ফিল্ম রিভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক
হীরালাল সেনের পরিচালনায় প্রথম বাংলা ছায়াছবি ‘বিল্বমঙ্গল’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯১৯ সালে। ২০১৯ এ শুটিং শেষ হয়ে গেলেও করোনাকাল পেরিয়ে সামান্য দেরিতে বাংলা ছবির একশো বছরকে শ্রদ্ধা জানালো অরিন্দম শীলের ছবি ‘মায়াকুমারী’।
ছবির ভেতর ছবি তৈরি, যাকে বলে film within a film, বড় সহজ কাজ নয়। গল্প, চরিত্র এবং অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, তার খুঁটিনাটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এমন ক্ষেত্রে। সেই জটিল ব্যাপারটাই মায়াকুমারীর চিত্রনাট্যের অপরিহার্য অঙ্গ। কারণ চলচ্চিত্রের একশো বছরকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শুধু যে পুরোনো দিনের ছবি তৈরির পদ্ধতি উঠে আসছে তেমন তো নয়, কারণ পরিচালকের নাম অরিন্দম শীল। গত কয়েক বছরে বাংলা থ্রিলার ছবির জগতে তিনি বেশ কিছু মনে রাখার মতো কাজ উপহার দিয়েছেন দর্শককে। তাই সিনেমার শতাব্দীও উদযাপিত হয়েছে থ্রিলারের হাত ধরেই। কারণ সেই অর্থে বাঙালির থ্রিলার চর্চাও কিছু কম দিনের নয়। সেই সাদা কলোর যুগ থেকে থ্রিলার ছবি ভালোবেসেছে বাঙালি দর্শক, তবে আজ কেন নয়?
নির্বাক ও সবাক ছবির বিখ্যাত অভিনেতা যুগল কাননকুমার ও মায়াকুমারী তথা মায়া-কানন জুটিকে নিয়ে ছবি তৈরি করতে ইচ্ছুক পরিচালক সৌমিত্র। কাননকুমারের ভূমিকায় অভিনয় করবে তারই নাতি প্রতিষ্ঠিত নায়ক আহির, এমনটা আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে। নায়িকার ভূমিকায় আহিরের পছন্দ বিজ্ঞাপনের মুখ রুনি বা অরুণাকে। কিন্তু গোটা ইউনিট নিয়ে ছায়া-শীতল নামে বাড়িটিতে শুট করতে গেলেও রুনির পক্ষে এমন একটা সেকেলে চরিত্রে অভিনয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এইখান থেকেই ছবির আসল গল্প শুরু হয়। যদিও ছবির প্রথম দৃশ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দৃশ্যের সুতোর টান চলবে ছবির শেষ অবধি।
একটা সময় ছিল যখন ছবির শুট করার পর তার পর্দার রূপ কেমন হবে তা জানতে লেগে যেত কয়েকমাস। সেখান থেকে এই ডিএসএলআর কিংবা মোবাইল ফোনে শুটের ফাস্ট ফরোয়ার্ড যুগে পাড়ি দিতে লেগে গেছে অনেকটা সময়। ছায়াছবি তৈরির প্রথম যুগের সেই সব টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট এ ছবিতে উঠে এসেছে চরিত্রদের মুখ দিয়েই। এমনভাবে গোটা ছবিতে বেশ কিছু ট্রিভিয়া ছড়ানো রয়েছে, যাকে তথ্য বলে মনে হবে না কখনোই। যাদের আহরণ করার তারা করবেন, বাকিরা উপভোগ করবেন মুহূর্তটুকু, এটাই এই ছবির মজা। ছবির বেশ কিছু জায়গায় উঠে এসেছে সুচিত্রা সেনের নাম। কারণ এ ছবির মুখ্য চরিত্র মায়াকুমারীর (ঋতুপর্ণা) চরিত্রের কিছুটা অংশে সুচিত্রার জীবনের ছাপ রয়েছে। কাজেই নানাভাবে মিসেস সেন আলোচিত হবেন সেটা স্বাভাবিক। এমনকি পুরুষ প্রধান ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম সুচিত্রাই দাপটের সঙ্গে নিজের পারিশ্রমিক বাড়িয়েছিলেন এ প্রশংসা মায়াকুমারীর মুখেই শোনা যায়। উঠে এসেছে কাননদেবীর কথাও। তবে এ ছবির পরতে পরতে রয়েছে মিসোজিনির প্রসঙ্গ, যা সেদিনের তো বটেই, এমনকি বর্তমান বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও অনেকটাই প্রযোজ্য। বাইরের দুনিয়াটা যতই পাল্টাক, ভারতীয় ছবির জগৎ এক্ষেত্রে যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে।
ছবির প্রথমার্ধ কিছুটা হালকা, স্বাভাবিকভাবেই। যে কারণে গল্পে মন বসাতে কিছুটা সময় লাগে। তবে ধীরে ধীরে কাহিনীর জটিলতা দর্শককে আকর্ষণ করতে শুরু করবে প্রথমার্ধের মাঝামাঝি জায়গা থেকে। তবে এই ছবির মূল নায়ক শুভেন্দু দাসমুন্সির চিত্রনাট্য, কাহিনীর রহস্যময় বাঁকে দর্শককে চমকে দেওয়াই যার উদ্দেশ্য। অভিনয়ের ক্ষেত্রে তিনজনের উল্লেখ করা অবশ্য প্রয়োজন। প্রথম অরুণিমা ঘোষ। সারপ্রাইজ প্যাকেজ বলে একটা কথা আছে, এ ছবিতে অরুণিমা তাই। মায়াকুমারীর চরিত্রে ঋতুপর্ণার সঙ্গে শারীরিকভাবে বিন্দুমাত্র মিল নেই অরুণিমার। অথচ তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন এই চরিত্রের জন্য তিনিই সেরা নির্বাচন।
দ্বিতীয় আবির চট্টোপাধ্যায়। যদিও তিনি অভিজ্ঞ অভিনেতা, এবং অরিন্দমের সঙ্গে এর আগে বহু ছবিতে কাজ করেছেন তবু, এ ছবিতে আবির চমকে দিয়েছেন। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চরিত্র, কাননকুমার এবং আহির। এর মধ্যেও আবার রয়েছে কাননকুমারের অভিনীত চরিত্রে রূপদান এবং আহিরের চরিত্রে তার দাদুর এবং নিজের ভূমিকায় সহজ সাবলীল আধুনিক অবতারে নিজেকে মেলে ধরা — প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন শরীরী ভাষায় মুগ্ধ করেছেন আবির। গত বছর থেকে তাঁর অভিনয়ে এক আলাদা আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে, বাংলা ছবির জন্য এ অবশ্যই সুখবর।
তৃতীয় রজতাভ দত্ত। তিনি দুর্দান্ত অভিনেতা এ কথা বাংলা ছবির দর্শক মাত্রেই জানেন। তবু বিশেষভাবে বলার কারণ এ ছবিতে তাঁর পরিসর খুবই স্বল্প, এবং জটিল। বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন রূপে হাজির হয়েছেন তিনি। কখনও এক মিনিট কখনও বা তারও কম সময়ের জন্য। সবচেয়ে লম্বা দৃশ্যেও তাঁর সংলাপ ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে যায়, ফলে তিনি পর্দায় থেকেছেন অল্পই, যদিও এ ছবির সূত্রধর যদি কেউ থেকে থাকে তবে তা রজতাভই। এত সামান্য উপস্থিতিতেও মনে দাগ কেটে যাবে তাঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি। আবেগ, বিস্ময়, অসহায়তা সব মিলিয়ে নিজের চরিত্রকে খুব অনায়াসে জ্যান্ত করে তুলেছেন তিনি। যদিও তা অপ্রত্যাশিত ছিল না মোটেও। এ ছাড়াও সৌরসেনি মৈত্র, ইন্দ্রাশিস রায়, অম্বরিশ ভট্টাচার্য, অর্ণ মুখোপাধ্যায় প্রত্যেকেই নিজেদের ছাপ রেখে গিয়েছেন।
এ ছবি নিয়ে আলোচনা করতে হলে মেকআপের প্রসঙ্গ আসা স্বাভাবিক। মেকআপ শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডুর হাতের কাজ বর্তমানে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির গর্বের বিষয়। এই ছবিতে কিছু ক্ষেত্রে প্রস্থেটিক খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে চোখে লেগেছে মেকআপের আধিক্য। তবে ঋতুপর্ণা এবং অরুণিমার বয়স্ক চেহারার মেকআপ বেশ মানানসই। শুভঙ্কর ভড়ের ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ও সময়বিশেষে বিভিন্ন কালার টোনের ব্যবহার নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। ছবির ক্রেডিট লিস্টের সঙ্গে বিরতির ঘোষনাও বেশ অভিনব, বাংলা ছবিতে কিঞ্চিৎ রসবোধ এখনও রয়ে গেছে দেখে স্বস্তি পাওয়া যায়।
সব শেষে অবশ্যই বলতে হবে গানের কথা। বিক্রম ঘোষের সুরে এই ছবিতে রয়েছে প্রায় এক ডজন গান। তার মধ্যে বেশ কিছু গানের সুর ও মেজাজ দর্শককে টেনে নিয়ে যাবে সাবেকি যুগে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে বসে স্রেফ সুরের মূর্ছনায় এই টাইম ট্র্যাভেল মনে রাখার মতোই। বেশ কিছু গান বার বার শোনা যায়। বাংলা ছবির গানে গত কয়েক বছর ধরে বিক্রম ক্রমশ নিজের জমি শক্ত করছেন।
মায়াকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে অজস্র রিসার্চ করলেও তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সৌমিত্র কেন কোনও খোঁজ করেনি তা স্পষ্ট হয় না। যদিও ছবির কাহিনীতে তার ছাপ স্বল্পই পড়েছে, তবু এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা যেতে পারতো। এরকম সামান্য কিছু অসঙ্গতি আছে ছবিতে, তবে তা উপেক্ষা করা যায় কাহিনীর কারণেই। রহস্যের কারণ হিসেবে মূল ঘটনার বর্ণনা, তার ফলাফল সবকিছু নিয়ে টান টান চিত্রনাট্যে একশো শতাংশ দিয়ে কাজ করেছেন পরিচালক ও অভিনেতারা। বড় বাজেট এবং একাধিক তারকা অভিনেতা নিয়ে মাল্টিস্টারার ছবির চল বাংলায় দিন দিন কমছে। এই দুই শর্ত পূরণ করেও এক কাল্পনিক রহস্য কাহিনীর জাল বুনতে সফল হয়েছেন পরিচালক। তাই চেনা ধাঁচের ছবির বাইরে বেরিয়ে একদম অন্যরকম কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলে ‘মায়াকুমারী’ হতাশ তো করবেই না, বরং আড়াই ঘণ্টার নির্ভেজাল বিনোদন দেবে এ কথা হলফ করেই বলা যায়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন