short-story-ghotibabur-horror

ঘটিবাবুর হরর
সৌরভ মুখোপাধ্যায়


ঘটিরাম গুপ্ত চলেছেন ডাক্তারখানায়।

আলাদা পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই, বাংলা-সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই ঘটিবাবুকে চেনেন। গত কয়েক বছর ধরে অজস্র রক্ত-হিম রহস্যগল্প আর ভয়াল-ভয়ঙ্কর ভৌতিক-তান্ত্রিক-উপন্যাস লিখে যিনি রোমাঞ্চভুক পাঠককুলের নয়নমণি হয়ে উঠেছেন, থ্রিলার-জগতের বেতাজ বাদশা আর হরর-জঁরের সর্ববাদীসম্মত মশালচি হিসেবে বঙ্গসাহিত্যে যাঁর ধন্যধ্বনি আকাশ ছুঁয়েছে, যাঁর লেখা পড়ে লোকে রাতে টয়লেট যেতে ডরায় এবং সেইহেতু ‘ডায়াবেটিস-রুগীরা পড়বেন না’ বলে বিজ্ঞাপন সাঁটা থাকে, সেলুনে অপেক্ষারত খদ্দেরদের জন্য নাপিতরা ইদানীং যাঁর বই কিনছে, খাড়া চুল কাটতে সুবিধা হবে বলে – ইনিই সেই একমেবাদ্বিতীয়ম্‌ ঘটি গুপ্ত। নামটিই যথেষ্ট, ইন্ট্রোডাকশনের অপেক্ষা রাখে না।

বরং, হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুটিকে নিয়ে কিঞ্চিৎ বিশদ হওয়ার প্রয়োজন আছে। সেটাই আগে হোক। বস্তুত এ-গল্প তো ডাক্তারেরই; লেখক এখানে নিমিত্ত মাত্র।

ভবানীচরণ ভাণ্ডারী আর.এম.পি – মানে রেজিস্টার্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার। তাঁকে ভবানী-ডাক্তার বলা যেতেই পারেই, আইনত। কিন্তু ঘেঁটুপুর গ্রামের তাবৎ লোকজন তাঁকে ‘ভাঁড়ে-মা-ভবানী’ বলে ডাকে, প্রায় প্রথম থেকেই। তাঁর অপূর্ব বিদ্যের দৌড় দেখেই এহেন নামকরণটি হয়েছিল, নিশ্চিত! তিনি প্র্যাকটিস শুরু করার অল্পদিনের মধ্যেই এ অঞ্চলে প্রাচীন প্রবাদ চালু হয়ে গিয়েছিল, ভবানী ডাক্তারের ডিসপেনসারির পথটি হল ওয়ান-ওয়ে! রুগিকে রোগ-সমেত যেতে দেখা যায় বটে সেদিকে, সারিয়ে ফিরতে দেখা গেছে এমন নজির নেই।

এ বিষয়ে জিগ্যেস করলে ভবানী ডাক্তার একদা বেশ বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘বুঝলে, সংস্কৃতে একটা জব্বর শোলোক আছে, শতমারী ভবেৎ বৈদ্য, সহস্রমারী চিকিৎসকঃ। যত রুগি মারতে পারবে, তত ডাক্তারের কদর বাড়ে। সে-বিচারে আমি ঠিক পথেই আছি হে।’

সাধারণ বুদ্ধি বলে, এহেন ডাক্তারের চেম্বারে অচিরেই মাছি ভিন্ন আর অন্য প্রাণীর আগমন হওয়ার কথা নয়। হতে বসেছিলও তাই। কে আর সেধে পৈতৃক প্রাণটি খুইয়ে ডাক্তারের ‘কদর বৃদ্ধি’ করতে যাবে! কিছুকাল যেতে-না-যেতেই ডাক্তার সারাদিন ফাঁকা চেম্বারে বসে হাতপাখা নাড়তেন শুধু।

কিন্তু, না! প্রখর বৈষয়িক বুদ্ধিবলে ‘ভাঁড়ে-মা-ভবানী’ ডাক্তার নিজের ভাণ্ডটি অন্য পথে পরিপূর্ণ করেই ফেলেছেন। এখন তাঁর চেম্বারে খদ্দেরের অভাব ঘটে না আর। ‘খদ্দের’ বলার মধ্যে কোনও দোষ নেই। কারণ, এখন যারা তাঁর কাছে আসে তারা কেউ রুগি নয় আদতে। বিশেষ একটি বস্তু কিনতেই আসে তারা। আর ভবানী সেটা বেচেন উপযুক্ত দরে। আরে, না! ওষুধ-বিষুধ নয়। উঁহু, নেশার জিনিসপত্তরও না!

ঘোড়েল-বুদ্ধির পাঠকরা এতক্ষণে আন্দাজ করেই ফেলেছেন।

হ্যাঁ, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট! মানে, ডাক্তার লিখে দেবেন, অমুক রুগি তমুক অসুখে আক্রান্ত হয়ে এতগুলি দিন শয্যাশায়ী এবং তাঁর চিকিৎসাধীন ছিলেন, এই সবেমাত্র আজকে তিনি ‘ফিট টু জয়েন হিজ জব’। যে-কোনও অসুস্থতার কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে, এই সার্টিফিকেটটি লাগে। তবে মাফ হয়, ছুটি মঞ্জুর হয়। ভারি জরুরি কাগজ।

মুশকিল হচ্ছে, এ-জিনিসে দু-নম্বরি করার দরকার পড়ে হরবখত। মানে, আসলের চেয়ে ফল্‌স সার্টিফিকেটেরই বেশি প্রয়োজন পড়ে, বিস্তর চাকরিজীবীর। অসুস্থ হয়নি, দিব্যি শুয়ে-বসে ছুটি খেয়েছে বা বেড়াতে গেছে বা আমোদ-আহ্লাদ করেছে – কিন্তু আপিসে দেখাতেই হবে যে বিছানা ছেড়ে ওঠার সামর্থ্য ছিল না! নাহলে মাফ নেই। তখন দ্বারস্থ হতেই হয় এমন ডাক্তারের, যিনি লিখে দেবেন, ঠিক যেমনটি দরকার। জাল সার্টিফিকেটের এই রেওয়াজ প্রায় সব আপিসেই চালু আছে। এমনকি ফচকে ছোঁড়ারাও এ-জিনিস খোঁজ করে প্রায়ই, ইশকুলে দিতে লাগে।

ঘেঁটুপুর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নামজাদা ডাক্তার যাঁরা, তাঁরা কেউই এই ফল্‌স সার্টিফিকেট লিখে দিতে রাজি হন না। অতএব, আর.এম.পি ভবানী ভাণ্ডারী গত কয়েক বছরে এই একচেটিয়া সুযোগটা লুফে নিয়েছেন। এবং, এতে তাঁর ডুবু-ডুবু বাণিজ্যতরী ফের সগর্বে ঘাড় উঁচিয়ে ছুটছে! এখন সারাদিন তিনি প্যাড খুলেই বসে থাকেন। টুকটাক খদ্দের-এর আনাগোনা লেগেই আছে। নাম ছড়িয়েছে। এপাড়া-ওপাড়া এমনকি আজকাল দূরদূরান্ত থেকেও লোক আসে। ডাক্তার অক্লান্ত। শুধু, কালেভদ্রে যদি সত্যিকারের কোনও রুগি ঢুকে পড়ে – তাঁর ‘হাতযশ’ জানে না এমন আনাড়ি রুগি – তবে ভারি বিরক্ত হন। রোগের ব্যাখ্যান শুনতে আর ভাল লাগে না তাঁর। বিরস গলায় বলেন, ‘সারাতে এসেছ নাকি? অন্য ডাক্তারের কাছে যাও বাপু! ওসব আর চর্চা নেই…’

হ্যাঁ, চিকিৎসাবিদ্যে যতটুকুও বা জানতেন, সব ভুলে গেছেন। ভাঁড়ে-মা-ভবানী এখন সার্থকনামা! এখন সারাদিন শুধু ফলস সার্টিফিকেট। পার পেশেন্ট তিন মিনিট; দুটো বাক্য, একটা সই, একটা স্ট্যাম্প। নো ঝামেলা। বাঁধা বয়ান – ‘দিস ইজ টু সার্টিফাই দ্যাট অমুকচন্দ্র তমুক, অ্যাড্রেস… (সত্যিকারের ঠিকানা), এজ… (সত্যিকারের বয়স), ওয়াজ সিরিয়াসলি ইল্‌ উইথ… (কাল্পনিক রোগ) অ্যান্ড ওয়াজ আন্ডার মাই ট্রিটমেন্ট ফ্রম…’

হ্যাঁ, ‘ফ্রম’! এই শব্দটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘ফ্রম’-এর ওপরেই নির্ভর করে, কত হবে দক্ষিণার পরিমাণ। পেশেন্টের, থুড়ি, ‘খদ্দের’-এর নাম-ঠিকানাটুকু শুনেই খসখস করে বাঁধা-গতের ওই প্রথম বাক্যটা লিখতে শুরু করেন ডাক্তার। কত সহস্রবার যে লিখেছেন ওই একটা বাক্য! প্রথম অংশটা প্রায় নিমীলিতচক্ষেই লিখে ফেলেন, তারপর ব্রেক কষেন ওই একটা শব্দে – ‘ফ্রম’।

চোখে জিজ্ঞাসা ফোটে অতঃপর। ‘ফ্রম…?’ মানে কতদিনের অসুস্থতা চাই? সার্টিফিকেট-প্রত্যাশী ব্যক্তি হয়তো উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে, সাত তারিখ থেকে।’ ডাক্তার লিখলেন, ‘ফ্রম দ্য সেভেন্থ…’। আবার ব্রেক। ‘কোন্‌ মাসের সাত তারিখ হে?’ খদ্দের একটু চমকায়, ভাবে, বাপ্‌রে, চাইলে যে-কোনও মাসেরই সাত তারিখ থেকে লিখে দিতে রাজি না কি? চার মাস, ছ’মাস, আট মাস… যা বলা হবে টানা কভার করে দেবেন ভবানী ভাণ্ডারী?

অবাক হওয়ার তখনও বাকি। মাসের নামটি বলে দেওয়ার পর, ডাক্তার পেন থামাবেন আবার। ‘কোন্‌ সাল?’

অর্থাৎ, সেটিও প্রয়োজনভিত্তিক! যেমন অর্ডার হবে, খসখসিয়ে লিখে দেওয়া যাবে! চাইলে, টানা আট-দশ বছর ধরেই এই রুগি তাঁর চিকিৎসাধীন ও শয্যাশায়ী, এমন সার্টিফিকেটও নির্বিকার মুখে লিখে দেবেন ভাঁড়ে-মা-ভবানী ডাক্তার! হ্যাঁ। অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ তো! শুধু, যত বেশিদিনের ‘কভারেজ’ দেবেন ডাক্তার, দক্ষিণাটি হতে হবে সেই অনুপাতে পুরুষ্টু!

দক্ষিণা নিয়ে অবিশ্যি সুলেখক ঘটিরাম গুপ্ত ভাবিত নন। তাঁর আজকের প্রয়োজনটি অতি সামান্য। একখানা সার্টিফিকেট দরকার বটে, কিন্তু বছর তো নয়ই, এমনকি মাস-সপ্তাহও নয়, মাত্তর একটি দিনের মকদ্দমা। আরও নিখুঁত করে বললে, একটা রাত। জাস্ট গতকাল, মানে এই এপ্রিল মাসের চব্বিশ তারিখটির সন্ধে থেকে মাঝরাত, ব্যস্‌, যথেষ্ট!

ঘটি গুপ্তকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন যে, তিনি প্রথমে ছোটখাটো টিউশনি করেই পেট চালাতেন। কিন্তু লিখিয়ে হিসেবে নামডাক হওয়ার পর একখানা পাকাপোক্ত চাকরি জুটেই গেছে তাঁর। বিখ্যাত পত্রিকা ‘দৈনিক ধুরন্ধর’-এর সঙ্গে ঘটি যুক্ত আছেন গত ক’বছর। সাংবাদিকের চাকরি। যদিও, সাংবাদিক হিসেবে তেমন কিছু বেশি ঝক্কি তাঁর ঘাড়ে চাপানো হয় না; রিপোর্ট-টিপোর্ট নয়, ফিল্ড ডিউটিও নয়, এডিট-ফেডিটও তত নয়। তিনি মনের সুখে নিজের লেখাই লেখেন বেশি। ওই কাগজেরই রোববারের পাতায় তাঁর হাড়কাঁপানো গল্প ও লোম-খাড়া-করা ডিটেকটিভ-ধারাবাহিক বেরোয়, ওই হাউসেরই ‘পাক্ষিক হাঁউমাঁউ’ পত্রিকা তাঁর পিলে-চমকানো ডাকিনী-আখ্যান আর ধুন্দুমার ডার্ক-ফ্যান্টাসি-উপন্যাস ছাপে নিয়মিত। ইদানীং তাঁর জনপ্রিয়তার ঠেলাতে ম্যাগাজিনের বিক্রিও বেড়েছে বেশ। দিন-আনা দিন-খাওয়া বাস্তব জীবনের সাদামাটা হাসি-কান্নার প্যানপেনে গপ্প-লিখিয়েদের যাবতীয় বাজারকে একেবারে মিয়োনো মুড়ির মতো ফিউজ করে দিয়ে, ঘটির রোমাঞ্চ-আখ্যান আর অন্ধকার-সাহিত্যই এখন বইপাড়ার গরম কচুরি। এবং সেটা নিয়ে ঘটির দেমাকও ওই কচুরির মতোই ফুলে থাকে ইদানীং; বাস্তববাদী সাহিত্যকে ‘কল্পনাহীন থোড়-বড়ি’ বলে তিনি ব্যঙ্গবিদ্রুপও করেন রীতিমতো।

দিব্যি কাটছিল। আচমকাই এক বিড়ম্বনা এসে হাজির হয়েছে। ওপরতলায় রদবদল। কী পোকা নড়েছে মাথায় কে জানে, পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ঢালাও হুকুম জারি করেছেন, বেতনভুক সব জার্নালিস্টকেই সপ্তাহে একদিন নাইট-ডিউটি দিতে হবে! কপি-এডিট, অনুবাদ, তাৎক্ষণিক কলমবাজি, পেজ-ছাড়া, সব কাজে হাত লাগাতে হবে। সে তুমি ঘটি বাটি কলসী যে-ই হও! পালা করে একদিন রাত-জাগতেই হবে আপিসে। কী স্বৈরাচার! ব্যাজার মুখে প্রথম সপ্তাহটা ডিউটি দিয়ে এসেছেন ঘটিরাম। সন্ধের ঝোঁকে যখন সব নিত্যযাত্রী ঘরে ফিরছে, ডার্ক-হরর-কিং ঘটি তখন লাস্ট ডাউন লোকালটা ধরে উল্টোবাগে রওনা দিয়েছিলেন। এইসময় কেউ চাকরি করতে বেরোয়, ছ্যাঃ! যেন চোরের ডিউটি! চাকর-জীবনে ভারি বিরক্তি লেগেছিল।

সেই বিরক্তির প্রভাবেই কি না কে জানে, দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঘটে গেল চিত্তির কাণ্ড! গ্রীষ্মের বিকেলে হাল্কা মেঘ আর ফুরফুরে হাওয়া – দোতলার দক্ষিণের জানলার কাছে ইজিচেয়ারে বসে এমন চোখ জুড়ে এল ঘটিরামের – সে চোখ খুলল একেবারে রাত সাড়ে আটটায়! শহরগামী লাস্ট লোকাল বেরিয়ে গেছে, আর যাওয়ার উপায় নেই। নাইট ডিউটি মিস্‌!

বাকি রাত বাড়িতেই নাইট-ডিউটি হয়ে গেল ঘটিবাবুর। মানে, জেগেই কাটালেন একপ্রকার! উদ্বেগে পায়চারি করলেন ঘরময়। কাল তো ফের যেতে হবে অফিস। গোমড়ামুখো জমরাল-ভুরু সম্পাদক পঞ্চভুজ চাকলাদার ওরফে প.চা-পঞ্চুর মুখোমুখি হতে হবে। কৈফিয়ত পেশ। প্রায় রয়েল বেঙ্গলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সমান। ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে পচা-পঞ্চু হলেন ঘটির আতঙ্ক-সাহিত্যের চেয়েও তিড়িতঙ্ক-জাগানেওয়ালা। জঁর-শাহেনশা বা থ্রিলার-নৃপতি বলে কোনও মক্কেলের ছাড় নেই সে চৌকাঠে।

সারা রাত ভেবে, ভোর নাগাদ সমাধানের রাস্তাটা বের করতে পেরেছেন ঘটি গুপ্ত। নান্য পন্থাঃ, মানে একটাই পথ! আগে কখনও নিজের জন্য দরকার হয়নি, কিন্তু লোকমুখে তো প্রচারিত হয়েই আছে সে ব্যক্তিটির সুনাম, যিনি এইসব ক্ষেত্রে নিমেষে উদ্ধার করতে পারেন! চেনা লোক। পাশের পাড়াতেই থাকেন, পথে-ঘাটে দেখাও হয় কালেভদ্রে, চুনো মাছ বা কুলেখাড়া কেনার সময় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এক আধটা কুশল-বিনিময়ও।

আজ ঘটি গুপ্তর মসিহা হবেন সেই ভাঁড়ে-মা-ভবানীই। এক রাতের ‘অসুস্থতা’র সার্টিফিকেট লিখে দেবেন রেজিস্টার্ড ডক্টর বি. ভাণ্ডারী। ঘটি আজ স্ট্রেট সেই কাগজ ফেলে দেবেন সম্পাদকের টেবিলে। পচা-পঞ্চুর চোদ্দপুরুষের মধ্যে কারও কিছু বলার নেই। আইনের ছাড়। ব্যস্‌!

অতএব, সাতসকালেই রোমাঞ্চ-সম্রাট ঘটিরাম গুটি গুটি চলেছেন ভবানী-সন্দর্শনে।

ভবানী ডাক্তারের চেম্বারে ভিড় তেমন থাকে না। তাঁর তো ঝটিতি-কারবার, কুইক অ্যাকশন। পার কাস্টমার তিন মিনিট। সুতরাং লাইন-জ্যামের অবকাশ নেই। ঘটিবাবু বেশ নিশ্চিন্তচিত্তেই পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন।

কিন্তু, এ কী ব্যাপার? ডাক্তারের চেয়ারে ইনি কে বসে? স্টেথোটি গলায় ঝুলছে ঠিকই, কিন্তু গোলগাল ভাঁড়ে-মা-ভবানী হঠাৎ রোগা হয়েছেন নাকি? ডাবের মতো পুরুষ্টু মুখখানা এমন চিমড়ে ঝুনো-নারকোল হল কবে? গায়ের হাকুচ কালো রঙটাও যেন কয়েক পোঁচ ফর্সা দেখাচ্ছে! মাথায় চকচকে টাক ছিল, সেখানে কীভাবে ঢেউ-খেলানো চুল… আর থ্যাবড়া নাকটা এমন খাড়া হয়ে উঠল কোন্‌ ম্যাজিকে, ঘটিবাবুর মাথায় ঢুকছিল না! হতভম্বের মতো তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।

‘কী, অবাক হচ্ছেন বুঝি?’

ভবানীচরণের সেই খসখসে গলাটাও পালটে কেমন খ্যানখেনে হয়ে গেছে! আমতা-আমতা করে ঘটিরাম বলেন, ‘না, মানে, ইয়ে… অনেক বদল দেখছি যে…’

খ্যাঁকখ্যাঁক করে একটা নতুন রকমের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, ‘বদলা নয়, বদল চাই! হেঁ হেঁ! সারা রাজ্যে বদল, সারা দুনিয়ায় বদল, সবাই বলছে বদল আনো! শুনতে পান না? বিপ্লব বিপ্লব করে চেল্লাচ্ছে দিনরাত। তা বিপ্লব মানে কী? চেঞ্জ, তাই তো?’

‘আজ্ঞে, তা তো একপ্রকার…’

‘তব্বে! সব চেঞ্জ হবে, নিজের চেহারাটিই কি শুধু একরকম থেকে যাবে জীবনভর? আনলুম একটু বদল। ইনকেলাব জিন্দাবাদ, হেঁ হেঁ! মাথায় হেয়ার উইভিং করালুম, ওজনটা কমালুম লাইপোসাকশন করে, ছোট্ট প্লাস্টিক সার্জারিতে নাকটাও মেরামত হল। আর, চামড়াতে লাগিয়ে দিলুম একটা মেলানিন রিডাকশন ট্রিটমেন্ট… রঙটা দেখেছেন? ভোল বদলে গেছে না?’

‘তা… ইয়ে, ভয়েসটাও কি…’

‘আলবাৎ! বড় কর্কশ শোনাত নিজের কানেই। ভোকাল কর্ডের একটু আপগ্রেডেশন করাতেই দেখুন, কেমন মিষ্টিমধুর টেনর বেরোচ্ছে… এক্কেরে শচীনকর্তার মতো!’

ঘটিবাবু বসলেন। মাথাটা একটু ভোঁ ভোঁ করছে। সার্টিফিকেটখানা এখন ভালয়-ভালয় পেলেই হয়। সে সিস্টেমটায়, আশা করা যাক, কিছু পরিবর্তন হয়নি!

না-বলতেই যেন মনের কথাটি বুঝে ফেলেছেন ডাক্তার। চোখ মটকে একটু হাসলেন, তারপর বললেন, ‘না না, ঘাবড়াবেন না। যা চান তা পেয়েই যাবেন!’

বিগলিত গলায় ঘটি বললেন, ‘আজ্ঞে, আমার কেস অতি সিম্পল এবং টাটকা। জাস্ট ওয়ান নাইট!’

টেবিলে রাখা চশমাটা নাকে চাপালেন ভাণ্ডারীর নব-সংস্করণ। চশমাটা যেন চেনা-চেনা, মনে হল ঘটিবাবুর, সেই পুরনোটাই। এটা তবে বিপ্লবের বাইরেই রয়ে গেছে!

ডাক্তার সেই চশমার ভেতর দিয়েই আধ মিনিট খুঁটিয়ে দেখলেন ঘটিরামকে। তারপর কাঁসি-গলাটাকেই যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললেন, ‘কী অসুখ?’

‘মানে?’

‘গোটা একটা রাত্তির, ফ্রম ইভনিং টু ডেব্রেক যে আপনি শয্যাশায়ী ছিলেন বলে আমি লিখে দেব, তা অসুখটা কী? চয়েজ করুন!’

ঘটি গুপ্ত হাঁ করে রইলেন কিছুক্ষণ।

‘চয়েজ? মানে, কী অসুখ… সেটা আমাকেই বলে দিতে হবে?’

‘ইয়েস!’ ওপ্রান্তে হলদেটে দাঁত বেরোল কয়েকটা, ‘এইটা নতুন সিস্টেম চালু করেছি। চেঞ্জ হয়ে গেছে এইটুকু নিয়ম। যিনি সার্টিফিকেট চাইবেন, তিনিই রোগ বেছে দেবেন। আমি সেই অনুযায়ী লিখব।’

‘মহা মুশকিলের চেঞ্জ,’ ঘটিবাবু ঘেমে উঠলেন, ‘আপনিই একটা সাজেস্ট করে দিন না স্যার… মানে সহজ কিছু…’

‘ও নো নো! সহজ বলে কিছু নেই। রোগ আবার সহজ কী, অ্যাঁ! আপনিই পিক্‌ আপ করে নিন আপনার পছন্দসই কোনটা। ইয়া-রোগ, না টিস্‌-রোগ…’

‘ইয়া… টিস্‌…! এসব কী রোগ?’

‘ধুর মশাই। আপনি মাথামোটা আছেন দেখছি! রোগ দু-রকমের, জানেন না? ইয়া দিয়ে শেষ, না হলে টিস্‌ দিয়ে! একদিকে ম্যালেরিয়া ডাইরিয়া পায়োরিয়া অ্যানিমিয়া নিউমোনিয়া লিউকেমিয়া ডিপথেরিয়া ফাইলেরিয়া… অন্যদিকে ম্যানিনজাইটিস কঞ্জাংটিভাইটিস জিঞ্জিবাইটিস এনসেফেলাইটিস পেরিক্রোনাইটিস পলিনিউরাইটিস…’

‘ওরেব্বাপ্‌রে, থামুন থামুন!’ ঘটি আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘আমার মাথা ঘুরছে মশাই! একটা মাত্তর রাত, তার জন্যে গোটা ডাক্তারি-শাস্ত্রের গন্ধমাদন তুলে আনছেন…’

‘বলেন কী!’ টেবিলের ওপারে কাঁসি-ভাঙা কণ্ঠে পাল্টা তেড়ে ওঠেন ভবানী, ‘এক রাত বলে কি হেলাফেলা করার বিষয়? ক্রাইম ইজ ক্রাইম! দশ টাকার পকেটমারিই বলুন আর লাখ টাকার তহবিল তছরুপ, ধরা পড়লে লক-আপে ঢুকতেই হবে কি না? সুতরাং, জালজোচ্চুরি করতে গেলে আটঘাট বেঁধেই করতে হয়। আগেকার জমানা আর নেই বুঝলেন, যে এলেন আর সঙ্গে সঙ্গে হাতে-গরম জালি কাগজ নিয়ে চলে গেলেন! এখন দুর্নীতিদমন বিভাগ খুব সজাগ, আমাকেও অনেক কিছু ভেবে-সমঝে তবে কাজ করতে হয়। পদে-পদে বিপদের ভয় আছে। আপনারও, আমারও!’

‘ক্‌-কী রকম…?’

‘ধরুন, এই-যে আপনাকে আমি ফল্‌স সার্টিফিকেটটি লিখে দেব… তারপর আপনার অফিসের বড়কর্তা যদি আপনাকে বসিয়ে জেরা করেন? সব রোগলক্ষণ জানতে চান যদি, ডিটেইলসে? এমনকি মনে করুন যদি অন্য ডাক্তারকে দিয়ে ক্রস-চেক্‌ করান, সত্যি সত্যি সিনড্রোম মিলছে কি না…! আপনার তো হয়নি কিচ্ছুটি, পাঁচ মিনিটের ইনভেস্টিগেশনেই বেঘোরে ফাঁসবেন!’

বিস্ফারিত চক্ষে ঘটি গুপ্ত বলেন, ‘এ-এমনও হ-হয় নাকি?’

‘আগে হত না, এখন হচ্ছে মশাই। এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়! জালি কেস ধরা পড়লে বিশাল হ্যাপা, থানা-পুলিশ পর্যন্ত! ডকুমেন্ট-ফোর্জারির মামলা, আন্ডার সেকশন ফোর-টোয়েন্টি, জানেনই তো! আপনি আমি দুজনেই ফেঁসে যাব। তাই, আমাদের এই কাজটা যাতে ফুল-প্রুফ থাকে— তার জোগাড়জন্তর আগে থাকতে করে রাখা চাই। উপযুক্ত প্রিপারেশন দরকার…’

‘কেমন প্রিপারেশন…?’ ঘটির বাঁও মিলছে না।

অমায়িক হাসলেন ভাঁড়ে-মা-ভবানী, ‘খুবই সরল ব্যাপার। আপনি আপনার অসুখ চয়েজ করবেন। আমি ঠিক সেই-অনুযায়ী আপনাকে একটা স্পেশাল ইনজেকশন দিয়ে দেব। যাতে, আজকেই আপনার মধ্যে সেই অসুখটার সব লক্ষণ ধরা পড়ে। তাহলেই আর ফাঁসার চান্স রইল না। মানে, ধরুন আপনি ম্যালেরিয়া বেছে নিলেন! এবার তবে আপনার শরীরে সুঁই ফুঁড়ে আমি অবিকল ম্যালেরিয়া-রুগির লক্ষণ তৈরি করে দেব। অফিসের বড়বাবু কোন্‌ ছার, মেডিকেল বোর্ড পর্যন্ত ঘোল খেয়ে যাবে।’

‘বলেন কী!’ ঘটিরাম খাবি খাচ্ছেন, ‘সুস্থ শরীরে ইনজেকশন ঢুকিয়ে রোগ-লক্ষণ বানাবেন! আমি তো ফল্‌স সার্টিফিকেটের জন্যে এসেছি, আপনি সত্যি-সার্টিফিকেট করে দিতে চাইছেন!’

‘সত্যের জন্যে সব কিছু ত্যাগ করা যায়, শাস্ত্রেই বলেছে, শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ!’ উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত দু-দিকে প্রসারিত করে ধর্মবেত্তার মতো বললেন শ্রীভবানী, ‘কিন্তু উল্টোদিকে… পরিত্রাণায় সাধুনাং, মানে কোনও কিছুর জন্যেই সত্যকে ত্যাগ করা চলে না! এদিকে ক্বশ্চিৎকান্তা বিরহগুরুনা, অর্থাৎ মিথ্যের পিছনে তো সারাটা জীবন ছুটলেন। তাহলে আসুন, বাসাংসি জীর্ণানি, যাকে বলে, অন্তত একবার সত্যের ছুঁচ শরীরে নিন!’

ড্রয়ার খুলে একটা সিরিঞ্জ বের করে ফেলেছেন ডাক্তার! সঙ্গে একটা সবজেটে তরলে ভরা ভায়াল। কাংস্যবিনিন্দিত গলায় বলছেন, ‘কিচ্ছু লাগবে না! এই দেখুন ‘ম্যালেরিয়া-সিন্ড্রোম সিরাম’। একদম এক্সক্লুসিভ জিনিস, আমার নিজস্ব উদ্ভাবন। টুকুস করে ঢুকিয়ে, আলতো পুশ! তারপরই দেখবেন কেমন হুবহু ম্যালেরিয়া-রুগির মতো কাঁপুনি দিয়ে… হেঁ হেঁ! কোন্‌ বড়বাবু কোন্‌ এমবিবিএস কোন্‌ সিআইডি আমার সার্টিফিকেটকে জাল বলে, কার বুকের পাটা আছে… দেখবেন তো একবার! হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলিয়ে তবে ছাড়ব… ও কী, আপনি এখন থেকেই এলিয়ে পড়ছেন যে! আরে এখনও ইঞ্জেকশন রেডিই করিনি তো, সবুর করুন, অ মশাই…’

ঘটিবাবুর মাথা টেবিলের ওপর। সারাজীবন বানিয়ে-বানিয়ে ভয়াল ভয়ঙ্কর চুল-খাড়া উদ্ভট গপ্পো লিখেছেন, কিন্তু এমন আতঙ্কের বাস্তব কল্পনাও করতে পারেননি! এ তো ডার্ক ফ্যান্টাসির বাবা, ম্যাকাবরের জ্যাঠা, স্পেকুলেটিভ ফিকশনের শ্বশুর! হাতের তেলো পায়ের চেটো ঠান্ডা হিম। বনবন করে ঘুরছে ডাক্তারখানার দেয়ালগুলো! বাহ্য জগৎ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সামনে মাইল মাইল সর্ষের ক্ষেত… তারপর নিকষ অন্ধকার! ব্ল্যাক আউট! ম্যালেরাইটিস জিঞ্জিথেরিয়া ফাইলেবাইটিস কনজাংটোনিয়া সব একসঙ্গে অ্যাটাক করেছে! ঘটিবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমবাহের স্রোত। এ যেন তাঁরই কলমের প্রোডাক্ট যত পিস্তলধারী মাফিয়া, নেকড়ে-রূপী পিশাচ, রক্তচোষা ডামরী আর স্কন্ধকাটা প্রেত চারদিক থেকে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে তাঁর দিকে।

মুখে-চোখে জলের ঝাপটা পেয়ে আবার তাকালেন ঘটিবাবু। এবং, তাকিয়েই, থ বনে গেলেন!

কে বসে তাঁর সামনে? ডাবমুখো নাদুসনুদুস, টাকমাথা, থ্যাবড়া নাক, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ – হ্যাঁ, এই তো আগমার্কা ভাঁড়ে-মা-ভবানী ডাক্তার!

‘এখন সুস্থ লাগছে তো?’

আহ্‌, গলাখানাও সেই কাঠ-চেরাইয়ের মতোই! কোনও সন্দেহ নেই ইনিই হচ্ছেন অরিজিনাল!

তাহলে… ফল্‌সটি কোথায় গেল? সেই লাইপোসাকশন মেলানিন ট্রিটমেন্ট আর ভোকাল কর্ড আপগ্রেডেশনের আষাঢ়ে গপ্পো-ফাঁদা দু-নম্বরি চীজ? খড়্গনাসা কাংস্যকণ্ঠ সেই ঝুনো-নারকোল?

মনের কথা পড়ে ফেলেই বুঝি, কাঁচুমাচু গলায় আসল ভবানীচরণ বললেন, ‘ভেরি সরি, বুঝলেন! উনি… মানে উনি হলেন গিয়ে… আসলে, আমার পিসতুতো ভায়রাভাই! পণ্ডিত মানুষ, কিন্তু রিসেন্টলি মাথাটায় একটু গণ্ডগোল হওয়াতে আমার এখানে এনে রাখা হয়েছে, বড় সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হবে। এমনিতে ঠিকই থাকেন, মাঝে মাঝে একটুখানি নেগেটিভ-পজিটিভ হয়ে যায়, বুঝলেন কিনা! ডিসপেনসারিটা খোলা রেখে জাস্ট মোড়ের মাথায় একটু বাজার করতে গেছি… ওমনি কোন্‌ ফাঁকে ভেতরের ঘর থেকে… ইয়ে, আপনাকে খুব হ্যারাস করেছেন বুঝি?’

ঘটিরাম ধাতস্থ হয়েছেন কিঞ্চিৎ। একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘নাহ্‌, ওই একটু আর কী! লোক বড় জাঁদরেল। …সে যাক, একটা সার্টিফিকেট যে দরকার ছিল, সেটা পাব কি?’

‘বিলক্ষণ পাবেন! হে হে,’ লজ্জিত মুখেই হাসলেন ডাক্তার, ‘ইয়ে… যা ভোগান্তি হল আপনার, বুঝতেই পারছি… আর ফী দিয়ে আমাকে লজ্জা দেবেন না, কেমন? এক্ষুনি লিখে দিচ্ছি, নিয়ে যান। শুধু বলুন, কোন্‌ তারিখ থেকে দরকার… কোন্‌ মাস… কোন্‌ সাল!’

যাক, সব আগের মতোই আছে! ঘাম-জ্যাবজেবে পাঞ্জাবিটি এখন বেশ শীতলতা দিচ্ছে বটে। ঘটি গুপ্ত স্বস্তির হাসি হাসলেন এতক্ষণে। ফল্‌স ডাক্তার তাঁকে অরিজিনাল সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিল। এখন অরিজিনাল ডাক্তারের হাতে ফল্‌স সার্টিফিকেটটি পেয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হবেন।

তবে, জ্যান্ত বাস্তব যে বানিয়ে-তোলা হররের চেয়েও হরিবল, থ্রিলারের চেয়েও থ্রিলারার হতে পারে, তা আজ ঘটিবাবু গাঁটে-গাঁটে টের পেয়েছেন। আর রিয়েলিস্টিক স্টোরিকে খিল্লি নয়, বাপ রে বাপ! ট্রুথ ইজ… কী যেন বলে… স্ট্রঙ্গার দ্যান ডার্ক ফিকশন!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *