মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
মায়ের মুখে প্রথম ডাকাতের গল্প শুনে চমকে উঠেছিলাম। তখন আমি এইটুকুনি। গল্প শুনতে-শুনতে স্পষ্ট ডাকাতগুলিকে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন। দপদপ শব্দ করে এই তারা ঘরে হানা দিল। কালো ধুমসো চেহারা ওদের। ঝাঁকড়া চুল। দারোয়ানি গোঁফ। চওড়া কপালজুড়ে লাল সিঁদুর। সকলের হাতে একটি করে বল্লম। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেই হুংকার ছাড়ল ওরা, কী আছে, সব আমাদের হাতে তুলে দে। জলদি। নইলে…
কেন, কী জানি, সে-গল্প ভয়ংকর। মায়ের মুখে শুনতে-শুনতে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে আরো কুঁকড়ে যেতাম। তবু থামতে বলতাম না কখনো মাকে। সেই থেকে অদ্ভুত একটা ইচ্ছেও জাগত মনে। ভাবতাম, মা খুব ভাগ্যবতী। আমিও যদি কখনো ডাকাত দেখতে পেতাম।
আশ্চর্য! সেই ইচ্ছে পূরণ হল আমার।
গোটা বাড়ি সেদিন গভীর শোকাচ্ছন্ন। ঠাকুমা মারা গেছেন আগের সপ্তাহেই। তারই মাঝে মধ্যরাতে সদলবলে হানা দিল ডাকাতদল। ওরা সাত-আটজন। সকলেরই মুখগুলো কালো কাপড়ে ঢাকা। কেবল একজন বাদে। তার হাতে ধরা একটি বন্দুক। বুঝলাম, ও-ই ডাকাতসর্দার। বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব কাড়ল ওরা আমাদের। ঘরঠাসা আত্মীয়-পরিজন। অলংকারশূন্য করল তাদের। বাবাকে দিয়ে জোর করে সিন্দুকটি খোলাল। ডাকাতরা চলে গেলে বাড়ি দ্বিতীয়বার মড়াকান্না জুড়ল। আমারও দু’চোখ জল থইথই।
কিন্তু একটি সত্য আজও কাউকে বলতে পারিনি। ডাকাতসর্দারটি অল্প বয়সি। তিরিশ-বত্রিশ বুঝি। ফরসা। সুন্দর। এমন দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষ আমি আর দেখিনি। বিশ্বকর্মা নিজের হাতে গড়েছেন যেন তাকে। লুঠপাটের কথা ভুলে ডাকাতসর্দারটির মিষ্টি মুখটির দিকে কতবার যে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়েছি। কথাগুলো অনেককাল আগের। ভরপুর সংসার এখন আমার। স্বামী সরকারি চাকুরে। ছেলে ইঞ্জিনিয়র। আমি চল্লিশোর্ধ্ব। তবু সেই মুখটি ভুলতে পারি না আজো! বস্তুত, সেদিন ঘরে দু’টি ডাকাতি সংঘটিত হয়েছিল। একটির কথা সকলে জানল। অন্যটি, কেবল আমি!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন