আশ্চর্যপুরের গিরগিটি
(জয়ন্ত দে)
মানুষটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ঋতুপর্ণার মুখের দিকে।
তার আগে অবশ্য ঋতুপর্ণাকে অনেকেই দেখছিল। স্বাভাবিক দেখবেই। ওর পায়ে স্নিকার। সাদা জিনসের ওপর কালো টিশার্ট। টিশার্টের ওপর দিকের দুটো বোতাম খোলা। মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। তার ওপর চুলে অন্তত তিনটে রং। কালো, সাদা আর তামাটে। দেখতে ওকে হবেই। ঋতুপর্ণা বলল, ‘আপনি ভূলোকবাবু, তাই তো ?’
‘কেন, হ্যাঁ আমি ভূলোক ভৌমিক।’
‘ভৌ !’
ভৌ শুনে ভূলোক ভৌমিক কেমন যেন অবাক হয়ে গেলেন। এটাকে ঠিক অবাক বলে না, বলে হতবাক !
ঋতুপর্ণা হাত বাড়াল। আমার নাম ঋতুপর্ণা। ভূলোক ভৌমিক ইতস্তত করলেন, এখানে এই চায়ের দোকানের সামনে একটা মেয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করাটা যেন ঠিক নয়। গ্রামগঞ্জের ব্যাপার— এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এটা পাঁচ পাবলিকের জায়গা। ভূলোক বেশ বুঝতে পারছেন মেয়েটাকে জোড়া জোড়া চোখ গিলছে। আসলে মেয়েটার সাজটা ঠিক মেয়ে মেয়ে নয়। মানে, মেয়ে বললে যেমন ছবি ফুটে ওঠে আর কি। এ মেয়ে অনেকটা টমবয় মার্কা। তাই জন্যে হয়তো বেশি চোখে পড়ছে। মেয়েটা বড্ড শহুরে। তার কাছে এসেছে বলছে, একে এক্ষুনি সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় যে যায়—বাড়ির দিকে—বাড়িতে— ?
ঋতুপর্ণা বলল, ‘এর নাম বিসন। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’
‘আমার সঙ্গে !’ কিছুটা বিস্ময়ের সঙ্গে ভূলোক তাকালেন।
এখন সকাল দশটা। নিত্যদিনের মতো চায়ের দোকানে এসেছে সাড়ে সাতটা নাগাদ। সামনের ইস্কুলে দশটার ঘন্টা পড়লেই সে আর দাঁড়াবে না। আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি যাবে। বাড়ি গিয়েও তার তেমন কিছু কাজ নেই। চাড্ডি মুড়ি খেয়ে, যা হোক কিছু করবে। কিন্তু মেয়েটা ওকে ভৌ বলল কেন?
অনেকদিন পরে আবার কেউ ভৌ বলল তাকে।
ঋতুপর্ণা বলল, ‘আমরা আপনার বেশি সময় নেব না। সামান্য একটু কথা বলে চলে যাব। কিন্তু সে কথাগুলো এখানে হবে না। কাজের কথা।’
ভূলোক ভৌমিক কিছুটা মিয়ানো গলায় বললেন, ‘চলুন, আমাদের বাড়ির দিকে যাওয়া যাক।’
চায়ের দোকান থেকে উনি আগেই উঠে পড়েছিলেন, এবার খুব শ্লথ গতিতে হাঁটা শুরু করলেন।
সময়টা কাগজে কলমে শীতের শেষ। কিন্তু অনেকদিন আগেই কলকাতা থেকে শীত বিদায় নিয়েছে। ঋতুপর্ণারাও যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল তাদের কখনও মনে হয়নি, এটা শীতকাল। হ্যাঁ তবে রাস্তায় কুয়াশা ছিল। কিছুতেই স্পিড তোলা যাচ্ছিল না। তাই এখানে আসতে একটু দেরিই হল। কিন্তু এখানে এসে যেটা দেখল, এখানে যেন এখনও শীত বেশ বিরাজমান। কেননা চায়ের দোকানের সবার গায়েই একটা করে চাদর। তাতে সবাই বেশ পাক মেরে আছে, জবুথবু হয়ে। তবু এই সকালবেলায় ওদের দেখে একটা চনমনে ভাব এসেছে।
‘কলকাতার মেয়েছেলে ! রকমচকম দেখছ। ব্যাটাছেলের বাপ !’
কথাটা ঋতুপর্ণা বা বিসনের কানে এসেছে। কিন্তু ওরা দু’জনেই কথাটার দিকে ফিরেও তাকাল না। ভূলোকের কানেও কিন্তু কথাটা পাথরের মতো নাচল ! ওরা এগিয়ে চলেছে।
যেতে যেতে একটু আড়ে তাকিয়ে ভূলোক ভৌমিক বললেন, ‘আপনাদের কিন্তু আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।’
বিসন উদাস হয়ে এই মাঠ ঘাট গ্রামের টলটলে প্রকৃতি দেখছে। শীতের শেষেও অঢেল সবুজ। সব যেন ছবি !
ঋতুপর্ণা বলল, ‘চিনতে পারার কথা নয়—আপনি আগে কখনও আমাদের দেখেননি।’
‘ও আচ্ছা।’
আবার কিছুটা ওরা হেঁটে এল। ভূলোক বললেন, ‘তালে আপনাদের পরিচয় ?’
ঋতুপর্ণা ভাবছিল, ঠিক কী বলবে ?
ভূলোক আবার বললেন, ‘মানে বাড়িতে আমার স্ত্রী আছেন। ছেলে, ছেলের বউ আছে। দুজনেই অবশ্য স্কুলে গেছে। দুজনেই মাস্টার। পড়ায় আরকি ! কিন্তু স্ত্রী জিগ্যেস করলে কী বলব— ?’
ঋতুপর্ণা বলল, ‘আমি ছবি করি।’
‘ছবি !’ ভূলোক একেবারে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে গেলেন। ‘ছবি, মানে ?’
‘সিনেমা ! আমি পরিচালক। আর ও বিসন। ক্যামেরা করে।’
বিসন ঘাড় নাড়িয়ে তাকাল ভূলোক ভৌমিকের দিকে। মনে মনে বিড় বিড় করল, শালা কী যে খ্যাপামি ! পাগলা কুত্তায় কামড়েছে! ধ্যাত ! ঠিক আছে, আজ কোনও কাজ নেই। চলেই এল। তবে জায়গাটা ভালো। ছবির মতো। পুকুরগুলোর মধ্যে বেশ সবুজ রং আছে। মায়া আছে। বিসন অন্যদিকে তাকাল।
ভূলোক ভৌমিকের হাঁটার মধ্যে কেমন যেন একটা নিস্তেজ ভাব। বিসনের মনে হচ্ছিল লোকটা অলস। এই ধরনের লোক কোয়ালিটির হলেও কাজ বের করানো খুব চাপের। ঋতুপর্ণার মতো পরিচালক, আগে দু দুটো ভালো ছবি করেছে, সে কী করে এমন আনপ্রফেশনাল লোকের দিকে হাত বাড়াচ্ছে !
যে দরজাটা এসে ভূলোক ঠেললেন, সেটা এ-বাড়ির সদর। একটু গলা তুলে ডাকলেন, ‘শুনছো !’ কেউ এলো না, কারও দেখা পাওয়া গেল না। ভূলোক এবার গলা খাকারি দিলেন তারপর, ‘কোথায় গেলে ? দেখো কারা এসেছেন !’
এবার টুংটাং করে কতগুলো বাসনের আওয়াজ হল। চোখ বন্ধ করে ঋতুপর্ণা বলে দিতে পারে, এত গম্ভীর আওয়াজ কাঁসার বাসন ! এবার পায়ের শব্দ। বিসন ঘাড় ঘুরিয়ে—ক্যামেরা—
যেমন ভেবেছিল ঋতুপর্ণা ঠিক তেমনই একজন আটপৌরে মহিলা। উনি প্রথমে দরজার সামনে, পরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
ভূলোকবাবু বললেন, ‘ওঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন।’
মহিলার চোখেমুখে বিস্ময়। পরক্ষণেই খুব দ্রুত পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। আবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরেও এলেন, এবার ওঁর হাতে একটা শতরঞ্চি। বারান্দার ওপরই পেতে দিলেন। তারওপর দুটো কাঠের চেয়ার এনে বসালেন। বিসন বসার জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এটা ঠিক শতরঞ্চি নয়। হাতে তৈরি করা বিশাল একটা আসন। চটের ওপর পুরো সুতোর কাজ। অসাধারণ !
ঋতুপর্ণা বলল, ‘আমাদের চেয়ার লাগবে না, এখানেই বসছি। বাঃ কী সুন্দর এটা। আপনি বানিয়েছেন ?’
ভদ্রমহিলার মুখে আলো। ঘাড় হেলাল।
খাবার জল এল। প্লেটে দানাদার। একবাটি করে মুড়ি। বিসন খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মুড়িগুলো ফটফটে সাদা নয়। একটু লাগচে, গাঁট আছে। কিন্তু খুব স্বাদ ! আঃ। জলটাও মিষ্টি মিষ্টি !
ভূলোকবাবু ওদের পরিচয় দিলেন—এঁরা গ্রামে এসেছেন—সিনেমা করতে —শ্যুটিং হবে—তাই গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখছেন।
ভদ্রমহিলা হাসলেন, বললেন, ‘আজ শ্যুটিং হবে—?’
ঋতুপর্ণা একটু বিব্রত গলায়, ‘না, না, সেরকম কিছু না! কিছু করা যায় নাকি ভাবছি। আমি এখন একটা অন্য কাজ করছি। সেটা শেষ হোক।’
ভূলোকবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘আপনারা এখানে দুটো ভাত খেয়ে যাবেন।’
ঋতুপর্ণা বলল, ‘আজ খাব না। আমরা এখুনি চলে যাব। অন্য একদিন খাব।’
মহিলার মুখটি ম্লান হয়ে গেল।
ঋতুপর্ণা বলল, ‘আমাকে আবার আসতে হবে। তখন খাব, ঠিক।’
‘ঠিক আছে আমি মামলেট করে দিই।’
‘দেশি মুরগির ডিম ? তাহলে আমাকে সেদ্ধ করে দেবেন প্লিজ। হেবি টেস্ট ! ছোটবেলায় মামারবাড়ি গিয়ে খেতাম। সেটা অবশ্য ধানসেদ্ধর হাঁড়ির ভেতর বয়েল হতো।’
‘দেবো।’ বিসনের কথায় সম্মতি দিয়ে মহিলা খুব সুন্দর করে হাসলেন। দেখে দু চোখ জুড়িয়ে গেল বিসনের উঃ ক্যামেরায় যা হতো না। কামাল হয়ে যেত।
উনি চলে গেলেন, রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে উনি এখন খাবার আয়োজনে ব্যস্ত। চারদিক বেশ শান্ত। একটা ঘুঘু পাখি ডেকে যাচ্ছে অবিরাম।
বিসন উঠে বাড়ির ভেতর হাঁটছে। ঋতুপর্ণা বলল, ‘তুমি ইচ্ছে করলে ঘুরে ফিরে দেখতে পারো। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে নিই।’
বিসন বলল, ‘দাঁড়াও আগে ডিম সেদ্ধটা খাই। আচ্ছা, আমি একটু দোতলার দিকে যেতে পারি ? ঘরে ঢুকব না।’
ভূলোক ঘাড় হেলালেন। তাঁর মনে এখনও দ্বিধা এরা কী করতে এখানে এসেছে— কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না। কী বলতে চায় মেয়েটি ? সিনেমা করে ! ভূলোক ভেবে তল কিনারা পায় না।
বিসন তার জুতো খুলে বারান্দার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরল। সদর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে খিড়কি দিয়ে ঢুকল। কত গাছ। চেনা অচেনা সারাবাড়িটা জুড়ে আছে।
ঋতুপর্ণা তাকাল ভূলোক ভৌমিকের দিকে। বলল, ‘আমি সিনেমা করি। আপনাকে আগেই বলেছিলাম। আমি চাই আপনি আমাদের সঙ্গে কাজ করুন।’
ভূলোক ভৌমিকের চোখে মুখে বিস্ময়। বাপের জম্মে তিনি এমন কথা শোনেননি। সিনেমা, চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর কোনওদিন সামান্যতম যোগাযোগ নেই। কোনওদিন ছিলও না। এরা মনে হয় কোনও ভুল করছে। তিনি সিনেমায় কী কাজ করবেন ? তিনি অভিনয়ের জানেনটা কী ? ভুল করছে, নির্ঘাত ভুল করছে।
তিনি অবাক হওয়া গলায় বললেন, ‘আপনারা মনে হয় কোনও ভুল করছেন।’
‘না, আমি ভুল করিনি।’ ঋতুপর্ণা টক করে নিশ্চিত গলায় কথা বলে উঠল।
ওর এমন নিশ্চিত গলা শুনে বেশ থতিয়ে গেলেন ভূলোক ভৌমিক।
ঋতুপর্ণা বললেন, ‘আমাদের ছবিটা পটভূমি বীরভূম। শ্যুটিঙের কাজ শুরু হয়ে যাবে এবার। আপনাকে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে।’
‘না, মানে, আমি কী কাজ করব ?’
‘ছবির পোস্টার। টাইটেল কার্ড করে দিতে হবে আপনাকে।’
ঋতুপর্ণার কথাটা শুনে চমকে উঠলেন ভূলোক ভৌমিক। বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গলা শুকনো হয়ে বলতে পারলেন না।
অমলেট এল। ডিম সেদ্ধ এল। তারও সঙ্গে চা।
ঋতুপর্ণা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে একটা লম্বা চুমুক দিল। বলল, ‘খুব ভালো চা হয়েছে কাকিমা।’ সে প্লেট টেনে অমলেট খাওয়া শুরু করল। বিসন এসে হাজির। ডিম সেদ্ধর দিকে তাকিয়ে ওর চোখজোড়া চকচক করছে। ডিমের প্লেটটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘দেশি ডিম !’
ভূলোক ভৌমিক চায়ের কাপে হাত দিলেন না। ঋতুপর্ণা একবার মৃদুস্বরে বলল, ‘নিন, আপনি চা খান।’
কিন্তু বুকের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে থাকলেন ভূলোক।
ঋতুপর্ণা বলল, ‘সারা ছবি জুড়ে কমেডি আছে। কিন্তু ছবিটি কমেডি ছবি নয়। হাসতে হাসতে কান্না ধরা আছে। জীবন ধরা আছে। আপনাকে তার ছবি আঁকতে হবে।’
‘আমি আর ছবি আঁকি না। আর আঁকতে পারি না। আমি পারব না।’ এবার ভূলোক ভৌমিক এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে উঠলেন।
‘আপনাকে যে আঁকতে হবে—।’ ঋতুপর্ণা বেশ আদেশের সুরে কথাটা বলল।
‘কিন্তু আমি যে আঁকতে পারি না।’
‘আমি জানি আপনি খুব ভালো ছবি আঁকেন। ভৌ। ভৌয়ের ইলাস্ট্রেশন খুব বিখ্যাত ছিল। আমি আরও জানি, বিশেষত টাইপ নিয়ে আপনার মতো খেলা খুব কম লোক করেছেন—।’
‘সে সব আমি ভুলে গেছি। আর কিচ্ছু পারি না। কিচ্ছু না !’
‘না, আপনি ভোলেননি। একটু চেষ্টা করুন, আপনি পারবেন। আমাদের হাতে এখনও অনেক সময় আছে।’
‘না, না, আমি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘কিচ্ছু ছাড়েননি। নিজে না আঁকলেও, কিছুদিন আগে বাচ্চাদের দিয়ে, এখানের এক স্কুলের দেওয়ালে অসাধারণ সব ছবি আঁকিয়েছেন।’
‘ওগুলো ওরা এঁকেছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। হয়তো দু একটা কথা বলেছি, আর কিছু নয়।’
‘আপনার নাম ভৌ। ছোটবেলায় আপনার কত আঁকা দেখেছি। আপনি পারবেন। নিশ্চয়ই পারবেন।’
‘সত্যি আমি আর পারব না। সেই স্কিল আর আমার নেই। আমি পারতেও চাই না।’ ভূলোক ভৌমিকের গলা ভারী হয়ে এল।
‘ঠিক আছে, আপনি চেষ্টা করুন। দেখা যাক না। আমার ছবির নাম, লোকেশনের কিছু ফোটোগ্রাফ আর মেন ক্যারেক্টারদের ফোটো নিয়ে আমি আবার আসব। আপনি চেষ্টা করুন। আপনি নামের লেটারগুলো নিয়ে খেলুন। আমার মন বলছে আপনি ছাড়া কেউ পারবে না। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আপনি সেরা—। আপনাকে পারতেই হবে। আজ শুধু নামটা আপনাকে দিয়ে যাব। পরের দিন যেদিন আসব, সেদিন বাদবাকি মেটেরিয়ালগুলো দেব।’
ভূলোক ভৌমিক ঘাড় নাড়ায়। ‘না, না, আমি আর কোনওদিন আঁকব না। ছবি আঁকা আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
ভূলোক ভৌমিকের স্ত্রী একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আলতো গলায় বললেন, ‘অত দূর থেকে ওনারা এসেছেন। চেষ্টা করেই দেখো না একবার। এ তো আর বইয়ে আঁকা নয়। তুমি বইয়ে এঁকো না।’
ভূলোক ভৌমিক অসহায়ের মতো চোখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
ঋতুপর্ণা তার কাঁধের ছোট ব্যাগ থেকে একটা ব্রোশিওর বের করল। বলল, ‘এটা বিজ্ঞাপনের জন্য বানিয়েছিলাম। এতে কাহিনীর একঝলক আছে। আর কিছু অভিনেতাদের নাম।’
‘কী নাম তোমাদের বইয়ের?’ ভূলোক ভৌমিকের স্ত্রী দূর থেকে প্রশ্ন করলেন।
ঋতুপর্ণা যেন একটু ইতস্তত করল। ঠিক এইসময় ঘুরতে ঘুরতে বিসন এসে পড়ল ওদের কাছাকাছি। তার কানে কথাটা গিয়েছিল, বলল ‘আশ্চর্যপুরের গিরগিটি। একজন বহুরূপীকে নিয়ে স্টোরি। দারুণ !’
‘আশ্চর্যপুরের গিরগিটি। একজন বহুরূপী!’ ভূলোক ভৌমিক ঋতুপর্ণার হাত চেপে ধরলেন। তাঁর চোখে মুখে প্রবল উত্তেজনা। ‘তোমরা এই কাহিনী কোথা থেকে পেলে ?’
ঋতুপর্ণা শান্ত গলায় বলল, ‘আমার বাবার ডায়েরির খসড়া থেকে।’
‘তোমার বাবার নাম কী ?’
‘শান্তশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়।’
‘ও! তুমি শান্তশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে?’
‘হ্যাঁ !’ ঋতুপর্ণা ঘাড় নাড়ায়। বিসন অবাক তাকিয়ে থাকে ওদের দুজনের দিকে। কী হচ্ছে ব্যাপারটা যেন ওর বোধগম্যের বাইরে। ভূলোক ভৌমিকের স্ত্রী বিস্ফারিত চোখে এগিয়ে এসেছেন দাঁড়িয়েছেন স্বামীর কাছে। যেন পারলে তাঁকে ছুঁয়ে দাঁড়ান।
‘তুমি কি প্রতিশোধ নিতে এসেছো ?’ ভূলোক ভৌমিক তীব্র গলায় প্রশ্ন করেন।
‘ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে নেই।’
‘তবে ?’
‘আমি এসেছি, এই কষ্ট থেকে আপনাকে মুক্তি দিতে। আমিও মুক্তি পেতে চাই।’
ভূলোক যে তীব্রতায় ঋতুপর্ণার হাত ধরেছিলেন, তার বাঁধান যেন আলগা হয়ে গেল। তিনি দু’হাত মুখে চাপা দিয়ে কেঁদে ফেললেন। ‘খুব অন্যায় করেছি আমি, এত বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ—।’
‘সবই অ্যাকসিডেন্ট ! আজকের দিনে হলে এটা হতো না।’
ভূলোক ভৌমিক নিজেকে সামলে মাথা তোলেন। ‘বিশ্বাস করো আমি ওনার কোনও ক্ষতি চাইনি। সবটাই ভুল হয়ে গেছে।’
‘আমরা বাবাও তাই জানতেন। বিশ্বাস করতেন।’
‘কে, কে বলেছে তোমাকে একথা ?’
‘আমার মা। ওই পর্বেই আপনারা দুজনে যখন সাউথ সেকশনের ট্রেনগুলোতে ঘুরে ঘুরে খুঁজছেন, তখন কোনওদিন ফিরে এসে বাবা বলেছিলেন মাকে। আমি তখন খুব ছোট।’
ভূলোক ভৌমিক অসহায়ের মতো ছটফট করেন। ‘তোমার বাবা গল্প লিখতেন আমাদের পত্রিকায়। ওঁর স্বপ্ন ছিল একদিন না একদিন উপন্যাস লেখার ডাক পাবেন। এমন নামী পত্রিকায় উপন্যাস লেখা মানে লেখক হিসেবে মস্ত বড় স্বীকৃতি। চার বছর অপেক্ষার পর সে বছর তিনি সুযোগ পেলেন। বহুরূপীদের চরিত্র করে উপন্যাস লিখবেন বলে প্রচুর ঘুরলেন। অসম্ভব পরিশ্রম করলেন। শেষে লিখলেন। আশ্চর্যপুরের গিরগিটি। তখন সম্পাদক ছিলেন অমিয়দা। অমিয় সেন। অসাধারণ সম্পাদক। নামী নামী লেখকরা সব ওনার হাত ধরে উঠে এসেছেন। অমিয়দা শান্তশ্রীর সেই লেখা পড়ে উচ্ছসিত। আমাদের আর্ট সেকশনে ঢুকে চিৎকার করে বললেন—ভৌ আজই শান্তশ্রীর উপন্যাসটা বাড়িতে নিয়ে যাও। মনে দিয়ে পড়ো। উঃ কী লিখেছে। চেষ্টা করো এই লেখার সঙ্গে টক্কর দিয়ে যেন তোমার ছবি হয়।’
ভূলোক ভৌমিক থামেন। স্মৃতির অতলে ডুব দেন।
‘সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম শিয়ালদায়। আমার সঙ্গে ছিলেন এখনকার বিখ্যাত লেখক সুবীরবাবু, অসীমানন্দবাবুরা। ওরা সবাই শান্তশ্রীর লেখাটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। অমিয়বাবুর প্রশংসা পাওয়া চাড্ডিখানি কথা নয়—উনি গুণী মানুষ। আমরা তিনজনে মিলে চা খেলাম। সুবীরবাবুরা যাবেন মদ্যপান করতে। আমাকে অফিস থেকে টানাটানি করছিলেন। আমি ওঁদের হাসতে হাসতে বললাম, শান্তশ্রীবাবুর লেখাটা আমার এই চামড়ার ব্যাগে আছে। আমি এখন এটা নিয়ে সোজা বাড়ি যাব। ওঁরা শুনে বললেন—আপনি পড়ে বলবেন তো আপনার কেমন লাগল ? যান, যান, সাবধানে বাড়ি যান। ওনারা আমাকে ট্রেনে তুলে দিলেন। বসার জায়গা পেয়েছিলাম জানলার ধারে। ট্রেনে আমি বেদানা কিনলাম। দামি ফল। কাগজের ঠোঙায় করে পাশে রাখা যায় না, ব্যাগ খুলে তার ভেতর ঢোকালাম। এক পাতা সেফটিপিন কিনলাম। আর এক শিশি হজমিগুলি। এই তিনবার আমি ব্যাগ খুলেছিল। কিন্তু কোনও জিনিস বের করিনি। বের করেছিলাম গামছা কিনে। হঠাৎ সস্তায় একজোড়া গামছা পেয়ে গেলাম। সেটা আর ঠিক করে ব্যাগে ঢুকছে না। ব্যাগ থেকে শান্তশ্রীবাবুর উপন্যাসের ফাইলটা বের করেছিলাম। ভেতরে দুটো বই ছিল, বের করলাম। তারপর বইদুটো বাইরে রেখে সব পর পর ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে রাখলাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখলাম, উপন্যাসের ফাইলটি নেই। আমার মাথায় বজ্রপাত হল। সারা রাত ঘুম হল না। সকালে উঠে স্টেশন মাস্টারের কাছে দৌড়ালাম। কেউ যদি পেয়ে জমা দিয়ে যান। না, কেউ জমা দেয়নি। তখনই চলে গেলাম অমিয়বাবুর বাড়ি। উনি গুণী মানুষ, নমস্য মানুষ। সব শুনে বললেন, মাথা ঠান্ডা করুন। এত চিন্তার কিছু নেই। কাউকে কিছু বলবেন না। আমরা শান্তশ্রীবাবুর কাছ থেকে উপন্যাসের কার্বন কপি আনিয়ে নেব। তার আগে আসুন আমরা একটা কাজ করি। উনি খসখস করে একটি বিজ্ঞপ্তি লিখে ফেললেন। বললেন, একবার পড়ে দেখে নিন। উনি পরিষ্কার করে লিখেছিলেন—কোন ট্রেন থেকে ফাইলটি খোয়া গেছে। বললেন, কারও না কারও চোখে পড়ে যাবে। আমাদের দৈনিক কাগজে পরের দিন সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশ হল। পর পর চারদিন। আমি সেই বিজ্ঞাপনটি নিজের খরচে অন্য দুটি দৈনিকেও ছাপালাম। না, কোথাও থেকে কোনও খবর এল না। পাঁচদিন পরে অমিয়বাবু বললেন, না, কোনও রেসপন্স নেই। বুঝলেন শান্তশ্রীবাবুকেই ডাকতে হবে। উনি বেয়ারা দিয়ে শান্তশ্রীবাবুকে ডেকে পাঠালেন। ওঁর কাছ থেকে লেখাটির কাবর্ন কপি চাইলেন। এবং শান্তশ্রীবাবু জানালেন, তাঁর কাছে লেখার কোনও কপি নেই। এখনকার মতো তখন জেরক্স ছিল না। সব লেখকই কার্বন কপি রেখে লেখা পাঠাতেন। অমিয়বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, আপনার কাছে খসড়া আছে। যান বাড়ি গিয়ে লিখতে বসুন। আশা করি এবার লেখাটা আগের থেকে আরও ভালো হবে। লেখা শেষ করুন—আমি আছি।’
ভূলোকবাবুর চোখে জল। গলা ভাঙা ভাঙা। নাকের ডগা লাল।
‘আমি ট্রেনে ট্রেনে বিজ্ঞপ্তি আটকে দিলাম। হারানোপ্রাপ্তি। পুরস্কার ঘোষণা করলাম। কোনও উত্তর এল না। এরপর আমার আর শান্তশ্রীবাবুর কাজ হল প্রত্যেকদিন সাউথ সেকশনে হকার, প্যাসেঞ্জারদের কাছে ফাইল খুঁজে বেড়ানো। পেলাম না। পুরো ভোজবাজি। এদিকে পুজো সংখ্যার কাজ শুরু হয়ে গেল। এ পৃথিবীতে কারও জন্য কিছু আটকায় না। আমাকে সে বছর আর কোনও কাজ দেওয়া হল না। মানসিকভাবে আমি এতটাই বিধস্ত ছিলাম যে হয়তো আমি কাজ করতেও পারতাম না। আমি তখনও পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি। পেলাম না। আমাদের পুজো সংখ্যা প্রকাশ পেল। একদিন আমি গেলাম ওনার কাছে ক্ষমা চাইতে। দেখলাম, উনি লিখছেন আর ছিঁড়ছেন। একটি পাতাও লিখতে পারছেন না। তোমার মা মামারা বলল ‘আপনি আসুন। আর কোনওদিন আমাদের বাড়ি আসবেন না’। ক’মাস পরে আমাদের অফিসের একজন খবর নিয়ে এল, শান্তশ্রীবাবু আত্মহত্যা করেছেন। মাথা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই আমি চাকরিতে জবাব দিয়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম। বিশ্বাস করো, তারপর থেকে আর কোনওদিন আমি রং তুলিতে হাত দিই না। কলকাতামুখো হইনি। সে সময় অনেক নোংরা কথা শুনেছি। আমার অপরাধের জন্য সুবীরবাবু, অসীমানন্দকে জড়িয়ে অনেক কুৎসা রটেছে। অনেকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন। আমি সুবীরবাবু, অসীমানন্দের কাছেও ক্ষমা চেয়েছি। অমিয়বাবুর কাছেও ক্ষমা চেয়েছি।’
ভূলোক ভৌমিক মাথা নীচু বসে থাকেন। বিড়বিড় করেন, ‘তোমরা আমাকে ক্ষমা করো।’
বিষণ্ণ ঋতুপর্ণা মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঋতুপর্ণা শান্ত গলায় বলে, ‘আপনার ফাইল হারিয়ে ফেলাটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আপনার এই ভুলকে ক্ষমা করার যিনি—তিনি আর নেই। বাবাও নেই, মাও নেই। কিন্তু আমি এসেছি, আপনার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমাকে ক্ষমা করে এই কাজটি করুন।’
‘তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইছ কেন ? তোমার তো কোনও অন্যায় নেই।’ ভূলোকবাবু বলেন।
‘আমি খুব অন্যায় করে ফেলছিলাম আর একটুর জন্য—। বড় হয়ে আমার বাবার মৃত্যু কথা আমি সব শুনেছিলাম। মনে মনে একটা রাগ পুষে রেখেছিলাম। প্রতিশোধ নেব। তারপর যখন সিনেমা করতে শুরু করি, দুটো ছবি বানানোর পর মনে হল বাবার মৃত্যু নিয়ে একটা ছবি করব। আমি দেখাব, একজন শিল্পী আর দুজন লেখক মিলে একজন অসম্ভব প্রতিভাধর লেখককে কীভাবে খুন করল। ঠিক সেসময় আপনার সম্পর্কে আমি খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। খোঁজ নিতে শুরু করে দেখলাম, আমি ভুল, আমি মিথ্যে। বাবার ঘটনাটির পর আপনি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন। চাকরি ছেড়ে নির্বাসনের জীবন কাটাচ্ছেন। আমার বাবার মৃত্যুর সঙ্গে কোনও ষড়যন্ত্রের ঘটনা নেই। কোনও নোংরামি নেই। যা আছে তা একটি অ্যাক্সিডেন্ট। আর সেই অ্যাক্সিডেন্ট-এ একজন নয় দুজন শিল্পী মারা গেছেন। শান্তশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় ও ভূলোক ভৌমিক।’
ঋতুপর্ণা হাত ধরে ভূলোকের, ‘আমার বাবাকে আমি আর বাঁচাতে পারব না, কিন্তু আপনাকে পারি। আপনি বেঁচে উঠুন। দয়া করে ছবি আঁকুন। বাবার হারিয়ে যাওয়া উপন্যাসের খসড়া থেকেই ছবিটা করছি। আপনি যদি ছবি আঁকেন, আপনার হাতের স্পর্শে আমার বাবাও আবার বেঁচে উঠবে।’
ভূলোক ভৌমিক বোবা চোখে ঋতুপর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফিসফিস করে বলেন, ‘আশ্চর্যপুরের গিরগিটি !’
-সমাপ্ত-
অতি চমৎকার গল্প!