Rannaghor – Ish Ilish

ইস! ইলিশ

(পাঞ্চালি দত্ত)

দেশভাগের পর বাবা শিলচরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও কিছুতেই ভুলতে পারেন নি তার সাধের সোনার বাংলাকে। নানা গল্পের মাধ্যমে চলেই আসত ওপারের কথা। আর তার মধ্যে একটি বিশাল জায়গা ছিল খাবার দাবার নিয়ে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই চলে আসতো রুপোলি শস্যের গপ্পো অর্থাৎ ইলিশ মাছ। তখনো দেশ ভাগ হয়নি। পদ্মানদীর ওপারে যেহেতু যেতে বেশ সময় লাগত, তাই নদীর এপারে সবাই রেস্তোরাঁয় পেট ভরে খেয়ে নিতেন। কিন্তু একটা রেস্তরাঁ র ইলিশ মাছের মেনুটি ছিল অদ্ভুত ধরনের। যেমন, ভাত ও ইলিশ ঝোল এবং ভাত ও ইলিশ (চোখে চাখা) । অতএব, এক ভদ্রলোক পকেট সাশ্রয় করতে অর্ডার করলেন দ্বিতীয়টি। খাবার পর যখন বিল মেটাতে গেলেন, দেখলেন তার চোখে চাখা অর্থাৎ পাতের কোনে যে ইলিশের টুকরোটি থাকবে, কিন্তু খাওয়া চলবে না – সেটির দাম ইলিশ ঝোলের চাইতে বেশি। ভদ্রলোকের চোখ কপালে। খেলেন ও না, অথচ বিল মেটাতে হবে কিনা যারা মাছটি উদরস্থ করছেন তাদের চাইতেও বেশি? হোটেলের মালিককে রেগেমেগে জিজ্ঞেস করতে , তিনি চুপিচুপি কানের পাশে এসে বললেন – ‘ কেউ দ্যাখে নাই, আমি দ্যাখছি। তুই যে ইলিশটারে চোষ ছোষ ।’ এই না হল ইলিশ! তাকে যেভাবেই , যেকোনো প্লেট, কাঁসা, পেতল, স্টিল , মাটির বাসনেই রাখা হোক না কেন, সে তার আভিজাত্য কে এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতে দেয় না। ইলিশ এমনই এক মাছ যাকে নিয়ে লেখক, কবি, গীতিকার কেউ বাদ নেই যে তাকে আলোচনার টেবিলে তোলেননি। এপার ওপারের ইলিশের স্বাদ নিয়ে কমলকুমার মজুমদারের উক্তি ” গঙ্গার ইলিশ একশো দেড়শো বছর ধরে কোম্পানির তেল খেয়েছে, পদ্মার ইলিশ তার সঙ্গে পাল্লা দেবে কেমন করে?” 

স্বামী বিবেকানন্দও ইলিশপ্রীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। এতটাই ইলিশ ভক্ত ছিলেন যে মৃত্যুর কয়েক্ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ দুপুরের ভোজনে খেয়েছিলেন ইলিশ মাছ ভাজা সঙ্গে ইলিশের তেল, ভাত, ইলিশ ঝোল ও অম্বল। শিষ্য ব্রজেন আবার পদ্মার ইলিশের সাইজ বড় বলাতে স্বামীজি মজা করে বলেছিলেন গঙ্গার ইলিশের মতন স্বাদ ওই ইলিশের হয় না। যতীন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য ,” পূর্ববঙ্গের ইলিশে তেল বেশি, আর কলকাতার ইলিশের সুগন্ধ বেশি ।” আবার ইস্টবেঙ্গল যেদিন মোহনবাগানকে হারিয়ে দিত, সেদিন ইলিশের নাকি স্বাদ বেড়ে যেত বহুগুণ। পকেটের চিন্তা ঝেড়ে হাতে করে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হতো গোটা ইলিশ। উদ্দেশ্য একটাই – মোহনবাগান সাপোর্টার পড়শীকে কাটা ঘায়ে নুন ছেটানো। আবার সেটার শোধবোধ হত ঠিক উল্টোটা ঘটলে। এবং তখন ইলিশ থিম পাল্টে চলে আসত চিংড়ি । ভানু বন্দপাধ্যায়ের ছবিতেও কত কাণ্ড এই ইলিশ নিয়ে। ‘ মোহনবাগানের মেয়ে ‘ ছবিতে খেলা শেষে গন্ডগোল ও ইলিশ চিংড়ির দাম বেড়ে যাওয়া , গান, গল্পঃ, হই হই, রৈ রৈ করে চলতো টান টান উত্তেজনা। কিন্তু বর্তমানে সব দ্বন্দ্ব, বাদানুবাদ, খুনসুটির অবসান ঘটিয়ে আমরা এক কেজি ইলিশ কিংবা তারও কম ওজনের ইলিশ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। পাশাপাশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সেই দামের সঙ্গে এবং ইলিশমাছকে পাশ কাটিয়ে অন্য মাছ ব্যাগে পুরে বাড়ি ফিরতে। কড়াইতে মাছ ছাড়লে নেই পাড়া জুড়ানো গন্ধ, নেই হাতে লাগা সেই মনমাতানো গন্ধ। কাঁচা লঙ্কা ও ইলিশের মধ্যে একটা দারুন সম্পর্ক রয়েছে। এবং সেটা আমরা জানিও যে কাঁচা লঙ্কা ছাড়া ইলিশ মাছ রান্না ঠিক জমে না। আর তাদের দুজনের যোগসূত্রটি নিয়ে একটা চমৎকার ছড়া বাঁধা হয়েছিল … ‘তুমি থাক জলে/আমি থাকি ডালে/দেখা হবে দুজনায়/মরণের কালে।’ মানে গাছের লঙ্কা, জলের ইলিশমাছকে উদ্দেশ্য করে বলছে যে, দুজনের মরণের সময়, মানে একমাত্র রান্নার সময়েই তাদের দেখা হবে— তার আগে নয়। ইলিশের খবর নিতে ছুটে গিয়েছিলাম ক্যানিং এর আড়তে এবং বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত বসিরহাটের ঘোজাডাঙা আড়তে । আগে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত ইলিশ এই আড়তে আসত, কিন্তু বাংলাদেশের কয়েকবছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে পদ্মার ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কীর্তনখোলা, বালেশ্বর, রূপসা, আড়িয়াল খান নদীর মাছই সাধারণত পাওয়া যায়। কিছু থাকে দীঘার ইলিশও। নাহ, ইলিশ নিয়ে বেশিক্ষণ না বাচক বা দীর্ঘশ্বাস ফেলা মানায় না। তবে আশা করছি সরকার এটা নিয়ে কিছু ভাবলে , যেমন ইলিশের ব্রিডিং এর সময়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া, ছোট ইলিশকে ধরা বারণ এবং আরও কিছু বৈজ্ঞানিক উপায়ে এদের রক্ষণাবেক্ষণের উপায় নিয়ে এগিয়ে চললে ইলিশকে নিয়ে এতটা দু:চিন্তার কারণ নেই আমাদের। কিছু ইলিশ চাষ করা হচ্ছে। তবে সেটা কি আর সেই স্বাদকে ছোঁয়াতে পারবে আমাদের রসনায়? যাইহোক, চাইব আবারো আগের মত ইলিশ নিয়ে নানা মতামত, বিবাদের ঝড় উঠুক চায়ের টেবিলে, মোড়ের আড্ডায় । তবে আপাতত মজার কথা হল, বাঙাল ঘটি কিন্তু এখন দুপক্ষই গলা জড়িয়ে ইলিশ চিংড়ি খায় চুটিয়ে। নর্থ কলকাতার বনেদি বাড়িতে তৈরি হয় নানা স্বাদের ইলিশ। অনেকের বাড়িতে আবার রথের দিন জোড়া ইলিশ আনার রেওয়াজ রয়েছে। আবার কেউ কেউ বিজয়া দশমীর দিন বছরের শেষ ইলিশ খেয়ে থাকেন। বনেদিবাড়ি, যেমন রামকৃষ্ণ মিত্র বাড়িতে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে রান্না পুজোয় ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে খেয়ে ইতি টানা হয় বছরকার মত। এই রূপোলী শস্য নিয়ে কত আদিখ্যেতা , রূপকথা ও নিয়ম। একবার ইলিশের মরশুমে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সারা রাজ্য জুড়ে শুধু ইলিশের গল্প শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে একটু ইলিশের গল্পের টেস্ট টা পাল্টাতে চাইলেন এবং তলব পড়লো গোপাল ভাঁড়ের। তাকে আদেশ করা হল বাজার থেকে ইলিশ মাছ কিনে ও সেটা ঝুলিয়ে রাজার কাছে আসতে হবে। কিন্তু রাস্তায় কেউ ইলিশ নিয়ে কোনো কথা গোপাল ভাঁড় কে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না। তারপরের গল্পতো আমাদের সবার জানা। অনেক গল্প, গাঁথা , স্মৃতি ঘিরে আছে এই মাছটিকে নিয়ে। পরিশেষে আপনাদের পাতে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই – সমুদ্রের গভীর জল থেকে উঠে আসা ইলিশ যখন মিষ্টি নদীর জলে মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত, তারপর সন্তান সম্ভবনা, ও মাতৃত্ব লাভের আস্বাদ পায়, এই সবকিছু মিলিয়ে ইলিশমাছের মধ্যে কি আমরা কামনার গন্ধ খুঁজে পাই!!! তবে হ্যাঁ, ইলিমাছের এক একটা আইটেমের প্রেম -ভালোবাসায় মজবেন না , এমন বাঙালি বোধহয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আজ তেমনি কিছু ইলিশ মাছের রেসিপি শেয়ার করছি আপনাদের সঙ্গে।

ইলিশ মালাই : ইলিশ মাছ পেটি ৬ /৮ পিস , ডাবের শাঁস বাটা ছোট ১ বাটি, পোস্ত বাটা ২ চামচ, আদার রস ১ চামচ, কাজু বাটা ১ চা চামচ, নুন, চিনি, সাদা তেল, ডাবের জল।
প্রণালি: ইলিশ হালকা ভেজে নিয়ে তুলে নিয়ে বাকি তেলে পোস্ত বাটা, কাজু বাটা, আদার রস, নুন চিনি দিয়ে ভালো করে কষিয়ে তাতে ডাবের জল দিন। ফুটে উঠলে মাছ ও ডাবের শাঁস বাটা ছাড়ুন। এবারে নামিয়ে নিন।

ইলিশ মুগ : ইলিশ ৬/৮ পিস, খালি খোলায় ভেজে ধুয়ে নেওয়া মুগডাল ছোট এক বাটি, জিরে ধনে গুঁড়ো ১ চামচ, হলুদ গুঁড়ো, নুন, চিনি, ধনেপাতা কুচি, সর্ষের তেল, চেরা কাঁচা লঙ্কা, লঙ্কা গুঁড়ো।
প্রণালি : সর্ষের তেল গরম করে তাতে সমস্ত গুঁড়ো মশলা অল্প জলে গুলে কষিয়ে নিয়ে মুগডাল দিন। এবারে জল ঢেলে আধ সেদ্ধ করুন। তারপর ইলিশ মাছ, সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দমে রাখুন কিছুক্ষণ। ইলিশ সেদ্ধ হলে গেলে ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।

আজ শেষ করছি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা দিয়ে যিনি ইলিশ মাছের নাম দিয়েছিলেন

‘ জলের রুপোলি শস্য’ ।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস শর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
হ্যাঁ, ইলিশকে যে কদিন আমরা কাছে পাই, ইলিশ উৎসবের সমারোহে ভরিয়ে ফেলি আমাদের হেঁশেল।

-সমাপ্ত-

 

1 thought on “Rannaghor – Ish Ilish

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *