তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশাল স্টিলফ্রেমের গেট পেরিয়ে সৃজন যখন পা রাখল দু–পাশের সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরু পিচরাস্তার উপর, তখনও ফিকে অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে রেখেছে সেদিনের ভোরবেলাটা৷ প্রায় দশ বছর হল ঠিক এরকম ভোর–ভোর মুহূর্তে রোজ এই মাঠটিতে চলে আসে আরও একটু সুস্থ থাকার বাসনায়৷ মাঠের চারপাশে বড় বড় রেন–ট্রি আর কৃষ্ণচূড়া–রাধাচূড়ার সহাবস্থান যেন নিরাপত্তার বেষ্টনী৷ সবুজে ঘেরা মাঠটিতে হাঁটার আরামও অন্যরকম৷ মাঠে নেমে হাঁটা শুরু করার ঠিক আগে চারপাশের আঁধারে চোখ চালিয়ে দেখতে চাইছিল এখনও পর্যন্ত ক’জন এসেছেন মাঠে৷ চেনার মতো আলো ফোটেনি দেখে মুখ নিচু করে শুরু করে দিল মাঠের সবুজ মাড়িয়ে পথ চলা৷ বড় বড় নিশ্বাস নিল কয়েকটা৷ ছাড়ল আস্তে আস্তে৷ নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার কারুকাজের পর ফুসফুসে একটা আলাদা জোর পায় সৃজন৷ হয়তো সবটাই মনবাবুর ব্যাপার নয়, কিছুটা টাটকা অক্সিজেনের প্রভাব, সেইসঙ্গে ভোরের বাতাসে ওজোনের উপস্থিতিও, তবু মনবাবুকে এভাবে চাঙ্গা করে রাখাটা খুব জরুরি৷ তার টার্গেট দশ রাউন্ড৷ রোজই মাঠটার চারদিকে দশ পাক দিয়ে আবার বাড়ির পথ ধরে দৈনন্দিন জোয়ালে কাঁধ ঠেকাতে৷
প্রথম রাউন্ডেই দেখা হয়ে গেল সদ্য সত্তরে পৌঁছোন দেবলবাবুর৷ লম্বা, সুদর্শন চেহারা৷ ডার্ক কমপ্লেক্সন৷ এখনও বেশ টানটান শরীর নিয়ে মাঠে আসেন প্রতিদিন, দেখা হতেই তাঁকে সুপ্রভাত জানিয়ে সৃজন বলল, কী চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, দেবলদা?
––দারুণ সুন্দর এই ভোরবেলাটা৷ হাওয়ায় আরও মনোরম হয়ে উঠছে মর্নিং ওয়াক৷ কী বলো? তবে যতক্ষণ সূর্য না ওঠে সেই পর্যন্ত এই আরাম৷
সৃজন ততক্ষণে তাঁকে ক্রস করে এগিয়ে গেছে জোরে জোরে পা ফেলে৷ তার এখন পঞ্চাশ, তার হাঁটার গতি কমে গেলে দেবলদাই তাকে তাড়া দেবেন, গো অ্যাহেড, ইয়ংম্যান৷
বার দুই রাউন্ড দিতেই সৃজন অনুভব করছিল হাওয়ার স্নিগ্ধতা৷ অমল ভোরের স্পর্শে কেটে যাচ্ছে অন্ধকারের রহস্যও৷ মর্নিং ওয়াকাররা একে–একে ঢুকছেন মাঠে৷ কারও মুখে সুপ্রভাত, কেউ বা সাহেবি ধাঁচে ‘গুড মর্নিং’৷ মাঠে ঢুকে যার–যার সঙ্গীসাথি খুঁজে নিয়ে গল্প–আড্ডার ফাঁকফুরসতে সবাই ব্যস্ত থাকেন স্বাস্থ্যোদ্ধারে৷ প্রত্যুত্তরে সৃজনও শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল প্রত্যেককে৷ কখনও হাত তুলছিল, কখনও হাসছিল মৃদু৷ ভোরের এই নরম আলোয় স্বাস্থ্যপ্রয়াসী মানুষগুলোর মুখ কী চমৎকার দেবদূতপ্রতিম থাকে, কী চমৎকার ঝলমল করতে থাকে তাই-ই লক্ষ করে প্রতিদিন৷
অল্পবয়সীদের কেউ কেউ তারও আগে পৌঁছে জোরে জোরে পা ফেলে শুষে নিতে চাইছে আরও একটু বেশি অক্সিজেন৷ তাদেরই একজন, হয়তো সবে চল্লিশ–পেরোন দেবাঞ্জন হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে বলল, সুপ্রভাত, সৃজনদা৷
––সুপ্রভাত, দেবাঞ্জন, বলে সৃজন আবারও নিশ্বাস টানল জোরে, ছাড়তে শুরু করল একটু একটু করে৷ প্রতিবারই মনে হয় আরও একটু জীবনকণা যুক্ত হচ্ছে তার শরীরে৷ আরও একটু ঝরঝরে হয়ে ওঠা।
বার কয়েক এমন নিশ্বাস নেওয়ার ফুরসতে সে আর একবার তাকিয়ে দেখে নিল মাঠের চারপাশ৷ চেনা–চেনা মুখগুলো যে–যার নিজের মতো করে ভরে নিতে চাইছে আরও জীবনকণা৷ এখন বৈশাখমাস৷ খররোদে আক্রান্ত হওয়ার আগেই অন্য প্রাতঃভ্রমণকারীরাও সেরে নিতে চাইছেন যার–যার রাউন্ডের কোটা৷ তারপর কেউ বাড়ির পথ ধরবেন, কেউ বা আরও দু’দণ্ড বসবেন মাঠের একদিকে কংক্রিটের টানা লম্বা বেঞ্চিতে, একটু আড্ডা দিয়ে গায়ের ঘাম গায়েই শুষে হাঁটা শুরু করবেন বাড়ির দিকে৷
চার রাউন্ড শেষ করে পঞ্চম রাউন্ড শুরুর ঠিক মুখে হঠাৎ কার ডাক শুনে সৃজন চমকে তাকিয়ে দেখল কংক্রিটের বেঞ্চিতে বসা থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের একজন সুকমলবাবুর হাতছানি৷ সুকমলবাবুরা তিন বন্ধু মাঠে এসে এক কি দু–রাউন্ড হেঁটে সোজা চলে আসেন টানা লম্বা কংক্রিটের বেঞ্চিতে তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসতে৷ পাশাপাশি বসে গল্পগুজব করেন প্রতিদিন৷ যেন হাঁটা নয়, তিন আশি ছুঁই–ছুঁই বন্ধু গল্পে–আড্ডায়–হাসি–ঠাট্টায় মেতে থাকতেই আসেন এই সবুজ পটভূমিকায়৷ হয়তো তার আগেই এসে বসে আছেন মিলনবাবু বা বাসববাবু, তাঁকে দেখে বলবেন, ‘আসতে আজ্ঞা হোক’, কিংবা হয়তো কেউই আসেননি, তিনিই প্রথম৷
হাঁটতে হাঁটতে সৃজন খেয়াল করছিল আজ কংক্রিটের বেঞ্চিতে সুকমলবাবুর নিত্যদিনের সঙ্গীরা কেউই আসেননি তখনও, হঠাৎ নজরে পড়ল গুটি–গুটি পায়ে ঢুকছেন তাঁর প্রায় সমবয়সী মিলনবাবু৷ সুকমলবাবুকে দেখে মিলনবাবু আর হাঁটার চেষ্টা না–করে সোজা এসে বসলেন তাঁর পাশে, বললেন, কই, বাসবদা আসেননি এখনও?
––কী জানি হয়তো আজ ভোরের আরাম–ঘুম ঘুমোচ্ছেন৷ এই যে সৃজন––
কী কারণে সুকমলবাবুর এই আহ্বান তা অনুমান করতে না–পেরে সৃজন কাছে যেতেই হাতের ঢাউস প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে হাত ঢুকে গেল তাঁর, পরক্ষণে বেরিয়ে এল রংচঙে কাগজে মোড়া একটি টফি, সেটি তার হাতে ধরিয়ে দিতেই সৃজনের স্বরে অনিবার্য প্রশ্ন, হঠাৎ?
সুকমলদার মৃদু হাসিসহ ছোট্ট উত্তর, আজ মাঠের জন্মদিন৷
ভারী শান্তশিষ্ট মানুষ সুকমলবাবু, কথা বলেন কম, হাসেনই বেশি৷ আজ তাঁর ভিতর লক্ষ করছিল এক অন্য উদ্যম৷ তাকে টফি দেওয়ার পর মুহূর্তে চোখ পড়ল সামনের সবুজে রাউন্ড দিতে থাকা নীলোৎপলের দিকে, তাকে বললেন, নীলোৎপল, শোনো––
মাঠের ট্রাক ছেড়ে হনহনিয়ে কাছে এল নীলোৎপল, বলুন সুকমলদা––
––এই নাও, ধরো, বলে প্লাস্টিকের ব্যাগটি থেকে বার করলেন একটা টফি, নীলোৎপলের হাতে দিয়ে বললেন, তোমার সকালটা মধুময় হয়ে উঠুক৷
নীলোৎপল টফিটার গায়ে ‘হনিটাচ’ শব্দটি পড়ে হেসে ফেলল, পরক্ষণে টফিটি গালে ফেলে বলল, হঠাৎ সকালে টফি?
সেই একই উত্তর দিলেন সুকমলবাবু, আজ মাঠের জন্মদিন৷
––আজ মাঠের জন্মদিন
‘মাঠের জন্মদিন’ শুনে সৃজনের মতো নীলোৎপলও কিছুক্ষণ ধন্দে, বলল, মানে মাঠটা আজকের কোনও তারিখে উদ্বোধন করা হয়েছিল?
––ধরে নাও সেরকমই কিছু৷
নীলোৎপল ততক্ষণে আবার ট্রাকে৷ তার এখনও চার–পাঁচ রাউন্ড হাঁটা বাকি৷ সে চলে যেতেই সুকমলবাবু আবার কাকে দেখে ডাকলেন, দেবাঞ্জন, এক সেকেন্ড ––
‘এক সেকেন্ড’, শুনে দেবাঞ্জনও তার হাঁটায় যতি টেনে এগিয়ে এল সুকমলবাবুর দিকে, তাকেও একটি টফি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আজ মাঠের জন্মদিন৷
দেবাঞ্জনের মুখেও বিস্ময়ের আঁকিবুঁকি ফুটে উঠতে বললেন, বাহ্, রোজ মাঠে এসে স্বাস্থ্য রক্ষা করবে, আর সেই মাঠের জন্মদিনে একটু শুভকামনা জানাবে না?
তাঁর একটু পরেই বছর চব্বিশের নীলাভ ও ষাট–পেরোন ধৃতিমানবাবুকে টফি ধরিয়ে দিয়ে তাদের কোনও জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ না–দিয়েই বললেন, আজ মাঠের জন্মদিন৷
দশ বছর এই মাঠে আসছে সৃজন, অথচ কখনও শোনেনি এভাবে পালিত হচ্ছে সবুজে উমসুম মাঠটির জন্মদিন৷ প্রশ্নটি মগজে উথালপাতাল করে উঠলেও জিজ্ঞাসা না–করে বলল, কততম?
তাঁর পাশে বসা মিলনবাবু হেসে উঠে বললেন, ধরে নাও আশিতম৷
––ঠিক আছে, তাই ধরে নিলাম, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর৷ বলে জিবের উপর মিষ্টি স্বাদ চারিয়ে নিতে নিতে সৃজন এগিয়ে চলল পরবর্তী রাউন্ড শুরু করতে৷
পরের রাউন্ড শেষ করে কংক্রিটের বেঞ্চির কাছে আরও একবার আসতেই দেখল বাসববাবু তাঁর পাতলা শরীরটা নিয়ে এগিয়ে আসছেন বাকি দুই বন্ধুর দিকে৷ রোজকার মতোই তাঁর হাতে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ, তবে ব্যাগটা আজ একটু ভারীই৷ তাঁদের কাছে এসে ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, নাও, ধরো৷ তোমাদের কাজ এই বুড়ো মানুষটাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছ৷
––বুড়ো কোথায়? সুকমলবাবু হেসে বললেন, আপনার তো আশি হয়নি এখনও৷
যেন আশি না হলে বুড়ো হতে নেই সৃজন এগিয়ে গেল হাসি–হাসি মুখে৷ সবুজ মাঠটির পুবদিকে পলক ফেলে সে দেখছিল তখনও আকাশে সুয্যিদেব ঘুম ভেঙে ছড়াতে শুরু করেননি তাঁর তীব্র কিরণ৷ একটু–একটু করে লাল রঙের তুলি বুলিয়ে পুব আকাশে হিজিবিজি দাগ কেটে কেউ জানিয়ে দিচ্ছিল দিনের প্রভুর আগমনবার্তা৷ আজ ঝিরঝির করে সামান্য বাতাস বইছে, জোরে হাঁটলেও তাই তেমন কষ্ট হচ্ছে না শরীরে৷ চারপাশে চোখ ফেলে তাকাতে নজর পড়ছিল সবুজ মাঠটার পশ্চিমে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার ডালে ডালে লাল আর হলুদের সমাহার৷ এপ্রিল–মে এই দুটো মাস মাঠটাকে রঙে রঙে ভরিয়ে দেয় এই গাছগুলো৷ পুবদিকের মস্ত নাগকেশর গাছটাও এ সময় ভরে ওঠে অজস্র রঙে৷ নাগকেশর ফুলের গঠনটাই এত চমৎকার যে, মাঠে নতুন কোনও আগন্তুক এলেই হাঁ করে ফুলের গঠন দেখতে থাকেন, দেখতেই থাকেন দু–চোখে বিস্ময় মাখিয়ে৷ দু–একজন অতিউৎসাহী তারের বেড়া পার হয়ে ফুল পাড়তে উদ্যোগী হলেই প্রাতঃভ্রমণকারীদের্ মধ্যে কেউ কেউ স্ববরযন্ত্রের ডেসিবেল বাড়িয়ে বলে ওঠেন, ফুল পাড়বেন না, ফুল পাড়বেন না৷ এখানে ফুল তোলা বারণ৷
সৃজন আবার বড় করে একটা নিশ্বাস টেনে ভরিয়ে ফেলতে চাইল তার দুর্বল ফুসফুস৷
সৃজন ভাবছিল তার ফুসফুস সত্যিই দুর্বল, না এটা তার মনের দুর্বলতা৷ গ্রন্থকীট হওয়ার কারণে গায়েগতরে সে পরিশ্রম করেনি কখনও৷ পারতও না পরিশ্রম করতে৷ ভাবত খুব বেশিদিন বাঁচবে না তার দুর্বল শরীর নিয়ে৷ কিন্তু মাঠে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করার পর থেকে তার মনে হচ্ছে শরীরে না হোক মনে এখন সে বেশ শক্তিশালী৷ মন আর শরীরের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র থাকে যার ফলে একে নির্ভর করে অন্যের উপর৷
ততক্ষণে দুটো মাঠের চারদিকের ট্রাক ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন আরও বহু মানুষ৷ তাদের মধ্যে কেউ চেনা কেউ অচেনা৷ সুকমলবাবু সবাইকে ডেকে টফি উপহার দিয়ে মাঠকে শুভেচ্ছা জানাতে বললেন হাসি–হাসি মুখে৷ মাঠের নিত্যদিনের সঙ্গীদের মুখে ছড়িয়ে যেতে শুরু করেছে ‘মাঠের জন্মদিন’ শব্দদুটি৷ জিবের উপর হনিটাচের স্বাদেগন্ধে মাখামাখি হয়ে আলোচনা করছেন এই মাঠ যাঁর ব্রেনচাইল্ড সেই ডগলাস সাহেবের কথা৷ ডগলাস সাহেব আজ আর নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটি সারাদিন মুখর হয়ে থাকে নানাজনের উপস্থিতিতে৷ পৃথিবীতে তিনি না–থেকেও রয়ে গেছেন অন্তরালে৷
হ্যাঁ, সেই কবে ডগলাস নামের এক সাহেব কলকাতার উপান্তে গড়ে তুলেছিলেন একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান যেখানে অনাথশিশুদের জন্য আছে একটি আবাসিক বিদ্যালয়, আছে দু–দুটি সবুজ মাঠ যা সকাল-বিকেল থাকে স্বাস্থ্যোদ্ধারকারীদের হেপাজতে তো দুপুরে থাকে খেলোয়াড়দের দখলে৷ তা ছাড়াও নানা প্রতিষ্ঠান বার্ষিক অনুষ্ঠান করতে মাঠটাকে সাজিয়ে তোলে কিছুদিন পর পর৷
পরবর্তী রাউন্ড শেষ করে কংক্রিটের বেঞ্চির কাছে আসতে সৃজন আবিষ্কার করল বাসববাবুর প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা ছিল লাল আবির৷ তিনি ততক্ষণে সেই আবির বার করে পরম যত্নে লাগিয়ে দিচ্ছেন সুকমলবাবুর মুখে৷ সুকমলবাবুও তার প্রত্যুত্তরে প্রথমে বাসববাবুর, পরে মিলনবাবুর মুখে আবির মাখাতে শুরু করলেন ঝলমলে মুখে৷ হঠাৎ সৃজন অনুমান করে কিছু একটা গভীর রহস্য আছে টফি ও আবিরের সহাবস্থানের মধ্যে৷ কিন্তু তা ওঁরা গোপন করে যাচ্ছেন কী জানি কেন। থমকে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল কংক্রিটের বেঞ্চির কাছে, কী সুকমলদা, আজ নিশ্চয় কিছু একটা স্পেশাল ডে…
মিলনবাবু তৎক্ষণাৎ ফাঁস করে দিলেন সেই গূঢ় রহস্য, বললেন, আসলে আজ সুকমলদার জন্মদিন৷ সে–কথা উনি বলতে লজ্জা পাচ্ছেন বলেই––
––তাই বলুন, সৃজনও বাসববাবুর ব্যাগ থেকে আবির বার করে মাখিয়ে দিল সুকমলবাবুর মুখে৷ বন্ধুদের অত্যাচারে ইতিমধ্যেই রঙিন তাঁর মুখমণ্ডল, আরও একটু হল সৃজনের আঙুলের কারুকাজে৷
––সুকমলদা আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিল যিনিই আশি বছরে পা দেবেন তাঁকে নিয়ে আমরা সেলিব্রেট করব মাঠে এসে৷
সুকমলবাবুর মুখের দিকে নজর ফেলল সৃজন৷ গত দশ বছর ধরে এই তিন বন্ধুকে এই নির্দিষ্ট আসনে দেখে আসছে তারা৷ বেশিরভাগ মর্নিং ওয়াকাররা ঘন্টাখানেকের মধ্যে যে–যার বাড়ি চলে গেলেও এঁরা তিনজন বসে থাকেন আটটা–সাড়ে আটটা পর্যন্ত৷ চোখে রিমলেস চশমা, সাদা ধুতি–পাঞ্জাবী পরা সুকমলবাবুর টাকমাথাটা চকচক করছে বৈশাখের রোদ্দুর পড়ে, মাত্র দু–চারটে সাদা ধবধবে চুল ফুরফুরে হাওয়ায় পতপত করছে উড়ে জানান দিচ্ছে এককালে তাঁর মাথা আলো করে থাকত চুলের রাশি৷ লাজুক–লাজুক মুখে প্রশান্ত চাউনি৷ আজ জন্মদিন হওয়ায় সেই চাউনিতে অরও একটু উপচে পড়া লজ্জাভা৷
আবিরে নিজেও রঙিন হয়ে সৃজন বলল, তা হলে আপনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র দিন তিনেকের ছোট। খুব ইন্টারেস্টিং তো
––রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শুনে সুকমলবাবু হতবাক, তাঁর বন্ধুরাও৷
––আজ আঠাশে বৈশাখ৷ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন আমরা মাঠে পালন করলাম গত পরশুর আগের দিন৷ আজও তা হলে একটু গানটান হোক সেদিনকার মতো৷ অশোকদা কোথায়? তাঁর কণ্ঠে একটা গান হলেই তো আরও একটু রং ধরবে এই খুশিয়াল মুহূর্তে৷ বাসবদার মুখে শুনতে চাই একটা কবিতা৷
সৃজনের প্রস্তাবে ঝলমল করে উঠল বয়স্ক মানুষগুলির মুখ৷ ততক্ষণে আরও বহু প্রাতঃভ্রমণকারী এসে হাজির হয়েছেন কংক্রিটের বেঞ্চির কাছে, সবাই হইহই করে বলছেন, এরকম একটা খবর আপনি চেপে গিয়ে আমাদের সবাইকে টফি খাইয়েছেন আজ সকালে ঠিক আছে, গান–কবিতা হয়ে গেলে আপনার মুখ থেকে আমরা শুনব আপনার জীবনকাহিনির কিছু টুকরো মুহূর্ত৷
শুনে সুকমলবাবুর মুখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত হাসি৷ যে–মানুষটা রোজ ভোরে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন, হাসতেন মৃদু–মৃদু, তিনিই আজ সবাইকার কেন্দ্রবিন্দু৷ তৎক্ষণাৎ কীরকম আনমনা হয়ে গেলেন আশির দরজা ছুঁয়ে থাকা মানুষটি৷ বোধহয় নিজের ভিতর অন্তরিন হয়ে গেলেন স্মৃতির প্রধান সড়ক বেয়ে৷ প্রধান সড়ক থেকে ক্রমে লেনে ও বাইলেনে৷ সিনেমার রিলের মতো পার হয়ে যাচ্ছে একটির পর একটি ছবি, এমন অসংখ্য ছবি মিলিয়েই তো তিনি৷ সেই যে ছোট্ট বালকটি তার যাত্রা শুরু করেছিল, সে তো তখনও জানত না জীবন মানে অসংখ্য ঘাত–প্রতিঘাতের সমন্বয়৷ সাদা ক্যানভাসে কখনও তিনি নিজে, কখনও অদৃশ্যে বাস করেন এমন কেউ একটু একটু করে রং মাখিয়ে রচনা করেছেন তাঁর আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি৷ সেই রং কখনও লাল–নীল–সবুজ, কখনও ধূসরও৷
সুকমলবাবু নিজের কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ হাসি–হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন অন্যদের মুখের দিকে চোখ রেখে৷ আশি বছরে পা দিয়ে তাঁর ভিতরে যে একটা অন্য শিহরন হচ্ছে তা জানাতে দ্বিধা না করে জানালেন বরাবরই খুবই অপ্রতিভ, নিষ্প্রভ ধরনের জীবনযাপন করেছেন, থাকতে চেয়েছেন একটু আড়ালে৷ তবে এই পৃথিবীতে দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকার আসল প্রাপ্তি রংবেরঙের নানা অভিজ্ঞতা৷ আজ মনে হচ্ছে তাঁর বয়স এক বছর বাড়ল না, বরং জীবন থেকে কমে গেল একটা বছর৷ কমে গেল তাঁর বেঁচে থাকার বয়স৷ তবে তাতে তাঁর কোনও আফসোস নেই৷ শুধু এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী থেকে সুস্থ থাকতে থাকতে চলে যাওয়াই ভালো৷ তাঁর একমাত্র কাম্য সেটাই৷
রোদ তখন আরও হলুদ হয়ে গড়িয়ে পড়ছে সবুজ ঘাসের পাতায়–লতায়, পাতার ফাঁকফোকর খুঁজে মাটির সন্ধানে৷ তীক্ষ্ণ পেরেকের মতো ফুঁড়ে ফেলতে চাইছে গায়ের চামড়া৷ কিন্তু সৃজনদের মাথার উপর ক’টা রেন–ট্রি আর মৃদু হাওয়ার স্পর্শ সেই রোদকে ঘেঁষতে দিচ্ছে না তাদের শরীরে৷ রেন–ট্রির নীচে মাত্র আধ ঘন্টা সময়, সেই সামান্য সময়টুকু আজ কাটল একটু অন্যরকমভাবে৷ সুকমলবাবুকে কেন্দ্রে রেখে অন্যদের প্রতিভার এক–একটু কিরণ ছিটকে পড়ল চারপাশে সমবেত সবার গায়ে৷
সকালের নৈমিত্তিক জীবনপ্রণালীতে হঠাৎই একটু অন্য রং ধরিয়ে অন্যদের মতো সৃজনও ঘরে ফেরার পথ ধরে৷ কিন্তু সুকমলবাবুর একটি কথা তার মনে টুংটাং শব্দ তুলতে থাকে নীরবে৷ একটি জন্মদিন মানে জীবন থেকে কমে গেল পৃথিবীতে তাঁর বেঁচে থাকার বয়স৷ কথাটা ক্রমাগত আবর্তিত হতে থাকে তার মজ্জার গভীরে৷ সেও ইতিমধ্যে অতিক্রম করে গেছে তার জীবনের মধ্যপথ৷ সে এখনও জানে না তার দৌড় কতদূর৷ মানুষের জীবন অনিত্য এরকম একটি দার্শনিক ভাবনা মগজে ভরে নিয়ে অন্য মানুষদের মতো সেও তার জীবন থেকে রোজ ঝরিয়ে ফেলছে এক–একটি দিন৷ বয়স বাড়ছে না–ভেবে এখন তার ভাবনাতেও আবর্তিত হচ্ছে সুকমলবাবুর ভাবনাটিই––তার বাঁচার বয়স কমছে প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মুহূর্তে৷
সারা শরীরে ও মনে একটা অদ্ভুত ঘোর মেখে বাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছে, তখনও জানত না তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও একটি বিস্ময়৷ তার আট বছরের ভাগ্নি রূপসা তার আসার পথে––যাকে বলে প্রত্যুদ্গমন করে বলল, মামা, এই নাও––
সৃজনকে অবাক করে তার হাতে ধরিয়ে দিল একটি টফি৷
সৃজনের জিবে তখনও রিমরিম করছে সুকমলবাবুর দেওয়া টফিটির স্বাদ–গন্ধ৷ সেই অনুভূতি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরও একটি টফির প্রাপ্তি অভাবনীয়৷ বলল, কী ব্যাপার, এই সাতসকালে টফি?
রূপসা মুখে বিজ্ঞ–বিজ্ঞ ভাব ফুটিয়ে বলল, মনে নেই, আজ আমার জন্মদিন আটে পা দিলাম আজ৷
সত্যিই মনে ছিল না সৃজনের৷ দু–চোখে বিস্ময় আপ্লুত করে বলল, তাই?
––বাহ্, ক’দিন আগে তোমাকে বলেছিলাম৷ সব ভুলে যাও আজকাল।
সৃজন যে অসম্ভব ভুলোমনা সে কথা বাড়ির দেওয়ালগুলোও অবহিত৷ কিন্তু তার চোখ নিবদ্ধ রূপসার হাসি–হাসি মুখের দিকে৷ একটু আগে পালন করে এল একজন আশিতে পা দেওয়া মানুষের জন্মদিন, এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে–বালিকা সে পা দিচ্ছে আটে৷ দু’জনেরই চোখ–মুখ–অভিব্যক্তি ঝলমল করছে এক আশ্চর্য লাবণ্যে, আনন্দে, উল্লাসে৷ তবে দু’জনের চোখের দ্যুতিতে দুরকম বিভা৷ একজন তার জীবনের দৌড় শেষ করার মুখে, অন্যজন সবে শুরু করেছে তার দৌড়৷
––জানো মামা, আমি আরও একটু বড় হয়ে গেলাম! কী মজা আর দু–বছর পরেই তো আমি হাইস্কুলে! হাইস্কুলের মাঠটা কত্ত বড়, জানো?
ক––ত্ত শব্দটি দু’হাত প্রসারিত করে দেখাতে চাইল রূপসা, যেন তার পৃথিবীটা আরও প্রসারিত হয়ে উঠবে দিনে–দিনে, তার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে৷
সৃজনের দু’চোখে খেলা করছিল রূপসার চোখেমুখে উপচে ওঠা উল্লাসের বহর একজনের পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছে প্রতিদিন, অন্যজনের পৃথিবী হয়ে উঠছে বড়, আরও বড়, আরও আরও বড়৷ দুজনের জন্মদিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৃজন নিজেকে ভাবছিল একটা হাইফেন৷ দু’জনের দু’রকম পৃথিবী নিয়ে দুই হাতে লোফালুফি করতে গিয়ে সে ভাবছিল তার নিজের পৃথিবীটা ঠিক এই মুহূর্তে কীরকম? জীবনের মধ্যভাগ পেরিয়ে সেও তো এগিয়ে চলেছে জীবনের শেষপ্রান্তে৷ তার অর্থ সুকমলবাবুর মতো তারও বেঁচে থাকার দিন কমে আসছে প্রতি মুহূর্তে৷ সৃজন কিছুক্ষণ স্তব্ধ৷ কিছুক্ষণ বিষণ্ণ৷ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক৷ পরক্ষণে রূপসার মুখের দিকে তাকিয়ে নেগেটিভ ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল তর্জনীর মস্ত টোকায়৷ হতাশা মানুষের জীবনকে গড়ে উঠতে বাধা দেয় বলে সে কখনও নেগেটিভ ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয়নি৷ পৃথিবীটাকে আরও বড়ো করে তোলার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাওয়াই প্রতিটি মানুষের ভবিতব্য৷ ক্রিকেটের মতো জীবনের শেষ বল পর্যন্ত খেলে যেতে হয় জেতার লক্ষ্যে৷ আগেই হেরে যাওয়া ঠিক নয়৷ অতএব––
তার অলক্ষ্যে জীবন থেকে এক–একটি করে পাতা ঝরে যাচ্ছে জেনেও সে নিজের পৃথিবীটা প্রতিদিন ইলাস্টিকের মতো টেনে টেনে বড় করবে, সেই লক্ষ্যেই সে এগিয়ে যাবে জীবনের শেষ বলটি পর্যন্ত হাতে তুলে নিয়ে৷
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন