকে আর সারপ্রাইজ দেয়া হলো না। ওই লম্বা চুলের ঝোলানো বেণীটা ছাপিয়ে আয়ত চোখ দুটো ঢেকে দেয়া হলো না। মাকে চমকে দেয়া হলো না। এর চেয়েও যে কঠিন চমক কৃষিকার জন্য অপেক্ষা করছে কে জানত! বিরক্ত বিষণ্ণ মনে বাধ্য হয়ে কলিংবেল এ হাত রাখে। কয়েকবার বেল টিপে সাড়াশব্দ না পেয়ে, মায়ের জন্য দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মাকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইলে চোখ রাখতেই, আলুথালু বেশে মা তার দরজাটা সামান্য খুলে বিরুক্তিভরা কণ্ঠে বলে, “আহ তোমাকে না বলেছি আজ দুধ দিতে এসো না”, মেয়েকে দেখেই হতভম্ব মা দরজা ছেড়ে দেয়। নদীর পাড় ভাঙার মত মড়মড় শব্দে দরজাটা খুলে যায়। মায়ের অবিন্যস্ত চুলের ডগা অতিক্রম করে সরাসরি তার চোখ পড়ে মায়ের নতুন শোবার ঘরে। সুঠামদেহী সুদর্শন এক পুরুষ, শরীরের উর্ধ্বাংশ নগ্ন আর নিম্নাংশ মায়ের বাহারি চাদরে ঢাকা। ধুমপানরত লোকটা মুখ নির্গত ধোয়া সাপের মত কুন্ডলি পাকিয়ে অসংখ্য সাপ মুখ হয়ে উর্ধ্বগামী হচ্ছে। এত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ের ভালবাসার বিশ্বাসের ইমারত অদৃশ্য বোমার আঘাত নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কৃষিকার হাত থেকে ব্যাগটা মাটিতে পড়ে যায়। ঘৃণা লজ্জায় তার সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে। পাগলের মত ছুটে সে বাসার সীমানা পেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত শহরের রাস্তার আনাচে কানাচে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে শুরু করে। আত্মাটা তো হায়েনারা খাবলে খুবলে খেয়ে ফেলেছে অন্তত দেহটা অক্ষত থাকুক। তাই শিকারীদের ভয়ে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার অতিক্রম করে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে বাধ্য হয়। অথচ মাও তো তার শিকারীর শিকার হয়ে গেছে! মা সারা শহর পাগলের মত মেয়েকে খুঁজে বেড়িয়েছে। মোবাইল সে বারান্দায় ফেলে গেছে। মেয়েকে না পেয়ে ঘৃণা লজ্জা তীব্র অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে অন্ধকার ব্যালকনিতে স্থানুর মত বসে থাকে মা। ঠিক সেই নির্মম মুহূর্তে মা-মেয়ের মুখোমুখি।
অদ্ভুত অপরিচিত এক বোধ নিয়ে কৃষিকা মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তার পরের ইতিহাস ‘কৃষিকা’ নামের অর্থ উদ্ধারের ইতিহাস। বই এ মুখগুজে পড়ে থাকাই হলো তার জীবন। মা-মেয়ের মধ্যখানের সহজ সেতু ভেঙে গেল চিরতরে। নিজের পড়াশুনা আর বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশনি করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করল যাতে ‘মা’ নামক নষ্ট নারীর সামনাসামনি তাকে হতে না হয়। এমন এক ‘দেয়াল’ নির্মাণ করলো, মা নামক নষ্ট নারীর সাহস হল না, সেই দেয়াল অতিক্রম করার। তবুও তার হাতের রান্না তাকে খেতে হতো। মায়ের শরীরের সেই চির পরিচিত ঘ্রাণ সে আর কখনোই পায়নি। কখনও কাছাকাছি, পাশাপাশি হয়ে গেলে কী এক কলুষিত দুর্গন্ধে নাড়িভুড়ি চিরে বিবমিষার উদ্রেক হতো। বন্ধ দম নিয়ে ছিটকে দূরে সরে যেত।
সেবার বোর্ডের মধ্যে কৃষিকা প্রথম হলো। মেট্রিকের রেজাল্টও তার দুর্দান্ত। পাগলের মত সে বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করতে শুরু করল। ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যেতে লাগল। মেয়ে, মাকে কোন সুযোগই দিল না। শব্দ করে সেই যে দরজা বন্ধ করেছিল বিদেশে যাবার পূর্ব-পর্যন্ত আর খোলেনি। মাও কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিল। একদিন দুপুরে মা জানলো সন্ধ্যায় মেয়ের বিদেশ যাত্রার ফ্লাইট। সেদিন মায়ের পরাজিত সৈনিকের মত বিধ্বস্ত চেহারা মেয়েকে কী এক নির্মম আনন্দ দিয়েছিল! আসলেই কী দিয়েছিল? চমকে উঠে সে। তবে কী জীবনের বাজিতে মা-মেয়ে দু’জনেই হেরে গেল? ওই পুরুষ দু’জনই কী শেষপর্যন্ত জিতে গেল? মায়ের শয্যাসঙ্গী দুই পুরুষ! কৃষিকা আড্ডা ছেড়ে দ্রুত বাইরে পা বাড়ায়। বন্ধুরা অবাক হয় না। ওরা জানে ওদের বন্ধুটা কেমন অদ্ভুতুড়ে! কৃষিকা নিজের জীবনটাও বিশৃঙ্খল করে ফেলেছে। মায়ের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কি তবে নিজের উপর নিয়ে নিল? জীবনের বাজিতে কি শেষপর্যন্ত হেরেই গেলো? নষ্ট নারী মায়ের ওপর সব আক্রোশ মিটাতে গিয়ে সংসার ত্যাগ করে দেশান্তরী হলো কিন্তু নষ্ট পুরুষ বাবাকে ঠিকই ছাড় দিল? প্রশ্নগুলো ওর হৃদপিন্ডকে চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত করতে লাগলো। আজ কত বছর হয়ে গেল, মাকে সে দেখে নাই, কথাও হয় নাই। মদ ওর নিত্যসঙ্গী। দেহের নেশাও কী কম! এই পাঠে প্রথম হাতেখড়ি ইউনিভার্সিটির ডর্মেটরির সেই শেতাঙ্গী মেয়েটার হাতে। সারারাত অবিরাম তুষারপাত আর প্রচন্ড হীম আবহে হঠাৎ করেই যেন পুরো ডর্ম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। বিধ্বস্ত মন নিয়ে বিদেশে বিভূঁইয়ে সদ্য পা রাখা কৃষিকার নিঃসঙ্গ না-খোলা দেহের ভাঁজে ভাঁজে নরম হাতের গাঢ় স্পর্শ, হীমকে ছাপিয়ে থরথর উষ্ণতার বাধাহীন উত্তেজনায় মগ্ন হয়ে ওঠে নিঃশব্দ কক্ষটা! কৃষিকা বাধা দেয় না, আসলে সে ভেসে যায়! ঠোঁটের অগ্রভাগে ঠোঁটের প্রগাঢ় চুম্বন মুহূর্তে, নিয়ন বাতির বিক্ষিপ্ত আলোয় সে আবিষ্কার করে শেতাঙ্গী মেয়েটাকে! তার চকচকে চোখে তীব্র তৃষ্ণা! কৃষিকা থামে না, প্রগাঢ় নেশায় ডুবে যায় অন্ধকারে! তারপর একটা সময় কেমন অরুচি ধরে যায়। এতো তার নিজেরই দেহের সেই পুরানো ভাঁজ, পুরানো খাঁজ! ঘৃণিত ওই পুরুষরাই তাকে টানে বারংবার। ওর সেই কৃষ্ণাঙ্গ প্রেমিক পুরুষটা উহ্ বিছানায় সে কী ভীষণ দুর্দান্ত খেলুড়ে। কামলীলার ষোলকলা পূর্ণ করে দেয়। হীম আচ্ছাদিত এই নিঃসঙ্গ পরবাসে ভিনদেশী প্রেমিকের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেহের তৃষ্ণার শেষবিন্দু শুষে নিতে উন্মক্ত কৃষিকা হঠাৎ প্রেমিকের বাহুপাশ থেকে ছিটকে পড়ে। “ডান ডান, সরি ডার্লিং আই এ্যাম নট ইন মুড!” উত্থিত বেপরোয়া শিশ্ম মুঠোতে চেপে রেখে চরম বিরক্ত প্রেমিক বলে উঠে, “ইটস নট ডান এট অল। দিস ইজ টু মাচ ডার্লিং।” তারপর আহত কণ্ঠে বলে, “ও কে ইটস ফাইন।” বিমিশ্র অনুভবের সঙ্গে তাৎক্ষণিক বিতৃষ্ণা পুষে রেখে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ মনে মনে বলে, না না এই মেয়েকে হাতছাড়া করা যাবে না। তাই ছাড় না দিয়ে উপায় নেই! নির্বিকার কৃষিকা লিভিং রুমের নরম গদিতে নগ্ন দেহটা এলিয়ে দ্রুত মোবাইল অন করে। চোখ দুটোতে যেন ঢল নেমেছে। মনটা উচাটন দেয়। আজ রাতে ফ্লাইট। পাঁচ বছর পর কৃষিকার নিজের দেশ, নিজের শহরে ফেরা। বোহেমিয়ান জীবনের ছোট্ট বোঝাটা নিয়ে সে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটা যেন ভুতুড়ে হয়ে গেছে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ভয় আর তীব্র বেদনায় ভেতরটা চুরমার হয়ে যেতে চায়। বাইরের লাইটটাও জ্বালানো নেই। উফ্ মা জানি কেমন আছে! উহ্ খোদা সব যেন ঠিকঠাক থাকে। অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়ানো কৃষিকার দু’চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে। আজ তার প্রায়শ্চিত্তের সময়। এ পাপের শাস্তি তাকে মাথা পেতে নিতেই হবে। মা, মা আমার, সে যে একজন মানুষ কেমন করে সে ভুলে গেলো? এতটা বছরে একটা বারের জন্যও এই কথাটা কেন একবারও মনে পড়লো না? কেন? বই, বিদেশের মুক্ত জীবনে সে তো কোন মানুষী দাবিই ছাড়ে নাই। তবে মাকে কেন ছাড় দিল না? নিজের গ্লানির বোঝাকে আত্মপ্রবোধের ভাষণে হালকা করতে চায়। তখন তো বয়স কম ছিল। এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হলে, সেও তো অন্ধকারেই থাকতো। এখন সে মানুষীবোধ বুঝতে শিখেছে, এখন সে সব ঠিক করে দিবে।
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর মেয়েকে দেখে কৃষ্ণার ভেতরটা মোলায়েম হতে হতে ভীষণ কঠিন হয়ে যায়। মানুষ তো! মেয়েকে স্পর্শ করতে গিয়েও পারে না। মা আত্মজার দিকে দু’পা এগিয়ে সন্তর্পনে চার পা পিছিয়ে যায়। পুরানো গিরিখাতের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। গতকাল রাতে কৃষ্ণা সমাজের চোখ আড়াল করে তার সমাধিতে সযত্নে বটগাছের চারা রোপণ করে এসেছে। ওই পতনের পর থেকে আর তাদের দেখা হয়নি। মানুষটা তো তাকে কলেজ জীবন থেকেই ছায়া দিয়ে রেখেছিল। সে তো তার জীবনে বটগাছই ছিলো। সব ঠিকঠাকের মধ্যে কৃষিকার বাবা নামক পুরুষ স্বামীটা কেমন করে জানি ঢুকে গেলো। একেই হয়তো বলে নিয়তি। মায়ের সর্ব হারানো বিষাদমুখ দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে কৃষিকা। মা কেমন বুড়িয়ে গেছে। মুখে কঠিন বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। নিজেকে অত্যাচারের ছাপ গোটা দেহে। গ্লানির বোঝা নিয়ে মেয়ে কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “মা, মা তুমি ভালো আছো তো?” প্রতিউত্তর না দিয়ে মা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, “কৃষিকা লম্বা জার্নি করে এসেছিস। ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোর ডিনারের ব্যবস্থা করি।” মায়ের শীতল ব্যবহারে কৃষিকা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলে, “মা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমিও রক্ত মাংসের একজন মানুষ। আমার মা যেন আমার সম্পত্তি। বাবাকে কত দ্রুত ছাড় দিয়েছি অথচ তোমাকে এতটা বছর ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে রেখেছি, কী নির্মম স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ সন্তান আমি। আমাকে মাফ করে দাও মা। মাফ করে দাও। তোমার জীবন গুছিয়ে তবেই এবার আমি ফিরব।”
কৃষ্ণা মেয়ের চোখে চোখ রাখে। ভাবলেশহীন অবশ সে দৃষ্টি। যেন এ জগৎ সংসারের কোথাও সে নেই। কৃষিকাও নেই। সেই যে চলে গেছে, আর ফিরে আসেনি। মুখোমুখি দাঁড়ানো দু’জনেই কেউ কারো না। দু’জন নারীরূপী মানুষ! অসহনীয় নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ কৃষ্ণা কথা বলে ওঠে, “আমার জীবন গুছানোর কিছু নেই। আমার জীবন সে একান্ত আমার। এই জীবনের সব হিসেব নিকেশ সবই আমার। যে জীবন তুই বেছে নিয়েছিস, সে জীবন তোর নিজস্ব। ওখানে আমি এখন আগন্তুক। তবে ভয় নেই, আমি এখনও শুধু তোর মা। মায়েরা মানুষ নন, তাদের শরীর রক্ত মাংসের না, বরং অন্য কোন কিছুতেই সৃষ্টি। কী সে তা তারা নিজেরাও জানে না। শুধু জানে তারা জন্ম দেন। তাই তারাও স্রষ্টা, মানুষ না। মা হয়ে গেলে তারা পূর্ণ হয়ে যান। তাদের কোন অপূর্ণতা থাকতে নেই। আমি তো মা। আমি আর কিছু না।” তারপর কেমন অপরিচিত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “নিজের জীবনে ফিরে যা। মায়েরা দূরে থেকেও সন্তানের কাছেই থাকে। তোর কোনও ভয় নেই। আমি শুধু তোর মা। আর কেউ না, কিছু না।” শ্লথ পায়ে কৃষ্ণা তার শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কৃষিকা তাকিয়ে দেখে সেই বিশৃঙ্খল ঘরটাই এখন মায়ের শোবার ঘর। উহ্ কী ভয়ঙ্কর শাস্তিই না মা, এতটা বছর ধরে নিজেকে দিয়ে যাচ্ছে। পাপ করেছে মেয়ে অথচ প্রায়শ্চিত্ত করছে মা। মূক কৃষিকা মৃতসম যন্ত্রণা নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। মা-মেয়ের মধ্যখানের গভীর গিরিখাতের ভয়ঙ্কর নিঃসীম অন্ধকার আরও ঘণীভূত হতে থাকে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বন্ধু নিলুফা আক্তার। কৃষিকা গল্পটি পড়লাম। আজ বহু বছর পর আসলে একটি সম্পূর্ণ গল্প পড়া হল। সম্পর্ক মানুষের মন কামনা বাসনা টান পাওয়া না পাওয়া সব কিছু মিলিয়ে ভিন্নধর্মী এক মনের খোরাক গল্পটি। গল্পের রচয়িতা, প্রকাশকের প্রতি শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। অনলাইনে বিজ্ঞাপন মুক্ত কিছু পড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ধন্যবাদ
অনেক ধন্যবাদ বন্ধু জয়! ❤️🙏