অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
“সারারাত যে ব্যাট নিয়ে সারা ঘর ঘুরলে ! তা বলি কটা মশা মারলে?”
হারুবাবু চেয়ারে বসে ঢুলছেন। গিন্নির কথাগুলো তার কানেই যাচ্ছে না।
“সেই তো এখন ঢুলবে বসে। আর রাতে ব্যাটিং করে বেড়াবে। ”কথাগুলো বলে এক ঠ্যালা দিলেন কর্তাকে।
হারুবাবু ধরমর করে উঠলেন “এগুলো আবার কেমন অত্যাচার! ঘুমন্ত মানুষকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেওয়া। যদি হাত পা ভেঙ্গে যায় আমার। তখন খাটে শুয়ে থাকব।”
গিন্নির মুখে হাসি “তবে তো বাঁচতাম। তখন তো আর এমন মশা মেরে সারারাত বিরক্ত করতে না!”
“ও আমি বিরক্ত করি? আসলে কারোর ভালো করতে নেই। মশার কামড়ে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া হলে সেটাই ভালো হত।”
“আরে মশা থাকবে তবে তো ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া হবে!” হারু বাবু এবার রেগে উঠলেন “মশা নেই মানে! যতবার ব্যাট চালিয়েছি ততবার ফটাস ফটাস করে ব্যাটের মধ্যে স্পার্ক করেছে।”
গিন্নির এক মুখ বিরক্তি “ও ব্যাটের স্পার্ক দেখেছ? মশা দেখনি! এই যন্তরটা ছেলে যে কেন কিনে দিয়ে গেল। যন্তর হাতে পেয়েই শিবের নাচন শুরু। ” “ আমি হলাম পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক। তাই রাতে লাইট না জ্বালিয়েই মশা মারছিলাম। লাইট জ্বালালেই তো তোমার ঘুম উধাও। আর আমাকে শিব বললে। একদম ঠিক খাঁটি কথা। শিব যেমন পার্বতীর প্রেমে পাগল। আমি তেমন তোমার প্রেমে পাগল।”
“ধুত্তরি নিকুচি করেছে প্রেমের। রাতে যখন ডিম লাইটের আলোয় জলজ্যান্ত একটা মোটা, ভুঁড়িওয়ালা লোককে মশা মারার ব্যাট হাতে দাপাদাপি করতে দেখি। তখন শিব নয় ভিরিঙ্গি মনে হয় আমার। তোমার এই বাতিকটা এবার ছাড়ো।”
হারুবাবুর একটা বাতিক নয়। অনেকগুলোই বাতিক। বাতিক গ্রস্থ মানুষ হলে গিন্নির মুখঝামটা তো খেতেই হবে।
হারুবাবু আজকাল মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন। সব থেকে আশ্চর্যের কথা হল সেখানেও তিনি মশা মারার ব্যাট হাতে জনগণের সেবা করছেন। বন্ধুরা ভেবেছিল যে টেনিস ব্যাট। বুড়ো বয়েসে খেলার শখ জেগেছে। একটু অবাক হয়েছিল যে কিনা সারাজীবন ফুটবলে একটা কিক দেয়নি, ব্যাডমিন্টন কোর্টে কখনও পা দেয়নি, সে খেলবে টেনিস!
হারুবাবু শয়েশয়ে মশা মারতে লাগলেন। বাতিক থেকে এটা কেমন নেশায় পেয়ে গেল।
কিন্তু হারুবাবু কি জানতেন মাঝরাতে এভাবে ওনাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মশারা! মশাদের দোষ নেই। তারা আর কত অত্যাচার সহ্য করবে! বনে জঙ্গলে তাদের পিছু ধাওয়া করা। মশাদের কোর্টে ওনার বিচার বসেছে। “হারুবাবু আপনার বাতিকটা কবে থেকে?”
হারুবাবু দুবার ঢোক গিললেন। “বাতিক মানে?”
মশাদের উকিল মশাই রেগে গিয়ে বললেন – “কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করছে, আপনি আত্মরক্ষার জন্য তাকে হত্যা করলেন সেটা মানা যায়। কিন্তু অযথা বনে বাদারে ঘুরে নিরীহ মশাদের ক্ষতি করছেন। তাদের ধরে ধরে হত্যা করছেন। এটা অপরাধ।” উকিল মশা কাউকে আদেশ দিলেন – আসামীর অস্ত্র নিয়ে আসা হোক। কিছু মশা উড়িয়ে নিয়ে এলো তার সেই মশামারার ব্যাট।
উকিলমশা বিরক্ত হয় বললেন “আপনারা মানুষ হয়ে মানুষের রক্ত খান। ওই ব্যাট দিয়ে আপনাদের উত্তম মধ্যম দেওয়া উচিৎ।”
হারুবাবু ভির্মি খেলেন “মাইরি বলছি জীবনে কোনোদিন একটা মানুষেরও রক্ত খাইনি। খেতে গিয়ে জিভে কামড় পড়লে সেই রক্ত পেটে গেছে নিশ্চয়ই। শীতকালে ঠোঁট ফাটলে সেই রক্ত চেটে নিয়েছি। একটু নোনতা স্বাদ। তাছাড়া কারোর রক্ত খাইনি।
জজসাহেব আর উকিল মশা হে হে করে হেসে উঠলেন “ আমরা সে রক্তের কথা বলছি না। জীবনের রক্ত। সেই রক্ত ক্রমশ শুষে নিচ্ছে নেতা, মন্ত্রী, বড় ব্যবসায়ী। আর হাভাতে মানুষগুলো দিন দিন শুকোতে শুকোতে মরে যাচ্ছে।”
“মাইরি বলছি আমি সেসব খবর শুধু পেপারে পড়েছি। আর কিছু জানি না।”
জজসাহেব ঘচ ঘচ করে কিছু লিখলেন “অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন, তৃণ সম দহে। অন্যায় সহ্য করাটাও আপনাদের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতত পানা পুকুরের মশার কামড় হল আপনার শাস্তি।”
“না, না” হারুবাবু গোল গোল চোখে নিজের বিছানায় উঠে বসেছেন। মশার ব্যাট আপাতত আলমারিতে তুলে রেখেছেন। এখন এক নতুন বাতিক হয়েছে, পেপার দেখে অসৎ মানুষগুলোর নাম টুকে রাখা। যদি সত্যি কোনোদিন মশাদের আদালতে নামগুলো পাঠাতে পারেন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Valo laglo