মূল রচনা – এইচ জি ওয়েলস, গল্পের নাম “The Country of Blind”
অনুবাদ – শুক্তি রায়
লেখক পরিচিতি – এইচ জি ওয়েলস, জন্ম ২১সেপ্টেম্বর, ১৮৬৬, এবং মৃত্যু ১৩ই অগাস্ট, ১৯৪৬ সালে। ইংরেজি সাহিত্য জগতের সুপরিচিত একটি নাম হল হারবার্ট জর্জ ওয়েলস যিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর লেখা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিসমূহ সম্পদ, যেগুলি অনূদিত হয়েছে বহু ভাষায়।
এখানে অনূদিত গল্পটির নাম The Country of Blind । এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে স্ট্র্যান্ড পত্রিকায় এবং ১৯১১ সালে এইচ জি ওয়েলস-এর ছোট গল্পের সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয় গল্পটি। পরে লেখক নিজের গল্পটির পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে সেটি পুনঃপ্রকাশ করেন ১৯৩৯ সালে এবং গল্পটি স্থান পায় ইংল্যান্ডের গোল্ডেন ককারেল প্রেস থেকে প্রকাশিত এইচ জি ওয়েলস-এর একটি গল্প সংকলনে। ১৯৩৯ সালের পরিমার্জিত গল্পটিই এখানে অনূদিত হয়েছে। তাঁকে অমর করে রাখবে সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে। তাঁর লেখা Time Machine, The Invisible Man, The First Men in the Moon সারা বিশ্বের সাহিত্য।
চিম্বোরাসো থেকে তিনশো মাইল আর তুষারাবৃত কোতোপ্যাক্সি থেকে এক মাইল দূরে ইকুয়াদোর-এর ঘন জঙ্গলে ঢাকা আন্দিস পর্বতমালার অভ্যন্তরে রয়েছে গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক রহস্যঘেরা উপত্যকা। সেই উপত্যকা হল শুধুমাত্র অন্ধদের দেশ। বহু বহু বছর আগে ওই উপত্যকা অতটাও দুর্গম ছিল না। সেই সময় স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপনকারীদের লোভ লালসা এবং অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে কিছু মানুষ ভয়ংকর কষ্টসাধ্য পার্বত্য পথ অতিক্রম করে তারপর সবুজে সাজানো প্রান্তর পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল চারদিক থেকে তুষার প্রাচীরে ঘেরা এই উপত্যকার মধ্যে। ওদের আসার অব্যবহিত পরেই এল এক ভয়ংকর ভূমিকম্প যাতে চেনা জগতটা একেবারে তছনছ হয়ে গেল। প্রশান্ত মহাসাগরের সুতীব্র জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিল উপকূলবর্তী জায়গাগুলোকে আর পাথর আর বরফের ধ্বস নেমে বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলল ওই উপত্যকাটিকে। এমনকি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্বত অভিযাত্রীদের কাছেই ওই জায়গার কোনো হদিস আর রইল না। যে সব মুষ্টিমেয় মানুষ ওই উপত্যকায় পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা আর তাদের পরিবার পরিজনদের ওখানে নিয়ে আসতে পারল না বা নিজেরাও পারল না ওই অবরুদ্ধ উপত্যকা থেকে নিজেদের পরিচিত জায়গায় ফিরে যেতে। ওরা বাধ্য হল ওই বিচ্ছিন্ন উপত্যকায় নতুন করে নতুন মানুষদের নিয়ে বসত গড়ে তুলতে।
ওই উপত্যকায় জল এবং উর্বর জমির অভাব ছিল না। পাহাড়ের গায়ে গায়ে অজস্র ফলের গাছে ফলত চেনা অচেনা সব সুস্বাদু ফল। শিকার করার বা পোষ মানানোর মতো পশুও অমিল হয়নি। উপত্যকার মধ্য দিয়ে উচ্ছল ছন্দে বয়ে চলত পাহাড়ি ঝর্ণারা যেগুলির ধারা একে অপরের সঙ্গে মিশে রূপ নিয়েছিল স্বচ্ছতোয়া নদীর। জঙ্গল থেকে নেমে এসেছিল কঠোর পরিশ্রমী জন্তু ইয়ামা, আলপাকা, গুয়ানাকো আর ভিকুনিয়া। এদের পোষ মানিয়ে চাষের কাজে লাগানো বা আহার্য হিসেবে এদের মাংস পাওয়া খুব কঠিন ছিল না। কাজেই প্রথম দিকের প্রিয়জন বিচ্ছেদের বেদনাকে জয় করে মানুষ ওই উপত্যকার বুকে গড়ে তুলল এক নয়া বসত। জীবন ফিরে এল জীবনের ছন্দে।
সব কিছু ভালোই চলছিল ওই বিচ্ছিন্ন উপত্যকার বুকে কিন্তু কিছুদিন পরেই ওখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দিল এক অদ্ভুত অসুখ। ওই মানুষগুলোর মধ্যে দেখা দিতে লাগল অন্ধত্ব। অতি দ্রুত কমে আসতে লাগল ওদের দেখার ক্ষমতা। ওদের সন্তান সন্ততিরাও জন্মাতে লাগল দৃষ্টিহীন হয়ে। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল প্রবল আতংক। তখনকার দিনে এই ধরনের অসুখ বিসুখ বা মহামারির ক্ষেত্রে মানুষ রোগের বৈজ্ঞানিক কারণ না খুঁজে খুঁজত ধর্মীয় প্রতিকার। রোগগ্রস্ত হওয়ার পর ওরা আবিষ্কার করল যে ওরা যখন এই উপত্যকায় পালিয়ে এসেছিল, তখন ওদের সঙ্গে ছিল না কোনো দেবতার মূর্তি বা ওদের সঙ্গে আসেননি কোনো গুণিন বা পুরোহিত। তখন ওরা সিদ্ধান্ত নিল যে ওদের তরফ থেকে কাউকে ফিরে যেতেই হবে ওদের চেনা পূর্ব পরিবেশে এবং পুরোহিতদের কাছ থেকে জেনে আসতে হবে ওই অন্ধত্ব রোগের প্রতিকার। সবাই মিলে যার কাছে যা কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল, সব জড়ো করে তুলে দিল এক বলশালী যুবকের হাতে, যে তখনো পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়নি। সেই যুবক গ্রামের সকলের হয়ে পাহাড় পেরিয়ে মানুষের জগতে ফেরার পথ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। পাহাড়ে পাহাড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েও সে পারল না চারদিকের পাথর আর বরফের প্রাচীর পেরিয়ে বাইরের জগতের পথ খুঁজে বের করতে। নদীখাত ধরে উপরে উঠতে উঠতে সে আবিষ্কার করল যে সে পৌঁছে গেছে নদীটার উৎসে যেখানে একটা গুহার মধ্য থেকে অবিরল ধারায় জল বেরিয়ে আসছে। কাজেই সেই পথ ধরে সেই যুবক উপত্যকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারল না।
এদিকে তার চোখের দৃষ্টি আগের চেয়ে ক্ষীণ হতে থাকল আর তারপর সে আক্রান্ত হল প্রবল জ্বরে। সেই অবস্থাতেই কী ভাবে যেন সে ফিরে এল তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন গ্রামটিতে। জ্বরের ঘোরে সে কী যে বলে চলল তার বেশির ভাগই গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারল না। তবু গ্রামের মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে রইল তার বিকারের ঘোরে বলা কাহিনি। সে কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকল বছরের পর বছর ধরে।
এদিকে অন্ধত্বের রোগ বেড়েই চলল। বয়স্ক মানুষরা হাতড়ে হাতড়ে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেল আর তরুণদের দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকল। বাচ্চারা অন্ধ হয়েই জন্মাল আর তারা অন্ধত্বেই অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকল। একটা সময়ের পর অন্ধত্ব নিয়ে আর কোনো সমস্যাই রইল না ওই মানুষদের কাছে কারণ চোখ বা দৃষ্টি নিয়ে কোনো ধারণাই রইল না একটা সময়ের পরে। চোখে দেখতে না পাওয়ার ফলে ওদের অন্য ইন্দ্রিয়গুলো হয়ে উঠল আরো সজাগ। ওদের বাসভূমি একেবারেই বিপদসঙ্কুল ছিল না। অচিরেই ওরা নিজেদের জায়গাটা আর নিজেদের মানুষদের খুবই ভালো ভাবে চিনে ফেলল। অভ্যাসের বশে ওরা আগুন জ্বালানো থেকে পশু পালন, বাচ্চা মানুষ করা… সবই করে ফেলতে লাগল স্বাভাবিকভাবেই। ওরা নিজেদের সংস্কৃতির বাইরে স্প্যানিশ সংস্কৃতির সামান্য ছোঁয়া পেয়েছিল কয়েক প্রজন্ম আগে, যা সময়ের সঙ্গে ওরা প্রায় ভুলেই গেল। ওদের পুরোনো জীবনের আরো অনেক কিছু তলিয়ে গেল বিস্মৃতিতে আর নতুন অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল ওদের। এই ভাবে বয়ে যেতে লাগল প্রজন্মের পর প্রজন্ম। একটা সময় এল যখন ওই ছোট্ট উপত্যকাটার মধ্যে বাস করছিল পেরু থেকে প্রথম যারা ওই উপত্যকায় এসেছিল তাদের পনেরোতম প্রজন্ম।
এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা ! এত দিন পরে ওদের ওই উপত্যকায় হঠাৎ এসে পড়ল বাইরের জগতের একজন মানুষ !
লোকটার নাম ছিল নুনেজ। কলম্বিয়ার মানুষ ছিল সে। সমুদ্রে নৌকো চালানো আর পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল ওর নেশা। পড়াশোনায় ওর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি যাই থাক, বই পড়ার এবং জগতকে জানার আগ্রহ ওর ছিল অপরিসীম। ভালো লাগার জায়গা থেকেই ও একদল ইংরেজ আন্দিজ পর্বতারোহীর গাইড হয়ে ও সেই দলটার সঙ্গে গিয়েছিল আন্দিজের কোনো একটা শৃঙ্গজয়ের অভিযানে। যে অভিযানে ও গিয়েছিল, তার অবস্থান না পথ সম্পর্কে ওর খুব একটা ধারণা ছিল না কারণ ও আগে কখনো ওই সব জায়গায় যায়নি। অভিযাত্রী দলের সঙ্গে যে অভিজ্ঞ সুইস গাইডরা ছিল তারা একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ার ফলে তাকে নিতে হয়েছিল ওই অভিযাত্রীদের পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব। দলটাকে নিয়ে ও পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে চলতে থাকল। পাথুরে পথ পেরিয়ে ওরা ক্রমে এসে পৌঁছল তুষারের দেশে এবং একটা সময় ওরা উপলব্ধি করল যে ওরা আন্দিজের সুউচ্চ শিখর পারাস্কোপোত্ল-এ পৌঁছে গেছে যাকে ইউরোপীয়রা ম্যাটারহর্ন অফ আন্দিজ বলে থাকে। কঠিন পথ পেরিয়ে অমন একটা জায়গায় পৌঁছে অভিযাত্রী দল খুবই খুশি। ওরা ওই বরফের দেশে একটা পাথরের আড়াল খুঁজে বের করে সেখানে তাঁবু গাড়ল। আর সেখান থেকেই হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল নুনেজ।
কী করে যে নুনেজ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, কেউ বুঝে উঠতে পারল না তা। পরে নুনেজের ওইভাবে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক রোমহর্ষক লেখা বেরিয়েছিল নানা কাগজে। নুনেজকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন থেকে শুরু হয়েছিল খবরের কাগজের রিপোর্ট। অভিযাত্রী দলের বাকিরা রাতে খাওয়ার সময় আবিষ্কার করল যে নুনেজ নেই। নেই মানে নেই ! নিজের তাঁবুতে সে নেই। বন্ধুদের তাঁবুতেও সে নেই। আশেপাশে অন্য কোথাওই সে নেই। দলের অন্যরা টর্চ নিয়ে চারপাশ খুঁজে আবিষ্কার করল যে ওরা যেখানে আছে, সেখান থেকে কোথাও যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একমাত্র যা ঘটে থাকতে পারে, তা মারাত্মক। নুনেজ কোনো ভাবে পাহাড়ের গা থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে অনেক অনেক নীচে। সেক্ষেত্রে তার জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু যতটা সম্ভব ওরা খোঁজাখুঁজি করল, নুনেজের নাম ধরে ডাকাডাকি করল। তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল নিজেদের উপস্থিতি কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হল না। সারাটা রাত অভিযাত্রী দলের কারোরই চোখে ঘুম এল না। অসম্ভব উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল ওদের রাতটা।
ভোরের আলো ফুটতেই বোঝা গেল সবাই যা আশংকা করছিল সেটাই ঠিক। বরফের পাহাড় থেকে নুনেজ যে গভীর খাদের মধ্যে পড়ে গেছে, সে ব্যাপারে আর সন্দেহ রইল না কারোর। সাদা বরফের উপর গভীর হয়ে দেখা যাচ্ছিল নুনেজের পড়ে যাওয়ার চিহ্ন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে পুব দিকের পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে অনেক গভীরে গড়িয়ে গেছে নুনেজ। পড়ার চিহ্নটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে খাড়া এবং পাতালস্পর্শী এক খাদ, যার পর আর কিছুই দেখা যায় না। সবটাই যেন কুয়াশায় ঢাকা। দুপুরের দিকে কুয়াশা একটু কাটতে বোঝা গেল বহু নীচে একটা উপত্যকার মধ্যে থেকে ছায়ার মতো করে দেখা যাচ্ছে কিছু পাইন গাছের মাথা। সেই উপত্যকায় পৌঁছোবার কোনো পথ নেই বলেই সকলের মনে হল এবং সকলে ধরে নিল যে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে নুনেজের।
পরের দিন থেকেই ওরা ফেরার রাস্তা ধরল। ফিরে গিয়ে ওদের পত্র পত্রিকা ভরে উঠল বড় বড় রোমাঞ্চকর লেখায়। লেখা হল পারাস্কোপেত্ল শৃঙ্গজয়ের কাহিনি আর তার মধ্যে লেখা রইল অসীম সাহসী পর্বতারোহী নুনেজের হারিয়ে যাওয়ার গল্পও। নুনেজের মৃত্যু নিয়ে শোক প্রকাশও কম হল না।
নুনেজ কিন্তু মারা যায়নি।
ব্যাপারটা হয়েছিল এই যে, চাঁদের আলোয় আন্দিজের অকল্পনীয় সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে নুনেজের মতো পর্বতারোহীরও দুর্ঘটনা ঘটল এবং পাহাড়ের গায়ে পা পিছলে বরফের ঢাল ধরে সে গড়িয়ে পড়তে থাকল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। তার মনে হল যে বরফের মেঘের মধ্যে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার অস্তিত্বটাই। হঠাৎ করে যেন বাতাসে পাক খেয়ে লাফিয়ে উঠল তার শরীরটা আর সেটা পরক্ষণেই আছড়ে পড়ল নরম বরফের উপর। ওর মনে হতে লাগল বরফের মধ্যে যেন সে ডুবে যাচ্ছে অথচ নিজেকে রক্ষা করার কোনো উপায়ই নেই তার। অসুস্থ বাচ্চার মতো নুনেজের চেতনা হারিয়ে যেতে লাগল। কত ক্ষণ ও অচেতন ছিল তা ওর জানা নেই কিন্তু যখন ওর চোখ খুলল ও দেখতে পেল আকাশ জুড়ে ঝিলমিল করে লক্ষ লক্ষ তারার শামিয়ানা। এবার নুনেজ অনুভব করল যে সে বেঁচে আছে এবং মোটামুটি অক্ষতই আছে। ওর জামার বোতামগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে, ওর পকেটের ছুরিটা বরফের মধ্যে হারিয়ে গেছে, মাথার টুপিটাও নেই আর ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী আইস অ্যাক্সটাও বেপাত্তা।
নুনেজ নিজের শরীরটাকে একটু তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝল যে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সামনে তাকাতেই ওর চোখে পড়ল আকাশটা একলা চাঁদের ভয়ংকর দ্যুতিতে যেন পৈশাচিক হাসি হাসছে আর গোটা প্রকৃতি জুড়ে যেন নেমে এসেছে এক রহস্যময় ভৌতিক সৌন্দর্য। নুনেজের বুক ঠেলে একই সঙ্গে বেরিয়ে হো হো অট্টহাসি আর বুক ফাটা কান্না।
একটু পরেই নুনেজ অনুভব করল যে সে যেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে সেখানেই শেষ হয়েছে তুষার রাজ্যের সীমানা। একটু নীচেই গোল গোল নুড়ি বিছনো একটা অঞ্চল আর তার পর চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে একটা রুপোলী রঙের স্রোত না নিঃসন্দেহে একটা পাহাড়িয়া নদী। অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ায় নুনেজ। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে পাথুরে পথ ধরে। একটু দূর গিয়েই একটা সমতল জায়গায় পৌঁছয় ও। পকেট হাতড়ে বের করে ছোট একটা ফ্লাস্ক যা অত কিছুর মধ্যেও অক্ষত রয়ে গেছে। ফ্লাস্কের মধ্যেকার পানীয়টা এক চুমুকে শেষ করে নুনেজ ওইখানেই শুয়ে পড়ে আর অচিরেই তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।
সকালের আলোয় ছোঁয়ায় আর পাখিদের গানে ঘুম ভাঙল নুনেজের। এবার চারদিকে তাকিয়ে ও বুঝতে পারল যে বরফের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে আশ্চর্যজনক ভাবে ও বরফের রাজ্য পেরিয়ে চলে এসেছে আন্দিজ পর্বতমালার অপর দিকে, যে দিকটার সন্ধান ওর পরিচিত জগত জানে না। ওর পিছনে আকাশের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল তুষারশৃঙ্গ আর সেখান থেকে নেমে এসেছে একটা দুধসাদা চওড়া হিমবাহ। হিমবাহটা শেষ হয়েছে ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার অদূরেই আর সেই হিমবাহ থেকে কুলকুল স্বরে বেরিয়ে আসছে একটা স্বচ্ছ জলের নদী। সেই নদীর স্রোত ধরেই নীচের দিকে নামতে লাগল নুনেজ। মাঝে মাঝে পড়তে লাগল খাড়া পাথরের দেওয়াল, যা পার করা নুনেজের মতো দক্ষ পর্বতারোহীর কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিছুদূর গিয়ে নুনেজ এসে পড়ল সবুজে ঢাকা এক তৃণভূমিতে যার চারপাশটা জুড়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে পাইন গাছের সারি।
আরো কিছুদূর এগিয়ে নুনেজ দেখতে পেল কিছু পাথরের বাড়ি। বাড়িগুলো কেমন যেন অন্য রকম! কেন অন্য রকম, সেটা নুনেজ ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু এটা ওর বুঝতে ভুল হল না যে বাড়ি যখন আছে, তখন ওখানে মানুষও আছে। ওই বাড়িগুলিকে লক্ষ্য করে ও চলতে থাকল।
সূর্য ততক্ষণে অনেকটা উপরে উঠে গেছে। পাখিদের গানও গেছে থেমে। গোটা উপত্যকা জুড়ে বইছে হিম শীতল তীব্র বাতাস। তবু দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ওই বাড়িগুলিকে। নুনেজ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল কিন্তু ও থামল না এবং সারা দিন হাঁটার পর যখন ও ওই গ্রামটাতে পৌঁছল তখন নরম হয়ে এসেছে বিকেলের রোদ। নুনেজ কাছে এসে অবাক হয়ে দেখতে পেল যে ওই গ্রামটা অন্যান্য পাহাড়ি গ্রামের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। গ্রামের চারদিক জুড়ে মখমলের মতো নরম ঘাসের গালিচা বিছানো আছে যেন। পাহাড়ের গায়ে পাথরের বাঁধ দিয়ে জল আটকাবার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। বাঁধের মাঝে মাঝে বাড়তি জল বের করে দেওয়ার ছোট ছোট গর্ত, যার মধ্য থেকে ক্ষীণ জলধারা বিনুনির মতো নেমে এসে বয়ে গেছে সমতলের পাথরে পাথরে। পাহাড় থেকে নেমে আসা জল ধরে রাখার জন্য রয়েছে পাথরের বড় বড় কুন্ড। সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে চমৎকার পরিকল্পনার ছাপ। গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা ছোট ছোট নুড়ি দিয়ে সুন্দর করে বানানো আর তার দু পাশে নানা রঙের সুগন্ধি ফুল। একটা ফুলও চোখে পড়ল না নুনেজের যার গন্ধ নেই। গ্রামে পৌঁছনোর আগে সার সার ইয়ামার খোঁয়াড়। খোঁয়াড়গুলোর ভিতরে গুছিয়ে রাখা রয়েছে ইয়ামাদের খাওয়ার মতো শুকনো ঘাস। বোঝাই যাচ্ছে গ্রামের চাষ ও পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ইয়ামারা ওখানে থাকে। রাস্তাগুলো সোজা আর সমান্তরাল। গ্রামের বাড়িগুলোও বেশ পরিকল্পনা করে বানানো হয়েছে মনে হয়। উঁচু পাথরের দেওয়াল আর কাঠের তৈরি দরজা কিন্তু কোনো বাড়িতেই যা নেই, তা হল জানালা। নুনেজ অবাক হয়ে দেখল গোটা গ্রামের একটা বাড়িতেও জানালা নেই। বাড়ির গায়ে রঙের পোঁচ আছে কিন্তু তা অদ্ভুত। কোথাও কালো, কোথাও সাদা কোথাও বাদামি বা কোথাও ধূসর রং এমনভাবে করা হয়েছে যে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সাযুজ্য তো নেইই, দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন বাড়ির দেওয়ালগুলোতে চোখ বন্ধ করে রঙের পোঁচ টেনে দিয়েছে। নুনেজ আপনমনেই ভাবে এই রংগুলো যে করেছে, সে বাদুড়ের মতো অন্ধ না হয়েই যায় না !
নুনেজ ওই পাথুরে পথ ধরে চলতে থাকল গ্রামের ভিতর দিয়ে। কোথাও মানুষের চিহ্ন দেখতে পেল না ও। বুকের ভিতরটা আশংকায় কেঁপে উঠল নুনেজের। গ্রামটা কি তাহলে মৃতদের গ্রাম নাকি ? আরো খানিকটা এগিয়ে ও দেখতে পেল গাছের ছায়ায় জড়ো করা শুকনো ঘাস বা খড়ের উপর কিছু মানুষ শুয়ে বিশ্রাম করছে আর কয়েকজন বাঁকে করে জলের বালতি নিয়ে চলেছে। লোকগুলোর পরনে ইয়ামার লোমের পোশাক আর মাথায় কান ঢাকা কাপড়ের টুপি। ওদের কোমরের বেল্ট আর জুতো চামড়ার তৈরি। লোকগুলো হাই তুলতে তুলতে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে এমন ভাবে, যেন তারা সারা রাত জেগে কাটিয়েছে। নুনেজকে যেন ওরা কেউ দেখতেই পাচ্ছিল না। নুনেজ তখন একটা উঁচু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে বিরাট এক হাঁক দিল যার শব্দ উপত্যকা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।
সঙ্গে সঙ্গে থমকে থেমে গেল তিনটে লোক। ওরা ওদের মাথা ঘুরিয়ে নুনেজকে খোঁজার চেষ্টা করল। নুনেজও হাত নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী করে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল কিন্তু ওদের রকম সকম দেখে মনে হল না যে নুনেজকে ওরা দেখতে পেয়েছে। একটু পরে ওরাও চিৎকার করে নুনেজকে কিছু একটা বলল। নুনেজ আবার হাত পা নাড়িয়ে ওদের ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করল যার বিন্দুবিসর্গ ওরা বুঝতে পারল বলে মনে হল না। এবার নুনেজ রেগে গজগজ করে উঠল, ‘কী রে বাবা ! বোকাগুলো কী অন্ধ নাকি ?’
নুনেজ এবার চলতে শুরু করল। সরু একটা জলধারার উপর ছোট একটা কাঠের পুল পেরিয়ে ও লোকগুলোর কাছে এগিয়ে এল এবং একটু কাছে আসতেই ও বুঝতে পারল যে ওরা সত্যিই অন্ধ। এবার নুনেজ বুঝতে পারল যে এতদিন ধরে লোকমুখে ও যে পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থিত অন্ধদের দেশের কথা শুনে এসেছে এতকাল, ও আজ সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হল যে সারা জীবনের সেরা অ্যাডভেঞ্চারটা ওর করা হয়ে গেছে। ওই তিনটে লোক নুনেজের দিকে তাকিয়ে নয়, কান এগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা ওকে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর পায়ের শব্দের মাধ্যমে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যে ওরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। ওদের চোখগুলো বন্ধ আর চোখের পাতা এমনভাবে ঢেকে রেখেছে চোখগুলোকে যে মনে হচ্ছে ওদের চোখের মণি জিনিসটাই শুকিয়ে হারিয়ে গেছে। কিছুটা সম্ভ্রম যেন লেগে আছে ওদের মুখের অভিব্যক্তিতে। একজন প্রায় বোঝাই যায় না, এমন স্প্যানিশে বলল, ‘একটা লোক… লোক নাকি পাথরের রাজ্য থেকে নেমে আসা কোনো ভুত ?’
নুনেজ আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ছোটবেলা থেকে ও যত গল্প শুনেছিল ওই গোপন উপত্যকা এবং অন্ধদের দেশ সম্পর্কে, সব ওর মনে পড়ে গেল আর ওর মনের মধ্যে ভেসে উঠল একটা পরিচিত প্রবাদ : অন্ধদের দেশে কানা রাজা। অন্ধদের দেশে কানা রাজা। অন্ধদের দেশে কানা রাজা… কথাগুলো অনুরণিত হতে লাগল নুনেজের মনের মধ্যে।
অত্যন্ত ভদ্রভাবে নুনেজ ওই লোকগুলোকে অভিবাদন জানাল। ওদের একজন অন্যজনকে প্রশ্ন করল, ‘ভাই পেদ্রো, ও কোথা থেকে আসছে, বলো তো !’ ‘পাথরের রাজ্য থেকে,’ অন্য লোকটা উত্তর দিল। ‘আমি ওই বিশাল পাহাড়ের ওধার থেকে একবারে অন্য একটা জগত থেকে আসছি। এমন দেশ থেকে যেখানে মানুষ দেখতে পায়। আমি বোগোতার কাছ থেকে আসছি, বুঝলে? এমন একটা জায়গা, যেখানে মানুষের দৃষ্টিশক্তি আছে’, নুনেজ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে।
‘দৃষ্টিশক্তি!’ একটু বিড়বিড় করে পেদ্রো, ‘দৃষ্টিশক্তি?’
‘আরে ও পাথরের দেশ থেকে আসছে রে !’ দ্বিতীয় লোকটা আবার বলে।
নুনেজ দেখল যে ওদের জামাগুলো বিচিত্রভাবে সেলাই করা। একটা সেলাইয়ের সঙ্গে অন্য সেলাইয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই। অদ্ভুত ব্যাপার !
লোকগুলো এবার হাত বাড়িয়ে নুনেজকে ছুঁয়ে দেখতে শুরু করল। ওদের ছোঁয়ায় নুনেজের অস্বস্তি হচ্ছিল, কাতুকুতু লাগছিল ফলে ও একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তৃতীয় লোকটা শক্ত করে ওকে ধরে ফেলল। ওরা ভালো করে নুনেজের গোটা শরীরে হাত বুলিয়ে ওকে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। ‘আহ ! লাগছে !’ নুনেজ চেঁচিয়ে ওঠে। ওর মুখের উপর হাত বোলাতে বোলাতে লোকটা ওর চোখের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। ‘অদ্ভুত জীব তো রে এটা, কোররেয়া !’ পেদ্রো নামের লোকটা বলে। ‘ওর চুলগুলো দেখ, যেন ইয়ামার লোম !’ অন্য জন মন্তব্য করে। ‘ও তো পাথরের দেশের লোক তাই ও পাথরের মতোই রুক্ষ’, কোররেয়া বলে। তারপর নুনেজের না কামানো গালে হাত রেখে আর ওর ভিজে ভিজে হাতের তালুকে ছুঁয়ে পেদ্রো বলে, ‘এখনো পুরো সাইজে আসে নি মনে হচ্ছে। আর একটু বাড়বে।’ নুনেজের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল আর ও একটু ছটফট করছিল কিন্তু তাতে ওই লোকগুলো কিন্তু ওকে ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে রাখল। ‘এই, সাবধানে !’ নুনেজ একবার অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। ‘দ্যাখ ! এই লোকটা কিন্তু কথা বলে’, গাঁট্টাগোট্টা তৃতীয় লোকটা বলে ওঠে।
নুনেজের গায়ের কোটটার গায়ে হাত ছুঁইয়ে পেদ্রো বলে, ‘আঃ ! কী খসখসে !’
‘তারপর তুমি এই দুনিয়ার ঢুকে পড়লে !’
‘হ্যাঁ, ওই দুনিয়া থেকে। বাইরের দুনিয়া থেকে। পাহাড় আর বরফের নদী পার করে, বুঝলে ? ওওওওই উপর থেকে। ওই বিরাট পৃথিবীটা থেকে। যেখান থেকে আমি নেমে এলাম সেখান থেকে সমুদ্র বারো দিনের পথ’, নুনেজ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে।
ওরা নুনেজের কথায় খুব একটা কান দিল না। কোররেয়া বলল, ‘শোন, আমরা ছোটবেলায় শুনেছি না, মানুষ আসলে প্রকৃতির হাতে গড়া। কিছুটা তাপ থাকে তার মধ্যে, কিছুটা জল আর কিছুটা পচন… পচন।’
‘ওকে বরং গাঁওবুড়োদের কাছে নিয়ে যাই’, পেদ্রো বলে।
‘আগে চেঁচিয়ে বলে দাও। নইলে বাচ্চারা তো ভয় পেয়ে যাবে। এ রকম তো আগে কখনো ঘটেনি’, কোররেয়া উত্তর দেয়।
কাজেই ওরা চিৎকার করে জানান দিল যে ওরা আসছে আর পেদ্রো নুনেজের হাত ধরে ওকে নিজে যাওয়ার চেষ্টা করতেই নুনেজ বলল, ‘দরকার নেই, আমি দেখতে পাই।’
‘দেখতে পাই?’ কোররেয়া অবাক !
‘হ্যাঁ, দেখতে পাই’, বলতে বলতেই নুনেজ পেদ্রোর বালতিটাতে হোঁচট খায়।
‘ওর এখনো বোধশক্তি তৈরি হয়নি’, তৃতীয় অন্ধ লোকটা গম্ভীরভাবে নিদান দেয়, ‘যেখানে সেখানে ধাক্কা খাচ্ছে, অর্থহীন কথাবার্তা বলছে। পেদ্রো, ওকে হাত ধরেই নিয়ে যাও।’
‘বেশ, তোমাদের হাতে যখন পড়েছি,’ নুনেজ হাসতে হাসতে ওদের সঙ্গে চলতে শুরু করে।
বোঝাই যাচ্ছে দৃষ্টি সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই। সময় মতো ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে দেখতে পাওয়া ব্যাপারটা ঠিক কী।
নুনেজের কানে আসছিল মানুষের হট্টগোল আর দেখতে দেখতে চৌরাস্তার মোড়ে জড়ো হয়ে গেল অনেক লোক। সব দেখে শুনে ওর স্নায়ু আর ধৈর্য, দুইয়ের উপরই খুব চাপ পড়ছিল। অন্ধদের দেশ ব্যাপারটা আগে যতটা সহজ মনে হচ্ছিল ওর, কার্যকালে ও বুঝল যে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। যত ও ওই চৌরাস্তার মোড়ের কাছে এগোচ্ছিল, জায়গাটাকে ততই বিশাল মনে হচ্ছিল। চারদিকে দেওয়ালের রঙের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই, তবে রাস্তাগুলো চমৎকার। ও আরো কাছে যেতেই নারী পুরুষ বাচ্চা মিলিয়ে ওকে যেন ছেঁকে ধরল এক বিশাল জনতা। ওদের সবারই চোখের পাতা বন্ধ এবং চোখের মণি নেই বলেই মনে হয়। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই বেশ মিষ্টি দেখতে। ওরা ওর কথা শুনছিল, ওর হাত ধরছিল, কাছে ঘেঁষে এসে গন্ধ নিচ্ছিল ওর শরীরের। ওদের গলার স্বর পাখির মতো মিষ্টি লাগছিল নুনেজের। ওদের সামনে ওর নিজের গলাকে রুক্ষ বলে মনে হচ্ছিল ওর যে কারণে কিছু মেয়ে আর বাচ্চা ওর কাছে আসছিল না, দূর থেকে ওকে দেখছিল। বাকিরা একদম ঘিরে ফেলেছিল ওকে এবং ওদের সব কিছুর মধ্যেই মিশে ছিল দুরন্ত কৌতূহল। যে তিন জন লোক ওকে নিয়ে এসেছিল, তারা যেন ওকে ওদের সম্পত্তি ভেবে নিয়েছিল। ওরা অন্যদের কাছে নুনেজের পরিচয় দিচ্ছিল ‘পাথরের রাজ্যের জংলি’ বলে।
‘বোগোতা’, নুনেজ বলার চেষ্টা করে, ‘পাহাড়ের ওপারে বোগোতায় থাকি আমি। বোগোতা, বুঝেছ? বোগোতা !’ ওর কথা শুনে সমবেত জনতার মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। একটা বাচ্চা নুনেজকে নকল করে বলে উঠল, ‘বোগোতা! বোগোতা!’ ‘হাসছ তোমরা? নুনেজ রেগেমেগে বলে ওঠে, ‘বোগোতা একটা কত্ত বড় শহর জানো? আর সেই শহরে যারা বাস করে তাদের চোখ আছে, তারা দেখতে পায়।’ ‘কী বলছে লোকটা? ওর একটা কথাও তো বোঝা যাচ্ছে না! কী সব কথা! শহর, চোখ, দেখতে পায়! কী যে বলছে!’ কেউ একটা বলে ওঠে। ‘ওর নাম নিশ্চয়ই বোগোতা,’ অন্য একজন মন্তব্য করে, ‘ও আসলে ঠিক বড় হয়নি। আধো আধো কথা বলছে দেখো, যার বেশির ভাগেরই কোনো মানে নেই।’ ‘আরে, যখন তখন ও হোঁচট খায়, ওর পা পিছলে যায়। নিজের শরীরটাকেই তো ও সামলে উঠতে পারে না। এইটুকু রাস্তা হেঁটে আসতেই তো ও দুবার হোঁচট খেল!’ প্রথম জন আবার বলে ওঠে।
এবার কোররেয়া বলে, ‘ওকে মাতব্বরদের কাছে নিয়ে চলো। ওরাই বলে দেবেন ওকে নিয়ে কী করা যাবে !’
বলতে বলতে একগাদা লোক হঠাৎ নুনেজকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে। ঘরটার এক কোনায় টিমটিম করে একটু আগুন জ্বলছিল শুধু। নুনেজ নিজেকে সামলাতে না পেরে সপাটে আছাড় খেয়ে পড়ে মাটিতে আর ওর মাথাটা গিয়ে ঠুকে যায় একটা লোকের পায়ের উপর আর ওর ছড়িয়ে থাকা হাত একটা লোকের মুখের উপর আছড়ে পড়ে। দু দিক থেকেই ভেসে আছে ব্যথা আর রাগ মেশানো একটা চিৎকার আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো হাত ওকে চেপে ধরে। নুনেজের কাছে ওই একতরফা লড়াইতে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। তবু ও বলল, ‘কী করব? এই রকম অন্ধকারে কেউ দেখতে পায়?’ চারদিকটা হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেল। লোকগুলো যেন ওর কথার মানে বোঝার চেষ্টা করছিল। নুনেজ শুনতে পেল কোররেয়ার গলা, ‘ও এখনো বড় হয়নি। ও হাঁটতে গেলে হোঁচট খায় আর ওর কথা বোঝে সাধ্য কার ?’ আবার একটা গুঞ্জন উঠল লোকেদের মধ্য থেকে নুনেজ যার বেশির ভাগটাই বুঝতে পারল না।
‘আমি কি একটু উঠে বসতে পারি? তোমাদের সঙ্গে কোনো লড়াইতে আমি যাব না, কথা দিচ্ছি’, নুনেজ বলে। সম্মিলিত মানুষগুলোর মধ্য থেকে আবার একটা অস্পষ্ট কলরব শোনা যায় আর তারপর কেউ একজন ওকে ধরে বসিয়ে দেয়।
এবার ঘোর অন্ধকারের মধ্য থেকে ভেসে আসতে লাগল একটা বয়স্ক কণ্ঠে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। নুনেজ বোঝাবার চেষ্টা করল যে জগতটা থেকে সে দৈব দুর্বিপাকে ওই উপত্যকাটায় ছিটকে এসে পড়েছে, সেটা কেমন। কী আশ্চর্য ওর চেনা প্রকৃতি! নীল আকাশ, তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণী, বর্ণময় সূর্যাস্তের কথা বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকল নুনেজ অন্ধদের দেশের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার একটা ঘরের মধ্যে বসে। যারা ওর কথা শুনছিল তারা সে কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারছিল না, বিশ্বাস করা তো দূরের কথা! নুনেজ এটা আশা করেনি। ওর মনে হয়েছিল অন্ধদের দেশে একমাত্র চক্ষুষ্মান মানুষ হিসেবে ওখানকার লোকেরা ওকে দেবতার আসনে বসাবে। কিন্তু ওই অন্ধদের দেশের লোকেরা ততদিনে আর বুঝতেই পারে না চোখ কী, দৃষ্টি ব্যাপারটা ঠিক কেমন। চোদ্দ পনেরো প্রজন্মের অন্ধত্ব ওদের কাছে থেকে মুছে দিয়েছে দৃশ্য জগতের স্মৃতি। ওদের কাছে বাইরের পৃথিবীর গল্পের সঙ্গে রূপকথার গল্পের কোনো পার্থক্য নেই। ওদের পাথুরে পাহাড়ঘেরা ওই উপত্যকাটার বাইরে আর কোনো কিছুই ওদের কাছে সত্য কিংবা বাস্তব নয়। কিছু প্রজন্ম আগেও হয়তো কিছু মানুষের মধ্যে থেকে গিয়েছিল দৃশ্য জগতের স্মৃতি বা অন্তত ধ্যানধারণা কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই ধ্যান ধারণার জায়গা নিয়েছে ওদের বাস্তব পৃথিবীর অনুভব, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা। ওদের কল্পনার জগতেও আর দেখার কোনো জায়গা নেই। সে জায়গা নিয়ে নিয়েছে শ্রুতিকল্পনা এবং স্পর্শকল্পনা। ধীরে ধীরে নুনেজের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকতে লাগল। ওরা ওকে অপরিণতমনস্ক ভাবছে কারণ দৃষ্টি সম্পর্কিত যা কিছু বর্ণনা ও করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল এতক্ষণ ধরে ওদের কাছে সেগুলো ওদের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না তাই সেগুলো ভুল বকা ছাড়া কিছু নয়। নুনেজ তাই নিজের কথা বলা বন্ধ করে ওদের কথা শোনার আর বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটাই ওদের গাঁওবুড়ো। সে নুনেজকে বলতে থাকল ওদের জীবন, মনন আর জগত সম্পর্কে (যে জগতটা ওই উপত্যকার মধ্যেই সীমিত)। কীভাবে কিছু মানুষ অনেক অনেক যুগ আগে এসে পৌঁছেছিল এই পাথর ঘেরা জগতটার মধ্যে এবং কীভাবে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ওরা শিখল ফসল ফলাতে, ওদের সুবিধার জন্য ঈশ্বর প্রেরিত জীব ইয়ামাগুলোর যত্ন নিতে এবং চাষের কাজে আর দুধ আর মাংসের জন্য ওই জীবগুলোকে ব্যবহার করতে। এই উপত্যকাটাই ওদের কাছে স্বর্গ, যেখানে ওদের জল সরবরাহ করার জন্য পাহাড় থেকে নেমে আসে জলের ধারা। এখানে আছে ডানা ঝাপটানো কিছু জীব যাদের ছোঁয়া যায় না আর তারা ওদের নানা ধরনের গান শোনায়। ওরা মনে করে সে গান স্বর্গের। নুনেজ একটু ভেবে বুঝতে পারল যে ওরা পাখিদের কথা বলছে।
বয়স্ক লোকটা নুনেজকে বুঝিয়ে বলতে লাগল যে সময় জিনিসটা দু ভাগে বিভক্ত; গরম আর ঠাণ্ডা। নুনেজ বুঝতে পারল যে অন্ধরা এ ভাবেই দিন আর রাত বোঝে। ওরা বলল যে গরম সময়টা ঘুমোনোর জন্য আর ঠাণ্ডা সময়টায় কাজ করতে হয়। এবার নুনেজ বুঝতে পারল যে যখন ও সন্ধ্যা বেলায় ওই গ্রামটায় এসে পৌঁছেছিল, কেন বেশির ভাগ মানুষ তখন হয় ঘুমিয়ে ছিল, নয় সবে ঘুম থেকে উঠেছে বলে ওর মনে হচ্ছিল। নুনেজকে ওরা অভয় দিয়ে বলল যে ওর কোনো ভয় নেই। ও খুব তাড়াতাড়িই মানুষ হিসেবে ওর ত্রুটিগুলো, যেমন চলতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া বা উল্টোপাল্টা অর্থহীন কথা বলা, কাটিয়ে উঠতে পারবে। ও যখন ওদের কাছে এসেই পড়েছে, ওরা ওকে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। ওকে শুধু শেখার চেষ্টাটা জারি রাখতে হবে।
গাঁওবুড়োর কথা শেষ হতেই সবাই একসঙ্গে নুনেজকে উৎসাহ জোগাতে উঠে পড়ে লাগল। ততক্ষণে রাত শেষ হয়ে আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই সময়টাকে, অর্থাৎ দিনকে ওরা রাত বলে আর রাত হল ঘুমোতে যাওয়ার সময়। নুনেজের কাছে ওরা জানতে চাইল যে সে ঘুমোতে জানে কীনা যার উত্তরে নুনেজ বলল যে সে ঘুমোতে জানে কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার আগে ওর কিছু খাবারের প্রয়োজন।
ওরা ওর জন্য বাটি করে ইয়ামার দুধ আর নোনতা রুটি নিয়ে এল। ওকে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেল খাওয়ার আর তার পরে ঘুমোনোর জন্য। ওরা বলে গেল পাহাড়ের ঠাণ্ডা হাওয়াই ওর ঘুম ভাঙিয়ে দেবে আর তখন শুরু হবে ওদের দিন অর্থাৎ নুনেজের রাত। নুনেজ খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল কিন্তু ওর চোখে ঘুম এল না। ও বারবার ভাবতে লাগল একটা দিনের মধ্যে কী অসম্ভব অবিশ্বাস্য রকমের একটা পরিবর্তন এসে গেছে ওর জীবনে! মাঝে মাঝেই ও হেসে উঠছিল নিজের মনেই কখনো মজায় কখনো তিক্ততায়।
‘বুদ্ধি পাকেনি! অপরিণত মন! এখনো ঠিক করে হাঁটতে শেখেনি!’ নুনেজ আপন মনেই হাসতে থাকে। আরে! ব্যাটারা জানেই না, বোঝেই না যে ওই অন্ধদের দেশে রাজা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে নুনেজের আবির্ভাব। ওদের মাথায় ঢোকাতে হবে যে নুনেজ ওদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে আছে কারণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন কিন্তু কী করে? নুনেজ ভাবতে থাকে, ভাবতেই থাকে। দিন রাতের দিকে গড়িয়ে চলে। অন্ধদের ঘুম ভাঙার সময় এগিয়ে আসে। নুনেজ জেগে বসে থাকে একলা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিরদিনই নুনেজকে খুব আকর্ষণ করে। সন্ধ্যার মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে ও খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াল। ওর চোখের সামনে ঝলমল করে উঠল সূর্যের শেষ আলো রাঙিয়ে ওঠা তুষারশৃঙ্গগুলি যাদের মাঝখান দিয়ে নেমে এসেছে দুধের নদীর মতো হিমবাহ। ওর সামনে বিছিয়ে আলো অস্ত আলোর রঙে রাঙানো স্বচ্ছ জলের নদী, নদীর দুপাশে ফসলের ক্ষেত আর ফসল ক্ষেতের শেষ সীমায় নেমে আসতে থাকা কুয়াশার পর্দা। হঠাৎ করে এক অব্যক্ত আবেগ ঢেউ তুলল নুনেজের মনের মধ্যে। ও মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল ওকে দৃষ্টিশক্তি দেওয়ার জন্য। এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর হতে পারে না।
এমন সময় নুনেজ শুনতে পায় পিছন থেকে কে যেন ডাকছে, ‘অ্যাই! অ্যাই বোগোতা! এদিকে এসো!’ ডাকটা শুনে নুনেজ উঠে দাঁড়ায় আর ওর মুখে ফুটে ওঠে একটা দুষ্টু হাসি। এইবার সে ওই অন্ধগুলোকে বুঝিয়ে ছাড়বে চোখে দেখতে পাওয়া আর না পাওয়ার ফারাকটা কোথায়। ও চুপি চুপি সরে পড়বে ওই জায়গাটা থেকে। ওরা ওকে খুঁজে হয়রান হবে। ও তখন ওদের কাছে ধরা দেবে যখন ওর ইচ্ছে হবে। এই ভেবে নুনেজ নিঃশব্দে একটু হাসল আর তারপর চুপিসাড়ে একটু সরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিক থেকে আওয়াজ এল, ‘এটা কী করছ বোগোতা? ঘাসের উপর গিয়ে দাঁড়ালে কেন? ঘাসের উপর যাওয়া বারণ।’
নুনেজ হতবাক! ও খুবই নিঃশব্দে ঘাসের উপর দাঁড়িয়েছিল যাতে ওর পায়ের শব্দ শোনা না যায় এবং ও একেবারে নিশ্চিত যে ঘাসের উপর একটুকুও পায়ের শব্দ ও করেনি। তাহলে? এবার অন্য লোকটা নুনেজের কাছে ছুটে এল পাথুরে রাস্তা ধরে। নুনেজ আবার রাস্তার দিকে সরে এসে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি এখানে!’ ‘সে কি আর আমি জানি না? কিন্তু তোমাকে যখন ডাকলাম আমি তখন তুমি এলে না কেন? তোমাকে কি বাচ্চাদের মতো হাত ধরে হাঁটা শেখাতে হবে? তুমি হাঁটার সময় রাস্তার শব্দ শুনতে পাও না, নাকি?’ লোকটা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল। ‘আমি রাস্তার শব্দ কেন শুনব? আমি তো রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছি’, নুনেজ হাসতে হাসতে জবাব দেয়। ‘দেখা… দেখতে পাওয়া… এগুলো অর্থহীন কথা। কতবার তোমাকে আমরা বলেছি এই কথা !’ লোকটা এবার রীতিমতো ধমক দেয় নুনেজকে, ‘এই সব আবোলতাবোল কথা বলা বন্ধ করে আমার পায়ের শব্দ শুনে আমার পিছনে পিছনে এসো।’
নুনেজের একটু রাগই হল। ‘ঠিক আছে, আমার দিনও আসবে’, ও নিজের মনেই বলল। ‘একটু চেষ্টা করলে শিখে যাবে তুমি,’ লোকটা নুনেজের আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘এই দুনিয়ায় কত কিছুই যে শেখার আছে !’ ‘আচ্ছা, তোমরা কখনো এই কথাটা শুনেছ যে অন্ধদের দেশে কানা রাজা?’ নুনেজ লোকটাকে প্রশ্ন করে। ‘অন্ধ মানে কী আর কানা বলতেই বা কী বোঝায়?’ লোকটা নুনেজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে জানতে চায়।
এইভাবে কেটে গেল চার চারটে দিন। নুনেজ দেখল ও যাদের রাজা হওয়ার কথা ভাবছিল, তারা ওকে একটা বোকা এবং অসমর্থ মানুষ ছাড়া কিছুই ভাবছে না। ওদের ব্যবহারে শ্রদ্ধা ভক্তি দূরে থাক, রয়েছে একটা করুণায় ভরা তাচ্ছিল্য। ওদের কথা শুনে চলা ছাড়া ওর কোনো উপায় ছিল না। ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে নুনেজকে শিখতে হল ওই অন্ধদের দেশের রীতিনীতি, নিয়ম আর অভ্যাস। রাতে ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নীচে কাজ করতে নুনেজের অসুবিধা হত। ও সিদ্ধান্ত নিল যে এই ব্যাপারটা বদলাতে হবে। রাতের পরিবর্তে দিনে কাজ করার সুবিধা অনেক বেশি।
ওই উপত্যকার মানুষগুলোর জীবনযাত্রা ছিল সহজ সরল। অল্পেতেই ওরা সন্তুষ্ট থাকত কারণ প্রকৃতির কাছ থেকে ওরা যেটুকু পেত, তার বাইরেও যে জগতে কিছু আছে বা থাকতে পারে, সে ধারণাই ওদের ছিল না। মেয়ে পুরুষ সবাই খুবই পরিশ্রম করত ঘরে বাইরে কারণ ওদের জীবনযাত্রা ছিল প্রাগৈতিহাসিক কালের মতো। ওদের মধ্যেকার সম্পর্কগুলোও ছিল জটিলতাবিহীন। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বাইরে ওদের কোনো চাহিদা ছিল না। অতিরিক্ত কিছুর জন্য মারামারি কাড়াকাড়ি ওদের কল্পনার বাইরে ছিল। দিনের উষ্ণ সময়টা ওরা বিশ্রাম করত আর শীতল সময়টায় কাজ করত। মাঝে মাঝে ওরা রাতের বেলা কাজ বন্ধ করে গান গাইত, বাজনা বাজাত, প্রাণ ভরে আনন্দ করত।
সবচেয়ে আশ্চর্যের যেটা ছিল সেটা হল কী অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে ওরা নিজেদের যাবতীয় কাজকর্ম করে যেত। চোখ বা দৃষ্টি না থাকার ফলে ওদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হত না। রাস্তাঘাটগুলো তৈরি করা হয়েছিল সমান্তরালভাবে যেগুলি সমকোণে মিলিত হত একটা অন্যটার সঙ্গে। রাস্তাগুলো ছিল পরিচ্ছন্ন। কোথাও একটুও উঁচু নিচু ছিল না, যাতে কেউ হোঁচট না খায়। ওদের প্রয়োজন অনুযায়ী অত্যন্ত সুব্যবস্থিত ছিল ওদের দেশের সব কিছুই। ওরা দৃষ্টিহীন হওয়া সত্বেও ওদের বাকি ইন্দ্রিয়গুলো ছিল অতিরিক্ত সজাগ, বিশেষ করে ওদের কান আর হাতের আঙুল। দূর থেকেই ওরা মানুষের হৃদস্পন্দন শুনতে পেত। কুকুরের মতো করে ওরা গন্ধ দিয়ে মানুষ চিনতে পারত। মুখের পেশি সঞ্চালনের পরিবর্তে স্বরক্ষেপণের মাধ্যমেই প্রকাশ পেত ওদের অভিব্যক্তি। কী সহজে এবং নির্ভুলভাবে ওরা ব্যবহার করত কোদাল, কাস্তের মতো কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি, জামা কাপড় সেলাই করত সূচ দিয়ে। কৃষি থেকে পশুপালন, গেরস্থালি থেকে বাইরের কাজ কোথাও চোখের অভাবে ওদের কোনো সমস্যা হত বলে নুনেজের মনে হয়নি। কাজেই নুনেজ ভেবে উঠতে পারছিল না যে কী করে ও নিজেকে ওদের চোখে ওদের চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করবে।
এক এক সময় নুনেজের মধ্যে এমন একটা অসহায় হতাশা তৈরি হত, যে ওর মনপ্রাণ যেন বিদ্রোহ করে উঠত। কতগুলো অন্ধ লোক ওকে বুঝিয়ে ছাড়বে যে দৃষ্টি বলে কিছু হয় না? ও কয়েকবার ওদের অন্যভাবে দৃষ্টি কাকে বলে বোঝাবার চেষ্টা করল। ও শান্ত হয়ে ধৈর্য ধরে ওদের বলতে গেল, ‘দেখো, আমার এমন একটা বাড়তি ব্যাপার আছে, যা তোমাদের মধ্যে নেই এবং তোমরা সেটা বোঝার চেষ্টাও করছ না!’
এক এক সময় লোকগুলো ওর কথা শোনার এবং বোঝার চেষ্টাও করত। ওরা মাথা নিচু করে ওদের কানদুটো বাড়িয়ে রাখত নুনেজের দিকে। নুনেজও ওদের আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করত দৃষ্টি ব্যাপারটা ঠিক কী রকম ! যারা নুনেজের কথায় কিছুটা হলেও মনোনিবেশ করার চেষ্টা করত তাদের মধ্যে ছিল একটা কিশোরী মেয়ে। ওর বন্ধ চোখদুটো অন্যদের তুলনায় কম লাল ছিল আর ওর বন্ধ চোখের মধ্যেকার মণিটা অন্তত কিছুটা হলেও চোখে পড়ত নুনেজের। মাঝে মাঝে নুনেজের মনে হত যে ওই মেয়েটির চোখে দৃষ্টি আছে। ও অভ্যাসের বশে চোখ বন্ধ করে থাকে। নুনেজ ওদের খুব আবেগের সঙ্গে বর্ণনা করত সূর্যোদয়ের রঙের খেলা কিংবা সূর্যাস্তের সময়ে বরফের পাহাড়ের উপরে পিছলে পড়া সোনালী সৌন্দর্য। লোকগুলো প্রথম দিকে মজা পেত নুনেজের কথায় কিন্তু পরের দিকে ওরা বিরক্ত হত ওদের কাছে অর্থহীন ওই কথাগুলো বার বার শুনতে। ওরা নুনেজকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল যে বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া বলে কিছু হয় না। এই উপত্যকার চারদিকে যত দূর ওদের পোষা ইয়ামাগুলো চরে বেড়ায়, তত দূরই মানুষের পৃথিবীর সীমানা। তারপর আর কিচ্ছু নেই। তারপর শুধুই হাওয়ার শব্দ! ওই হাওয়ার দেশ থেকে কখনো জলের ফোঁটা পড়ে, কখনো কখনো জমাট জলের ফোঁটাও পড়ে, কখনো পাথরের দেশ থেকে হুড়মুড় করে নেমে আসে জল বরফ আর পাথর মিলিয়ে ভয়ংকর কী একটা। কিন্তু সে সব দেশে কেউ যেতে পারে না। সেখানে দেবতাদের রাজত্ব। মানুষদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।
একবার নুনেজ অনেকটা দূরে পেদ্রোকে দেখতে পেল। সে হেঁটে যাচ্ছিল ওদের ভাষায় সতেরো নম্বর রাস্তা ধরে। নুনেজ জাদুকরের মতো করে ভবিষ্যৎবাণী করে বসল, ‘আমি পেদ্রোকে দেখতে পাচ্ছি। একটু পরেই পেদ্রো এইখানে চলে আসবে। ওর পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ লোকটি বলল, ‘বললেই হল! পেদ্রোর পায়ের শব্দ মোটেই এদিকে আসার মতো নয়!’ ‘দেখা যাক!’ নুনেজ চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বলে এবং পরক্ষণেই ও খেয়াল করে যেন ওকে ভুল প্রমাণিত করার জন্যই পেদ্রো দশ নম্বর রাস্তায় ঢুকে পড়ল আর ওর থেকে অনেক দূরে চলে গেল। নুনেজের কাছে দাঁড়িয়ে যারা নুনেজের কথা শুনছিল, তারা হাসি ঠাট্টায় ফেটে পড়ল আর পেদ্রো যখন পরে জানতে পারল যে নুনেজ ওকে নিয়ে এই রকম ছেলেখেলা করছিল, তখন সে বেজায় চটে গেল নুনেজের উপর।
নুনেজ কিন্তু ওর দৃষ্টিশক্তির বিশেষ সুবিধার ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টাতে ক্ষান্ত দিল না। ও বলল যে ও পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাবে আর ওখান থেকে যা কিছু ও দেখতে পাবে সেগুলোর কথা ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবে গ্রামবাসীদের কাছে। ওরাও বেশ মজার একটা ব্যাপার পেল। নুনেজ পাহাড় বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে গেল এবং ও আবিষ্কার করল যে সময়টা দিনের বেলা ফলে কোনো মানুষই বাড়ির বাইরে নেই। সবাই ওই জানালাহীন ঘরগুলোর মধ্যে ঘুমোচ্ছে। ফলে ফিরে এসে বর্ণনা করার মতো কিছু থাকল না নুনেজের কাছে। রাতের বেলা ওই পাহাড় বেয়ে কষ্ট করে ওঠা বৃথা কারণ ওখান থেকে কুয়াশার মধ্য দিয়ে নুনেজের চোখে পড়বে না খুব একটা কিছু। ফলে নুনেজ যা করে দেখাবে বলে দাবি করেছিল, তার কিছুই সে করতে পারল না আর তাতে আরো বেশি করে অন্ধদের ব্যঙ্গ আর রং তামাশার পাত্র হয়ে দাঁড়াল। রাগে নুনেজের গা রিরি করতে থাকল। ওর মনে হল হাতের কাছে একটা কোদাল জাতীয় কিছু থাকলে ও সোজা সেটা বসিয়ে দিত কারো একটার মাথায়। একটা কোদাল ও হাতে তুলেও নিয়েছিল কিন্তু যেই মুহূর্তে নুনেজের মাথা একটু ঠাণ্ডা হল, ও বুঝতে পারল যে একজন অন্ধ মানুষকে ও জেনে বুঝে আঘাত করতে পারবে না।
অন্ধরা কিন্তু বুঝে গিয়েছিল যে নুনেজ একটা কোদাল তুলে নিয়েছে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠল। ওদের শরীরগুলো টানটান হয়ে উঠল আর ওদের কানগুলো ঘুরে গেল নুনেজের দিকে। ‘অ্যাই! কোদালটা নামিয়ে রাখো’, কেউ একটা আদেশ করল নুনেজকে। নুনেজ চমকে উঠল লোকটার কথা শুনে। একটা অদ্ভুত ভয় যেন গ্রাস করে নিল ওকে। এক পা পিছিয়ে গিয়ে একটা লোককে ঠেলে সরিয়ে নুনেজ পাগলের মতো ছুট দিল গ্রামের প্রান্ত ধরে।
মাঠের উপর দিয়ে প্রাণপণ ছুটতে থাকল নুনেজ। ওর পায়ের নীচে পিষে যেতে থাকল মাঠের ঘাসগুলো। নুনেজ জানে এইভাবে ঘাসের উপর দিয়ে ছোটা বারণ কিন্তু ও একেবারে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ ছুটে ও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মাঠের মধ্যেই। ওর শরীরের সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ও দেখতে পেল নির্ভুলভাবে ওকে অনুসরণ করে ছুটে আসছে এক দল লোক। ওদের হাতে কোদাল, শাবল, লাঠি। নুনেজ বুঝতে পারল ওদের কাছে ও আবারও হেরে গেছে। আরো অনেক লোক এসে ভিড়ছে ওদের দলে। ওরা একটা জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসে কী যেন শুঁকতে লাগল। নুনেজ নিঃশব্দে হাসতে থাকল ওদের কাণ্ড কারখানা দেখে কিন্তু ওর সেই হাসি মুছে গেল পর মুহূর্তেই।
একটা লোক ঘাসের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল নুনেজের দিকে। নুনেজ নিজের জায়গা উঠে পিছু হটতে লাগল এবং একটা সময় আবিষ্কার করল যে গ্রামটাকে ঘিরে থাকা উঁচু পাথরের দেওয়ালে ওর পিঠ থেকে গেছে আর সেই দেওয়াল টপকানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে লোকগুলো ধীরে ধীরে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি বেষ্টনী তৈরি করে ফেলেছে নুনেজকে মাঝখানে রেখে।
নুনেজ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। ওর কানের মধ্যে বাজতে থাকল ছোটবেলায় শোনা প্রবাদ বাক্য, ‘অন্ধদের দেশে কানারাই রাজা!’ হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে কোদালটাকে। কী করবে ও এখন? ও কি আক্রমণ করবে ওদের?
এদিকে রাস্তা ধরে পিলপিল করে এগিয়ে আসছে ওর অনুসরণকারীরা। প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে তাদের সংখ্যা। কী করবে নুনেজ এখন? ওদের আক্রমণ করবে নাকি পালাবার চেষ্টা করবে? পালাবার চেষ্টা কী করেই বা করবে নুনেজ? ওর সামনে এক বিশাল জনতা আর পিছনে এক বিশাল প্রাচীর।
‘বোগোতা! তুমি কোথায় বোগোতা?’ গম্ভীর গলায় একটা ডাক ভেসে আসে। নুনেজ কোদালটা তুলে ধরে। এবার লোকগুলো সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ধরেছে ওকে। ও নিজেকে বলতে থাকে, ‘আমায় যদি ওরা মারে, আমি পাল্টা মার দেবই! ঈশ্বরের দিব্যি, আমি পাল্টা মার দেবই!’ তারপর লোকগুলোর উদ্দেশ্যে ও চিৎকার করে বলে, ‘শোনো ঈশ্বর আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তোমাদের নেতা, তোমাদের রাজা হিসেবে। আমি এখানে আমার ইচ্ছে মতো চলব। যেখানে খুশি যাব আর যা খুশি করব। বুঝতে পারছ তোমরা ? আমি এখানে আমার মর্জির মালিক!’
লোকগুলো নিঃশব্দে ঘিরে ধরল নুনেজকে। ওর নড়াচড়া করার জায়গাও রইল না খুব একটা। যেন সবাই মিলে কানামাছি খেলতে। একজন ছাড়া কেউ দেখতে পারছে কিন্তু সেই একজন দৃষ্টিমানকে ঘিরে ধরেছে অজস্র দৃষ্টিহীনের দল। নুনেজ ভেঙে পড়তে পড়তে বলল, ‘তোমরা বুঝতে পারছ না যে তোমরা অন্ধ আর আমি দেখতে পাই। আমি তোমাদের চেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা মানুষ। আমাকে তোমরা আমার মতো থাকতে দাও!’
‘বোগোতা! কোদালটা ফেলে দাও আর ঘাস থেকে সরে এসো। ঘাসগুলোকে নষ্ট কোরো না!’ নুনেজের পাশ থেকে কে একটা চেঁচিয়ে বলল। নুনেজ মাটিতে বসে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতেই ও বলতে থাকল, ‘আর এগিও না তোমরা। আমি কিন্তু মেরে দেব এবার। ভগবানের দিব্যি, আমি মেরে দেব কিন্তু। আমাকে নিজের মতো করে থাকতে দাও!’
হঠাৎ করে নুনেজ এক লাফে উঠে পড়ে ছুট লাগাল। সামনের লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে ও ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেল একটু। তারপর যে ওর সামনে আসে, তাকে ঠেলে ধাক্কে ও উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এবার দু দিক থেকে দুটো লোক ওর পথ আটকে দাঁড়ায়। নুনেজ ভয়ের চোটে এলোপাথাড়ি কোদাল চালিয়ে দেয়। একটা লোক কাতরে ওঠে আর ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে।
এবার অন্য লোকগুলোও হিংস্র হয়ে ওঠে। চিৎকার করতে করতে, লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ওরা নুনেজের পিছু নেয়। একটা লম্বা লোক পথ আটকে দাঁড়ায় নুনেজের। নুনেজের তাকে আঘাত করে কোদাল দিয়ে। তারপর দুটো লোকের ফাঁক গলে দৌড় লাগায়।
চারদিকে এতগুলো লোক দেখে নুনেজ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর মাথা আর কাজ করছিল না। ও বুঝতেই পারছিল না যে ও কোথায় আছে, কোন দিকে ছুটছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল ওর আর ও মাটিতে পড়ে গেল। ওর পড়ে যাওয়ার শব্দ কানে যেতেই লোকগুলো ঘিরে ধরল ওকে। নুনেজ আবার উঠে পড়ল আর নদীর দিকে ছুট দিল। অন্যরাও গর্জন করতে করতে ছুটল ওর পিছন পিছন। নদীর উপরে একটা কাঠের পুল আর সেই পুলে ওঠার মুখেই একটা বাচ্চা ইয়ামার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে নুনেজ চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল। ওর শরীরে আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও রইল না।
এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটল নুনেজের বিদ্রোহের। গ্রামের লোকেরা ওকে মারধোর করল না কিন্তু ওরা ওকে ফেলে রেখে এল গ্রামের সীমানার বাইরে। দু দিন ধরে এক দানা খাবার বা এক ফোঁটা জলও জুটল না নুনেজের। মাঝে মাঝেই ওর মাথার মধ্যে ফিসফিস করে উঠত ওর চিরচেনা প্রবাদটা, ‘অন্ধদের দেশে কানা রাজা!’ নুনেজ অনেক ভাবার চেষ্টা করল ও কীভাবে এখানকার লোকেদের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে। অতগুলো লোকের সঙ্গে যে ও লড়াই করে পারবে না, তা তো প্রমাণিতই হয়ে গেছে। ওর কাছে উন্নতমানের অস্ত্রও নেই আর এই পরিস্থিতিতে ও সহজে হাতে পাবে না কোনো অস্ত্র।
লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রামে ঢুকে একটা লোককে মেরে ফেলা খুব কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু তারপর? ও নিজেকে ওদের সামনে যতই ভয়ংকর প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন, কখনো না কখনো ওকে তো ঘুমোতেই হবে। তখন? এবার নুনেজ কী করবে? কী খাবে? কীভাবে বাঁচবে? পাইনের জঙ্গলের মধ্যে খাওয়ার মতো কোনো রকমের ফল বা কন্দ পাওয়া গেল না। নুনেজ ভাবল দু একটা ইয়ামাকে পাথর দিয়ে মেরে যদি তাদের মাংস খাওয়া যেত কিন্তু ইয়ামাগুলো নুনেজকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করার দিকে গেল না। নুনেজ ওদের দিকে এগোলেই ওরা নুনেজের দিকে অবিশ্বাসী বাদামি রঙের চোখ মেলে তাকায় আর থুথু ছিটিয়ে ছুটে পালায়।
দ্বিতীয় দিন ওইভাবে থাকতে থাকতে নুনেজ ভীষণ অসুস্থ বোধ করতে লাগল। ওর সারা শরীর কাঁপতে লাগল জ্বরাক্রান্ত রুগির মতো। ও কোনো মতে নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে গ্রামের প্রাচীর পেরিয়ে ঢুকল গ্রামের মধ্যে। নদীর ধার ধরে একটু এগিয়েই দুটো অন্ধ লোককে দেখতে পেয়ে ও চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল আর ওরাও এগিয়ে এল ওর সঙ্গে কথা বলতে।
‘আমার অন্যায় হয়ে গিয়েছিল’ নুনেজ বলে, ‘আর এ রকম হবে না।’ ‘ভালো কথা। এর পর থেকে ভালো হয়ে থেকো, কেমন?’, একটা লোক উত্তর দেয়। হঠাৎ করে বাঁধভাঙা কান্নায় আকুল হয়ে ওঠে নুনেজ। কেন, তা ও নিজেও জানে না। ওর মনে হচ্ছিল ওর শরীরটা বইবার ক্ষমতাও ওর আর নেই। ততক্ষণে আরো কিছু লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। নুনেজকে কাঁদতে দেখে তাদেরও খুব মায়া হল ওর জন্য।
‘কী? তুমি কি দেখতে পাও?’ একজন বয়স্ক লোক নুনেজকে জিজ্ঞাসা করল। ‘না, পাই না’, নুনেজ উত্তর দিল, ‘দেখা বলে কিচ্ছু হয় না। আমারই মনের ভুল ছিল ও সব।’ ‘তাহলে… তোমার মাথার উপর কি আকাশ আছে? বরফ আছে?’ আর একটা প্রশ্ন ছুটে এল। ‘না না কিচ্ছু নেই!’ বাচ্চার মতো কাঁদতে কাঁদতে নুনেজ বলে, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে খেতে দাও!’
নুনেজ সাংঘাতিক কোনো শাস্তির ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু দেখা গেল অন্ধ লোকগুলোর মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা নেই। ওরা নুনেজের বিদ্রোহকে ওর মানসিক সমস্যার প্রমাণ বলেই ধরে নিল। ওরা একে অপরকে এটাই বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে নুনেজ বাচ্চা না হয়েও ও বাচ্চার মতোই। ওর মনের বিকাশ ঠিক মতো হয়নি বলেই ও অনেক কিছু পারে না, অনেক কিছু বোঝে না আর সে কারণেই ও অনেক সময় উল্টো পাল্টা কথা বলে আর উল্টো পাল্টা কাজ করে। ওকে ধৈর্য ধরে শিখিয়ে নিতে হবে আর মেনে নিতে হবে যে ও আর দশটা সাধারণ মানুষের চেয়ে পিছিয়ে আছে। ওকে বশে রাখার জন্য মাত্র কয়েক ঘা চাবুক মারা হল ওকে আর তারপর ওকে দেওয়া হল প্রচণ্ড কায়িক পরিশ্রমের কাজ। নুনেজও দেখল যে আর কোনো রাস্তা ওর সামনে খোলা নেই নিজের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার বা এদের নিয়ন্ত্রণ করার। তাই ও সকলের কথা মেনে নিয়ে বাধ্য ছেলের মতো কাজ করতে লাগল।
এইভাবে নুনেজ অন্ধদের দেশের একজন নাগরিক হয়ে উঠল। ওখানকার মানুষরাও ওর কাছে অন্ধদের দেশের একজন লোক হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠল আলাদা আলাদা একজন করে মানুষ। ওখানকার প্রকৃতি এবং পরিবেশ ওর আপন হয়ে উঠতে লাগল আর সেই অনুপাতেই ওই উপত্যকার বাইরের জগতের থেকে ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকল মনের দিক থেকেও। ওর প্রভু ইয়াকব রেগে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষটা মন্দ নয়। পেদ্রো, যার সঙ্গে ওই দেশে এসে প্রথম পরিচয় হয়েছিল নুনেজের, সে ছিল ইয়াকবের ভাইপো। মেদিনা সারোতে ছিল ইয়াকবের ছোট মেয়ে। অন্ধদের দেশে কোনো কদর ছিল না সেই মেয়ের কারণ ওদের বিচারে ও ছিল অসুন্দর। ওর ধারালো মুখ, চোখা নাক আর বড় বড় অক্ষিপল্লব অন্ধদের বিচারে ছিল সুন্দরী হওয়ার পরিপন্থী। ওদের মতে সুন্দরী মেয়েদের যা থাকতেই হবে তা হল মাখনের মতো মসৃণ ত্বক। নুনেজ যেহেতু দেখতে পায়, ওর চোখে মেদিনা সারোতে প্রথম থেকেই যথেষ্ট সুন্দরী ছিল এবং ক্রমে সে নুনেজের চোখে হয়ে উঠল অতুলনীয়া, অনন্যা। ওর বন্ধ চোখদুটো অন্যদের মতো গর্তে ঢোকা ছিল না বরং চোখের বড় বড় পাতা আর চোখের উপরের হালকা লালচে আভা দেখে নুনেজের মনে হত ও যেন কোনো কারণে চোখ বুজে আছে, যে কোনো মুহূর্তেই চোখ খুলে তাকাবে। তার উপর মেদিনার গলার স্বর ছিল মিহি এবং দুর্বল, যা শুনতে অসুবিধা হত ওর নিজের লোকেদের। এই সব কারণে মেদিনার কোনো অনুরাগী জোটেনি ওই অন্ধদের উপত্যকায়।
নুনেজ যখন বুঝতে পারল যে ওকে ওর বাকি জীবনটা ওই অন্ধদের দেশের কাটাতে হবে, তখন ওর মনে হতে থাকল যে মেদিনা সারোতেকে সঙ্গে পেলে ওর জীবনটা কিছুটা হলেই সুন্দর হবে। ওর ইচ্ছে করে মেদিনাকে যত্ন করতে, ওর ছোট ছোট কাজগুলো সুন্দরভাবে করে দেয় নুনেজ। কখনো কখনো একসঙ্গে কাজ করতে করতে ওদের হাতদুটি স্পর্শ করে একে অপরকে। মেদিনা নুনেজের স্পর্শে হাত সরিয়ে নেয় না বরং নুনেজের হাতে ফিরিয়ে দেয় অনুরাগভরা প্রশ্রয়। একদিন রাতের অন্ধকারে তারায় ভরা আকাশের নীচে বসে খাচ্ছিল ওরা দুজনে। নুনেজ দেখতে পেল মেদিনার কাঁপা কাঁপা আঙুলগুলো ওর দিকে প্রসারিত, ওকে খুঁজছে মেদিনার আঙুলগুলি। তারার আলোয় মেদিনার মুখের দিকে ভালো করে তাকায় নুনেজ। ওর মনের মধ্যে জেগে ওঠে মুগ্ধতা।
নুনেজ সিদ্ধান্ত নিল যে ও মেদিনার সঙ্গে কথা বলবে। ওকে জানাবে নিজের ভালোলাগার কথা। গ্রীষ্মের এক রাতে সেই সুযোগ এসে গেল। মেদিনা খোলা আকাশের নীচে বসে সুতো কাটছিল। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছিল ও যেন কোনো মানুষ নয়, রুপো আর মায়া দিয়ে গড়া একটা অবয়ব। নুনেজ মেদিনার পায়ের কাছে বসে ওকে জানায় নিজের মনের কথা। নুনেজ মেদিনাকে বলে যে ওর চোখে মেদিনা এক অসাধারণ সুন্দরী। ও মেদিনাকে ভালোবাসে, ওকে বিয়ে করতে চায়। নুনেজের গলায় এবং বলায় এতটাই আবেগ ঝরে পড়ছিল যে মেদিনা কোনো কথা বলতে পারে না। ওর হাতের আলতো কোমল স্পর্শ নুনেজকে বুঝিয়ে দেয় যে মেদিনা ওর ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত।
তার পর থেকে যখনই সুযোগ মিলত, নুনেজ মেদিনার সঙ্গে গল্প করত, যে গল্পের বেশির ভাগটাই জুড়ে ছিল ভালোবাসার এতোলবেতোল কথা। নুনেজের কাছে মুছে গেল ওই উপত্যকার বাইরের জগতটা, যেখানে সে জন্মেছে এবং বড় হয়েছে। সেই জগতের গল্প যখন ও মেদিনার কাছে বলত, ওর নিজের কানেই সেগুলো ঠেকত অবিশ্বাস্য রূপকথার মতো। কখনো কখনো খুবই দ্বিধার সঙ্গে ও মেদিনাকে দেখতে পাওয়ার কথাও বলত আর সেই কথাগুলো মেদিনার কাছে হয়ে উঠত স্বপ্নে ভরা মায়াকাহিনীর মতো। মেদিনা ‘দৃষ্টি’ ব্যাপারটা আদৌ বুঝত না কিন্তু ওর খুব ভালো লাগত তারাদের কথা, ফুলেদের কথা, বরফে ঢাকা পাহাড়দের কথা শুনতে। ও কখনো অন্য কারো কাছে জানাত না যে নুনেজ ওকে ‘দেখতে পাওয়া’ নামক বিষয়টা নিয়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করে।
সময়ের সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠতে লাগল নুনেজ আর মেদিনার ভালোবাসা। মেদিনারই এক দিন প্রথম বাড়িতে জানাল যে নুনেজ আর মেদিনার মধ্যে প্রেম ভালোবাসা চলছে। বাড়ির কেউই বিষয়টায় খুশি হল না কারণ প্রথমত নুনেজ একজন বিদেশী আর দ্বিতীয়ত ওদের বিচারে নুনেজ মানসিক ভারসাম্যহীন। বাড়ির মেয়েরা মেদিনাকে ভীষণ বকাবকি করল। ওদের অভিযোগ এই, যে মেদিনা বাড়ির সম্মান নষ্ট করেছে একজন বোকা হাঁদা বিদেশীকে পছন্দ করে। মেদিনার বাবা ইয়াকব এমনিতে নুনেজকে পছন্দই করতেন কিন্তু তার হাতে নিজের মেয়েকে দিতে উনি মোটেই রাজি হলেন না। গ্রামের জোয়ান ছেলেরা নুনেজের উপর এত রেগে গেল যে তারা ওর উপর চড়াও হয়ে গেল লাঠি সোটা নিয়ে। ভাগ্যক্রমে সময়টা ছিল দিনের শেষ ভাগ যখন নুনেজ অল্প আলোয় কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছিল। এবার নুনেজ কিন্তু চোখ থাকার সুবিধাটা পেয়ে গেল। একা হাতে বেশ কয়েকজনের দলকে ও হারিয়ে দিল। ছেলেগুলোও নুনেজকে সমঝে চলতে শুরু করল কিন্তু এত কিছুর পরও নুনেজ মেদিনাকে বিয়ে করার অনুমতি পেল না।
মেদিনা এদিকে কান্নাকাটি করেই চলেছে। কারোর সঙ্গে সে কথা বলে না। ঠিক করে খাওয়া দাওয়াও করে না। ওর বাবা ইয়াকব ওকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘ওই ছেলেটাকে তুই কী করে পছন্দ করলি, মা? ও মাথায় বুদ্ধি নেই। মাঝে মাঝেই কী সব আবোলতাবোল বকে ও। কোনো কাজ ও ঠিক করে করতে পারে না।’ ‘আমি সব জানি, বাবা’, মেদিনা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়, ‘কিন্তু ও তো এখন আগের চেয়ে ভালো আছে। পরে ও একদম ঠিক হয়ে যাবে। ওর মনটা খুব ভালো, বাবা। এই গ্রামে অত ভালো মন আর কারোর নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে তো আজ পর্যন্ত এই গ্রামের কোনো ছেলের পছন্দ হয়নি। কিন্তু ও আমাকে ভালোবাসে, বাবা আর আমিও ওকে ভালোবাসি।’
বুড়ো ইয়াকব পড়ল মহা ফাঁপরে। একদিকে গ্রামের লোকেদের নুনেজকে নিয়ে আপত্তি আর অন্য দিকে মেদিনা নুনেজের জন্য কেঁদে অস্থির। সত্যি কথা বলতে কী, ইয়াকব নিজের মনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে নুনেজের জন্য ওর মনেও একটা স্নেহের জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। নুনেজ নিজের কাজগুলো মন দিয়ে করে এবং আজকাল ‘দেখা’ ‘দৃষ্টি’ আর ওই ধরনের অসংলগ্ন কথাও ও আর বলে না খুব একটা। ইয়াকব তখন অন্ধকার জানালাহীন ঘরে গ্রামের মাথাদের সঙ্গে একটা মিটিংয়ে বসল। ও সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করল যে নুনেজ আর আগের মতো নেই। ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে মাত্র এই কটা মাসে। যদি মেদিনাকে বিয়ে করে ও সারা জীবন ওই গ্রামেই থেকে যায় তাহলে ও একদিন আর দশটা গ্রামের ছেলের মতোই হয়ে যাবে। তাছাড়া গ্রামের ছেলেদের কেউ তো মেদিনাকে পছন্দই করেনি। নুনেজ বিদেশী হলেও ও তো মেদিনাকে ভালোবাসে।
গ্রামের বিচক্ষণ বৃদ্ধদের মধ্যে ছিলেন এমন একজন যাঁর কাছে অসুখ বিসুখ করলে চিকিৎসা করাতে যায় তামাম গ্রামের লোক। সে একদিন আলোচনায় নিয়ে এল নুনেজের বিষয়টা। সে বলল, ‘আমি অনেক ভেবে দেখেছি। নুনেজকে পরীক্ষাও করেছি আমি। ওর সমস্যাটা এখন অনেক পরিষ্কার আমার কাছে। আমার মনে হয় ওকে সুস্থ করে তোলা যাবে।’
‘যাক ! নিশ্চিন্ত হওয়া গেল !’ বুড়ো ইয়াকব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ওর সমস্যাটা ঠিক কোথায় ?’ ‘সমস্যাটা ওর মাথায় মানে ওর মাথার ভিতরে’, অন্ধ ডাক্তার বলে।
‘মানে? ঠিক করে বুঝিয়ে বলো। ওর মাথার ভিতরে কী হয়েছে?’ অনেকগুলো লোক একসঙ্গে প্রশ্ন করে।
‘আচ্ছা সোজা করে বুঝিয়ে দিচ্ছি’ ডাক্তার মন্তব্য করে। অন্যরা নিজেদের কানগুলো খাড়া করে ডাক্তারের কথা শোনার জন্য। ডাক্তার বলে, ‘দেখো আমাদের সবার মুখেরই উপর দিকে দুটো করে গর্ত আছে যেগুলো পাতলা চামড়া দিয়ে ঢাকা। সেই গর্তগুলো আমাদের কোনো কাজে লাগে না আবার সেগুলো আমাদের জন্য কোনো সমস্যাও তৈরি করে না। তাই তো?’
সবাই সমস্বরে ডাক্তারের কথাকে সমর্থন জানায়।
‘এবার ব্যাপারটা হল’, ‘ডাক্তার আবার নিজের কথার খেই ধরে বলতে শুরু করে, ‘ওই বোগোতা বা নুনেজের মুখের উপর দিকের ওই গর্তগুলো আমাদের মতো চামড়া দিয়ে ঢাকা নয়। ওগুলোর ভিতরে কিছু একটা আছে, যা নড়াচড়া করে। অসুখটা সেখানেই। ওই নড়াচড়ার ফলে ওর মাথার ভিতরটা অস্থির হয়ে থাকে।’
‘ঠিক !’ ইয়াকব ডাক্তারের সঙ্গে একমত হয়ে বলে, ‘সেটাই আসল সমস্যা।’
‘ওকে পুরোপুরি সুস্থ করার একটাই উপায়’, ডাক্তার বলে, ‘আর সেটা হল ওর মুখের উপর বসে যে দুটো জিনিস ওর মাথার মধ্যে সমস্যা তৈরি করছে, অপারেশন করে সেগুলিকে বাদ দিয়ে দেওয়া। তাহলেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে ওর আর কোনো অসুবিধা থাকবে না।’
‘তাহলেই ও ঠিক হয়ে যাবে?’ ইয়াকব প্রশ্ন করে।
‘একদম ঠিক হয়ে যাবে। একেবারে ঠিক হয়ে যাবে’, ডাক্তার উত্তর দেয়।
‘যাক! বিজ্ঞানের জয় হোক! সমাধানটা এত সহজ তা কে জানত?’ বুড়ো ইয়াকব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে। তারপর সে নুনেজকে খুঁজতে বেরোয় এমন সুখবরটা শোনানোর জন্য।
নুনেজ কিন্তু ওই সুখবরটা শুনে আদপেই খুশি হল না। ইয়াকব অবাক হয়ে গেল নুনেজের রকম সকম দেখে। খুশি হওয়ার পরিবর্তে নুনেজ একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল। ‘আমি তো বুঝতেই পারছি না যে তুমি কি আদৌ আমার মেয়ের ব্যাপারে আগ্রহী?’ বিরক্ত হয়ে ইয়াকব মন্তব্য করে।
মেদিনা সারোতে এগিয়ে আসে নুনেজকে বোঝানোর জন্য যে ওদের বিয়ের জন্য ওই অন্ধ ডাক্তারের কাছে নুনেজের অস্ত্রোপচার করাটা খুব জরুরি। নুনেজকে নরম স্বরে মেদিনাকে বলে, ‘আমার কাছে দৃষ্টি ছাড়া জীবনের কোনো মানে নেই। তুমি কি চাও জীবনের দেওয়া এত বড় আশীর্বাদটা আমি হারিয়ে ফেলি ?’ মেদিনা অবাক হয়ে মাথা নিচু করে। ওর দু চোখের পাতার মধ্য দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নুনেজ বলতে থাকে, ‘আমার জগত তো দৃষ্টি ছাড়া অন্ধকার। আমি সত্যিই দেখতে পাই। আমার দেখতে পাওয়া কোনো মানসিক বিভ্রম নয়। আমি এই পাথুরে পাহাড়, স্রোতের নদী, পাথরের ফাঁকে ফুটে থাকা ফুল, রাতের তারায় ভরা আকাশ… সব দেখতে পাই। আর আমি দেখতে পাই তোমাকে। শুধুমাত্র তোমাকে দেখার জন্যই আমার চোখ দুটোর প্রয়োজন। এই চোখ দিয়ে আমি তোমার সরল মুখখানা, তোমার বন্ধ চোখ, তোমার ফুলের মতো ঠোঁটদুটো দেখি। আমার চোখ আছে বলেই আমার কাছে তুমি বিশ্বের সব চেয়ে সুন্দর মানুষ। ওই বুদ্ধুগুলোর কথায় সায় দিয়ে আর তুমি আমায় বলছ আমার শরীর থেকে আমার চোখ দুটো বাদ দিয়ে দিতে? আমি আর তোমাকে দেখতে পাব না? শুধু তোমার গলার স্বর শুনব? শুধু তোমাকে স্পর্শ করব? আমার সমস্ত সত্তা ডুবে যাবে ওই পাথরের মতো কঠিন অন্ধকারের মধ্যে? আমার মধ্যে আর কোনো দিন জাগবে না কোনো কল্পনা? তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না আমার জীবনটা এতটাই অভিশপ্ত হয়ে যাক!’
নুনেজের নিজের মধ্যেকার তীব্র আবেগ মন্থন করে কথাগুলো বলে ফেলে। মেদিনা খুব শান্ত নরম গলায় বলে, ‘জানো তো… অনেক সময় আমার মনে হয়…’
‘কী মনে হয়?’ নুনেজ জানতে চায়।
‘আমার মনে হয়…’ মেদিনা বলে, ‘তুমি আর এই ধরনের অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলবে না। তুমি সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তুমি যা যা বলছ সেগুলো একেবারেই রূপকথার মতো কল্পনা। আমার শুনতে খুব ভালো লাগে তোমার এই কল্পনার কথাগুলো কিন্তু এগুলো তো সত্যি নয়, বাস্তব নয়! এখন কিন্তু…’
‘এখন কিন্তু কী?’ নুনেজ অস্ফুটে বলে ওঠে।
মেদিনা চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি তোমার সঙ্গে খুব ভালো হয়ে থাকব, বিশ্বাস করো। কক্ষনো তোমার অবাধ্যতা করব না। শুধু এইটুকু মেনে নাও তুমি।’
নুনেজের প্রথমটা মাথা গরম হয়ে যায় মেদিনা ওর কথা বুঝতে পারছে না বলে তারপর ও বোঝে মেদিনা বা এত দিন মাস বছর ধরে অন্ধত্বে কাটানো মানুষদের ও আলোর মাহাত্ম্য কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। ওর মনটা করুণা আর সহানুভূতিতে ভরে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও মেদিনাকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের লতিতে চুমু খেল। তারপর ওই ভাবেই বসে রইল তারায় ভরা আকাশের নীচে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর নুনেজ বলল, ‘তাহলে তো আমার রাজি হওয়া ছাড়া আর রাস্তা নেই!’ মেদিনা পাগলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে নুনেজকে বলতে থাকল, ‘প্লীজ, তুমি আপত্তি কোরো না। অন্তত আমার কথা ভেবে রাজি হয়ে যাও, প্লীজ!’
এক সপ্তাহ পর অপারেশনের দিন ধার্য হয়ে গেল আর ওই একটা সপ্তাহে নুনেজের চোখে পলকের জন্যও ঘুম এল না। যখন গ্রামের বাকি সবাই গভীর ঘুমে, ও দু চোখ মেলে দেখে যেত সূর্যকরোজ্জ্বল উপত্যকাটার সৌন্দর্য। নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারত না ও, রাজি করাতে পারত না নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত পালন করতে। এইভাবে ফুরিয়ে গেল একটা সপ্তাহ। সকালের রোদ ঝলমল করে উঠল বরফ ঢাকা পাহাড়ের মাথায় আর নুনেজের মনে হল যে এই শেষ বারের মতো ও সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখছে। রাতের এলেই জেগে উঠবে অন্ধদের দেশ আর ওর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে ওর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, ওর দৃষ্টিশক্তি।
মেদিনা সারোতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে রোজকার মতোই নুনেজের সঙ্গে কথা বলতে এল। নুনেজ খুব দুঃখী হয়ে ওকে বলল, ‘আজই শেষ। কাল থেকে আর তোমাকে দেখতে পাব না আমি।’ মেদিনা গভীর আলিঙ্গনে নুনেজকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘একটুখানি ব্যথা লাগবে তোমার, একটুখানি তার বেশি নয়। আমি সারা জীবন আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার ব্যথার শুশ্রূষা করব, তুমি দেখো!’ নুনেজ নিজের আর মেদিনার কথা ভেবে করুণায় ভেসে যেতে লাগল। মেদিনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ও যেন নিজের দৃষ্টিশক্তির উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে বলল, ‘বিদায়! সারা জীবনের জন্য বিদায়!’
তারপর নিঃশব্দে মেদিনার থেকে দূরে সরে গেল নুনেজ। মেদিনা কান পেতে শুনতে থাকল নুনেজের চলে যেতে থাকা পায়ের শব্দ। সেই শব্দের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা শুনতে শুনতে কান্নায় ভেঙে পড়ল মেদিনা।
নুনেজ হাঁটতে থাকে আপন মনে। আর মাত্র একটা দিন। তারপর সারা জীবনের জন্য ও আর কিছুই দেখতে পাবে না। নুনেজের ইচ্ছে হল সারাটা দিন ধরে ও ওই প্রকৃতির অকৃপণ দানে সাজানো উপত্যকাটার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। দু চোখ ভরে উপলব্ধি করে সবুজ প্রান্তরের শোভা, জলের ধারে নিজের ছায়ার দিকে আত্মমগ্ন তাকিয়ে থাকা নার্সিসাস ফুলের রূপ, পাখিদের অকারণ আনন্দে নেচে বেড়ানোর দৃশ্য। তারপর রাত আসবে আর সেই রাতের অন্ধকার চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যাবে নুনেজের জীবনে।
ভাবতে ভাবতে আপনমনে এগিয়ে চলেছিল নুনেজ একেবারেই উদ্দেশ্যহীনভাবে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল পুব দিকে আলো করে বরফের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা সোনার রাজপোশাক পরা উদীয়মান সূর্যের রূপ। সেই দৃশ্য দেখে নুনেজের মনে হল ওর দৃষ্টিশক্তির সামনে ওই অন্ধদের উপত্যকা, ওর ভালোবাসার মানুষ এবং পৃথিবীর আর যাবতীয় কিছু অতি তুচ্ছ… অর্থহীন।
নুনেজ যে পথ দিয়ে যে দিকে যাবে বলে রওনা হয়েছিল, সে দিকে সে আর ঘুরল না। ও হাঁটতে থাকল সূর্যোদয়ের পথ ধরে। অন্ধদের গ্রাম তখন যে যার কুঠুরিতে বিশ্রামের আয়োজনে। নুনেজ হাঁটতে থাকে গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, পাথরের দেওয়াল টপকে ও বেরিয়ে যায় গ্রামের সীমানার বাইরে। এর পর খাড়া পাথুরে পাহাড়। সূর্যের আলো ততক্ষণে সোনা রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে বরফের চূড়াগুলিকে। সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের দিকে চোখ রেখে নুনেজ যেন হঠাৎ করে ভরে ওঠে প্রাণপ্রাচুর্যে। ওর মনে হয় ওর সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের পাহাড় আর বরফের চূড়াগুলো ওকে ঠিক পথ করে দেবে সময় মতো। আর যদি তা না হয়, ও চিরঘুমে আচ্ছন্ন থাকবে এই তুষারভূমিতে কিন্তু যতক্ষণ ওর শরীরে প্রাণ থাকবে, ও প্রাণ ভরে উপভোগ করবে এই অনন্য প্রকৃতির সৌন্দর্য।
বহুদিন পর নুনেজের মন যেন পাহাড় পর্বত পেরিয়ে উড়ে চলল ওর পৃথিবীর দিকে। ওর মনে পড়তে লাগল ওর নিজের শহর বোগোতার কথা, ওই শহরের প্রাসাদ, রাস্তা আর গীর্জাগুলো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল যেন। ওর স্মৃতিতে ভেসে উঠতে লাগল ওর নিজের দৃশ্য জগতের হাজারো খুঁটিনাটির কথা, রোদ ঝলমল দিন আর গ্যাসের আলোয় মায়াবী রাতগুলোর কথা, ওর পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধবদের কথা। আর যত এগুলো মনে আসত লাগল, ততই দ্রুত হাঁটতে লাগল ওই দুর্গম পাহাড়ি পথে নুনেজের পা দুটো। পাহাড়ের ঝর্না ওর মনে জাগিয়ে তুলতে থাকল নদীযাত্রার স্মৃতি, সমুদ্রযাত্রার দুর্দম সব অভিজ্ঞতা। ওর চোখে ধরা পড়ল আকাশের বিশাল উদার রূপ যা অন্ধদের উপত্যকার মতো আকাশ একটা উলটোনো নয় বাটির মতো নয়। ওর মনে হল এই বিশালত্বের মাঝে হারিয়ে যাওয়া ও দৃষ্টিহীন খণ্ডিত জীবনের চেয়ে অনেক ভালো।
সকালের হালকা কুয়াশা কেটে গেছে ততক্ষণে। নুনেজের চোখ দুটো ব্যস্ত হয়ে উঠল পাথরের পর্দার মাঝে ফাঁক খুঁজতে। এমন একটা ফাঁক যার মধ্য দিয়ে ও নিজেকে বের করে নিয়ে যেতে পারবে ওর চেনা জগতে। নুনেজ পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে লাগল আর মাঝে মাঝেই চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল যে ওর পায়ের নীচের পথটা ঠিক কোন দিকে চলেছে। ওর মনে হতে লাগল সামনের পাহাড়টা পেরোলে ও একটা গিরিশিরা পাবে আর তার উপর দিয়ে ও পৌঁছে যেতে পারবে আর একটা পর্বতশৃঙ্খলায় যেখান থেকে শুরু হবে বরফের রাজ্য। সেই বরফের রাজ্য যদি ও পেরোতে পারে, তবে নিশ্চয়ই পর্বতশ্রেণীর অপর দিকে যাওয়ার একটা রাস্তা বেরোবে। কিন্তু নুনেজের সঙ্গে পর্বতারোহণের কোনো সরঞ্জাম নেই আর সেটাই সমস্যার। তবু নুনেজ সাহসে ভর করে এগোতে থাকে কারণ ওর সামনে এগোনো ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই।
অনেকটা উঁচুতে উঠে নুনেজ ফিরে তাকাল ওই অন্ধদের গ্রামটার দিকে। কী ক্ষুদ্র লাগছে ওটা এখন! একবার ওর মনে পড়ল মেদিনা সারোতের কথাও। সেও যেন অনেকটা দূরের হয়ে গেছে। নুনেজ এবার ঘুরে দাঁড়াল তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণীর দিকে। ওর চোখ জরিপ করতে থাকল দূরে মিলিয়ে যাওয়া পাহাড়ি পথরেখাটিকে। তারপর মনে মনে কী একটা হিসেব করে ওর মুখে ফুটে উঠল সন্তুষ্টির হাসি। পাথুরে পথ ধরে আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে ও এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
যখন তুষার শিখরগুলির গায়ে সূর্যাস্তের রং লাগল, তখন পৌঁছে গেছে অনেক অনেক উঁচুতে। ওর শরীর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, সারা গায়ে কালশিটে আর এখানে ওখানে ছড়ে যাওয়ার রক্ত। নুনেজ একটা চ্যাটালো পাথরের উপর শুয়ে পড়ল। উঁচু থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল সারা দিনে ও যে অনেক মাইল হেঁটেছে তা নয় কিন্তু ও উঠে এসেছে অনেকটা উপরে। এর পর কী ও জানে না, কিন্তু ও জানে যে ওর সারা দিনের পরিশ্রম ওকে অন্ধত্বের অভিশাপের ঊর্ধ্বে নিয়ে এসেছে নিঃসন্দেহে। নুনেজ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে না। ওর মনে হতে থাকে ও যে অন্ধদের দেশ থেকে এত দূর পালিয়ে আসতে পেরেছে, তাই ওর খুব বড় সৌভাগ্য। ওই দেশের রাজা হওয়ার কথা ও কল্পনা করেছিল এক সময় ! সে কথা ভাবতেই মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে ওর।
ওর চোখের সামনে মহিমার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত সূর্যাস্তের সৌন্দর্য। নানা রঙের ছটায় ঝলমল করছে আকাশ আর পাহাড়। ওর মুখের পাশে আলতো ছোঁয়া লাগছে এক ছোট্ট কমলা রঙের উদ্ভিদের। উপত্যকার মধ্যে নামছে নরম আলো। আকাশের রং ক্রমে হয়ে উঠছে কমলা-গোলাপি থেকে গাঢ় নীল, গাঢ় নীল হারিয়ে যাচ্ছে প্রোজ্জ্বল বেগুনি রঙের মধ্যে আর নুনেজ জানে এবার নক্ষত্রখচিত অন্ধকারে ঢেকে যাবে চরাচর।
অন্ধকারে হারিয়ে যায় সূর্যাস্তের বর্ণগৌরব। রাত নামে। নুনেজ স্বচ্ছ শীতল আকাশের নীচে শুয়ে থাকে নিস্পন্দ, একাকী। কত দিন পর রাতে ঘুমোবার সুযোগ এল ওর জীবনে!
ঘুমের মধ্যে নুনেজের মনে হয় যেন ওর পিঠের নীচে কেমন যেন একটা কম্পন অনুভব করা যাচ্ছে! এক লাফে উঠে বসে নুনেজ। এবার ওর কানে আসে গুড়গুড়গুড়গুড় একটা শব্দ। নিজের এতদিনে পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা থেকে নুনেজের বুঝতে দেরি হয় না যে পাহাড়ে ধ্বস নামতে চলেছে। এতদিন রাতের অন্ধকারে কাজ করে নুনেজ চোখ অন্ধকারে আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখতে পায়। কৃষ্ণপক্ষের মরা চাঁদের আলোর নুনেজ স্পষ্ট বুঝতে পারে অদূরে পাহাড় বেয়ে ধোঁয়ার মতো নেমে আসছে বরফ আর পাথর মিলিয়ে বিশাল এক ধ্বস। এই ধ্বস এতটাই বিধ্বংসী হবে যে গোটা অন্ধ উপত্যকা তলিয়ে যেতে পারে তার নীচে।
নিজের নিরাপত্তার চিন্তা হঠাৎ মুছে গেল নুনেজের মন থেকে। ওর মনের মধ্যে জেগে উঠল একটা ভয়ংকর ত্রাস। যদি ওর আশংকা সত্যি হয় তবে একটা মারাত্মক বিপর্যয় আসতে চলেছে যে বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া খুব কঠিন। অন্ধদের ওই গ্রামটাকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে পাথরের প্রাচীর। তার একটা দিক যদি ধ্বসে পড়ে তাহলে গ্রামের বেশির ভাগ অংশই চাপা পড়ে যাবে পাথর আর বরফের নীচে। তার সঙ্গে যদি ধেয়ে আসে পাহাড়ের মধ্যে বন্দী কোনো হ্রদের জল তাহলে আর কারোরই রক্ষা থাকবে না। চকিতে নুনেজের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে মেদিনা সারোতের নিষ্পাপ মুখটা।
নুনেজ নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই। চাঁদের আলোকে সঙ্গী করে প্রায় ছুটতে ছুটতে ও নামতে থাকে পাহাড়ের পাকদণ্ডী ধরে। ওর গলা দিয়ে বেরোতে থাকে একটা জান্তব চিৎকার যা প্রতিধ্বনিত হতে থাকে পার্বত্য প্রাচীরের মধ্যে। যে পথটা আসতে ওর প্রায় গোটা দিন সময় লেগেছিল, ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সেই পথটুকু পেরিয়ে অন্ধদের উপত্যকায় নেমে এল নুনেজ। উপত্যকায় তখন কর্মচঞ্চলতা। কেউ কল্পনাও করতে পারছে একটু দূরেই প্রকৃতি কী নিদারুণ এক মৃত্যু উৎসবের আয়োজন করে চলেছে !
নুনেজ চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘সাবধান! সাবধান! বিশাল ধ্বস নামতে চলেছে!’ ওর গলা শুনেই ছুটে এল বেশ কিছু ছেলে ছোকরার দল। ওকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেল তারা ইয়াকবের কাছে। ‘এই যে! পাওয়া গেছে! কোথায় পালিয়ে বসেছিল কে জানে?’ একজন উত্তেজিত গলায় ইয়াকবকে জানায়। ইয়াকব নুনেজকে দেখে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলে, ‘আজ না তোমার অপারেশন হওয়ার কথা? সেই ভয়েই তুমি গা ঢাকা দিয়ে বসেছিলে, তাই তো? তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হওয়াটাই আমার দিক থেকে বেজায় আহাম্মকি হয়েছে মনে হচ্ছে ! অ্যাই তোমরা দেখো তো ডাক্তারবাবু কোথায়? আমার হয়েছে যত জ্বালা!’ ‘বিশাল ধ্বস নামতে চলেছে। সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। আগে পালাও এখান থেকে!’ নুনেজ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। ‘কী সব বলছে পাগলের মতো? ধ্বস কী? কোথা থেকেই বা তা নামবে?’ ইয়াকব প্রচণ্ড বিরক্ত হয় নুনেজের কথা শুনে।
নুনেজের গলার স্বর শুনে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে মেদিনা সারোতে। নুনেজকে আবেগভরে জড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘আমাকে ফেলে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? কত কাঁদছিলাম আমি, তুমি জানো? আমি তো ভাবলাম তুমি বুঝি আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে!’ ‘চলেই যেতাম আমি’, নুনেজ উত্তর দেয় কিন্তু আমি যে দেখলাম পাহাড় বেয়ে বিশাল ধ্বস নামছে। তোমাদের পালাতে হবে এই জায়গা ছেড়ে। আমি দেখতে পাই। তোমরা আমার সঙ্গে এসো।’ ‘দেখেছিস? আবার ওর মধ্যে পাগলামি চাগাড় দিয়েছে ! আবার ওই সব অর্থহীন কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে ও। অ্যাই, কে কোথায় আছিস ওকে টেনে নিয়ে যা ডাক্তারের কাছে!’ কে একজন মন্তব্য করে।
নুনেজকে ঘিরে ফেলে ওকে ধরতে যায় গ্রামের ছোকরারা। হঠাৎ করে সবার কানে আসে কান ফাটানো তীব্র এক শব্দ যে শব্দের মানে কেউ বুঝে উঠতে পারে না। যে যেদিকে পারে ছুট লাগায়। মুহূর্তের মধ্যে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে আতংক। হুড়মুড় করে নেমে আসতে পাথর আর তারই সঙ্গে কলকল করে নেমে আসছে পাথরের রাজ্যে অবরুদ্ধ জল।
চারদিকে অন্ধ মানুষদের আর্ত চিৎকার। নুনেজ বুঝতে পারছে আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে উঁচু জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারলে সে নিজেও ওই জলের তোড়ে ভেসে যাবে খড়কুটোর মতো। তবু সে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে মেদিনা সারোতেকে। ওর মনে হয় এই ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে অন্তত একটা প্রাণকে সে বাঁচাতে চায়। বাকিটা যার যার ভাগ্যের হাতে। পায়ের তলায় পৌঁছে গেছে হিমশীতল জলের ধারা। আর দেরি করা যাবে না। নুনেজ একবার সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, ‘শোনো, আমি দেখতে পাই। আমি তোমাদের বলে দিতে পারি কোনখানে গেলে তোমরা বাঁচতে পারবে। যারা যারা আমার উপর ভরসা করতে পারো এই দিকে এসো।’
ধ্বসের শব্দ, জলের গর্জন আর ভীত মানুষদের চিৎকারের মধ্যে নুনেজের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। নুনেজ ছুটতে থাকে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া উত্তর পশ্চিমের পাকদণ্ডীটার দিকে। ও জানে ওই পথে ও নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যেতে পারবে। তারপর বিপর্যয় থামলে হয়তো ওই ধ্বসই ওকে ওই পাহাড় প্রাচীর পেরোবার পথ করে দেবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে অনেকটা উপরে উঠে যেতে হবে নইলে জলের তোড় ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
হঠাৎ নুনেজের হাতটা টেনে ধরে একটা নরম হাত। নুনেজ একবার ফিরে তাকায়। মেদিনা সারোতেকে দেখতে পায় নিজের পাশে। ভয়ে আর ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছে সে। নুনেজ এক মুহূর্তের জন্য মেদিনাকে বুকে টেনে নেয় তারপর মেদিনার হাতটা শক্ত করে টেনে ধরে ও ছুটতে থাকে পাহাড়ি পথ দিয়ে। একটু উঠে নুনেজ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় যে ওরা বিপদসীমা পেরিয়ে এসেছে। নীচে যেন এক বিশাল জলাধারের চেহারা নিয়েছে গোটা গ্রামটা। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে নুনেজের।
চলার গতি কমায় নুনেজ। সমস্ত শক্তিটা একসঙ্গে ক্ষয় করে ফেললে চলবে না। নরম গলায় অস্ফুটে কী যেন বলে মেদিনা সারোতে। নুনেজ মেদিনার মুখের উপর আঙুল বুলিয়ে ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। মেদিনার বন্ধ চোখের নীচে সে অনুভব করে জলের ছোঁয়া। এক অজানা মায়ায় ভরে যায় নুনেজের অন্তর।
পাখিদের গান ভেসে আসছে ঘন জঙ্গলের মধ্য থেকে। নুনেজ চোখ দূরে তাকায়। অন্ধকার কাটছে একটু একটু করে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন