অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
ঐশী সকালে ঘুম চোখে ঘড়ি দেখল, সকাল সাতটা। তাহলে এতক্ষন সে স্বপ্ন দেখছিল! বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিল। আয়নায় নিজের মুখ দেখে স্বপ্নের কথাটা আরেকবার ভাবল। ঐশীর বিয়ে হচ্ছে তনুময়ের সঙ্গে। স্বপ্নিল সেই বিয়েতে খুব খাটছে। বাড়ির কারোর আপত্তি নেই ঐশীর এই দ্বিতীয় বিয়েতে। এমনকি স্বপ্নিলও কোনো ঝগড়া করছে না। বাড়ি ভর্তি লোক সবাই খুব খুশি। শুধু ঐশী কেঁদে চলেছে। আর চিৎকার করে বলছে “আমার স্বপ্নিল আর তনুময় দুজনকেই চাই। দুজনকে ছাড়াই আমি বাঁচতে পারব না।”
ঐশী ব্রাশ করতে করতে ভাবল জীবনে এরকম একটা বিটকেল স্বপ্ন সে কোনোদিন দেখেনি। ঐশী যখন কলেজের ফিফথ সেমিস্টার। তনুময় তখন পাশের বাড়ির পিজিতে থাকত। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্টুডেন্ট। লাস্ট ইয়ার। ঐশীর সঙ্গে তনুময়ের তখন থেকেই সম্পর্ক। তারপর তনুময় এমটেক করতে খড়গপুর চলে যায়। তবুও ফোনে যোগাযোগ ছিল। ঐশী ততদিনে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে হিস্ট্রিতে এমে করবে বলে ভর্তি হয়েছে। বাড়িতেও ততদিনে ব্যাপারটা জানিয়েছে। যদিও তনুময়ের বাড়ি থেকে আপত্তি ছিল। এসবের মাঝেই তনুময় এমটেক শেষ করে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি পেয়ে গেল এবং তখনই তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না সেটাও জানালো।
সেই আপাদমস্তক ভালো মানুষের প্রেমে পড়ে ঐশী অনেক স্বপ্ন দেখে নিয়েছিল। শিবপুরের ফাঁকা পিজিরুমে মনের মিল থেকে শরীরের মিলও হয়েছিল। ঐশী কার্পণ্য করেনি। স্বপ্ন যখন ভাঙল, ভেবেছিল তনুময়ের মুখ জীবনেও দেখবে না। ঐশীর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। একমাত্র মেয়ের বিয়েটা দেখে যেতে চেয়েছিলেন। তাই কলকাতায় নামি সরকারি ব্যাঙ্কের পাত্রের সঙ্গে ঐশীর বিয়ে হয়ে যায়। ঐশীকে রূপ আর গুনের দিক দিয়ে অপছন্দ করার কারন ছিল না। অতীতের কথা ঐশী কিছুই লুকোয়নি। তনুময়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থেকে শারীরিক সম্পর্ক সব কিছুই খুলে বলেছিল।
স্বপ্নিল ক্যাফেটেরিয়ার শীতল হাওয়ার বিপরীতে বসে একটা কথাই বলেছিল “আমি কি আপনাকে একবারও প্রশ্ন করেছি আপনার পাস্ট নিয়ে? তাহলে নিজেকে এক্সপ্লেন করছেন কেন? অতীত সবারই থাকে। বর্তমানে বাঁচতে গেলে তাকে মাথায় চাপিয়ে ঘুরতে পারবেন না তো! আমারও একটা ছোট অতীত আছে। মোটা টেকো মানুষটা প্রতিবারই রিজেক্ট হয়েছে। আমি প্রায় বিয়াল্লিশবার ট্রাই করেছিলাম। সেই স্কুল লাইফ থেকে। কিন্তু একটাও পটেনি। আপনিও ইচ্ছে করলে রিজেক্ট করতে পারেন।”
ঐশী এমন নিপাট সহজ সরল কথা শুনে হেসে ফেলেছিল। “আপনি একজন ভালো মানুষ। আপনি বরং আমাকে রিজেক্ট করতে পারেন।” স্বপ্নিল কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলেছিল “আমার মাথায় কম চুল থাকতে পারে। কিন্তু আমি পাগল নই। হীরে পেয়ে কেউ হারাতে চায়? খালি আমাকে একটু মানুষ করে নেবেন। মা বাবা সেই ছোটবেলায় মারা গেছে। মাসির কাছে মানুষ। এখন অবশ্য আলাদা ফ্ল্যাটে থাকি। তবে আমি ভীষণ আগোছালো।”
ঐশী চুপ ছিল। স্বপ্নিল কেশে বলেছিল “নানা কাজের লোক আছে। সারাদিন ধরে ফ্ল্যাট গোছাতে হবে না। রান্নারও লোক আছে। আপনি চাইলে চাকরি করতে পারেন। খালি আমাকে একটু গুছিয়ে রাখতে হবে। খুব ভুলে যাই।”
ঐশী আর স্বপ্নিলের বিয়েটা ধুমধাম করে হয়ে গেল। ঐশী নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। ঐশীদের কমপ্লেক্স এর সামনে একটা ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি করে। এর মধ্যে কোল আলো করে শুভ এলো। ঐশীর সাত বছরের সংসার জীবন।
প্রায় ছমাস আগে তনুময় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। ঐশী একসেপ্ট করেনি। তারপর আজ হঠাৎ দক্ষিণ কলকাতারই একটি শপিং মলে তনুময়ের সঙ্গে দেখা। এতদিন পরেও একদম একরকম আছে। চিনতে অসুবিধা হয়নি। কোথাও যেন সেই পুরনো ভালোবাসার ঘ্রাণ ঐশীকে পিছনে টানতে থাকে। তনুময় এগিয়ে এসে বলে “চলো ফুডকোর্টে বসি। এক কাপ কফি অন্তত খেতে পারো।”
ঐশীর ইচ্ছে করছিল বলতে “তোমার সঙ্গে একমিনিটও আমি কাটাতে চাই না।” কিন্তু বলতে পারল না। লিফটে করে চারতলায় পৌঁছে কোনার দিকে একটা টেবিলে বসল।
তনুময় কফি নিয়ে এলো। সঙ্গে কুকিস। “ঐশী তোমার মনে হয় অনেক অভিযোগ আছে আমার প্রতি। কিন্তু সত্যি আমার কিছু করার ছিল না।”
ঐশী হাসল “না কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমি তোমার জন্যই একজন খুব ভালো মানুষ পেয়েছি। ধন্যবাদ স্বরূপ আজকের কফি আমার তরফ থেকে।” মনে মনে ভাবল, স্বপ্নে তনুময় অপ্রত্যাশিত ভাবে ঢুকে পড়লেও তার মনের অন্দরমহলে প্রতিটা জানলা দরজা শুধুমাত্র স্বপ্নিলের জন্যই খোলা।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন