ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
‘খিঁ-খিঁক-খিঁ-খিঁ-খিঁক…!’
পাটখেত থেকে ঘাড় উঁচু করে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল মংলু৷ কোত্থাও কেউ নেই৷ মেয়েলিগলায় হাসে কে?
ভট্-ট্-ভট্-ট্…! মোটরবাইকের গর্জন৷ টুক করে মংলু বসে পড়ল৷ বিশ্বাস নেই৷ হয়তো হতচ্ছাড়া ঘণ্টা ওকেই খুঁজতে বেরিয়েছে৷
গর্জন ছাড়তে-ছাড়তে মোটরবাইক চলে গেল হাইরোড ধরে৷ মংলু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল৷
তখনই আবার খিক-খিক! হাসির ঢেউ৷ ঠিক যেন বাচ্চা মেয়ে হাসছে৷
‘বাবারে বাবা৷ কী ভয়, কী ভয়! এত ভয় নিয়ে বাঁচবে কী করে?’
যাচ্চলে! আবার কথাও কইছে৷ অথচ চারিদিক শুনশান, জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না৷
‘তেনারা’ নাকি? মংলুর শরীরে কাঁটা ফুটল৷
কিন্তু এই ভরদুপুরে, রোদে ঝাঁ-ঝাঁ করছে, এইসময় তো ‘তেনারা’ আসেন না৷ অন্ধকার ছাড়া তেনাদের নাকি দেখা যায় না৷ মংলু অবশ্য এসব বিশ্বাসও করে না৷ অন্যদের মুখে শুনেছে৷
‘দুর বোকা! আমায় ভয় পাচ্ছ? তুমি না ব্যাটাছেলে! ডানপিটে, বেপরোয়া! সবাই তোমায় ভয় পায়! এই তোমার সাহস? উপরের দিকে তাকাও৷ এই যে আমি, নিমগাছের ডালে।’
মংলু তাজ্জব হয়ে দেখল, পাশের ঝাঁকড়া নিমগাছের ডালে একটা রঙিন পাখি বসে আছে৷ এমন পাখি ও আগে কখনও দেখেনি৷ বড়সড় কাকাতুয়ার মতো শরীর, ফিঙের মতো লম্বা ল্যাজও আছে৷ ধপধপে সাদা, গলার কাছটা লাল-হলুদ, ল্যাজে সাতরকম রামধনু-রং৷
পাখিটা দিব্যি গলা ফুলিয়ে বলল— ‘অত হাঁ করে দেখার কী আছে? কিছু কি ভুল বললাম? তুমি ভয় পাওনি?’
‘সে-একটু-ইয়ে…’ মংলু তোতলাতে থাকে, ‘মানে…পাখি যে কথা বলবে, তা আমি কী করে বুঝব?’
‘পাখি কথা বলবে, তুমি কী করে বুঝবে?’ পাখিটা আবার খুকখুক করে হাসল, ‘তুমি তো বেশ মাথামোটা ছেলে! পাখিরা কথা বলে না? আমরা তো নিজেদের মধ্যে সবসময়েই কথা বলছি৷ তোমরা যাকে কিচির-মিচির বা শিস বলো! তুমি এটাও জান না? ছি-ছি।’
মংলুর গা রি-রি করে উঠল৷ একটা পাখি তাকে নিয়ে মস্করা করছে!
‘বাজে বোকো না! তোমরা কিচিরমিচির করে কী বকবক করো, তা নিয়ে আমরা কি মাথা ঘামাই নাকি? নাকি তোমাদের বকবক বুঝতে পারি?’
‘এই তো৷ এতক্ষণে চালাক ছেলের মতো কথা বলেছ৷ তোমরা আমাদের কথা বুঝতে পারো না৷ বুঝতে পারো না, তোমাদের নিয়ে আমরা পশুপাখিরা হাসি-ঠাট্টা করি৷ প্রচুর গালমন্দও করি৷ এখন আমার কথা তুমি বুঝতে পারছ৷ তাই রেগে যাচ্ছ৷ কী করে বুঝতে পারছ, জানো?’
মংলু দুদিকে মাথা নাড়ল৷
পাখি বলল, ‘তোমার প্যান্টের বাঁ-পকেটে একটা আধুলি আছে৷ বের করে দ্যাখো।’
মংলু ফের হতভম্ব৷ ওর কাছে একটা আধুলি আছে, এই পাখিটা জানল কীভাবে? আর কেউ তো জানে না! কাল বিকেলে নগেনজ্যাঠার পাকা চুল বেছে দিয়েছিল৷ তার পারিশ্রমিক৷
ও আধুলিটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷
‘কিছু বুঝতে পারছ? আধুলিটা কি এ দেশের?’
‘না৷ ভূটানের৷ তাতে কী? আমাদের এখানে তো ভূটানের পয়সা দিব্যি চলে।’
‘সে আমি জানি৷ তবে এই আধুলিটা সাধারণ ভূটানি আধুলি নয়৷ হঠাৎ চলে এসেছে৷ আর তাতেই হয়েছে আমার বিপদ।’
মংলু হাঁ হয়ে ওপরদিকে চেয়ে আছে৷
পাখি বলল, ‘এই আধুলির মালিক জাংথেম৷ সাংঘাতিক ভূটানি যাদুকর৷ অনেক ভেলকি, তন্ত্রমন্ত্র জানে৷ মানুষকে পশুপাখি, পশুপাখিকে মানুষ বানিয়ে দেয় চোখের পলকে৷ জাংথেম থাকে তোমাদের গাঁয়ের ওধারে, ওই যে ভূটান পাহাড় দেখছ, ওই পাহাড়ে৷ পরশু দুপুরে জাংথেম যখন খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিল, এক ব্যাটা কাক চকচকে আধুলি দেখেই মুখে করে তুলে নেয় বাসায় রাখবে বলে৷ উড়তে-উড়তে মুখ থেকে আধুলিটা পড়ে গেল৷ তোমার ওই নগেন জ্যাঠা তখন ক্ষেত দেখতে বেরিয়েছিল৷ সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল৷ নিয়েই সোজা পকেটে৷ কী অদ্ভুত লোক বলো!’
‘এতে অদ্ভুতের কী হল? ফাঁকা পথে পয়সা পড়ে আছে৷ কেউ কোথাও নেই যে জিগ্যেস করবে৷ তাই তুলে নিয়েছে৷ এ কি হাজার টাকা যে থানায় জমা দেবে? কিন্তু তাতে তোমার কী বিপদ হল?’
‘বিপদ হল না? আমাকে এই আধুলি পাহারা দিয়ে বেড়াতে হচ্ছে৷ ওটা আমায় উদ্ধার করতেই হবে।’
‘তোমায় উদ্ধার করতে হবে? কেন?’
পাখিটা এবার ঠোঁট মুচড়ে হাসল৷ পাখিরা যে এরকম শব্দ না করে হাসতে পারে, মংলু প্রথম দেখল৷
‘হাসছ কেন?’
‘হাসছি এই ভেবে যে তুমি আমায় সত্যি-সত্যি পাখি ভেবেছ৷ ভাই মংলু, আমি সাধারণ পাখি নই৷ এখন পাখি সেজে আছি৷ আসলে আমি জাংথেমের সাকরেদ৷ ওই ভূটান পাহাড়েই থাকি৷ আমিও ঘুমোচ্ছিলাম। যে-ই না জাংথেম জানতে পারল তার মন্ত্রপূত আধুলিটা হাপিস, অমনি আমায় পাখি বানিয়ে ছেড়ে দিল৷ যা, আধুলিটা উদ্ধার করে নিয়ে আয়৷ সেই তখন থেকে তক্কে-তক্কে আছি৷ কী যে জ্বালা!’
মংলু দোটানায় পড়ে গেল৷ পাখিটার জন্যে একটু খারাপ লাগছে৷ বেচারি দু’দিন ধরে উড়ে-উড়ে বেড়াচ্ছে৷ আবার দারুণ কৌতূহলও হচ্ছে৷ মন্ত্রপূত আধুলি!
‘কী ভাবছ? ভাবছ আমি সত্যি কথা বলছি কিনা?’
‘ঠিক তাই।’ মংলু বলল, ‘তোমার কথা যাচাই করার ইচ্ছে হচ্ছে৷ এই আধুলি ঠিক কী করতে পারে বলো তো?’
‘বশীকরণ করতে পারে।’ পাখি বলল, ‘হাতের মুঠোয় ওকে রাখলে তুমি যে কাউকে বশ করতে পারবে৷ তুমি যা বলবে, যা চাইবে সে তাই করবে৷ আর পশুপাখি, গাছপালা, পোকামাকড় সবার ভাষা বুঝতে পারবে৷ যেমন আমার কথা বুঝতে পারছ।’
মুহূর্তে মংলুর শরীর দিয়ে উত্তেজনার তরঙ্গ বয়ে গেল৷ কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠল৷ পকেটের মধ্যে মুঠো করে ধরল আধুলিটা৷ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আজকের সকাল৷
মংলুরা নিতান্তই গরিব৷ জমিজিরেত নেই৷ বাবা চাষের কাজ জানেন না৷ কুচবিহার শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন৷ মাসখানেক কাজ নেই৷ বসে আছেন৷ যা দু’-চার পয়সা ছিল, শেষ হতে বসেছে৷ তাই সোমবার থেকে ওদের বাড়িতে কেবল রাতের বেলায় উনুন জ্বলছে৷ সকালে মা এর-ওর বাড়ি কাজ করে যা চিঁড়ে-মুড়ি পায়, নিয়ে আসে, ওর চারজন ভাগ করে খায়৷ মংলুর ছোট্ট একটা বোনও আছে৷ সন্ধেবেলা যখন ভাত রান্না হয়, ভাতের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে, মংলুর আর পড়ায় মন বসে না৷ শরীর আনচান করে৷ কতক্ষণে যে মা খেতে ডাকবে৷
কাল ওদের স্কুলে বিডিও অফিস থেকে দু’বস্তা চাল, ডাল, ডিম, তেল নিয়ে এসেছিল৷ হেডস্যার বললেন, ‘ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাওয়া ইস্কুল থেকেই দেওয়া শুরু হবে।’ শুনে সারা ইস্কুল জুড়ে দারুণ হইচই পড়ে গেল৷ দুপুরে ভাত-ডাল-ডিম! কী আনন্দ, কী আনন্দ! সব্বাই পেটপুরে খেতে পাবে৷ কেউ আর ইস্কুল কামাই করবে না৷
বাড়িতে এসে বলতে বাবা-মাও খুশিতে ডগমগ৷ মা তো বলেই ফেলল, ‘ইস, মুন্নিটা বড্ড ছোট৷ নইলে ওকেও ইস্কুলে পাঠাতাম।’
কিন্তু আজ সকালে ইস্কুলে গিয়েই মংলু ধন্দে পড়ে গেল৷ কী ব্যাপার! সব থমথম করছে৷ দিদিমণি-স্যারেরা নিজেদের মধ্যে নীচুগলায় কথা বলছেন৷ সকলেরই মুখ গম্ভীর৷ কিছু দূরে উনুন-ডেকচি-হাঁড়ি-খুন্তি পড়ে আছে৷ রান্নার তোড়জোড় হচ্ছে না তো! তবে কি সব ফেরত চলে যাচ্ছে? ওদের খাওয়াবে না?
একটু পরেই বোঝা গেল৷ গর্জন করতে-করতে তিনটে মোটরবাইক এসে দাঁড়াল ওদের ইস্কুল চত্বরে৷ ধুলো-ধোঁয়ায় ভরে গেল চারদিক৷
হাতে বালা, গলায় সোনার চেন ফুলহাতা ছোপছোপ গেঞ্জিপরা ছ’টা ষণ্ডাগণ্ডা ছেলে নামল৷ তাদের একজনকে মংলু ভালো করে চেনে, ঘণ্টা৷ ওদের গ্রামের বিশু প্রধানের ছেলে৷ বাবার শহরে ফলাও পাইকারি মুদির দোকান৷ দলবল নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় হুজ্জতি করে বেড়ায়৷ নামকাওয়াস্তে একটা ক্লাব আছে৷ তার নাম করে বছরে বারোমাস নানা ছুতোয় চাঁদা তোলে৷ ওদের দলকে এ তল্লাটে ভয় পায় না, এমন লোক নেই৷
ঘণ্টা চাবির রিং ঘোরাতে-ঘোরাতে এগিয়ে এল৷ পিছনে বাকিরা৷ ইস্কুলের বারান্দায় স্যার-দিদিমণিরা৷ মংলু দেখল, ওঁদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ ছেলেমেয়েরাও জড়ো হয়েছে একপাশে৷
‘স্যার, সব ঠিক আছে তো? মালটা কোথায় রেখেছেন? নিয়ে যেতে এলাম।’
‘বাবা ঘণ্টা, শোনো৷ এ হয় না।’
‘হয় না মানে? কী আলফাল বকছেন? কাল বিকেলে আপনার বাড়িতে সব বলে এলাম৷ ক্লাবে একটা কালার টিভি কিনছি৷ টাকা দরকার৷ বলিনি?’
‘সে বলেছ৷ কিন্তু বাবা, বললেই তো হয় না৷ এসব কি ইস্কুলের সম্পত্তি? আমরা কি এর মালিক? সরকার দিয়েছে বাচ্চাদের খাওয়াতে৷ ওরা অনেকেই বাড়িতে দু’বেলা খেতে পায় না৷ তাই—’
‘থামুন তো! বেকার জ্ঞান ঝাড়বেন না৷ আমরা লেকচার শুনতে আসিনি৷ আমরা কি সবটা নিয়ে যাব বলেছি? ফিফটি-ফিফটি৷ ছ’দিনের জায়গায় তিনদিন খাওয়াবেন৷ কে দেখতে যাচ্ছে? আগে তো একদিনও পেত না।’
পাশ থেকে আরেকটা ষণ্ডা বলে উঠল, ‘তুমি বড্ড বেশি বকছ গুরু৷ মাল ওঠাও, ব্যস।’
‘না।’ হেডস্যার বললেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ছেলেমেয়েদের খাওয়ার চাল তোমাদের দিতে পারব না।’
‘পারব ন্যা! ইল্লি আর কী! বুড়ো বয়েসে ভীমরতি হয়েছে৷ না দেওয়ার মালিক কি তুমি? আমাদের চেনো না? অ্যাই চল্, বস্তা ওঠা৷… সরো, সরে যাও—৷ নইলে তোমার ছাত্তরদের সামনে—’
বলতে-বলতে ঘণ্টার সঙ্গী হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসে৷
মংলুর মাথার মধ্যে হঠাৎ যেন বিস্ফোরণ ঘটে গেল৷ শরীরের মধ্যে আগুনের হলকা৷ ও স্থানকাল ভুলে গেল৷ নিমেষে পকেট থেকে বের করে এনেছে ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী গুলতিটাকে৷ গুলতিতে ইটের টুকরো বসিয়ে সর্বশক্তিতে ছিলায় টান দিল৷
‘আঁঃ—!’
প্রথমজন কপাল চেপে বসে পড়েছে৷ রক্ত বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে৷
সকলে বিমূঢ৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় ইটটা তীব্রবেগে ছুটে গেল ঘণ্টার দিকে৷ সোজা গিয়ে বিঁধেছে তার কানের ওপরে৷ ঘণ্টাও আর্তনাদ করে বসে পড়েছে৷
আর একমুহূর্ত দাঁড়ায়নি মংলু৷ তার পকেটের ইট ফুরিয়ে গেছে৷
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট্-ছুট্৷ ছুটতে-ছুটতে গ্রাম পেরিয়ে এসেছে, ধানখেত পেরিয়ে হাইরোড৷ হাইরোডের পাশে লম্বা-লম্বা এক মানুষ উঁচু পাটবন৷ সেইখানে এসে লুকিয়েছে৷ উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে৷
তারপর আস্তে-আস্তে ভয় এসে জড়ো হয়েছে৷ ওরা তো জানতে পারবে৷ ওকে ছেড়ে দেবে? ও যদি না ফেরে? কতদিন ফিরবে না? কোথায় থাকবে? আর ওর মা-বাবা-বোন? ওরা তাদের ওপর অত্যাচার করবে না?
নিজের মনেই ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদেছে মংলু৷ ও যে হেডস্যারের ওপর ওই মাস্তানটার চোটপাট সহ্য করতে পারেনি!…
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই পাখিটার কথা যদি সত্যি হয়, বিপদের অন্ধকারে একটা আলোর রেখা ও দেখতে পাচ্ছে৷ দেখাই যাক্ না৷ যদি আধুলিটার কোনো গুণ না থাকে, কী করবে ওরা? মারবে? মেরে ফেলবে? ফেলুক৷ এই গ্রামে থাকতে হলে, বাড়ি ফিরতে হলে ওকে ওদের মুখোমুখি হতেই হবে৷ আজ, না হয় কাল৷
‘কী ভাবছ মংলু? আধুলিটার ক্ষমতা আছে কিনা? চলোই না৷ আমি তো আছি৷ ভয় কী!’
পাখিটা উড়তে-উড়তে বলল৷
বেশিদূর যেতে হল না৷ মংলু দূর থেকেই হায়নাগুলোকে দেখতে পেল৷ গ্রামে ঢোকার মুখেই ওরা চারজন দাঁড়িয়ে আছে৷ বুড়ো বটগাছের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল৷
ওরাও মংলুকে দেখতে পেয়ে গেছে৷ সঙ্গে-সঙ্গে সিগারেট ফেলে চারটে বদমাশ দ্রুতপায়ে এদিকে এগিয়ে এল৷ শিকার যে এত সহজে নিজেই এসে ধরা দেবে, ওরা ভাবতে পারেনি৷
মংলু ভেতরে-ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত৷ পকেটের আধুলিটাকে শক্তভাবে মুঠোয় চেপে আছে৷ বাইরে নির্বিকার৷ গ্রামেই দিকেই হেঁটে যাচ্ছে৷
ওরা কি একটু ঘাবড়ে যাচ্ছে? ওদের দেখেও মংলু ছুটে পালাবার চেষ্টা করছে না, উলটে এগিয়ে আসছে, এমন হওয়ার কথা নয়৷ ওরা একটু দূরত্বে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷
মংলু ভ্রূক্ষেপহীন, যেন দেখতেই পাচ্ছে না৷ ওর কানে এল ওদের কথাবার্তা৷
‘কী ব্যাপার গুরু? ছোঁড়াটা আমাদের দিকেই আসছে।’
‘নির্ঘাত বদমাশটার কাছে গুলতি রেডি করা আছে৷ কাছে এসেই ঝাড়বে।’
‘ঠিক বলেছ৷ পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আছে না?’
‘সাবধান! ওকে বিশ্বাস নেই।’
চারটে বদমাশ রাস্তার দু’দিকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ যেন পজিশন নিচ্ছে৷ মংলুর হাসি পেল৷ পাজি লোকেরা এত ভিতু! ওরা চারটে ষণ্ডা-মুশকো, ও একা৷ তবু ওদের নিশ্চিন্ত করতে ও পকেট থেকে আধুলি-ধরা হাতটাকেও বার করে আনল৷ দেখুক৷
রাস্তার মাঝখান দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে মংলু৷ একটু দূরেই দুদিকে ওরা৷
হঠাৎ দুদিক দিয়ে ছুটে এসে চারজনে ওকে জাপটে ধরল৷
‘এ কী! কি হল? আমি কী করেছি?
‘কী করেছিস! নচ্ছার, শুয়োর!…অ্যাই, ওর পকেট থেকে গুলতিটা বের করে নে৷…চলো! আজ তোমার হচ্ছে।’
‘কী হবে?’
‘কী হবে, দেখতেই পাবে৷ মেরে তোমার হাড়মাংস আলাদা করব৷…এটাকে ক্লাবে নিয়ে চল।’
‘ওখানে ঘণ্টাদা আছে বুঝি?’
‘আইব্বাপ্, এটা তো সাংঘাতিক জিনিস রে৷ ব্যাটা সব জানে৷…হ্যাঁ, ওখানে তোমার ঘণ্টাদাদা আছে৷…তোমার ঘণ্টা সে-ই বাজাবে৷ চলো!’
চ্যাংদোলা করে টানতে-টানতে মংলুকে ওরা নিয়ে চলল ক্লাবের দিকে৷
মুখে-মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে৷ মংলুর বন্ধুরা, গ্রামের বাচ্চাবুড়ো, ক্রমেই ভিড় বাড়ছে৷ মংলু ওই শোয়া অবস্থাতেও নির্বিকার৷ মুখে মুচকি হাসি৷ ওর চোখ ঘুরছে ভিড়ের মধ্যে৷ বাবা-মা নেই তো? দেখলেই এমন বিচ্ছিরি কান্নাকাটি শুরু করবে৷
ক্লাবঘরের ভিতরে এনে মংলুকে ওরা দাঁড় করাল৷ মংলু দেখল, ঘণ্টা আর তার সঙ্গী বসে৷ ওর কপালে তুলো সাঁটা, ঘণ্টার কানের ওপরে ব্যান্ডেজ৷
‘বস্, ধরে এনেছি এটাকে।’
মংলু হাসতে-হাসতে বলল, ‘ওমা! তোমরা ধরলে কোথায়? আমি তো নিজেই—’
‘অ্যাই চোপ! এক চড়ে তোমার গাল ফাটিয়ে দেব।’
‘তোরা থাম।’ ঘণ্টা উঠে দাঁড়িয়েছে৷ তার চোখ জ্বলছে৷ সোজা এসে সে মংলুর গলা টিপে ধরল, ‘আমায় মারলি কেন? বল-বল।’
‘আঃ, লাগছে৷ আগে গলাটা ছাড়ো, নইলে বলব কী করে!… হ্যাঁ, এবার বলছি৷… তোমরা স্যারদের ওপর হুমকি দিচ্ছিলে, তাই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।’
‘মাথা গরম হয়ে গেছিল? তোর এত বড় সাহস! এবার যদি তোমার মাথাটা একেবারে ঠান্ডা করে দিই, কে তোমায় বাঁচাতে আসবে?’
‘পারবে না।’
‘কী—? কী বললি? শয়তানের বাচ্চা, দাঁড়া! দেখাচ্ছি!’
পাঁচটা বুনো মোষ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে ওর দিকে তেড়ে এল৷ ঘণ্টা ওর গলা আবার চেপে ধরতে গেল৷
প্রাণপণে আধুলিকে মুঠোয় চেপে মংলু ফিসফিস করে বলল, ‘থামো! থেমে যাও!’
অমনি তাজ্জব ব্যাপার৷ যেন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমা৷ যে যেখানে ছিল, ওখানেই আটকে গেল৷ নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই৷ এক্কেবারে স্ট্যাচু৷ ঠিক ‘গুপি গাইন’-এর মন্ত্রীমশাইয়ের অবস্থা৷ ঘণ্টার দুটো হাত শূন্যে মাঝপথে আটকে আছে৷
ছ’টা মস্তানেরই চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে! নির্বাক৷
মংলুর শরীর রোমাঞ্চিত৷ আদেশের সুরে বলল, ‘সবাই ওই ওখানে গিয়ে দাঁড়াও৷ কোনোরকম বাঁদরামি করার চেষ্টা করবে না।’
সবক’টা সুড়সুড় করে ঘরের এককোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল৷
‘বাঃ, লক্ষ্মী ছেলে!’ মুঠোয় আধুলি নাড়াচাড়া করতে-করতে মংলু বলল, ‘এবার আমরা যাব আমাদের স্কুলে৷ কেমন?’
সবক’টাই ঘাড় নাড়ল৷
ক্লাবঘরের বাইরে লোক থইথই করছে৷ আশপাশের চার-পাঁচটা গ্রাম থেকে ঝেঁটিয়ে এসেছে৷ মংলু বেরিয়ে এল৷ পিছনে পোষা কুকুরের মতো মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছ’টা মস্তান৷ লোকে হাঁ হয়ে দেখছে৷
হেডস্যার এদিকেই আসছিলেন৷ খবরটা শুনেছেন অন্যদের কাছে৷ তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না৷
মংলু তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘স্যার, ওদের নিয়ে এসেছি৷… অ্যাই, দাঁড়িয়ে আছ কেন? সবাই স্যারের পা জড়িয়ে ধরো৷ ক্ষমা চাও৷ বলো, আর কখনও এমন হবে না।’
বলতে-না-বলতে ঘণ্টা আর পাঁচ সঙ্গী সাষ্টাঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ল হেডস্যারের পায়ের ওপর৷ দম দেওয়া পুতুলের মতো৷ হেডস্যারের পায়ের ওপর মাথা ঠুকছে, পা জড়িয়ে ধরেছে৷ কেঁউকেঁউ করে বলছে, ‘স্যার, এবারের মতো মাপ করে দিন স্যার৷ আর কখনও করব না৷ ভালো হয়ে যাব স্যার।’
সে এক দৃশ্য বটে! কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি৷
এইসময় একটা শোরগোল উঠল৷ তার মাঝে মহিলার কান্নাভেজা গলা৷ পরক্ষণেই ভিড় ঠেলে ছিটকে এসে পড়ল মংলুর মা৷ শাড়ি লুটোচ্ছে মাটিতে৷ দু-চোখে জল, উদ্বেগ৷ পাগলের মতো অবস্থা৷
‘সোনা! সোনা আমার! কী হয়েছে তোর?’ বলতে-বলতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল মা৷
‘মা! মা!’ মংলুরও চোখে জল উপছে এল৷ কোনোরকমে বলল, ‘কিছু হয়নি মা৷ আমি ভালো আছি।’
কখন যে হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেছে, মংলু বুঝতেও পারেনি৷ একটা শব্দ হল— ‘ঠং-ং!’
আধুলিটা গড়াতে-গড়াতে চলে গেছে রাস্তার ধারে৷
কোথায় গেল, কোথায় গেল? মংলু নিজেকে সামলে ব্যস্ত হয়ে খুঁজতে লাগল৷
কিন্তু তার আগেই পাখিটা দেখে ফেলেছে৷ উপর থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছে আধুলিকে৷
মংলু শুনতে পেল, পাখিটা বলছে, ‘ভাই মংলু, আমি একে নিয়ে যাচ্ছি৷ তোমার কাজ হয়ে গেছে৷ কোনো চিন্তা নেই৷ ওরা আর কিছু করবে না৷ তবু যদি কখনও দরকার হয়, ডেকো৷ চলে আসব৷ টা-টা।’
নিমেষের মধ্যে ডানা মেলে নীল আকাশে উধাও হয়ে গেল রঙিন পাখি৷
মংলু হতভম্ভের মতো তাকিয়ে রইল৷
অন্যরা কেউ কিন্তু এ দৃশ্য দেখতে পায়নি, জানতেও পারেনি৷
সত্যি-সত্যিই এরপর থেকে ওই ছেলেগুলো একদম পালটে গেছে৷ ঘণ্টা এখন রোজ শহরে বাবার দোকানে বসে৷ অন্যরাও কাজকর্ম খুঁজছে৷ এই এলাকায় এখন খুবই শান্তি৷ কোনো উৎপাত নেই৷
মংলু, ছোট্ট মংলু এখন সবার চোখের মণি৷
একটাই আফশোস মংলুর, কথায়-কথায় পাখির নামটাই জানা হয়নি৷ যদি সত্যিই দরকার পড়ে, কী নামে ডাকবে?
ইস্স্, ও কী বোকা!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো লাগল