novel-firay-firay-aasay

ফিরে ফিরে আসে
সুস্মিতা নাথ





আগের রাতে নাইট ডিউটি ছিল। ফলে ঘুম হয়নি। তাই বাড়ি ফিরে দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে ঘুমিয়েছিল বিমল। সেই ঘুম ভাঙ্গল প্রায় সন্ধ্যার আগ দিয়ে। বিছানা ছেড়ে তখনও ওঠেনি, হঠাৎ মনে হল, কে যেন বাঁ পাশের জানলা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। শোওয়া অবস্থাতেই মুখ তুলে খোলা জানলাটার দিকে তাকাল বিমল। আর, অমনি চমকে উঠল। বাইরের থেকে জানলায় মুখ ঠেকিয়ে কে একজন নিবিড় ভাবে ওকে দেখছে! বিমল রীতিমতো হতবাক। তেমনই অপ্রস্তুত। কারণ যে ওকে দেখছে সে একে তো অপরিচিত, তারোপরি এক যুবতী নারী। ধড়ফড় করে উঠে বসে বিমল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “কে? কে আপনি?”

কিন্তু কিছু বলল না মেয়েটি। জবাবে শুধু মিষ্টি করে হাসল সে। বিমল কী বলবে ভেবে পায় না। অপরিচিত এক যুবতীর সামনে একটু সঙ্কোচও বোধ করে। তবু আবার একই কথা জিজ্ঞেস করল সে। সঙ্গে যোগ করল, “কী চাই আপনার? কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?”

কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে রইল সে। ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি খেলছে। বড় জোর কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হবে মেয়েটার। ভারী মায়াবী চেহারা। শ্যামলা গায়ের রং, পানপাতার মতো মুখ, আর দিঘির মতো গভীর দুটি চোখ। বিমল মুগ্ধ হয়ে তাকায়। এবার লাজুক হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার চোখেমুখে। তারপরেই আচমকা সে সরে গেল জানালার ধার থেকে।

বিমল ঝটপট বিছানা ছেড়ে নামে। বিদ্যুৎ বেগে ঘরের দরজা খুলে জানলার এদিকটায় ছুটে আসে। কিন্তু মেয়েটি তখন আর সেখানে নেই। মুহূর্তেই যে কোথায় সরে গেল কে জানে! যেন ম্যাজিকের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। চারদিকে তাকিয়ে কোথাও তার টিকিটিও দেখা গেল না।

ভয়ানক অবাক লাগে বিমলের। এই তো মাত্র চারখানা কোয়ার্টার্স। সামনে একফালি সরু রাস্তা, পিছনে রাজ্যির ঝোপঝাড়। এর মধ্যে কোথায় গেল মেয়েটি? কোন বাড়িতে ঢুকল? নতুন জায়গা, নতুন কোয়ার্টার, নতুন মানুষজন। এখনও এখানকার হাবভাব বুঝে উঠতে পারেনি বিমল। ঘটনাটা তাই ওকে বড় বিভ্রান্ত করল।

এখনও অন্ধকার নামেনি। অনেক দূরে ধানক্ষেত ছাড়িয়ে আকাশ লাল করে পাহাড়গুলির পিছনে সূর্য ডুবছে। বাতাসে হিমেল ভাব। অপূর্ব মনোরম পরিবেশ। কিন্তু নিসর্গের এই সৌন্দর্য নয়, বিমলের চোখে ভাসছে সেই নারীমূর্তি। বেগুনি সালোয়ার পরা একটি হাস্যোজ্জল মেয়ে। যার গায়ের রং শ্যামলা, মুখ পানপাতার মতো, চোখ দিঘির মতো গভীর। এখনও চোখ বুজলেই বিমল স্পষ্ট দেখছে সে মেয়েটার মাথার দু’পাশে ঝুলে থাকা লম্বা দুটি বেণী আর প্রাণবন্ত হাসি। মুক্তার মতো দাঁতের সারি মেলে যখন হাসে, তখন দু’ধারে দু’টি গজদন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল মেয়েটার ঢলঢলে চোখ দু’খানা। চোখগুলি যেন কথা বলে। যখন সে হাসে, তখন যেন শুধু মুখ দিয়ে নয়, চোখ দিয়েও হাসে।

হতবিহ্বল বিমল কিছুক্ষণ বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে ওর চোখ মেয়েটিকে খোঁজে। কিন্তু না পেয়ে অবশেষে মাথায় অজস্র প্রশ্ন নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। হাতমুখ ধুয়ে প্রথমে এক কাপ চা করে খায়। বাইরে ততক্ষণে চাপ চাপ অন্ধকার নেমেছে। ওদের রেলপাড়া আরও নিঝুম হয়ে উঠেছে। বিমলের মনে হয় যেন বনবাসে আছে ও। কোথাও কোনও শব্দ নেই। লোকজনের দেখা নেই। ওর অসহ্য লাগে। এমন একটা জায়গায় দিনের পর দিন কাটাবে কীভাবে ভেবে পায় না।

মাত্র তিন দিন হল নিমাতি স্টেশনে বদলি হয়ে এসেছে বিমল। গত কাল থেকে নতুন কোয়ার্টারে থাকতেও শুরু করেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই বড় অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা চলছে এখানে। কিছুতেই কিছু বোধগম্য হচ্ছে না ওর। একে তো একেবারে পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এই স্টেশন, তার উপর লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। দিনের বেলা তাও হয়তো দু’-চার জনের মুখ দেখা যায়। কিন্তু আলো মরে আসার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ এমন নিঝুম হয়ে যায় যে, বলার নয়। কেমন যেন গা ছমছম করে ওর।

এমনিতে সহকর্মীরা প্রত্যেকেই বেশ ভাল। সব ব্যাপারে সহযোগিতা করছে ওকে। কাজের চাপও কম। কিন্তু জায়গাটা বড় বেশি নিরালায়। খুব কাছের লোকালয়টিও অন্তত এক-দেড় কিলোমিটার দূরে। কেন যে এমন জায়গায় স্টেশন বানাল রেল! বিমল ভেবে পায় না। এই নির্জনে ওর মন বসছে না কিছুতেই। তিন দিন হল এখানে আছে, অথচ মনে হচ্ছে যেন কত কাল হয়ে গেল।

নিজের কোয়ার্টার প্রায় গুছিয়ে নিয়েছে বিমল। যদিও গোছানোর মতো তেমন কিছু নেইও। আগে যে লোকটি এই কোয়ার্টারে থাকত, সে চলে যাওয়ার সময় অনেক জিনিস রেখে গেছে। সেগুলো সে আর নিতেই আসেনি। ফলে তার সৌজন্যে বিমল গৃহস্থালির প্রায় সব জিনিসই পেয়ে গেছে। ওকে সামান্যই কিনতে হয়েছে। ঘুমানোর চৌকিটা তো বটেই, একটা বড় ট্রাঙ্কে রান্নার বাসনপত্রও ছিল। আরও নানা টুকুটাকি জিনিস ওতে আছে, সব এখনও ঘেঁটে দেখা হয়নি। বিমল ভাবল, এখন ওই ট্রাঙ্কটাই ভাল করে দেখা যাক।

বেশ বড় ট্রাঙ্ক। বন্ধ থাকলে অনায়াসে একটা টেবিলের কাজ করবে। এতক্ষণ বিমল চায়ের কাপ ওটার উপরেই রাখছিল। এখন কাপটা রান্নাঘরের সিঙ্কে রেখে এসে ট্রাঙ্কের পাল্লা খুলল। খুলতেই একটা বোটকা গন্ধ বেরিয়ে এল। দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকলে বাক্সপ্যাটরায় এমন গন্ধ হয়। বাসনপত্র বের করে নেওয়ার পরেও জিনিসে ঠাসা এটা। সবার উপরে একটা শক্ত পিচবোর্ট রাখা। বিমল আলগোছে সেটা সরাতেই নজরে এল পুরনো বেডকভার, কম্বল, বালিশ, একটা ফ্লাস্ক, তিনটে খালি কৌটো, একটা প্লাস্টিকের স্টুল, ও আরও নানান হাবিজাবি। কিন্তু বোটকা গন্ধটা এত অসহনীয় লাগছিল যে, ট্রাঙ্কটা বেশিক্ষণ খুলে রাখতে ইচ্ছে হল না। আগের দিন রঘু এসে এর থেকে বাসনগুলো বের করেছিল বলে তখন গন্ধটা টের পায়নি বিমল। কিন্তু এখন এই গন্ধ অসহ্য লাগছে। তাই আর নাড়াঘাঁটা না করে আবার বন্ধ করে দিল ওটা।

কিন্তু এখন কী করবে? রাত দশটার সময় ডিউটিতে যেতে হবে। এখন সবে সন্ধে সাড়ে ছ’টা। এই দীর্ঘ সময় ঘরে বসে বসে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না বিমল। একা একা কিছুতেই ঘরে মন টিকছে না। কাজ বলতে তেমন কিছুই নেই। দুপুরে যে খিচুরি আলুভাজা রেঁধে রেখেছে, ওতেই রাতে হয়ে যাবে।

আজও নাইট ডিউটি আছে। কিন্তু সে তো যেতে হবে দশটা নাগাদ। এর আগের দীর্ঘ সময়টা কাটাবে কী করে সেটাই চিন্তার। সেই মেয়েটার কথাও ভাবাচ্ছে। কে হতে পারে মেয়েটা? কেনই বা এভাবে ওর জানলার সামনে দাঁড়িয়েছিল? তা ছাড়া গতকাল সকাল থেকে যে আজব ব্যাপারগুলো ঘটেছে সেগুলোরই-বা রহস্য কী? এই মেয়েটা কি কোনওভাবে ওগুলোর সঙ্গে যুক্ত? কিন্তু কীভাবে? কিছুতেই কিছু ভেবে পাচ্ছে না বিমল। সব মিলিয়ে বড় বিভ্রান্ত ও। আজ নিয়ে সবে তৃতীয় দিন ও নিমাতিতে আছে। এরই মধ্যে কত কী ঘটে গেল! বিমল শুরু থেকে ভাবতে চেষ্টা করে নিমাতিতে পৌঁছানোর পর থেকে কী কী ঘটল।




স্টেশনটা যে ছোট সেটা আসার আগেই জেনেছিল বিমল। কিন্তু এমন জনমানবহীন জায়গায় সেটা ও ভাবতে পারেনি। প্লাটফর্মের পিছনে গুনে গুনে চারখানা কোয়ার্টার্স। এ ছাড়া আশেপাশে কোনও বাড়িঘর তো দূর, সভ্য জগতের কোনও চিহ্নই নেই। যে দিকে তাকাও কেবল ঘন গাছগাছালি। প্লাটফর্মের ধারেও তিনটে কৃষ্ণচূড়া গাছ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে গাছগুলো। ফুল ছড়িয়ে আছে প্লাটফর্মের বাঁধানো মেঝেতেও।

রেললাইনের উল্টোদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ধানখেত। এর পরেই একের পর এক পাহাড়। অদূরে, হাতের ডান দিকে একটা নদীও দেখা যাচ্ছে। সরু কিন্তু টলটলে জল নিয়ে স্রোতস্বিনী। একটু কান পাতলে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে। নদীর উপরে ব্রিজ আছে। ওটার উপর দিয়েই রেললাইন চলে গেছে।

এমনিতে ছবির মতো সুন্দর জায়গা। এক-দু’দিন শান্তিতে কাটাবার জন্যে আদর্শ। কিন্তু আগামী ক’টা বছর এক নাগাড়ে এখানে থাকার কথা ভাবতেই দমে গেল বিমল। অথচ উপায়ই-বা কী? চাকরি করতে হলে এসব মেনে নিতেই হবে।

স্টেশন তথা জায়গার নাম নিমাতি। স্টেশন মাস্টার বনমালী মুখার্জী বললেন, স্থানীয় ভাষায় নিমাতি শব্দের অর্থ ‘না-মাতা’ বা ‘কথা না বলা’। অর্থাৎ নীরব থাকা। নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে গোটা এলাকাটাই কী ভীষণ নীরব নিস্তব্ধ! থেকে থেকে কিছু পাখির ডাক ছাড়া লোকজনের কোলাহল, গাড়িঘোড়ার প্যাঁ-পু, কারখানার ঘটরমটর ইত্যাদি কোনও শব্দই নেই। চিরকাল শহরে কাটানো বিমলের মনে হচ্ছে, এত নৈঃশব্দ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন।

পুরো স্টেশনে স্টাফ সাকুল্যে ছয় জন। চারজনের থাকার ব্যবস্থা কোয়ার্টারগুলিতে। তাদের মধ্যে এখন বিমলও একজন। ওর জন্যে বরাদ্দ হয়েছে তিন নম্বর কোয়ার্টার। কারণ ওটাই খালি ছিল। এ ছাড়া দু’জন ক্লাস ফোর স্টাফ স্থানীয় মানুষ। তারা সাইকেলে চেপে আসা-যাওয়া করে। তাদের একজন রঘু। যে এখন ফুল গাছে জল দিচ্ছে।

প্লাটফর্মের উপরেই অফিসঘরগুলির ঠিক সামনের জায়গায় বেশ সুন্দর একটা বাগান করেছে রঘু। এর মূল উদ্যোগ বনমালীবাবুর হলেও বাগানের পুরো দায়িত্ব সামলায় রঘুই। রঘু মালী নয়। আদতে সে পিয়নের পদে নিযুক্ত। কিন্তু এই স্টেশনে যেহেতু তেমন কোনও কাজ নেই, তাই রঘুকে বাগান পরিচর্চায় লাগিয়েছেন বনমালীবাবু।

গাছে জল দিতে দিতে বিমলকে লক্ষ করছিল রঘু। এই অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন মাস্টার সদ্য বদলি হয়ে এসেছে। বড় স্টেশন থেকে কেউ এখানে এলে শুরুতেই যেমন ভাবভঙ্গি হয়, এই সাহেবেরও একই অবস্থা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে এসে খুব মুষড়ে পড়েছে। মনে মনে হাসল রঘু। বিমলকে উদ্দেশ্যে করে মনে মনে বলল, “ক’টা দিন যাক স্যার, দেখবেন কেমন মায়া পড়ে যাচ্ছে।”

আনমনে চারদিক তাকিয়ে দেখছিল বিমল। তখনই বিমলের বয়সী একজন এসে করমর্দনের জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “বিমল দাশগুপ্ত?”

বিমলও নিজের হাত এগিয়ে ধরে হেসে সহমত বোঝাল।

আগন্তুক বলল, “আমি হিমন্ত কলিতা। বুকিং সামলাই।”

বিমল আগেই জেনেছে, এখানে মাত্র একজন বুকিং স্টাফ। আসলে সারা দিনে মাত্র দু’টি প্যাসেঞ্জার ট্রেন ও একটি এক্সপ্রেস ট্রেন এখানে থামে। এক্সপ্রেস ট্রেনটা দূরপাল্লার ট্রেন এবং সপ্তাহে তিন দিন চলে। আপ তিন দিন, ডাউন তিন দিন। তাই দিনে আপ অথবা ডাউন, একটিই থামে। সব মিলিয়ে যাত্রীও হাতে গোনা। মালবাহী ট্রেন থামলেও এখান থেকে বিশেষ মাল বুকিং হয় না বললেই চলে। সুতরাং বুকিং ও টিকিট কাউন্টার সামলানোর জন্যে একজন স্টাফই যথেষ্ট।

হিমন্ত জানাল, সে দু’নম্বর কোয়ার্টারে থাকে। অর্থাৎ বিমলের কোয়ার্টারের পাশেরটাতেই। সঙ্গে ওর স্ত্রী এবং দুই সন্তানও আছে।

হিমন্তের ডিউটির সময় হয়ে গিয়েছিল বলে আর সেখানে দাঁড়াল না। তবে যাওয়ার আগে বলল, কোনও প্রয়োজন হলে যেন ওকে নির্দ্বিধায় জানায় বিমল। রঘুকেও বলে গেল, রঘু যাতে বিমলকে সঙ্গ দিয়ে ওর কোয়ার্টারে নিয়ে যায়।

এরই মধ্যে স্টেশন মাস্টার বনমালীবাবু সেখানে এলেন। বিমলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কোয়ার্টারটা দেখেছেন, দাশগুপ্ত?”

বিমল বলল, “না স্যার, এখনও যাইনি।”

“যান দেখে আসুন। সকাল সকাল দেখে নিলে কাজের সুবিধে। রঘু আপনার সঙ্গে যাবে। ওরাই সাফসাফাই যা করার করে দেবে। জলের সাপ্লাই, কারেন্টের লাইন আগে চেক করিয়ে রেখেছি। সব ঠিক আছে। নতুন বাল্বও লাগানো হয়েছে কয়েকটা। এর পর আপনার যা যা দরকার, রঘুকে বললেই ব্যবস্থা করে দেবে।”

বিমল মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানায়। বনমালীবাবু যোগ করেন, “আশা করি এক-দু’দিনের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তবে যতক্ষণ না সব হচ্ছে, আপনাকে আমার কোয়ার্টারে থাকার আমন্ত্রণ রইল। আমরা যা খাই, তেমনই সামান্য ডালভাত খাওয়াবো আর কি। আমি আমার স্ত্রীকে বলে রেখেছি।”

বিমল শুনে আপ্লুত হয়। পাঁচ বছরের চাকরি জীবনে কোনও সহকর্মীর থেকে এমন আপ্যায়ন এবং আন্তরিকতা আগে কখনও পায়নি ও। কিন্তু কাউকে অহেতুক ব্যস্ত করা ওর পছন্দ নয়। তাই বলল, “এমা! মিছেমিছি ম্যাডামকে কেন কষ্ট দেওয়া, স্যার। আমি একা মানুষ, কিছু না কিছু ঠিক ম্যানেজ করে নেব।”

“পারবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কেমন পাণ্ডব বর্জিত জায়গা। বাজারহাট পেতে হলে অন্তত দেড় কিলোমিটার যেতে হবে। আজ বিকেলে বা কাল সকালে কখনও রঘুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। তারপর গৃহস্থালির জন্যে যা যা দরকার কিনে নিয়ে আসবেন। তবে হ্যাঁ, থাকার জন্যে একটা চৌকি, একটা গ্যাস স্টোভ, কিছু বাসন, এবং আরও টুকিটাকি জিনিস ওঘরেই আছে। একটা বড় ট্রাঙ্কে সব পেয়ে যাবেন।”

বিমল শুনে অবাক হল। এমন তো কোনও কোয়ার্টারে থাকে না! বলল, “কিন্তু জিনিসগুলো কার, স্যার?”

“ওগুলো অমিতাভ প্রামাণিক বলে একজনের। ছ’বছর আগে সে এখানে পোস্টেড ছিল। সে চলে যাওয়ার সময় জিনিসগুলো আর নিয়ে যায়নি। এর পর থেকে ওই কোয়ার্টারেই সব রাখা আছে।”

“কিন্তু সে কখনও নিতে এলে?”

“সে সম্ভাবনা নেই। সে এখন এন-জে-পিতে পোস্টেড। আমি যোগাযোগ করেছিলাম তার সঙ্গে। বলেছিলাম, জিনিসগুলো কবে নেবে সে? কিন্তু সে জানিয়েছে, এসব আর সে নেবে না। পরবর্তী যারা কোয়ার্টারে আসবে তারাই যেন ব্যবহার করে ফেলে। …আসলে খুব দামী কিছু তো নেই। এগুলো বয়ে নেওয়ার খরচ যা হবে, সে টাকায় এর চেয়ে বেশি জিনিস কিনে ফেলা যাবে।”

বিমল মনে মনে ভাবে, এ যেন শাপে বর। নইলে এসব ওকে নিজেকেই কিনে নিতে হত। এখন সে খরচ ও ঝক্কি দু’টোই কমলো।

ইতিমধ্যে রঘুর বাগান পরিচর্চা তখনকার মতো হয়ে গিয়েছিল। সে এসে বলল, “চলুন, স্যার, আপনাকে আপনার ঘরে পৌঁছে দিই।” এর পর নিজেই বিমলের ট্রলি দু’টি মাথায় তুলে এগিয়ে চলল। পিছন পিছন বিমলও।




বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই ঘরে অনেকদিন লোক থাকেনি। চারদিকে ঝোপজঙ্গল গজিয়ে প্রায় হানাবাড়ির রূপ নিয়েছে। রঘুই চাবি দিয়ে তালা খুলল। ঘরের ভিতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে ধাক্কা দিল বিমলের। সারা ঘরে মাকড়সার জাল আর ঝুলকালি। দেখেই চোখমুখ কুঁচকে গেল। বলল, “কদ্দিন এই কোয়ার্টার খালি ছিল?”

“আজ্ঞে, অনেক দিন, স্যার।” বলল রঘু, “কম হলেও তিন চার বছর তো হবেই। বেশিও হতে পারে। আমি চাকরিতে আসার পর থেকে এটা খালিই দেখছি।”

“ওমা! তা হলে আমার আগে যিনি এ-এস-এম ছিলেন, তিনি কোথায় থাকতেন?”

“প্রকাশবাবু? তিনি তো চার নম্বরে পাশোয়ান স্যারের সঙ্গে মেস করে থাকতেন স্যার। শুনেছি শুরুতে দিন কয়েক এই কোয়ার্টারে ছিলেন। পরে পাশোয়ান স্যারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন।”

“ওহ! তা হলে রমেশ পাশোয়ান এখন একাই থাকছে?”

“না, স্যার। এখন ওঁর পরিবার চলে এসেছে। তারা এতদিন বিহারে তাদের দেশের বাড়িতে থাকত। প্রকাশবাবু চলে যাওয়ার পরে পাশোয়ান স্যার ফ্যামিলি নিয়ে আসেন।”

মুহূর্তের জন্যে মেস করে থাকার একটা সম্ভাবনা মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়েছিল বিমলের। কিন্তু সব জেনে এখন সেটা চলে গেল। বোঝা গেল এখানেও একক জীবন শুরু হতে চলেছে। এই কোয়ার্টারই ওর আগামী ক’ বছরের ঠিকানা।

কিন্তু এখন কোয়ার্টারের অবস্থা দেখে ওর মাথায় হাত। একে মোটামুটি বাসযোগ্য করে তুলতে অন্তত তিন-চারদিন সময়ের দরকার। সম্ভবত ওর মনের অবস্থা বুঝেই রঘু বলে উঠল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না, স্যার। আমি একজন কামলা ডেকে এনে আপনার পুরো ঘরদোরের সাফসাফাই করে দেব।”

বিমল দেখল রঘু বেশ করিৎকর্মা। একটু পরেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরল। তার পর দু’জনে মিলে কাজে লেগে গেল। বিমল চলে এল বনমালীবাবুর বাড়িতে। দুপুর সময়টা এখানেই কাটল। মধ্য বয়স্ক এই দম্পতির দুই সন্তান। এবং দুজনেই বাইরে থেকে পড়াশোনা করছে। এখানে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর ছোট সংসার। বনমালীবাবুর স্ত্রী খুব আন্তরিক ভাবে আপ্যায়ন করলেন। অনেক কিছু রেঁধে খাওয়ালেন।

লাঞ্চ সেরে একটু শুয়েছিল বিমল। গতকাল গোটা রাত ট্রেনে কাটিয়ে বেশ একটু ক্লান্ত লাগছিল। ভেবেছিল ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু নানা কারণেই ঘুম এল না। আসলে এখনও এই অদ্ভুত জায়গায় পোস্টিংটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। শুধু মনে হচ্ছে, এই জঙ্গুলে জায়গায় বেশি দিন থাকবে কী করে?

কিছুক্ষণ বিছানাতেই উশখুশ করে, চারটে নাগাদ উঠে পড়ল বিমল। তারপর চলে এল নিজের কোয়ার্টারে। এসে দেখে, কোয়ার্টারের শ্রী অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছে রঘু ও তার সাকরেদ। ঘরের চারপাশ থেকে আগাছার জঙ্গল উপড়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে। ঘরের ভেতরটাও ঝুল ঝেড়ে, মেঝেটা ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছে। রঘু বলল, “কাল থেকেই অনায়াসে থাকতে পারবেন, স্যার। শুধু জিনিসপত্র কী কী কিনতে হবে দেখে নিন। তার পর দু’জনে গিয়ে নিয়ে আসব।”

বিমল দেখল, আপাতত বিছানাপত্র, কয়েকটা বাসন, এবং রান্না খাওয়ার আনাজপাতি, আর একটা ছোট গ্যাস সিলিন্ডার কিনে আনলেই হল। তাও নেহাত কম জিনিস হবে না। বিমল ভেবেছিল পরদিন সকালেই যাবে। কিন্তু রঘু বলল, ”কাল কেন, স্যার? আজকেই যাওয়া যাবে। সন্ধ্যায় হাট বসে। ওখানে প্রায় সবই পেয়ে যাবেন। সস্তাও হবে।”

অগত্যা সেটাই করল। ঠিক সন্ধের আগ দিয়ে স্নান-টান সেরে একটা সাইকেল নিয়ে রঘু হাজির। এসেই বলল, “স্যার, সাইকেল চালাতে জানেন তো?”

বিমল হেসে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি। তবে অনেকদিন চালাইনি।”

“এখানে কিন্তু সাইকেলই ভরসা স্যার। স্টেশন থেকে কোথাও যাওয়ার হলে সহজে কিছু পাবেন না। টেম্পু বা রিকশা পেতে হলে ট্রেনের টাইমের অপেক্ষা করতে হবে। তখন যাত্রী নিয়ে কোনও টেম্পু বা রিকশা এলে, সেগুলো ফিরতি পথে সওয়ার নিয়ে যায়।”

বিমল মনে মনে ভাবল, তাহলে একটা সাইকেল কেনাও জরুরি। তবে তখনকার মতো একটা সাইকেলের ব্যবস্থা করে ফেলল রঘু। হিমন্ত কলিতার সাইকেলটা তার বাড়ি থেকে চেয়ে আনল। এর পর দুই সাইকেলে দুইজন রওনা হয়ে গেল নিমাতি হাটের উদ্দেশে। আগে আগে চলেছে রঘু, পিছন পিছন বিমল।




নিমাতি আসার দ্বিতীয় দিনই নিজের কোয়ার্টারে শিফট করল বিমল। সকালে বনমালী মুখার্জীর বাড়ি চা বিস্কুট খেয়েই কোয়ার্টারে এল একবার। গতকাল সন্ধ্যায় সমস্ত বাজার করে এনেছে। বালিশ তোষক থেকে শুরু করে চাল-ডাল-নুন-তেল-শাকসব্জি সবই। রঘুর কথাই ঠিক। ঐ হাটেই সব পেয়ে গেছে। কোয়ালিটি হয়তো খুব ভাল নয়। কিন্তু এ নিয়ে বিমল ভাবিতও নয়। একা মানুষ, কাজ চলার মতো জিনিসপত্র হলেই হল।

কাল বাজার যাওয়ার সময় দেখছিল, রেল এলাকা পেরিয়ে লোকালয় পেতে অনেকটা পথ যেতে হয়। মাঝে কেবল খাস জমি, আর ঝোপঝাড়। একেবারে ছোট জনপদ নিমাতি। তবে বিশেষ ঘুরে দেখা হয়নি এখনও। বাজার করতেই রাত হয়ে গেল। সব কেনাকাটি করে যখন ফিরল তখন রাত আটটা বেজে গেছে। রঘুও সঙ্গে এসেছে। বিমলকে পৌঁছে দিয়ে, জিনিসপত্র কোয়ার্টারের রেখে, সাড়ে আটটা নাগাত রঘু ফিরে গেছে নিজের বাড়ি। জিনিসগুলো রাখা হয়েছে কোয়ার্টারের প্রথম ঘরটাতে।

ছোট্ট কোয়ার্টার। মোটে দু’টি ঘর। একটা বসার, অন্যটা শোওয়ার। এ ছাড়া ঘরের সামনে একটি, ও ভিতর দিকে একটি বারান্দা, এক টুকরো উঠোন, উঠোনের এক পাশে রান্নাঘর, অপর পাশে টয়লেট ও বাথরুম পাশাপাশি। তবে কোয়ার্টারগুলির চারপাশে বাগান করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা আছে। বনমালীবাবু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে ভারী সুন্দর বাগান করেছেন। বাকিরা অবশ্য তা করেনি।

আজ বিমলের জিনিসপত্র গোছানোর পালা। রঘু বলেছে, দরকারে ওকে ফোন করে নিতে। তবে আজ রান্নাবান্নার ঝক্কি নেই। আজও বনমালীবাবুর বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া হবে। মিসেস মুখার্জী খুব আন্তরিক ভাবেই বলেছেন, আজকের দিনটা তার বাড়ির আতিথ্য নিতে। বিমলের জন্যে এটা আশীর্বাদের মতো। রান্নাবান্নার ঝামেলা না থাকলে এক দিনেই পুরো ঘর গুছিয়ে নেওয়া যাবে। ডিউটির দিকেও বনমালীবাবু বেশ ছাড় দিয়েছেন। বলেছেন ইভনিং শিফটে কিছুক্ষণের জন্যে এলেই হবে।

কিন্তু কোয়ার্টারে এসে দরজা খুলেই একটু থমকে গেল বিমল। কেমন যেন সব কিছু অস্বাভাবিক লাগল ওর। মনে হচ্ছে, কাল যেভাবে জিনিসগুলো রাখা হয়েছিল, সেগুলো একই অবস্থায় নেই। কিন্তু পরিবর্তনটাও স্পষ্ট বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাল করে সব দেখতে লাগল। তখনই খেয়াল করল স্নানের জন্যে যে প্লাস্টিকের বালতি আর মগ কিনে এনেছিল, সেগুলো নেই। অথচ স্পষ্ট মনে আছে, কাল বিছানাপত্রের বান্ডিলের পাশেই বালতিটা রাখা হয়েছিল। ওটার ভিতরেই ছিল মগটা। কিন্তু ওগুলো এখন কোথায় গেল! বিমল উৎকণ্ঠিত। তা হলে কি চোর ঢুকেছিল ঘরে? চিন্তা ঘনায় মনে। চোর ছাড়া আর কার কাজ হবে?

কিন্তু চোর ঢুকল কোন দিক দিয়ে? সামনের দরজা দিয়ে যে ঢোকেনি, সে নিশ্চিন্ত। কারণ বিমল তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে। জানলাগুলোও বন্ধ দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি উঠোনের দেওয়াল টপকে ঢুকল? প্রশ্নটা মনে আসতেই উঠোনের দিকটা দেখতে ছোটে বিমল। কিন্তু দ্যাখে, ঘরের উঠোনমুখী দরজাটাও ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। বড় সংশয়ে পড়ে যায় বিমল। চোর আসার পথ খুঁজে না-পেয়ে বিভ্রান্ত সে।

ভেতর দরজা খুলে উঠোনে বেরোয় বিমল। উঠোনের পাঁচিলটা প্রায় সাতফুট উঁচু। তবে চোরের পক্ষে এ পাঁচিল টপকানো তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু পাঁচিল টপকে এলেও ঘরের ভিতরে ঢুকল কী করে এটাই বড় প্রশ্ন। তা ছাড়া উঠোন থেকে বাইরে বেরোবার একটা দরজাও আছে। কাজেই কেউ পাঁচিল টপকে ঢুকলেও বেরোবার সময় দরজা খুলে বেরোবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দরজাটাও ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। অর্থাৎ চোর যে এদিক দিয়ে ঢোকেনি এটা স্পষ্ট। তা হলে ঢুকল কোন দিক দিয়ে?

চারপাশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে বিমল। বন্ধ টয়লেটের দরজা খুলে উকি দেয়। এর পর বাথরুমে আসে। আর তখনই চমকে ওঠে। ওর কিনে আনা টকটকে লাল বালতি ও সবুজ মগ বাথরুমে ঝকমক করছে! আশ্চর্য! এগুলো এখানে কে এনে রাখল! নিজের মনেই বিড়বিড় করে ওঠে বিমল। ও যারপরনাই হতভম্ব। ওর পুরো মনে আছে, জিনিসগুলো সব সামনের ঘরটাতেই রাখা হয়েছিল। সারাদিন খাটাখাটুনির পরে রঘু যথেষ্ট ক্লান্ত ছিল। তাই ওগুলো একসঙ্গে নামিয়ে রেখেই ও চলে গিয়েছিল। বিমলও দরজায় তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল বনমালীবাবুর বাড়িতে। তা হলে বালতি আর মগ বাথরুমে কে রাখল? বিমল ভয়ানক বিভ্রান্ত।

কিন্তু বিস্ময়ের আরও বাকি ছিল। রান্নাঘরে এসে দেখে মুদি দোকানের জিনিস, এবং সমস্ত আনাজ রান্নাঘরের একটা ঝুড়িতে রীতিমতো সাজিয়ে রাখা। ঝুরিটা বিমল কেনেনি। ওটা আগের থেকেই এখানে ছিল। কিন্তু এই আনাজগুলো এভাবে কে রাখল! বিমল কিছুতেই ভেবে পায় না। তা হলে কি রঘু এসব গুছিয়ে দিয়েছে? রঘুর কাছে কি কোনও আলাদা চাবি আছে? হয়তো তাই। তবু ব্যাপারটা নিঃসংশয় হওয়া দরকার। বিমল তখনই আবার ঘর বন্ধ করে স্টেশনে চলে আসে। রঘুকে এখন এখানেই পাওয়ার কথা।




প্লাটফর্মের বাগান মন দিয়ে পরিচর্চা করছিল রঘু। বিমল এসে দাঁড়াল সেখানে। রঘু মুখ তুলে বলল, “কিছু বলবেন, স্যার?”

বিমল বলে, “না মানে বলছিলাম যে, তুমি আজ কখন আমার কোয়ার্টারে এসেছিলে?”

“আজকে? আজকে তো যাইনি, স্যার! কোনও দরকার আছে কি? তা হলে যাব।”

বিমল অবাক হয় শুনে। বলে, “নাহ, তেমন দরকার কিছু নেই। কিন্তু আজ ঘর খুলে মনে হল যেন তুমি ঘরে এসেছিলে। তা হলে কি কাল রাতেই কিছু জিনিস গুছিয়ে এসেছিলে?”

এবার প্রশ্ন চোখে তাকায় রঘু। তার পর বলে, “কী গোছানোর কথা বলছেন, স্যার?”

“গোছানো বলতে রান্নাঘরের জিনিস রান্নাঘরে, বাথরুমের জিনিস বাথরুমে রাখোনি তুমি?”

রঘু ভুরুতে ভাঁজ ফেলে বলে, “না তো, স্যার! কাল তো শুধু জিনিসগুলো আপনার সামনের ঘরটায় রেখেই চলে গেলাম।”

বিমলের চোখেমুখে বিস্ময় ও চিন্তার মিলিত ছাপ ফুটে ওঠে। বিষয়টা খুব গোলমেলে ঠেকছে। রঘু জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার, স্যার? আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে?”

বিমল মাথা নেড়ে বলে, “তেমন কিছু নয়। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। তুমি বলছ, তুমি জিনিসগুলো এক জায়গাতেই রেখেছিলে। আমিও তেমনটাই দেখেছি। কিন্তু আজ একটু আগে যখন কোয়ার্টারে ঢুকলাম, তখন দেখি বালতি ও মগ বাথরুমে রাখা, তেমনই রান্নার সামগ্রী সব কিচেনে গোছানো। তুমি যদি তা না করে থাকো, তা হলে কে করল?”

রঘুর চোখেমুখেও বিস্ময় ফুটে ওঠে। বলে “তাই নাকি, স্যার? বড় আশ্চর্যের। আর আমি গেলে তো স্যার আপনি জানতেনই। আপনার থেকে ঘরের চাবি নিয়েই তো যেতাম।”

“সেটাই তো কথা। এটাই তো ভাবাচ্ছে আমাকে।”

ততক্ষণে হাতের কাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রঘু। বলল, “চলুন তো, স্যার, দেখে আসি ব্যাপারটা কী?”

বিমল আবার রঘুকে সঙ্গে নিয়ে কোয়ার্টারের দিকে এগোয়। প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে শর্টকাটে মেরেকেটে মিনিট দুয়েকের হাঁটা পথ। পলকেই নিজের আস্তানায় এসে পৌঁছায়। আবার তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। কিন্তু সামনের ঘরটা পেরিয়ে ভিতরের শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই বিমলের চক্ষু চড়কগাছ। চৌকির উপরে বিছানা পাতা। নতুন আনা তোষক, বেডশিট ও বালিশ পরিপাটি করে বিছিয়ে রেখেছে কেউ! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হয় না বিমলের। বলে ওঠে, “এই দ্যাখো রঘু, এখন দেখি বিছানাও পেতে রেখেছে! অথচ একটু আগে যখন এলাম তখন কিন্তু বিছানার বান্ডিলটা নীচেই রাখা ছিল। অদ্ভুত! কে এসব করছে বলো তো?”

রঘু হতভম্ব হয়ে মাথা চুলকোয়। বলে, “আমি কীকরে বলি, স্যার?”

এর পর বাকি ঘরগুলো রঘুকে ঘুরে দেখাতে চায় বিমল। কিন্তু রঘুর তখন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে। সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে ওঠে, “স্যার, আমি পরে এসে দেখব। ডাউন প্যাসেঞ্জারের আসার সময় হয়ে গেছে।” তার পরেই হন্তদন্ত হয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হয় রঘু।

বিমল থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের ভিতরে। কে এসব রসিকতা করছে, কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না ওর। সবচেয়ে বড় কথা, যেই হোক, সে ঘরে ঢুকছে কীকরে? বিমল নিশ্চিত, এই ঘরের তালার কোনও ডুপ্লিকেট চাবি অন্য কারও কাছে আছে। কারণ ওর হাতে একটাই চাবি এসেছে। সাধারণত তালায় দু’টি অন্তত চাবি থাকে। কাজেই অপর চাবিটা নিঃসন্দেহে অন্য কারও কাছে আছে। এবং সে-ই এই সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে।

টুকিটাকি যা বাকি ছিল, নিজের মতো সাজিয়ে নিল বিমল। তার পর নিজের কোয়ার্টারেই স্নান সারল। উঠোনে একটা তার টাঙ্গানো আছে আগের থেকেই। ওটাতেই টাওয়েল এবং ছাড়া কাপড়গুলো ধুয়ে মেলে দিল। এইসব করতে করতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর। বিমল ভাবল, দুপুরের খাওয়া সেরেই ডিউটিতে চলে যাবে। বনমালীবাবু যতই ছাড় দিন, অযথা সুযোগ নেওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া ও ঘরে বসে করবেই বা কী? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘর আবার তালা দিয়ে বনমালী মুখার্জির বাড়ির দিকে এগোল।




সব শুনে বনমালীবাবু চুপ করে রইলেন। ওঁর স্ত্রী খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু পলকের জন্যে থমকে দাঁড়ালেন। এরপর বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বনমালীবাবুর দিকে তাকালেন। ব্যাপারটা বিমলের নজর এড়ালো না। বলল, “বৌদি কি কিছু জানেন?”

ভদ্রমহিলা যেন খানিক অপ্রস্তুত বোধ করলেন। এর পর হড়বড় করে বলে উঠলেন, “না না, আমি কিছু জানি না।”

বনমালীবাবু বললেন, “ব্যাপারটা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না দাশগুপ্ত। আপনি দু’-একটা দিন আরও ওয়াচ করুন তো। তেমন কিছু মনে হলে আমাকে জানাবেন।”

“একটা সন্দেহ হচ্ছে আমার,” বলল বিমল, “এই কোয়ার্টারের কোনও ডুপ্লিকেট চাবি কারও কাছে আছে কি?”

সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিলেন না বনমালী মুখার্জি। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “কী জানি! তেমন তো হওয়ার কথা নয়। আবার হতেও পারে। আমার কাছে তো এক-সেট চাবিই ছিল যেটা আপনাকে দিয়েছি।”

“হ্যাঁ। কিন্তু স্যার, যে কোনও তালার সঙ্গে অন্তত দুই সেট চাবি থাকে সব সময়।”

“সে হয়তো থাকে। কিন্তু এটার একটাই চাবি আমি দেখে এসেছি এতকাল। তবে আপনার যদি সন্দেহ হয়, তবে তালাটা সত্বর বদলে ফেলুন। নতুন যে তালা দেবেন, সেটার দুটি চাবিই নিজের কাছে রাখুন।”

কথাটা মনে ধরল বিমলের। বলল, “সেটাই ভাল, স্যার। আমি তা হলে খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। একটা তালা এনে তারপর ডিউটিতে চলে যাব।”

“ডিউটি নিয়ে অত ভাবতে হবে না আপনার। ও আমি সামলে নেব। আপনি একটু ধাতস্ত হয়ে ডিউটি জয়েন করুন।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আপনি যে এত কন্সিডারেট, এটাই আমার প্রাপ্তি। তবে স্যার একদম ভাববেন না। আমি একদম ফিট আছি। ঘরদোরও মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি। এবার আপনি বললে আমি ইভনিং ও নাইট দু’টোই টেনে নিতে পারব। নইলে এখানে ঘরে একা একা বসে করবটা কী?”

হাসলেন বনমালী মুখার্জী। বললেন, “পারবেন বলছেন?”

“একদম স্যার।”

“তা হলে আজ নাইট শিফট আপনাকে দিলে অসুবিধা হবে? আমার শরীরটা একটু বেগরবাই করছে, তাই।”

“কোনও অসুবিধা নেই, স্যার। বললাম তো, আমি তালাটা কিনে আনার পরে আপনি আমার হাতে ছেড়ে দিন। এর পর আমিই সামলে নেব।”

বনমালী মুখার্জী আশ্বস্ত হন। বলেন, “কাজের তেমন চাপ নেই, বুঝলেন? কিন্তু ঐ যে, ডিউটি টাইমে আপনাকে হাজির থাকতে হবে। তবে রাতে একেবারে একা থাকতে হবে না আপনাকে। দিগন্ত বলে যে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীটি আছে, সে এখানে রোজ নাইট করে। আমি নিজেদের সুবিধার জন্যে এভাবেই ওদের ডিউটি নির্ধারিত করেছি। একজন দিনে, একজন রাতে। এতে রঘু এবং দিগন্ত দুজনেই খুশি, আমাদেরও সুবিধে।”

“রঘু কেন খুশি, সে তো বুঝলাম। যতই হোক নাইট ডিউটি সাধারণত কারও পছন্দ নয়। কিন্তু দিগন্ত খুশি কেন? রোজ রোজ নাইট ডিউটিতে আপত্তি করে না?” জিজ্ঞেস করে বিমল।

বনমালী মুখার্জি হেসে বলেন, “নাহ, করে না। তবে এর কারণ আছে। দিগন্তের একটা দোকান আছে। নিজেরই বাড়ির সামনে মুদি দোকান। সে সারাদিন দোকান করে, রাতে এসে স্টেশনে ঘুমায়। এখানে তো বিশেষ কিছু কাজ নেই। তাই সারা রাত ওর প্রায় ঘুমিয়েই কাটে।”

সব শুনে বিমল মনে মনে হাসল। সত্যি, মানুষগুলো কী সুন্দর নিজেদের মতো নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে। এবং এটা করা সম্ভব হয়েছে একমাত্র পারস্পরিক আস্থা এবং নিজেদের মধ্যে সুন্দর সমঝোতা থাকার জন্যে। মিলেমিশে কাজ করলে সকলের কতই না সুবিধা হয়। অথচ এ কথাটাই অধিকাংশ মানুষ বোঝে না। নিমাতিতে এসে এই ব্যাপারটা খুব ভাল লাগছে বিমলের। যে কয়েকজন এখানে থাকে, তারা একটা বড় পরিবারের মতো থাকে। শুধু জায়গাটা এমন নির্জন না হলে বাদবাকি সবই ভাল। সহকর্মীরা ভাল, কাজ কম, ইচ্ছেমত ডিউটির সময় নির্ধারণ করা যাবে, আশা করা যায় ছুটি-টুটি পেতেও অসুবিধে হবে না, এসব তো কম অ্যাডভান্টেজ নয়।




প্রথম দিনের নাইট ডিউটি নির্বিঘ্নেই কেটেছে বিমলের। বাড়ি এসেও মোটামুটি সব স্বাভাবিক ভাবেই চলল। কেবল বিকেলে ওই অচেনা মেয়েটির আগমন সামান্য বিচলিত করল বিমলকে। এর পর বারংবার সেকথাই কেবল মনে হতে লাগল। বিমল ভাবছে, যে করেই হোক মেয়েটির পরিচয় জানা দরকার।

আজও রাতের খাওয়া সেরে ন’টার মধ্যে স্টেশনে চলে এল। এসে রমেশ পাশোয়ানকে পেল। লোকটা একটু কম কথা বলে ঠিকই, কিন্তু আন্তরিক। আজ বিমলকে দেখেই বলে উঠল, “আগে চলে এলেন, দাদা?”

বিমলের থেকে বয়সে বড়ই হবে ভদ্রলোক। তবু বাঙালি কাউকে অবাঙ্গালিরা দাদা বলতে বেশ ভালোবাসে। বিমলও একই রকম দাদা সম্বোধন করে বলল, “আরে দাদা, একা একা ঘরে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। আপনারা এত দিন ধরে এখানে আছেন কীকরে?”

পাশোয়ান বলল, “বিয়ে করেননি নিশ্চয়ই?”

বিমল হেসে মাথা নাড়ল। পাশোয়ান বলল, “তা হলে এখনই করে নিন। নইলে সত্যি এখানে একা থাকা খুব বোরিং। কত আর টিভি দেখবেন, বা মোবাইল ঘাঁটবেন?”

বিমল বলল, “বিয়ে তো বললেই হয়ে যায় না। তবে একটা টিভি কিনতে হবে। এত দিন আমার টিভি দেখার একেবারেই নেশা ছিল না। কিন্তু এখন দেখছি, এই নেশাটা তৈরি করতে হবে। নইলে তো পাগল হয়ে যাব।”

“বই পড়ার নেশা থাকলে আমার বাড়িতে কিছু বইয়ের সংগ্রহ আছে, আপাতত সেগুলো আপনার কাজে আসতে পারে।” পেছন থেকে বনমালীবাবুর গলার আওয়াজ ভেসে এল।

ভদ্রলোক যে কখন এই ঘরে ঢুকেছেন, বিমল খেয়ালই করেনি। এর পর আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল। অবশেষে দিগন্ত ডিউটিতে আসার পরেই বনমালীবাবু ও রমেশ পাশোয়ান গেলেন।

এ ষ্টেশনে রাতে কোনও যাত্রীবাহী ট্রেন থামে না। তবে অন্যান্য বেশ কিছু ট্রেন এ পথে যাতায়াত করে। ফলে সারা রাত যে ঘুমিয়ে কাটাবে এমনও নয়। আবার যেহেতু যাত্রীদের আনাগোনা নেই, তাই টিকিটবাবু হিমন্ত কলিতা, কিংবা কন্ট্রোলের পাশোয়ানকেও না থাকলে হয়ে যায়। যেটুকু দরকার সেটা একজনই করে নিতে পারে। বিমল ডিউটিতে লেগে গেল।

দিগন্ত এসে ওদের অফিস ঘরটাতেই বিছানা পাততে শুরু করেছে। গতকালও সেটা লক্ষ করেছে হিমন্ত। বাড়ি থেকে এসে একটুও দেরি করে না দিগন্ত। এসেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে। আর মুহূর্তের মধ্যেই নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। কাল তাই দিগন্তর সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। আজ তক্কে তক্কে আছে বিমল। দিগন্তকে বিছানা করতে দেখেই ও বলে উঠল, “এখনই ঘুমবে না দিগন্ত। কথা আছে।”

কথাগুলো হিন্দিতে বলল বিমল। কারণ স্থানীয় ভাষা ও জানে না। তাই হিন্দিই ভরসা। দিগন্ত কী ভাবল কে জানে, মাথা তুলে তাকাল। তারপর ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল, “জী বাবু, বলিয়ে কেয়া বোলেগা।”

বিমলের তেমন কোনও কথা নেই। ও তো শুধু সময় কাটাবার জন্যে কথা বলতে চায়। নাইট ডিউটি করতে ওর কোনও অসুবিধা নেই। আগেও তো করেছে। কিন্তু সে সব বড় বড় স্টেশনে। ওখানে রাত না দিন বোঝা দায়। সারাক্ষণ লোকের হাঁকপাঁক, একের পর এক ট্রেন আসছে, যাত্রীদের ছুটোছুটি কিংবা অপেক্ষা, মালপত্র নিয়ে কুলিদের ব্যস্ততা, ড্রাইভার-টিটি-টিসি-গার্ড ও আরও নানা কর্মীতে গমগম করে। ফলে সেখানে নাইট ডিউটির আলাদা চাপ মনে হয় না। কিন্তু এমন নির্জন স্টেশনে রাত কাটাবার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বিমলের। গতকাল সারা রাত কেমন গা ছমছম করেছে ওর। নিজে অনেক সুযোগ থাকলেও ঘুমোতে পারেনি। কিন্তু দিগন্তকে মহাসুখে ঘুমোতে দেখেছে।

বিমল ওকে বসার ইঙ্গিত করে বলল, “বোসো। তেমন কিছু নয়। তোমার সঙ্গে তো ভাল করে আলাপই হয়নি, তাই একটু আলাপ করি।”

নিজের করা বিছানার উপরেই বসল দিগন্ত। তারপর বিমলের দিকে তাকাল। বিমল বলল, “কদ্দিন ধরে চাকরি করছ?”

“অনেক দিন হল, স্যার। এই স্টেশন যখন থেকে চালু হল, তখন থেকেই।”

“বাহ, তা হলে তো তুমি এখানকার সবচেয়ে পুরোনো স্টাফ।”

দিগন্ত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, স্যার।”

বিমল বলে, “আচ্ছা, এই যে এত নির্জন জায়গায় স্টেশন, চারদিকে জঙ্গল আর মাঠঘাট, এখানে কোনও ভয়টয় কিছু নেই?”

“কীসের ভয়ের কথা বলছেন, স্যার?”

বিমল বলে, “এই ধরো বাঘ হাতি এইসব জংলি জন্তুটন্তুর কথা বলছি।।”

শুনে হেসে ফেলল দিগন্ত। বলল, “না স্যার, এদিকে বাঘ, হাতি, কিছু নেই। যদিও মাঝেমধ্যে বানরের ঝাঁক চলে আসে। তা ছাড়া সাপখোপ আছে। কাউকে কিছু করে না সাধারণত। তবে সাবধান থাকা দরকার।”

“আর অন্য কোনও ভয়?”

“অন্য ভয় মানে?” আবার জানতে চায় দিগন্ত।

বিমল বলে, “এই ধরো চোর ডাকাতের ভয়?”

শুনে সরবে হেসে ওঠে দিগন্ত। যেন বিমল কত আজব প্রশ্ন করেছে। হাসতে হাসতেই বলে, “মোটে তো চার ঘর মানুষ থাকে এখানে। তাদের জন্যে চোর ডাকাত আসে? ওদের তো আসা-যাওয়ার খাটনিই পোষাবে না, স্যার।”

বিমল মনে মনে ভাবে, সেই তো। এখানে তো বাইরের লোক কেউ থাকে না। মাত্র এই চারজন স্টাফ, এবং তাদের পরিবার। চোর নিশ্চয়ই দেড়-দু’ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে এখানে চুরি করতে আসবে না। অর্থাৎ চোরের সম্ভাবনা নাকচ করে দিতে হল। তখনই দিগন্ত যোগ করল, “স্যার, এ বড় শান্তির জায়গা। এখানে আপনি সারাদিন দরজায় তালা না দিলেও কোন অসুবিধা নেই। এই তো মাস দুই-তিন আগের কথা, পাশোয়ানবাবু ফ্যামিলি নিয়ে পাঁচ দিনের জন্যে কোথায় যেন গিয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিতেই ভুলে গেছে। পাশোয়ানবাবু ভেবেছে তার বৌ দিয়েছে, তার বৌ ভেবেছে তার ননদ দিয়েছে, আর ননদ ভেবেছে দাদা দিয়েছে। ট্রেন এসে গিয়েছিল বলে সবাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। এর পরের পাঁচ দিন বাড়ি ওভাবেই খোলা থাকল। একদম কিনারের কোয়ার্টার কিনা, তাই অন্যরাও কেউ খেয়াল করেনি যে বাড়ি খোলা। পাঁচ দিন কাটিয়ে ষষ্ঠ দিনে যখন সবাই ফিরল, তখন আবিষ্কার করল, এত দিন সব খোলা ছিল। কিন্তু ঘরের কুটোটাও খোয়া যায়নি। তা হলেই বুঝুন।”

ঘটনাটা শুনেই বিমলের মাথায় অন্য এক সম্ভাবনা উঁকি দেয়। মনে হল, একটা বড় প্রশ্নের উত্তর ও পেয়ে গেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে চোরের প্রসঙ্গ ছেড়ে জিজ্ঞেস করে, “পাশোয়ানের বোনও এখানে থাকে নাকি?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“বোন কত বড়?”

“বড়, স্যার। যুবতী মেয়ে। মাথায় একটু ছিট আছে নাকি। তাই বিয়ে হয়নি।”

“ছিট আছে মানে? পাগল?”

“না না পাগল ঠিক না। এমনিতে সবই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু দেখলে বা কথা বললে বুঝবেন, একটু বুদ্ধি কম। বা একটু অন্যরকম।”

বিমলের চোখের সামনে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়ানো সেই মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠে। ও মনে মনে নিশ্চিত হয় যে, মেয়েটি তা হলে পাশোয়ানেরই বোন। ওর পাশের চতুর্থ বা শেষ কোয়ার্টারটাই পাশোয়ানের। ফলে ও যখন ঘর থেকে ছুটে বেরোল, মেয়েটি এর আগেই নিজেদের ঘরে চলে গেছে। যদিও দেখে আপাতদৃষ্টিতে কিছু অস্বাভাবিক লাগেনি মেয়েটিকে। কিন্তু ওর আচরণটাই কি অস্বাভাবিক নয়? সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত পুরুষ তার নিজের ঘরে শুয়ে আছে, আর তাকে সে উঁকি মেরে দেখছে? যদি কোনও বাচ্চা বা অবোধ শিশু হত, মানা যেত। কিন্তু তা তো নয়। রীতিমতো এক যুবতী সে। এমন কাজ কোনও প্রকৃতস্থ মেয়ে বা মহিলা করবে না।




অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আরও একবার অবাক হওয়ার পালা। দরজা খুলেই বিমল দেখে, ঘরদোর একদম ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা। সদ্য যে মোছা হয়েছে, সেটা ভেজা মেঝে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। আগের দিন স্নান করে যে জামাকাপড়গুলি ধুয়ে উঠোনে শুকোতে দিয়েছিল, সেগুলোও ঘরে এনে পরিপাটি করে ভাঁজ করে রেখেছে কেউ। বিমলের চোখ রীতিমতো কপালে উঠেছে। কারণ এখন তো ঘরে নতুন তালা ঝুলছে, এবং ওটার দুটো চাবিই ওর নিজের কাছে। অর্থাৎ ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে কেউ ঘর খুলেছে, এমন সম্ভাবনা আর নেই। তা হলে ঘরের ভিতরে ঢুকল কীকরে? আর কেই বা ঢুকল!

হাজার বিভ্রান্তি নিয়ে যখন হতবাক হয়ে আছে বিমল, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর মনে হল কে যেন নূপুর পায়ে ওর শোওয়ার ঘর থেকে উঠোনের দিকে হেঁটে গেল। তড়িতে সেই শব্দ অনুসরণ করে উঠোনে ছুটে আসে ও। তখনই উঠোনের দরজা গলে কে যেন বেরিয়ে গেল। সবুজ ফুলছাপ শাড়ির প্রান্তভাগ বিমল স্পষ্ট দেখতে পেল। তা হলে কি এই দরজা দিয়েই আসাযাওয়া চলে? কৌতূহলী বিমল দৌড়ে দরজার কাছে এসে ওটা খোলার চেষ্টা করে। আর তখনই আবিষ্কার কিরে, এমনিতে বন্ধ মনে হলেও দরজাটা আলগোছে দেওয়ালের গায়ে সেঁটে আছে। দরজার কাঠের ফ্রেম পচে ও ঘুণ ধরে ঝরঝরে হয়ে আছে।

অদ্ভুত লাগে বিমলের। কেন মেয়েটা ওর ঘরে আসছে। আর কেনই বা ওর কাজকর্ম কিরে দিচ্ছে!

বেলা বাড়ছিল। নাইট ডিউটি করে ক্লান্ত বিমল। তাই ভাতের সঙ্গে আলু ও ডিম সিদ্ধ বসিয়ে স্নানে গেল ও। তারপর ফিরে এসে ভাঁজ করে রাখা পোশাকগুলো পরার জন্যে নিতেই অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে গেল মন। আহা! কী যত্ন করেই না সব গুছিয়ে গেছে! চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই নারীমূর্তি। মনের মধ্যে অদ্ভুত পুলক অনুভূত হয়। গুন গুনিয়ে গান করতে করতে ও জামাকাপড় পালটায়। ভেজা টাওয়েল মেলে আসে উঠোনে। এরপর চুল-টুল আঁচড়ে যখন ছোট্ট আয়নাটায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, ঠিক তখনই মনে পড়ল ও ভাত বসিয়ে স্নানে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, সর্বনাশ! ভাত বোধহয় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

আয়নাটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে উঠোন পেরিয়ে ভাত দেখতে ছোটে বিমল। কিন্তু কিচেনে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। স্টোভ নেভানো। ভাতের হাঁড়ি নামানো হয়ে গেছে। একটা গামলায় নিপুণ হাতে হাঁড়ি কাঁত করে ফ্যান ঝরাতে দেওয়া। পাশের একটা বাটিতে ডিম ও আলু সিদ্ধ খোসা ছাড়িয়ে রাখা। বিমল যারপরনাই হতবাক। আবার এসেছিল সে! কখন এল? চারপাশে তাকিয়ে আগন্তুককে খোঁজে ও। উৎকীর্ণ হয় আশপাশ থেকে নূপুরের শব্দ শোনার জন্যে। এবার যতটা না বিস্ময়, তারচেয়ে অনেক বেশি জিজ্ঞাসা জমে মনে। একই সঙ্গে অদ্ভুত ভাল লাগায় ভরে ওঠে মন। আবেগে চোখ ভিজে যায়। এমন করে ওর খেয়াল তো কেউ রাখেনি কখনও।

বিমল একাচোরা মানুষ। ওর জন্যে ভাবার বা ওকে ভালোবাসার বিশেষ কেউ নেই পৃথিবীতে। একদম শৈশবেই এক দুর্ঘটনায় মা বাবা দু’জনকেই হারিয়েছে। বড় হয়েছে জেঠুর বাড়িতে। সেখানে কখনও স্নেহ ভালোবাসা পায়নি। জেঠিমা ওকে বোঝা ভেবে এসেছে সব সময়। জেঠতুতো দাদা দিদিদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে, জেঠির নিত্য গঞ্জনা সয়ে ওর বেড়ে ওঠা। তাই একটু বড় হতেই বুঝেছিল, জেঠুর আশ্রয় থেকে যেভাবে হোক ওকে বেরিয়ে যেতে হবে। যে কোনও একটা কাজ জুটিয়ে নিজের ব্যবস্থা নিজের করতে হবে। সেটাই করেছিল বিমল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই বেরিয়ে এসেছিল জেঠুর বাড়ি থেকে।

প্রথমে এক মাড়োয়াড়ি দোকানে কাজ পেয়েছিল। দু’বেলা খাওয়া থাকা ওখানেই। রাতের ঘুমের ব্যবস্থাও দোকানেই করে নিয়েছিল। সেই সঙ্গে কলেজেও ভর্তি হয়েছিল। কলেজে যেতে পারত না বিশেষ, কিন্তু রাত জেগে পড়ত। আর সেই সঙ্গে যেখানেই চাকরির বিজ্ঞাপন দেখত, আপ্লাই করে চলছিল। এরই ফলশ্রুতি রেলের এই চাকরি। এতেও নাই নাই করে পাঁচ বছরে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন আর বিমলের বিশেষ কোনও চাওয়া নেই। তবে হ্যাঁ, একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন এখনও অধরা ওর কাছে।

বিয়ের বয়স নিঃসন্দেহে হয়েছে ওর। পাত্র হিসেবে অযোগ্যও নয়। কিন্তু পাত্রীর সন্ধান কে দেবে? জীবন সংগ্রামে এমন মজেছিল যে, এতদিন কোনও নারীর দিকে তাকানোর সুযোগই হয়নি। প্রেম তো দূরের কথা। কাজেই দেখাশোনা করে বিয়েই ওর ভবিতব্য। অথচ ওর হয়ে সেই দেখাশোনাটা করবে কে? এই প্রশ্নে এলেই দমে যায় বিমল।

এত দিন ভাবত, ওর জন্যে একমাত্র ভরসা খবরের কাগজের পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন কিংবা আন্তর্জালের ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো। কিন্তু এখন কেন কে জানে ওর মনে হচ্ছে, হয়তো সেসবের প্রয়োজন হবে না। রমেশ পাশোয়ানের এই বোনটার মধ্যেই যেন মনের মানুষটিকে খুঁজে পাচ্ছে ও। যে এমন কেয়ার নিতে জানে, এত খেয়াল রাখতে জানে, সে যে ভাষার লোকই হোক, যে জাত ধর্মেরই হোক, তার চেয়ে ভাল জীবনসঙ্গী বিমল আশা করে না।

মনে এক অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে ভাত খেল বিমল। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে। এখন টানা কয়েক ঘণ্টা ঘুমোবে ও। কেননা আজও নাইট ডিউটি আছে। মুখটুখ ধুয়ে দরজা আলগোছে আবজে কেবল শুয়েছে বিমল, তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। স্টেশন মাস্টার বনমালীবাবুর ফোন। ফোন তুলতেই তিনি বললেন, “দাশগুপ্ত, আপনার ঘরে কোনও রিপেয়ারিংয়ের কাজ আছে? কোনও কিছু মেরামতির প্রয়োজন? আই-ও-ডব্লিউকে কমপ্লেন পাঠাব। জানেনই তো, এখানে তারা সবসময় লোক পাঠাতে পারে না। তাই সব কোয়ার্টারের যা যা সমস্যা সব জানিয়ে একত্রে জানাই। তারাও এসে একবারে সব করে দিয়ে যায়।”

ছোট স্টেশনের এও এক সমস্যা। হঠাৎ কিছু বিগড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করা কঠিন। কুশল কারিগর ও রসদ দু’টোই পাওয়া সমস্যা। এমনিতে রেলের নিজস্ব সব ব্যবস্থা থাকে। রেল এলাকার সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আই-ও-ডব্লিউ অফিস সামলায়। হাসপাতাল, পাওয়ার হাউজ, দমকল, ইত্যাদিও থাকে। কিন্তু নিমাতির এত ছোট পরিসরে সব ব্যবস্থা এখনও হয়ে ওঠেনি। তবু বনমালীবাবু খুব কাজের লোক। তিনি ইমার্জেন্সির জন্যে স্থানীয় এক মিস্ত্রী ও প্লাম্বার ঠিক করে রেখেছেন। তা ছাড়া দিগন্ত নিজে ইলেক্ট্রিশিয়ান। কারেন্টের ছোটখাটো সমস্যাগুলো সে সমাধান করে দেয়।

এখন বনমালীবাবুর কথা শুনে প্রথমেই উঠোনের ভাঙ্গা দরজার কথা মনে পড়ল বিমলের। ওটা তো নামেই দরজা এখন। আসলে একটা ফটোকে পরিণত। আপাতদৃষ্টিতে বোঝা না-গেলেও আদতে দরজাটা একেবারে আলগা হয়ে লেগে আছে। জোরে হাওয়া বইলেই পড়ে যেতে পারে। সেটার কথা তাই বলতেই যাচ্ছিল বিমল, কিন্তু কী ভেবে থেমে গেল। উল্টে বলল, “নাহ, আমার কোয়ার্টারে সব একদম ঠিকঠাক আছে, স্যার। কোথাও কিছু মেরামতির দরকার নেই।”

যতই হোক, ওই দরজা এমন আলগা হয়ে আছে বলেই তো সেই রহস্যময়ীর অবাধ যাতায়াত সম্ভব হচ্ছে।




আজও ঘুম ভাঙল সন্ধের আগ দিয়ে। গতকালের মতো প্রায় একই সময়ে। জাগার পরেই বিমল খোলা জানলার দিকে তাকাল। আসলে সে কাউকে খুঁজল। কিন্তু জানলায় কাউকে না-দেখে মনে মনে একটু দমে গেল ও। তখন আর উঠতেই ইচ্ছে হল না বিছানার থেকে। ভাবল আরও একটু শুয়ে থাকা যাক। তাই পাতলা বালাপোশটা গায়ে জড়িয়ে নিল আবার।

এখন শীত ফুরিয়ে বসন্ত চলছে। মার্চ মাসের মধ্যভাগ। বাংলায় চৈত্রের শুরু। অন্যান্য জায়গায় এখনই যথেষ্ট গরম পড়ে গেছে। কিন্তু নিমাতিতে এখনও বেশ ঠান্ডা। চারপাশ এত খোলা, এবং এত গাছপালার প্রাচুর্যের জন্যেই সম্ভবত আবহাওয়া খুব মনোরম। এখনও পাখা চালানোর দরকার পড়েনি। ঘুমোনোর সময় রীতিমতো গায়ে কিছু জড়াতে হয়। নাইট ডিউটিতে তো পাতলা একটা সোয়েটারও পরতে হচ্ছে।

পাশ ফিরে কেবল চোখ বুজেছিল বিমল, অমনি পাশের ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল। চাদর সরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল ও। শুধু যেন এই হাসিটা কিংবা নূপুরের আওয়াজ শোনার জন্যেই উৎকীর্ণ ছিল এতক্ষণ। মনের ভেতর দিয়ে বসন্তের বাতাস বয়ে যায়। বিমল মাঝের দরজা দিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকায়। মুখোমুখিই দাঁড়িয়েছিল সেই মেয়ে। বিমল তাকানো মাত্র চোখেমুখে এক ঝলক হেসেই সরে গেল সেখান থেকে। আজ সে লাল-হলুদ চুড়িদার পাঞ্জাবি পরেছে। লাল পাঞ্জাবি, হলুদ চুড়িদার। ওড়নার রং হলুদ। এখনও দরজার কোণ থেকে ওড়নার প্রান্তভাগ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ সে চলে যায়নি। ওঘরেই আছে।

বিমল আজ খাটের থেকে নামল না। বরং বসে বসেই সেই মেয়ের উদ্দেশ্যে বলল, “ওঘরে কেন? সামনে এসো।”

এল না সে। একভাবে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। বিমল আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

তবু কোনও উত্তর নেই। বিমল একটুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “নামও বলবে না? তবে তোমার প্রতি আমি খুব কৃতজ্ঞ। আজ তোমার জন্যেই ভাত পোড়েনি। কিন্তু তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সব কাজ করে দিচ্ছ, অথচ সামনে আসছ না কেন?”

এখনও উত্তর নেই। বিমল এবার নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামে। ভাবে পায়ে পায়ে এগিয়ে একেবারে চমকে দেবে ঐ মেয়েকে। সেটাই করে। কিন্তু এ ঘরে এসে চমকে গেল ও নিজেই। কোথায় সে মেয়ে? সে তো কোথাও নেই! সামনের দরজা আবজানোই। যেমন শোওয়ার আগে আবজে রেখেছিল, সেভাবেই। ইচ্ছে করেই ছিটকিনি আটকায়নি ও। কিন্তু এখনও একই রকম দেখছে। অর্থাৎ মেয়েটি যাওয়ার আগে আবার ভেজিয়ে গেছে দরজা। কিন্তু এতক্ষণ যে ওর ওড়না উড়তে দেখল, সেটা কীকরে হল? এরও উত্তর পেতে সময় লাগল না। কীকরে যেন ওড়নার এক ছেড়া টুকরো দরজার ধারে একটা তারকাঁটায় গেঁথে ঝুলছে। নিঃসন্দেহে মেয়েটির ওড়নাই। অসাবধানে তারকাঁটায় লেগে ছিড়ে গেছে।

বিমলের খারাপ লাগে। ও ওড়নার টুকরোটা যত্ন করে তুলে রাখে। তারপর রাস্তার ধার থেকে একটা বড় পাথর কুড়িয়ে এনে তারকাঁটাটাকে বাড়ি দিয়ে উপড়ে ফেলে।

এসব করতে করতেই সন্ধ্যা নামে। বিমল রাতের কাজের জন্যে প্রস্তুত হয়। প্রথমেই এক কাপ চা বানিয়ে বিস্কুট সহযোগে খেয়ে নেয়। দুপুরের ভাত রয়ে গেছে। আছে আলু সেদ্ধও। এবার ও পিয়াজ লঙ্কা কুচি দিয়ে ডিমের ঝুরো ভাজা বানায়। রাতে ও দিয়েই ডিনার সেরে ডিউটিতে যাবে। ভেবেছে, এবার বাজারে গিয়ে ঘি ও কিছু স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার এনে রাখবে। নইলে এখানে খিদে পেলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিনে খাওয়ার উপায় নেই।

আজও ন’টার মধ্যেই স্টেশনে চলে এল বিমল। বনমালীবাবু বললেন, “অনেক আগেই চলে এলেন যে দাশগুপ্ত?”

“ঘরে থেকেই বা কী করব, স্যার। বোর লাগে।”

“এবার তা হলে সংসার বসান। বিয়ে থা করুন। একা একা সত্যি বাঁচা কষ্টকর।”

হাসল বিমল।

“হাসছেন যে? ঠিক বলিনি আমি?” জিজ্ঞেস করলেন বনমালী মুখার্জী।

বিমল বলল, “আমি আর কী বলি, স্যার। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছে।”

“না না, সব ঈশ্বরের উপরে ছেড়ে দিলে চলবে না। নিজেকেও উদ্যোগ নিতে হবে। বাই দ্য ওয়ে, এখন সব ঠিকঠাক চলছে তো? নতুন তালা লাগানোর পরে নিশ্চয়ই চোর-টোরের আগমন ঘটছে না?”

চোর শব্দটা শুনে নিজেরই অপ্রস্তুত লাগে বিমলের। কোথায় চোর? এখানে প্রতিটি মানুষই বড় ভাল। এত ভাল যে, বিমল কোথাও এমন পায়নি। নিছকই অজ্ঞতা বশত সন্দেহ হয়েছিল, ঘরে হয়ত চোর ঢুকছে। যদিও কখনও কিছু চুরি যায়নি। কেবল ঘরে কারও আগমনের ইঙ্গিত পেতেই মনে হয়েছিল নির্ঘাত চোরই হবে। কিন্তু এখন এমন ভাবনার জন্যে নিজেরই সঙ্কোচ বোধ হয়। বলে, “স্যার, কোথায় চোর? সেটা আমার মনের ভুল ছিল।”

“যাক, আপনার ভুল ভেঙেছে জেনে আমারও ভাল লাগল। তা এখন আর ঘরে জিনিসপত্র এদিক ওদিক হচ্ছে না তো?”

শুনে আবার হাসল বিমল। কিন্তু সত্যিটা প্রকাশ করল না। প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। তবে মনে হাল্কা একটা আশঙ্কা জন্মাল। আচ্ছা, এই যে মেয়েটি প্রায়ই ওর ঘরে আসছে, সেটা কি কেউ জানে না? কারও কি নজরে পড়ছে না? অন্তত পাশোয়ানের বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই জানে। কিন্তু পাশোয়ানের আচরণ দেখে তেমন কিছু বোঝেনি বিমল। মনে সংশয় দানা বাঁধে। যদিও তেমন কিছু প্রকাশ করে না ও।


১০


রোজকার মতো ডিউটি শুরু হয়েছে বিমলের। তবে এখন সে এইখানের নাইট ডিউটির ব্যাপারটা বেশ বুঝে গেছে। একটু হিসেব করে চললে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুমোবার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। বনমালীবাবু আগেই জানিয়েছিলেন। গত দু’দিন নিজেও ডিউটি করে বুঝে গেছে। তাই আজকে সঙ্গে একটা চাদরও নিয়ে এসেছে বিমল। রাত দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত সাধারণত আপ কিংবা ডাউন কোনও দিক থেকেই কোনও ট্রেনের এই পথে আসাযাওয়া নেই। একান্তই কোনও দূরপাল্লার গাড়ি অসম্ভব লেট করলে, কিংবা কোনও মালবাহী ট্রেন কখনও এ সময়ে পাস হয়। সে ক্ষেত্রেও আগেই জানা যায়। কাজেই মাঝের এই দু’ঘণ্টা মোবাইলে অ্যালার্ম সেট করে টানা ঘুমিয়ে নিতে পারবে। এ ছাড়াও অনেক বার টুকরো টুকরো পাওয়ার ন্যাপ নেওয়াই যায়। শুধু সুযোগের সদ্ব্যবহার জানতে হবে।

কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসটা বেরিয়ে যেতেই অফিসঘরের দরজা আবজিয়ে হুড়কো টেনে দিল বিমল। তারপর বিছানার চাদরটা আয়তাকার টেবিলটায় বিছিয়ে দিল। এখানেই শোবে ও। দিগন্ত নিজের বিছানায় অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমল চপ্পল খুলে টেবিলের উপরে উঠে পড়ল।

একটু হয়তো তন্দ্রামতো এসেছিল, কিন্তু তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল দরজা নক করার শব্দে। বিমল কান খাঁড়া করে শব্দটা বোঝার চেষ্টা করে। শোওয়া অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। একটু পরপরই কে যেন ঠকঠক করে দরজা নক করছে। বিমল ভাবল এখন তো কোনও ট্রেন নেই যে, কোনও যাত্রী আসতে পারে। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দু’টো চল্লিশ বাজে। এত রাতে তা হলে কে এসেছে? শোওয়া অবস্থার থেকে উঠে বসল ও। তবে টেবিল থেকে নামল না। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠল, “কে বাইরে?”

তখনই আওয়াজটা থেমে গেল। কোনও উত্তর এল না। ইতিমধ্যে বিমলের গলার আওয়াজে দিগন্ত জেগে উঠেছে। সে বলল, “ও কিছু না, স্যার। আপনি ঘুমান।”

বিমল বলল, “কিছু না মানে? এতক্ষণ ধরে দরজায় নক করছে কেউ, আর তুমি বলছ কিছু না?”

দিগন্ত বলল, “রাতের স্টেশন। এমন একটু-আধটু হয়ই। এসব পাত্তা দেবেন না। মোটেই দরজা খুলবেন না।”

বিমলের কিছু বোধগম্য হয় না। বিরক্তি নিয়ে দিগন্তের দিকে তাকায়। দিগন্ত আবার চাদর জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। অর্থাৎ আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে। প্রচণ্ড রাগ হয় বিমলের। গত দু’দিন ডিউটি করে ও বুঝেছে, স্রেফ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রেলের বেতন নিচ্ছে দিগন্ত। কোনও কাজ করে না। রাতে এসে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়, আর ভোর হতেই চলে যায়। এ ছাড়া আর কোনও কাজেই তাকে দেখেনি বিমল। সেই তুলনায় রঘু ঠিক বিপরীত। যতক্ষণ আছে, ততক্ষণই কিছু না কিছু করেই চলেছে সে। এমনকি এর তার ব্যক্তিগত কাজও বিনা বাক্যে করে দেয়।

ঠিক তখনই আবার দরজায় ঠকঠক শব্দ হল। এবার যেন মৃদু ধাক্কাও দিচ্ছে। ফলে দরজার বন্ধ পাল্লাও নড়ে নড়ে উঠছে। বিমল এখন একটু রাগত স্বরেই বলল, “কে দরজা ধাক্কাচ্ছেন? কী দরকার?”

দিগন্ত শুয়ে শুয়েই বলল, “স্যার, শুনবেন না। আপনি শুয়ে পড়ুন।”

দিগন্তের নির্লিপ্ততা দেখে আরও রাগ হল বিমলের। বলে উঠল, “অ্যাই দিগন্ত, তুমি শুয়ে শুয়ে ভাষণ না দিয়ে ওঠো তো। দরজার পাশের জানলাটা খুলে দ্যাখো কে এসেছে?”

দিগন্ত এবার উঠে বসে বড় বড় চোখে বিমলের দিকে তাকায়। বলে, “স্যার আপনি এখানে নতুন তো, তাই অনেক কিছু জানেন না। পরে বনমালী স্যারের থেকে শুনে নেবেন। এখন শুধু বলব, এসব শব্দকে পাত্তা দেবেন না।”

বিমলের ভুরুতে ভাঁজ পড়ে। বলে, “বনমালী স্যারের থেকে শুনতে হবে কেন? তুমি যদি জানো, তবে তুমিই বলো।”

দিগন্ত মাথা নিচু করে বলে, “ঠিক আছে, বলব স্যার। কিন্তু এই রাতে না। এখন আপনি শুয়ে পড়ুন। এখন দরজা খোলা ঠিক নয়।”

ঠকঠক আওয়াজটা থেকে থেকেই আসছে। অস্বস্তি হচ্ছে বিমলের। কিন্তু দিগন্ত এভাবে বলছে যে, দরজাটা খুলতেও পারছে না। অন্য সময় হলে বনমালী মুখার্জী বা অন্য কোনও সহকর্মীকে ফোন করে বিষয়টা জানাত। এবং তারা এসে ব্যাপারটা দেখতে পারত কিংবা যথাযত পরামর্শ দিত। কিন্তু এত রাতে কাউকে এ নিয়ে বিরক্ত করতে মন চাইল না। অগত্যা দিগন্তের কথা মেনে শুয়ে পড়ল আবার। তবু একবার বলল, “এমনও তো হতে পারে যে, কেউ খুব অসুবিধায় পড়ে সাহায্য চাইছে?”

“না, স্যার। সবটা শুনলে আপনি বুঝবেন, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। থাকতে থাকতে দেখবেন, মাসে অন্তত তিন-চারবার এমন ঘটেই। আজকে নিশ্চয়ই অমাবস্যা, পূর্ণিমা কিংবা একাদশী হবে।” বলল দিগন্ত।

অমাবস্যা-পূর্ণিমার মতো প্রাকৃতিক বিষয়ের সঙ্গে এ ঘটনার কী সম্পর্ক বোধগম্য হয় না বিমলের। ওর জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় দু’টোই বেড়ে চলে। তবে তখনই মোবাইল নিয়ে গুগল সার্চ করে পঞ্জিকা দেখে বেশ অবাক হল। দিগন্তের অনুমানই ঠিক। আজ ফাল্গুনের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী।


১১


সকাল হতেই দিগন্তকে চেপে ধরল বিমল। -“এবার বলো ঘটনাটা কী?”

তখনও অন্য কেউ ডিউটিতে আসেনি। আটটার আগে কেউ আসবেও না। ততক্ষণ বিমলই থাকবে। রঘু আসে সাড়ে সাতটার মধ্যে। দিগন্ত ঠিক ছ’টার সময় চলে যায় রোজ। কিন্তু আজ আটকে দিল বিমল।

দিগন্ত নিজের বিছানাটা গুছিয়ে একটা স্টুল টেনে বসে। তারপর চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ ঘুরিয়ে বলে, “আমি যে আপনাকে বলছি, সে কথা কাউকে বলবেন না যেন, স্যার।”

“কেন? তুমিই তো বললে, ব্যাপারটা সবাই জানে।” বলল বিমল।

“তা তো জানে। কিন্তু কেউ নিজের মুখে বলতে চায় না। আমিও বলতাম না। কিন্তু কালকে আপনি নিজেই দেখলেন। তা ছাড়া আপনি মাস্টার মানুষ। আপনাকে সব সময় নাইট ডিউটি করতে হবে। তাই আপনার জেনে রাখা উচিত।”

“আসল কথায় এসো।” তাড়া দিল বিমল।

দিগন্ত বলল, “ওটা জিতুমণির আত্মা, স্যার।”

“মানে! আত্মা মানে ভূত? আশ্চর্য! আর জিতুমণি কে?

“এখানকারই এক স্থানীয় যুবতী ছিল। খুব হাসিখুশি, ভাল মেয়ে। সেই জিতুমণিকে এক দিন সকালে রেলে কাটা অবস্থায় পাওয়া গেল।”

“মানে! অ্যাক্সিডেন্ট না আত্মহত্যা?”

“সে জানি না, স্যার। লোকে তো বলে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা কোনটাই না। ওটা একটা খুন। কিন্তু কে প্রমাণ করবে, স্যার? গরিবের জন্যে কোনও আইন নেই। শুনেছি জিতুমণি তখন গর্ভবতী ছিল।”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না। জিতুমণি নিশ্চয়ই বিবাহিত ছিল? ওর স্বামীই কি…”

“না স্যার, বিয়ে হয়নি তখনও।”

“তা হলে নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে ওর প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল? নাকি কেউ জোর করে কোনও অন্যায় করেছিল ওর উপরে?”

“অত কিছু বলতে পারব না। ওর বাবাকে আর পুরো পরিবারটাকেই চিনি। একদম সহজ সরল মানুষ ওরা। ওর বাবার নাম জীবন পাটোয়ারি। নিমাতি বাজারে জীবনের দোকান আছে। দোকানে জিতুমণিও কখনও সখনও বসত। সেখানেই প্রামাণিক স্যারের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিল।”

“প্রামাণিক স্যার কে?”

“অমিতাভ প্রামাণিক স্যার। আপনার জায়গায় বেশ কয়েক বছর আগে সে ছিল।”

বিমল বুঝতে পারে, কার কথা বলছে দিগন্ত। এই অমিতাভ প্রামাণিকের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রই তো ও ব্যবহার করছে এখন। শুনেছে এখন সে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পোস্টেড। কিন্তু এই জিতুমণির কথার মধ্যে ওঁর প্রসঙ্গ আনল কেন দিগন্ত? প্রশ্নটা করেই ফেলল বিমল, “বুঝলাম। কিন্তু এখানে অমিতাভ প্রামাণিকের কথা আসছে কেন?”

“প্রামাণিক স্যারের বাড়িতে প্রায়ই জিতুমণিকে আসতে দেখা যেত। জিতুমণি মারা যাওয়ার দিন দুই পরেই প্রামাণিক স্যার ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। এর পরে আর ফিরেই আসেনি। শুনেছি অনেক দিন, মানে ছ’-সাত মাস ছুটিতে ছিল সে। এর পরে ট্র্যান্সফার নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।”

কপালে ভাঁজ পড়ে বিমলের। তার মানে কি প্রামাণিকের সঙ্গে জিতুমনির কোনও প্রেমের সম্পর্ক ছিল? এর ফলেই কি গর্ভবতী হয়ে পড়ে সে? এবং এটাই কি জিতুমণির অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ? দিগন্তের কথাগুলো যেন সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। ও সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী ধারণা, জিতুমণির মৃত্যুর সঙ্গে অমিতাভ প্রামাণিকের কোনও সম্পর্ক আছে কি?”

“সে আমি ছোট মুখে বড় কথা বলি কী করে? তবে লোকে কানাঘুষো নানা কথা বলে। মনে আছে, এই ঘটনার পরে বড়জোর দুই কি তিন দিন প্রামাণিক স্যার এখানে ছিল। কিন্তু জিতুমণির জন্যে ওঁর মধ্যে তেমন কোনও দুঃখ দেখিনি, যতটা একটা ঘড়ির জন্যে দেখেছি।”

“এই ঘড়ির প্রসঙ্গটা কী? এ আবার নতুন টপিক আনলে দেখি?”

“না, নতুন কিছু না, স্যার। এও সবাই জানে। ঐ সময়ে প্রামাণিক স্যারের ঘড়িটা যেন কীকরে হারিয়ে গিয়েছিল। ওটা নাকি খুব দামী ঘড়ি ছিল। বিলিতি ঘড়ি। খাঁটি সোনার চেন। জিনিসটা প্রামাণিক স্যার পেয়েছিল ওঁর ঠাকুদ্দার থেকে। সব সময় স্যারের হাতে ঘড়িটা থাকত। কিন্তু সেটাই কীকরে হারিয়ে গেল, কে জানে! এর পর স্যার যতদিন ছিল, ততদিন তন্ন তন্ন করে ঘড়িটা খুঁজেছে। ঘরে বাইরে সর্বত্র। কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুঁজতে দেখা গিয়েছে সেখানে, যেখানে জিতুমণির টুকরো হওয়া দেহটা পাওয়া গিয়েছিল। রেললাইনের পাশে সে জায়গার ঝোপঝাড় সরিয়ে অনেকবার তাকে ঘড়ি খুঁজতে দেখা গেছে। এতেই লোকের মনে একটা সন্দেহ হয়েছিল আরকি।”

“জিতুমণির মৃত্যুর কোনও তদন্ত হয়নি?”

“তদন্ত? না-নাহ। এসব বড় বড় শহরে হয়। যাদের পয়সার জোর আছে তাদের জন্যে হয়। বললাম না, গরিবের জন্যে কিছুই নেই।”

বিমল কী বলবে ভেবে পায় না। দিগন্তের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে পরবর্তী কথা শোনার জন্যে। দিগন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এই জিতুমণির আত্মাই আসে, স্যার। প্রতি পূর্ণিমা-অমাবস্যা আর একাদশী তিথিতে এখানে আসে। অপঘাতে মরা তো, তাই আত্মা মুক্তি পায়নি। তবে কাউকে কিছু করে না। সবাই বলে সে আসে প্রামাণিক স্যারের খোঁজে।”


১২


আজকেও এসে ঘর একদম টিপটপ সাজানো গোছানো পেল বিমল। মেঝে ঝাড়ু দিয়ে মোছা হয়েছে। বিছানার চাদর টানটান করে পাতা। শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা। আজ আর অত অবাক হল না বিমল। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে মেয়ে যেন কিছুতেই ধরা না-দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। সবসময় আসছে, পরম আপনজনের মতো ঘরের কাজকর্ম করে রাখছে, কেবল সামনে আসছে না।

প্রথমে এক কাপ চা বানিয়ে খেল বিমল। এরপর রান্না বসাল। আজ একটু মনোমতো খাওয়ার ইচ্ছে করছে। আগের দিন দু’বেলাই সিদ্ধ ভাত খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। তাই এখন আয়েস করে ডিম কষা রাঁধবে। সঙ্গে একটু মুসুরডাল সিদ্ধ। একার জন্যে এটাই অনেক বিলাসিতা।

উনুনে প্রথমেই ডিমসিদ্ধ বসাল বিমল। তার পর পিয়াজ রসুন টমেটো মিহি করে কেটে নিল। এগুলো পেস্ট করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু যেহেতু শিলনোড়া বা মিক্সার গ্রাইন্ডার কিছুই নেই, তাই আপাতত এভাবেই রাঁধতে হবে। মশলা অবশ্য সবই গুঁড়ো কিনে এনেছে।

ডিম সিদ্ধ হতে সময় লাগে। তাই এই সময়টাতে স্নান সেরে নিল। তারপর রান্নায় ফিরে এসে দেখে সে মেয়ে আবার কাজ এগিয়ে রেখেছে। ডিম উনুন থেকে নামিয়ে একেবারে খোসা ছাড়িয়ে রাখা। কিন্তু বিমল সবচেয়ে অবাক হল, পাশে রাখা জিনিসটা দেখে। একটা মিক্সার গ্রাইন্ডার। নিঃসন্দেহে পুরোনো। কিন্তু এটা হঠাৎ কোত্থেকে এল! বিমল হতবাক।

জিনিসটার দিকে ভাল করে তাকিয়েই অবশ্য মনে পড়ল, এই টকটকে লাল রঙের জিনিসটা প্রামাণিকের ট্রাঙ্কে দেখেছিল ও। কিন্তু ওটা যে একটা মিক্সার গ্রাইন্ডার সেটা বোঝেনি তখন। অজস্র হাবিজাবি জিনিসের মধ্যে এমন ভাবে ওটা রাখা ছিল যে, সব জিনিস না সরালে বোঝা সম্ভব নয়, কোনটা কী জিনিস। যেটাই হোক, এটা তো এখানে ছিল না! ট্রাঙ্ক থেকে বেরই করেনি ও। তা হলে এখন এটা কিচেনে কে আনল? তবে প্রশ্নের উত্তর পেতে দেরি হল না। বুঝল, এও সে মেয়েরই কাজ। এবং সে জানত যে, ট্রাঙ্কে একটা মিক্সার গ্রাইন্ডার আছে। তাই এখন প্রয়োজন দেখে বের করে রেখেছে। মনে প্রশ্ন নিয়ে এদিক ওদিক তাকায় বিমল। তখনই রান্নাঘরের জানলার ধার থেকে একটা গোলাপি শাড়ির আবছায়া যেন সরে গেল। বিমল বোঝে, সে জানলার বাইরেই দাঁড়িয়ে। তাই বলে ওঠে, “আমি জানি তুমি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আছো। প্লিজ, সামনে এসো।”

কিন্তু নিরুত্তর সে মেয়ে সামনে এল না। বিমল জানলার ধারে এসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে আছে। জানলার পাল্লার নীচ দিয়ে কেবল গোলাপি শাড়ির কুচি দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির এই সলজ্জ আচরণ, এই লুকোচুরি খেলা, বিমলের বেশ মজাই লাগছে। বলল, “ঠিক আছে, সামনে না হয় পরেই এসো, কিন্তু তোমার নাম তো জানাও।”

তবু উত্তর নেই। বিমল বলল, “নামটাও বলবে না তো? তা হলে আমিই তোমার একটা নাম রাখি, কেমন?”

ওপাশ থেকে সে নীরবই রইল। বিমল বলল, “তোমার নাম দিলাম টুকি। টুকি পাশোয়ান। যেভাবে লুকোচুরি খেলছ আমার সঙ্গে, এর বাইরে আর নাম খুঁজে পেলাম না।”

ঠিক তখনই ওপাশ থেকে খিলখিল করে হাসি ভেসে এল। বিমলও হেসে সঙ্গও দেয়।

কথা বলতে বলতেই বিমল উনুনে কড়াই চাপায়। তেল ঢালে, ডিম ছাড়ে, মিক্সার গ্রাইন্ডারে পিয়াজ রসুন পেস্ট করে। বলে, “এই মিক্সারটা বের করে দিয়ে সাংঘাতিক উপকার করেছ তুমি। অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এবার দ্যাখো, কেমন ডিমের কষা রাঁধি। একটু চেখে যেও।…”

ঠিক তখনই দরজার সামনে একটা ছায়া দেখে চমকে ঘুরে তাকাল বিমল। কিন্তু যা ভেবেছিল তা নয়, অর্থাৎ সে মেয়ে নয়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিমন্ত কলিতা। বিমল যতটা অবাক, সম পরিমাণ অবাক হিমন্তও। বলল, “অনেক বার দরজা নক করেছি আপনার, সাড়া পাইনি। তাই দরজা যেহেতু খোলাই ছিল, ঢুকে পড়লাম। কিন্তু আপনি একা একা কার সঙ্গে কথা বলছিলেন দাশগুপ্ত?”

বিমল যারপরনাই অপ্রস্তুত। কী বলবে ও? আলগোছে হেসে কথা এড়াতে চায়। বলে, “আরে আসুন আসুন। একা একা রান্না করছি তো, তাই সময় কাটাতে সিনেমার ডায়লগ আওড়াচ্ছিলাম। ”

হিমন্ত কতটা বিশ্বাস করল কে জানে, বলল, “আসলে আজ বাজারে গিয়েছিলাম। চিকেন এনেছি। গিন্নি রান্না করে আপনার জন্যে একটু পাঠিয়ে দিল।” বলেই সঙ্গে আনা ক্যাসারোলটা এগিয়ে ধরল।

কিন্তু এর পরে একটুও বসল না হিমন্ত। বিমল খুব বলেছিল এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যেতে। কিন্তু খুব তাড়া দেখিয়ে চলে গেল সে।

এদিকে মেঘ না চাইতে জল পেয়ে বিমল পুলকিত। চিকেন কারিটা রীতিমতো অপ্রত্যশিত প্রাপ্তি। আজ তা হলে চিকেন ও ডিমকষা দিয়ে ওর মহাভোজ। কিন্তু একই সঙ্গে একটা খটকাও মনে বিঁধছে। নানা ভাবনা খেলছে মনে। হিমন্ত কি সত্যিটা বুঝতে পেরে গেল? পাশোয়ানের বোন যে ওর ঘরে অহরহ আসে, এ কথা কি সে জানে?

এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই আবার রান্নাঘরে ফিরে আসে ও। কিচেনে ঢুকে প্রথমেই জানলার ধারে এল। উঁকি দিয়ে দেখল, সেই গোলাপি শাড়ি আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। সে চলে গেছে। কিন্তু তখনই ওর চোখ চলে গেল উল্টো দিকের কোয়ার্টারটায়। ওটাই হিমন্ত কলিতার। ঠিক একই সমান্তরালে হিমন্তের কিচেনের জানলাও হাট করে খোলা। হিমন্তের গিন্নিকে রান্না করতে দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ সেই মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তায় এমন মজে ছিল যে, এ ব্যাপারটা একেবারেই খেয়াল হয়নি। এখন একটা শিরশিরে বাতাস খেলে গেল মনে। ও নিশ্চিত, হিমন্ত না হলেও ওর গিন্নি নিঃসন্দেহে মেয়েটাকে ওর জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এবং ওদের আলাপচারীতাও শুনেছে। যদিও হিমন্ত এমন ভাব করছিল যেন, কিছুই জানে না।

যাকগে, বিমল মনে মনে ভাবে, কেউ জানলেই বা ক্ষতি কী? বরং ভালই হবে। ওদের সম্পর্কটা সহজে মেনে নেবে। এ কথা সত্যি যে, বিমল সে মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছে। পাশোয়ান রাজী থাকলে, সম্পর্কটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে প্রস্তুত ও।


১৩


আগেই প্ল্যান করে রেখেছিল, তাই দুপুরে খেয়ে শোওয়ার আগে স্টেশনে এল বিমল। ঘরের পোশাকেই চলে এসেছে। ক’জনই তো মাত্র লোক। তাও আবার সবাই চেনা। তাই ডিউটি না-থাকলে অত ফর্মালিটির প্রয়োজন পড়ে না। গত রাত থেকে ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে আছে বিমল। রাতের সেই দরজা নক করার শব্দ, দিগন্তের বলা কাহিনি, অমিতাভ প্রামাণিকের আকস্মিক চলে যাওয়া এবং আর ফিরে না আসার রহস্য, সবই মাথার ভিতরে অদ্ভুত ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে। দিগন্তের সব কথাই যে ওর বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, তা নয়। আবার একেবারে ফেলেও দিতে পারছে না। কারও মৃত্যু নিয়ে কেউ এমন সুনিপুণ গল্প বানাবে না বলেই ওর ধারণা। তবু সত্যতা যাচাই করা দরকার। বনমালীবাবুকে জিজ্ঞেস করলেই সব বিস্তারিত জানা যাবে। সে উদ্দেশেই এখন স্টেশনে আসা।

স্টেশনে ডিউটিরত বনমালীবাবু সহ হিমন্তকেও পেয়ে গেল বিমল। ও সরাসরিই প্রসঙ্গে এল। তার পর বলল, “আমার বিশ্বাস আপনারা অনেকটাই জানেন, স্যার। প্লিজ আমাকে সব খুলে বলুন।”

হিমন্ত বলল, “আমিও এখানে তুলনায় নতুন। তিন বছর হল আছি। রাতে যেহেতু আমাকে ডিউটি করতে হয় না, তাই আমার এই অভিজ্ঞতা নেই। তবে ঘটনাটা আমিও শুনেছি। মুখার্জি স্যারই এই ব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন।”

বনমালী মুখার্জী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সম্ভবত নিজের বক্তব্য গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “হ্যাঁ ঘটনাটা, মানে জিতুমণির অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা, এবং ওর সঙ্গে প্রামাণিকের প্রেমের সম্পর্কের কথা সত্যি। এও সত্যি যে, জিতুমণি যখন মারা যায় তখন সে অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সম্ভবত প্রামাণিকের সন্তানই ধারণ করেছিল সে। যদিও কিছুই তদন্ত বা প্রমাণ হয়নি।”

“আর এই ভৌতিক কাণ্ডগুলির কথা? অমাবস্যা পূর্ণিমা ইত্যাদিতে নাকি…”

আনমনে মাথা ঝাঁকালেন বনমালী মুখার্জি। অস্ফুটে বললেন, “হ্যাঁ, সে রাতগুলোয় অদ্ভুত এই ব্যাপারটা ঘটে। দরজা খিল দিয়ে না-রাখলে আবজানো দরজা খুলেও যায়। মনে হয় ঘরে কেউ ঢুকেছে। কিন্তু কাউকে দেখা যায় না। শুধু অনুভূত হয়। এক সময় সে চলেও যায়। তখন আবার দরজা নিজের থেকেই আগের মতো বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয় যেন কাউকে খুঁজতে এসেছে এবং না-পেয়ে নীরবে চলে যাচ্ছে।

তবে এটুকুই। এর বেশি কিছু ঘটে না। একে ভূত বা অপ্রাকৃত বা অন্য কী বলবেন, সেটা আপনার কথা। এর পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে কিনা আমার জানা নেই। শুধু এটাই বলতে পারি, কারও কখনও কোনও ক্ষতি হয়নি। তাই এখন ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছি। সে রাতগুলোয় সামান্য একটু গা ছমছম করে ঠিকই, কিন্তু খুব যে ভয় পাই তাও নয়। আপনিও পাবেন না। তা ছাড়া দিগন্ত তো সঙ্গেই থাকে।”

“কথাটা আমার ভয় পাওয়া বা না-পাওয়ার নয়।” বলল বিমল। “আমি শুধু ব্যাপারটার সত্যতা জানতে চাইছি। অমিতাভ প্রামাণিকের কথা কিছু বলুন। সে কি এই মৃত্যুর সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত?”

“সে তো আমার পক্ষে বলা কঠিন দাশগুপ্ত। সেভাবে কোনও তদন্ত হয়নি, সাক্ষ্য প্রমাণ সব লোপাট হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু ব্যাপার সেদিকে ইঙ্গিত দেয় বৈকি।”

“যেমন?”

“যেমন, জিতুমণির মৃত্যুর তিন দিনের মাথাতেই সে হঠাৎ এখান থেকে চলে গেল। এর পর দীর্ঘ সাত মাস সে মেডিকেল গ্রাউন্ডে ঘরে বসে রইল। তারপর উপর মহলে ধরাধরি করে কীভাবে যেন ট্র্যান্সফার নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। এই পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহজনক।”

“লোকটার নাকি ঘড়িও হারিয়েছিল তখন?”

“হ্যাঁ, ঠিক। দিগন্ত আপনাকে সবই বলেছে দেখছি। তবে এই ঘড়ি হারানোয় আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্যের হল, প্রামাণিককে একাধিকবার ওর ঘড়ি খুঁজতে দেখা গিয়েছে দুর্ঘটনাস্থলের আশাপাশে। সেটাই সবার মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল।”

“পেয়েছিল ঘড়ি?”

“নাহ।”

“প্রামাণিক আর কখনও আসেনি নিমাতিতে?”

“নাহ। হয়তো জনরোষের ভয়েই আসেনি। কারণ স্থানীয়রা ওকেই খুনি ভাবছিল। যদিও তদন্ত তেমন কিছুই হয়নি। আমার ধারণা যে করেই হোক, প্রামাণিকই তদন্ত প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের রোষ তো এতে যায় না। ও এলেই মারধর খেত। তাই হয়তো আর ফেরেনি এখানে। অনেক দিন পরে আমি যোগাযোগ করেছিলাম, ওর জিনিসগুলো কী হবে, সে ব্যাপারে। বলেছিলাম, এখন তো সব ঠান্ডা হয়েছে, আপনি এসে আপনার জিনিসপত্র নিয়ে কোয়ার্টার খালি করে দিন।”

“তখন কী বলল সে?”

“বলল, সামান্যই তো জিনিস। সেগুলোর দামের চেয়ে বয়ে নেওয়ার খরচ তুলনায় অনেক বেশি হবে। তাই ওগুলো আর সে নিয়ে যেতে চায় না। নতুন যারা আসবে তারাই যেন সেসব ব্যবহার করে।”

বিমল এবার হিমন্ত কলিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার তেমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে কি? মানে বলতে চাইছি ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা।”

হিমন্ত বলল, “আমার হয়নি। তবে আমার স্ত্রীর হয়েছে।”

“তাই নাকি? ঘটনাটা বলুন।”

“আমার স্ত্রীর ভোরে ওঠা অভ্যাস। সকালে সে হাঁটতে বেরোত। রেল লাইনের পাশ দিয়ে যে সরু কাঁচা রাস্তাটা গেছে, সেটা ধরেই হাঁটত সে। প্রথম প্রথম আমাদেরও জিতুমণির ব্যাপারটা এত জানা ছিল না। তাই সে হাঁটার সময় যেখানে জিতুমণি কাটা পড়েছিল, সেখানেও চলে যেত। আর ওখানেই দু’দিন একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এক দিন নাকি ওর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা হেসেছেও। কিন্তু একটু পরেই আবার ওদিকে তাকিয়ে দেখেছে মেয়েটা সেখানে নেই। তখন চারদিকে তাকিয়েও আর খুঁজেই পায়নি ওকে। এতেই ওর কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়। সে এসে আমাকে বলে।

আমি তখন মুখার্জি স্যারের কাছেই জানতে চাই, এখানে তেমন কোনও মেয়ে আছে কিনা। থাকলে সে কোন পরিবারের। কারণ এ তো জানাই যে, এই জায়গায় আমাদেরই কয়েকজন স্টাফ ও তাদের পরিবার ছাড়া কেউ থাকে না।

তখন স্যারই আমাদের ব্যাপারটা খুলে বলেন। এবং রেল লাইনের সেই জায়গায় একা যেতে বারণ করেন।”

তখনই বনমালী মুখার্জী যোগ করলেন, “হ্যাঁ, এ ব্যাপারেও একটু সতর্ক থাকবেন দাশগুপ্ত। নদীর ধারে ব্রিজটা শুরু হওয়ার ঠিক আগেই জিতুমণি কাটা পড়েছিল। তাই ওখানে কখনও যেতে হলেও, কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। একা যাবেন না।”

“দেখা যায় বুঝি?”

“এমনটাই শুনেছি। যদিও আমি দেখিনি। তবে রাতের ট্রেনের ড্রাইভার ও গার্ডরা অহরহ নাকি ওকে দেখে থাকে। কখনও নাকি রেল লাইনের উপরে বসে থাকতেও দেখে।”

“এ তো রীতিমতো স্পাইন-চিলিং ব্যাপার স্যাপার!” বিস্ময়ে বলে ওঠে বিমল। চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে ওর। শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নামে। মৃদু হাসলেন বনমালী মুখার্জী। বললেন, “অত ভয় পাবেন না দাশগুপ্ত। আমরা তো এত দিন ধরে হেসেখেলে থাকছি এখানে। কখনও কোনও খারাপ করেনি সে। আসলে মেয়েটার উপরে প্রচণ্ড অন্যায় হয়েছে হয়তো। তাই ওর অতৃপ্ত আত্মা মুক্তি পাচ্ছে না।”


১৪


নাইট ডিউটির ধকল সত্ত্বেও দুপুরে কিছুতেই ভাল ঘুম হল না বিমলের। ছিন্ন ছিন্ন তন্দ্রা এসেই কেটে যাচ্ছিল। জিতুমণি নামের অচেনা একটি মেয়ের করুণ মৃত্যু এবং সেই সঙ্গে অমিতাভ প্রামাণিকের ভূমিকা ওকে ভাবাচ্ছিল। সব শুনে ওরও মনে হচ্ছে, অমিতাভ প্রামাণিকই খুনি। নইলে সে এমন পালিয়ে গেল কেন?

ঘুম হচ্ছে না বলে বেশিক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হল না। কিন্তু উঠেই বা কী করবে? কাজ তো কিছু নেই। দিনের রান্না রয়ে গেছে। তাই রান্নার ঝামেলাও নেই। উঠে চা করে খেল বিমল। তার পর কিছুক্ষণ অযথাই মোবাইল ঘাঁটল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুক্ষণ বিচরণ করল। কিন্তু এসব ওর ভাল লাগে না। বোর লাগছিল ওর। তখনই মনে হল, প্রামাণিকের ট্রাঙ্কটা ভাল করে দেখা উচিত। ওতে কী কী আছে না-আছে খুলে দেখা যাক। কাজের কিছু থাকলে বের করে নেবে। যেমন আজকে মিক্সার গ্রাইন্ডারটা পাওয়া গেল। সেটা অবশ্যই ওই মেয়েটার জন্যে। যার নাম রেখেছে টুকি। ভেবেই হাসি পেল বিমলের।

এর পরেই কাজে নেমে পড়ল বিমল। একটা স্টুলের উপরে বসে ট্রাঙ্কের ভারী পাল্লাটা টেনে তুলল। এবারও সেই বোটকা গন্ধ নাকে ধাক্কা দিল। তবে এবার যেন কিছুটা কম। বিমল একটা একটা করে জিনিস বের করে নীচে নামাতে লাগল। ড্যাম ধরে যাওয়া ব্যবহৃত বেডকভার, বালিশ, মশারি, এবং একটা পাতলা কম্বল নামানোর পরে অনেকটাই হাল্কা হল সেটা। ভেতরে এখনও পড়ে আছে চশমার বাক্স, প্লাস্টিকের মগ, দুখানা চীনেমাটির কফিকাপ, দাঁতের ব্রাশ রাখার প্লাস্টিকের স্ট্যান্ড, ইত্যাদি আরও অনেক হাবিজাবি। কিন্তু এসবের ভিড়ে চকচক করে ওঠা একটা জিনিসে দৃষ্টি আটকে গেল বিমলের। আশেপাশের জিনিসগুলো সরাতেই চমকে উঠল ও। এটা একটা হাতঘড়ি। পুরোনো দিনের গোল ডায়াল, কিন্তু অসম্ভব আভিজাত্যপূর্ণ।

বিমল বুঝে গেল, এই সেই ঘড়ি, যেটা অমিতাভ প্রামাণিক হারিয়েছে। হয়তো ট্রাঙ্কেই সেটা কোনওভাবে খুলে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্রামাণিক সেটা বুঝতে পারেনি। তাই হয়তো ট্রাঙ্কটা খুঁজেই দেখেনি। উল্টে বাইরে খুঁজে বেরিয়েছে। বিমল ঘড়িটা বের করে আনে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব অমূল্য জিনিস। একেবারে অ্যান্টিক পিস। দ্রব্যমূল্যও নেহাত কম হবে না। সোনার তো বটেই, সঙ্গে বেশ কটা দামী পাথরও বসানো। পাথর সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান নেই বিমলের। তবু মনে হল যেন হীরে ও চুনি পাথর। সে জন্যেই এই ঘড়ি হারিয়ে এত মুষড়ে পড়েছিল প্রামাণিক।

বিমল সঙ্গে সঙ্গে বনমালী মুখার্জীকে রিং করে ঘড়ির কথা জানায়। শুনে স্বাভাবিকভাবেই তিনিও সাংঘাতিক অবাক। বিমল বলল, “প্রামাণিকের ফোন নম্বর থাকলে ওকে জানিয়ে দিন, স্যার।”

বনমালী মুখার্জি বললেন, “হ্যাঁ-হ্যাঁ আছে আমার কাছে। দেখি এখনই রিং করছি। এ তো মারাত্মক খবর দিলেন আপনি!”

কিছুক্ষণ পরেই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল বিমলের কাছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল, “মে অ্যাই টক টু মিস্টার বিমল দাশগুপ্ত?”

“ইয়েস, …স্পিকিং…।” বলল বিমল।

ওপাশের বক্তা বলল, “মিস্টার দাশগুপ্ত, আমি অমিতাভ প্রামাণিক বলছি। আপনি…”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ,” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রতিক্রিয়া জানাল বিমল। বলল, “ভালই হল আপনি রিং করেছেন দেখে। তা প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ, আপনার রেখে যাওয়া জিনিসগুলো আমাকে খুব সাহায্য করছে। ওসব ব্যবহার করছি আমি। তা, আজকে ট্রাঙ্কটা গোছাতে গিয়ে আপনার ঘড়িটা পেয়ে গেলাম।”

“সেটা জেনে কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার, বলে বোঝাতে পারব না দাশগুপ্ত। অশেষ ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। কিন্তু একই সঙ্গে বেশ অবাকও হচ্ছি, জানেন?”

“অবাক কেন?”

“দুটো কারণে অবাক হয়েছি। প্রথমত এমন একটা মূল্যবান জিনিস পেয়েও আপনি যে সততার পরিচয় দিলেন, তা আজকের দিনে সত্যি বিরল। দ্বিতীয়ত, ঘড়িটা ট্রাঙ্কে গেল কেমন করে সেটাই বিস্ময়ের। ঘড়ি হারানোর পরে আমি ট্রাঙ্কটা কিনেছিলাম। ঘরের জিনিসপত্র সব ভরে রাখার জন্যে ওটা তড়িঘড়ি কিনতে হয়েছিল। রঘু কিনে এনে দিয়েছিল। তাই ওটার ভিতরে ঘড়িটা পেয়েছেন শুনে সত্যি অবাক লাগছে। যাকগে, ওটা যে পাওয়া গেছে, সেটাই বড় কথা। আমি তো আশা পুরোপুরি ছেড়েই দিয়েছিলাম। জানেন? ঘড়িটা আমার ঠাকুরদার। সেই যুগে তিনি বিলেতে পড়াশোনা করেছেন। জমিদার বাড়ির সন্তান ছিলেন। অঢেল টাকাপয়সার মালিক ছিলেন। ল্যাঙ্কো ব্র্যান্ডের এই ঘড়িটা তার খুব শখের সংগ্রহ ছিল। ল্যাঙ্কোর নাম শুনেছেন তো?”

বিমল সহজ ভাবে অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, “সরি, আমার ঠিক জানা নেই।”

“ল্যাঙ্কো হল, ল্যাঞ্জেনডর্ফ ওয়াচ কোম্পানির শর্ট ফর্ম। এটা সম্ভবত সবেচেয়ে প্রাচীন কিংবা প্রাচীনতমগুলির মধ্যে একটি অন্যতম ঘড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি। এদেশীয় নয়, সুইজারল্যান্ডের কোম্পানি। দাদু খোদ কোম্পানির আউটলেটে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে ঘড়িটা করিয়েছিল। এটা তৈরি হয়েছিল উনিশশো ছত্রিশে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে। ডায়ালের নীচে এর পুরো ডিটেল পাবেন।…ভাবুন কত পুরোনো আর ইউনিক জিনিস।”

বিস্ময় প্রকাশ করল বিমল। বলল, “এ তো সব দিক থেকেই মহামূল্যবান। ঐতিহাসিক মূল্যই তো অনেক।”

“একদম। সে জন্যেই ঘড়িটা হারিয়ে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, এমন সুখবরটা দেওয়ার জন্যে।”

হাসল বিমল। বলল, “তা, এবার আপনার কাছে জিনিসটা পৌঁছাই কী করে বলুন তো? ডাকযোগে বা কুরিয়ারে পাঠানো ঠিক হবে কি?”

“না না না, এ ভুল করবেন না। আপনি ওটা আপনার কাছেই রাখুন। আমি আগামীকাল ভোরের ট্রেনেই নিমাতি রওনা হচ্ছি। উঠব আপনার ওখানেই।”

“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।” বলল বিমল।

কথাবার্তা প্রায় শেষই হয়ে এসেছিল, তখনই ঘরের কড়া নাড়ার শব্দ শোনে বিমল। প্রামাণিকের থেকে বিদায় চেয়ে দরজা খোলে সে। দেখে, রমেশ পাশোয়ান দাঁড়িয়ে। অফিস ফেরত বিমলের কাছে এসেছে সে। তাই ঘরে ঢুকল না। শুধু বলল, “কাল আমার ছেলের জন্মদিন। সামান্য আয়োজন করেছি। রাতে কিন্তু আমার ওখানে ডিনার করবেন। এখানকার সবাই নিমন্ত্রিত।”

বিমল বলল, “নিশ্চয়ই যাব। কিন্তু কাল আবার অমিতাভ প্রামাণিকের আসার কথা। সম্ভবত বিকেলের মধ্যেই এসে পড়বে।”

“জানি। মুখার্জী স্যার বলছিলেন। আপনি নাকি তার ঘড়ি পেয়েছেন? খুব ভাল কথা। প্রামাণিক এলেও আমার ওখানেই ডেকে নেব। আপনার কোনও আলাদা আয়োজন করার দরকার নেই।”

শুনে আশ্বস্ত হয় বিমল। মনের ভিতরে একটা আনন্দের হাওয়াও বইতে শুরু করেছে। পাশোয়ানের বাড়িতে গেলে নির্ঘাত সে মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে। পরিচয়ও হবে। তখন কি নিজেকে লুকিয়ে রাখিতে পারবে সুন্দরী? ভেবেই অদ্ভুত পুলক জাগে বিমলের।

ইতিমধ্যে সন্ধে গড়িয়ে রাত ঘন হয়েছে। পাশোয়ান চলে গিয়েছে। এবার বিমল ডিনারের আয়োজন করে। এ সপ্তাহে পুরোটাই ওর নাইট ডিউটি।


১৫


আজও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই স্টেশনে রওনা হল বিমল। রেল কোয়ার্টারের গলি পেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই প্লাটফর্মে ওঠার সিঁড়ি। বাড়ি থেকে প্লাটফর্ম সব মিলিয়ে বড় জোর মিনিট দুই-আড়াইয়ের পথ। আপন মনে হেঁটে আসছিল ও। গলির মুখটাতে যখন এসেছে, তখন মনে হল কে যেন সজনে গাছটার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। গলিটার ঠিক এই জায়গায় বেশ অন্ধকার থাকে সব সময়। গলির ভেতরের ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলো এখানে পৌঁছায় না। তেমনই প্লাটফর্মের আলোও এখানে আড়াল হয়ে থাকে। সাপখোপের ভয়ে রাতে এই জায়গাটুকু মোবাইলের আলো জ্বেলে পার হয় বিমল। সেখানেই যেন অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ।

স্বাভাবিকভাবেই ভুরুতে ঈষৎ ভাঁজ পড়ে বিমলের। মেরেকেটে মাত্র ক’জনই তো বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? একটু সতর্ক হয়েই এগোয় ও। খানিক যেতেই দেখে, সেই মেয়ে। আজ তার পরনে নীল রঙের সালোয়ার। রঙটার জন্যেই সম্ভবত অন্ধকারে মিশে আছে প্রায়। বিমল থমকে দাঁড়ায়। মনের ভেতরে আকস্মিক বয়ে যায় চোরা আনন্দের স্রোত। এবার একেবারে মুখোমুখি দু’জনে। সে যেন বিমলের অপেক্ষাই করছে। বিমলের মুখ দিয়ে বিস্ময়সূচক প্রশ্ন বেরিয়ে আসে, “তুমি এখানে!”

কিছু বলল না সে। বিমল বলল, “এখনও এমন নীরব থাকবে?”

অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তবু বিমলের মনে হল, মেয়েটি হয়তো হাসল। কিন্তু বড় ম্লান সে হাসি। আগের সেই গজদন্ত বের করা প্রাণবন্ত হাসি এ নয়। অন্ধকারে বিমল ঠিক বুঝতে পারছে না। বলল, “নামটা তো বলো। নাকি আমি তোমাকে টুকিই ডাকব?” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলল বিমল। কিন্তু উল্টো দিক থেকে কোনও প্রত্যুত্তর নেই।

এক তরফাই কথা চলছে। বিমল বলল, “আচ্ছা বলো, এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো? কারও অপেক্ষা করছ কি?”

এবার যেন ঈষৎ মাথা দোলাল সে। বিমল জিজ্ঞেস করল? “কার জন্যে অপেক্ষা?” বলেই গভীর ভাবে তাকাল মেয়েটির দিকে। এই অন্ধকারেও বিমলের মনে হল, মেয়েটির চোখ দু’টো যেন ছলছল করছে। ও কাঁদছে! বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে বিমলের। কেন এত থমথম করছে ওর মুখ? কেন কাঁদছে হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েটা? মেয়েটার অজানা ব্যথা যেন বিমলের মধ্যেও সিঞ্চিত হয়। ও কিছু বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু এর আগেই বনমালীবাবুর গলার স্বর ভেসে এল, “এখানে দাঁড়িয়ে আপনমনে কী বলছেন দাশগুপ্ত?”

চমকে উঠে ঘুরে তাকায় বিমল। হঠাৎ যেন ঘোর কাটে ওর। বনমালী মুখার্জী আবার বলেন, “কার সঙ্গে কথা বলছেন? এখানে তো কেউ নেই!”

বিমল মাথা ঘুরিয়ে সজনে গাছটার দিকে তাকায়। সত্যিই তো! কেউ তো নেই এখানে। কিন্তু এই তো সে ছিল। পলকের মধ্যে কোথায় গেল তা হলে? বিমল হতবিহ্বল। কোনও উত্তর নেই ওর কাছে। বনমালীবাবু বললেন, “চলুন আপনাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

বিমলের সব কেমন অদ্ভুত লাগে। বলে, “কী দরকার স্যার? আমি চলে যাব।”

“চলুন না। গল্প করতে করতে যাই। আমার তো কোনও কাজ নেই।”

বিমলের কোনও বাধাই মানলেন না ভদ্রলোক। ওর সঙ্গে আবার অফিসে এলেন তিনি।

অফিসে গিয়ে বিমল দেখে, দিগন্ত আগেই এসে গেছে। সে তার বিছানা পেতে ঘুমানোর জন্যে তৈরি। এতেই হঠাৎ যেন একটু খেপে উঠলেন বনমালীবাবু। বললেন, “অ্যাই দিগন্ত। খালি ঘুমোলেই চলবে? আমি বলছি, আজ তুই একদম পড়ে পড়ে ঘুমোবি না। দাশগুপ্ত স্যারের সঙ্গে ডিউটি করবি। একসঙ্গে থাকবি। স্যার যত বার বাইরে যাবে, ততবার তুইও যাবি। অন্যথা যেন না হয়, বুঝলি?”

দিগন্ত মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা স্যার।”

বনমালীবাবু এবার বিমলের দিকে ফিরলেন। বললেন, “আমাদের চারদিকে অনেক মায়া বুঝলেন? সব কিছুকে পাত্তা দেবেন না। আর হ্যাঁ, ভয়ও পাবেন না।”

বিমল কিছু বলে না। ওর যেন সব কেমন ঘেঁটে গেছে। এত কাছের থেকে দেখল, অথচ এত ভুল দেখল? ওর কেবলই মনে হচ্ছে, এ হতেই পারে না। সে নিশ্চয়ই ওখানে ছিল। নিশ্চয়ই ওকে কিছু বলতে এসেছিল। পরে বনমালীবাবুকে দেখে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও। এমনিতেও সে মেয়ে লুকোচুরিতে ওস্তাদ।

রাতটা কাটল স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু বারংবার সেই মেয়ের অশ্রুসজল মুখখানির কথা মনে পড়ল বিমলের। আর যত বার মনে পড়ল, তত বারই বুকের ভিতরে একটা কষ্ট অনুভব করল সে। এ ছাড়া রাত কাটল নির্বিঘ্নে। স্টেশন মাস্টার বনমালীবাবুর নির্দেশ মেনে দিগন্ত ওর সঙ্গে জেগেই থাকল প্রায়। কেবল অবসরে ঘুমালো। সবই স্বাভাবিক চলল। কেবল বিমলের মনের ভিতরে চলল চাপা ঝড়। ঘটনাটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এতটাই ভুল দেখল ও! এইতো এখনও চোখ বুজলে দেখতে পারছে সেই মুখ, সেই ছলছল দু’টি চোখ, নীল সালোয়ার। সব মনের ভুল হতে পারে! বিমল ভেবে তল পায় না।


১৬


বিকেল পাঁচটার ট্রেনে অমিতাভ প্রামাণিক এসে গেল। বিমল বাড়িতেই ছিল। ঘড়িটা হাতে পেয়ে প্রামাণিক প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত। বারংবার বিমলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু জিনিসটা কীকরে ট্রাঙ্কে গেল, এবং সে কেন সেটা দেখেনি, এই ব্যাপারে প্রামাণিক এখনও বিস্ময় প্রকাশ করছে। প্রামাণিক বলল, ঘড়িটা হারিয়ে যাওয়ার পরে সে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু ট্রাঙ্কে খোঁজেনি কারণ, ট্রাঙ্ক তো কিনেছেই এটা হারানোর পরে। নিমাতি ছেড়ে যাওয়ার আগের দিন। যাওয়ার আগে ট্রাঙ্কের ভিতরে ঘরে যাবতীয় জিনিসপত্র ভরে রেখে যায় সে। সুতরাং ট্রাঙ্কের মধ্যে ঘড়ি থাকার সম্ভাবনাটাই খুব অবাক করছে তাকে। যাই হোক, এখন জিনিসটা ফিরে পেয়ে সে যারপরনাই আনন্দিত।

বিমল চা করে আনল। সঙ্গে বিস্কুটও দিল। আজ রাতের খাওয়া পাশোয়ানের বাড়িতে। রমেশ পাশোয়ান প্রামাণিককেও ফোন করে নিমন্ত্রণ করে রেখেছে। বিমল দেখল সঙ্গে একটা বড়সড় উপহারের বাক্স এনেছে প্রামাণিক। বোঝা গেল, এটা পাশোয়ানের ছেলের জন্যেই। ওর জন্মদিন উপলক্ষেই তো আজকের ভোজ।

বিমল নিজেও দুপুরে বাজারে গিয়ে উপহার কিনে এনেছে। ঠিক সাতটা নাগাত তৈরি হয়ে নিল বিমল। ট্রলিব্যাগ থেকে ইস্তিরি করা একটা টিশার্ট বের করল। সঙ্গে জিন্স। সাধারণত যা করে না, আজ তাই করল। মুখে হাল্কা পাউডার দিল। গায়ে পছন্দের পারফিউম। যতই হোক, আজ একটা বিশেষ দিন। আজ ওর টুকির সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক পরিচয় হবে।

পাশোয়ানের বাড়ি গিয়ে দেখে, অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে। বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে সব। পাশোয়ানের ছোট ছেলের জন্মদিন। তার বয়স আট হল। আরও এক ছেলে আছে পাশোয়ানের। তার বয়স বারো-তেরো হবে। স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল পাশোয়ান। কিন্তু তখনও পাশোয়ানের বোনকে আশেপাশে দেখতে পায়নি। বিমলের চোখ তো সব ছাপিয়ে একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে হচ্ছে ওই মেয়ে, বিমলের টুকি।

অতিথিরা যারা আছে, প্রত্যেকেই বিমলের চেনা। বনমালী মুখার্জী এখন ডিউটিতে আছেন বলে কেবল তাঁর স্ত্রী এসেছেন। বাকিরা অর্থাৎ হিমন্ত কলিতার স্ত্রী ও দুই যমজ শিশু সন্তান, দিগন্ত এবং রঘুও আছে। রঘু আজ ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরেনি। নিমন্ত্রণ খাওয়ার জন্যে থেকে গেছে। সবাইকেই দেখা যাচ্ছে কেবল একজন ছাড়া। কোথায় গেল সে? বিমল অস্থির হয়ে ওঠে।

একটু পরেই কেক কাটা হল। সবাই সেখানে উপস্থিত। কেবল সে মেয়ে ছাড়া। বিমলের চোখ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। ধৈর্য হারাচ্ছে সে। এবারও কি সে সামনে আসবে না? একটু রাগও হচ্ছে মনে মনে। এত আড়ালে থাকলে চলবে কী করে? সম্পর্ক কি এভাবে এগোতে পারে?

এরই মধ্যে কাগজের প্লেটে প্লেটে কেক বিতরণ শুরু হয়েছে। তখনই বিমল দেখল, এক স্থূলকায় মহিলা একটা ট্রেতে করে কেক সাজিয়ে এনেছে। দেখেই বোঝা যায় অন্যদের থেকে সে সামান্য আলাদা। আজ যাদের স্পেশাল চাইল্ড বলা যায়, তাদেরই একজন সে। পাশোয়ান সামনে এসে বিমলকে বলল, “এ আমার বোন।”

ধক করে উঠল বিমলের বুক। মুহূর্তের মধ্যে স্থাণু হয়ে গেল ও। বিস্ফারিত চোখে তাকাল কেবল। সৌজন্য বশত নমস্কার জানাতেও ভুলে গেল। ইতিমধ্যে ওর হাতে কেকের প্লেট তুলে দিয়ে সে চলে গেছে পরবর্তী অতিথির দিকে।

পাশোয়ান বিমলের এই অবাক হওয়ার কারণ বুঝল না। তাই বলল, “ও ছোটবেলার থেকেই মেন্টালি রিটার্ডেড। তাই আর বিয়ে দিয়ে উঠতে পারিনি।”

কেউ পিছন থেকে ছুরি মারলেও হয়তো এতটা শক পেত না বিমল। ওর মাথা পুরোপুরি ঘেঁটে গেছে। এই মহিলা যদি পাশোয়ানের বোন হয়, তা হলে সে মেয়ে কে? এতক্ষণ ধরে যাকে খুঁজছে, সে কি এখানে থাকে না? তবে কোথায় থাকে? কোত্থেকে আসে? অজস্র প্রশ্ন এসে ভিড় জমায় মাথায়। ওর কেমন পাগল পাগল লাগে।

এর পর যতক্ষণ সেখানে থাকল, বিমল যেন নিজের মধ্যেই থাকল না। বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। একবার হিমন্ত কলিতা জিজ্ঞেসও করল, “কী খবর দাশগুপ্ত? কেমন যেন আনমনা দেখাচ্ছে আপনাকে? সব খবর ঠিক তো?”

বিমল হেসে নিজেকে সামলে নিল।

হিমন্ত কলিতা সবার আগেই খেয়ে স্টেশনে চলে গেল। যাতে বনমালী মুখার্জি খেতে আসতে পারেন। এখানে সবার মধ্যে এমনই অদ্ভুত বন্ধন যে, এভাবেই একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে সবাই। মিনিট পনেরোর মধ্যে এসেও গেলেন বনমালী মুখার্জী। বিমল, অমিতাভ প্রামাণিক, বনমালীবাবু, রঘু ও দিগন্ত এক সঙ্গে খেতে বসল। এর পর যখন ফেরার জন্যে উঠল তখন বনমালী মুখার্জী বিমলকে এক ফাঁকে ডেকে বললেন, “দাশগুপ্ত, আজকে নাইট ডিউটিটাও আমি চালিয়ে নিচ্ছি। আপনি বাড়িতে থাকুন।”

ব্যাপারটা বুঝতে না-পেরে বিমল বলল, “কেন স্যার? সারাদিন ডিউটি করেছেন আপনি, আবার কেন রাতে করবেন? ওটা আমার ডিউটি আমিই করব।”

“আপনার ঘরে গেস্ট আছে। তাই ঘরেই থাকুন না।” বললেন বনমালী মুখার্জী।

বিমল বলল, “সে জন্যেই তো আরও ডিউটিটা করা দরকার স্যার। ঘরে শোওয়ার ব্যবস্থা বলতে তো ঐ ছোট একখানা চৌকি। প্রামাণিকেরই চৌকি। আজ ওকে ওটা ছেড়ে দিয়ে আমি ডিউটি করব। ওখানেও তো ঘুমোতে পারব।”

বনমালীবাবু একটু চুপ করে কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “সে বুঝলাম। কিন্তু আমি বলছি অন্য কারণে। আজ আবার অমাবস্যা। আপনি ভয়টয় পাবেন না তো?”

কথাটা বিমলের পৌরুষে বিঁধল। মোটেই সে ভীতু নয়। সবচেয়ে বড় কথা, বনমালী মুখার্জী যাতে ভয় পায় না তাতে সে কেন ভয় পাবে? তাই বলল, “এখন তো আমি সব জেনে গেছি, স্যার। আপনি নিশ্চিত থাকুন, এখন আর ভয়ও পাব না, সাবধানও থাকব।”

রঘু ওখানেই দাঁড়িয়ে দু’জনের কথাবার্তা শুনছিল। সে এবার উপযাজক হয়ে বনমালী মুখার্জীর উদ্দেশে বলল, “চিন্তা কিরবেন না, স্যার। আজকে তো আমিও স্টেশনে থাকব। এত রাতে আর বাড়ি ফিরব না। তাই আমি আর দিগন্ত মিলে দাশগুপ্ত স্যারকে পুরো সঙ্গ দেব।”

শুনে বনমালীবাবু যেন আশ্বস্ত হলেন।

এর পরেই অমিতাভ প্রামাণিককে নিজের কোয়ার্টারে রেখে বিমল চলে এল ডিউটিতে।


১৭


আজ যেহেতু অমাবস্যা, সে জন্যে বিমলরা সবাই অধিক সতর্ক। ট্রেন যাতায়াতের সময় ছাড়া অফিসঘর খিল দিয়ে আটকে ভেতরে থাকছে তিনজন। বাইরে যখন বেরোতে হচ্ছে, তখন বিমলের সঙ্গে রঘু আর দিগন্তও বেরোচ্ছে। তিন জন থাকায় বেশ জমজমাট আজ রাতের ডিউটি।

কিন্তু বিমলের মনে অনবরত কাঁটা ফোটাচ্ছে একটাই প্রশ্ন, —সে মেয়ে তা হলে কে? বড় অস্থির লাগছে ওর। মাঝেমধ্যে একটা আশঙ্কা মনে উঁকি দিচ্ছে। আর তখনই সারা শরীর হিম হয়ে আসছে ওর। বিমল ভাবে, যে করেই হোক সে মেয়ের পরিচয় ওকে জানতে হবে। না হলে ও কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে বা।

দিগন্ত আজ বিছানা করলেও ঘুমোয়নি। রঘু আর ও সেখানে বসে আছে। দিগন্ত রাতের ঘটনাবলী সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। সে বলল, “স্যার, যা ঘটে সব রাত দু’টোর থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে ঘটে। এর আগেও না, পরেও না। কিন্তু এই দেড় ঘণ্টা মারাত্মক সময়।”

বিমল বলল, “প্রতি অমাবস্যা, পূর্ণিমা আর একাদশীতে সে আসে? মানে মাসে চারবার সে আসেই?”

দিগন্ত বলল, “হ্যাঁ স্যার। এই চার দিন ফিক্সড। তবে ইচ্ছে হলে এর বাইরেও কখনও সখনও আসে।”

বিমল বলল, “এলে নাকি দেখা যায় না কিছুই। শুধু বোঝা যায়। এদিকে হিমন্তের মিসেস নাকি দেখেওছে, তুমি কখনও দেখেছ দিগন্ত?”

“অনেকবার, স্যার।” বলল দিগন্ত, “রাতের ফাঁকা স্টেশনে বেরলে অনেকবার লাইন ধরে হেঁটে যেতে দেখা যায় তাকে।”

রঘু বলল, “আমিও দেখেছি। আমার যে দিনের ডিউটি, তাও দেখেছি। একবার তো একদম কাছের থেকে।”

“পুরোটা বলো।” বলল বিমল।

রঘু বলল, “সময়টা ছিল শীতের সময়। গত বছরেরই ঘটনা। পৌষ কিংবা মাঘ হবে। এদিকটায় এমনিতেই খুব ঠান্ডা পড়ে। গত বারও মারাত্মক ঠান্ডা ছিল। তেমনই ঘন কুয়াশা। বেলা দশটার আগে রোদের মুখ দেখা যায় না, এমন অবস্থা। কুয়াশা কেটে সাইকেল চালিয়ে আমি সাতটার থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে কাজে এসে যাই। যত ঝড়-বৃষ্টি-কুয়াশা হোক, আমার সময়ের নড়চড় হয় না। তা, সেদিনও তেমনই এসেছি। খোলামেলা বলে এদিকটাতে কুয়াশা আরও বেশি থাকে। পুরো স্টেশন চত্বর ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় মুড়ে আছে। আমি এসেই বাগানের কাজে লেগে গেলাম।

কাজ করতে করতে হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হয়। মনে হয়, আমি যেন একা নই। আরও কেউ সামনে আছে আমার। আমি ভাবলাম বুঝি মুখার্জী স্যার। তিনি সময় পেলেই এসে বাগানের তদারকি করেন, আমার কাজকর্ম দেখেন। সেটা ভেবেই আমি মুখ না তুলে কাজ করতে করতে বললাম, “ডালিয়াগুলো কেমন ফুটেছে, দেখেছেন স্যার?”

কিন্তু স্যারের কোনও উত্তর এল না দেখে একটু অবাক হলাম। এর পর মুখ তুলে তাকাতেই আমার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড়। দেখি, সে সামনেই দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বাগানটা দেখছে। একদম স্পষ্ট তার চেহারা দেখছি আমি। মেটে রঙের একটা শাড়ি আর কালো ব্লাউজ পরা। আমার তখন এমন অবস্থা যে, না পারছি উঠে পালাতে, না পারছি ওখানে থাকতে। বড় জোর আধ মিনিট সময় সে সেখানে ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন অনন্ত সময়। জীবনে এত ভয় কখনও পাইনি, স্যার। একেবারে সাক্ষাৎ অশরীরীর সামনে আমি! ঐ আধ মিনিট কী করে যে কেটেছে, বলে বোঝাতে পারব না। এর পরেই সে কুয়াশার ভিতরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছিল।”

“ওফ! সাংঘাতিক। আমার সব অবিশ্বাস্য লাগছে। নিমাতিতে না এলে, এবং সে রাতের অভিজ্ঞতা না হলে আমি হয়তো এসব গুলগপ্পো বলে উড়িয়ে দিতাম। আচ্ছা দিগন্ত, জিতুমণি দেখতে ঠিক কেমন ছিল বলো তো?”

“সুন্দর ছিল, স্যার।” দিগন্ত বলল।

রঘুও বলল, “সেদিন যেমন দেখেছি তাতে আমারও সুন্দরী মনে হয়েছে।”

বিমল বলল, “শুধু সুন্দর বললে কি বোঝা যায়? বলছি যে ঠিক কেমন ছিল দেখতে, সেটা বলো।”

এবার দিগন্ত যেন একটু মুশকিলেই পড়ে। জিতুমণি কেমন দেখতে ছিল সেটা কী করে বর্ণনা করা যায়, ও ভেবে পাচ্ছে না। বিমলই বলল, “মেয়েটার কি লম্বা চুল ছিল?”

“হ্যাঁ স্যার। একদম কোমর পর্যন্ত চুল ছিল।”

“চুলে কি বেণী বাঁধত? নাকি খোলাই ছেড়ে রাখত?”

দিগন্ত একটু ভেবে বলল, “দুই রকমই তো দেখেছি, স্যার। কখনও দুই দিকে বেণী ঝুলিয়ে আসত। কখনও আবার খোলা চুলেও।”

দুই বেণীর কথা শুনে বিমলের ভিতরটা শিরশির করে ওঠে। ওর অনুমান মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আরও নিশ্চিত হতে হবে। জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মেয়েটা হাসলে কি গজ দাঁত দেখা যেত?”

শুনে দুই চোখ বিস্ফারিত করে দিগন্ত বলে উঠল, “হ্যাঁ, স্যার। একদম ঠিক বলেছেন। কি-কিন্তু আপনি কীকরে জানলেন?”

বিমলের মনের ভিতরে দমকা হাওয়া বয়ে গেল যেন। তা হলে, যা ভাবছে সেটাই সত্যি! এ কয়েকদিন যাকে অনবরত দেখেছে, যার উপস্থিতি প্রতি পদে অনুভব করেছে সে তা হলে কোনও রক্তমাংসের কেউ নয়? ভাবতেই শরীরের সমস্ত রক্ত জমে গেল।

“হ্যাঁ স্যার, আপনি কীকরে জানলেন? আপনিও কি তাকে দেখেছেন নাকি?” এবার প্রশ্ন করে রঘু।

বিমল প্রাণপণে নিজেকে সামলে ম্লান হাসে। তারপর সত্যিটা গোপন করে বলে, “না দেখিনি। আসলে ঐ ট্রাঙ্কে একটা মেয়ের ফটো পেয়েছিলাম। ওটা জিতুমণি কিনা সন্দেহ হয়েছিল। তাই মিলিয়ে নিলাম।”

অবিশ্বাস করল না দুই শ্রোতা। রঘু এবার বলল, “কিন্তু জানেন, স্যার? সে কিন্তু এমনিতে খুব পয়া।”

বিমল বলল, “মানে! পয়া বলছ কেন? আমি তো ভূতপ্রেত বলতে অশুভ শক্তিই জানি।”

“না স্যার, সে কথা ঠিক নয়। আমরা কিন্তু কেউ ওকে অশুভ মানি না। হ্যাঁ, ইহজগতের কেউ নয় বলে, একটু এড়িয়ে থাকি, কিংবা ভয়ও পাই ঠিকই, কিন্তু সে আজ পর্যন্ত কারও কোনও ক্ষতি করেনি। আর যারা ওর দর্শন পেয়েছে, তাদের পরে ভালই হয়েছে। সে জন্যেই তো ওর বিরুদ্ধে আমাদের কারও কোনও নালিশ নেই।

আমি যেদিন তার প্রথম দেখা পেলাম, সেদিনই আমার চাকরির পারমানেন্ট হওয়ার কাগজ এসেছিল। মুখার্জি স্যার একদিন দেখেছিল। সেদিনই স্যারের ছেলে একটা ভয়ানক রোড এক্সিডেন্ট থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে গিয়েছিল। এমনই কিছু না কিছু ভাল হয়ই। ওর দেখা পেলে সঙ্গে সঙ্গে বোঝা না গেলেও মোটামুটি এক মাসের মধ্যে কোনও না কোনও ভাল খবর আসেই। এটা একদম নিশ্চিত।”

বিমল মজা করে বলে, “তা হলে তো তার দর্শন পাওয়া আমার খুব প্রয়োজন। প্রোমোশনের পরীক্ষাটা দিয়ে রেখেছি। কে জানে হয় কিনা।”…

গল্পে গল্পে সময় পেরোচ্ছিল। এরই মধ্যে প্যাসেঞ্জার ও মালবাহী মিলিয়ে দু’টি আপ ও তিনটে ডাউন ট্রেন নিমাতি ক্রস করেছে। ঘড়ির কাঁটা দুইয়ের ঘরে পৌঁছতেই নড়েচড়ে বসল তিনজন। বিমলের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। তুলনায় অনেক স্বাভাবিক দিগন্ত ও রঘু। তারা খোস মেজাজে গল্প করে চলেছে। তবে এখন আর সে অশরীরীকে নিয়ে কোনও কথা নয়। সন্তর্পণে সেসব কথা এড়িয়ে এখন চলছে অন্য গল্প। পাশোয়ানের বাড়ির নেমতন্নে কোন আইটেমটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে, কে কতটা খেয়েছে, এসবই এখন গল্পের বিষয়।

বিমল গল্প শোনার ফাঁকে ফাঁকেই আড় চোখে দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কান খাঁড়া করে আছে, দরজায় ঠক ঠক শব্দ শোনার জন্যে। মন্থর গতিতে সময় গড়ায়। সেকেন্ড মিনিট পেরিয়ে সোয়া দু’টো বেজে গেল। তখনও তেমন কিছু ঘটল না। অর্থাৎ সে তখনও এল না।

সে কেন আসছে না, বিমলরা জানে না। আসলে সে তখন বিমলের কোয়ার্টারে গেছে।


১৮


ভীষণ এক অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল অমিতাভ প্রামাণিকের। মনে হচ্ছে কে যেন ওর পাশে শুয়ে আছে। একদম ওর গা ঘেঁষে। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পারছে সে। ছোট্ট চৌকিতে তাই ঠাসাঠাসি অবস্থা। মনে মনে ভাবল, নির্ঘাৎ বিমল দাশগুপ্তই কাজের ফাঁকে ঘুমোতে এসেছে। যখন এখানে পোস্টেড ছিল, সে নিজেও নাইট ডিউটিতে দেদার ঘুমাতো। আসলে কাজ তো তেমন নেই। তাই ঘুমাতে বাধাও নেই। তবে সে কখনও অফিস ছেড়ে কোয়ার্টারে এসে ঘুমাতো না। অফিসেই শোওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল।

চৌকিটা ছোট বলে শুতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। পাশ ফিরতেও পারছে না। জেগে যাওয়ায় বাথরুমও পেয়েছে ওর। প্রামাণিক অন্ধকারেই বিছানার থেকে নেমে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ডের দিকে এগোয়। এই ঘর ওর পরিচিত। তবু বহু দিনের অনভ্যাসে সুইচ বোর্ডটা পেতে একটু সময় লাগে। তখনই অদ্ভুত একটা আওয়াজ কানে আসে ওর। কে যেন কাচের চুড়ি পরে হাত নাড়ছে। কীসের আশঙ্কায় মুহূর্তেই শরীর অবশ হয়ে আসে প্রামাণিকের। তড়িঘড়ি সুইচ খুঁজে আলো জ্বালে। কিন্তু তখনই বিছানায় চোখ যেতেই সে পাথর হয়ে যায়।

চৌকির উপরে যাকে দেখতে পেল, তাকে দুঃস্বপ্নেও আশা করেনি অমিতাভ প্রামাণিক। তাও আবার এত বছর পরে। আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে গেল সে। থরথর করে কাঁপতে লাগল। কিন্তু ছুটে পালাতেও পারছে না। কে যেন ওর পা দু’খানা মাটিতে গেঁথে দিয়েছে। আর্তনাদের মতো ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “জি-জি-জিতুমণি! তু-তু-মি এখানে ক্কি-কীকরে?”

রক্তশূন্য সেই নারীমূর্তি অপার্থিব আওয়াজে হেসে উঠল। তার চোখে আগুন জ্বলছে। প্রতিহিংসায় বিকৃত অভিব্যক্তি।

প্রামাণিকের শরীর বেয়ে হিমস্রোত নামে। কে যেন বরফের চাঁইতে ফেলে দিয়েছে তাকে। শিরশির করে কেঁপে ওঠে সে। নিদারুণ অসহায় ভাবে বলে ওঠে, “…আ-আ-আমাকে ক্ক-ক্ষমা করো জি-জিতুমণি। আমি খুব ভু-ভুল করেছি।…”

সামনের আবছায়া অবয়ব নিরুত্তর। কেবল অদ্ভুত হিমশীতল পাথুরে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রামাণিক মরিয়া হয়ে বলে চলে, “বি-বিশ্বাস করো, আ-আ-আমি তোমাকে খু-খুন ক্ক-করতাম না। কি-কিন্তু তুমি বাচ্চাটা ন-নষ্ট করতে চাইলে না। …আ-আ-আমি যে ফে-ফেঁসে যেতাম। আ-আমি বিবাহিত ছিলাম।…”

এসব কথা যেন কানেই যায় না ছায়ামূর্তির। বিছানা ছেড়ে নেমে আসে সে। বিস্ফারিত চোখে প্রামাণিক দেখে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে ওটা। সে এগোয় আর প্রামাণিক এক-পা দু’পা করে দরজার দিকে পেছোয়। সেই সঙ্গে হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করে, “আ-আ-আ-আমি জানি, আমি অন্যায় করেছি। খু-খুব অন্যায়। তোমাকে ঠকিয়েছি। তোমাকে খুন করেছি। কি-কিন্তু বিশ্বাস করো, এ ছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। আ-আ-আমাকে ক্ষমা ক্ক-করে দাও।…”

ছায়ামূর্তি ভাবলেশহীন। প্রামাণিকের কোনও আর্তি গুরুত্বই দিচ্ছে না সে। স্থির চোখে সে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। আর হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

পিছোতে পিছোতে একেবারে সদর দরজার কাছে এসে পড়েছে প্রামাণিক। দরজায় পা ঠেকতেই সে সজাগ হয়ে ওঠে। প্রাণে যেন জল আসে প্রামাণিকের। মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বাইরে। তারপর স্টেশনের দিকে ছুটতে শুরু করে। ওখানে তার সহকর্মীরা আছে। সেখানে পৌঁছতে পারলে আর চিন্তা নেই।

কিন্তু ভুল ভাঙ্গল একটু পরেই। প্লাটফর্মের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখে, পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে সেই অশরীরী। হতবিহ্বল প্রামাণিক। দিকভ্রান্ত হয়ে যায় সে। আবার উল্টো দিকে ফিরে দৌড়য়। কিন্তু বারে বারেই ওর যাত্রাপথ বদলে দিতে থাকে আবছায়া সেই অবয়ব। দিশেহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় লোকটা কখনও এদিকে, কখনও ওদিকে ছুটে চলে। কোথায় চলেছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু থেমে যাওয়ার সাহস তার নেই। কারণ পিছন পিছন বাতাসে ভাসতে ভাসতে ওকে তাড়া করে চলেছে সেই অশরীরী নারী।

অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারদিক। রাত্রি শেষ প্রহরের সবে শুরু। ভোর হতে এখনও ঢের দেরি। এর মধ্যেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে ছুটছে অমিতাভ প্রামাণিক। মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে উঠছে, “বাঁচাও। কে আছো বাঁচাও।” কিন্তু সে নিষ্ফল আর্তনাদ মিলিয়ে যাচ্ছে অমানিশার ঘুমন্ত চরাচর আর নিঃসীম নির্জন প্রান্তরে।


১৯


রাত সাড়ে বারোটার চেন্নাই এক্সপ্রেসটা তিন ঘণ্টা লেট করে রাত তিনটে পঁচিশে নিমাতি পেরোবে। ট্রেন পাস করতে বেরিয়েছিল বিমল। ওর সঙ্গে দিগন্ত এবং রঘুও বেরিয়েছে। এতক্ষণ নির্বিঘ্নেই কেটে গেছে। যে অশরীরীর আগমনের আশঙ্কা ছিল, ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেটা আর আজ ঘটেনি। আর এতক্ষণ যখন ঘটেনি, আর ঘটার সম্ভাবনা নেই। অন্তত অভিজ্ঞ দিগন্তের এমনটাই অভিমত।

ঘন অন্ধকার কেটে রেললাইন ধরে তীব্র আলোটা দ্রুত এগিয়ে আসছে। আপ চেন্নাই এক্সপ্রেস। হাতে সবুজ পতাকা নিয়ে লাইন ক্লিয়ারের সিগনাল দিতে তৈরি বিমল। ট্রেনটা যখন হুইসেল বাজিয়ে স্টেশনে প্রায় ঢুকে পড়ছে তখনই আচমকা সবাই দেখে, রেল লাইন ধরে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছে একজন। প্লাটফর্মের কাছাকাছি আসতেই ট্রেনের উজ্জ্বল আলোয় তাকে সহজে চিনেও ফেলল সবাই। বিমল চিৎকার করে উঠল, “লাইন থেকে সরে যান প্রামাণিক। ট্রেন ঢুকছে।”

কিন্তু সে মুহূর্তেই ঝড়ের বেগে ধেয়ে গেল চেন্নাই এক্সপ্রেস। বিমল চোখ বন্ধ করে ফেলল।

সে রাতেই প্রামাণিকের দেহের থেঁতলে যাওয়া নিম্নভাগ পাওয়া গেল প্লাটফর্মের কাছেই। কিন্তু শরীরের ঊর্ধ্বভাগ ভাগ সহ বাকি অংশ কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। নির্জন স্টেশন চত্বরে এখন অনেক লোক। হাতে হাতে শক্তিশালী আলো। এখানের কর্মীরা তো আছেই, স্থানীয় থানার থেকে পুলিশও এসে গেছে। কীকরে যেন খবর পেয়ে চলে এসেছে জিতুমণির পরিবারের লোকেরা এবং আরও অনেকেই। সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজছে।

রেল লাইনের দু’ধারেই চলছে সন্ধান। দেহের খোঁজে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সবাই। রাতের অন্ধকার কেটে এখন আলো ফুটছে। পুব আকাশে রক্তিম আভা। পাখিদের কলকাকলিতে আড়মোড়া ভাঙছে প্রকৃতি। বড় মনোরম পরিবেশ। অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজ করছে চরাচরে। অথচ এর মধ্যেই ঘটে গেছে কী বীভৎস ঘটনা। প্রামাণিকের থেঁতলে যাওয়া দেহখণ্ডটা দেখে বমি করে ফেলেছিল বিমল।

দেহের বাকি অংশের সন্ধানে সবাই নদীর কাছাকাছি চলে এসেছে। দূর্ঘটনাস্থল থেকে এ জায়গা অনেকটাই দূরে। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করে এখানেই সেটা পাওয়া গেল। এত দূরে কীকরে দেহাংশটা এল, সেটাও বড় বিস্ময়ের। নদীর ধারে যেখানে ব্রিজটা শুরু হচ্ছে তার পাশের বুনো ঝোপের মধ্যে সেটা পড়ে আছে। দিগন্ত ফিসফিস করে বলল, “জানেন, স্যার? ঠিক এই জায়গাতেই জিতুমণির দেহটাও পাওয়া গিয়েছিল। কী আশ্চর্য সমাপতন!”

বডিটার দিকে তাকিয়েই গা ঘিনঘিন করে উঠল বিমলের। কী করুণ মৃত্যু! কী ভয়াবহ পরিণতি! আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় প্রামাণিকের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। বুকের নীচে এক থোপা দলাপাকানো মাংস শুধু। বিমল দেহটার দিকে তাকিয়েই ছিটকে সরে এল সেখান থেকে। চোখ সরিয়ে নিল ঐ দৃশ্য থেকে। তিনজন ডোম এসেছিল। তারাই দেহটা প্লাস্টিকে মুড়ে বের করে আনতে লাগল। ঠিক তখনই কে যেন আতঙ্কভরা স্বরে বলে উঠল, “সামনে তাকান, স্যার!”

উপস্থিত সবাই থমকে তাকাল সেদিকে। বিমল দেখল, এক নারী অবয়ব খুব ধীরে ধীরে নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে। সেই নারী, যাকে ও বহুবার দেখেছে। চোখের পলক পড়ছে না কারও। আতঙ্কে পাথর হয়ে গেছে সবাই।

এখনও দিনের আলো পুরো ফোটেনি। ছোট্ট ব্রিজটার উপরে আধো আলো আধো অন্ধকার মেখে সে ছায়ামূর্তি অস্পষ্ট হতে হতে ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বনমালীবাবু ভাবুক কণ্ঠে বলে উঠলেন, “যা জিতুমণি, ওপারে যা। এ নদীই তোর বৈতরণী, একে পেরিয়ে যা। প্রতিশোধের পালা শেষ। এবার শান্তি পাক তোর আত্মা। মুক্তি হোক তোর।”

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “novel-firay-firay-aasay

  1. সুস্মিতা নাথের লেখা আগেও পড়েছি । এভাবেই উনি ওনার লেখার ভেতর দিয়ে সবাইকে স্তম্ভিত করে দেন । বড় ভালো এই উপন্যাসটি। খুবই শক্তিশালী লেখিকা এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওনার এই ধরনের চমকপ্রদ লেখা বরাবরই পড়ে থাকি। লেখিকাকে ধন্যবাদ। এই পত্রিকাকেও ধন্যবাদ যে এমন একটি সুন্দর উপন্যাসিকা উপস্থাপনা করেছেন পাঠকের সামনে।

  2. চমৎকার ! উপন্যাসের বিষয়বস্তু যাই হোক, গল্প বলার মুনশিয়ানা আর কাহিনির নির্মাণ অসাধারণ। অকারণ শব্দ নিয়ে খেলা নেই, নেই গদ্যের কারিকুরি দেখানোর অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে এক নিঃশ্বাসে উপন্যাস পড়াতে গেলে চাই কিছু দক্ষতা। সুস্মিতা নাথের সে দক্ষতার প্রমাণ আগেও পেয়েছি। আবার হলাম চমৎকৃত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *