ফিচার
রাজু আলাউদ্দিন
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোর্কা বিশ বছর বয়সে Impresiones y Paisajes (১৯১৮ সাল) নামক প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটির ভূমিকায় বইয়ের কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তা ছিলো তাঁর পরবর্তী রচনা সম্পর্কে এক দিক নির্দেশনার মতো। ভূমিকার শুরুতেই তিনি পাঠকদেরকে সচেতন করার লক্ষ্যে বলেন, “পাঠকবন্ধু, এই বইটি পড়তে গিয়ে তুমি এতে লক্ষ্য করবে এক স্পষ্ট অস্বচ্ছতা এবং এক নিশ্চিত বিষন্নতা। দেখতে পাবে কীভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা কীভাবে প্রায়শই আঁকা হয়েছে তিক্ততা দিয়ে এবং বলা হয়েছে বিষন্ন কণ্ঠে। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোতে যে সব দৃশ্য সাজানো হয়েছে তা স্মৃতি, ভূদৃশ্য ও বিভিন্ন চরিত্রের বয়ান। হয়তো বাস্তবতা তার কুয়াশাচ্ছন্ন মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে না, তবে অন্তর্গত আবেগের স্তরে কল্পনা বা ফ্যান্টাসী তার আত্মার আগুন বহিঃপ্রকৃতির উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে ছোট ছোট ঘটনাগুলোকে স্ফূর্তির সঙ্গে আগলে ধরে। মাঠে মাঠে পূর্নিমার চাঁদ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে সেই বিশ্বস্ততাকে মর্যাদা দিয়েছে এই কল্পনা। আমাদের আত্মায় এমন কিছু আছে যা অস্তিত্বশীল সব কিছুকে ধাক্কা দেয়। বেশির ভাগ সময়ই তা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। তবে যখনই আমরা স্মরণ করি বা যন্ত্রণা ভোগ করি তখন এক সহৃদয় দূরবর্তীতা জেগে ওঠে এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীকে যখন আমরা আগলে ধরতে যাই তখন তা আমাদের ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। এই কারণে আমরা সবাই বিষয়গুলোকে আলাদাভাবে দেখি। আমাদের আবেগগুলো হচ্ছে রং ও সুরের যে আত্মা তার চেয়েও বেশি উচ্চতর। কিন্তু প্রায় কারোর মধ্যে এই আবেগগুলো বিশাল ডানা মেলার জন্য এবং বিস্ময়গুলোকে আগলে ধরার জন্য জেগে ওঠে না। কবিতা সব কিছুতেই আছে। আছে কুৎসিতের মধ্যে, আছে সৌন্দর্য্যে, আছে অসহ্য কিছুর মধ্যেও। আত্মার গভীর হ্রদগুলোকে জাগিয়ে তোলা এবং আবিস্কার করতে জানাটাই হচ্ছে কঠিন।” (Impresiones y Paisejes, Federico Garcia Lorca, La Linia del Horizonte, 2019, P 51-52)
লোরকা এই কঠিন কাজটা সম্ভব করে তুলেছিলেন মাত্র ৩৮ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে। আর এই ভূমিকাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনি পরবর্তী জীবনে যে-প্রবণতাগুলোকে বিকশিত করে তুলেছিলেন গোটা দশেক কাব্যগ্রন্থে এবং কয়েকটি নাটকে তার বীজ বুনে রেখেছিলেন Impresiones y Paisajes নামক কাব্যগ্রন্থে।
লোর্কার আবির্ভাবের সামান্য আগেই স্প্যানিশ সাহিত্য হুয়ান রামোন হিমেনেস এবং আন্তোনিও মাচাদো প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছেন। দু’জনই স্পেনের আধুনিক যুগের কবিতার দুই প্রধান স্তম্ভ। তাদের প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে একেবারে আলাদা পথে যাত্রা করেছিলেন লোরকা। তাঁর পথ হিমেনেসের মতো আন্দালুসীয় আত্মার আলোয় উদ্ভাসিত হলেও তাতে লোকচরিত্র, প্রাকৃতিক সজীবতা আর সুররিয়ালিস্টিক কুহকের মিশ্রণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো। অন্যদিকে, মাচাদোর ইন্দ্রিয়ঘন গহন উপলব্ধির বর্ণিল উচ্চারণ তাকে পথ দেখিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু লোর্কার আত্মা অন্য এক বিষাদে গড়া ছিল, তাই আলাদা হয়ে গিয়েছিল তার পথ।
তার এই ভিন্ন পথ এতটাই আকর্ষণীয় ছিলো যে কেবল স্প্যানিশভাষী পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাই নয়, এমন কি ইংরেজি অনুবাদের সুবাদে ভিন্ন ভাষী কবি পাঠকরাও ঐ আত্মার উত্তাপে নিজেদের শীতার্ত হৃদয়কে সেঁকে নিয়েছেন ভালোবাসার বিনিময়ে। তিরিশ ও তিরিশোত্তর আমাদের অসংখ্য কবির ক্ষুধার্ত আত্মা খামছে ধরেছিলো লোরকা নামক আন্দালুসীয় আগুনের গোলকটিকে। বিষ্ণু দে থেকে শুরু করে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাদের নিজস্ব আত্মার জ্বালানির সাহায্যে ফুৎকারে আগুনের গোলকটাকে প্রসারিত করে আমাদের গায়ে তার আঁচ ছড়িয়ে দিয়েছেন অনুবাদের মাধ্যমে। এক একটি অনুবাদে যেন গুয়াদালকিবিরের কল্লোল ধ্বনিত হয়ে উঠলো। কান পাতলে তাতে শুনা যায়, ‘সহৃদয় দুরবর্তীতার জাগরণ’; লোরকার রঙিন বিষন্নতা। বাংলাদেশের কবিরা, আমাদের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কবিরাই লোর্কামুগ্ধ। পঞ্চাশের শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, ষাটের আবদুল মান্নান সৈয়দ, সত্তরের আবিদ আজাদ, আশির দশকের আমরা এবং পরবর্তীতে সুমন রহমানসহ পরবর্তী প্রজম্মের অনেকেই লোর্কা সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছেন। মনে পড়ে, আশির দশকে আমরা লেখালেখির শুরুতে আমাদের ক্ষুধার্ত আগ্রহকে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম নানান ভাষার কবিদের দিকে। আমি মনে করি এই আগ্রহের মাধ্যমে আমরা কাব্যরুচির নির্ভুল স্বাক্ষর রাখার চেষ্টা করেছিলাম। সাজ্জাদ শরিফ লোর্কার কবিতা অনুবাদ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। তবে সাজ্জাদেরও আগে মোরশেদ শফিউল হাসান তার কবিতার অনুবাদ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন ১৯৮৪ সালে। বাংলাদেশে— সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে– সেটাই লোর্কার কবিতার প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ। বলতে দ্বিধা নেই মোরশেদ শফিউল হাসানের বইটিই লোর্কা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহকে প্রথমবারের মতো উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বা বাংলাদেশের কোন অনুবাদকই লোর্কার প্রথম বইটিকে আমলে নেননি। তার কথা ভূমিকায় বা জীবনে তারা উল্লেখ করলেও, সেখান থেকে অনুবাদ করেননি কোনো কবিতা। এর কারণ কি এই যে ইংরেজিতে তারা কেউ-ই এই বইটির তর্জমা খুঁজে পাননি বলে? অথচ ১৯৮৪ সাল থেকেই এই বইটির একটা পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ রয়েছে। অনুবাদ করেছিলেন লরেন্স এইচ. ক্লিব যা ইউনিভার্সিটি প্রেস অব আমেরিকা থেকে বেরিয়েছিল। এমনকি ইংরেজিতেও অনেকেই লোর্কার বিভিন্ন পর্বের কবিতা অনুবাদ করলেও তারা কেউই Impresiones y Paisajes থেকে কোন কবিতা অনুবাদ করেননি। তারা হয়তো এই গ্রন্থের কবিতাগুলোকে লোর্কার পরিপক্ক বা প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা মনে করেননি। কিংবা এগুলো টানা গদ্যে লেখা বলে কবিতার মর্যাদা দিতে চাননি? কিন্তু টানা গদ্যের এই কবিতাগুলোয় লোর্কার পরবর্তীকালের কাব্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রধান চিহ্নগুলোর বহু কিছু এতে উপস্থিত। লোর্কার এই কবিতাগুলো আমরা যদি অনুধাবন করি তাহলে তার কেবল কাব্যব্যক্তিত্বের সূচনা হিসেবেই নয়, একইসাথে তার বিকাশের ইতিহাসটিকেও বুঝবার জন্য জরুরী। পরবর্তীকালে তিনি এরকম টানা গদ্যে আর ফিরে আসেননি, অন্তত একক কোন কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে তো নয়ই। কিন্তু তাই বলে এগুলোকে তিনি বর্জনের ঘোষণা কখনো দেননি। দেয়ার কথাও নয়, যেহেতু তার মৌল প্রবণতার এক বীজতলা হিসেবে এই গ্রন্থটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কবিতাগুলো বিশ বছর বয়সে বেরুলেও, এগুলো রচিত নিশ্চিতভাবেই রচিত হয়েছিল তারও কয়েক বছর আগে। সে অর্থে এটি তার কিশোরপর্বের রচনা। আর কৈশোর হচ্ছে সেই সময় যাকে বলা যেতে পারে পরিণত মনের মৌল কাঠামোর গঠনপর্ব। অতএব এই কবিতাগুলো ছাড়া লোর্কার আবির্ভাবের স্বরূপটিকে বোঝা সম্ভব নয়। লোর্কাকে বুঝবার লক্ষ্যে এখানে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে নমুনা হিসেবে একটি কবিতা অনুবাদ করা হলো।
আভিলা
যখন পৌঁছালাম তখন শীতের রাত। আকাশে অল্প কিছু নক্ষত্র আর হাওয়া রাত্রির অনন্ত সুরকে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল করে তুলছিল… কারোরই উচিত নয় কথা বলবার কিংবা সশব্দে হেঁটে যাওয়া, যাতে করে মহিয়সী তেরেসার আত্মা বিরক্ত হয়…শক্তিশালী এ শহরে প্রত্যেকেরই দুর্বল অনুভব করা সঙ্গত… যখন কেউ এর উদ্দীপক প্রাচীরের মধ্য দিয়ে যায়, তখন তাকে হতে হবে ধর্মপরায়ণ, অবশ্যই শ্বাস নেওয়ার পরিবেশে বাঁচতে হবে তাকে। সারসের নীড়ে গড়া মুকুটশোভিত এইসব নিঃসঙ্গ লড়াই শিশুতোষ গল্পের মতই সত্য হয়ে ওঠে।
মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত অবধি, কেউ এক অবিশ্বাস্য আওয়াজ শুনতে পাবে এবং শহরের আকাশে ঝড়ের মেঘের মধ্যে দেখতে পাবে সোনার পেগাসাস, যার পিঠে একজন বন্দী রাজকন্যা যাচ্ছে পালিয়ে, অথবা দেখতে পাবে পাখির পালকগোঁজা আর বল্লম হাতে সারি সারি এক দল বীর টহল দিচ্ছে প্রাচীরকে ঘিরে।
প্রায় জলহীন নদীটি সুবিশাল পাথরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলছে, তার শীতলতায় স্নান করছে তুচ্ছ গাছগুলো, আর গাছগুলোকে ছায়া দিচ্ছে একটি উদ্দীপনামূলক রোমানেস্ক আশ্রম, এবং ছায়ায় লুকানো এক সাদা সমাধির শীতল বিশপ চিরকাল প্রার্থনা করছে। শহরকে ঘিরে থাকা পর্বতগুলো যেখানে সূর্যশান্তি বিস্তৃত, ছায়াহীন বৃক্ষবিহীন, আর আলো ধরে রাখে লাল একঘেয়েমির উজ্জ্বল স্বর…আভিলা সব থেকে বেশি কাস্তিয়্যো, সবচেয়ে বেশি রাজকীয় সুবিশাল সমগ্র মালভূমি জুড়ে।
কখনোই কোলাহল নেই, শুধুমাত্র বাতাস চৌরাস্তায় শীতের রাতে প্রবল বদল নিয়ে আসে। রাস্তাগুলো সংকীর্ণ, তাদের বেশির ভাগই তুষার শীতল। মরচে-পড়া ঢাল নিয়ে কালো কালো ঘরগুলো বিষন্নবিধুর, এবং প্রবেশদ্বারে সুবিশাল শিলার খিলান আর যত সোনালি পেরেক। সৌধ্যগুলোয় আছে স্থাপত্য সারল্য ভীষণ। শক্ত আর গুরুভার কলামের সারি, সহজ পদকরাজি, শান্ত ও সমতল দরোজাসমূহ, বিসদৃশ মাথার যত সুউচ্চ ভবনে পরস্পরকে চুম্বনরত পেলিকান কীর্ণ তাতে।
তারপর সবখানে ভাঙা বাহু ক্রস আর প্রাচীন বীরেরা সব সমাহিত দেয়ালে দেয়ালে, মিষ্টি ও আর্দ্র মঠে মঠে। সুবিশাল মৃত্যুর ছায়া চারিদিকে। কোনো কোনো অন্ধকার ছোট্ট প্লাজায় বেঁচে আছে সুপ্রাচীন আত্মা, তাদের ভেতরে প্রবেশ করলে যে-কারোর মনে হবে পঞ্চদশ শতকে অবগাহনের অনুভূতি। হলুদ পুষ্পিত ছাদ আর লম্বা বারান্দার দুই কি তিনটি ভবনের এই প্লাজাগুলো। দরজাগুলো বন্ধ কিংবা সেগুলো ভরে আছে ছায়ায়, কুলুঙ্গিতে বাহু ভিন্ন এক সাধু, আর ভয়কাতর চৌরাস্তা কিংবা প্রাচীরের কোনো এক দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে প্রান্তরের আলো। কেন্দ্রে বিধ্বস্ত পেডেস্টালের উপর এক ভাঙা ক্রস আর আলুথালু কিছু শিশু, সমগ্রের সাথে তারা বেমানান নয়। ধূসর গগন তলে এইসব, এবং নীরবে নদীর জল অবিরাম তরবারির সংঘর্ষের ধ্বনি তুলে যায়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন