আমেরিকায় ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান
রবীন্দ্র চক্রবর্তী
আমাদের ছোটবেলায় সাত-আট বছর হতে না হতেই মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল দলে নাম না লেখালে ছেলেদের কোনো ইজ্জত থাকতো না। নিজের বা পাড়ার দাদারা এই দলভুক্তিকরনের কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে বছরের পর বছর পালন করে আসতেন। ছোটদের জন্যে নিজের দলের খেলোয়াড়দের নাম আওড়ানো যেন এই ভোটাধিকার অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল। তখনও কলকাতায় সেরকম টিভি আসে নি, তাই রেডিও-ট্রানজিস্টার এ কান পেতে ধারা-বিবরণী শুনে বা খেলার আসর পত্রিকার পাতায় ছবি দেখে খেলোয়াড়দের চিনতে হতো। ক্লাস ফোরের কোনো ছেলে যদি বিদেশ বসু, কম্পটন দত্ত, কি সুরজিৎ সেনগুপ্তের ছবি দেখে চিনতে না পারতো তার নাম মুহূর্তে মাটিতে মিশে যেত।
এর পরে যুগ বদলে গেছে। টিভির দৌলতে আন্তর্জাতিক খেলা দেখার সাথে সাথে বাঙালিদের মন কেড়ে নিয়েছে ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকার ডাকসাইটে খেলোয়াড়রা। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান দুই দলই বিদেশ থেকে নামকরা খেলোয়াড়দের ভাড়া করে এনে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার সাথে সাথে সেই ইলিশ বনাম চিংড়ি, কিম্বা ঘটি-বাঙালের খাঁটি ঘরোয়া রসিকতা অনেক অংশে লুপ্ত হয়ে গেছে। রেষারেষি কমে গেছে অনেক পরিমাণে। তবু মরা হাতি লাখ টাকা।
গতবছর অতনু বলেছিল ইংল্যান্ডে নাকি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান সমর্থকেরা পাঁচবছর ধরে কলকাতা ডার্বি অনুকরণে ফুটবল প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেছিল আটলান্টায় কোনোভাবে এর প্রচলন করা যায় কিনা। তারপরে এ সম্পর্কে আর উচ্চ-বাচ্য শুনি নি।
হঠাৎ মাস দুয়েক আগে এক সন্ধ্যেতে পার্থর ফোন। বললো আটলান্টায় কলকাতা ডার্বি আসছে ইংল্যান্ডের প্রচলনের পথ ধরে। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে আমাদের এই প্রতিযোগিতা হবে রবিবার, ১৪ই আগস্ট। কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দুদলের কর্মকর্তারা এই প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং সমর্থন জানিয়েছেন। এই প্রতিযোগিতার নাম হবে আই. এফ. এ শীল্ড ইউ. এস. এ।
তবে আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমাকে এই আটল্যান্টায় ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান খেলা নিয়ে গান লিখে দিতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি। অমিত কুমার গাইবেন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। পরের দিন দুপুরে কাজের খাতিরে ফ্লাই করছি হিউস্টনে। তবে সঙ্গীত জগতের সর্বোচ্চ শিখরে যাঁর স্থান, সেই কিশোর কুমার – তাঁর ছেলে আমার লেখা গান গাইবেন, এমন কথা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবি নি। তাই আমি বললাম, “লিখে দেব”।
শুনে পার্থ আলগা গলায় বললো, “তুমি তো মোহনবাগান – তাই না?” আমি বললাম “হ্যাঁ, আর তুমি?” ও হেসে বললো, “ইস্টবেঙ্গল”! মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে গেল, “যাত্তারা!” এর পরে পার্থ আর আমার মধ্যে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে কি ভাবে এই প্ৰচেষ্টাকে সফল করা যায়, প্রতিবারই মনে হয়েছে প্রতিযোগিতা আর সহযোগিতা যেন একই পথের দুই প্রান্ত। অন্তরে কোনো তফাৎ নেই। বলতে দ্বিধা নেই এই প্ৰচেষ্টার পিছনে পার্থর অক্লান্ত পরিশ্রমের কোনো তুলনা হয় না। শুনেছি, এই সকার ম্যাচের প্রকল্পের খসড়া করেছিল পার্থ আর শুভ স্টারবাক্সে বসে, একটা ন্যাপকিনের পিছনে নক্সা এঁকে।
দেখতে দেখতে মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। তৈরী হলো দুটো মোহনবাগান, দুটো ইস্টবেঙ্গল দল। শুরু হলো অনুশীলন পর্ব। প্রতি শনিবার-রবিবার প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চললো ভিন্ন খেলার মাঠে। তৈরী হলো পাঁচটা হোয়াটস্যাপ গ্রূপ। সেখানে চব্বিশ ঘন্টা চললো আলোচনা, কৌশল-পরিকল্পনা, মাঝে মাঝে পরনিন্দা-পরচর্চাও। নতুন লোগো সৃষ্টি হলো সুভদ্রের সৃজনশীলতায়। রক্তিমদার প্রয়াসে প্রকাশ পেল আই এফ এ শীল্ড ইউ এস এর ওয়েব সাইট।
এই প্রথম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের স্পর্শ এলো আমেরিকায়; আটল্যান্টা শহরে। ইন্টারনেটে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হলো এই উদ্যোগের জয়ধ্বনি। অফিসিয়াল জার্সি এলো কলকাতা থেকে। ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন খ্যাতনামা খেলোয়াড় মাইক ওকোরো রাজি হলেন প্রধান অতিথি হতে। সম্মত হলেন হিউস্টন থেকে উড়ে আটল্যান্টা আসতে শুধু এই খেলায় উপস্থিত থাকার তাগিদে। অমিত কুমার গাইলেন আমার লেখা গান। উত্তেজনা ধীরে ধীরে খেলার মাঠের গন্ডি পেরোলো। ছবির পর ছবি উঠলো অনুশীলনের। ভারতের ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকাতে সেই উত্তেজনার প্রকাশ পেল বারবার। আটলান্টার বাঙালি সমাজ যেন কোন নতুন চুম্বকে বাঁধা পড়েছে। ১৩ই আগস্টে কিশোরদের প্রতিযোগিতায় মোহনবাগান দল ২-১ গোলে জয়যুক্ত হলো।
দেখতে দেখতে এলো ১৪ই আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম জন্মবার্ষিকী পালনে আমেরিকার জর্জিয়া রাজ্যের আধুনিক শহর জনস্ক্রীক মেতে উঠল এক নতুন উত্তেজনায়। ম্যাচের উদ্বোধন করলেন জনস্ক্রীকের মাননীয় মেয়র জন ব্র্যাডবেরী। উপস্থিত ভারতের আটলান্টা শাখার কনস্যুল জেনারেল মাননীয়া ডঃ স্বাতী কুলকার্ণি। খেলার মাঠে ধ্বনিত হলো ভারতীয় ও আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত। কলকাতার উন্মাদনা এলো জনস্ক্রীকে।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল এর ভক্তদের নিয়ে তৈরী চারটি দলের মোকাবিলা হলো নিউটাউনের অস্ট্রো-টার্ফ মাঠে। ইস্টবেঙ্গলের দুই দলের দলনায়ক ছিলেন মানস চ্যাটার্জি ও অভিক পাল। মোহনবাগানের নেতৃত্ব করেছিলেন অমিত পোদ্দার ও সুমন্ত বর্ধন। ফাইনালে টাই-ব্রেকারে জয়ী হলেন ইস্টবেঙ্গল দল। ফেসবুক লাইভে প্রচারিত হলো এই খেলার টেলিকাস্ট; ধারাবিবরণী দিলেন অর্ক পন্ডিত। ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন খ্যাতনামা খেলোয়াড় মাইক ওকোরো সবাইকে জুগিয়ে গেলেন অনুপ্রেরণা। নাইজিরিয়া, ভারত, আমেরিকা এক হয়ে মিশে গেল খেলার আনন্দে। অজস্র পরিশ্রম করে ওই গরমের মধ্যেও ভিডিও তুললেন সতীনাথ সরকার। সমর্থকদের ভিড় উপচে পড়লো মাঠের চারপাশে। দেখলাম সবার পরিবারের সদস্যরা এসেছেন এই মাঠে; এ যেন এক নতুন ধরনের মেলা।
ফুটবল-প্রেমী প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে আই. এফ. এ শীল্ড ইউ. এস. এ. সৃষ্টি করলো কলকাতা ডার্বির এক নতুন ইতিহাস। উপস্থিত মিডিয়া একে একে অনেককেই ইন্টারভিউ করলেন। মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল দলের চার পরিচালক রাজাগৌতম কর, রবীন্দ্র চক্রবর্তী, সোমেশ কারাঞ্জি ও রক্তিম সেন সবাই একমত প্রকাশ করে বললেন, “এই প্রতিযোগিতা শুধু যে এক নতুন স্বাক্ষর রাখল আমেরিকায় তাই নয়; ভবিষ্যতে এই প্রতিযোগিতা বার্ষিক প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত হবে এবং আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্রসারিত হবে।”
দেখতে দেখতে মাঠে আঁধার ঘনিয়ে এলো। খেলা হলো শেষ। খেলার শেষে ট্রফি ও মেডেল বিতরণ করলেন মাইক ওকোরো। জয়ী দল ইস্টবেঙ্গলের আনন্দ হলো গগন-চুম্বী। মোহনবাগান হলো মন-মরা। আমিও সেই আহত মনের একজন। খেলার পরে মাঠের প্রান্তে ডিনারের জোগাড় ছিল। সবাই খাবার নিলেন মিলেমিশে।
ফেরত এলাম গাড়িতে। বাড়ি যাবার পালা। কেমন যেন পুজো-ভাঙা ভাব। কোথায় একটু ফাঁকা ফাঁকা ঠেকলো। আমার অর্ধাঙ্গিনী সোমা, অমিত কুমারের গাওয়া গানটা চালিয়ে দিলেন গাড়িতে।
লাল হলুদ আর সবুজ মেরুন
জার্সি যখন গায়,
আমেরিকায় দেশের মাটির
গন্ধ পাওয়া যায়!
সেই দলাদলি, ঝগড়া ঝাঁটি
ছেলেবেলার মন,
ভরে দিল আই এফে শীল্ড
ফুটবল প্রাঙ্গণ!
গানটা নিজেরই লেখা, কিন্তু শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে গেলাম। সত্যি তো! আমার গায়ে সবুজ-মেরুন জার্সি। দেশের মাটির এমন গন্ধ আমেরিকায় এর আগে তো এভাবে কোনোদিন পাই নি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন