সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
“মা! আজ মোনালিসা দেখলাম, ছোট্ট ছবি। তিরিশ বাই একুশ ইঞ্চি মাত্র। ঘরের মাঝখানে বুলেটপ্রুফ কাচের ভেতর সাজানো। ওখানেই আরও অনেক ছবি আছে। সেগুলোও ভীষণ সুন্দর- বকবক করছিল পৃথা।
কল্যাণী শুনতে শুনতে আয়নায় নিজেকে দেখল। বহুকাল আগে একজন বলেছিল “তোমার এই এক চিলতে হাসি যেন চোখে লেগে থাকে। মোনালিসার মত” সেই থেকে মোনালিসার সঙ্গে নিজেকে কেমন একাত্ম করে ফেলেছিল কল্যাণী। বিয়ের পর সমরকে বলেছিল মোনালিসাকে দেখার সাধের কথা। সে হেসে বলেছিল এহ, আগে জানলে বড়লোক কোনো বন্ধু ধরে গছিয়ে দিতাম তোমাকে। ছিটকাপড়ের ব্যবসাদারের বউ হতে হত না।
তাই এতবছর পরে যখন পৃথা বলল মুকুল বলেছে হানিমুনে প্যারিস যাবে, কল্যাণী বলেছিল মোনালিসাকে দেখে আসিস।
শুধু দেখেই আসেনি, মেয়ে লুভ্র মাষ্টারপিসের ওপর একটা বই এনেছে গিফটে যাতে ছবিতে অন্তত মায়েরও ঘোরা হয়ে যায়। পাতার পর পাতা অজানা মানুষ আর তাদের চেনা অভিব্যক্তি দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। কল্যাণী বইটা নিয়েই শুতে যায়। ঘুমের মধ্যে দেখে সে আর মোনালিসা এক অজানা জায়গায় হাঁটু অবধি জলে ডুবিয়ে বসে আছে। মোনালিসা বলছে, আমার বরের ছিল সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা। আমি তার তিন নম্বর বউ ছিলাম। এই ছবিটা সে নেয়নি। অসমাপ্ত ছবি নেবে কেন বল?
“ভালোবাসত খুব?”
মোনালিসার ঠোঁটে সেই হাসি, মুখময় অজস্র ফাটল। বলে ব্যবসা, রাজনীতি এসব করে ভালোবাসার সময় থাকে?
ঘুম ভেঙ্গে যায় কল্যাণীর। জল তেষ্টা পায়। সমরকেও তো রাজনীতি করতে ডেকেছিল। রাজী না হওয়ায় পার্টির লোকজন এসে চিৎকার করছিল রক্তচোষা বাদুর বলে। ঠাসা কাপড়ের থানের গরমের মধ্যে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিল সমর। রক্ষা হয়নি তাও। শাটারের ওপর পোষ্টার লাগিয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল ওরা। শেষে কল্যাণীর চুরিগাছা বাঁধা দিয়ে পার্টি ফান্ডে টাকা, বনধের দিনে দোকান বন্ধ করে ঝান্ডা হাতে হাঁটার মুচলেকা দিয়ে শাটার তুলিয়েছিল। পরে ওই মিছিলে গিয়েই কী করে বুকে লাঠির গুঁতো খেয়ে আর দাঁড়াতে পারল না। মাঝেমাঝেই রক্তবমি হচ্ছিল। বড় ডাক্তার, এক্সরে ওষুধ করে করেও চারটে বছরই ছিল। কী ভাগ্যি মেয়েটা পড়াশুনোয় ভালো ছিল। দাঁড়িয়ে গেছে নিজের পায়ে।
বইয়ের মলাটে মোনালিসার হাসিমুখ যেন অল্প নড়ে ওঠে – কষ্ট হয় কল্যাণী?
হয়। মানুষটা মেয়ের এই সৌভাগ্যটুকু দেখল না এটাই বড় কষ্ট।
আহা ভালো থাক মেয়ে। আমার সন্তানদের মধ্যে দুটিকে হারিয়েছিলাম জান?
কল্যাণীর মনে হয় মোনালিসার মুখের ফাটলগুলো যেন আর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ছবির ওপর হাত বুলিয়ে কল্যাণী বলে এসো, ঘুমোই একটু।
সারাদিনে হাতের কাজ তাড়াতাড়ি সারে কল্যাণী। একার সংসারেও কাজের বিরাম নেই।
কী খেলে? মোনালিসা জিজ্ঞাসা করে
ভাত, মুসুরির ডাল, কুমড়ো পটলের ডালনা…
দুপুর গড়িয়ে আসে। মোনালিসার মুখের ফাটলগুলো নরম হয় কল্যাণীর গল্প শুনতে শুনতে। সেই যে কে যেন বলেছিল সে মোনালিসার মত, যে কথা কেউ জানেনা, সেই কথা শুনে মোনালিসার হাসি চওড়া হয় ।
কল্যাণী বলে তুমি অমনি ঠোঁট টিপে হাস কেন? এই তো এমন একমুখ হাসিতে তোমাকে আরও ভালো দেখায়।
আমাদের সময়ে লোকে বলত কেবল বোকা আর বেশ্যারাই অমনি মুখ খুলে দাঁত দেখিয়ে হাসে। সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়েরা অমনি দাঁত দেখাত না তখন।
ওঃ তুমি যে অন্য সময়ের এ কথা আমি ভুলেই যাই- কল্যাণীও অল্প হাসে।
সন্ধে নাগাদ পৃথা ফোন করে। মা, কেমন আছ? কাল যাব তোমার ওখানে। জানি বাড়িতেই থাকবে তাও বলে রাখলাম। ফ্রি আছ তো?
কল্যাণী খুশি হয়। বলে আমার আবার কাজ কী?
বইয়ের মলাটে মোনালিসার ছবিটা কি একটু করুণ দেখায়?
সে দিকে তাকিয়ে কল্যাণী মেয়েকে বলে আসিস, কাল আমার এক নতুন বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন