অমিতা মজুমদার
জয়নালের এক সময় কদর ছিল গ্রামের সব বাড়িতে। সকাল হলেই কুড়াল (কুঠার)খান নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। সারাদিন কোনো না কোনো বাড়িতে চ্যালাকাঠ কাটার কাজ পেয়ে যেত। জয়নালকে দিয়ে কাজ করাতেও সবাই স্বস্তি পেতো। জয়নাল কথা বলে কম, তার চাহিদাও খুব সামান্য। সকালবেলা ঠিক হতো কী পারিশ্রমিকে সে কাজ করবে। দু’তিনটে কাজ জয়নাল খুব ভালো করতে পারে। চ্যালাকাঠ কাটা সে আস্তগাছ কেটে হোক বা কেটে ফেলা গাছের মুড়া (মাটির নিচে থাকা অংশ) খুঁড়ে খুঁড়ে ছোটো ছোটো কাঠের টুকরো বের করা, মাটি কাটা, জঙ্গল,ঘাস নিড়ানো। এসব কাজের জন্য তার দাবি থাকত সকালে এক গামলা পান্তা সাথে দুটো শুকনো লংকা পোড়া আর একটা পিঁয়াজ। সারাদিন কাজ শেষে একসের চাল গামছায় বেঁধে কাঁধের উপর ফেলে বাড়ির পথে হাঁটত জয়নাল। জয়নালের বাড়িতে বিধবা মা আছে। মা ছেলের একবেলা ভাতে ভাত ফুটিয়ে খেতে পারলেই চলে যায়। জয়নালের জীবনে প্রয়োজন খুবই সীমিত। জয়নাল বেশি কিছু প্রয়োজন হবার জীবন কখনো দেখেনি হয়তো দেখতে চায়নি। বাপ ছেচল্লিশের মন্বন্তরে নাকি মারা যায়, যখন তার বয়স পাঁচ আর ভাইয়ের তিন। বিধবা মা কেমন করে কী খাইয়ে তাদের বড়ো করেছে ঊনত্রিশ বছরের জোয়ান জয়নাল তা জানে না। যেভাবে চলছিল জয়নাল তাতেই মহাখুশি। এহেন জয়নালের জীবনে রোজগারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরে। কেউ কোনো কাজে ডাকে না, বাড়িতে চুলা জ্বলে না, বিধবা বুড়া মা কতদিন উপোষ দেবে। এমন সময় পাশের গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সিকদার সাহেব ডেকে পাঠাল। কাচারিবাড়িতে গিয়ে দেখে তার মতো যারা দিন আনে দিন খায় প্রায় সবাই হাজির হয়েছে। সিকদার সাহেব তার সাদা ধবধবে দাড়ি যা এখন মেহেদির রঙে রঞ্জিত, চোখে সুরমা, গায়ে আতর মেখে মাথায় জিন্নাহ টুপি পরে হাতে তজবিহ জপতে জপতে কাচারিঘরে আসলো। অমনি মেম্বার বদরআলী তার গদিআঁটা চেয়ার নিজের গামছা দিয়ে মুছে বসতে দিয়ে সামনে বৃন্দাবনী হুঁকোটা ধরে। সিকদার সাহেব কিছুক্ষণ ধ্যানী ঋষির মতো চোখ বুঁজে থাকল তারপরে যা বলল তার সারমর্ম হলো এই দুর্দিনে আমাদের মা বাপ রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা, অখণ্ড পাকিস্তানের সরকার আমাদের মুসলমান ভাই তোমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেছে। আজ থেকে তোমরা যদি পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করো তাহলে পোশাক, খাবার ও নগদ টাকা পাবে। তার উপর যদি ক্যাপ্টেন সাহেবের সুনজরে পড়ো তাইলে তোমার নসীব খুলে যাবে। একেতো ইসলাম রক্ষার জন্য বেহেশ্ তের দরজা তোমাদের জন্য খুলেই গেল। এখন কও মিঞারা তোমরা রাজি কি-না। কেউ একবারও জানতে চাইল না কী কাজ তাদের করতে হবে সকলে একবাক্যে বলে উঠল হ রাজি। আসলে সকলের পেটে তখন ক্ষুধার আগুন জ্বলছিল, চোখে দেখছিল বাড়িতে অপেক্ষমান ক্ষুধার্ত স্বজনের মুখ। তাই এক কথায় ওরা হয়ে গেল রাজাকার-আল-বদর। তারপরের নয় মাসের কথা কেউ মনে করতে চায় না। জয়নালও একদিন হয়ে গেল কাঠুরে জয়নাল থেকে জল্লাদ জয়নাল। তার কুঠার গাছ কাটার বদলে লঞ্চঘাটের পন্টুনে রাখা লোহার পিলারের উপরে মানুষ জবাই করার কাজ পেলো। একটি শরীর মাথা থেকে আলাদা করে নদীতে ফেলে দেওয়াই তার কাজ। এই কাজ করতে করতে একসময় তার এমন হলো যতক্ষণ নদীর জল লাল না হয় ততক্ষণ সে শান্তি পায় না। তাই প্রতিদিন তার তরতাজা তরুণ মানুষ চাই। যখন হাত পা চোখ বাঁধা শরীরটায় কুঠার চালায় আর রক্তের ধারা ছিঁটকে তার চোখে মুখে লাগে অদ্ভুত এক উল্লাস অনুভব করে। কখনো মনে মনে ভাবে আচ্ছা গাছ কাটার বেলায় তো আমি গাছের কান্না শুনতে পাইতাম মনটা কেমন উদাস হইত, মনে হইত নিজের শরীরে কুঠার চালাইতেছি। আর এখন এক একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ কাইট্যা(কেটে) ফ্যালাই(ফেলি) আর মনডায় কেমন ফুর্তি ফুর্তি লাগে। একদিন হঠাৎ জয়নাল শোনে তার কামখান নাই, ক্যাপ্টেন সাহেব ক্যাম্প উঠাইয়া চইল্যা গেছে। সিকদার সাহেবও কোথায় গা ঢাকা দিছে। সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগতেছে। সে তো তার গ্রাম, আর এই নদীর পাড়ের লঞ্চ ঘাট ছাড়া তেমন কিছু চিনে না। বুড়া মাকে রেখে সে কোথায় পালাবে! কেনই বা পালাবে? সিকদার সাহেব তো কইছিল (বলেছিল) তারা ধর্মরক্ষার জন্য কাজ করতেছে, দেশের দশের ভালোর জন্য যারা দেশের শত্রু তাদের মারতেছে। এতে দোষের কিছু নাই, নাই পাপের ভয়। এসব ভাবতে ভাবতে জয়নালের কেমন গা গুলিয়ে ওঠে বমি বমি পায়, চোখের সামনে শুধু মানুষের মুখ দেখে যারা ভেসে গেছে দ্বিখণ্ডিত হয়ে সুগন্ধা নদীর জলে। একসময় বিধ্বস্ত গ্রামের মানুষজন ফিরে আসে তাদের প্রাণের প্রিয় বাস্তুভিটায়। নানারকম ঘর গৃ্হস্থলীর কাজে জয়নালের ডাক পড়ে। কিন্তু কোথায় জয়নাল! জয়নালকে মাঝে মাঝে কেউ কেউ দেখে কোনো জঙ্গলাকীর্ণ গাছের গোড়ায় বসে আছে জড়ভরত হয়ে। পরনে একটা চটের টুকরো, শরীর জুড়ে ক্ষত যা দুর্গন্ধ ছড়ায়, চুলের জটায় যেন পোকামাকড়ের ঘরবসতি। এই জয়নালকে একদিন কোমরে দড়ি দিয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দালাল আইনে অভিযুক্ত আসামী হিসেবে। যে মামলার বাদি স্বয়ং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সিকদার সাহেব। কারণ তিনি এখন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন