onubad-jelar-jelbondi

জেলার জেলবন্দি
(The Jailer Jailed – Anton Chekov)
অনুবাদ – তপন রায়চৌধুরী


কখনও কি খেয়াল করেছেন, কেমন ভাবে গাধার পিঠে ওজন চাপানো হয়? সাধারণত এই হতভাগ্য প্রাণীটির পিঠে ইচ্ছেমতন যে-কোনো কিছু চাপানো হয়, সংখ্যা বা পরিমাণের কথা চিন্তা করা হয় না মোটেই। আসবাবপত্র, রান্নার যাবতীয় জিনিস, বিছানা, পিপে, বস্তা বা বড়সড় থলে, যার মধ্যে বাচ্চাদের বসিয়ে এমনভাবে ভার চাপানো হয় যে, সব মিলিয়ে গোটা ব্যাপারটা একটা আকারহীন বস্তুপিণ্ড ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এমনকি গাধাগুলোর ক্ষুরের অগ্রভাগ বা প্রান্তভাগ পর্যন্ত দেখা যায় না।

লামভ জেলা আদালতের সরকারি উকিল আলেক্সি টিমোফেয়েভিচ ব্যালবিন্সকিকে দেখতে অনেকটা এইরকমই লাগছিল, যখন রেলের বগি লক্ষ্য করে তৃতীয় ঘন্টা বাজার পরে তিনি দৌড় লাগালেন, যাতে একটা বসার জায়গা মেলে। ভবিষ্যতের জন্য গুচ্ছ গুচ্ছ প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, পিচবোর্ডের বাক্স, টিনের বাক্স, সুটকেস, একটা বিরাট বোতল, মেয়েদের একটা হাতাহীন ঢিলেঢালা বহির্বাস এবং ঈশ্বর জানেন না- জানি আরও কত কি — এইসব জিনিসপত্র তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে গেছে। তাঁর রক্তিম মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত, পা-দুটো শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁর স্ত্রী নাতাশা ভভনা একটা বহুবর্ণময় রঙচঙে রোদ-আটকানো হালকা ছাতা সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করছিলেন। তিনি একজন গৌরবর্ণা, স্বর্ণকেশীনি, স্ফিত চোয়াল বিশিষ্ট মহিলা যার মুখময় ফুটফুট দাগে ভরা। তাঁর চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে এবং দেখাচ্ছে যেন একটা কচি বান-জাতীয় মাছ বড়শি দিয়ে গেঁথে জল থেকে তোলা হয়েছে।

অবশেষে অনেকগুলো বগি ঘুরে ঘুরে দেখার পর উকিলসাহেব একটা জায়গা খুঁজে পেলেন। সেখানে তিনি তার সমস্ত মালপত্র রাখলেন, কপাল থেকে ঝরে পড়া ঘাম মুছলেন এবং সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর স্ত্রী বলে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছ?”

ব্যালবিন্সকি বললেন, “প্রিয়ে, আমি একটু স্টেশন চত্বরে যাচ্ছি, যদি এক গ্লাস ভদকা পাওয়া যায়।”

স্ত্রী বললেন, “ওসব চিন্তা ছাড়ো। এখানে বসো।”

ব্যালবিন্সকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং সেখানেই বসে পড়লেন। নাতাশা একটা বিরাট ঝুড়ি দিয়ে আদেশ করলেন স্বামীকে, “এটা ধরো। এর মধ্যে কিছু থালা এবং ডিশ আছে।“

ব্যালবিন্সকি ঝুড়িটা নিলেন এবং এক আন্তরিক ব্যাকুলতা নিয়ে ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলেন।

চতুর্থ স্টেশনে যখন গাড়ি দাঁড়াল, নাতাশা স্বামীকে পাঠালেন গরম জল নিয়ে আসার জন্য। স্টেশন চত্বরে খাদ্য এবং পানীয় যেখান থেকে পরিবেশন করা হয়, স্ত্রীর কথামত ব্যালবিন্সকি গেলেন সেখানে এবং হঠাৎ ফ্ল্যাজকিন নামে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তাঁর। এই বন্ধুটি লিন্সক-এর জেলা আদালতের সভাপতির সহকারী। এঁরই সঙ্গে ব্যালবিন্সকি প্ল্যান করেছিলেন বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে।

ফ্ল্যাজকিন বললেন, “আরে বন্ধু, এসবের মানে কী? বলতে খুব খারাপ লাগছে, আমরা একই বগিতে যাবো ঠিক করেছিলাম, আর, তুমি কিনা একটা তৃতীয় শ্রেণির বগিতে চেপে যাচ্ছ? কেন? তোমার কি টাকা ছিল না? নাকি অন্য কিছু?”

Courtesy: bio.biography.com

ব্যালবিন্সকি একটা হতাশ ভাব নিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন, তারপর বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, “আমার কাছে এখন সবই সমান ভাই। আমরা যে প্ল্যান করেছিলাম, মনে হচ্ছে, সব ভেস্তে গেল। ট্রেনের তলায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই আমার। ভাই, তুমি কল্পনা করতে পারবে না, কীভাবে আমার স্ত্রী আমাকে শেষ করে দিচ্ছেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, আমি এখনও বেঁচে আছি! হা ঈশ্বর! চারিদিকের আবহাওয়া এত সুন্দর, এই মুক্ত বাতাস, এই পৃথিবী, প্রকৃতি, এক নিরুপদ্রব অস্তিত্বের জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা – বিদেশে চলে যাওয়ার শুধু ভাবনাটাই আমাকে এক স্বর্গীয় আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু না, এক শয়তানী নিয়তি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে। অদৃষ্টের পরিহাস দ্যাখো, আমি পালাতে চেয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য, গোটা শীতকাল জুড়ে আমি মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখলাম, একটু একা হওয়ার। কিন্তু এখন? আমি আটকে গেলাম ওর কাছে। আমি একটার পর একটা চেষ্টা করলাম বেরিয়ে আসার, কিন্তু সব বৃথা! আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, কিন্তু তিনি হাজির! আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, “কেন, এত খরচ করার কী আছে?” বললাম, টাকার সমস্যা হবে না। তাছাড়া তৃতীয় শ্রেণিতে যাওয়া মানে দুর্গন্ধময়, দম-বন্ধ-করা পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া। তাছাড়া, সম্মানের ব্যাপার তো একটা আছেই। কিন্তু তিনি শোনার পাত্রী নন। এক বিশ্রী হিসেবি পিশাচ তার ওপর ভর করেছে। কেন এইসব বাক্স-প্যাটরা সুটকেস আমি বয়ে বেড়াবো? আমরা যে শুধু দশ পুড (১৬.৩৯ ইনটু ১০ কেজি) মালপত্র নিয়ে চলেছি তা নয়, সেসব রাখার জন্য গাড়িতে চারটে বসার জায়গাও দরকার। কন্ডাক্টর ক্রমাগত বলে চলেছেন অন্যদের বসার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে, যাত্রীরাও রেগে উঠছে, আর, তিনি ক্রমাগত তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছেন। কী লজ্জা! ভাবতে পারো! আমি একটা অগ্নিকুণ্ডের ওপর বসে আছি। কিন্তু কীভাবে পালাব তাঁর কাছ থেকে? ঈশ্বরের সাহায্য চাইছি। তিনি আমাকে একটুও ছাড়বেন না তাঁর কাছ থেকে। আমাকে তাঁর কাছেই বসে থাকতে হবে, একটা বড় ঝুড়ি হাঁটুর ওপর রেখে। এখন তিনি আমাকে গরম জল আনতে পাঠিয়েছেন। বলো তো, আদালতের একজন সরকারি উকিলের পক্ষে আমার চা-পাত্র হাতে নিয়ে এরকম এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করা কি ভালো দ্যাখায়? তুমি তো জানোই, আমার কিছু সাক্ষী, কিছু বিবাদী মানুষ হয়তো এই ট্রেনেই যাচ্ছেন। আমার সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে বসেছে। কিন্তু বন্ধু, এখন থেকে এসবই হচ্ছে আমার জন্য বড় শিক্ষা। ব্যক্তিস্বাধীনতা কী জিনিস, তা বোঝা অসম্ভব। জীবনে কোনো কোনো সময় মানুষ আত্মহারা হয়ে যায় এবং দেখবে, একেবারে কোনো কারণ ছাড়াই তুমি কাউকে হয়তো জেলে বন্দি করে রাখছ। এখন বুঝতে পারছি, জেলে বন্দি হয়ে থাকা কাকে বলে! ওহ্, কী সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা! “

ফ্ল্যাজকিন হেসে বলল, “আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে তুমি নিশ্চয়ই খুশি, জামিনে ছাড়া পেয়েছো বলে।”

“ওহ! একদম ঠিক বলেছো।“

##

ভেরজবলভো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফ্ল্যাজকিন যখন হাঁটছিলেন, হঠাৎই তৃতীয় শ্রেণির কামরার জানালার পাশে বসা ব্যালবিনস্কির নিদ্রালু মুখমণ্ডল দেখতে পেলেন একঝলক। আর, ঠিক সেই মুহূর্তে চোখ খুললেন ব্যালবিন্সকি। দেখতে পেলেন ফ্ল্যাজকিনকে। ইশারায় ডাকলেন তাঁকে এবং বললেন, “একটু অপেক্ষা করো। এখনও ঘুমোচ্ছে সে, জাগেনি। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে, আমি একটু ফাঁকা হই তখন। অবশ্য পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব, তবে এই ঝুড়িটা মেঝেতে রাখতে পারি ওই সময়টুকুর মধ্যে। এ আমার পরম ভাগ্য! ওহ হ্যাঁ, আমি তোমায় বলিনি, না?”

“কী?”

“এত ভালো আছি এখন!”

“কী ব্যাপার?”

“দুটো বাক্স আর একটা ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। অনেকটা হালকা হয়েছি এখন বলতে পারো। গতকাল হাঁসের মাংস এবং পকৌড়াগুলো শেষ করেছিলাম। ইচ্ছে করেই বেশি খেয়েছিলাম যাতে বোঝার পরিমাণ কিছুটা কমে। এখন বেশ জায়গা হয়েছে কোচটাতে। তুমি খুব সহজেই একটা কুড়ুল ঝুলিয়ে রাখতে পারো। ওহ, সত্যি বলছি, এটা বেড়ানো নয় ভাই, এটা অত্যাচার।“

কথাগুলো বলে উকিলসাহেব বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাঁর নিদ্রিত স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে নিজের মনেই বললেন, “কী সাংঘাতিক অত্যাচারী তুমি! দজ্জাল মহিলা, কপালগুণে কখনও কি তোমার কাছ থেকে পালাতে পারব? চোখ বুজে আমি স্বপ্ন দেখি … কী স্বপ্ন? যদি সম্ভব হত, তবে কঠোর পরিশ্রমের দন্ডাদেশ দিতাম তোমায় … এই রে … তিনি জেগে উঠছেন।”

চোখের নিমেষে উকিল সাহেবের মুখ এক সরল সাদাসিধে আকার ধারণ করল এবং চকিতে মেঝেতে রাখা ঝুড়িটা নিজের কোলে তুলে নিলেন।

##

এডুকুনেন স্টেশনে যখন তিনি গরম জল সংগ্রহ করার জন্য বেরিয়ে এলেন, অনেক উৎফুল্ল দেখালো তাঁকে। খুশির মেজাজে বলে উঠলেন বন্ধুকে, “আরও দুটো বাক্স চুরি গেছে। সব রোলগুলো খেয়ে নিয়েছি আমরা এবং হালকা হয়েছি আরও।

কনিজবার্গ আসামাত্র উকিলসাহেব ছুটে গেলেন ফ্ল্যাজকিনের কামরায় এবং তাকে অনেক উজ্জ্বল দেখালো তখন। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন বন্ধুর ডিভানের ওপর এবং অট্টহাস্য করে উঠলেন, বললেন, “বন্ধু! আজ কী আনন্দ! তোমাকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। আজ আমি সুখী, আমি স্বাধীন, সত্যিই স্বাধীন! আমার বউ পালিয়েছে।

“পালিয়েছে মানে?

“রাতেই সে কামরা ছেড়ে চলে গেছে এবং আর ফিরে আসেনি। অথবা ট্রেনের তলায় চাপা পড়েছে। কিংবা হয়তো হতে পারে, কোনও স্টেশনে সে পড়ে আছে। যাইহোক, সে চলে গেছে। ওহ্ ভগবান!

ফ্ল্যাজকিন বলে উঠলেন, “কিন্তু শোনো, সেক্ষেত্রে তোমার একটা টেলিফোন করা উচিত।“

“ঈশ্বর না করুন। আমি আমার স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করছি। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। চলো, একবার প্ল্যাটফর্ম ঘুরে আসা যাক, একটু স্বাধীনভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যাক।”

অবশেষে দুই বন্ধু প্ল্যাটফর্ম বরাবর হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। আর, মাঝেমাঝেই উকিলসাহেব আবেগভরে বলে উঠছিলেন, “ওহ্, কী যে ভালো লাগছে এখন! আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি। সত্যিই কি এমন মানুষ আছেন যিনি সবসময় এইভাবে থাকেন? ভাই, তুমি জান কি?

তৎক্ষণাৎ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, “আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব। আমরা একসঙ্গে ব্যাচেলার হয়ে কাটাব।“

কথাগুলো বলে তিনি তৎক্ষণাৎ তার কোচের দিকে ছুটে গেলেন তার জিনিসপত্র আনার জন্য। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি ফিরে এলেন একেবারে বিমর্ষ হয়ে, হাতে তামার চা-পাত্র নিয়ে।

বন্ধু ফ্ল্যাজকিন কিছু বলতে যাবেন তাঁকে, এমন সময় বললেন উকিলসাহেব, “বউ ফেরত এসেছে। মনে হয়, রাতে ভুল কামরায় উঠে পড়েছিল। কী আর বলব ভাই!

উকিলসাহেব উঠে দাঁড়ালেন, করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর বন্ধুর দিকে। তার চোখদুটো জলে ভরে গেল। এক অস্বাভাবিক স্তব্ধতা সেই মুহূর্তে! বন্ধু ফ্ল্যাজকিন শান্তভাবে তার বন্ধুর জামার কলারে হাত রেখে বললেন, “আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, তাহলে পালিয়ে যেতাম।”

উকিলসাহেব বললেন, “তার মানে?”

ফ্ল্যাজকিন বলে উঠলেন, “পালাও। এছাড়া আর কোনও কথা নেই।”

উকিলসাহেব উল্লসিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, পালাবো! ঠিক বলেছ। শোনো, আমি বলছি তোমাকে, আমি কী করব। আমি পরের স্টেশনে নেমে গিয়ে ইচ্ছে করে ভুল ট্রেনে উঠে পড়ব। তারপর পালিয়ে যাব। পরে তাঁকে বলা যাবে, আমি ভুলবশত অন্য ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। দারুণ হবে। বিদায় বন্ধু। প্যারিসে দেখা হবে তোমার সঙ্গে।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “onubad-jelar-jelbondi

  1. বাহ্। গল্প টা দারুণ। আর অনুবাদও হয়েছে ঝরঝরে। 👌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *