prabandho-jaha-nei-bharate

যাহা নাই ভারতে
জয়া মিত্র
 
সকাল থেকে সন্ধান করেও একটি পশু পাননি সেদিন পান্ডবরা। হতাশভাবে ফিরছেন। ‘হাতে বারোমণী ধনুক আর তেরোমণী বাণ নিয়ে পান্ডবেরা শিকার করতে যাচ্ছে। মের-সুমের পর্বতে গিয়ে ঘেরা দিয়েছে। কিন্তু একটা শুয়োর বা একটা সম্বর হরিণও পাওয়া গেল না। ক্লান্ত হয়ে তারা কদলীবনে আসে। কদলীবনে সুন্দরী এক কুমারী কন্যাকে দেখা যায়। তাকে পান্ডবেরা জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কার মেয়ে? কোথা থেকে আসছ? যাবেই বা কোথায়?
-সেসব কথায় তোমাদের কী? আমি অনেক দূর থেকে আসছি। আমাকে দিয়ে তোমাদের কী কাজ?
-তোমাকে আমরা হস্তিনাপুরে নিয়ে যাব। আমাদের ঘরের বৌ করে রাখব। আজ থেকে তোমার খাওয়াদাওয়া সবকিছু আমাদের সঙ্গে হবে।

পান্ডবেরা দ্রৌপদী(ধোঁফা)কে নিয়ে হস্তিনাপুরে এল। ধোঁফাকে থাকবার জন্য সাতমহলা প্রাসাদ দেওয়া হল।’ এই হল পঞ্চপান্ডবের বিবাহকথা। কোনো লুকোছাপা, মারদাঙ্গা- কোনো বিষয়ই নেই।

ডুঙ্গরিয়া ভীলদের এই মহাভারত, যাকে নিজেদের সুবিধার জন্য আমি ‘মহাভারত’ বলে উল্লেখ করছি, আসলে যে গাথাটির নাম ‘ভীলোঁ নু ভারথ’, আমাদের কাছে তার অনেকগুলো আশ্চর্যের মধ্যে একটা এই গোপনতার, রহস্যময়তার অভাব। আমাদের পরিচিত যে মহাভারত, সে যেন এক লতাজাল জটিল অরণ্য। তার পরতে পরতে রহস্য, আপাতবিচ্ছিন্ন বহু উপাখ্যান শেষ পর্যন্ত কোথায় যে পরস্পরে গ্রন্থিবদ্ধ আছে তা অনুধাবন করাও এক সারাজন্মের বিষয়। তার আনাচে কানাচে, কন্দরে গহ্বরে মনুষ্যচরিত্রের কতো যে উন্মোচন! আমাদের পরিচিত মূল্যবোধে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ‘পুণ্যের’ জয়। বিষাদেও মনুষ্যত্ব অপরাজেয়। এই অন্য মহাভারতে, ‘ভারথকথা’য়, ঘটনার কল্পনাতীত বৈচিত্র, মনুষ্যচরিত্র বহুধা রয়ে যায় দুর্জ্ঞেয় কিন্তু সমগ্র উপাখ্যানে সেই পাপ পুণ্যের ভাগটিও কিছু গুলিয়ে যাওয়া, অন্তত আমাদের মতো অদীক্ষিত পাঠকের কাছে। কীরকম- সে প্রসঙ্গে একটু পরে যাওয়া যাবে। এছাড়া কোনো গোপনতার রহস্য নেই। সবকিছুই খোলামেলা। যদিও সহজবোধ্য কিনা সে প্রশ্ন ভিন্ন।

কেবল দ্রৌপদী নয়, কুরুবংশের পত্তনও ঠিক এমনই সোজা সরল- সাত ঋষি বনে তপস্যা করছিলেন। ধুনিতে ত্রিশূল পুঁতে রেখে বারোবছর ধরে করা কঠিন তপস্যা নষ্ট করার জন্য শিবশক্তি চিলের রূপ ধরে নেমে আসে। বাতাসে ভর করে সে পৃথিবীর চারিদিকে পাক খেতে খেতে ত্রিশূলের ওপরে এসে বসে আর চিলের দেহ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। বারো বছর পূর্ণ হলে সাধুরা চোখ খুলে চিলের মৃতদেহ দেখেন। প্রাণীহত্যা হয়ে গেছে তো তপস্যার ফল নষ্ট হলো। পৃথিবীতে অঘটন ঘটে গেল।

‘এই কথা ভেবে ঋষি আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। প্রাণদায়িনী অমী হংসা আর কনিয়োর নামের জংলী লতার গুচ্ছ নিয়ে চিলের ওপর বুলোতে লাগলেন। তখন চিলের কঙ্কাল থেকে গান্ধারী(গতরমা) আর মরা চিলের রক্তমাংস থেকে কুন্তী(কুতরমা)র জন্ম হল।’ এরপর অতি সাবলীল ভাবেই কুমারী কুন্তীর রূপে মুগ্ধ সূর্যের কিরণবাণে কুন্তীর গর্ভধারণ, জল নিয়ে ফেরার আগেই সন্তানের জন্ম আর মাটির গর্তে সন্তানকে রেখে ধরিত্রীকেই তার রক্ষা আর পালনের ভার দিয়ে আসা।

কিন্তু এ থেকে যদি কারো মনে হয় যে উপাখ্যানটির গতিপথ বেশ সরল আর চরিত্রগুলিও পরস্পরের বেশ বাধ্য- তাহলে তাঁকে আরো অপেক্ষা করতে হবে।

ভীলরা যে অঞ্চলে বসবাস করেন, তার ত্রিসীমানায় কোথাও গঙ্গা নেই। কোনো বড়ো নদীই নেই। অথচ ভারথ উপাখ্যান শুরু হয় এক ব্যাঙকে নিয়ে যে গঙ্গাস্নান করতে যাচ্ছিল। ঠিক এই লাইন থেকেই শুরু হয় এই ‘ভিলোঁ নু ভারথ’- ‘এক ব্যাঙ তীর্থস্নান করতে গঙ্গায় যাচ্ছিল। পথে বাজারের ভিড়ে গরুর পায়ের নিচে পড়ে সে চেপটে মরে গেল। তখন তার আত্মা এক বেণেনীর পেটে…’ রাজা শান্তনু(সতরাঝা)কে সাতবার জন্ম নিতে হয় গঙ্গাকে স্ত্রীরূপে লাভ করার আগে। গুরুর নির্দেশে অনিচ্ছায় তাঁকে বিয়ে করেন গঙ্গা, সেই একই শর্তে- জাত সন্তানদের হত্যা করতে হবে রাজাকে। এখানে সন্তানসংখ্যা তিন। দুই পুত্র নিধনের পর জাত কন্যাকে মমতাবশতঃ না মেরে দূরে বন্ধুগৃহে রেখে আসেন রাজা। সেই মিথ্যাচারে গঙ্গা ত্যাগ করেন রাজাকে। রাজা আকুল হয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলে হাতে থাকে কেবল পাঁচটি চুল।

চুল কি শুধু গঙ্গার? এলো চুল তো দ্রৌপদীরও। সে আবার ঝিলিক দেওয়া সোনালি, লম্বা চুল। সুদীর্ঘ কেশরাশি। ছোট ঝরণার মত মৃদু কলকল শব্দে নাক ডেকে রাণী ঘুমোবার সময় সে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল দাসীরা। কী করে তার একগাছি গেল ছিঁড়ে। সেই ছেঁড়া চুলটি নিয়ে কৌতুকভরে বাতাস তা ফেলে দিল পাতালে যেখানে ছাপর খাটে ঘুমের আয়োজন করছে বাসুকি নাগ। রৌদ্রকিরণের মত চুলের স্পর্শে আর সুগন্ধে উতলা বাসুকি চলে এই কেশের মালিককে খুঁজতে বেরোয় আর শেষকালে এসে পৌঁছয় হস্তিনাপুরের বাদলমহলে। সিঁড়ি ভেঙে ‘ধমধম করে’ সেই বিশাল পুরুষকে উঠে আসতে দেখে রাণীর দাসী তাকে রাজসভার দরজা দেখাতে যায় কিন্তু দাসীকে ঠেলা দিয়ে রাজা হাজির স্বয়ং দ্রৌপদীরই ঘরে। রাণী তাকে তর্জন করে। ভয় দেখায় অর্জুনের। তারপর দুজনের মল্লযুদ্ধে পরাস্ত অর্জুনকে নিজের একটা গোঁফ ছিড়ে তাই দিয়ে বেঁধে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে বাসুকি। তার প্রতাপ দেখে রাণী তাড়াতাড়ি দাসীদের বলে তামার কুন্ডীতে জল গরম করতে। সেই গরম জলে ঘষে ঘষে বাসুকিকে স্নান করায়, বাহান্ন ব্যঞ্জন রেঁধে তাকে খাওয়ায়। ফুলের সেজ পেতে বাসুকির সঙ্গে ক্রীড়া করে। সকালে চলে যাবার আগে, রাত্রে ফিরে আসবার কথা জানিয়ে অর্জুনের বাঁধনটুকু কেটে দিয়ে যায় বাসুকি। আর অর্জুন? তার ‘ধমম…‘ করে পড়ে যাবার শব্দ পুরো বাদলমহলে শোনা যায়। সে কেবল গায়ে ব্যথার অভিযোগ করে দিনচর্যায় রত হয়। রাণী তাকেও ‘তামার কুন্ডীতে জল গরম করে……’। বস্তুত, এই ‘তামার কুন্ডীতে জল গরম করে ঘষে ঘষে স্নান করানো’ আর বত্রিশ ব্যঞ্জন রান্না করে বিছানায় বসিয়ে পুরুষকে খাওয়ানোর ঘটনা পুরো আখ্যানে এতোবার ঘটে যে আমরা আন্দাজ করতে বাধ্য হই, এই বিলাসিতাটির প্রতি কোনো সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা কোথাও প্রচ্ছন্ন আছে কি না।

আমাদের পরিচিত কোনো ধারণা দিয়ে এসব ঘটনার অর্থ আমরা নির্ণয় করতে পারি না। শরীর বিষয়ে মালিকানার কোনো বোধ কি অনুপস্থিত এঁদের মধ্যে? ঠিক যেরকম অনুপস্থিত জমি সম্পর্কে মালিকানার ধারণা? একথা সত্যি যে খুব সাম্প্রতিকের আগে পর্যন্তও পৃথিবীর বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে পৃথিবীর জমির ওপর ব্যক্তি-মালিকানার ধারণা ছিল বোধের অতীত । ১৮৫৪ সালের আদি আমেরিকান গোষ্ঠিপতির যে চিঠি আজ আমাদের বিস্ময়ের ও বিহ্বলতার আকর, তা শুরুই হয়েছিল এরকম ভাবে যে ‘কী করে তোমরা বলতে পারো পৃথিবীর জমি বিক্রি করা বা কিনবার কথা! এ আমরা তৈরি করিনি। যা আমার নয়, তাকে আমি কীভাবে বিক্রি করতে পারি?’ গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ঊড়িষ্যায় আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে তাঁদের বয়স্কা নেত্রী মুক্তা ঝোড়িয়া দিল্লির সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন ঠিক এই কথা- ধরতির মাটি, গাছ, পাহাড় নদী- এসব আমরা বানাইনি, তোমরাও বানাও নি। তাহলে যা আমাদের নয়, তা আমরা কী করে বিক্রি করতে পারি আর তোমরাও কী করে তা কিনতে পারো? হয়ত সেরকমই কোনো কারণে আমরা দেখি, যে রাজ্যের অধিকার পাওয়া্র উগ্র ইচ্ছা আর তা না দেওয়ার চেষ্টা, শেষ পর্যন্ত ভয়াবহ সশস্ত্র যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে সেই অধিকার কায়েম করাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিচিত মহাকাব্যের নানা পর্ব আবর্তিত হতে থাকে অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে, ‘ভীলোঁ নু ভারথ’-এ সেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ নিষ্পন্ন হয় ঠিক চোদ্দ লাইনের মধ্যে। সে যুদ্ধে মূল নেতৃত্ব দেয় সুভদ্রাপুত্র ‘বালা’ অভিমন্যু আর ভীম। ‘বালা’ অর্থ বালক, অবিবাহিত। সমগ্র কুরুক্ষেত্রে অর্জুন নিতান্তই অনুপস্থিত। ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ ইত্যাদি নিরস্তিত্ব।

তার অর্থ কিন্তু এমন কখনই নয় যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অনুপস্থিতির কারণে এই মহাকাব্যের আখ্যানভাগ সংক্ষিপ্ত বা সরল। বরং এতে বিস্তৃত রয়েছে এমন অনেক কাহিনী, প্রসঙ্গ- যা আমাদের মত অক্ষরবিলাসী নাগরিক পাঠকের কাছে সবসময় সুবোধ্যও নয় এমনকি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ অপ্রধান হলেও সেই যুদ্ধকে উপলক্ষ্য করে যে ঘটনার স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে, তার মধ্যে একদিকে যেমন আছে পাতাল থেকে সংগ্রহযোগ্য আসল গন্ডারের খড়্গের ঢাল অন্যদিকে তেমনি এক-পা-ওয়ালা মানুষদের দেশ থেকে সংগৃহীত তীর্থস্তম্ভ (তিরিত থাম্প)। সেসব সংগ্রহের উপাখ্যানগুলি ধরে আমাদের কল্পনাশক্তির কঠিন পরীক্ষা চলে। আবার কোথাও কোথাও পরিচিত কোনো উপাখ্যানের স্মৃতি বা সাদৃশ্য আশ্চর্য করে দেবার মত। যেমন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পান্ডবপক্ষে একমাত্র নিহত ‘বালা অভিমন্যু’র মৃত্যুর পর অর্জুন যখন হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন, তখন তাঁর পুত্রশোক আর বাঁধ মানে না। প্রাসাদে নিজেকে সামলাতে অসমর্থ পিতা শ্মশানে গিয়ে সন্তানের জন্য বিলাপ করতে থাকেন। তৃতীয় দিনে শ্মশান অভিমন্যুর কন্ঠে সেই শোকাতুর অর্জুনকে যে সান্ত্বনাবাক্য বলে তা গীতার দীর্ঘ জটিল রাজনৈতিক উচ্চারণের তুলনায় অতিসংক্ষিপ্ত ও রহস্যময়। ‘যখন আমি জীবিত ছিলাম, তখন তোমার পুত্র ছিলাম। তার আগের জন্মে তুমি আমার পুত্র ছিলে। সে জন্য তো কোনো শোক নেই। এখন আমি মৃত। জীবিতের সঙ্গে মৃতের কোনো সম্পর্ক হয় না। উঠে গৃহে যাও।’ আমরা জানি এই একই বাক্য আছে ঋগ্বেদের প্রাচীনতর অংশ দশম মন্ডলের ৭ম মন্ত্রে, যেখানে মৃতব্যক্তির স্ত্রী এবং আত্মীয়স্বজনকে বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তির জন্য শোক করছ সে জীবিতকালে তোমাদের আত্মীয় ছিল। এখন সে মৃত। মৃতের সঙ্গে জীবিতদের কোনো সম্পর্ক থাকে না।’ কতো প্রাচীন তাহলে এই উপলব্ধির বয়স? এই বেদবাক্য মেনে নিলে কী হয় ধনী সভ্য সমাজের সতীদাহ রচনার? ভীম-হিড়িম্বার পুত্র, যাকে আমরা ঘটোৎকচ বলে চিনি, ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমভাগে যে কোথাও কোথাও বার্বারক বলে উল্লিখিত আর নিজের পিতার দ্বারাই যে শিশুকালে নিহত হয়, নাম-না-করেও সেই বালককে সদ্য জন্মানো অবস্থায় বাবার পেছনে ছুটে যেতে দেখি এখানে। তুই যদি আমার পুত্র তবে নিশ্চয়ই যুদ্ধবিদ্যা জানিস- এর উত্তরে অস্তিবাচক উত্তর দিলে ভীম সেই পেছনে ছুটে আসা ছেলেকে প্রশ্ন করেন- যুদ্ধ হলে তুমি কার পক্ষে লড়াই করবে? সে জবাব দেয়- যারা হারবে, তাদের পক্ষে। শুনে ভীম হিসাব করেন, আমার সঙ্গে যুদ্ধে কৌরবেরা অবশ্যই হারবে। তখন এই হিড়িম্বাপুত্র ওদের সপক্ষে থাকবে। এই ভবিষ্যতের বিপদসম্ভাবনা নির্মূল করতে ভীম ছেলের মাথায় পা দিয়ে চেপে তাকে মাটিতে পুঁতে দেন। আপাদমস্তক শিউরে দেওয়া এই ঘটনাও বিবৃত হয় কিন্তু এমনই নিরাসক্ত ভাবে যা একে পরাবাস্তব করে তোলে। বলা যায় পরাবাস্তবতাই এই সমগ্র আখ্যানের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এবং তার পেছনে কোনো সচেতন নির্মাণ নেই, প্রায় প্রাকৃতিক পরাবাস্তব। রামায়ণে গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসার কালে রাত্রিকে দীর্ঘায়িত করতে সূর্যদেবকে বগলে চেপে রাখার বৃত্তান্ত আমাদের চিরকাল হাসিয়েছে। হনুমানের লাফ দিয়ে সাগর পার করা, ছোট কিংবা বড়ো হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ব্ল্যাকম্যাজিক সুলভ ক্ষমতা তার ঈষৎ নিম্ন-অবস্থানের সঙ্গে মানানসই। প্রশংসনীয় তো বটেই কারণ তা প্রভুর কাজে লাগছে। সেই দীর্ঘায়িত রাত্রি-কাহিনীর এক সমতুল পেয়ে যাই এই ভারথ-এ। ‘বালা’ যুদ্ধঘোষণা করে জ্যাঠাদের সামনে সভা থেকে ‘পানের বিড়া তুলে নিলে’ তার জননী সুভদ্রা(হোদরা) কুন্তীর পরামর্শে নিজের দাদা কৃষ্ণের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়েন কী করে একমাসের পথ বিরাটনগরী থেকে ‘গওনা’ না-হওয়া বৌ উত্তরাকুমারীকে নিয়ে আসা হবে? কারণটিও বিচিত্র। পুত্রের জীবন আশংকার চেয়ে হোদরা-র বেশি উৎকন্ঠা দেখা যায়- ঘরবসত না করে যদি ছেলে মারা যায়, বংশে তবে ‘বালহত্যার পাপ’ লাগবে। সে ছেলে যদিও নিজের কিশোর বয়সেই স্বর্গের ঈশ্বরী ইন্দ্রাণীকে ‘কঙ্কন পরিয়ে’ নিজের ঘরে রেখেছিল এবং শোধ নিতে আসা পবন ও ইন্দ্রদেবকে স্রেফ পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তো, কৃষ্ণ যাতায়াতের পথের কথা ভেবে রাত্রিকে ছয়মাস দীর্ঘ করে দেন। আকাশপথে পবনবেগী ঊট নিয়ে রওনা হয় রূপা আহির। ঘটনাচক্রে যথারীতি অনেক দেরি হয়ে যায় তার। একসময়ে দেখতে পায় নিচ দিয়ে কে যেন আস্তে আস্তে কোথায় যাচ্ছে। জিগেস করে জানতে পারে যে সে রাত্রি। তার কাল শেষ হয়েছে, সে অবসানের দিকে যাচ্ছে, দিন আসবেন বলে। আহির বলে ‘যাচ্ছ যাও, আমার কাঠটা পড়ে গেল, একটু কুড়িয়ে দিয়ে যাও’। রাত্রি হাত উঁচু করে ফেলে দেওয়া কাঠটা তুলে দিতে গেলে রূপা আহির খপ করে তার হাত ধরে তুলে নেয় আর একটা বস্তার ভেতর তাকে ঢুকিয়ে রেখে দেয়। অনেক পরে কাজ মিটে গেলে হস্তিনাপুরে পৌঁছবার আগে, কবি কিন্তু এই কথাটা ভুলে যান না, রূপা রাত্রিকে মুক্ত করে দিয়ে মাফ চেয়ে নেয়- আমাদের একটা খুব জরুরি কাজ ছিল বোন, সেটা অন্ধকারেই করতে হতো, তাই তোমাকে বেঁধে রেখেছিলাম। এখন চলে যাও। কিছু মনে করো না। সাদৃশ্যময় কল্পনার দুটো ঘটনার মধ্যেকার অমিলটুকু পাঠকের এড়িয়ে যেতে পারে না। সমস্ত কথনটির মধ্যেই আহীরের নম্রতা, কৌরবদের তামাক ইত্যাদি সেবনের বিলাসিতা দম্ভ কিন্তু প্রজাদের প্রতি একরকম রাজকীয় উদারতা, লোকমুখে পান্ডবদের নিষ্ঠুরতা-পয়সা না-দিয়ে মিষ্টি নেওয়ার মত নানা ইঙ্গিত আখ্যানটিকে এক অন্যরকম রাজনৈতিক চরিত্রও দেয়। তা আরও বেশি জোরালো ভাবে প্রকাশ পায় ‘গুরু’দের প্রসঙ্গগুলোতে। শিয়ালরূপী শান্তনুকে বিয়ে করতে একেবারে অনিচ্ছুক গঙ্গা আশ্রয় নেন মের-সুমের পর্বতে তপস্যারত নিজের গুরুর কাছেই। পান্ডুরাজা কালো কুকুররূপে দুঃখভোগ করছিলেন কারণ দৌপদীর গুরু বালা হরগুরাকে, কুন্তীর গুরু গতরাবাসীকে নিচুজাত বলে পান্ডবরা অসম্মান করেছিল। সেই পাপ থেকে পিতাকে উদ্ধার করতে হলে পান্ডুরাজার গুরুসহ এই গুরুদের প্রত্যেককে সসম্মানে বরণ করে এনে শঙ্খোদ্বার(মেনেতরা) যজ্ঞ করাতে হবে। সেই পাপমুক্তি যজ্ঞের উপায় সম্পর্কে পান্ডবদের উপদেশ দেয় দ্রৌপদী যে এর আগে ঔদ্ধত্য থেকে মুক্ত হবার জন্য পান্ডবদের শিখিয়েছিল ভক্তিকে রাজ্যে স্থাপন করে তার উপাসনা করতে। পান্ডবদের যজ্ঞে পৌরহিত্য করার জন্য রাজি হতে পূর্বকৃত অপরাধের দন্ডহিসাবে বালা হরগুরা দেন উদ্ধত ভীমকে নাকে বলদের মতো নকেল লাগিয়ে, চার হাতেপায়ে গাড়ি টেনে গুরুর কাছে আসতে হবে, তাঁর দেওয়া ঘাস খেতে হবে, পিঠের গাড়িতে গুরুকে বসিয়ে রাজধানী ফিরতে হবে। গল্পে এর সমস্তটাই পালিত হয় অবশ্য কিন্তু ক্ষমতার উঁচুনিচু ভেদের ক্ষতচিহ্ন কোথাও কথা বলে না কি?

যদিও কোনো বিষয়ের সাক্ষ্য থেকেই আমাদের অভ্যাসমত সাধারণীকরণের চেষ্টা এই আখ্যানে আরও বেশি বিভ্রান্তির উদ্রেক করতে পারে। দ্রৌপদীকে বলা হয় সবচেয়ে জ্ঞানী আর তার প্রায় সমতুল হচ্ছেন কুন্তী অথচ কুন্তীকে যেসব কাজ করতে দেখা যায় তার অনেকগুলোই হীন তঞ্চকতা বলে মনে হতে পারে। যে সদ্যোজাত সূর্যপুত্রকে কুন্তী মাটির মধ্যে গর্তে রেখে পাথরচাপা দিয়ে পৃথিবীর হাতে সমর্পণ করে এসেছিলেন, সেই কর্ণ জেদ করে পিতৃপরিচয় জানবার সময়ে সূর্যের কাছ থেকে যেসব অজেয় শস্ত্র ও অঙ্গবস্ত্র উপহার পান, যুদ্ধপ্রস্তুতির কালে কৃষ্ণের পরামর্শে জননী কুন্তী অকারণে হীন মিথ্যা আচরণ করে সেগুলো নিয়ে পালিয়ে আসেন। অকারণ এইজন্য যে মা পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শুনে রাজা কর্ণ হাঁটুতে ভর দিয়ে পুরো রাস্তা গিয়ে মায়ের পাদস্পর্শ করে সেই সূর্যের দেওয়া অঙ্গবস্ত্র ‘অগন পিছৌড়া’ দিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসেন। বারে বারে প্রশ্ন করেন বলো তোমার কি প্রয়োজন? তবুও আগে থেকে করা পরিকল্পনামতো শিশু অভিমন্যু খেলার ছলে কর্ণের অজেয় ধনুকবাণ নিয়ে নিজেদের বাড়ি পালিয়ে গেলে ‘দেখি বালা কোথায় গেল’র ছলে সেই কুন্তী পরিত্যক্ত ছেলের সেই সম্পদটি গায়ে দিয়ে ছুটে হস্তিনাপুরে চলে যান। পান্ডবপক্ষ অর্থাৎ ভীম-অর্জুন যেন যুদ্ধে জেতে, তা নিশ্চিত করতে। অথচ ভীমের পরাক্রমে, এমনকি ভীমের উপস্থিত বুদ্ধিতে বারে বারে নানা সংকট থেকে রক্ষা পেয়েও ভীমকে কুন্তী সমস্ত আনন্দ উৎসব থেকে বাদ দেবার চেষ্টা করতে থাকেন। এমন বহুবার। আর কি যে বিচিত্র সব উপায়ে ভীম নিজের মনস্কামনা পুরো করেন! সত্যিকথা বলতে সমস্ত গাথাটির মধ্যে সবচেয়ে কিংবা বলা যায় একমাত্র জটিল চরিত্র এই কুন্তীই, বাকিদের কারোর মধ্যেই বিশেষ পরিবর্তন বা দ্বন্দ্ব খুব একটা দেখা যায় না। আর প্রধান দুই গুরুস্থানীয় চরিত্র- কুন্তী ও কৃষ্ণকে উপলক্ষ্য করেই আগে কথিত য়ামাদের পাপপুণ্যের মানদন্ডটি বারবার চিড় খেতে থাকে। অভিমন্যুর সৃষ্টি, সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ের ব্যবস্থা এবং উত্তরকালে কৃষ্ণের হাত দিয়ে বালা অভিমন্যুর নিধন- সবটাই ক্ষমতার জটিল খেলা। তাকে আড়াল করারও কোনো চেষ্টা নেই ভারথ-উপাখ্যানে বরং অভিমন্যুর মৃত্যুর পর স্পষ্টই বলা হল- ভগবান পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করালেন।

হয়তো এই আখ্যান যাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি তাঁদের কাছে এইসব ছলনা ও পাপপুণ্যের হিসাব কোনো ভিন্ন অর্থ ধরে। সেই সমাজকে কে জানে কতোযুগ ধরে ক্ষমতাবানদের সমাজের হিংস্রতা, পীড়ন, শঠতা সহ্য করে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে! আমরা স্মরণ করতে পারি- প্রায় শৈশব থেকে ভীলজাতির বলতে গেলে যে একমাত্র উল্লেখ আমরা শিখেছি তা হল অবনীন্দ্রনাথের অপরূপ ভাষায় ছবিলেখা রাজকাহিনী। সেখানে শোলাঙ্কি রাজকুমারীর চূড়ান্ত রোম্যান্টিক বিরহব্যথার গান ‘আজু কি আনন্দ’-র প্রেক্ষাপট তৈরি করে রাজা বাপ্পাদিত্যের নৃশংস ভীলহত্যা। একবার নয়, বারবার। এঁরা যে এইদেশের মানুষ-সেই বোধ স্বাধীনদেশেও কখনো আমাদের চেতনায় আসেনি। আমরা সেই সব আখ্যান পড়ে এখনও আপ্লুত। তাই প্রায় অন্যগ্রহের বাসিন্দাদের মত, হতে পারে যে আমরা বুঝতেও পারব না প্রকৃতিতে যে ভাবে আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা করে মৌমাছি, প্রজাপতি, নানা পতঙ্গ ও সাপসহ আরও বহু প্রাণী, সেরকম ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কোন ছদ্ম মূল্যবোধ তৈরি করতে হয় কোনো প্রান্তিক সমাজকে।

যেমন যৌনঈর্ষা বা মেয়েদের কেবল ভোগের বস্তু হিসাবে দেখার ধারণা এই ভারথকথায় অনুপস্থিত, অথচ রোমান্তিক প্রেমে উপাখ্যানের অভাব নেই। খেয়াল না করে পারা যায় না যে তার সবই এসেছে মেয়েদের দিক থেকে। পাতালে মৃত অর্জুনকে দেখে মুগ্ধ রাজকন্যা হীরাপথের নিঃস্বার্থ প্রেম, ভীম ও হিড়িম্বার ক্ষণিক প্রেম যার অন্ত হয় ভীমের নির্বিকার নিষ্ঠুরতায়- তার দুটি উদাহরণ। আবার অন্যকিছু প্রায় অনভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মূল্যবোধও আমাদের নাড়া দেয়। ইন্দ্ররাজা প্রায় অকারণে বেণের ছেলেকে সভাসদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন বটে কিন্তু ঘটি দিয়ে মেপে মেপে বলদের গাড়ি বোঝাই করে তার সমস্ত বকেয়া বেতন যথাযথ শোধ করে দিতে কার্পণ্য করেন না। বিরাটরাজা কন্যাবিবাহে অসংখ্য বরযাত্রী আনার যে শর্ত দেন, তাও আমাদের অদ্ভুত লাগে। এ ক্ষেত্রে এবং আরও বহু ক্ষেত্রেই মা ও ভাইদের সবচেয়ে জটিল সংকটগুলি থেকে নিজের মতো ভাবে উদ্ধার করে ভীম। কিন্তু যেসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে চরিত্রটি পার হয়, তাতে পাঠককে ভীম সম্পর্কে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে। অত্যন্ত খিদে আর অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা- এ যেন ভীমের স্বভাবের স্থায়ী ভাব। অবলীলায় প্রহার ও সংহার করে সে- এমনকি অকারণেও, ক্রীড়াচ্ছলে। কিন্তু কলিকাল এসে পড়ার পর দেখি হিমালয়যাত্রার পথে তুষারে প্রথম তারই আঙুল খসে পড়ে। এ কি কোনো নৈতিক শাস্তিবিধান?

গুজরাট রাজস্থান সীমান্তের ছোট ছোট পাহাড় বা ডুঙ্গরে বসতি করা ভীলজাতির মানুষদের মধ্যে বহুকাল ধরে মহাভারত, রামায়ণ- যাকে এঁরা বলেন ‘রোমসীতামণি কথা’ ছাড়াও লম্বা সব গাথাকাব্য আছে। তবে সেগুলি ঠিক কাব্য হিসাবে গণ্য হবে কিনা বলা কঠিন। এই ভারথকথা ঐ ডুঙ্গরিয়া ভীল সমাজে কখনোই গীত হতো না, এগুলি তাঁদের নিজস্ব ধর্মানুষ্ঠানের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর গায়নভঙ্গীও সম্পূর্ণ ভিন্ন। যিনি এই আশ্চর্য দীর্ঘ আখ্যানকে লিখিত রূপ দিয়ে আমাদের সামনে এনে দিয়েছেন, সেই শ্রী ভগবানদাস প্যাটেল খুব স্পষ্ট করেই সেই সমগ্র গায়ন-বিশিষ্টতার কথাও লিখেছেন।

জানি না, হতে পারে এই গাথার স্রষ্টা ও বহুকালের নিষ্ঠ বাহকেরা আজ হয়ত দিল্লি জয়পুর কি পুণেতে রাজমিস্ত্রির যোগানদারের কাজ করেন কিংবা খনিতে পাথর ভাঙেন কারণ কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা, আগের মতই, আজও তাঁরা পাননি। তাঁদের এই পরমাশ্চর্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও খুব বেশিদিন যাবার আগেই যাদুঘরের সামগ্রী হয়ে যাবে। তার আগে পর্যন্ত…।।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “prabandho-jaha-nei-bharate

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *