short-story-ekti-mrityur-dai

একটি মৃত্যুর দায়
বিতস্তা ঘোষাল


অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রুমি। মনটা দুর্বল হচ্ছে ক্রমশ। কী ভালো মানুষের মতো মুখ করে ঘুমিয়ে আছে পাশ ফিরে। যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না! একবার ভাবল ফিরে যাই। পরমুহূর্তে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। আজ কোনওভাবেই ছেড়ে দেব না। আর নয়। অনেক বছর, অনেক দিন ধরে সহ্য করে আসছি। এবার হয় তুমি – নয় আমি। একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব, ভাবতে ভাবতে মুখটা তার মুখের কাছে নিয়ে গেল। নাকের সামনে হাত রাখলো। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক। ঘুমের ওষুধ খেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সত্বেও টের পাচ্ছে না তার উপস্থিতি। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল রুমি। তারপর বালিশটা নিয়ে মুখের উপর চেপে ধরল। এবার সে ছটফট করছে। চোখটা ক্রমশ বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে, আর একটুখানি সময় সোনা। তারপর তুমি মুক্ত। স্বাধীন। চিরকালের জন্য মুক্তি তোমার। আমারও মুক্তি দিনের পর দিন তোমার তিল তিল করে দেওয়া যন্ত্রণা থেকে। জানি ধরা পড়বই। তবু তোমাকে এবার যেতেই হবে। বালিশটা আরও কিছুক্ষণ চেপে রইল রুমি। ধীরে ধীরে ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেল।
মৃত্যু নিশ্চিত করতে রান্নাঘর থেকে কুটনো কাটার ছুরিটা নিয়ে এল। এলোপাথাড়ি চালাতে যাচ্ছে, তখনি মোবাইল বেজে উঠল।

চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না রুমির। মৃত্যুটা শেষ অবধি…
‘মা ও মা ফোনটা ধরো। বেজেই চলেছে। বন্ধ রাখতে পারো না!’ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল টুপুর। বলে বালিশ কানে চাপা দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুলো।
কোনওরকমে চোখ খুলে মোবাইলটা মাথার পাশে রাখা কম্পিউটার টেবিল থেকে ধরতে গেল রুমি। তার আগেই সেটা কেটে গেছে ।
‘বাঁচা গেল’, বলে রুমি বালিশে মাথা রাখল।
মোবাইল আবার বেজে উঠলো। দূর বাবা! মাঝরাতে কে! নির্ঘাত কোনো রঙ নাম্বার। আমি কি অমুকের সঙ্গে কথা বলছি কিংবা কী করছ সুইট হার্ট! ঘুমিয়ে গেছিলে! কত করে বললাম রাতে ফোন কোরো। এতক্ষণ অপেক্ষা করে আমিই বাধ্য হয়ে করলাম। কাল আবার অফিস আছে তো! সারা রাত জেগে থাকলে চলবে আমার!
এসব প্র্যাঙ্ক-কলের উৎপাতে রাতে শোবার আগে ফোন অফ করেই শুতো রুমি। কিন্তু গতবছর কাকু মাঝরাতে মারা গেলে এর জন্যেই জানতে পারেনি।
ল্যান্ডফোনও নেই যে সেখানে ফোন করে জানানো যাবে। অথচ সে ছাড়া কেই বা আছে কাকু কাকিমার। নিঃসন্তান কাকুর একমাত্র কাছের মানুষ সেই। শেষ অবধি পুলিসের লোক এসে কলিংবেল বাজিয়ে জানিয়ে গেল কাকুর মৃত্যু সংবাদ। তারপর থেকে মোবাইল খোলাই রাখে সে।
চোখ ভালো করে না খুলেই ফোন ধরে জড়ানো গলায় বলল, ‘হ্যালো?’
‘নমস্কার ম্যাডাম। এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি লালবাজার থেকে বলছি।’
ওদিকের কথা শেষ হবার আগেই রুমি বলল-
‘এত রাতে গাড়ির ফাইন দিতে পারব না দাদা। কাল সকালে জমা করে দেব। নোটিশ পেয়েছি।’
‘ম্যাডাম, অন্য বিষয়ে কল করছি। ফাইনের বিষয়ে নয়।’ অন্য প্রান্ত ঠান্ডা কন্ঠে বলল।
‘ও। তাহলে প্লিজ আমার হ্যাজব্যান্ডকে ফোন করে নিন।’
‘তিনি কি বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ, থাকার তো কথা। ধরুন ডাকছি।’
এতক্ষণে ঘুমটা কাটছে রুমির। ফোনটা কানে নিয়েই পাশের ঘরে গেল। বিছানা ফাঁকা। সুতপা একাই শুয়ে আছেন। তবে কী?
এবার মেয়েকে ডাকল। ‘এই টুপুর বাবা ফেরেনি?’
ঘুম ঘুম চোখে টুপুর বলল, ‘আমি তো দরজা খুলিনি। দেড়টা অবধি জেগে ছিলাম। আসেনি।’
‘ও’, বলে রুমি ফোনে বলল- ‘শুনুন তিনি এখনো ফেরেননি।’
‘ম্যাডাম, আপনি কাইন্ডলি আমার কথা এবার শুনুন। একটু আগে বাইপাসে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। প্যাসেঞ্জারদের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তাঁদের হাসপাতালে এমারজেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একজনের গলায় ঝোলানো কার্ডে লেখা নীলাঞ্জন ভাদুড়ি। তাঁর ফোন লিস্টে লাস্ট এসএমএসটা দেখে আপনাকে ফোন করছি।’
‘হ্যাঁ। তিনি আমার হ্যাজব্যান্ড।’ খুবই শান্ত গলায় বলল রুমি।
‘মা, বাবার কী হয়েছে?’ টুপুর ঘুম থেকে ধড়মড় করে উঠে বসে হাত থেকে ফোন নিয়ে নিল। ‘হ্যালো, আমি নীলাঞ্জন ভাদুড়ির মেয়ে। বাবাকে কোথায় ভর্তি করা হয়েছে? বাবা ঠিক আছে তো?’
‘ম্যাডাম আপনারা যদি একটু তাড়াতাড়ি চলে আসেন তবে সুবিধা হয়।’ বলে ঠিকানাটা বলে দিলেন অফিসার।
রুমি এতক্ষণে ঘরের আলো জ্বালালো। হঠাৎ করে চোখে আলো পড়ায় একটা অসোয়াস্তি অনুভব করল। চোখটা কয়েক মুহূর্ত বন্ধ করে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে কথা ভেবে নিল।
‘ও মা কী করব? ড্রাইভার ডাকব?’ টুপুর অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘দাঁড়া, দাদাকে ফোন করি। তবে ধরবে কিনা জানি না। তুই ড্রাইভার না দেখে ট্যাক্সি পাস কিনা দেখ।’
পিঁ পিঁ পিঁ রিং হচ্ছে। দেবব্রত ফোন ধরল। ‘কিরে এত রাতে! কী হল?’
‘সরি দাদা, তোর ঘুম ভাঙালাম। নীলাঞ্জনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। এইমুহূর্তে লালাবাজার থেকে জানালো।’
‘সেকী! আসছি এখনি।’ বলে কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখল দেবব্রত। ঘড়ি দেখল, আড়াইটে। একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে গাড়ি বের করল। একটাই বোন তার। রুমি। পারস্যের কবি জালাল উদ্দিন রুমির নামে বাবা নাম রেখেছিল। রুমি অবশ্য জালাল উদ্দিনের কবিতা পড়েছে কিনা জানা নেই। বাবাও নেই কত বছর হয়ে গেল।
কিন্তু এত রাতে নীলাঞ্জন কোথা থেকে ফিরছিল? সেতো গাড়ি নিজে চালায় না। ড্রাইভার আছে। তবে!
মাথার একঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে দেবব্রত মিনিট কুড়ির মধ্যেই রুমির বাড়ির কাছে এসে কল করল। ‘নেমে আয়। এসে গেছি।’

রুমি আশ্চর্যরকম শান্ত। দেবব্রত জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গেছিল? এত রাত অবধি বাইরে কী করছিল?’
‘জানি না।’ বলে সে চুপ করে বাইরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
গাড়ি এখন বাইপাসে। বাইরেটা দেখতে দেখতে রুমি বলল, ‘ভোরের কলকাতা পুরো অন্যরকম, বল দাদা। তোর মনে আছে আমরা কতদিন গাড়ি নিয়ে মাঝরাতে নতুন ব্রিজ তৈরি দেখতে চলে যেতাম! নদীর উপর দিয়ে কেমন লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যেত চারপাশে, জলে সেই ছায়া আন্দোলিত হতো।’
‘হুম।’ দেবব্রতর অবাক লাগছে বোনের মুখে এখন এসব শুনে। বরাবরই খুব ভীতু সে। কারোর সামান্য কিছু হলেই কান্নায় ভেঙে পড়ত। অথচ নীলাঞ্জনের বিষয়ে একটা কথাও বলছে না। চোখে কোনও জল নেই।
সে বলল, ‘টুপুর বাবার সঙ্গে কখন কথা হয়েছিল তোদের?’
বাবাকে লাস্ট ফোন করেছিলাম সাড়ে বারোটায়। বাবা ধরেনি। কখনোই বাইরে থাকলে ফোন ধরে না বলে আমি করি না। মা’ই বারবার ‘ফোন করো, দেখো বাবা কোথায় আছে’ – জানতে চায় বলে বাধ্য হয়ে করি।
অধিকাংশ দিনই মা জেগে থাকে। আমি বড়জোর দেড়টা অবধি জেগে তারপর শুয়ে পড়ি। মায়ের বেশি চিন্তা। জেগে থাকে আর বারবার ফোন করে।
‘টুপুর চুপ করো। দেখো রাতের শহর কেমন মায়াবী আলো মাখা। কত মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ফুটপাথের উপরেই। ওখানেই তাদের আস্তানা। সারাদিন যেখানে সেখানে কাজ করে রাতে নিজের জন্য বুক করে রাখা মাটিতে শুয়ে পড়ে। কী অদ্ভুত তাই না! কোনো ঘর নেই, বাড়ি নেই। কার বাচ্চা, কে কার বউ, কেই বা কার বর এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই, অধিকারবোধ, ঝগড়া, অশান্তি কিছু নেই। কেমন মিলেমিশে পাশাপাশি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।’
‘এই তুই চুপ করতো! কখন থেকে আলফাল বকে যাচ্ছে। এবার থাম। হাসপাতালে এসে গেছে। নামতে হবে। ওখানে যে কী অবস্থা হয়ে আছে কে জানে!’ দেবব্রত রুমিকে থামিয়ে দিল।
‘দাদা বিরক্ত হচ্ছিস কেন? হয় বেঁচে আছে, নয় নেই। মাঝামাঝি হলে সমস্যা।’
‘মা… তুমি থামো এবার। তোমার বোধহয় মাথাটা কাজ করছে না। মামা চলো ভেতরে যাই।’

টুপুর বুঝতে পারছে না মা এত ঠান্ডা মাথায় কীভাবে কথা বলছে! কারোর কিছু হলেই মা এ ডাক্তার সে ডাক্তার, একে তাকে ফোন করতে থাকে। অথচ আজ কাউকে কিছু জানাচ্ছে না। কী আশ্চর্য রকম শান্ত। তবে কী ভেতরে ভেতরে কিছু চলছে! নির্ঘাত চলছে। সে বইতে পড়েছে মানুষ যখন প্রচন্ডভাবে ভেঙে পড়ে তখন তার বহির্প্রকাশ হয় অন্যভাবে। কেউ অতিরিক্ত বকে, কেউ ঘন ঘন ঝাল দেওয়া খাবার খেতে চায়। কেউ বা চেঁচামেচি করে। মায়েরও তেমন কিছু ঘটছে। সে মামাকে নিয়ে রিসেপশনে গেল।
‘উল্টোদিক থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। ড্রাইভার এখন কোমায়। পিছনের যাত্রী আনার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। নীলাঞ্জনবাবুও একটু আগেই… সরি।’ পুলিস অফিসার ছেলেটি জানালো।

আইসিইউ-এর বাইরের কাচ দিয়ে রুমি মুখটা দেখতে পাচ্ছে। সারা মুখে ব্যান্ডেজ। আহারে! খুব লেগেছিল। সে সহযাত্রীর মুখটা দেখতে চাইল। এবং চমকে উঠল। এখন নাকী এর সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। সেদিনও মৃত বাবার নামে দিব্যি দিয়ে বলল, ‘দেখ জীবনে প্রচুর মহিলা আসবে যাবে। কিন্তু কেউ স্থায়ী নয়। তোমার রানীকে নিয়ে সন্দেহ করাটা এবার বন্ধ করো। আমার কর্মচারী ছিল, এখন মাঝেসাঝে কথা হয়, হাই-হ্যালো… তার বাইরে কিছু নয়।’
রুমি চুপ করে গেছিল। তার আগের দিন রাতেই এক বান্ধবী হোটেল খেতে দেখে ছবি তুলে পাঠিয়ে ছিল নীলাঞ্জন আর রানীর। সে ছবিটা দেখানো মাত্র নীলাঞ্জন চিৎকার করে উঠেছিল। ‘তুমি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছ? খুন করে দেব তোমায়। কোনও প্রমাণ করতে পারবে না। আমার বাড়িতে থেকে আমার পয়সা ধ্বংস করে আমাকেই জেরা করছ? মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব।’

আরও নানা কথা বলে পাশের ঘরে গিয়ে নিজের মাকে বলছিল, ‘কী ছোটোলোক মেয়ে দেখেছ! জানোয়ার একটা।’ বলেই যাচ্ছিল নীলাঞ্জন।
টুপুর বলল, ‘মা তোমার লজ্জা বোধ একবারে নেই। কতবার বলেছি এই দুশ্চরিত্র নোংরা লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাই আমরা। তা না, ভালো লাগে তোমার রোজ রোজ অপমানিত হতে!’
পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি সুতপার গলা ভেসে এল। ‘কী শিক্ষা দিচ্ছে মেয়েকে! বাবার বিরুদ্ধে লাগাচ্ছে। বিয়ের সময়ই মানা করেছিলাম শহরের মেয়ে বিয়ে না করতে। জীবনটা পুরো নষ্ট করে দিল। এর থেকে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করলে টাকা পয়সা পাওয়া যেত, তার সঙ্গে মুখে মুখে চোপা করার সাহস পেতো না। ঝাঁটা মেরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে হয় এসব মেয়েকে।’ টুপুর বলে উঠল, ‘আম্মা কি ভেবেছ! দেশে আইন পুলিস কিছুই নেই! দিয়ে দেখ একবার! দেব থানায় ডায়েরি করে। কে কাকে দূর করে তখন দেখব।’
‘ও নীলু এ কী বলছে শুনছিস? আমাকে নাকি জেলের ঘানি টানাবে! হায় হায়! এমন দিনও এলো! এত লোকের মরণ হচ্ছে, আমার কেন হচ্ছে না…’ সুতপা সুর করে কান্না জুড়লেন।
‘আঃ মা। থামো দেখি। ওদের ক্ষমতা জানা আছে। অত দম থাকলে কবেই যেত! আর ওরা কিছু করলে আমি কী হাতে চুড়ি পরে বসে থাকব!’
‘আম্মা তোমার ড্রামা বন্ধ করো। ছোট থেকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’ বলেই টুপুর ডাক দিল- ‘বাবা দারুণ মারপিট হচ্ছে। এসো দেখি।’
নীলাঞ্জন মায়ের ঘর ছেড়ে বাইরের ঘরে মেয়ের সঙ্গে টিভি দেখায় মন দিল।
সুতপা আরো কিছুক্ষণ রুমিকে শাপ দিয়ে ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

রুমি ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল। এদের মধ্যে কোন মনুষ্যত্ববোধ নেই সে বুঝতে শুরু করেছিল। আরও বুঝেছিল, মা আর ছেলে মিলে মানসিক নির্যাতন করে তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইছে যাতে সে আত্মহত্যা করে। কিন্তু না। রুমি আত্মহত্যা করবে না। সে অল্প অল্প করে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। অবশ্য সে সব প্রতিবাদ মা ছেলের যৌথ আক্রমণে নিমেষে ভেসে যেত।
‘কী অলুক্ষুণে মেয়ে রে বাবা! এখানেই থাকবে, আমার ছেলেরই টাকায় চলবে, আর…’
টুপুর চিৎকার করে উঠত। ‘আম্মা তোমার খাওয়া পরার দায়িত্ব কী তোমার বাবা নিয়েছিল! তুমি তো দাদুর কাছে সারাজীবন নানা বায়না করে যেতে। কই দাদুর মুখে তো এমন কথা শুনিনি।’
‘তোর মায়ের মত চাহিদা আমার ছিল না।’ তিনিও চেঁচাতেন।
‘চাহিদা! চাহিদা কাকে বলে! বাবা মায়ের জন্য কী এনে দেয়?’
‘কেন এই তো ঘুরে এলি। গলার হারটাও আমার ছেলেরই দেওয়া।’
‘আম্মা দুবছর আগে লাস্ট ঘুরতে গেছি। আর হার! সেতো আমি জন্মের সময় থেকেই একই দেখে যাচ্ছি। নতুন কিছু তো দেখিনি এত বছরেও।’
তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকে। রুমি নিজের ঘরে ঢুকে গান চালিয়ে দেয় আর মনে মনে ভাবে কবে যে এসব থেকে মুক্তি পাবে!

নীলাঞ্জন সিটবেল্ট বাঁধেনি? এই গাড়িতে তো এমন ভাবে অ্যাক্সিডেন্টে মরে যাবার কথা নয়। কোনও ধাক্কা লাগলেই সামনের থেকে বেলুনের মতো ফুলে গিয়ে যাত্রীকে সেভ করে দেবে।
দেবব্রতর কথায় রুমি অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘দাদা ও কখনও সিটবেল্ট বাঁধত না। যতবার বলেছি, সামনে বসো, বেঁধে নাও। ততবার বলেছে তার নাকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু নেই। যদি এমন হয় যে একটা প্লেন বা ট্রেন যাচ্ছে, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটল, সবাই মরে গেল, সে একা বেঁচে যাবে। বেশি বললে বলত, অত সহজে তোমাকে মুক্তি দেব না। আগে তোমাকে মারব, তবে মরব। তুমি তো আমার মৃত্যু চাও। কিন্তু সে সাধ তোমার পূর্ণ হবে না।’
‘আজ তোর সঙ্গে শেষ কী কথা হয়েছিল?’
‘রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেনি। অনেকক্ষণ বাদে মেসেজ করেছিল, কাজে আছি। রাত হবে। দরজা খুলে রেখো।’
‘তুই কী প্রায়ই দরজা এভাবেই খুলে রাখতিস?’
‘না। জেগে থাকি। এলে খুলে দিই। আগে বারবার কলিংবেল বাজাতো, সারা ফ্ল্যাটের লোক জেগে যায় বলে এখন বলে রেখেছি ফোন করতে। রিং হলে নেমে গেট খুলে দেব।’

অপঘাতে মৃত্যু। তিনদিনের মধ্যে সব কাজ মিটে গেল। সুতপা শোনার পর থেকেই ক্রমাগত গালাগাল, হুমকি আর বিলাপ করে চলেছে। ‘রাক্ষুসী। আমার ছেলেটাকে খেল। নরকেও ঠাঁই হবে না। পুলিসে দেব ডাইনিটাকে। ও টুপুর চলে আয় আমার কাছে। এবার এ তোকেও খাবে।’
টুপুর এই কদিনের মধ্যেই অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। বলতে গেলে একা হাতেই শ্মশান থেকে শ্রাদ্ধর কাজ সামলেছে দেবব্রতকে সঙ্গে নিয়ে। সে গম্ভীর মুখ করে নিজের কাজে মন দিল।

চতুর্থ দিন নীলাঞ্জনের স্মরণসভা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশীরা নিজেদের মতো করে নীলাঞ্জনকে স্মরণ করছেন। সুতপা সবার সামনেই বলে উঠল, ‘এই মেয়েটাই খুন করেছে আমার ছেলেকে। দিনরাত মানসিক নির্যাতন করত ছেলেটার ওপর। ছেলে আমার সেই কারণে বাড়িই ফিরতে চাইতো না।’
সবাই রুমির মুখের দিকে চেয়ে। ফিসফিস চলছে। রুমি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। মাইকের সামনে গেল। পাশে টেবিলের উপর ফুল দিয়ে সাজানো নীলাঞ্জনের ছবির দিকে খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফেসবুকে শেষ দিন এই ছবিটাই পোস্ট করেছিল সে। ক্যাপশন দিয়েছিল, ‘হয়তো তোমারই জন্য…’।
কার জন্য নীলাঞ্জন! এই রানী বলে মেয়েটার জন্য? কোথায় গেছিলে তুমি তাকে নিয়ে? একেই কি প্রেম বলে? অমর প্রেম? এরকম আর কতজন ছিল তোমার? আমি ছাড়া আর সবাইকেই তুমি এত ভালবাসতে? না, নীলাঞ্জন তুমি কাউকেই ভালবাসতে না। এমনকি নিজেকেও নয়। তুমি আদ্যন্ত স্বার্থপর একটা মানুষ। কিন্তু যদি সম্পূর্ণভাবেই তা হতে তাহলে এভাবে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না। নিজের শরীরটারও খেয়াল রাখতে হত বাবু। ঠিক সময়ে খাওয়া, শোওয়া, ঘুমনো। ডিসিপ্লিন জীবনে খুব প্রয়োজনীয়। নইলে সাফল্য আসে না। সেটা তুমি বুঝতেই চাইলে না।
নিজের মনেই খানিক বিড়বিড় করল রুমি।
তারপর খুব ধীর কন্ঠে শান্তভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি খুনী। রোজ আমি চেষ্টা করেছি নীলাঞ্জনকে খুন করতে। নিত্য নতুন পদ্ধতি ভেবেছি খুনের। বোঝার চেষ্টা করছি কিভাবে মারলে মৃত্যু নিশ্চিত হবেই। এমনকি যেদিন চলে গেল, সেদিনও রাতে আমি ঘুমের মধ্যে তাকেই মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মারার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। মেরেই হয়তো ফেলতাম। কিন্তু ফোনটা এল। আমার হাত থেকে বেঁচে গেল নীলাঞ্জন।’
‘আমি স্বীকার করছি প্রতিমুহূর্তে চেয়েছি সে মরে যাক, কারণ নইলে আমাকে মরতে হতো। কিন্তু প্রতিটা খুনের পিছনে একটা মোটিভ থাকে। সেটা জানা দরকার মা। প্রতিদিন তুমি আর তোমার ছেলে মিলে আমাকে মানসিক নির্যাতন করতে। সামান্য বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মতান্তরে তুমি ভিতরে ঢুকে অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে। যদি শখ করে কিছু চেয়েছি, তুমি বলেছ, এত লোভ কেন তোর! বাবার ঘরে কী ভিখারি ছিলি? কিছু দেয়নি কখনও? বাবার ঘরে মাত্র কুড়ি বছর ছিলাম। তোমার বাড়িতে তিরিশ বছর। একটা দিনও বললে এটা আমারও বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, আমি লোভী। স্বীকার করছি আমার অনেক চাহিদা। এসে থেকে তোমার ছেলের, তোমার ভালবাসা পাবার জন্য ব্যকুল ছিলাম। লোভীর মতো অপেক্ষা করতাম কাজ শেষ করে নীলাঞ্জন ঘরে ফিরে আমার সঙ্গে কখন গল্প করবে। অথচ ছেলে ফেরা মাত্র জল-চা দেবার অছিলায় তুমি তাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যেতে। সারাদিনের গল্প জুড়তে। আমাকে কখনও সে গল্পে ডেকেছ? আমি নিজে থেকে এ বাড়িতে আসিনি। তবু এত অবহেলা! মুখ বুজে সহ্য করেছি সেইসব দিন। ভেবেছি বাচ্চা হলে সন্তানের টানে বাবা মেয়ের পাশে এসে শোবে। সেই সূত্রে আমার সঙ্গেও ধীরে ধীরে একটা যোগ তৈরি হয়ে যাবে। অথচ টুপুর হবার পর তুমি ছেলেকে আমার ঘরে আর শুতেই দিলে না। বাচ্চা বারবার উঠবে, কাঁদবে- তোমার সারাদিনের কর্মক্লান্ত ছেলের ঘুম হবে না।’
‘আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করত এই বাড়িটা নেবার আগে তোমাদের যে বাড়িটা ছিল তাতে তো একটাই ঘর। তোমার ছেলে হবার পর বাবা কোথায় শুতো তখন! নাকি তোমার বাবা তোমার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল! ছেলে দিনের পর দিন বাইরে রাত কাটিয়ে বাড়ি ঢুকেছে, চরম উৎশৃঙ্খল জীবন যাপন করেছে, সংসারের ন্যূনতম খরচ দিতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে ঝামেলা করেছে। আর তুমি কী করেছ মা হিসাবে? ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে তাকে আরও উত্তেজিত করেছ, এত খরচ ছেলে কেন দেবে বলে!’
‘হ্যাঁ মা, আমি মনে মনে অজস্রবার তোমার ছেলেকে খুন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। একটা লোক বাড়ির কাজের লোক, ড্রাইভার, রাস্তাঘাট, আত্মীয় স্বজন, মেয়ে সবার সামনে আমাকে সমানে অসম্মান করেছে, খাওয়াপরা থাকা নিয়ে অপমান করেছে আর আমি তাকে করুণা করে ছেড়ে দিয়েছি। আর তুমি! নিজে একটা মেয়ে হয়েও সেই অপমানে ইন্ধন যুগিয়েছ। আমার কান্না, যন্ত্রণা তোমাকে স্পর্শ করার বদলে আনন্দ দিয়েছে। তুমি ভেবেছ, ছেলের পক্ষে বললে ছেলে তোমার থাকবে। অথচ তুমি বুঝতে পারনি যে পুরুষ নিজের স্ত্রীকে মর্যাদা দেয় না, সে কোনো মহিলাকেই সম্মান দিতে শেখেনি। তুমি তাই টের পাওনি ছেলে আসলে তোমারও ছিল না। দায়িত্ব অস্বীকার করতে করতে সে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেছে। সে বুঝে গেছিল, বউয়ের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক সে রাখতে পারবে না তুমি থাকতে। তাই বাড়ি ফেরা বন্ধ করে দিচ্ছিল।’
‘কাজের নাম করে স্বেচ্ছাচার, উৎশৃঙ্খল জীবন শুরু করে দিয়েছিল। অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তুমি সেখানেও তাকে উৎসাহ যুগিয়েছ। কি না একজন পুরুষের অনেক মহিলার প্রতি টান থাকতেই পারে। আমাদের শাস্ত্রেও লেখা পুরুষ বহুগামী হওয়াটিই স্বাভাবিক। তাতে দোষ নেই। আচ্ছা মা, তোমার বরেরও কী তাই ছিল! আমি দেখিনি। অবশ্য তিনি একজন মেরুদন্ডহীণ পুরুষ ছিলেন। নইলে আমার সঙ্গে করা তোমাদের এত দুর্ব্যবহার তিনি মেনে নিতেন কী করে! ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। না হলে এই দিনটা তাকে দেখতে হত। তা সত্ত্বেও তুমি ঠিক বলেছ, আমি খুনী! তিরিশ বছর ধরে নিজের স্বপ্ন, ভালবাসা, চাওয়া, প্রত্যাশা একটু একটু করে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি। তোমরা নিয়ম করে আমাকে খুন করেছ। আমার শরীরটা আছে। হৃৎস্পন্দন এখনো ধুকধুক করছে। কিন্তু মনটা! সেটা আর নেই।’
‘আমার কোনো অনুতাপ নেই নীলাঞ্জনের মৃত্যুতে। দুঃখও নেই। একটাই আফসোস নিজে হাতে মারতে পারলাম না। আর মেয়েটা পিতৃহীন হল। বাবার স্নেহ মায়া ভালবাসা পরিপূর্ণভাবে না পেলেও ছিল তো একটা সম্পর্ক। যতই আলগা হোক, তবু রক্তের। অস্বীকার তো করেনি কখনও। বরং যতটুকু বাড়ি ফিরত মেয়ের টানেই। তুমি চাইলেও সেটা আটকাতে পারোনি। এটাই চরম সত্যি। কিন্তু প্রকৃত খুনী কে? নিজের সন্তানের কানে প্রতিদিন একটু একটু করে বিষ ঢুকিয়ে তার বাঁচার ইচ্ছেটা কে শেষ করে দিয়েছিল? এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি কেন ঘটল ভেবে দেখো। নিয়তি কে আটকাতে পারে! চেয়েছিলে আমি মরি। কিন্তু জানতে না অন্যের ক্ষতি চাইলে নিজেরই ক্ষতি হয়।
ছেলের মৃত্যুর দায় তুমি অস্বীকার করতে পারবে কী মা?’
এখন গভীর রাত। অতিথিরা সবাই চলে গেছে। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। বিছানায় শুতে এসে রুমি দেখল টুপুর কাঁদছে। সে এসে মাথায় হাত রাখা মাত্র টুপুর জড়িয়ে ধরল। বুকের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল ‘মা আম্মা কবে যাবে! বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দেবে আম্মাকে? প্লিজ দিয়ে দাও। নইলে আমিও একদিন বাবার মতো স্বার্থপর, স্বেচ্ছাচারী, একটা খারাপ মানুষ হয়ে যাব। বাবার রক্ত আমার শরীরেও বইছে। তাকে একদিন হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমি বাঁচব না মা।’
রুমি কোনও কথা না বলে টুপুরকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে জল। কিন্তু লোকটার জন্য তার কোনও দুঃখ কষ্ট হচ্ছে না। এমনকি কোনও ভালো স্মৃতি শত চেষ্টা করেও মনে পড়ছে না। বরং বহু বছর পর আজ তার গভীর ঘুম পাচ্ছে। দু’চোখ জুড়িয়ে আসছে নিশ্চিন্তে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *