সোমজা দাস
কালো জলে বৈঠা টানলে সুরেলা যে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ওঠে, আঁধারের পর ঘাটে লোক কমে এলে পরে, সেই শব্দে জলিল মাঝির নেশা ধরে। রাত বাড়লে মহীন ছোড়া বাড়ি যাওয়ার আগে একবার আওয়াজ দিয়ে যায়, “কী হো খুড়া, ঘর যাবা না?”
জলিলও গলা চড়ায়, “তুই যা। সিধা ঘর যাবি, ননীর ঠেকে গে গিলতি বসবি না য্যানে।”
নাহ্, মহীন আজকাল ননীর ঠেকে যাচ্ছে না বেশ কদিন। বউটা রাগ করে। মহীনের বউ বাতাসীর পাঁচ মাসের পেট চলছে, রোগা ভোগা মেয়ে। জলীলকে ধর্মবাপ মানে বাতাসী। জলিলের তিনকূলে কেউ নেই। বাতাসী তাকে ‘বাপ’ বলে ডাক দিলে জলিলেরও বুকের ভিতরে নরম কাদা তলতল করে।
গাঁয়ের ছেলে মহীন। ওর বাপ দুযযোধন মিরধা ছিল জলিলের প্রাণের বন্ধু। তা সেও গেছে দুই বৎসর হল। এখন মহীন নাও চালায়। ওদের দুজনকে একসঙ্গে বড় মানায়। বাতাসীর তরতরে মুখটা দেখলে জলিলের আরেকটা কচি মুখ মনে পড়ে যায়। সে যদি বেঁচে থাকত, আজ জলিলেরও একটা সংসার হত। এতদিনে নাতিপুতিতে ঘর ভরত। আজ ভাবতে বসলে মনে হয় সে যেন কত জন্ম আগের কথা!
রাত বাড়লে ঘাটের মাঝিমাল্লারা যখন একে একে ঘরে ফিরে যায়, জলিল একা ঘাটে বসে বিড়ি ফোঁকে। কখনও কেউ যদি বেশি রাতে ঘাটে আসে, সে জেনেই আসে আর কেউ না থাকুক জলিল মাঝি থাকবে। অনেকদিন ঘরেও ফেরে না জলিল। পুরো রাতটা ছইয়ের ভেতরেই কাটিয়ে দেয়। নদীর কুলকুল শব্দ শোনে বুড়ো মাঝি জলিল মিঞা। যে সব রাতে নদীর বাতাস ভারী হয়, শনশন শব্দে সেই হাওয়া ধাক্কা মারে জলিলের নৌকোয়। সেইসব রাতে জলিল দড়িদড়া খুলে দেয়। নৌকো ভেসে চলে আপন খেয়ালে। জলিল গলুইয়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে তারা ভরা আকাশ দেখে। সেই রাতগুলোতে নিজের মেয়েটার কথা বড় মনে পড়ে তার।
জলিলের বিবি ফাতিমার যখন পেট হল, নিশুত রাতে জলিলের দরাজ বুকের উপর শুয়ে আঙুল দিয়ে চুড়বুড়ি কাটত। মাদী বিড়ালের মতো আহ্লাদী সুরে গুনগুন করে বলত, “বেটি হলে নাম রাখব বুলবুলি।”
জলিল হাসত। কইত, “ক্যানে? বেটি ক্যানে হবে? ছেইলেব্যাটা হবে মোর। তোর সনে মিলায়ে নাম রাখব ফারুক।”
ফাতিমা ঠোঁট ফোলাত। জলিলের বুকে চিমটি কেটে বলত, “ছাই নাম! মোর বেটিই হবে দেইখ্যে নিও।”
জলিল নিচু হয়ে ফাতিমার স্ফীত গর্ভে স্নেহচুম্বন এঁকে দিত। হেসে বলত, “খেপি! দুনিয়া সুদ্ধু লোকে ব্যাটা চায়, আর এর নাকি বেটির শখ।”
ফাতিমা বলত, “তুমি বুঝবা না। বেটিকে মন ভরি সাজাব, যতন করব। তুমি কাজে গেলে ওর সনে পুতুলের ঘর পাতব, বলে মোর কতদিনের সাধ!”
আল্লাহ বোধ হয় সেই রাতে নিঁদের ঘোরে ছিলেন। ফাতিমার দোয়া অর্ধেক শুনেছিলেন তিনি। মেয়েই হয়েছিল ফাতিমার। কিন্তু সেই মেয়েকে যত্ন করার জন্য, তার পুতুলের ঘর সাজানোর জন্য ফাতিমা আর রইল না। সদ্যোজাত ন্যাকড়ার পুটলির মতন মেয়েটাকে জলিলের হাতে দিয়ে ফাতিমা অনেক দূরে কোথাও খেলাঘর সাজাতে রওনা দিল।
“যাবেন নাকি মিঞা?” অচেনা পুরুষ কণ্ঠের ডাকে ঘোর ভাঙে জলিল মিঞার। তাকিয়ে দেখে কালো আলখাল্লা গায়ে এক ফকির বাবা। মুখে লম্বা দাড়ি বুক সমান নেমেছে। গলায় রঙিন পাথরের মালা, হাতে ঝাড়ন। ধরমর করে উঠে বসল জলিল মিঞা। এই মাঝরাতে ফকিরসাহেবকে নদীর ধারে দেখে বেশ অবাকই হল।
“ওই পারে যাব মাঝি”, ফকির সাহেব বললেন।
“চলেন”, বলে নৌকো থেকে নেমে দড়ি খুলল জলিল মিঞা। আজকের রাতটা বড় শান্ত। নদীর জলে বড় ঢেউ নেই। অঘ্রানের শুরুতে বাতাসে হিম, থেকে থেকে গায়ে কাঁটা লাগে। ফকির নৌকোয় চড়ে বসলেন। চাঁদের আলো মুখে পড়ছে। জলিল তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। অন্ধকারে মুখ ভাল বোঝা যায় না, তবু বয়স বেশি হবে না ফকিরবাবার। মুখের চামড়ায় ভাঁজ আসেনি এখনও। গালে হাত দিয়ে একমনে কী জানি ভাবছেন, দূরে অন্ধকারে প্রসারিত তাঁর গভীর, উদাস দৃষ্টি।
জলিল কতকটা আগ বাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করে, “কোথার থেইক্যে আসলেন ফকিরবাবা? আগে তো এই গাঁয়ে দেখি নাই? সাকিন কই?”
জলিলের কণ্ঠস্বরে ফকিরবাবার ধ্যান ভাঙে। মৃদু হেসে বলেন, “ফকিরের সাকিন থাকতে নাই মিঞা। দ্যাশ দ্যাখতে বেরাইছি। পীরপুরের মেলায় গ্যাসলাম। তারপর মন ডাকল ইদিকপানে। আল্লাহর ডাক, সাড়া দেওন তো লাগবোই। তাই আসলাম। দিনের বেলায় ছিলাম তোমাদের গাঁয়ের মসজিদে। জলপড়া, তাবিজ দিছি কয়জনারে। রাত্তিরে শুইলাম। নিন্দের ঘোরের মধ্যে মন কইল, আর না। এখন ঠাঁই নাড়া করতে হবে। তাই আবার চলা শুরু।”
“এত রাত্তিরে যাবেন? আন্দারে কুত্তা শ্যায়ালে উৎপাত করব। রাত্তিরটা হেথায় থাইক্যা কাইল গ্যালে হইত না?” বলল জলিল।
“না মিঞা, আল্লাহ যখন ডাক দ্যায়, তখনই ঠাঁই নাড়তে লাগে। মন লাগানো চলে না”, কতকটা আনমনে বলে আবার দূরে অন্ধকারের দিকে তাকাল ফকিরবাবা। জলিলের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। বুক খালি করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল একটা। হায় রে আল্লা, না জানি কোন বাপ মায়ের কোল শুনা করে ঘর ছেড়ে এসেছেন ফকিরবাবা? কতই বা বয়স হবে? বড়জোর তিরিশ বত্রিশ। কিসের এমন তাগিদ যার জন্য সব গিঁঠ খুলে ফেলা যায়? কী এমন ডাক, যার কাছে ঘর সংসার, বাপ-মা, বিবি বাচ্চা সব পর হয়ে যায়? জলিল মিঞা তো এখন এই এত বয়স অবধি পারল না মায়া ছাড়তে।
নাকি এমন মন জন্ম থেকে নিয়েই জন্মায় এই মানুষগুলো? যেমন জলিলের মেয়েটা জন্মেছিল। জলিলের বেটি, তার কলিজার টুকরা, বুলবুলি। মেয়েটার কচি মুখটার দিকে চাইলেই শোকাতাপা বুকটা শীতল হত জলিলের। মা-হারা মেয়ে, জ্ঞান হতেই কেমন করে বুঝে নিয়েছিল এই দুনিয়ায় বাপ ছাড়া তার আর কেউ নেই। বাপকে চোখে হারাত মেয়েটা। পুতুলের ঘর সাজানোর আগেই কচি হাতে বাপের ছন্নছাড়া সংসারের হাল ধরেছিল বুলবুলি। নাম বুলবু্লি হলে কী হবে, মুখে কথা শোনা যেত না তার। বড়ো চাপা, বড়ো শান্ত ছিল জলিলের বেটি। তাই তো, বাপের এত বড় জুলুমটাও মুখ বুজে সয়ে নিল মেয়েটা।
কতদিনই বা আগের কথা? এখনও ভাবলে বুকের ভেতরটা টনটন করে জলিলের। দুপুরে রাঁধাবাড়া সেরে বুলবুলি ঘাটে আসত তাকে খাবার দিতে। না জানি কী অজ্ঞাত কারণে ঠিক সেই সময়েই মহীনের ঘাটে আসার দরকার পড়ত। হয়তো তখন ঘাটে ভিড়, জলিল আর দুযযোধন দুজনেই এ পার ও পার করে চলেছে অক্লান্তভাবে। ছেলে-মেয়ে দুটিতে নদীর চড়ায় বসে থাকত, গল্পগাছা করত। একসঙ্গে এক গাঁয়ে বেড়ে উঠেছে দুটিতে। কে জানে কবে জলিল ও দুযযোধনের অজান্তেই ছেলে-মেয়ে দুটিতে নিজেদের মন দেওয়া নেওয়া সেরেছিল, তাদের বাপেরা টের পায়নি। ওদের বাপেরা যখন পারানির কড়ি গুনতে ব্যস্ত ছিল, ওরা দুটিতে এ পারের ঘর সাজানোর স্বপ্ন দেখছিল। জাতধম্ম গাঁ ঘরে লোকেরা মানে বটে, কিন্তু তাদের বাপেরা গলায় গলায় বন্ধু। সেই আশাতেই বোধ হয় স্বপ্নের গালিচা বিছিয়েছিল দুটিতে। বোকা অবোধ কিশোর কিশোরীদুটি বোঝেনি, ভিন ধর্মে বন্ধুত্ব বাধে না, কিন্তু ঘর বাঁধাও চলে না।
লুকোতে চেষ্টা করেছিল ওরা। কিন্তু প্রেম লুকোনো সহজ তো নয়। জলিল দেখে ঘরের কাজে মেয়ের মন নাই, উনানে বসানো ভাতে পোড়া গন্ধ ছাড়ে। যত লুকাতে চায়, মনের গোপন আবেগ চোখে ফুটে বেরোয়। দোরে উদাস হয়ে বসে থাকে বুলবুলি, নিজের মনেই হাসে, অল্পেতেই চোখ ছলছল করে ওঠে।
যৌবন একদিন জলিল মিঞারও ছিল। লক্ষণ চিনতে অসুবিধে হয় না তার। অপরাধী যুগলও ধরা পড়ে অচিরেই। বুক কেঁপে ওঠে জলিল মিঞার। হায় হায়, অবোধ ছেলেমেয়ে দুটো করেছে কী!
নদীর ঘাটে চুপচাপ বসে থাকে দুই বন্ধু। কেউ কথা কয় না। সেই কবে থেকে দুই বন্ধু এই নদীতে নৌকা বায়। কত দিন গেল, কত কিছু বদলালো চোখের সামনে। ফাতিমার ইন্তেকাল হতে উন্মাদপ্রায় জলিলকে তো সেদিন দুযযোধনই সামলেছিল। আবার দুযযোধনের বড়ো ছেলেটা যেদিন খেলতে গিয়ে জলে ডুবে মোলো, সেদিন তো জলিলই ডুব লাগিয়ে মরা ছেলেটাকে বুকে করে তুলে এনেছিল। ছেলের শোকে যখন দুযযোধনের বউয়ের প্রাণ যায় যায়, হামা টানা মহীনকে তো ফাতিমাই কোলে কাঁখে করে মাতৃস্নেহ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিল কতদিন। কিন্তু আজ যেন সবকিছু বদলে গেছে। দুই বন্ধু পাশে বসে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না কারও। চোখ তুললে দুজনেই দেখে অন্যজনের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, ঘৃণা।
না, মেয়ের বোকামির জন্য বন্ধুকে হারাতে চায়নি জলিল। কয়েকটা নির্ঘুম রাত কাটানোর পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। খানিকটা তাড়াহুড়ো করে মাসখানেকের ভিতরেই তিন গাঁ পরে পাত্রস্থ করেছিল বুলবুলিকে। ছেলে মাদ্রাসায় পাশ দিয়েছে, বাপের বিস্তর খেত জমি আছে। ফর্সা দীঘল সুন্দর ছেলে, টানা টানা মায়ামাখা চোখ। বিয়ের দিন যখন জামাইকে দেখেছিল জলিল, বুকটা তার ঠান্ডা হয়েছিল। ভাল থাকবে বুলবুলিটা। ছোটবেলার মন দেওয়া নেওয়া, সে তো কতজনারই হয়ে থাকে। সংসারের জোয়াল কাঁধে এলে ওসব কম বয়সের মন উচাটন ভুলতে সময় লাগবে না। নিশ্চিন্ত হয়েছিল জলিল আর দুযযোধন। দুজনের পুরোন বন্ধুত্বটা আবার ফিরে এসেছিল। মহীন মুখ শুকিয়ে ঘুরত বটে, কিন্তু সেদিকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি।
“এখান থেইকে কই যাবেন ফকিরসাহেব?” দাঁড় ঠেলতে ঠেলতে জিজ্ঞাসা করল জলিল।
ফকির ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা তার কানে গেল কি না বোঝা গেল না। জলিল উত্তরের অপেক্ষাও করেনি। এ শুধু কথা বলার জন্যই বলা। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের মনেই গুনগুন করে গান ধরে জলিল।
উজান গাঙের নাইয়া!
কইবার নি পাব রে নদী গেছে কতদূর?
যে কূল ধরলে চলেরে নদী সে কূল ভাইঙ্গা যায়।
গেয়ে চলে জলিল। সেই সুরের অব্যক্ত বেদনা নদীর স্রোতে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ভেসে যায় বহুদূর। রাতপরিরাও চুপটি করে কান পেতে শোনে এক পিতার সব পাঁজর নিংড়ানো হাহাকার। পথ পেরোয়, ঢেউ ভাঙে জলিল মাঝি। ক্লান্ত শরীর, ক্লান্ত মন। এই শরীরভাঙা ক্লান্তিটুকুই তার গুনাহগার। এই কান্না বুকে বয়ে বেড়ানোই তার শাস্তি।
অথচ সেই একদিন যদি চোখের জলের ধার বুঝত জলিল, আজ সবকিছু অন্যরকম হত। বুলবুলি পা জড়িয়ে ধরেছিল তার। দুয়ারে মাথা ঠুকেছিল। বারবার বলেছিল, ‘মরি যাব আব্বা, আমি মরি যাব।’
জলিল বোঝেনি। দশ গাঁয়ে কে কবে শুনেছে যে মোছলমানের বেটি হিঁদুর ঘরে যায়? দুযযোধনের ঘরে গোপাল ঠাউর আছে। সে ঘরে নেবে বুলবুলিকে? ওর হাতের ভাত খাবে? সেইসব কথাই মেয়েকে বলেছিল জলিল। রেখেঢেকে বলেনি। সেদিন তার উপর কোন জ্বীনের ভর হয়েছিল কে জানে! ফুলের মতো মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে ঘরে বন্ধ করে বাইরে থেকে আগল তুলে দিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে আর একটা কথাও বলেনি জলিলের সাধের বুলবুলি। পর-ঘরে যাওয়ার সময়েও চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ফেলেনি। শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল বাপের মুখের দিকে। সেই দৃষ্টিতে আগুন ছিল, ছিল গরল। বুলবুলির সেই দৃষ্টি আজো জলিলকে ঘুমোতে দেয় না।
জলিল বাপ। সে তো মেয়ের মন্দ চায়নি। মেয়ের খারাপ কোন বাপটা চায়? ভুল ভাঙল অচিরেই। সকালে দুটো পান্তা গিলে খেয়াঘাটে গেছিল জলিল। ঘন্টাখানেক পরেই মহীন এসেছিল ছুটতে ছুটতে। কুটুম গাঁ থেকে লোক এসেছে, জলিলকে খুঁজছে। লোকদুটোকে দেখে জলিলের বুক কেঁপে উঠেছিল কোন অজানা আশঙ্কায়। অপেক্ষা করার সময় ছিল না, মুখে রক্ত তুলে ছুটেছিল জলিল। ততক্ষণে সব শেষ। খেতে ছড়ানোর কীটনাশক পুরোটাই গলায় উপুড় করে দিয়েছিল জলিলের আদরের চিড়িয়া।
বোবা দৃষ্টি মেলে চোখ তুলে তাকিয়েছিল সে। মেটে উঠোনে শোয়ানো বুলবুলির নীল হয়ে যাওয়া শরীরটা ছোঁয়নি জলিল মাঝি। তাকাতে পারেননি মুখের দিকেও। ভয় হয়েছিল, কী জানি সেই দৃষ্টিটা সঙ্গে করেই পরপারে নিয়ে গেল নাকি বোকা মেয়েটা। শুধু হাত দুটো দেখেছিল, যে দুটো হাত দিয়ে একদিন বাপের পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিল বুলবুলি।
মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জলিলকে সেদিন অপমান্যি কম করেনি। সাতজনে সাত কথা শোনাতে কেউ ছাড়েনি। কিন্তু সেইসব কথা জলিলকে ছুঁচ্ছিল না। জলিল তাকিয়েছিল সদ্য গোঁফ গজানো একটা কচি মুখের দিকে। এই তো কদিন আগেই বরবেশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিল বুলবুলির পাশে। অথচ সেদিন উঠোনে বউয়ের মৃত শরীরের পাশে বসে লম্বা-চওড়া জোয়ান ছেলেটা রাতারাতি কেমন কুঁকড়ে গেছিল। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বুলবুলির মুখের দিকে। সেই মুহূর্তে চোখ জ্বালা করে উঠেছিল জলিলের। বিরবির করে বলেছিল, “ভুল হই গেল, মস্ত ভুল হই গেল।”
এক মুহূর্তও আর সেখানে না দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে গাঁয়ের পথ ধরে ছিল সেদিন জলিল।
“উইদিকের ঘাটে নৌকা লাগাও মাঝি”, ফকিরবাবার ডাকে সম্বিত ফেরে জলিলের।
“হ্যাঁ বাবা, এই লাগাই।”
নৌকা টানে জলিল। কাদার মধ্যে দাঁড় বিধিয়ে টেনে টেনে ঘাটে আটকাল সে।
“আসেন বাবা, হাত ধরেন আমার। ঘাটে বড় কাদা”, বলে হাত বাড়াল জলিল। ফকিরবাবা তার হাত ধরে নৌকা থেকে নামল। ঝোলা থেকে পারানি বের করতে হাঁ হাঁ করে উঠল সে।
“না না বাবা, গজব। আমার পাপ লাগবে। দোয়া করবেন বাবা”, বলে কানে হাত ছোঁয়াল জলিল মাঝি।
ফকির হাসলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে কাছাকাছি কোথাও অকাল-অঘ্রানে বিদ্যুৎ চমকাল। পিছু ফিরে কাদা ভেঙে এগোতে লাগলেন ফকিরবাবা। ধীরে ধীরে কালো আলখাল্লা পরা দেহটা মিলিয়ে গেল দূরে অন্ধকারে। জলিল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, তারপর বসে পড়ল কাদার উপরেই।
বিদ্যুতের আলোয় ফকিরবাবার টানা টানা মায়ামাখা চোখদুটো চিনতে ভুল হয়নি জলিলের। যেটুকু সন্দেহ ছিল মনে, শেষের হাসিটুকু দেখে সব মুছে গেছে। কানে এসেছিল বটে, বুলবুলির সেই সাতদিনের মরদ শোকেতাপে ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। কতবার ইচ্ছে হয়েছে খবর নেওয়ার। সাহস হয়নি জলিল মিঞার। ভেবেছে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে তার সামনে।
আজ এই নদীর বুকে মধ্যরাতে নিয়তি তাকে আবার এক দৃষ্টির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাতে দহন নেই, নেই ঘৃণা। অমন করে এক জনমের কান্না চোখে নিয়ে হাসতে সকলে পারে না। জলিলের বুকে কত যুগ ধরে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আংরার উপর যেন কোন অমিয়া সাগর ঢেউয়ের পর ঢেউ হয়ে বয়ে গেল। শুধু ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া সেই প্রবল ঢেউ হৃদয়ের কুলে সজোরে আঘাত করল। ডান হাত তুলে বুকটা চেপে ধরল জলিল মাঝি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো সুতীব্র কান্না বুক চিরে বেরিয়ে এল তার, “হায় আল্লাহ!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন