micro-story-gaaner-opare

গানের ওপারে…
সুনৃতা মাইতি


নিত্য সময় ঘরের মধ্যে কাটানোর ফলেই হোক বা পরিণত বয়সের কারণেই হোক, বেশ কিছু অদ্ভুত বোধ গড়ে উঠেছে কুহুর। এটা কি সপ্তম ইন্দ্রিয় বোধ বলা যেতে পারে? স্বাদের ক্ষেত্রে যেমন উমামি বলে একটা নতুন স্বাদসূচক এসেছে, অনেকটা ঠিক সেইরকম কি! ঝাল, মিষ্টি, টক, নোনতা, তেতোর পর উমামি!

যেমন ধরো ইদানিং কলিং বেলের শব্দ শুনলেই সে বুঝে যায় কে এসেছে। তার মেয়ে একনাগাড়ে দু- তিন বার কলিং বেল বাজাবেই বাজাবে। উফ! এই জেনারেশনের মধ্যে ধৈর্য্য ব্যাপারটার যে কি অভাব! আবার মেয়ের বাবা অতি নিপাট ভদ্রলোক। তিনি একবার বেল বাজিয়েই ভেতরের মানুষের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করেন বেশ কিছুক্ষণ। এগুলো চেনা। বাকি খবরের কাগজওলা থেকে দুধওলা বা অচেনা ডেলিভারি বয়, একেকজনের বেল বাজানোর ধরন একেকরকম। কুহুর মেয়ে ঠাট্টা করে বলে,” বেল বাজানোর ধরন দেখেই তুমি কি বুঝে যাও আমাজন না ফ্লিপকার্ট!”

তবে আজকাল কুহু এই সেন্সের প্রয়োগ করে বাড়িতে মেয়ের তত্বাবধানে বেজে চলা গানের ফিরিস্তি থেকেও অনেককিছু আঁচ করতে পারছে। গান ব্যাপারটা অবশ্যি কুহুর বড় পছন্দের। নিজে সেরকম পরিপাটি করে গাইতে না পারলেও গাইবার চেষ্টা করে এসেছে চিরকাল। তবে দু লাইনের বেশি গাইতেই পারেনা ঠিকঠাক। শুনতে কিন্তু খুবই ভালোবাসে। আজকাল মনে হয় গানের সাথে পারিপার্শ্বিক জগতের কিছু নিবিড় যোগসূত্র অবশ্যই আছে। এই দার্শনিক কথাটি মাথায় আসবার সঙ্গে সঙ্গেই কুহুর সান্টুদার কথা মনে পড়েছিল। আর সাথে বেদম হাসিও।

ছোটবেলায় পাশের বাড়ির ইনুদি কার সাথে একটা পালিয়ে গিয়েছিল। তখন প্রেম করে পালানো টালানো ব্যাপার বেশ ইন ভোগ ছিল। কুহুদের আরেক প্রতিবেশী বজ্জাত সান্টুদা তখন কয়েকদিন নিয়ম করে টেপরেকর্ডারে ওই গানটা চালাত।

“আরে ছো! ছো !ছো! কেয়া শরম কি বাত, ভদ্দর ঘরকি লেড়কি ভাগে ডেরাইভার কে সাথ…”

সান্টুদা নিজেও বা কি এমন ধোয়া তুলসিপাতা!মেয়ে দেখলেই বলতো, ইলু…ইলু…। ইলু ইলু গানটা যে কি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল তাদের ছোটবেলায় ! এখন শুনলে কি বোকাটেই যে লাগে!

সে যাই হোক, এই বাড়িতে বেজে চলা গানের খসড়া থেকেই একদিন হঠাৎ কুহুর মনে হলো মেয়ে প্রেমে পড়েছে। যেমন তেমন প্রেম নয় জব্বর প্রেম। প্রেম-টেম জাতীয় ব্যাপারের নাম শুনলেই কুহুর প্রবল ভয় হয়। যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল বয়সকালে! মনে মনে প্রমাদ গোনে সে। মেয়ে আজকাল যে সব গান শুনছে তা খুব ঝমঝমে নয়…বরং বেশ মৃদু আর মায়াবী। যেমন ধরো, তুঝে ইয়াদ কর লিয়া হেয় আয়ত কি তরহা কিংবা কেশরিয়া তেরা ইশক হেয় পিয়া…। কি অপূর্ব সব কথা!

তুঝে ইয়াদ কর লিযা হ্যায় আয়ত কি তরহা
কায়েম তু হো গয়ী হেয় রিবায়ত কি তরহা…

আর মাহিয়ে যেয়সা সোনা! এটা তো একটা পঞ্জাবি গান! ছোটবেলায় কুহুর মামাবাড়ির টিভিতে সর্বক্ষন একটি পঞ্জাবি গানের চ্যানেল চলতে থাকত। কারণ তখন ওই চ্যানেলটা ফ্রি ছিল। কি সাংঘাতিক! তখন থেকেই কুহুর পঞ্জাবি গানের ওপর একটা অ্যাপাথি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই গানটা মন দিয়ে শুনতে ভারী ভালো লেগেছিল তার। আজকাল কুহু সব কিছুকেই ভারী বিবেচনা করে গ্রহণের চেষ্টা করে। এটা কি বয়সজনিত ব্যাপার! তবে বয়স হলে তো মানুষ খানিক রিজিড হয়ে যায়, তার ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা!

ওহ ইটস লাভ অর সামথিং লাইক দ্যাট…। এই গানটা প্রায়ই শুনত মেয়ে। কয়েকদিন কান খাড়া করে লিরিকস গুলো বোঝবার চেষ্টা করেছিল কুহু। গানটা টিভিতে ইউ টিউব কানেক্ট করে একদিন দেখছিল তার মেয়ে। পড়বি তো পড় সে সময়ই কুহুর নজরে পড়ল ভিডিওটা। বেশ একটা ছবি আছে তো গানটাতে! কেমন যেন চেনা সব ছবি! যেমন কফি হাউসে বসে থাকা ক্যাবলা একটি ছেলে ঘাবড়ে টাবড়ে কফি ফেলে দিলো জামায়; কিংবা ট্যাক্সি ড্রাইভারের চোখ বাচিয়ে গার্ল ফ্রেন্ডের গালে টকাস করে খেল একটা চুমু…। ধুত্তেরি! সবই তো সেই কুড়ি বছর আগের কথা …। কিন্তু কথা হলো এইসব পুরোনো স্মৃতি উসকানো গানটা এখনকার দিনে গাইছে কে? আজকাল জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়াটা একেবারেই কষ্টসাধ্য নয়। কুহু তার মেয়ে শিনীবালিকে গায়িকার নামটা বলতেই একটু ধাক্কা খেলো। দোষের মধ্যে গুগল সার্চ করে কুহু জানতে পেরেছিল গায়িকার নাম অলিভিয়া রডরিগেজ! মেয়ে বলল,

…উহু! মা তুমি কি বোকা! ওটা তো রডরিগো। তুমি তো ওই প্যানপেনে রবী- গানগুলোর বাইরে কিছু জানোনা। হঠাৎ এই গানটা নিয়ে এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছ যে!

কেন উৎসাহ দেখাচ্ছে তা নিয়ে আর বিস্তারে গেল না কুহু। চেপে যাওয়াই ভালো, আবার কেঁচো খুঁড়তে সাপের পাঁচ পা দেখতে পেলে পোলাপান মাথায় চড়ে নাচবে।

কুহুর বাড়িতে স্পিকারে কিংবা টিভিতে ইউ টিউব কানেক্ট করে গান শোনা নিয়ে নিদারুণ সব ঝামেলা হয়ে গেছে। অবশেষে একটা নিয়ম চালু করা গেছে সর্বসম্মতিক্রমে। যেমন ধরো সকালের দিকটা কুহুর। সে কাজ করতে করতে এবং রান্না করতে করতে রবী ঠাকুরের গান শোনে। আসলে কিনা যতো বয়স বাড়ছে রবী ঠাকুরের গানকে ততই যেন আকঁড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তার। প্রতিটি লাইন যেন নতুন নতুন অর্থ নিয়ে ধরা পড়ছে নিত্যদিনের কাজের মাঝে। পেন ড্রাইভে পছন্দের গান ভরা থাকে তার। কাজের সময় কিংবা দিনান্তে বিশ্রাম নেবার কালে সে ইদানিং নিয়ম করে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে। আবার কুহুর মেয়ে শিনীবালি কলেজ থেকে ফিরে জগঝম্প সব গান শোনে। ইংরেজি গানের লিরিকস বোঝা এমনিতেই দুষ্কর। তবু রোজ রোজ কানের কাছে সেই ভাষা বাজলে কিছুতো বোঝা যায়। এখন আর খুব একটা খারাপ লাগে না গানগুলো, একেক সময় নিজের অজান্তেই কোমর দুলে ওঠে, হঠাৎ শরীরে ছন্দের স্পর্শ টের পায় সে। গান কি খুব একটা ভাষার মুখাপেক্ষী? কুহুর মনে হয় তা অনেক সময় তো বটেই। সুর আর কথার মেলবন্ধনেই তো গান।

কিন্তু মেয়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। কুহুর বাবার সাথে কথা বলবে? তিনি যা ব্যস্ত মানুষ! এখন কেরিয়ারের কথা চিন্তা করবে কি মেয়ে এইসব নিয়ে পড়েছে! এটা কি ঠিক? ঠাকুরপুজো দেওয়ার সময় সে বেশ কয়েকদিন ঠাকুরকে জল -বাতাসা দিয়ে আর্জি জানালো,

এইসব আবোগ্দা প্রেমটেম কাটিয়ে দাও ঠাকুর! সামনের সেমিস্টারে প্লেসমেন্ট হবে, এখন সি জি পি নেমে গেলে ঘোর কেলো!

তার কিছুদিন পরেই হঠাৎ করে কুহু দেখতে পেল মেয়ে খানিক মুষড়ে পড়েছে কেমন ধারা! গান শুনছে না। যাও বা শুনছে কেমন যেন হতাশার আভাস তাতে। আই ওয়স আ লায়ার…আই গেভ ইন্টু দ্য ফায়ার….কিংবা ও বেদরদেয়া….এটা কি অরিজিৎ সিং এর গাওয়া? হেভি তো গানটা!

তারপর হঠাৎ একদিন একেবারে শান্ত আর গম্ভীর হয়ে গেল তার উচ্ছল মেয়ে। গান শোনা বন্ধ হলো রাতারাতি। একদিন দেখা গেল দিনের বেলা পর্দা টেনে শুয়ে আছে সে। বিস্তর ঘাবড়ে গেলো কুহু। এসব লক্ষন তার বেশ চেনা। তার বেলায় কেউ ছিলোনা বোঝার মতো। দৌড়ে গেল সে মেয়ের ঘরে। আর মায়ের কোলে মুখ গুঁজে অনেকটা কাঁদল শিনীবালি। কিছু জিজ্ঞাসা করলো না কুহু…কিছু না। শুধু নিজের মনকে ধিক্কার দিল। কেন যে ঠাকুরের কাছে ওইরকম প্রার্থনা করেছিল সেইদিন। মেয়েটার এই কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না।

রাতে মেয়ের বাবা ফেরেননি তখনও। তিনি কি এক অফিসিয়াল পার্টিতে গেছেন। কুহু বসার ঘরের সোফা কাম বেডে রজাই মুড়ে আধশোয়া হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছিল। মনটা বড্ড নিমিঝিমি হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার কথা ভাবলেই। এমন সময় মেয়ে আসছে দেখে সাউন্ড সিস্টেমের রিমোটটা সে বিনা বাক্যব্যায়ে মেয়ের হাতে গুঁজে দিতে গেল। শুনুক না হয়। কিন্তু রিমোটে কোনও উৎসাহ নেই মেয়ের তখন। সে তখন মায়ের রাজাই এর তলায় ঢুকে গেল সুড়সুড় করে। আর মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। সাউন্ড সিস্টেমে তখন রবী ঠাকুর বলছেন …

তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে…….

তোমার সুধা রসের ধারা গহনপথে এসে
ব্যাথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে।

কিমাশ্চর্যম! মেয়েও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে! গান শুনতে শুনতে মেয়ের শরীরের অল্প অল্প স্পন্দন পরিষ্কার বুঝতে পারছে কুহু। মেয়ের চোখ বুজে গেছে , চোখের কোল বুঝি চিকচিক করছে অল্প!

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *