রাশেদ রউফ
ঊনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয়। এই আধুনিকতাকে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘অভিনব আলো’। তার কিরণ ছড়িয়ে পড়ে সাহিত্যের সমগ্র ভুবনে। এ সময় বিকশিত হয় সাহিত্যের সব ক’টি শাখা। প্রাচীন যুগে ও মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে গদ্যের বিশেষ স্থান ছিলো না। তখন যা কিছু রচিত হয়েছে প্রায় সবই হয়েছে পদ্যে। একটি পংক্তির সঙ্গে আরেকটি পংক্তির মিল রেখে, ছন্দ মিলিয়ে। মনের আবেগ, কষ্ট, দুঃখ ও কল্পনার সমস্ত রঙ চিত্রিত হয়েছে ছন্দে। মধ্যযুগে শত শত কবিতা রচিত হয়েছে। তবে সেগুলি পাঠের জন্য লেখা হয়নি। লেখা হয়েছিলো গানের জন্য। সুর করে গাওয়ার জন্য। ঊনিশ শতকে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠার কারণে সাহিত্যে আসে নতুন প্রাণ। এ সময় আসে বৈচিত্র্য। বলা যেতে পারে, ঊনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ উপহার হলো গদ্য। আজ চারদিকে দেখি গদ্যের প্রাধান্য। গদ্য ছাড়া আমাদের চলে না। গল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণ কাহিনি সবকিছু লেখা হচ্ছে গদ্যে। এমনকি কবিতাও লেখা হচ্ছে গদ্যে। ঊনিশ শতকের আগে গদ্য ছিলো না, তা নয়; তবে গদ্যে লেখা হয়েছে খুব কম। আজকাল বড়দের কবিতার মতো কিশোর-কবিতাও লেখা হচ্ছে গদ্যে। কিন্তু সেই গদ্যেও আছে ছন্দের অনুরণন। পদ্যে বা ছন্দে লেখা কবিতায় যেমন মাত্রা, যতি, পর্ব ইত্যাদি থাকে, তেমন থাকে না গদ্যে লেখা কবিতায়। পদ্যছন্দ নিয়ম-নীতির পথ অতিক্রম করে চলে, আর গদ্যছন্দ সেদিক দিয়ে মুক্ত। তার বন্ধন নেই। তবে তার প্রকাশভঙ্গি ও বাক্যবন্ধনে থাকে সুসংহত গতি ও বিরতি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গদ্য কাব্যের ছন্দ প্রকৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘গদ্যই হোক পদ্যই হোক, রসরচনামাত্রেরই একটি স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত। সেই নিগূঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয়। পদ্যছন্দবোধের চর্চা বাঁধা-নিয়মের পথে চলতে পারে, কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণ বোধ মনের মধ্যে যদি সহজে না থাকে, তবে অলংকার শাস্ত্রের সাহায্যে এর দুর্গমতা পার হওয়া যায় না। অথচ অনেকেই মনে রাখেন না যে, যেহেতু গদ্য সহজ, সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়। সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা। অসতর্কতাই অপমান করে কাব্যলক্ষ্মীকে, আর কাব্যলক্ষ্মী তার শোধ তোলেন অকৃতকার্যতা দিয়ে। অসতর্ক লেখকদের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তূপাকার করে তুলবে এমন আশঙ্কার কারণ আছে। কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা যথার্থ কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য।’
আমাদের দেশে সচেতনভাবে গদ্য কিশোর-কবিতা লিখছেন হাতেগোনা কয়েকজন লেখক। তাঁদের মধ্যে সুজন বড়ুয়া ও আমীরুল ইসলামের নাম অগ্রগণ্য। তবে গদ্যে না লিখলেও কিশোর-কবিতায় নিরীক্ষা করে চলেছেন, এ রকম লেখকের সংখ্যা প্রচুর। আহসান হাবীব ও আল মাহমুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরা শুধু বিষয় বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ নন, ছন্দ-মাত্রা-আঙ্গিকেও সমান অগ্রগামী।
লুই আরাগঁ বলেছিলেন, কবিতার ইতিহাস হলো তার টেকনিকের ইতিহাস। টেকনিকের সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায়, ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা। এ প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন : এ সংজ্ঞা সহজ বলেই জটিল; কেননা ছন্দ কাকে বলে, শব্দ-ই বা কী, এবং সমর্পণ কেমনভাবে সম্ভব, এসব চিন্তা যতক্ষণ না কবি, পাঠক বা সমালোচকের ধারণায় পৌঁছবে, ততক্ষণ এই সূত্রটি দিয়ে কবিতার রহস্য কিছুমাত্র ধরা যায় না। কোলরিজের ‘শ্রেষ্ঠ শব্দের শ্রেষ্ঠ ব্যুহ’ অথবা মালার্মের ‘শব্দই কবিতা’ তত্ত্বকেও শিথিল অর্থে গণ্য করলে তুচ্ছ শোনায়। বস্তুত মনে হয় না যে অপৃথক যতিজাত ছন্দ-শব্দের স্বতন্ত্র বিচার কোনো রকমেই সম্ভব না। কবিতার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ নেই, যেকোনো শব্দই কবিতার শব্দ এ কথা মেনে নেবার পরের মুহূর্তেই বলতে হয় যে তবু প্রাত্যহিকের শব্দে আর কবিতার শব্দে কতই ভিন্নতা! তবে কি ছন্দই এই ভিন্নতা এনে দেয়?
ছন্দই এই ভিন্নতা এনে দেয় কিনা সেটা নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ রচিত হতে পারে। তবে আমরা মনে করি, কিশোরকবিতার গঠন-কৌশলের প্রধান ভিত্তি হলো ছন্দ। অন্ত্যমিল কিশোর-কবিতাকে প্রাণময় করে তোলে। আহসান হাবীব ও আল মাহমুদ অন্ত্যমিলবিহীন কিশোরকবিতা রচনা করে নিরীক্ষা প্রয়াসী হয়েছিলেন। আহসান হাবীবের ‘স্বদেশ আমার’ কবিতাটির উদাহরণ দিতে পারি। তিনি লিখলেন :
জেলের সেলে বন্দি ছিল
মৃতের স্তূপের অন্ধকারে বন্দি ছিল
বন্দি ছিল বন্ধ দুয়ার ভয় থম থম ঘরের মাঝে
শহর জুড়ে কার্ফু তার কাফন ছড়ায়
সেই কাফনে বন্দি ছিল।
ওরা তখন মন্ত্রপূুত মশাল নিয়ে নামল পথে
মৃতের স্তূপে ফোটাল ফুল
নতুন প্রাণে গাঁথল নতুন দীপাবলি।
আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার
গ্রাম-নগরে রাত পেরিয়ে রাত পেরিয়ে রাত পেরিয়ে
সূর্য নামে।
তখন দেখি
আলোর মুকুট মাথার পরে
ভুবন জুড়ে বাইরে এল বন্দিনী মা
বাংলা আমার স্বদেশ আমার।
আবার আল মাহমুদ লিখলেন কবিতা ‘বোশেখ’। এই কবিতায় ‘কবিতার কিশোরটি’ বোশেখকে বলছে :
সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি
তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী
গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?
কী সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষির ভিটে?
—————–
হে দেবতা বলো তোমার কী আনন্দ
কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?
—————–
তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস
উড়িয়ে নিলে গরিব চাষির ঘরের খুঁটি
কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে
তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে না তো!
অন্ত্যমিলবিহীন হলেও ছন্দবিহীন নয় কবিতা দুটি। দুটো কবিতাই স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। তবে অন্ত্যমিলহীন কবিতার যে নিরীক্ষা তাঁরা করেছেন, তা গ্রহণযোগ্যতা পেলেও তেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে মনে হয় না। তাঁদের নিরীক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পরবর্তী সময়ের কবিরা আরো সতর্ক পদক্ষেপে কবিতা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। অন্ত্যমিল না রেখেও মধ্যমিল কিংবা ভেতর মিল দিয়ে কবিতার শরীরকে তাঁরা নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্রভাবে। সুজন বড়ুয়ার তেমন একটি কবিতা দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একটি মৌলিক গ্রন্থ : ‘হাওয়ার সাথে হাতে মেলাতে’।
তিনি লিখেছেন :
হাওয়া তোমার কান্ড দেখে থেকে থেকে
আমার বড্ডো অবাক লাগে।
ইচ্ছে জাগে
দাঁড়িয়ে থাকি তোমার আগে।
দেখি তুমি কেমন করে কোন্ পথে কোন্ রথে চড়ে
করছো কেবল আসা-যাওয়া।
কিন্তু হাওয়া ইচ্ছে আমার ইচ্ছেই সার
যতই করি পথ তোলপাড়
পাই না তবু তোমার দেখা।
মিছেই একা দাঁড়িয়ে ভাবি-
কী তুমি গায় জড়িয়ে রাখো দেখিই নাকো
ভর দিনেও দেখি না ছাই দূরবীনেও।
এ রকম অন্ত্যমিল না দিয়ে পংক্তির মাঝখানে অনির্দিষ্ট বিভিন্ন পর্বে মধ্যমিল সংযোজনের মাধ্যমে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে দেশে। যেমন :
মাঠ মানে তো সবাই জানে গানে গানে মেতে ওঠা,
ছুটতে থাকা ঘোড়ার মতো, ফুটতে থাকা ভোরের মতো,
দুরন্ত ঢেউ, উড়ন্ত মেঘ। মাঠ মানে তো অনেক কথা-
স্বাধীনতা-মন আনচান-সুখ অফুরান।
[মাঠ মানে]
তবে কিশোরকবিতার সাম্প্রতিক যত উৎকর্ষ সাধন, চমৎকারিত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন কিংবা পরীক্ষা নিরীক্ষা, তার জন্য আমরা কবি আহসান হাবীব ও সুজন বড়ুয়ার কাছে ঋণী। তাঁদের নতুন চিন্তা, উদার মনোভাব ও শক্তিমান প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের কিশোরকবিতার ইতিবাচক রূপায়ন ঘটেছে। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদক্ষেপে পরবর্তী সময়ের কবিরা উৎসাহিত হয়েছেন।
শুধু অন্ত্যমিলহীন কবিতায় নয়, আহসান হাবীবের নিরীক্ষা ছিল পংক্তি বিন্যাসে, অসম পর্ব বিন্যাসে এবং অনির্দিষ্ট দূরত্বে অন্ত্যমিল সংযোজনে। কয়েকটি কবিতার উদাহরণ দেওয়া যাক :
তখন একটি দুটি তিনটি করে এসে
একশো দুশো তিনশো করে ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে।
[জোনাকিরা]
তোমরা সঙ্গে আড়ি আমার-আড়ি আড়ি আড়ি
থাক না তোমার আকাশজুড়ে মস্ত হাওয়া গাড়ি
তুমি ভারি দুষ্টু মেয়ে
সকাল বেলা থাকো এমন শান্ত চোখে চেয়ে।
[আড়ি]
সেই ছবিটি দাও
ধরা যাক এই রঙের বাহার নাও ফিরিয়ে নাও।
[ফুল ছবি আর ভালবাসা]
অন্যদিকে সুজন বড়ুয়া পাঠকের স্বাধীনতার কথাও চিন্তা করে পংক্তি নির্মাণ করে চলেছেন। কোথাও কম, কোথাও বেশি পর্ব সংযোজন করে পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাতে চান না। কিন্তু মধ্যমিল ও অনুপ্রাসের দ্যোতনায় তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে অনন্য। যেমন :
দুপুর যখন রোদের নূপুর বাজাবে একটানা
ঘণ্টা গুণেই ভাবি আমি পাঠশালা জেলখানা।
[জানলা তুমি অনেক অনেক সুখি]
আমার ছিল আর এক ভাই, জানো কি তার নাম?
দুরন্ত সেই উড়ন্ত নীলকণ্ঠ ক্ষুদিরাম।
[কৃষ্ণচূড়া কাছে]
কিশোরকবিতা নিয়ে আজকাল অনেকেই নিরীক্ষা করছেন। বিষয়-বিন্যাস নিরীক্ষা, শব্দ চয়ন নিরীক্ষা, ছন্দ নির্বাচন নিরীক্ষা, উপমা বিশ্লেষণ নিরীক্ষা। এসব নিরীক্ষাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেও আমরা বলতে পারি- পাঠক কিন্তু রসবোধসম্পন্ন কবিতাই খোঁজে। নিরীক্ষা অনেকক্ষেত্রে চমৎকারিত্ব প্রদান করলেও জনপ্রিয় ধারার কবিতাগুলোই বেশি পঠিত হয়ে থাকে। মনে রাখা জরুরি যে, ছন্দ এক সম্মোহনী উপাদান। ছন্দের কারণে কিশোরকবিতা হয়ে ওঠে মোহময়। ছন্দের সঙ্গে থাকবে ভাবের সমন্বয়। ছন্দ কবিতার ভাবকে পাঠকের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছাতে সাহায্য করে। ছন্দের মতো কবিতার আরেকটি সুন্দর উপাদান হলো অন্ত্যমিল। ছন্দ যেমন কবিতার শরীরের দ্যোতনার সৃষ্টি করে, তেমনি অন্ত্যমিল আনে ধ্বনি-মাধুর্য।
মোট কথা কিশোরকবিতার সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ ‘কৈশোর’। তবে কবিতায় সরাসরি কৈশোর উপস্থিত না থাকলেও সেই কবিতাটি যদি কিশোর পাঠকের মনোরঞ্জনে ভূমিকা রাখতে পারে, তাকেও আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। কিশোরকবিতার সীমানা বা পরিধিকে বিস্তৃত করতে হলে বৈচিত্র্যময় বিশালতাকেও বিবেচনায় আনা জরুরি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন