রিমি মুৎসুদ্দি
শরতের আকাশে রাতের শেষ তারাটাও মিলিয়ে গিয়ে সূচনা হল ঊষার। ব্রাহ্মমুহূর্ত।
সচল বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে মধুমতী সূক্ত-
‘মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।’
সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এক দ্বৈত সঙ্গীতের ধারা। ব্রহ্মের এ এক অহৈতুকী তৃপ্তি। এই তৃপ্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আনন্দ-স্বরূপের প্রকাশ।
যাজ্ঞবল্ক্যের আশ্রমের ব্রহ্মচারীরা স্বাধ্যায় পাঠ শুরু করার আগে ‘ওম্’ মন্ত্র উচ্চারণ করছেন।
‘ওম্’ ধ্বনির মধুর ঝঙ্কার ব্রহ্মবীজ মন্ত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে।
কাত্যায়নীর রন্ধনশালায় প্রাতরাশের আয়োজন শুরু।
মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য ধ্যানে মগ্ন। তবে চোখ বন্ধ করে ধ্যান নয়। শরতের এই সোনালী আকাশ, আশ্রমের প্রতিটা গাছপালা, আশ্রম কন্যাদের দুগ্ধ দোহন, আশ্রমিক কিশোরদের যজ্ঞকাষ্ঠ সংগ্রহ যতদূর দৃষ্টি প্রসারিত তিনি সব দেখছেন। চারপাশের জগতের প্রতি তাঁর ধ্যানমগ্নতা অনুমেয়। কিন্তু এর বেশি কেউই কিছু বুঝতে পারেন না।
স্ত্রী কাত্যায়নী প্রাতরাশ নিয়ে এলেন। যবাগূ, পুরোডাশ আর দুগ্ধ। যাজ্ঞবল্ক্য কিছুই খেলেন না। কাত্যায়নী প্রশ্ন করার আগেই মহর্ষি বললেন, তিনি প্রব্রজ্যা নিতে চান। চলে যাওয়ার আগে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, গোধন দুই স্ত্রীর মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে যাবেন। কাত্যায়নী বুঝলেন, এই সিদ্ধান্ত অপরিবর্তনীয়।
স্ত্রীপ্রজ্ঞা কাত্যায়নীকে তাঁর সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ দান করে যাজ্ঞবল্ক্য এলেন গ্রন্থশালায়। সেখানে তাঁর সুমেধা স্ত্রী মৈত্রেয়ী অধ্যয়নরত। স্বামীর উপস্থিতি মৈত্রেয়ী প্রথমে বুঝতে পারেননি। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর ব্রহ্মবাদিনী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অনুভব করলেন,
মায়া। বড় মায়া। এ মায়া কাটানোই জরুরি।
তিনি বললেন,
“অয়ি মৈত্রেয়ী, আমি গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করে উচ্চতর আশ্রম অর্থাৎ চতুর্থ আশ্রমে যাবো। কাত্যায়নীর সঙ্গে তোমাকেও আমার সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে যেতে চাই।”
স্থির শান্ত অবিচল মৈত্রেয়ী বললেন,
“এই গাভী সোনা রূপা দিয়ে আমি কি করব ভগবান?”
যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন,
“এই সম্পত্তির দ্বারাই তোমার বাকী জীবন সুখে ও স্বচ্ছন্দে কাটবে। যেমন অন্যান্য অবস্থাপন্ন গৃহীরা থাকেন তুমি তেমনভাবেই তোমার দিন অতিবাহিত করতে পারবে।”
মৈত্রেয়ী প্রশ্ন করলেন,
“এই সব বিত্ত দ্বারা আমি কি অমর হতে পারব?”
যাজ্ঞবল্ক্য হাসলেন। বললেন,
“না প্রিয়ে। সম্পদ দ্বারা অমৃতত্বের আশা নেই। স্বর্ণ ও সূর্য দুইয়েরই নিজস্ব কিরণ আছে। কিন্তু সূর্যকিরণ আর স্বর্ণকিরণ কি এক?”
স্বামীর এরূপ উক্তি শুনে মৈত্রেয়ী বললেন,
“যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং?”
অর্থাৎ, “যা দিয়ে আমি অমৃতা হব না, তা দিয়ে কি করব?”
মৈত্রেয়ী তাঁর প্রাজ্ঞ স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন অমৃতের সন্ধান। এই প্রশ্ন শুনে যাজ্ঞবল্ক্য খুশি হলেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম স্ত্রীকে বললেন,
“আমি গার্হস্থ্য আশ্রমেও তোমাকেই সর্বাধিক প্রিয় মনে করেছি। আজ এই প্রশ্ন শুনে আমার এই নতুন আশ্রমেও তুমিই আমার প্রিয়তর হলে। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। এসো, বস আমার কাছে। অমৃতত্ত্ব-এর ব্যাখ্যা শোনো।”
অতঃপর অমৃতের সন্ধানে যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর যাত্রা শুরু হল। পায়ে হেঁটে অনেকদুরের পথ একসঙ্গে তাঁরা গেলেন না। কেবল প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে, মেনে নেওয়া ও না মেনে নেওয়ার রাস্তা ধরে জ্ঞানমার্গের পথে হাঁটলেন দুই সহযোদ্ধা, সহযাত্রী। যেন, দুজনেই দুজনকে বললেন,
-আমার যা কিছু সব তোমার
প্রিয় বস্তুর ব্যাখ্যায় যাজ্ঞবল্ক্য বললেন,
“প্রিয় মানুষ, প্রিয় বস্তু অথবা দেবতার প্রতি প্রীতিবশত কোনোকিছুই প্রিয় হয় না। যা কিছু প্রিয় তা আসলে আত্মপ্রীতিরই এক রূপ।”
এই আত্মপ্রীতিকে জানাই আত্মজ্ঞান। আর এই আত্মজ্ঞান লাভ করাকেই তিনি অমৃতের সন্ধান বললেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বললেন, এক খণ্ড সৈন্ধব লবণ জলে ফেললে তা নিমেষে জলে মিশে যায়। তখন লবণ আর জলকে পৃথক করা যায় না। সেই জলের যেকোনো অংশ পান করলেই তার স্বাদ লবণাক্ত হয়।
আরও উদাহরণ দিলেন তিনি। দুন্দুভি, শঙ্খ, বীণা প্রভৃতি বাদ্যের কোনও অস্তিত্বই নেই ধ্বনি ছাড়া। কেবলমাত্র ধ্বনি পারে দুন্দুভি শঙ্খ বীণা প্রভৃতি জড়বস্তুকে বাদ্যযন্ত্রে রূপান্তরিত করতে। ঠিক তেমনি আত্মা থেকে নির্গত বস্তু সমুদয়কে জানতে চাইলে আত্মাকে জানা প্রয়োজন। আত্মাকে জানলেই জগৎকে জানা যায়।
এই আত্মা সম্বন্ধে তিনি বললেন,
“আত্মা বিচ্ছেদহীন, উচ্ছেদহীন। ব্রহ্ম যখন দ্বৈত- তখন একে অপরকে দেখে। আঘ্রাণ করে। আস্বাদন করে। জানে, শোনে, স্পর্শ করে, চিন্তা করে। কিন্তু সবই আত্মা- এই চেতনা সম্পূর্ণ হলে, কাকে আঘ্রাণ করবে? কাকে আস্বাদন করবে? কাকে বলবে? কার কথা শুনবে? কি ভাববে? কি স্পর্শ করবে?”
মৈত্রেয়ী খানিক বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
“কিরূপে সেই জ্ঞান লাভ করব? কোন সাধনা দ্বারা? কোন গ্রন্থে পাবো?”
যাজ্ঞবল্ক্য স্মিতহাস্যে উত্তর দিলেন,
“প্রজ্বলিত অগ্নি থেকে যেমন ইন্ধন দ্বারা ধূম নির্গত হয়, তেমনি বেদ, উপনিষদ, ইতিহাস, পুরাণ ও অন্যান্য সমস্ত বিদ্যা, শ্লোক, মন্ত্র, সূক্ত সবই মহাভূত থেকে নির্গত। এগুলো সবই তাঁর নিঃশ্বাস। সেই নিঃশ্বাসকে ধারণ করতে হলে চাই মনন। নিদিধ্যান। একগ্রতা দ্বারাই তা সম্ভব।”
মৈত্রেয়ী একমনে শুনছেন তাঁর কথা। ঋষি এরপর বললেন,
“তবে ব্রহ্মরহস্যের সবটা জানা যায় না। যেমন মৃত্যুর পর আর তার কোনও সংজ্ঞা থাকে না।”
মৈত্রেয়ী এবার ব্যাকুল হলেন। বললেন,
“ভগবান, আপনি আমাকে বিভ্রান্ত করলেন। মৃত্যুর পর সংজ্ঞা থাকবে না? আমি কিছুতেই তা বুঝতে পারছি না। তাই যদি হয়, তাহলে এই সবই তো মোহ?”
যাজ্ঞবল্ক্য চেষ্টা করলেন, এই বিভ্রান্তি দূর করতে। তিনি বললেন,
“আমি মোহজনক কিছু বলছি না। যেখানে একজন অপরজনকে দেখে, ঘ্রাণ নেয়, রস রূপ আস্বাদন করে অথবা অবলোকন করে সেখানেই ভেদবুদ্ধি। আত্মা এক হয়ে গেলে সবই তো তখন তার। এই সমস্তকে যার দ্বারা জানা যায় তাকে কি করে জানবে প্রিয়ে? বিজ্ঞতাকে জানা সম্ভব?”
মৈত্রেয়ীর শেষ প্রশ্নের উত্তর যাজ্ঞবল্ক্য দিতে পারলেন না। স্ত্রীকে আশীর্বাদ করে ঋষি চললেন সাধনার আরও উচ্চতর মার্গে। হয়ত যে প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি তাঁরই সন্ধানে?
মৈত্রেয়ী অনুভব করলেন জলের স্রোতের মত কি যেন সরে যাচ্ছে। কি যেন দেখতে পাচ্ছেন না।
যাজ্ঞবল্ক্য নেই? তিনি কোথাওই নেই আর?
এই প্রশ্নের উদয় হতেই তাঁর মনে পড়ল একটু আগেই শোনা সেই অভেদতত্বের কথা। তিনি অনুভব করলেন, যাজ্ঞবল্ক্য আছেন। তাঁর সঙ্গেই আছেন। এই নির্বিকল্প ধারণার স্তরেই তো উন্নীত করে অমৃতত্ব।
সমস্তরকম বিচ্ছেদকে মহামিলনের মধুরতায় রূপান্তরিত করে দিয়ে গেলেন তাঁর ভগবান, তাঁর স্বামী, তাঁর ভালোবাসা- যাজ্ঞবল্ক্য।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভাল লাগল।
সহজ করে লেখা । সুন্দর । ভাল লাগলো ।