bibidho-tumi-jamini-ami-shoshi-hey

তুমি যামিনী আমি শশী হে
রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়


‘ও বাবা, কী জোর বৃষ্টি নামল রে!’ ঠাকুর ঘরের জানলা বন্ধ করতে করতে বললেন শশীবালা। ‘অ পুঁটি, দেখ না মা শোবার ঘরের জানলা দিয়ে জল আসছে কিনা। হতচ্ছাড়া বৃষ্টি নামার আর সময় পেলো না!’
‘ওগো শুনছ? দোকানে যাবে বলেছিলে না? বৃষ্টি মাথায় করে এখন যেতে হবে না। পরে যেও।’
ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে জোর গলায় বললেন শশীবালা, যাতে কর্তার কানে যায়। কোনও জবাব এল না দেখে গুটিগুটি ঘরে গেলেন তিনি। দেখলেন যামিনী ঝুলবারান্দায়।
‘কী গো, কথা বলছি, উত্তর দিচ্ছ না যে? এখন আর বেরিও না, বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হলে তখন যেও। চা যেটুকু আছে এখনও দুদিন চলে যাবে। জিনিস থাকতে থাকতেই বলি আমি।’
কম কথার মানুষ যামিনী মুখুজ্যে শুধু বললেন, ‘আনা হয়ে গেছে।’
অবাক চোখে স্বামীর দিকে খানিক তাকিয়ে গজগজ করতে করতে ঘরের দিকে গেলেন শশীবালা। ‘অনেক তেএঁটে দেখেছি, এমনটা জীবনে দেখিনি।’ ঘরে ঢুকে দেখলেন গোল টেবিলের ওপর চায়ের প্যাকেটটা বসানো।

ফরিদপুরের যামিনী মুখার্জী আর খুলনার শশীবালা গাঙ্গুলীর বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে। শশীবালার বাবা ছিলেন যামিনীর বড় মামার বন্ধু। সম্বন্ধটা সেখান থেকেই হয়েছিল। যামিনী তখন চব্বিশ আর শশীবালা ষোলো।
যামিনীর বড় মামা অচ্যুতকে শশীবালার বাবা অনন্ত বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ে বলে বলছি না অচ্যুত, ও কিন্তু খুবই বুদ্ধিমতী। যেখানেই যাক, ঠিক নিজের মতো করে খাপ খাইয়ে নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি কেবল ভালো একটা পরিবারের খোঁজে ছিলাম। তোমার বোনপো যখন, তখন আশা করি শশী আমার ভালো থাকবে।’
অচ্যুত আশ্বাস দিয়েছিলেন বন্ধুকে, ‘আমার দিদি জামাইবাবু খুবই ভালো মানুষ। যামিনী আর কামিনী – দুই ভাই। কামিনীর বিয়ে হয়ে গেছে। সে সস্ত্রীক ঢাকায় থাকে।’

বিয়ের পর বছর দুই ফরিদপুরে শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন শশীবালা। তারপর যামিনী মুখুজ্যে বর্ধমানে চাকরি নিয়ে চলে আসেন। সেখানেই থেকে গেছেন পঁয়ত্রিশ বছর। যামিনী আর শশীবালার এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সে দিল্লিতে থাকে। তার তিন বছরের একটি ছেলে। ছেলে ধ্রুব মেয়ের থেকে ছ’বছরের ছোট।
যামিনীবাবু মানুষ খারাপ নন। শান্ত স্বভাব, খিটখিট গিজগিজ নেই। খাওয়াদাওয়া নিয়েও বিশাল কিছু খুঁতখুঁতুনি নেই। কিপটে নন, প্রয়োজনে খরচ করেন। সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছেন। এসব নিয়েই তো গিন্নিদের অভিযোগ থাকে। তাহলে বলা যেতে পারে, যামিনী মুখার্জী একজন দোষহীন মানুষ, তাই তো?

এক বাটি দুধে এক ফোঁটা চোনার মতো যামিনীর চরিত্রেও একখানি খুঁত আছে। মহিলাদের বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর ওঁর তেমন আস্থা নেই। এই কারণেই শশীবালার পরামর্শ কানে তোলেন না বিশেষ। চুপচাপ থাকেন, তাই দক্ষযজ্ঞ বাধে না।

শশীবালা বিয়ের পরপর ব্যাপারটা বুঝতেন না। একে তো বয়েস কম ছিল তার ওপর সংসার, ছেলেপিলে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকতেন। ওনার কোন কথাটা কর্তামশাই শুনলেন আর কোনটা শুনলেন না, সে নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসত পেতেন না। ক্রমে বয়েস বাড়ল, সাংসারিক অভিজ্ঞতা বাড়ল, শশীবালা বুঝলেন তাঁর শান্তশিষ্ট পতিদেব আসলে তার বুদ্ধির ওপর ভরসা করেন না তাই, পরামর্শও গ্রাহ্য করেন না। যামিনীর স্বভাবের একটা মোক্ষম দিক আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন শশীবালা। সে সব ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে শশীবালা বুদ্ধিমতী। এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে গেলেন না তিনি। কিছু কিছু ব্যাপারে এমন প্যাঁচ কষলেন, যাতে কত্তামশাই নড়াচড়া না করতে পারেন।

বাথরুমের দিকের জানলাটা অপেক্ষাকৃত পলকা। শশীবালা কথাটা যামিনীর কানে দিয়েছিলেন। যথারীতি চুপ থেকে তিনি বিষয়টা ঝেড়ে ফেলেছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন, চোরের খেয়ে কাজ নেই, এত দরজা জানলা থাকতে ওই হাফ জানলা গলে ঢুকবে। এমন তো নয় জানলাটা হাঁ করা৷ শিক তো আছে।
এক রাতে প্যাঁক করে হাঁস ডাকার শব্দে ঘুম ভাঙে যামিনীর। চোখ খুলে দেখেন ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক। এত রাতে হাঁস ডাকল কোত্থেকে! আশপাশে তো কারোর হাঁস নেই! এটুকু ভাবতে ভাবতেই ‘কে’ বলে চিৎকার করে উঠেছেন তিনি। আর তাতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছেন শশীবালা। ছেলে ধ্রুবও বেরিয়ে এসেছে তার ঘর থেকে।
শশীবালা কোনও কথা না বলে সোজা বাথরুমের দিকে গেলেন। যামিনী গিন্নির পেছন পেছন পৌঁছে দেখলেন বাথরুমের জানলার শিক ব্যাঁকানো। হৃদপিন্ড ছুটতে শুরু করল তাঁর। জানলার নীচে তখন নাতির জন্যে রাখা খেলনা রবারের প্যাঁকপ্যাঁক হাঁস।
ওই জানলা নিয়ে বহুদিনই আতঙ্কিত ছিলেন শশীবালা। কিন্তু যামিনী পাত্তা দিচ্ছিলেন না বলে উনি নিজের বুদ্ধিমতো নাতির খেলনাটা জানলার নীচে রেখে দিয়েছিলেন। চোরের পা যেই পড়েছে ওমনি রবারের হাঁস প্যাঁক করে উঠে জানান দিয়েছে। ধ্রুব বলেই বসল, ‘বাবা, যাই বলো, মায়ের কিন্তু ফাটাফাটি বুদ্ধি! এবার জানলাটায় গ্রিল বসিয়ে নাও।’ আঁতে বড় লাগল যামিনী মুকুজ্যের।
ততদিনে শশীবালা বুঝে গেছেন, তিনি যা বলবেন, কর্তামশাই তার উল্টোটি করবেন। মনে মনে হেসেছিলেন শশীবালা।

ইদানীং ঘন ঘন তেষ্টা পাচ্ছে যামিনীর। বাথরুমে যাওয়াও বেড়েছে। শশীবালার নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা। রাতে খাবার পরে একটা মিষ্টি খাওয়া বরাবরের অভ্যেস যামিনীর। নোনতার থেকে মিষ্টিটাই তার বেশি পছন্দের।
শেষপাতে একখানা কালাকাঁদ কর্তার পাতে দিয়ে শশীবালা বললেন, ‘বারবার বাথরুমে যাচ্ছ, ডায়বেটিস হয়নি তো? তোমার মায়ের তো ছিল। একবার ডাক্তার দেখিয়ে নাও।’
‘আরে ধুৎ, তোমার যত অলুক্ষুণে কথা! ডায়াবেটিস হতে যাবে কেন? জল বেশি খাচ্ছি তাই বাথরুম বেশি যাচ্ছি।’ কালাকাঁদে কামড় দিয়ে বললেন যামিনী।
শারীরিক অস্বস্তি বাড়তে থাকায় পাড়ার বয়স্ক ডাক্তারবাবু প্রণব বোসের কাছে নিজে থেকেই গেলেন যামিনী এবং সেটা অবশ্যই গিন্নির অজান্তে। পরীক্ষা করতে দিলেন ডক্টর বোস। ফলাফল সুবিধের এল না। রক্তে বাড়াবাড়ি রকমের চিনি।

বাড়িতে জানাতেই হবে, লুকোবার কোনও উপায় নেই। নিরামিষ রান্নায় যেটুকু চিনি পড়ে তাও বাদ দিতে বলেছেন ডাক্তারবাবু। এ ভারি ঝকমারি হল!
‘কী, বলেছিলাম না, আমার কথা তো গ্রাহ্যির মধ্যে আনো না। এখন হল তো?’
‘তুমি খুশি তো? এটাই তো চেয়েছিলে। আমার পছন্দের খাওয়াগুলো বন্ধ হয়ে যাক। এবার দুহাত তুলে ধেই ধেই নৃত্য করো, আর কি!’

মায়া হল শশীবালার। আহা রে, লোকটা মনের কষ্ট থেকেই এসব বলছে। সত্যিই তো, কত কিছু খাওয়া বারণ হয়ে গেল! রাতে খাবার পর অভ্যেসমতো মিষ্টির অপেক্ষায় ছিলেন যামিনী।
‘উঠে হাত ধুয়ে নাও।’ গিন্নির গলা কানে যেতেই রোগের কথা মনে পড়ে গেল তার। মুখ চুন করে উঠে পড়লেন। হাত মুখ ধুয়ে ঝোলানো তোয়ালেতে হাত মুছে ঘরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই শশীবালা বললেন, ‘নাও, এই দিয়েই মিষ্টিমুখ করো।’
বাঁ হাতে একটা হোমিওপ্যাথির শিশি, ডান হাতে তার মুটকিতে কয়েকটা গুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শশীবালা। ‘এ আবার কী?’ বিস্মিত প্রশ্ন যামিনীর।
‘আরে বাবা বিষ দিচ্ছি না, খাও না, মুখটা মিষ্টি হবে আবার ভালো ঘুমও হবে। খেয়ে দেখ।’ বিস্ময়াবিষ্ট যামিনী কলের পুতুলের মতো গুলিগুলো চালান করলেন মুখে।
‘চুষে চুষে খাও, কামড়িও না। তাহলে মিষ্টি ভাবটা বেশিক্ষণ থাকবে।’ শলা দিলেন শশীবালা।
‘মা কিন্তু গুরুদেব লোক, বলো বাবা?’ ধ্রুবর খোঁচা হজম করে নিলেন যামিনী।
কেবল বললেন, ‘মা আবার লোক হয় কী করে?’ আড়চোখে দেখলেন, মা বেটায় হাসছে।

বিসিএ শেষ করে চাকরি করছিল ধ্রুব। এমসিএ করার ইচ্ছে নেই। মনের সাধ, কম্পিউটার পার্টসের ব্যবসা করবে। লোন পেতে অসুবিধে হবে না। সমস্যা কেবল জায়গার। বাড়ির পাশেই একটা দশ বাই দশ ফুটের ঘর আছে। কোনো এক কালে ওই ঘরে শোনপাপড়ি তৈরি হত। তারপর দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিত। মালিক মারা যাবার পর তার ছেলে আর ওই ব্যবসায় আসেনি। ঘরটা তালা দেওয়াই পড়ে আছে।
ধ্রুবর ইচ্ছে সেই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে ঘরটা যদি নেওয়া যায়। আপাতত ভাড়া নেওয়া, পরবর্তীতে ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে কেনার কথা পাড়া যাবে। বিষয়টা বাবাকে বলার সাহস হচ্ছে না ধ্রুবর। ব্যবসায় আপত্তি আছে বাবার।

মাকে ধরে পড়ে ধ্রুব, ‘ও মা, তুমি একবার বলো না বাবাকে। আমি কথা দিচ্ছি, বছর দুয়েকের ভেতরেই আমি ব্যবসা দাঁড় করিয়ে ফেলব।’
‘তুই তো জানিস বাবা, আমি যা বলি, তোর বাবা তার উল্টোটা করে।’
‘তোমার খুব বুদ্ধি, তুমি কিছু না কিছু উপায় বের করবে ঠিক। ও মা, মা গো, দেখ না।’ এরপর মা-ছেলেতে শলা পরামর্শ হল। কী হল, তা জানা গেল না।

খাবার টেবিলে বসে ধ্রুব বলল, ‘বাবা, আমি ঠিক করেছি কম্পিউটার পার্টসের ব্যবসা করব। এখন সবথেকে ভালো ব্যবসা এটাই। ঘরে ঘরে কম্পিউটার।’
‘ঠিক যখন করে নিয়েছ, তবে করো।’
‘একটা দোকান ঘর দরকার বাবা। বলছিলাম কি, পাশের ওই নবীনের ঘরটা ভাড়া নিলে হয় না? পরে না হয়…।’
‘পাগল হলি না কী রে ধ্রুব! কত পুরনো ঘর, সারাতেই তোর কোমর খুলে যাবে। দেওয়ালে ড্যাম্প, মেঝে খারাপ। ও ঘর নিয়ে তোর লাভ হবে না।’ আসরে শশীবালা।
‘না না, তুমি যতটা বলছ ততটা খারাপ নয় মা ঘরটা। সব থেকে বড় কথা, সস্তায় পাব তো। নবীন ছেলেটা অত ঘোড়েল নয়। কম ভাড়ায় দিয়ে দেবে।’
‘সস্তার তিন অবস্থা, জানিস তো কথাটা। নিয়ে ফেঁসে যাবি তারপর। আমি তো বলি বাপু, দরকার নেই। তুই বরং চাকরিই কর।’ শশীবালা নাছোড়বান্দা।
‘নবীনকে যোগাযোগ কর, আসতে বল একদিন। কথা বলি। তুই যে ব্যবসার করার কথা ভাবছিস, আজকালকার দিনে তার মার নেই।’ যামিনী মুখুজ্যে রায় দেন।
কপট রাগ দেখান শশীবালা, ‘হ্যাঁ, রাজি তো হবেই, আমি না করেছি কি না। সত্যি বাবা, সারাটা জীবন শুধু উলটো গানই গেয়ে গেল মানুষটা।’

ধ্রুবর কাজ হয়ে গেল। রাত্রে বাবাকে এড়িয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ধ্রুব বলে গেল, ‘তুমি অনন্যা মা গো। এত সহজে কাজ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।’
ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে তখন চুল আঁচড়াচ্ছিলেন শশীবালা, গুনগুন করে গাইছিলেন, ‘তুমি যামিনী, আমি শশী হে…’।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “bibidho-tumi-jamini-ami-shoshi-hey

  1. যামিনী আর শশীকলার খুব সুন্দর গল্প। সার্থক নামকরণ।

  2. যামিনী ও শশী দুইয়ে মিলে রম্যরচনাটা দুর্দান্ত দাঁড়িয়ে গেছে দিদি। শুধু হাসলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *