পাঞ্চালী দত্ত
অপার বাংলার সঙ্গে যখন থেকে যুক্ত হয়েছি, প্রতি বছর শারদীয়া সংখ্যায় লিখছি। আমার লেখার বিষয় যেহেতু খাবার, তাই দুর্গাপুজোকে ঘিরে নানারকম খাবার নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছি। ভাবছিলাম এবারে তাহলে ভাঁড়ার ঘরের কোন রসদটিকে উপস্থাপনা করা যায়! ভাবনার ঘরে ছিলিম টানতে রসদঘর থেকে বেরিয়ে এল পান্তাভাত। তাই ঠিক করলাম মায়ের ভোগের পান্তাভাত নিয়ে এবারে লিখব। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় দশমী দিন মাকে পান্তাভাত দেওয়া হয় আর সঙ্গত হিসেবে সেখানে থাকে নানারকম পদ যা পান্তা দিয়ে খেতে ভীষন ভালো লাগে ।
গ্রামীণ খাবার পান্তা । রাতে বেশি করে ভাত রান্না করে তাতে জল দিয়ে পরদিন সেই গাজন বা ফারমেন্টেড ভাত কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, শুকনোলঙ্কা ভাজা, নুন, সর্ষের তেল দিয়ে সকালের জলখাবার বা নাস্তা সেরে চাষিরা মাঠে নেমে পড়ে সরঞ্জাম হাতে আমাদের খাবারের যোগান দিতে। অভাবের সংসারে এই পান্তা “মাল্টি টাস্কিং ” এর কাজ করে। শরীর ঠাণ্ডা রাখে ও ক্লান্তি দূর করে। অ্যাসিডিটির নিরাময় করতে সাহায্য করে। স্তন্যপান করানো মায়েদের দুগ্ধ উৎপাদনে সাহায্য করে, আলসার রোগীদের জন্য খুব ভাল। কোষ্ঠকাঠিন্য কমানো, সোডিয়াম এই ভাতে কম থাকায় রক্তচাপে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এছাড়া রিহাইড্রেশনে সহায়তা করে। এতে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রণের মত উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে, সিরাম কোলেস্টরল কমাতে সাহায্য করে, হজম শক্তির জন্য দারুণ এবং শরীরে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে।
“পান্তা খেয়ে শান্ত শরীর কাপড় দিয়ে গায়
গরু চরাতে পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে যায়।”
শুধু তাই ই নয়, এটি কোলজেন তৈরিতে সাহায্য করে ফলতঃ ত্বকের ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করায় ত্বক মসৃণ, টানটান ও উজ্জ্বল দেখায়।
পান্তাভাতকে কি আর সাধে তাই বলা হয় ‘বিউটি সিক্রেট অফ এশিয়া’!
জ্বালানি বাঁচিয়ে, অভাবের সংসারে, শরীরকে পুষ্টি জোগাতে এই সামান্য খাদ্য খেয়েই তাদের পুষিয়ে নিতে হয় নানাদিকগুলো। আর পেঁয়াজ, লঙ্কার সঙ্গে সঙ্গত হিসেবে যদি একটু ডালের বড়া ভাগ্যে জুটে যায় তাহলে তো কথাই নেই। তাই তো চন্ডীমঙ্গল এ কবি লিখেছেন ফুল্লরার দুঃখের কথা যখন সে চৈত্রের প্রচন্ড খরায় অভাবে পাথরবাটি পর্যন্ত বাঁধা দিতে হয়
“দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান ।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।”
দরিদ্র গ্রামীণ এই খাবারটি কিন্তু আমরা মা দুর্গাকেও ভোগ দিয়ে থাকি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় আমাদের আঞ্চলিক এবং মরশুমি খাবারগুলোই কিন্তু দেবদেবীদের খেতে দেই। ঋতু অনুযায়ী আমরাই যেন কিছুটা ঠিক করে নেই দেবদেবীর ভালো লাগা খাবারগুলো। যেমন তাল ও জন্মাষ্টমীর সময় মিলে যায়। তাই গোপালকে তালের বড়া নিবেদন করি, সরস্বতী র জন্য কুল , লক্ষ্মীর আখ বা বাতাবিলেবু এবং অঞ্চলভেদে প্রসাদের নমুনাও পাল্টাতে থাকে।
এবারে আসি পান্তার কথায়। জৌলুসহীন এই গ্রামীণ খাবারটি জীবনধারণের জন্য অবিচ্ছেদ্য পদ গরীবের। বাংলার মানুষেরা সেই খাদ্যের মানের বিচার আচার না করে নিজেরা যেভাবে খেয়ে থাকে মাকেও সেভাবেই এই খাবারটি নিবেদন করতে ভালবাসে এবং ধীরে ধীরে মায়ের ভোগের এক বিশেষ পদ হিসেবে জায়গা করে নেয়।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জল ঢালা ভাতকে বলে হয় পোষ্টাই ভাত। সেখানে মাকে পান্তার সঙ্গে কচুশাক ভোগে দেওয়া হয়। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়িতেও দশমীতে মাকে দেওয়া হয় পান্তার সঙ্গে কচুশাক। কোথাও আবার সরস্বতী পুজোর দিন শীতল ষষ্ঠীতে পান্তা ও গোটা সেদ্ধর প্রচলন রয়েছে। গ্রাম বাংলায় মনসা পুজোতেও পান্তাভাত দেওয়া হয়। জমশেরপুরের বাগচিদের বাড়িতে একচালার কনকদুর্গা পুজোয় পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাইয়ে মাকে বিদায় দেন। বালুরঘাটের গৌরি পাল বাড়ির পুজোয় নবমী ও দশমীর ভোগে পান্তা ও তার সঙ্গে বোয়াল মাছ এবং রাইখোর মাছ ভোগ দেওয়া হয়। আগরপাড়াতে ছাতাপাড়া বাঁড়ুজ্যে বাড়িতে মাকে কাঁধে করে বিসর্জনে নিয়ে যাওয়ার আগে খেতে হয় পান্তা। শান্তিপুরে বৈষ্ণব ও শাক্তের মিলনক্ষেত্র হল মৈত্র বাড়ি। তিনদিন নানা পদে ভোগ দেওয়া হলেও দশমীতে কচু শাক ও চালতার টক সহ পান্তা ভোগ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। উত্তর হাওড়ার সালিখা হাউস এর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে পুজোকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন গীতিকার সুরকার পুলক বন্দোপাধ্যায়। ভোগের নানারকম পদ থাকলেও দশমীতে কিন্তু পান্তা মাস্ট। আর সঙ্গত হিসেবে থাকে চালতা দিয়ে মুসুর ডাল, ছাঁচি কুমড়োর চচ্চড়ি, কচুশাক ও ল্যাটা মাছ পোড়া। প্রায় চারশো বছর পুরোনো মধ্য হাওড়ার ২৪ নম্বর কালি ব্যানার্জি লেনে মহালয়ার পরের দিন নিরামিষ খান বাড়ির সদস্যরা এবং সেটা চলে দশমী পর্যন্ত পান্তা ও কচুশাক দিয়ে ইতি টেনে।
তাই যে কোন পুজোর ভোগ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করলে দেখা যায় সমকালীন সবজি, ফল বা ফসল দিয়ে নিবেদন করার মাধ্যমে ফুটে ওঠে সেই জায়গার জল, মাটির গল্প। সভ্যতার আদিম যুগ থেকে মানুষের প্রধান ছিল কৃষিকাজ। শস্য ও সন্তান কামনায় প্রার্থনা শুরু হয় মাতৃ উপাসনা। পরবর্তীকালে দেবী পূজিত হন শক্তি ও শৌর্য এর প্রতীক হিসেবেও।
আমরা যদি নবপত্রিকার বিষয়ে বিশ্লেষণ করি, সেখানে দেখতে পাই যে নবপত্রিকা তৈরি হয় নয়টি গাছের সমন্বয়ে – কলা, ধান, কচু হলুদ, জয়ন্তী, ডালিম, মানকচু, বেল, অশোক।
রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ।
অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।
ফলতঃ এখানেও লক্ষ্য করলে দেখা যায় নদীমাতৃক কৃষিজীবী বাঙালির মাটি, শস্য ও গ্রামীণ উপাচার ঘিরেই কিন্তু মাতৃপুজা।
পুরাণে আমরা পাই দুর্গম অসুরের হাত থেকে মুনি, ঋষি দেবতাদের রক্ষা করার জন্য দেবী বিন্ধ্যাচলে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কঠোর তপস্যাবলে দুর্গম বর পেয়েছিল, কোনও পুরুষের হাতে তার মৃত্যু হবে না। ব্রহ্মা তপস্যায় সন্তুষ্ট হলে সে বর চায় যে সে বেদকে নিজের অধিকারে যাতে আনতে পারে। এই বর পাওয়ার ফলে দুর্গম স্বর্গ মর্ত্যে যাগযজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাতে শুরু করল। যজ্ঞধুমের অভাবে আকাশে মেঘের সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনাবৃষ্টি ও খরায় শাক সবজি, ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে দেবদেবীরা শরণাপন্ন হন দেবী আদ্যাশক্তির। শিবের শরীর থেকে পদ্মসীনা, চতুর্ভূজা এক অপরূপ দেবী আবির্ভূতা হলেন। তাঁর সারা শরীরে একশত চক্ষু ফুটে উঠল। শত চক্ষু দিয়ে সাতদিন ধরে অনবরত বারিধারা ঝরতে লাগল। মাটি হয়ে উঠল সরস। দেবী শতাক্ষি নামে ভক্তদের হৃদয়ে স্থান করে নিলেন। তিনি চারটি হাতে ধারণ করলেন ধনুর্বান, পদ্ম, দশ রকমের শাক – কন্দ ও ফলমূল। পদ্মের বীজ জলধারায় পড়ে পদ্মের কানন সৃষ্টি হল। আর হাতের শাকসবজি মাটিতে পড়ে জন্ম নিতে লাগল ফসল। শস্য সম্ভারে ধরিত্রী আবারো সবুজ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল এবং দেবীর আরেক নাম হল __ শাকম্ভরী। পরিশেষে তিনি দুর্গমকে পরাস্ত করেন। তাই এখানেও দেখতে পাই যে যুগে যুগে আমরা খাদ্যশস্যের আর্তিতে বারেবারে প্রার্থনা বা পুজো করেছি দেব দেবীদের। তাঁদের বিশেষ দিনগুলোতে চেষ্টা করি শুদ্ধাচারে কিছু ভোগ নিবেদন করতে। এতে আমরা পাই এক নির্মল আনন্দ ও তৃপ্তি।
দেবী দুর্গাকেও এই চারদিন নানারকম ভোগ সাজিয়ে দেই, যেমন ফলমূল, ভাত, পোলাও, ছানার ডালনা, শুক্তো, খিচুড়ি, ফুলকপির তরকারি, পটলের দোলমা, লাবড়া, চাটনি, পায়েস, ভাজা ইত্যাদি। অনেক জায়গায় আবার আমিষ ভোগ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। এবং নদীমাতৃক বাংলায় আমিষ পদে অবশ্যই থাকে বিশেষ কিছু মাছ।
তবে মজার একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করি আমরা এই জায়গায় কিন্তু এখনও প্রবেশ ঘটায়নি পিৎজা, পাস্তা, নুডুলস, চানাচুর কিংবা চিলি পনিরের। আসলে কিছু আবেগ, আচার, ঐতিহ্য অপরিবর্তন রেখেই আমরা ভালবাসি চলতে।
ফিরে আসি আবারো পান্তা প্রসঙ্গে। বলা হয়, সেদিন যেহেতু সবার মন থাকে ভরাক্রান্ত তাই আগের দিন কিছুটা খাবার তৈরি করে রাখা হয় এবং সেটার কথা ভেবেই সেদিন রাখা হয় পান্তা ভাত। সঙ্গে থাকে সাধারণ কিছু পদ। এটাই ধীরে ধীরে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে অনেক জায়গায় এবং অনেক বনেদি বাড়িতে দশমীতে ভোগের জায়গা পোক্ত করে নেয় পান্তা।
পান্তা কিন্তু বৈষ্ণবরা রাধা গোবিন্দকেও দেয়। সেই সঙ্গে থাকে দই, চিনি, কলমিশাক ভাজা, বড়া, বাটা ও নানা নিরামিষ পদ।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যে পান্তার কথা উল্লেখ রয়েছে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ধনী গরীব, জমিদার কৃষক, বণিক ব্যাধ অর্থাৎ নানা শ্রেণীর মানুষদের কথা তাঁর কাব্যে তুলে ধরেছেন যেখানে আঞ্চলিক বহু খাবারের কথাও উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে পান্তা ” একশ্বাসে তিন হান্ডি আমানি (পান্তা ভাতের জল) উজাড়ে।”
শান্তিপুরে বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোয় দশমীতে পান্তার সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছের টক। পাবনা, চট্টগ্রামে অনেক পুজো বাড়িতে জোড়া ইলিশ, আখের গুড়, তেঁতুলের ক্বাথ দিয়ে বানায় পদ্মের নালের টক। আর খুলনা, বিক্রমপুরে রান্না হয় শাপলা নালের টক। মুখার্জি বাড়িতে দশমীতে পান্তার সঙ্গে দেওয়া হয় মাছ পোড়া, কচু ঘন্ট এবং চালতার অম্বল। তাছাড়া যাবার সময় মাকে পুঁটুলি করে দেওয়া হয় খই, দই, মুড়কি, চিড়ে যাতে রাস্তায় কোনো অসুবিধে না হয় খাবারের এবং যাত্রার সময় পান খাইয়ে তবেই বিদায় জানানো হয়।
এভাবেই চলে আসছে প্রথা। আবারো শেষ করব পৌরাণিক গল্প দিয়ে। শরৎ ও বসন্ত এই দুই ঋতুতে দেবী শাকম্ভরী ও মহিষাসুরমর্দিনী পুজো হয়। শাকম্ভরীর কথা আগে উল্লেখ করেছি। এছাড়া কথিত যে মহিষাসুরমর্দিনী বলতে মহিষ অর্থাৎ বন্য প্রাণী এবং অসুর অনাবৃষ্টি এই দুই এর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, সেই মাকে পূজিত করা হয় মহিষাসুরমর্দিনী রূপে। অনেকেই এই উৎসবকে বাঙালির নবান্ন বা নতুন ফসলের উৎসব বলে মনে করেন। সব মিলিয়ে ভোগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে দুর্গাপুজোয়, যার মধ্যে গ্রামবাংলার সাদামাটা পানসে পান্তাও অন্যতম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন