মৌসুমী ঘোষ
যে লোকটাকে আমি খুঁজে বার করব বলে দেউলিয়া ফুলের বাজারে গেছিলাম সে লোকটাকে এবারও পেলাম না। ঐ লোকটাই প্রথম বলেছিল, ফুলের চাষে অনেক হ্যাপা। মাটি কোপানো, সার দেওয়া, কলম বাঁধা, নিড়ানো; পোকার উপদ্রব হলে তো আরোই গেল।
সেবার গাড়ি নিয়ে বম্বে রোড দিয়ে আসার সময় কোলাঘাট পেরিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। একটা চায়ের দোকান দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা কোন জায়গা?
চায়ের দোকানটাতে বসেছিল লোকটা; বলেছিল, দেউলিয়া। অনেকদিন আবছা আবছা লোকটার মুখটা মনেও ছিল। তবে এখন আর খেয়াল নেই সে নিজের কোনো নাম বলেছিল কিনা।
সেদিন ঐ লোকটাই বলেছিল, আমাদের গ্রামে ফুল-চাষ হচ্ছে হালে। এখন এ গ্রামের ষোলো-আনাই ফুলচাষী। আগে ধান চাষ হতো। এখন আমরা সবাই ধান কিনে খাই।
লোকটার বর্ণনা শুনে চায়ের দোকানের ছেলেটা বলল, হাইওয়ে ফোর-লেন হবার সময় কত দোকান গুঁড়িয়ে গেছে বুলডোজারের চাপে। আপনি কি মধু চাচার কথা বলছেন? উনি এখন কোলাঘাট থেকে ভোরবেলায় যে ফুলের লোকালটা হাওড়া যায় তাতে ফুল নিয়ে যান।
একদিন ভোরবেলা দেউলিয়া স্টেশনে গেলাম লোকটাকে খুঁজে বার করতে। ঐ লোকটা বলেছিল, আমি নিজে এক ধরণের নতুন গোলাপ চারা তৈরি করছি। গোলাপের ওপর দিকের রং হবে গেরুয়া, মাঝে সাদার ওপর নীলের ছিটছিট আর নিচটা সবুজ। একটা চারার দাম- পাঁচশ টাকা। আমি আপনাকে কম দামে দেব। ফুলটা বসন্তে ফোটে। চারাটা পুঁততে হয় বৃষ্টির মরসুমে। শীতে কুঁড়িতে ভরে যায় গাছটা।
ট্রেনের খবর হল। পাশের ছেলেটা বেল, রাই বেল, মোতিয়া বেল নিয়ে কথা বলছিল তার পাশের ছেলেটার সঙ্গে। আমি ওদের পিছু পিছু ট্রেনে উঠলাম। আমি ওদের লোকটার খোঁজ করতেই বলল, মধু চাচা না মাধব কাকা? মাধব কাকা নামে দেউলিয়ার একজন হাওড়ার মল্লিকবাজারে বসে কিন্তু মাধব কাকা তো যাতায়াত করে না, ওখানেই থাকে!
একটা পাগল বিড়বিড় করছিল, সব বিলিতি চারা। ট্যালিস্ম্যান, স্নো-হোয়াইট, গোল্ডেন ফেয়ারি। হঠাৎ বলে উঠল, ডেভিড, ওর নাম ডেভিড।
লোকটাকে খুঁজতে মল্লিকবাজার গেলাম। বাজারটা বসন্তের তাজা ফুল আর শীতের পচা ফুলে ছয়লাপ।
খানিক দূর থেকে দেখলাম এক জায়গায় লোকটা একজন খরিদ্দারকে বলছে, দামের আর দোষ কি বলুন? ফুল সরাসরি চাষীর হাত থেকে তো আপনার হাতে আসছে না। চাষী চালানদারকে বেচছে, চালানদার পাইকারকে বেচছে, পাইকার দোকানদারকে বেচছে। দোকান থেকে আপনি পাচ্ছেন। অর্থাৎ চার ধাপে দশগুণ দাম তো বাড়ছেই।
আমি লোকটাকে বললাম, দাদা চিনতে পারছেন? আপনি সেবার দেউলিয়া বাজারে বসে আমাকে যে গোলাপ চারা গাছটা দেবেন বলেছিলেন সেটা নিতে এসেছি।
লোকটা চারাগাছের ডাঁই থেকে চারাগাছ তুলতে ঝুঁকেছিল। বলল, আপনার সঙ্গে আমার আগে কোথায় দেখা হয়েছিল বললেন?
– দেউলিয়ায়, চায়ের দোকানে।
চারা গাছের ডাঁই থেকে একটা চারা আমার হাতে দিয়ে বলল, চেনা দিয়েও লাভ নেই, দাদা। দাম পঁচিশ টাকার থেকে এক পয়সাও কম নিতে পারব না।
পাঁচশোর বদলে পঁচিশ! আমার কী রকম গুলিয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকাতেই দূরে আর একটা ফুল বিক্রেতাকে দেখে মনে হল, ঐটাই সে লোকটা যাকে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর চলে এসেছি। কাছে যেতেই সে ঠিক চিনতে পারল আমায়। বলল, আর কীভাবে আপনাকে দেব সেই গোলাপ চারা? প্রথমে বুলবুল তারপর ফণী। তার পরের বছর কোভিড আর আমফান। এত দাপট সামলাতে না পেরে একে একে গ্রামের ষোলো-আনাই এখন পান-চাষী। আমি ফুল ছেড়ে থাকতে পারিনা বলে এখানে পাইকারের ফুলের দোকান সামলাচ্ছি। পাশের গুমটিতে ছেলে পান বেচে। নিয়ে যান এক গোছ মিঠা পাতা।
ফুলের বাজার থেকে একহাতে চারা আর এক হাতে পান নিয়ে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশনে এসে ট্রেনে চাপলাম। কোনো একটা স্টেশানের ধারে একটা পলাশ ফুলের গাছ দেখে মনে হল, লোকটার সঠিক নাম তো জানা হল না! যে লোকটা বসন্তকালে অন্য রকম গোলাপ ফোটাতো, সে কি মধু না মাধব না ডেভিড না অন্য কিছু!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভীষণ ভালো লাগল মৌসুমী। একদম অন্যরকম বিষয়। বুননও চমৎকার!
কিছু গল্পের অভিঘাত এমন মারাত্মক হয়। কী অদ্ভুত গভীর গল্পটা! এইটুকু আয়তনে, কিন্তু পরিসরে যোজনবিস্তৃত! আর কী অদ্ভুত মায়াবী চলন গল্পটার। অপূর্ব লাগল। সত্যি বলতে ছুঁল গল্পটা।