নন্দিতা আচার্য
সাবানের ফেনার মত পেলব এক বিষণ্ণতা আমাকে ছেয়ে ছিল। এই সেই রাজবাড়ি? হেতমপুর নামটা যেন রূপকথা থেকে উঠে এসেছে। চারদিকে পাতলা অন্ধকার নেমে আসছে। অতীতের সমস্ত অহং নিয়ে বুকে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসের মতই থমকে দাঁড়িয়ে আছে নিঃস্ব রিক্ত প্রাসাদটি।
ড্রাইভার তাড়া দেয়, দেরি হয়ে যাবে, চলুন এবার; আপনি তো এখন উষ্ণ প্রস্রবনে যাবেন। চান করবেন নাকি?
বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণে এ সময় ফ্রেশ জল থাকে। অন্ধকারে জল এবং আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কেউ কোথাও নেই; আকাশে শুধু একটি ভাঙা চাঁদ। সিঁড়ি বেয়ে জলে এসে দাঁড়ালাম, কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছিল আমার।
গতকাল দুপুরে এসেছি এই গাছ আর পাখিদের রাজ্যে। একা থাকব, কিন্তু এতবড় গেস্ট রুম হবে বুঝিনি। থার্মাল পাওয়ারের গেস্টহাউস। বড় বড় ঘর, করিডর আর ব্যালকনি জুড়ে আলোর রাশি; চারদিকে গাছ আর গাছ। আম-জাম-কুল, পলাশ-অশ্বথ-খেজুর, রঙ বেরঙের রকমারি ফুল; চোখ জুড়িয়ে যায়! কিন্তু রাতে ডিনার করে ফিরে আসার পর, এই বিশাল গেস্টরুমটায় ঢুকে আমার কেমন মন খারাপ লাগতে শুরু করে। প্রথম রাত বালিশ মাথা দিয়ে শুতে না শুতেই এক ‘হুউশ’ আওয়াজ, যেন দৈত্যর বুক থেকে বেরনো বেদনার শ্বাস; গা শিরশির করে আমার! এরই সঙ্গে রাতচরা পাখি, কুকুর, আর দূর পাল্লার ট্রেনের হুইসেল; এক অজানা জগত রহস্যের পরত খুলতে শুরু করে।
ভোরবেলা এখানে চারদিকে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে নতুন নতুন মানুষের মুখোমুখি হই, তারা কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকায়; কথা বলতে বলতে বন্ধুত্বও হয়ে যায়। একা গেস্ট হাউসে আছি শুনে ওরা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বলে, রাতে ভয় করে না? তবে এটা খুব নিরাপদ জায়গা, ভয়ের আদৌ কিছু নেই।
ভয়ের কথা স্বীকার করা যায় না; তাই বলি, ধুর, আমার কিছুতেই ভয় নেই!
কিন্তু ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে যাদের আমন্ত্রণে এসেছি, তাদেরকে বলেই ফেলি, রাতে একটু গা ছমছম করছিল।
ওদের হাতের চায়ের কাপ থেমে যায়, বুঝেছি, আমরা ভাবছিলামও এমনটা। চারতলার পুরো ফ্লোরটাই তো খালি, তাই না?
আমি ঘাড় নাড়ি, হ্যাঁ, পর পর চারটে রুমে কেউ নেই।
সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলে ওঠে, না না, পাশেই রয়েছেন ডক্টর আসিফ; নতুন এসেছেন, একদম ইয়াং ছেলে। দাঁড়ান, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই এখুনি। পাশে কেউ আছে জানলে, অত ভয় লাগবে না আর।
ভীতু ভাবছে আমাকে; বিরস মুখে তাড়াতাড়ি শুধরে দিই, অত নয়, সামান্য অস্বস্তি লাগছিল। তবে ওনাকে তো একবারও দেখলাম না!
সামনের দুই ভদ্রলোক তড়াক করে টেবিল থেকে উঠে বললেন, চলুন, এখনই পরিচয় করাই। ওনার সম্ভবত নাইট শিফট চলছে। ঘুমিয়ে পড়লে আর কথা বলা যাবে না।
ডক্টর আসিফ বেশ হাসিখুশি, একদম আমার ঘরের পাশেই। আর নাইট শিফটও ওনার আজই শেষ। কী আনন্দ; যাক, রাতে ভয় লাগলে মনে করব, পাশে আছে একজন।
যথারীতি রাত নামলো যাবতীয় দুর্বোধ্য শব্দরাজি নিয়ে। আজ যেন ভৌতিক শব্দগুলো আরও বেশি; এই ঘরের ভেতরেই তারা ফিসফিস করে আমোদ করছে। দাঁতে দাঁতে চেপে নিজেই নিজেকে বলি, নো ভয়! তখনই বুক কাঁপিয়ে এক রাতচরা পাখির অদ্ভুত ডাক, তারই সঙ্গে কানের কাছে দাঁড়িয়ে এক টিকটিকি সমানে বলে চলেছে, ঠিক ঠিক ঠিক! আমি তার সঙ্গে ঝগড়া জুড়ি, কিসের ঠিক রে?
এসবের মধ্যে কখন ঘুম এল জানিনা। তবে দরজায় সতর্ক আওয়াজ পেয়ে আচমকা ভ্যাবলার মত জেগে উঠে দেখি, রাত সাড়ে তিনটে! আবার আওয়াজ, সঙ্গে চাপা গলায় ডাক, ম্যাডাম, আমি ডক্টর আসিফ; ব্যালকনির দিকের জানলাটা একটু খুলুন…
রাতের একক অবস্থানে আমার ভরসা ডক্টর আসিফ, তিনি কেন এমন অসময়ে ডাকাডাকি করছেন? এই সময় কোন মহিলাকে ডাকার মানে কী! আবার সেই টিকটিকি ঘাড়ের ওপর এসে বলে ওঠে, ঠিক ঠিক ঠিক!
কাঁপা হাতে টানা ব্যালকনির সামনের জানলাটা খুললাম; আসিফ বিব্রত মুখে দাঁড়িয়ে…
রাতে ডিনার খেতে যাবার সময়, তালাচাবিটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আসিফ কমন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিজেই ওরটা দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে লক করে আপাতত ঘুরে আসুন।
আমি তো ভুলভুলাইয়া; নিচ থেকে ঘরে ফিরে চাবি আবিষ্কার করি দ্বিতীয় বাথরুমের তাকে! তখনই ফেরত দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ফোন এল; পুরো ভুলে গেলাম!
এখন আমার হাতে আসিফের তালাচাবি; হসপিটাল থেকে ওনার এমারজেন্সি কল এসেছে। ইমিডিয়েট যেতে হবে…
লম্বা বারান্দা পেরিয়ে নিচে নেমে গেলেন আসিফ, জানলায় মুখ লেপটে কুণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে; অন্ধকার আকাশে তখন চাপা এক আলো, কী মোহময় রূপ তার! নতুন করে ঘুমোতে না গিয়ে, টিকটিকি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আমি সেদিকেই চেয়ে থাকি অপলকে…
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন