prabandho-amader-sahityo-kobe

আমাদের সাহিত্য কখন স্বাধীন হবে?
জাকির তালুকদার


ইংরেজরা বলে, ঈশ্বরের পরে সবচেয়ে বেশি মানুষ সৃষ্টি করেছেন শেক্সপিয়ার। কথাটা অমূলক নয়। শেক্সপিয়ারের নাটকে অসংখ্য চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। বিখ্যাতদের কথা বাদ দিলেও তাঁর নাটকের কোরাস দল, বিবেক দল, ভূতের দল পর্যন্ত এখনো আমাদের সাথে পৃথিবীতে বসবাস করে। ইশ্বরের সৃষ্ট মানবের মৃত্যু ঘটে। অল্পকিছু মানুষ বাদ দিলে বাকি সবাই কবরে শোয়া বা চিতায় ওঠার পরমুহূর্তেই জীবিতদের জগৎ, মন, জীবন থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু শেক্সপিয়ারের সৃষ্ট মানুষগুলো শত শত বছর পেরিয়েও আমাদের কাছে জীবন্ত।

পৃথিবীর বিরাট অংশের লেখাপড়াজানা মানুষের মনে জীবন্ত। কেউ কেউ অলক্ষে ছাপ রেখে যায় মানুষের জীবন যাপনেও। মহান স্রষ্টা শেক্সপিয়ারের এ এক অসাধারণ কৃতিত্ব এবং প্রাপ্তিও বটে।

বাংলাসাহিত্যে কি এমন চরিত্র নেই?

বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা, কমলাকান্ত? রবীন্দ্রনাথের অমল, রতন? মীর মশারফ হোসেনের মোহাম্মদ হানিফা? মানিক বাঁড়ুজ্জেরর ভিখু? মানিকেরই হোসেন আলী, কপিলা, কুসুম, শশী ডাক্তার? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র মজিদ? তারাশঙ্করের দেবু, কবি নিতাই? বিভূতিভূষণের অপু, দুর্গা? এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে। অসংখ্য না বলা গেলেও পর্যাপ্ত সংখ্যকই আছে বলা যায়।

কিন্তু তারা বাঙালি পাঠক ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার মানুষের কাছে পরিচিত নয়। কেন নয়?

শেক্সপিয়ারের সাহিত্যিক মহত্ব স্বীকার করতেই হবে। সেইসাথে এই সত্যটিকেও স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক বর্বর সফলতা, এবং অর্ধেক পৃথিবী জয় করাও একটি বড় কারণ। ইংরেজরা যে দেশকেই পদানত করেছে,সেখানেই চালিয়েছে লুণ্ঠন, ভেঙে দিয়েছে সেসব দেশের স্বকীয় সভ্যতা, সমাজব্যবস্থা, উৎপাদনকাঠামো। বিজিত দেশের শিল্প ধ্বংস করে তাদেরকে বানিয়েছে কাঁচামালের সরবরাহকারী এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার। অর্থনৈতিক ক্ষতির সাথে সাথে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে সেদেশের সংস্কৃতির, সাহিত্যের, শিল্পকলার। নিজেদের আগ্রাসনের বৈধতা নিয়েছে পোপের কাছ থেকে এই বলে যে, হিদেন পশ্চাৎপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতিগুলোর কাছে তারা নিয়ে যাচ্ছে বাইবেলের আলো। তবে শুধু বাইবেল নয়, নিয়ে গেছে নিজেদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও। উদ্দেশ্য কিন্তু ইংরেজিসাহিত্যের মহত্ব প্রচার নয়, বরং এটাই দেখানো যে– ‘তোমাদের সাহিত্য নিকৃষ্ট। তাই তোমাদের আত্মস্থ করতে হবে ইংরেজি সাহিত্যকে। আদর্শ হিসাবে মেনে নিতে হবে ইংরেজি সাহিত্যকে। অনুকরণ-অনুসরণ করতে হবে ইংরেজি সাহিত্যকে’। আমাদের দেশে খুব পরিচিত লর্ড মেকলে-র একটি উক্তি মনে করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন– ‘আমাদের ইংল্যান্ডের লাইব্রেরির একটিমাত্র সেলফে যে জ্ঞানের সমাহার রয়েছে, প্রাচ্যের সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার জড়ো করলেও তার সমান হবে না।’ সেই সেলফ-এর জ্ঞানভাণ্ডার পৌঁছে দিতেই যেন তাদের ভারতবর্ষ দখল। অর্ধেক পৃথিবী দখল। শেক্সপিয়ার যে যোজন যোজন দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছেন, তা সম্ভব হয়েছে যেসব কারণে, তার অন্যতম কারণ ইংরেজদের এই উপনিবেশ নির্মাণ। শুধু নাটক দেখিয়ে তো শেক্সপিয়ারকে জনগণের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে তারা পারত না। সেটি নিশ্চিত করেছে স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে শেক্সপিয়ারকে ঢোকানোর মাধ্যমে। মিল্টন-বায়রন-শেলি-কীটস সবার প্রসঙ্গেই একই কথা প্রযোজ্য। তবে আমরা শেক্সপিয়ারের কথাই বলছি শুরু থেকে তাঁকে উদাহরণ হিসাবে উপস্থিত করার কারণেই। এতে বাঙালির বা ভারতবাসীর লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে, সে বিচারে আমরা এখন যাচ্ছি না। আমরা বলছি একজন লেখকের আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী সহযোগিতার কথা। শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা এবং সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে কীভাবে উপনিবেশের মানুষগুলোকে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে বিজাতীয় চিন্তার অনুসারী বানানো হয়, তা আমরা এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে দেখেছি। দেখেই চলেছি। চিনুয়া আচেবে আফ্রিকার কালো মানুষ। অথচ তাকে শৈশবে ইংরেজ-পরিচালিত স্কুলে কীভাবে মগজ ধোলাই করা হয়েছিল তা নিজেই বর্ণনা করেছেন। ট্রেজার আইল্যান্ড, অলিভার টুইস্ট, হেনরী রাগার হ্যাগার্ডের অ্যাডভেঞ্চার বইগুলোতে সাদাদের বীরত্বের কাহিনী আছে। আর সেই বইগুলোতে কালো আফ্রিকান মানেই জংলি, কুসংস্কারচ্ছন্ন, আদিম, অশিক্ষিত। কিন্তু মগজ ধোলাই এমনই জিনিস যে আচেবে নিজের অজান্তেই ঐসব অ্যাডভেঞ্চারের নায়কদের পক্ষ নিয়ে নিতেন মনে মনে। ঘৃণা করতে শিখেছিলেন নির্যাতিত কালো মানুষদের। অনেক বছর পরে তাঁর বোধোদয় হয়। লিখছেন– ‘কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস পড়ে আমি উপলব্ধি করেছি সমুদ্রতটে লম্ফ-ঝম্পরত ঐসব আদিমদের মধ্যে আমিও আছি ’।

নগুগি ওয়া থিয়েঙ্গোর অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। ১৯৫২ সালে যখন আমাদের দেশের মানুষ মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, সালাম-রফিক-বরকত রক্ত দিচ্ছেন রাজপথে, সেই সময় কেনিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইংরেজদের শিক্ষানীতির মাধ্যমে পরিচালিত করার আদেশ জারি হয়। তখন নিজেদের মধ্যেও মাতৃভাষা গিকুয়ুতে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নগুগি লিখেছেন– এ সময় সবচেয়ে কষ্টের ছিল স্কুল প্রাঙ্গনে গিকুয়ু ভাষায় কথা বলে ধরা পড়ার অভিজ্ঞতা। দোষী ছাত্রটিকে শারীরিক শাস্তি দেওয়া হতো– নগ্ন পাছায় তিনটি বা পাঁচটি করে বেত্রাঘাত– অথবা ধাতব একটি প্লেট বহনে বাধ্য করা হতো যাতে লেখা থাকত আমি মূর্খ অথবা আমি গাধা। মাঝে মাঝে দোষী ছাত্রদের জরিমানা করা হতো এত বেশি পরিমাণে যে যে তাদের পক্ষে তা জোগাড় করা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার।

অন্যদিকে কথ্য বা লিখিত ইংরেজিতে যে কোনো পারদর্শিতাকে ভীষণভাবে পুরস্কৃত করা হতো। পুরস্কার, সম্মান, প্রশংসা, উচ্চতর জগতে যাওয়ার টিকেট। কলা, বিজ্ঞান এবং পড়াশোনার অন্যান্য শাখাগুলোতে মেধা এবং সক্ষমতার একমাত্র পরিমাপক হয়ে দাঁড়াল ইংরেজি জানা। সাহিত্যের লেখাপড়া তখন নির্ধারিত হতে লাগল নিয়ন্ত্রক ভাষার দ্বারা সমানভাবে এর আধিপত্যকে আরো শক্তিশালী করার মাধ্যমে। কেনিয়ার ভাষায় চর্চিত কথ্যসাহিত্য বন্ধ হয়ে গেল। প্রাথমিক স্কুলে রাইগার হ্যাগার্ডের পাশাপাশি আমাকে পড়তে হতো ডিকেনস এবং স্টিভেনশনের সহজপাঠ। জিম হকিন্স,অলিভার টুইস্ট, টম ব্রাউন– খরগোশ, চিতা, সিংহের গল্প নয়– যেগুলো ছিল আফ্রিকান শিশুর কল্পনার জগতের নিত্যদিনের সাথী।

মাধ্যমিক স্কুলে স্কট, জি বি শ, জন বুকানন, অ্যালেন প্যাটন, ডব্লউ ই জোনস। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাহাম গ্রিন থেকে চসার, টি এস এলিয়ট পর্যন্ত’।

এমন শিক্ষা একজন শিশু বা কিশোরের মনে কোন ধরনের মনোভাব তৈরি করে দেয় তা দেখা যাক চিনুয়া আচেবের বর্ণনা থেকে– ‘আমার মনে আছে যখন বড় হচ্ছিলাম তখনকার কথা। অন্যদেরকে আমরা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতাম।’। নিজেদের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাচ্ছিল ‘অপর’ একটি শ্রেণী, যারা ইংরেজি-শিক্ষিত নয়।

খুব চেনা চেনা লাগছে না কথাগুলো? লাগারই কথা।

কারণ আমরা বাংলাদেশে বাস করছি ঠিক এমনই একটি সমাজকাঠামোর মধ্যেই। আমাদের পরিবেশ একই রকম আছে। যদিও এইদেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। এমনটি কেন হলো? ইংরেজি শিক্ষার জন্য? না। ইংরেজি-শিক্ষিতদের আলাদা একটি শ্রেণী হিসাবে তৈরি এবং তাদের ক্ষমতার সর্বত্র অধিষ্ঠিত করে রাখার ফলাফল আমাদের বর্তমান দুর্দশা। সেই শ্রেণীটিকে অভিজাত হিসাবে প্রচার করা হয়েছিল। তারা মেকলে-কথিত সেই শ্রেণী যারা গাত্রবর্ণে ভারতীয়, কিন্তু মননে ইংরেজ। কোন ইংরেজ? উপনিবেশিক ইংরেজ।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ছোট ইংরেজ বা নীচুশ্রেণীর ইংরেজ’। তাদের হাতেই শাসনভার তুলে দিয়ে আপাত প্রত্যক্ষভাবে বিদায় নিয়েছে ইংরেজরা। কিন্তু বাংলা-ভারত-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলো পরিচালনা করছে সেই ছোট ইংরেজরাই বা নীচুশ্রেণীর ইংরেজরাই। যারা গাত্রবর্ণে স্বদেশীয়, চিন্তায় ইংরেজ-অনুগামী। আফ্রিকার সাহিত্যিকরা চিনতে পেরেছেন এই শাসক শ্রেণীকে। তাই লিওপোল্ড সেঙ্ঘর, ফ্রান্জ ফ্যানো, এইমে সেজেয়ার, নাগিব মাহফুজ, চিনুয়া আচেবে, ওলে সোয়েঙ্কা, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গে, ওসমান সেমবেন, তায়িব সালিহ-রা কোনো কলোনিয়াল হ্যাংওভারে ভোগেন না। পশ্চিম সবসময় বলে– ‘আমাদের মতো ভাবো, আমাদের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখো, এবং সেইসঙ্গে নিজেকেও’। আমরা বাংলাদেশ-ভারতবর্ষের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ পশ্চিমের কথা মেনে চলি। কিন্তু আফ্রিকার লেখকরা সেভাবে দেখতে অস্বীকার করেছেন। সেই কারণেই তায়িব সালিহ সৃষ্টি করতে পারেন মুস্তাফা সায়ীদের মতো চরিত্র, যে অর্থনীতির তুখোড় ছাত্র এবং পণ্ডিত হয়ে ইউরোপ জয় করে, ইউরোপের শ্বোতাঙ্গ যুবতীদের একের পর এক ভোগ করে, সে তাদের ত্যাগ করলে মেয়েদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করে (অন্তত তিনজন), সে বলে সে তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে আফ্রিকার ওপরে নির্যাতনের প্রতিশোধ নিচ্ছে, তারপরে বিচারে বেকসুর খালাস হয়ে স্রেফ উধাও হয়ে যায়। উপন্যাসের কথক যখন মনে করে সে তাকে খুঁজে পেয়েছে, তখন উত্তর পায়– ‘মুস্তাফা সায়ীদ একটি বিভ্রমমাত্র’ । ইংরেজি অনুবাদে বলা হয়েছে ‘মুস্তাফা সায়ীদ ইজ এ লাই’। সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা লন্ডন-ফেরত কথককে সে শ্লেষের সাথে বলে– মহান মিথ্যেবাদী ইংরেজ কবিদের ওপর গবেষণা করতে হয়েছে আপনাকে। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভটা কী?

ঔপনিবেশিক বয়ানকে চিনতে পারাটাই আফ্রিকার লেখকদের বড় অর্জন। চিনুয়া আচেবে কলম ধরেছেন ঔপনিবেশিক বয়ানের প্রতিবয়ান নির্মাণে। অন্য আফ্রিকান লেখকরাও। জোসেফ কনরাডকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লেখক বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু তিনিও যে উপনিবেশের জনগণকে বলেন ‘পেছনের দুই পায়ে দাঁড়ানো কুকুরের মতো’, সেকথা তো আড়াল করা যাবে না।

ওসমান সেমবেন চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন। তার একটি সিনেমায় দেখা যায় আফ্রিকার নারীশক্তির পরিচয়। আফ্রিকার নারীরা ততক্ষণ রাজনীতিতে আসে না যতক্ষণ পুরুষরা লেজেগোবরে পাকিয়ে ফেলে। একটি চলচ্চিত্রে দেখা যায়, পুরুষরা ফরাসি দখলদারদের সাথে জীবন সংগ্রামে পেরে উঠছে না, নিজেদের অধিকার সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা তাদের ফসলের স্বত্ত্ব হারাচ্ছে। তারা শেষবারের মতো গ্রামের ময়দানে নাচের আয়োজন করে এবং বর্শাগুলো সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ, চূড়ান্ত অপমান। তখন নারীরা বেরিয়ে আসে, হাতে তুলে নেয় বর্শাগুলো, আর নাচতে শুরু করে, সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নাচ।

বেগম রোকেয়ার কথা কি মনে পড়ে এই অংশটুকু পড়তে গিয়ে?

কিন্তু আমরা পারিনি বেগম রোকেয়া বা কাজী নজরুলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে। আফ্রিকার লেখক-কবিরা পেরেছেন। সেই কারণেই নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গে লিখতে পারেন ‘ডিকলোনাইজিং অফ মাইন্ড’। আর আমরা তাকিয়ে থাকি পশ্চিমে ইউরোপ-আমেরিকার লেখকরা নতুন কোন উপন্যাস লিখছেন সেই খবর পাওয়ার আশায়।

আমাদের মননে ইউরোপ, প্রধানত ব্রিটেন এবং আমেরিকা, এখনও নিরংকুশ প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে বটে, কিন্তু মনোজগতের উপনিবেশিক শাসন থেকে এখনও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, অভিসন্দর্ভ, সকল রচনায় ঔপনিবেশিক প্রভুর অনুসরণ। এই তথ্য এডওয়ার্ড সাইদ পরিবেশন করার আগেই অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীর চিন্তাতে এসেছিল। নিজস্ব পথ নির্মাণের তাগিদ অনুভব করেছিলেন অনেকেই। পরের অণুকরণ ও পরের আরোপিত চিন্তাধারা দিয়ে যে নিজেদের জন্য আলাদা ও পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য নির্মাণ আদৌ সম্ভব নয় সে ব্যাপারে যেমন সিরিয়াস লেখালেখি তেমনই নেহায়েৎ বৈঠকি ভঙ্গিতে বারংবার আলোচনা করেছেন বিনয় সরকার। আমাদের মনোজগতে চল্লিশের দশকে অন্তত সাত-সাতটি বিদেশী প্রভাব কার্যকর ছিল। তাঁর মতে, ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির বাচ্চারা বিদেশী মাল খেয়ে মানুষ হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতেও অপ্রতিহত সেই বিদেশী মাল। দেড়-দুইশ বছর ধরে বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল বিলাতি মনন-চিন্তন। উনবিংশশতকের তথাকথিত আধুনিক সংস্কৃতির শুরুই হয়েছে বিলাতের ভাষা, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ওপর ভর করে। ঐ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসি বিপ্লব ও ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতি কিছুদিন ঢেউ তুলেছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে। ফরাসি কঁৎ-দর্শন ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমের উপর। অনেকেরই ধারণা, বঙ্কিমের হিন্দু ধর্মদর্শন পুরোটাই কঁৎ-প্রভাবিত। ১৮৭০-৮৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন বিপ্লব ও সংস্কৃতি নিয়েও কিছুটা ঢেউ উঠেছিল। সেইসময় হেমচন্দ্র মার্কিন-প্রশস্তি লিখেছেন– ‘হোথা আমেরিকা নব-অভ্যুদয়/ পৃথিবী গ্রাসিতে আসিছে আশয়’। একেবারে যথার্থ ভবিষ্যৎ অনুধাবন। নিজের বাণী বিশ্বমাঝে পৌঁছে দেবার জন্য আমেরিকাকেই বেছে নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। ইতালিয়ান আর জার্মান প্রভাব বাংলায় আসে একসঙ্গে। ১৮৬০-৭০ সালের মধ্যে ইতালির স্বাধীনতা অর্জন এবং জার্মান-সাম্রাজ্যেরও প্রতিষ্ঠা। এই দুই ঘটনা বাঙালিকে কিছুটা চাঙ্গা করে তুলেছিল। ইতালিয়ান মাৎসিনি আর জার্মান বিসমার্কের নাম না নিলে কোনো বাঙালি কংগ্রেসীর তিন বেলার ভাত হজম হতো না। মাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির জীবনী সকল শিক্ষিত বাঙালি তরুণের অবশ্যপাঠ্য ছিল। যোগীন বিদ্যাভূষণ ছিলেন এই আন্দোলনের চাঁই। সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, বিপিন পাল প্রমুখ দেশনায়করা সারা দেশে মাৎসিনি সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছেন। আর বিনয় সরকারের সরাসরি অভিমত হচ্ছে– ব্রজেন শীল, সতীশ মুখোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, হীরালাল হালদার ইত্যাদি পণ্ডিতরা বিবেকানন্দ’র যুগে জার্মান হেগেল খেয়ে মানুষ হয়েছে। ভারতবর্ষীয় ঐক্যের প্রবক্তারা কথায় কথায় বিসমার্ক প্রবর্তিত জার্মান ঐক্যের উদাহরণ দিতেন। ন্যাশনাল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় উদ্যোক্তাদের সামনে ছিল জার্মান আদর্শ। রাসবিহারী ঘোষ ছিলেন জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রিডারিখ লিখ্ট-এর দারুণ ভক্ত। সবশেষে এলো রুশ প্রভাব। মানবেন্দ্রনাথ রায়, ভূপেন দত্ত, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, অবনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ‘মস্কো থেকে হজ’ করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বলশেভিক বিপ্লবের বাণী প্রচারে। রুশপ্রভাব অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। তবে প্রথম থেকে অদ্যাবধি বাঙালি জাতি বিশ্বকে দেখতে অভ্যস্ত ইংরেজির চোখেই। বিনয় সরকার আক্ষেপ করে বললেন– ‘এই জন্য আজ পর্যন্ত বঙ্গসন্তানের চোখ ফুটল না। আমাদের অধ্যাপক, বিজ্ঞান-গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, বণিক, মজুর-নায়ক ইত্যাদি নানা পেশার লোকেরা অত্যাধিক ইংরেজ-চোখো লোক। আমাদের সংস্কৃতি বিলাতি সংস্কৃতির মফস্বলে পরিণত হয়েছে। বিলাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী অধ্যাপকগুলো যুবক-বাঙালিকে ইংরেজের সত্যিকারের গোলামে পরিণত করে ছেড়েছে।’

এই পরিস্থিতি এখনও অটুট। বলা যায় আশঙ্কাজনক হারে বর্ধিষ্ণু। ব্রিটিশের বদলে প্রধান জায়গা নিয়েছে কেবল আমেরিকা। ঔপনিবেশিকতা আরো বেশি প্রকট। আমাদের সাহিত্যের জগতে এই প্রবণতা একবারে মহামারির আকার ধারণ করে আছে। ছেদ টেনে দিয়েছে আমাদের আবহমান বাংলার সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে আমাদের উত্তরপুরুষদের। আমরা নিজেরা সেই হারানো সূত্রের সন্ধান না করে সাহিত্যে চালিয়ে যাচ্ছি ঔপনিবেশিক আকরণ ও অবয়ব। ফলে আমাদের রচনা বাংলায় লেখা হলে তা ‘বাংলার’ কি না এই সন্দেহ সবসময় থেকেই যাচ্ছে– কখনো প্রচ্ছন্নভাবে কখনো প্রকটভাবে। এই ব্যাপারে তো সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই যে জনসমাজের আখ্যানপাঠের আকাঙ্ক্ষা লোকায়ত ঐতিহ্যবাহিত প্রকরণগুলির মধ্য দিয়েই পূরণ হওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে লোকায়ত অভিব্যক্তিগুলি শুধু লেখ্য নয়, কথ্যরূপেও বিরাজমান ছিল। তাই আমাদের ঐতিহ্যবাহিত লেখ্য-প্রকরণগুলিও পাঠ এবং শ্রুতির বিষয়টি মনে রাখত সবসময়। কথক বা কথনীয়া-পাঠকরা ছিলেন আমাদের সাহিত্য প্রবাহের অন্যতম প্রধান বাহন। প্রাক-ঔপনিবেশিক বাঙালি সমাজে আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রবহমান এমন এক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার সন্ধান পাই যাতে সামাজিক অভিজ্ঞতালব্ধ আখ্যানবয়নের কিছু কিছু পরীক্ষিত পদ্ধতি ছিল স্বীকৃত। এই পদ্ধতিগুলি সাধারণভাবে পারস্পরিক সহযোগমূলক অর্থাৎ আখ্যানপ্রণেতা এবং তার শ্রোতা-পাঠকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল। উপনিবেশবাদের পত্তনে শুধু আমাদের মসলিন শিল্পই নয়, ভেঙে গেল আমাদের ঐ সাহিত্যিক ধারাবাহিকতারও উপলব্ধি। অস্বীকৃত হলো লেখক ও পাঠকের দ্বিবাচনিকতার আকরণ। বাংলা উপন্যাসের তথা কথাসাহিত্যের জন্মের প্রেক্ষিত এটাই। এল ইউরোপীয় কাঠামো। পাশ্চাত্যের সাথে প্রতিতুলনা না করতে পারলে কাউকে যেন কোনো ধরনের স্বীকৃতিপ্রদান ছিল এককথায় অসম্ভব। যে ইংরেজের সাথে প্রতিতুলনা করা হতো, যাকে মান বা স্ট্যান্ডার্ড ধরা হতো তার মান অনেক সময়ই উপমিত-র তুলনায় কমই ছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রকে আখ্যা দেওয়া হতো ‘বাংলার ওয়াল্টার স্কট’ নামে। অথচ অসুস্থ স্বাদেশিকতার কথাটা বাদ দিলে অন্য সব ক্ষেত্রেই বঙ্কিমের প্রতিভা ও কৃতি ওয়াল্টার স্কটের তুলনায় অনেক বেশি। যদিও আবহমান বাংলার সাহিত্য-প্রাকরণিক ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই, কিন্তু তাঁর লিখনশৈলীর শক্তিমত্তাকে অস্বীকারের কোনো সুযোগ বঙ্কিম তাঁর সবচেয়ে বড় নিন্দুকের জন্যও রাখেননি। তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। সেই ক্ষতির বিবরণ সংক্ষেপে সার আকারে তুলে ধরেছেন দেবেশ রায়– ‘বাংলা উপন্যাসে সঞ্চারিত হয়নি লোকায়তের পৌরুষ, বাংলা উপন্যাসের কাহিনীতে আসেনি পুরাণ বা মিথ, ভাষার লোকায়তিক পেশি, বাংলা উপন্যাসের সংলাপে আসেনি আমাদের প্রতি ক্রোশে আলাদা উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও ব্যঙ্গশ্লেষ রসিকতার শান! এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনী নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না। আমরা উপন্যাসে কাহিনী খুঁজেছিলাম, কাহিনীর সেই মায়ামৃগ আত্মপরিচয় থেকে আমাদের আরো দূরে সরিয়ে এনেছে।’

এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নিজেকে ও নিজেদের সেই কথাটি মনে করিয়ে দেওয়া– একজন গোলাম তখনই প্রকৃত গোলাম, যখন সে চিন্তা করে প্রভুর মতো করে, এমনকি প্রভু যখন তাকে দৈহিক স্বাধীনতা দিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তখনও।

প্রত্যক্ষ প্রভুর হাত থেকে আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীন হতে হলে মনোজগতের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

আর সাহিত্য স্বাধীনতার পথ দেখাতে না পারলে জাতির স্বাধীনতালাভ সম্ভব হবে না।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *